Mystery Of Dream

মনে করুন,প্রচন্ড মাথাব্যাথা নিয়ে আপনি আপনার রুমে ঘুমিয়ে আছেন।হঠাৎ একটা দুঃসপ্নে ঘুম ভেঙে গেলে দেখলেন আপনি সাদা-কালো এক জগতে আটকা পড়েছেন।চারপাশে সব ঠিকই আছে।কিন্তু সবকিছুর রং সাদা-কালো।কেমন লাগবে আপনার?
.
ইয়ুৎসি চ্যাং ২৮ বছর বয়সী একজন তরুণ। বিগত কয়েকদিন ধরে সে একধরনের সমস্যায় ভুগছে। সে যাই সপ্ন দেখছে তাই সত্যি হয়ে যাচ্ছে।
আর তার সপ্নগুলোও উদ্ভট ধরনের। সে দেখলো এক অজানা অচেনা লোককে খুন করা হয়েছে। পরের দিন নিউজপেপারে সেই একই লোকের খুন হওয়ার খবর দেখে আশ্চর্য হয়ে যায় সে।
কিন্তু যে ভয়াবহ সপ্ন তার জীবন বদলে দিলো তার গল্পটা অন্যরকম।
.
ইয়ুৎসি তার এক কাজিনের সাথে রুম শেয়ার করে থাকে। সেদিন রাতে তার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা শুরু হয়। রাতের খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে সে। হঠাৎ সপ্নে দেখলো তার কাজিন ইয়ামো ঘুমের মধ্যেই তাকে ছুরি দিয়ে হত্যা করেছে।তার ঘুম ভেঙে যায়।কিন্তু ঘুম থেকে উঠার পরই তর চারপাশ বদলে যায়।সে দেখে সে ছাড়া আশেপাশের বাকিসব সাদা-কালো।সে রুম থেকে বের হয়ে তার কাজিনকে ডাকতে থাকে।দেখে তার কাজিন বাসায় নেই।সে বাসা থেকে বের হয়।দেখে বাইরের সব কিছুই সাদা-কালো।অবাক বিষয় রাস্তায় কোনো গাড়ি-ঘোড়া,মানুষজন কিছুই নেই।তবে চেনা পরিচিত দোকানগুলো সব আগের মতোই আছে।কিন্তু সেখানেও কোনো মানুষ নেই।প্রচন্ড ঘাবড়ে গেলো ইয়ুৎসি।তার ইচ্ছা হলো একটা পরীক্ষা করে দেখে।সে একটা গ্রোসারি শপে ঢুকলো।সেখান থেকে একটা চকলেট তুলে নিলো।চকলেট মুখে দেওয়ার পরেও কোনো স্বাদ পাওয়া গেলো না।একমাত্র সপ্নেই কিছুর স্বাদ,গন্ধ পাওয়া যায় না।সপ্নের জগৎই মূলত হয় রঙবিহীন।সে কী তবে সপ্নের জগতে আটকা পড়েছে?
সে তাড়াতাড়ি করে বাসায় ফিরলো।চোখ বন্ধ করে আবার ফিরতে চেষ্টা করলো বাস্তব জগতে।কিন্তু কিছুতেই পারলো না।সে চোখ বন্ধ করে নিজের বাবা-মাকে কল্পনা করলো যারা তার ছোটবেলাতেই মারা গিয়েছেন।কি আশ্চর্য! সে চোখ খুলে দেখলো তার বাবা-মা তার পাশে বসে আছে।তারা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।সে চাইলো তার মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিক।তখন তাকে অবাক করে দিয়ে তার মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।ইয়ুৎসি বুঝতে পারলো সপ্নের জগতে মানুষ যা চায় তাই হয়।তাহলে সে যদি আবার রঙিন জগতের সপ্ন দেখে তবে কী সে ফিরে যেতে পারবে?
.
