> নীল চিরকুট পর্ব ১, ৫ - ভালবাসার গল্প - গল্প - বাংলা লাভ স্টোরি - রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প - নৌশিন আহমেদ রোদেলা
-->

নীল চিরকুট পর্ব ১, ৫ - ভালবাসার গল্প - গল্প - বাংলা লাভ স্টোরি - রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প - নৌশিন আহমেদ রোদেলা

১.

গ্রীষ্মের তান্ডব শুরু হয়েছে মাত্র। আকাশে তেজস্বী সূর্য। রোদের তাপে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পিচ ঢালা রাস্তা, ফুটপাত। শাহবাগ জাতীয় গ্রন্থাগারের দ্বিতীয় তলার ফ্যানগুলো দ্রুত গতিতে ঘুরছে। চারপাশে পিনপতন নীরবতা। ভ্যাপ্সা গরমে ঘেমে নেয়েই চাকরির বই ঘাটছে বিভিন্ন বয়সের পাঠক। গ্রন্থাগারের একদম কোণার দিকে বিরক্ত ভঙ্গিতে বসে আছে নীরা। সামনে রাখা বইয়ের এক-আধ পাতা উল্টে পাল্টে দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

' তুই কি তোর পাগলামোটা বন্ধ করবি না নমু? এভাবে আর কতদিন? সহ্যের একটা সীমা থাকা উচিত। তোর কি বিরক্ত লাগে না?' 

নম্রতা জবাব দেয় না। সামনে থাকা চির পরিচিত  ফিলোসোফির বইটি আবারও উলটে পালটে দেখে। বইয়ের মলাটের নিচের দিকটায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নীরা এবার চেতে উঠে বলল,

' আর কতবার দেখবি এই বই? তিন বছর ধরে তো দেখছিস। কিছু পেয়েছিস?' 

নীরার উঁচু স্বরে কয়েক জোড়া বিরক্ত চোখ তাদের ওপর এসে পড়ল। নীরা ঝটপট গলার স্বর নিচু করল। চাপা ফিসফিসিয়ে বলল,

' নমু? পাগলামো করিস না। আজকালকার যুগে এমনটা শুধুই কল্পনা। কেন এতো সিরিয়াস হচ্ছিস বল তো? তিনটা বছরে কী থেকে কী হয়ে গিয়েছিস জানিস? একবার তাকিয়ে দেখেছিস নিজেকে? এটা ১৯১৯ নয় একটা ২০১৯। বুঝার চেষ্টা কর একটু।' 

নম্রতা জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়াল। হাতের বইটা নির্দিষ্ট জায়গায় খুব যত্ন করে রাখল। ডানহাতের আঙ্গুলগুলো দিয়ে খুব যত্ন করে ছুঁয়ে দিল বইটার গা। সাথে সাথেই বুকের ভেতর উথলে উঠল এক দলা কান্না। নম্রতা মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল। এদিকে ওদিক তাকিয়ে চোখের জল গড়ানো আটকাল। আর কত কাঁদবে সে? প্রতিটি দিন তো এমনই হচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তই তো নিঃশ্বাস আটকে আটকেই বেঁচে থাকছে সে। নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। নম্রতার কাঁধে আলতো স্পর্শ করে বলল,

' ক্লাস টাইম হয়ে গিয়েছে দোস্ত। এবার তো চল। আর কতক্ষণ থাকবি?' 

নম্রতা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

' হুম। চল।' 

কথাটা বলেও কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকে নম্রতা। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ফিলোসোফির ময়লা হয়ে আসা মলাটটির দিকে। তারপর ধীর, গম্ভীর পায়ে বেরিয়ে যায়। নীরা খানিক অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ছোট্ট বেলার উচ্ছল বান্ধবীটির এমন বদলে যাওয়া দেখে বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা করে উঠে। মনটা সেই অজ্ঞাত পুরুষের প্রতি ভয়ানক রাগে ফুঁসে ওঠে। পরমুহূর্তেই নিভে যায়। কে জানে? আদৌ সে পুরুষ নাকি কোনো মহিলা? 

ভার্সিটি ক্লাস শেষে রোকেয়া হলের দিকে হাঁটছিল নম্রতা আর নীরা। বরাবরের মতোই চুপচাপ নম্রতা নীরার গল্প ঝুড়ির নীরব শ্রোতা। নীরা ছোট থেকেই কম কথা বলা মেয়ে আর নম্রতা চঞ্চল। কিন্তু সেই ইন্সিডেন্টের পর অদ্ভুতভাবেই বদলে গেল সব। নম্রতার চঞ্চলতা শরৎ-এর শিউলির মতোই ঝড়ে পড়ল। দুই বান্ধবীর মধ্যে তৈরি হলো বিস্তর নীরবতা। সেই নিশ্চুপতা দূর করতেই ইন্ট্রোবার্ট নীরা নিজেকে প্রকাশ করতে শিখল। নম্রতাকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু নম্রতার আটকে থাকা মনটা আর সচল হলো না। হাজারও ব্যস্ততা আর হাসি-মজার মাঝেও এক চিলতে উদাসীনতা তার চোখে-মুখে দৃঢ় বসতি গেঁড়ে বসল। সেই দৃঢ় বসতিকে নাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কি নীরার আছে? রোকেয়া হলের প্রধান ফটকের কাছে আসতেই হঠাৎ-ই দাঁড়িয়ে পড়ল নম্রতা। নীরা নম্রতা থেকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিল। পিছন ফিরে ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

' কি রে? দাঁড়িয়ে পড়লি যে? কি হয়েছে?' 

নম্রতা জবাব না দিয়ে ফটকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটির হাতে দশ-বারোটা পাতলা নীল রঙের কাগজ। রোল করে ধরে রেখেছে হাতে। নীরা জবাব না পেয়ে নম্রতার দৃষ্টি অনুসরণ করে মেয়েটির হাতের দিকে তাকাল। তারপর নরম কন্ঠে ডাকল,

' নমু?' 