সে চোখ বন্ধ করলো।সে ভাবতে লাগলো সে তার বিছানায় ঘুমিয়ে আছে।সেখানে সব রঙিন।সাথে সাথে তার ঘুম ভেঙে গেলো।সাথে প্রচন্ড মাথাব্যাথার যন্ত্রণা।তা নিয়েই সে উঠে গেলো কিচেনে।গিয়ে দেখলো তার কাজিন ইয়ামো একটা ছুরি নিয়ে তার ধার পরীক্ষা করছে।ইয়ুৎসি আঁতকে উঠলো। সপ্নে সে এটাই দেখেছে।সে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে পালিয়ে বেরিয়ে এলো।তখন রাত ২.৩০।সারাটা রাত সে পথে পথে ঘুরে কাটালো।দুই রাত রাস্তায় কাটালো।সঙ্গে কোনো টাকা-পয়সাও আনেনি।দুইদিন উপোস করে সারা শরীর ক্লান্ত তার।দূর্বল শরীর নিয়ে রাস্তার পাশে ফুটপাতে ঘুমিয়ে পড়লো ইয়ুৎসি।জেগে উঠলো সেই অপরিচিত সাদা-কালো জগতে।বিছানা থেকে উঠে বসলো ইয়ুৎসি।আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।সাদা-কালো আয়নায় নিজের রঙিন প্রতিবিম্ব বদলে গিয়ে হঠাৎ অন্যরূপ নিলো।চমকে উঠলো ইয়ুৎসি।এটা সে নিজে।ফুটপাতে শুয়ে আছে।কি বিভৎস অবস্থা।খোলা মুখের চারপাশে মাছি ভনভন করছে।কিছু লোক হেঁটে যাওয়ার সময় টাকা ফেলে দিয়ে যাচ্ছে।আশেপাশের ছিঁচকে চোরেরা সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।সে ফিরে যেতে চাইলো না।চোখ বন্ধ করে নিজের মাকে কল্পনা করলো।তার মা সোফায় বসে উলের সোয়েটার বুনছে।তাকে দেখেই মমতাময়ী হাসি দিলো।এই প্রথম ইয়ুৎসি মায়ের গলা শুনতে পেলো।তার মা বলছে,'তোমাকে ক্ষুধার্ত লাগছে।কিছু কি খাবে?'
ইয়ুৎসি মাথা নাড়লো।সে তার ইউনিভার্সিটির জন্য বের হলো।সেখানে গিয়ে সে যাকে যাকে দেখতে চাইলো সবাইকে দেখতে পেলো।সবার প্রথমে সে দেখতে পেলো মারিয়া ডি কোস্টাকে।মেয়েটাকে খুব ভালো লাগে ইয়ুৎসির।রূপালি ঘন লম্বা চুলের এই মেয়েটা তার চেয়ে জুনিয়র।ইয়ুৎসি চাইলো মারিয়া নিজে এসে তার সাথে কথা বলুক।আর সেটাই হলো।সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না।অবশ্য সবই তার চিন্তামতোই হচ্ছে।মারিয়া তাকে তার সাথে কফি খাওয়ার জন্য বলছে যেটা বাস্তবে কখনোই সম্ভব নয়।আফসোস সে মারিয়ার সোনালি চুল অনুভব করতে পারছে না।কারণ বাকি সবার মতো সেও সাদা-কালো।কিন্তু সে সেটা নিজের মতো কল্পনা করে নিয়েছে।ক্যাফেটেরিয়ায় ঢোকার পরপরই হঠাৎ তার নাকে এক বাজে গন্ধ এলো।নাড়িভুড়ি উল্টে এলো তার গন্ধে।মারিয়া হঠাৎ সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলো।তাকে আঁকড়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো,'তুমি ঠিক আছ?'