নম্রতা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে তাকাল। হাসার চেষ্টা করে বলল,

' কিছু না। চল।' 

নীরা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মাথা নাড়ল। নম্রতার গোপন রাখা অশ্রুগুলো যে আজও বেহায়ার মতো ঝড়বে তা বেশ বুঝতে পারছে নীরা। এমনটাই তো দেখে আসছে দিনের পর দিন। এক-দুই সপ্তাহ ঠিকঠাক যায় তারপর আবারও শুরু হয় নম্রতার ধুঁকে ধুঁকে কান্না। আচ্ছা? এতো বড় মেয়ের কি এতো আবেগ সাজে? নীরার আপ্লুত মস্তিষ্ক উত্তর দেয়, ছোট-বড় কি? মেয়ে মানেই তো আবেগের আঁটখানা। 

হলে পৌঁছে প্রয়োজনীয় কাজগুলো বেশ স্বাভাবিকভাবেই করল নম্রতা। গোসল-খাওয়া শেষ করে বিছানায় গা এলালো। বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার পর পরই উপলব্ধি করল, সে ভীষণ ক্লান্ত। শরীরের ভারটা বোধ হয় আর বয়ে চলা যাচ্ছে না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। বুকে জমিয়ে রাখা কান্নাগুলো উথলে উথলে উঠছে। নম্রতা ফ্যানের সুইচ অন করে আগাগোড়া কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়ল। ক্লান্ত চোখজোড়া বন্ধ করতেই বুকে অসহনীয় এক ব্যথা চিনচিন করে উঠল। নম্রতা হুড়মুড় করে উঠে বসল। টেবিলের ড্রয়ারে থাকা পুরোনো ডায়েরিটা বের করেই বুকে চেপে ধরল। গলাটা খানিক কাঁপছে তার। বোধ হয় কান্না পাচ্ছে। নম্রতা বিছানার সাথে লাগোয়া দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসল। চোখদুটো বুজে নিয়ে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল। ডায়েরিটাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরল বুকে। মনের কার্ণিশে ভেসে উঠল প্রায় চারবছর আগের অদ্ভুত সুন্দর দিনগুলোর কথা। তখন কতটা চঞ্চল ছিল নম্রতা! ২০১৫ সাল। মাত্রই কলেজে পা রেখেছে নম্রতা। দীর্ঘ সময় গার্লস স্কুলে কাটানো মেয়েগুলো যেমন কলেজে উঠেই পাখা মেলে দেয় আকাশে। ঠিক তেমনভাবেই পাখা ছড়িয়েছিল নম্রতা। ক্লাসে, বাইরে, বান্ধবীদের আড্ডায় দুষ্টুমিতে ছেয়ে গিয়েছিল সে। কিভাবে কিভাবে একদল ছেলে বন্ধুও জুটিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু কারো সাথেই তেমন একটা ঘনিষ্ঠতা হয়ে উঠে নি। উকিল বাবার দুই মেয়ের বড়জনই ছিল নম্রতা। ছোটবোন নন্দিতা তখন ক্লাস ওয়ানের গন্ডিতে পা দিয়েছে মাত্র। বাবার আদুরে হওয়ায় বাড়িতে তখন অবাধ স্বাধীনতা। সকালে কলেজের নামে বেরিয়ে সন্ধ্যা পাঁচটার আগে বাসায় ফিরে গেলেই সব দোষ মাফ। নম্রতারা তখন শাহবাগেই থাকত। তাদের ধানমন্ডির বাড়িটা কমপ্লিট হয় নি তখনও। সে বছরই বান্ধবীদের সঙ্গ পেয়ে জাহাঙ্গীরনগর থেকে শুরু করে রবীন্দ্র সরোবর চষে বেড়ানো হলো তার। বাসায় বেশ কয়েকবার জব্বর বকুনিও খেলো। 'ভালো মেয়ে'র পদবীটা সরে গিয়ে দুষ্ট, ফাজিল মেয়ের পদবীগুলোও সেবছরই পাওয়া হলো। এই দুষ্টুমি ভরা জীবনটাতে হঠাৎই একদিন ঘটনাপ্রবাহতা এলো। কলেজ ফাঁকি দিয়ে বান্ধবীরা গিয়ে বসল শাহবাগ জাতীয় গ্রন্থগারে। সেইসময় নম্রতা ব্যতীত বান্ধবীদের প্রায় সবারই বয়ফ্রেন্ড ছিল। নম্রতা প্রেম-ভালোবাসা পছন্দ করে না তেমনটাও নয়। বরং প্রেম নিয়ে নম্রতার ছিল অন্যরকম বিলাসিতা। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা সামনাসামনি প্রেম তো সবাই করে। নম্রতার ইচ্ছে সে 'চিঠি প্রেম' করবে। একদম সেই আগের যুগের মতো। সপ্তাহে একটা চিঠি পাওয়া। ধুরু ধুরু বুকে সেই চিঠি পড়া। বুক ভরা আবেগ নিয়ে চিঠি লেখা, অপেক্ষা করা। আরো কত কী! নম্রতার এমন উদ্ভট কথায় হেসে কূল পেত না নীরা। সেবারও তাই হলো। নীরা হাসতে হাসতে বলল,

' ধুর! এমনও হয় নাকি? ওসব শুধু কল্পনাতেই সম্ভব। এটা তোর মান্ধাতার আমল না দোস্ত। ২০১৫ সাল। এখন প্রথম দিন প্রেম করেই দ্বিতীয় দিনে বন্ধুদের ফাঁকা বাসা খুঁজে ছেলেরা। সেই যুগে এসে চিঠি প্রেম? তাও আবার না দেখে? ইম্পসিবল। ওমন ছেলে বাংলাদেশে ক্যান? এই পৃথিবীতে আছে কি-না সন্দেহ।' 

নম্রতা মুখ ফুলিয়ে বলল,

' একদম ফাউল আলাপ করবি না বলছি। প্রেম করতে হলে চিঠি প্রেমই করব। তবু না দেখে। একদম পুরাতন যুগের মতো। আমাদের যোগাযোগের শুধু একটা সোর্সই থাকবে তা হলো চিঠি। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ কিচ্ছু না। একটা চিঠি পাওয়ার আশায় ক্যালেন্ডারের দিন গুণবো। আর যখন সেই আকাঙ্ক্ষিত চিঠিটা পাবো তখন এক মুঠো স্বর্গীয় সুখ আছড়ে পড়বে আমার বুকে। ভাবতে পারছিস?' 

নীরা বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে তাচ্ছিল্য ভরে হাসল। মাথা নেড়ে বলল,

' পাচ্ছি। তুই যে দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছিস তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছি আমি। শোন দোস্ত, এগ্লা আগলা স্বপ্ন দেখা বন্ধ কর। এই আধুনিক যুগে এসে।  যোগাযোগের এতো এতো উপকরণ থাকা সত্ত্বেও কোনো ছেলে একটা চিঠি পাওয়ার আশায় বসে থাকবে না। আগে প্রেম করার আর কোনো রাস্তা ছিল না বলে চিঠি চালান হতো। এখন সেই সমস্যা নেই। যে জিনিসটা সহজেই পাওয়া যাচ্ছে তার জন্য এতো অপেক্ষা কেনো?' 

নম্রতা উৎসাহ নিয়ে বলল,

' তুই বুঝতে পারছিস না। সহজ জিনিস তো সবাই পায়। ভালোবাসা এতোটা সহজ হয়ে গিয়েছে বলেই তো এখন আর তার মূল্য নাই। প্রথমবার দেখা হলো। দ্বিতীয়বার দেখা হতেই বলে দিল 'আই লাভ ইউ'। মানে কোনো ফিলিংস নাই। বলতে হয় বলে বলছে। বলতে না হলে বলতো না। 'আই লাভ ইউ' শব্দটা যোগাযোগের সহজলভ্যতার জন্যই এতোটা ঠুনকো আর সস্তা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমার প্রেম হবে ইউনিক। চিঠিতে দু'জনের আবেগ থাকবে। অপেক্ষা থাকবে। এক চিঠিই বারবার পড়ার আকুতি থাকবে। তারপর ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে বন্ধন। যোগসূত্র।' 

নীরা হাতজোড় করে নিচু স্বরে বলল,

' আমারে ক্ষেমা দে মা। এইসব পাগলা আলাপ দয়া কইরা আর করিস না। মানুষ তোরে পাবনায় দিয়ে আইবো। জীবনটা সিনেমা না দোস্ত। তুই তো রীতিমতো বাংলা সিনেমা রচনা করে ফেলছিস।' 

নম্রতা ফুঁসে উঠে বলল,

' ঠাডাইয়া লাগামু এক চড়। তোর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে না করলে করিস না। জোর করছে কে? চিঠি প্রেম হবে কি হবে না তা আগেই কি করে বলিস তুই? আগে তো চেষ্টা করে দেখি নাকি?' 

নীরা সন্দিহান গলায় বলল,

' চেষ্টা? তা কী করে চেষ্টে করবি তুই?' 

নম্রতা দুর্বোধ্য হাসল। নোটবুক থেকে একটা নীল রঙের কাগজ টেনে নিয়ে বলল,

' এইভাবে।' 

নীরা বুঝতে না পেরে বলল,

' মানে?' 

নম্রতা জবাব দিল না। নীল কাগজের মসৃণ জমিনে একের পর এক অগোছালো শব্দগুচ্ছ সাজাতে লাগল। তার প্রথম সম্বোধনটা ছিল এমন, 

প্রিয়....!

তোমায় সম্মোধন করার জন্য চমৎকার কোনো শব্দ এই মুহূর্তে মাথায় আসছে না আমার। তাই সম্মোধনটা উহ্য রাখছি। তুমি তো জানো, নীরবতাতেই মিশে থাকে হাজারও আকুতি, হাজারো ভালোবাসা। তাই এই নীরবতা থেকেই নাহয় খুঁজে নাও সেই নাম। চমৎকার সেই সম্বোধন। যে সম্বোধনে কেঁপে উঠবে তোমার বুক। ঠোঁটে ফুঁটবে তৃপ্তির হাসি। আচ্ছা? তুমি-আমি দুজনেই কি এক? যদি একই হই তাহলে কি তোমার স্বপ্নগুলোও আমার স্বপ্নের মতো ধোঁয়াসে? ভীষণ অগোছালো এই মনটা কি হঠাৎ হঠাৎই ভীষণ অভিমানে আমার মতো আরো খানিকটা অগোছালো হয়ে যায়? আমার হয়। খুব করে হয়, জানো? হঠাৎ করে চমকে উঠি। হঠাৎ করেই কান্না পায়। বুকে ব্যাথা হয় তারসাথে অসহনীয় এক শূন্যতা। সেই শূন্য মনে খা খা দুপুর নেমে আসে কখনো বা নামে গাঢ় বর্ষা। দুপুরের প্রখরতায় পুড়ে তামাটে হয় এই মন। বর্ষায় হয় আপ্লুত.... রক্তেভেজা বাণ। বুকের কোথায় যেন তীক্ষ্ণ ব্যাথা হয়। অযথায় কান্নাগুলো গলায় এসে আটকে যায়। ছন্নছাড়া বাতাসে উড়ে চলে লম্বা চুল। উদাসী চোখদুটো বারবার পাতা ঝাপটায় কিন্তু অপেক্ষাটা ফুরায় না। মন বলে এইতো আসবে। এখনই তো সময়। কিন্তু...আসে না। কি আসে না? কেন আসে না?  জানি না। শুধু জানি অপেক্ষাটা ফুরায় না। এই অপেক্ষাটা বুঝি নির্বীক, অমর? এই অপেক্ষার হয়তো মৃত্যু নেই। আমি এই অপেক্ষাটার একটা নাম দিয়েছি, জানো? এই অপেক্ষাটার নাম হলো ---" Pain Of Expect" 