ইয়ুৎসি জানে এসব তার কল্পনা।তাই সেটা নিয়ে আর মাথা ঘামালো না।সে চোখ বন্ধ করে রঙিন জগতের কথা চিন্তা করতে লাগলো।কিন্তু এইবারে সে কিছুতেই ফিরে যেতে পারছেনা।নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হলো।দ্রুত বাসায় ফিরে গেলো।তার মা তার জন্য স্যুপ বানিয়েছেন।ইয়ুৎসি সেটাতে মনোযোগ না দিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।নিজের প্রতিবিম্বের জায়গায় ফুটে উঠলো হাসপাতালের বেডের ছবি।সেখানে সে শুয়ে আছে।পাশে দাঁড়ানো নার্স ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করছে।কিন্তু সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।তাহলে কী সে কোমায় চলে গেছে?সে কতদিন ধরে হাসপাতালে আছে?তাকে ভর্তিই বা কে করালো।সে কী কোমায় আছে নাকি?সে আবার চোখ বন্ধ করে তার আসল দুনিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করলো।কিন্তু পারলো না।হতাশ হয়ে বসে পড়লো সে।তখন তার মা এসে তার পাশে বসলো।তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।আশ্চর্যজনকভাবে এটা সে চিন্তা করেনি।এখন তার সপ্ন তার নিয়ন্ত্রণে নেই।অবচেতন মন দ্বারা তার সপ্ন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।হঠাৎ মারিয়া এসে তার রুমে ঢুকলো।তার মাও মারিয়ার সাথে পরিচিত লোকজনদের মতো হাসিমুখে কথা বলতে লাগলো।এর মধ্যেই হঠাৎ করে মারিয়ার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো।একসাথে কাটতে লাগলো কত সুখ-দুঃখের মূহুর্ত।তার মধ্যেই তাদের কোলজুড়ে এলো এক ফুটফুটে শিশু।তার নাম রাখা হলো জোসেফ।দিনের পর দিন যায়।কিন্তু তারা একই রকম রয়ে যায়।জোসেফকে কোলে নিয়ে ঘোরার দিন শেষ হয়না।হঠাৎ সে একদিন আয়নার সামনে দাঁড়ায়।নিজের সেই একই প্রতিবিম্ব।বরং আগের চেয়ে হাস্যোজ্জল।প্রতিবিম্ব মিলিয়ে গিয়ে সৃষ্টি হয় আরেক দৃশ্যপট।হাসপাতালের বেডে এখনো শুয়ে আছে সে।তবে আগের বেডে নয়।নতুন এক বেডে।অচেনা পরিবেশে।আগের সেই নার্সও নেই।এক মোটাসোটা হাসিখুশি নার্স দাঁড়িয়ে তার পালস রেট চেক করছে।এবার নিজের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো সে।বৃদ্ধ হয়ে গেছে সে!মাথার চুল পেকে গেছে।এত বছর সে কোমায় ছিলো!সে কী আর বাস্তব জগতে ফিরে যেতে পারবে না?হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলো তার।তার মনে হলো কেউ যেন তার নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে।হঠাৎ দমবন্ধ হয়ে সে মাটিতে বসে পড়লো।নিস্তেজ হয়ে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।
.
.
নার্স হেলেনা যখন থেকে এখানে কাজ করছে তখন থেকে এই রোগীকে দেখছে।আগে যারা কাজ করতো তাদের মুখে শুনেছে এই রোগীর সারাজীবন হসপিটালেই কেটেছে।প্রায় ৩০ বছরের মতো কোমায় এই রোগী।এর কোনো নাম-ঠিকানাই জানা যায়নি।তখন থেকেই এই রোগীর প্রতি এক গভীর মায়া কাজ করে হেলেনার।আজ তার দুঃখের দিন।কারণ আজ দুপুরের দিকে ২০১ নং কেবিনের এই রোগীর হার্টবিট বন্ধ হয়ে যায়।সে তার ছবি তুলে স্থানীয় পত্রিকায় ছাপায় যাতে কোনো না কোনো পরিচিত তার শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকতে পারে।পরের দিন সকাল ৯.০০টায় এক ভদ্রমহিলা হাসপাতাল কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেন।তার নাম মারিয়া ডি কোস্টা।তিনি ইয়েৎসু সম্পর্কে বিস্তারিত বলেন।ইয়েৎসুর পরিচিত আরো অনেকেই যোগাযোগ করে।হাসপাতাল কতৃপক্ষের অলসতার কারণে এতদিন কেউ এই রোগীর পরিচয় খুঁজে বের করতে তৎপরতা দেখায় নি।এইজন্য হেলেনা কিছুটা ক্ষুব্ধ।
.
ইয়েৎসুর শেষকৃত্যে মারিয়াসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলো।যেহেতু ইয়েৎসুর আত্মীয় স্বজন তেমন ছিলো না তাই আত্মীয়-স্বজনেরা কেউই আসেনি।কিছু কিছু জীবন এভাবেই শেষ হয়ে যায়।ইয়েৎসুর জীবনের সাথে সাথে শেষ হয়ে গিয়েছিলো তার রহস্যময় সপ্নজগতেরও। বেচারী মারিয়া।সে জানলোই না ইয়েৎসুর সপ্ন জগতের একটা বড় অংশ জুড়ে শুধু সে-ই ছিলো।


Writer:- Rittika Nandy