আমার ছোট থেকেই খুব ইচ্ছে একজন পত্র মিতা হবে আমার। একদম পুরাতন দিনের মতো। আচ্ছা? তুমি কি অনেক আগের যুগের চিঠি প্রেমের গল্পগুলো শুনেছ? সেখানে একটা চিঠিকে ঘিরে প্রেমিক-প্রেমিকার কত আবেগ, কত অনুভূতি থাকে দেখেছ? রোজ কারো চিঠির জন্য অপেক্ষা। কাঁপা কাঁপা বুকে সেই চিঠি পড়া। ঘুমহীন চোখ দুটো চিঠির পাতায় নিবদ্ধ করে প্রত্যেকটি অক্ষর বুকের মাঝে গেঁথে নেওয়া। ইশ! কী অনুভূতি! আজকালকার সহজলভ্য দিনগুলোতে এমন একজন দুষ্প্রাপ্য বন্ধু কি সত্যিই পাওয়া যায়? পাওয়া গেলে আমি পেতে চাই। খুব করে পেতে চাই জানো? প্রেম না হোক, শুধুই বন্ধুত্ব হোক। কেউ একজন আমার চিঠির অপেক্ষা করুক। চলতে থাকুক তার আমার নীল চিরকুটের গল্প। এই অাধুনিক জগৎ-টাতে সবার অগোচরে তুমি-আমি চিঠি দেওয়া নেওয়া করব। তুমি আমায় জানবে না। আমি তোমায় জানব না। চিঠিতে কোনো সম্বোধন থাকবে না। শুধু থাকবে এক আকাশ আবেগ, এক ঝুড়ি কথা আর ছোট্ট একটা আদুরে নাম। তারপর.....অনেক অনেকদিন পর যখন দু'জন দু'জনকে খুব করে চাইব। ঠিক তখন আমাদের দেখা হবে। বিষয়টা মজার না? 

হয়তো মজার, হয়তো নয়। তোমার কাছে মজার লাগছে কিনা বুঝতে পারছি না। তবে আমি তোমার চিঠির অপেক্ষায় রইলাম। সেই তুমিটা কে হবে জানি না। তবে এটুকু জানি সেই তুমিটা আমার 'সে' হবে। আজ এতটুকুই। 

ইতি 
শ্যামলতা 

চিঠিটা পড়ে নিয়ে চোখ কপালে তুলল নীরা। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,

' তুই সিরিয়াসলি চিঠি লিখে ফেললি?' 

' ফেললাম।' 

' এবার কি করবি?' 

' সেটা তো দেখতেই পাবি।' 

' তুই তো ফর্সা। তাহলে ইতি শ্যামলতা লিখলি কেন?' 

নম্রতা হেসে বলল,

' নামটা সুন্দর লাগে তাই।' 

কথা বলতে বলতেই পাশের সারি থেকে দর্শনের একটা মোটা বই নিয়ে তার মলাটের মাঝে চিঠিটা রেখে দিল নম্রতা। নম্রতার কাজে প্রথম দফায় স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে হেসে ফেলল নীরা। হাসতে হাসতে বলল,

' পাগল তুই? এখন লাইব্রেরিতে এসে ক'জন মানুষ বই পড়ে শুনি? যে যার মতো বই এনে যার যার বই পড়ে। এসব বই পড়ার সময় কই? তারওপর এই মোটা দর্শনের বই? মলাটের নিচে? কারো চোখেই পড়বে না তোর চিঠি। আর পড়লেও হাসতে হাসতে মরে যাবে।' 

নম্রতা হেসে বলল,

' মরলে মরল। বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের মাঝে একজন হাসতে হাসতে মরে গেলে দেশের অর্থনীতিতে ভয়ানক কোনো ক্ষতি হবে না।' 

নীরা হঠাৎ-ই গম্ভীর কন্ঠে বলল,

' আর যদি কোনো মেয়ে ফাজলামো করে?' 

নম্রতা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,

' চিঠি পড়েই বুঝতে পারব।'

সেদিন চিঠি রেখে এসে উত্তেজনায় ঘুম হলো না নম্রতার। নীরাকে ফোন দিয়ে বারবার জ্বালাতে লাগল। মনের মধ্যে ঘুরতে লাগল একটাই প্রশ্ন, কি হবে?  কি হবে? আদৌ কি কারো চোখে পড়বে?

২.

সারারাত উত্তেজনায় ছটফট করে ভোর চারটার দিকে ঘুমুতে গেল নম্রতা। কলেজে তখন ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে। পরীক্ষার আগের দিনের ক্লাসটা তখন ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ। সারা বছর টু টু করে ঘুরে বেড়ানো নম্রতাদের জন্য শীট, নোট কালেক্ট করার সেই এক মোক্ষম সময়। কিন্তু নম্রতার মাথায় পরীক্ষার চিন্তা খেলল না। পরীক্ষার প্রতি সেনসেটিভ নম্রতা গ্রীষ্মের ঝুম বৃষ্টি মাথায় করে কলেজে গেল ঠিক, কিন্তু দু'মিনিটও টিকল না। ক্লাসরুমের পেছন দরজা দিয়ে নীরাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনলো। বৃষ্টিতে আধভেজা হয়ে নয়টার দিকে শাহাবাগ গ্রন্থাগারে গিয়ে পৌঁছাল তারা। গ্রন্থাগার তখন মাত্রই খুলেছে। নম্রতা উত্তেজনা নিয়ে দ্বিতীয় তলার দিকে ছুট লাগাল। নীরা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল,

' এতোদিন আমার শুধু সন্দেহ ছিল। আজ প্রমাণ হয়ে গেল যে তুই মারাত্মক পাগল। কাল বিকেলে মাত্র চিঠি লিখলি। আজই উত্তর পেয়ে যাবি? তোর কি ধারণা? মানুষ তোর চিঠির জন্য হা-হুতাশ করে মরে যাচ্ছে?' 

নীরার কথায় নম্রতার উৎসাহ খানিক মিইয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কপাল থেকে বৃষ্টির পানি ঝাড়ল। কম্পিত হাতে ফিলোসোফির বইটা উঠিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। নীরা তাড়া দিয়ে বলল,

' কি রে? দেখ জলদি। এসেছে তোর চিঠি?' 

নম্রতা চাপা উত্তেজনা নিয়ে বলল,

' যদি না থাকে?' 

' যদি নয়। সত্যিই থাকবে না। সবাই তো আর তোর মতো পাগল নয় যে বই না পড়ে বইয়ের ভেতর চিঠি খুঁজে বেড়াবে। তবু দেখ। কথায় আছে, মনের শান্তিই বড় শান্তি।' 

নম্রতা মলাটের নিচে চিঠির খোঁজ করল। তার নিজের লেখা চিঠি ব্যতিত ভিন্ন কোনো চিঠি পাওয়া গেল না। নীরা গুজগুজ করে বলল,

' বলেছিলাম পাবি না। শুধু শুধু ক্লাসটা মিস করলি। স্যার নিশ্চয় কত্তকিছু দাগিয়ে দিয়েছে। পরশু পরীক্ষায় কী লিখব আমরা?' 

নম্রতা জবাব দিল না। বৃষ্টি ভেজা চুপসানো মুখ নিয়েই বাড়ি ফিরলো। অসময়ের বৃষ্টিতে ভেজায় পরের দিনই ভয়ানক জ্বরে কাহিল হলো। জ্বর আর পরীক্ষার চাপে চিঠির কথা বেমালুম ভুলে গেল নম্রতা। প্রায় এক সপ্তাহ পর, পরীক্ষা শেষে বান্ধবীদের সাথে ফুসকা খেতে বসে চট করেই মনে পড়ে গেল তার সেই নীল চিরকুটের কথা। ফুসকা ফেলে নীরাকে নিয়ে আবারও হাজির হলো গ্রন্থগারের বারান্দায়। ফুসকা ফেলে আসায় নীরা তখন মহা বিরক্ত। এই মাথা পাগল মেয়েটা তার বন্ধু হওয়ায় বিরক্তির বহরটা যেন আরও খানিকটা অতিরঞ্জিত। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের ওপর বিরক্ত হওয়া চলে না। এরা মানুষের বিরক্তি বা রাগকে যেমন পাত্তা দেয় না। ঠিক তেমনই অন্যকে সাহায্য করতে গিয়ে মান-প্রাণ সব হারালেও বিরক্ত হয় না। নম্রতা হলো সেই ধরনের মানুষ। তার ওপর বিরক্ত হওয়া সাজে না। নম্রতা এবারও আশাহত হলো। ফিলোসফির বইটির দিকে কিছুক্ষণ বিরক্ত ভরে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলল। মাথা নেড়ে বলল,

' চিঠির জবাব না এলে নাই। এই চিঠিটা এখানেই থাকুক। আমার আবেগময় সুন্দর চিঠিটা এই বইকে উৎসর্গ করলাম। চল, আজ তোকে ডাবল প্লেট ফুসকা খাওয়াব।' 

নীরা বিস্ময় নিয়ে বলল,

' ফুসকা খাওয়াবি মানে? তোর মন খারাপ লাগছে না?' 

' না, লাগছে না। আমাদের ছোট্ট জীবনটাতে ছোট্ট ছোট্ট বিষয় নিয়ে মন খারাপ করতে নেই। বাবা বলে, Life is a beautiful flower. We should feel it's fragrance. এই যে চিঠি বিষয়ক সুন্দর ঝামেলাটা হয়ে গেল? এটাও সেই বিউটিফুল ফ্লাওয়ারেরই অংশ। আই হ্যাভ টু ফিল ইট।'

নম্রতা সর্বদা প্রাণোচ্ছল, প্রাণোবন্ত মেয়ে। তার সতেরো বছরের জীবনে কখনোই তাকে দীর্ঘসময় চুপচাপ বসে থাকতে দেখা যায় নি। সবসময় ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি আটকে রাখা তার স্বভাব। অল্পতে উত্তেজিত হওয়া, অল্পতে খুশি হওয়া, প্রাণ খোলে হাসা আর আড্ডা জমানোর গুণে সে সর্বদাই আকর্ষণীয়া। নম্রতার স্বাভাবিক চরিত্র অনুযায়ী 'চিঠি' বিষয়ক ব্যাপারটাও তার মনে খুব একটা দাগ আঁকতে পারল না। পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব, দুষ্টামো আর পাগলামো ভরা জীবনে ওই ক্ষুদ্র চিঠিটা দীর্ঘক্ষণ জায়গা দখল করে রাখতে পারল না। নম্রতা চিঠির কথাটা বেমালুম ভুলে বসল। যথারীতি ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা শেষ হয়ে সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হলো। কলেজের সিনিয়র সিটিজেন হতে পেরে তারা তখন মহাখুশি। বান্ধবীরা মিলে হৈ-হৈ করে টিউশনি করা। ফুসকার দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেওয়া তখন নিত্য-নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠল। ঠিক এমন একটা সময়েই ঝড়টা এলো। এই মৃদু, শান্ত ঝড়েই এলোমেলো হয়ে গেলো নম্রতা। একদিন ইংরেজি টিউশনি শেষ করে শাহবাগ গ্রন্থাগারে গিয়ে বসল বান্ধবীরা। উদ্দেশ্য, নিরিবিলিতে ক্লাস নোট আর এসাইনমেন্ট কমপ্লিট করা। বান্ধবীরা সবাই নোট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেই নম্রতার অসচেতন চোখ দুটো ওই চির পরিচিত বইটির ওপর গিয়ে পড়ল। নিতান্ত কৌতূহল বশত উঠে গিয়ে বইটা তুলে নিলো সে। মলাটের নিচে নিজ হাতে লেখা নীল চিরকুটের খোঁজ নিতেই চমকে উঠল নম্রতা। নীল কাগজের পরিবর্তে সাধারণ সাদা কাগজে লেখা সম্বোধনহীন ছোট্ট এক চিঠি ওঠে এলো হাতে। সেখানে গুটি গুটি সুন্দর অক্ষরে লেখা,

' আপনি কি পাগল নাকি নিতান্তই কিশোরী একজন? পাগল বোধ হয় নন। আমার জানা মতে, পাগলেরা সাজিয়ে গুছিয়ে চিঠি লিখতে জানে না। কিন্তু কিশোরীরা জানে। যুবতীদের থেকে কিশোরীদের চিঠি লেখার গুণটা পাকা। তাদের মাথায় থাকা উদ্ভট চিন্তাগুলোও ভীষণ পাকা। যেমন আপনার এই চিঠি প্রেমের উদ্ভট ভাবনাটা! উদ্ভট বললাম বলে মন খারাপ করলেন? মন খারাপ করবেন না। এই ভাবনাটা সত্যিই উদ্ভট বৈ অন্য কিছু নয়। আজকের যুগে এসে এভাবে বন্ধুত্ব বা প্রেম করার সাহস কারো হবে বলে মনে হয় না। হয়তো মাথাতেও আনবে না। তবে মাঝে মাঝে উদ্ভট কিছু করতে খারাপ লাগে না। যেমনটা আমি করছি। আপনার এই উদ্ভট চিঠির উদ্ভট জবাব দিচ্ছি। আমার মতো মানুষ অজ্ঞাত এক কিশোরীকে চিঠি লিখছে তা আমার নিজের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না!' 

চিঠিটা এক নিঃশ্বাস দু-তিনবার পরে ফেলল নম্রতা। সারা শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে। প্রায় তিন সপ্তাহ পর সেই আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটা হাতে পেয়ে গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না তার। নম্রতা কিছুক্ষণ থম ধরে দাঁড়িয়ে থেকে লাফিয়ে উঠল। কয়েকজোড়া কৌতূহলী দৃষ্টি তার ওপর পড়তেই চাপা ফিসফিসিয়ে বলে উঠল নীরা,

' এই নমু? কি করছিস? সবাই দেখছে।' 

নীরার কথায় চারপাশের খেয়াল হলো নম্রতার। চারদিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হাসল। তারপর বই হাতে কোণার এক টেবিলে চেয়ার টেনে বসল। বুকের পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে হৃদপিণ্ড। তার  চিঠির জবাব এসেছে, এই সাধারণ কথাটা বিশ্বাস করতেই তার খুব বেগ পেতে হচ্ছে।  নম্রতা সাদা কাগজে লেখা চিঠিটা টেবিলের উপর মেলে রাখল। কয়েক মুহূর্তে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে আনন্দিত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নোট বুকের মাঝে ভাঁজ করে রাখা নীল কাগজটা টেনে নিয়ে লিখতে বসল। কিন্তু বিস্ময় নিয়ে উপলব্ধি করল, তার হাঁত কাঁপছে। মাথাটা ফাঁকা আর গোলমেলে লাগছে। মাথার ভেতর গোছানো, সুন্দর কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। নম্রতা দু'হাতে মুখ চেপে বসে রইল। মাথাটাকে একটু শান্ত করে লিখতে শুরু করল কয়েক লাইনের সম্বোধনহীন চিঠি, 

' আপনাকে কী বলে সম্বোধন করা যায় বলুন তো? প্রথমবার 'প্রিয়' সম্বোধন করেছিলাম। এবার সেই ভরসাটাও পাচ্ছি না। এভাবে 'আপনি' 'আপনি' সম্বোধন করে আমায় ঘাবড়ে দেওয়ার কোনো মানে হয়? আর সাদা পাতায় কেন লিখেছেন? নীল চিরকুট কি কখনো সাদা পাতায় লেখা যায়? নীল চিরকুট সবসময় নীল কাগজেই লিখতে হয় এটাই নিয়ম। আর নিচে ইতি ওতি কিছুই তো লেখেন নি। একটা চিঠিতে এতো এতো ভুল করা মানুষটি কি-না আমায় কিশোরী মেয়ের উদ্ভট চিন্তাভাবনার কারখানা বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, এ তো ভারি অন্যায়! 

ইতি 
শ্যামলতা ' 

লেখা শেষে দু-বার পড়ে নিয়ে চিঠিটা মলাটের ভাঁজে রেখে দিল নম্রতা। আর সাদা কাগজে লেখা চিঠিটা খুব যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দিলো। বাসায় এসে চিঠিটাকে ডায়েরির পাতায় আঠা দিয়ে লাগাল। চিঠির কোণায় দুটো লাল গোলাপের পাঁপড়ি লাগিয়ে তাতে লিখল, 'শ্যামলতা ও সে'। তারপর থেকে শুরু হলো নতুন চিঠির অপেক্ষা। কিন্তু অপেক্ষাময় দিনগুলো যেন আর কাটে না। কলেজ শেষে রোজ একবার গ্রন্থাগারে খোঁজ নেওয়ার পরও চিঠির সন্ধান মেলে না। অপেক্ষা করতে করতে নম্রতা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ল ঠিক তখনই দ্বিতীয় চিঠিটা এলো। নম্রতাকে দু-দুটো সপ্তাহ অপেক্ষা করিয়ে সাদা কাগজের মাঝখানে গুটি গুটি অক্ষরে দুই লাইনের একটা চিঠি লিখল অপরিচিত সেই 'সে'।  

' সত্যিই! এ তো ভারি অন্যায়। কিন্তু আমার যে নীল রঙা কাগজ নেই। এখন উপায়? আমাকে কি তবে চিঠি খেলা থেকে বহিষ্কৃত করা হবে?'  

সেই দুই লাইনের চিঠিই অসংখ্যবার পড়ল নম্রতা। প্রথম দিকটাই বিরক্ত হলেও পরমুহূর্তে বেশ লাগল। এই চিঠির জন্য অপেক্ষামান অনুভূতিই তো চাইছিল সে। এখন সেই আকাঙ্ক্ষিত অনুভূতির জন্য নিশ্চয় বিরক্ত হওয়া চলে না? নম্রতা অনেক ভেবে চিন্তে লিখল।

৩.

' না। আপাতত বহিষ্কার করা হচ্ছে না। তবে আপনার এই ভয়াবহ অপরাধের জন্য আপনাকে ভয়ানক এক শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তুমিময় শাস্তি। এই শাস্তিতে আপনি টাপনি নিষিদ্ধ নগরীর শব্দ। পত্রমিতাকে কেউ কখনো "আপনি" বলে সম্বোধন করেছে শুনেছেন কখনো? আচ্ছা? আপনাকে কি এখন বন্ধু বলে সম্বোধন করা যায়? অনেকটা আগের যুগের পত্রমিতার মতো? 

ছোটবেলায় দাদির কাছে পত্রমিতাকে ঘিরে অজস্র গল্প শুনেছি। আমার দাদাভাই আর দাদির সম্পর্কটা হয়েছিল মূলত চিঠি-পত্রকে কেন্দ্র করে। দাদি যখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে তখন "পত্রমিতালী" বলে একটা সংখ্যা ছিল। একদিন দাদির সই দুষ্টুমি করে সেই পত্রমিতালীতে দাদির নাম ঠিকানা দিয়ে দিল। কিন্তু সপ্তাহব্যাপী কোনো চিঠিপত্র এলো না। সেখান থেকে চিঠি না এলেও চিঠি এলো অন্য একটা ঠিকানা থেকে। দাদুর ভাষ্যমতে সেটা ছিল দাদাভাই কতৃক ভুল ঠিকানায় চিঠি। ভুল চিঠিতে কিন্তু কোনো রোমান্টিসিজম ছিল না। চিঠিটা ছিল দাদাভাইয়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয় মারা যাওয়ার দুঃসংবাদ বহন করা দুঃখী দুঃখী চিঠি। আমার দাদি ছিল অল্পবয়স্কা আবেগী মেয়ে। দাদাভাইয়ের দুঃখে সে এমনই ব্যথিত হলো যে, দাদাভাইয়ের ঠিকানায় আবেগমাখা সান্ত্বনাপত্র পাঠিয়ে দিল। তারপরই শুরু হলো চিঠিচালান ভালোবাসা। প্রায় একবছর পর, দাদাভাই ঢাকা থেকে রাজশাহী দাদুর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। সেই বিয়েতে ওকালতি করার জন্য নাকি ঘটককে বিস্তর টাকা খাইয়েছিলেন দাদাভাই। আপনি ভাবতে পারছেন? সেই এতো এতো বছর আগে চুপি চুপি প্রেম করে বিয়ে করে ফেললেন তাঁরা। কেউ সেই প্রেমের খবর জানল না। বুঝল না। ব্যাপারটা মজার না? আমি রং-নাম্বারে প্রেমের গল্প শুনেছি কিন্তু এভাবে চিঠি প্রেমের গল্প একদম নতুন। আচ্ছা? তাদের প্রেমটাকে কী নাম দেওয়া যায়, বলুন তো? রং-নাম্বারের সাথে মিলিয়ে রং-লেটার? 

বিঃদ্রঃ আপনি কিন্তু এবারও ইতিতে কিছু লেখেন নি। এবার আমি আপনাকে কী বলে সম্বোধন করি বলুন তো?

ইতি 
শ্যামলতা '

চিঠিটা লিখে বার কয়েক চোখ বুলাল নম্রতা। তারপর কম্পিত হৃদয়ে চিঠিটা রেখে দিল নির্দিষ্ট বইয়ের মলাটের নিচে। বাকিটা সময় সেই অপরিচিত 'সে' এর থেকে পাওয়া দুই লাইনের চিঠিটা হাতে নিয়ে থম মেরে বসে রইলো। নোট বুক আর এসাইনমেন্টের পাতাগুলো ফ্যানের কৃত্রিম বাতাসে চঞ্চল হয়ে উঠল। নম্রতার খুশির জোয়ার যেন তাদের মাঝে প্রাণ দিল। বাতাসের ঝাপটায় উলোটপালোট হতে লাগল পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। আনমনা নম্রতার কাছে বইয়ের পাতার উড়োউড়োর শব্দটাকে হঠাৎ-ই ভীষণ মাদকীয় বলে বোধ হতে লাগল। সেই সাথে মাথায় উঁকি দিয়ে গেল অদ্ভুত এক প্রশ্ন, ' আচ্ছা? পত্রমিতার 'সে' নামক লোকটা যদি টাক পড়া বৃদ্ধ কোন লোক হয়, তবে? বা রাস্তার কোনো ছাইপাঁশ বেয়াদব ছেলে?' মস্তিষ্কের করা যুক্তিসংগত প্রশ্নটা মনের কাছে খুব একটা পাত্তা পেলো না। সেই অপরিচিত মানুষটি যেমনই হোক সে যে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ তা বেশ বুঝতে পারছে নম্রতা। লাইনের ভাঁজে ভাঁজেই ফুটে উঠছে লোকটির প্রগাঢ় ব্যক্তিত্ববোধ। এটা কি শুধুই নম্রতার ভ্রান্ত ধারণা? হলে হোক। এই ভ্রান্ত ধারণা মেনে নিতেই যেহেতু ভালো লাগছে তাহলে এই ভ্রান্ত ধারণাতে কোনো সমস্যা নেই। মানুষের ছোট্ট জীবনটাতে কিছু কিছু ভ্রান্ত ধারণা থাকলে ক্ষতি নেই। ভ্রান্ত ধারণাকে বুকে আগলে ধরে খানিকটা খুশি আর খানিকটা স্বপ্ন দেখাতেও ক্ষতি নেই। 

পত্রপ্রণয়ের তৃতীয় চিঠিটা এবার দু'সপ্তাহের মাথাতেও হাতে পেলো না নম্রতা। প্রতিদিন কলেজ শেষে গ্রন্থগারের পরিচিত বইটিতে ডুব দিয়ে ব্যর্থ হয়েও খুব একটা মন খারাপ হলো না নম্রতার। বরং তার উচ্ছল প্রাণে জোয়ার এলো। ফুলে ফেঁপে উঠলো হাসি-তামাশাময় জীবন। অবসরে চিঠির জবাবে অপরিচিত ব্যক্তিটি কী কী লিখতে পারে সেই ভাবনায় আকন্ঠ ডুবে রইলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে চমৎকার এক রবীন্দ্র সংগীতও গেয়ে ফেলল নম্রতা। বিস্ময়কর ভাবে পুরষ্কার হিসেবে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'দূরবীন' বইটাও হাতে পেয়ে গেল। আহ! সেদিন নম্রতার কি আনন্দ। অল্পতে খুশি হয়ে যাওয়া নম্রতা সেদিন বান্ধবীদের পেছনে বিস্তর টাকা উড়াল। এক মাসের হাত খরচ আর জমানো টাকাগুলো শেষ করে মনের সুখে গান ধরল,

' তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে
আমায় শুধু ক্ষণেক–তরে।
আজি হাতে আমার যা–কিছু কাজ আছে
আমি সাঙ্গ করব পরে।
না চাহিলে তোমার মুখপানে
হৃদয় আমার বিরাম নাহি জানে,
কাজের মাঝে ঘুরে বেড়াই যত
ফিরি কূলহারা সাগরে॥' 

এই গানটা সেদিন ওই টাইম-টেবিলহীন অপরিচিত ব্যক্তিটিকে ভেবে গেয়েছিল নম্রতা। নীরার ভাষায়, সেই গানের মতো আবেগময় গান নাকি পৃথিবীতে দ্বিতীয়জন গাইতে পারে নাই। কথাটা শুনে প্রচুর হেসেছিল নম্রতা। তার দামফাটা, প্রাণখোলা হাসির মাঝেও সেই লোকটির ভাবনা উঁকি দিয়ে গেল মাথায়। পত্রপ্রণয়ের তৃতীয় চিঠিটা এলো ঠিক ষোল দিনের মাথায়। এবারও সম্বোধনহীন গুটি গুটি অক্ষরে লেখা চিঠি। কিন্তু এবার আর সাদা নয় গাঢ় নীল রঙা পাতার মাঝ বরাবর দুই থেকে তিন লাইনের ছোট্ট এক চিঠি। নম্রতা ভেবে পায় না এই লোক এতো ছোট চিঠি লিখে কিভাবে? এর মাথায় কি এতো এতো কথা কিলবিল করে না? এই লোকটা কি স্বল্পভাষী? উহু, নম্রতা তো তাকে কথা বলতে দেখেনি। শুধু লিখতে দেখেছে। তাই লোকটিকে স্বল্পভাষী বলা যায় না। লেখার সাথে মিলিয়ে স্বল্পলেখ্য বলা যায়। নম্রতা আবারও চিঠির ওপর ঝুঁকে পড়ল। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে গালের সাথে চেপে ধরে সুখী সুখী দৃষ্টিতে তাকাল। খোলা চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে উড়ে এসে আছড়ে পড়তে লাগল চিঠিতে। দুই-তিন লাইনের চিঠিটাই আনমনা হয়ে পড়তে লাগল নম্রতা। 

' "রং-লেটার লাভ স্টোরি! বাহ! ইন্টারেস্টিং তো। কিছু কিছু সম্পর্ক সম্বোধনহীন হলে মন্দ হয় না শ্যামলতা। আপনার-আমার সম্পর্কটা না-হয় সম্বোধনহীনই হোক। আর হ্যাঁ, আপনার দেওয়া শাস্তিটা আমি মাথা পেতে নিলাম। কোনো একদিন প্রয়োজন হলে সে শাস্তির সত্যিকার প্রতিফলন ঘটাব। তুমিময় শাস্তির আগে চিঠিগুলো একবার আপনিময় হোক।' 

এটুকু পড়েই খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠল নম্রতা। ছোট্ট একটু লেখাতে এতো আকর্ষণ কী করে ঢেলে দেয় এই লোক? লোকটির কাছে কি চিঠি-মাদক ধরনের কিছু আছে? নম্রতা প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়ে। সেই পত্রপ্রণয়ের স্বল্পলেখ্য মানুষটি যে মনে করে সাদার বদলে নীল কাগজে চিঠি লিখেছে তাতেই নম্রতার খুশি যেন আর ধরে না। তারমানে, লোকটিও সময় করে তার মতোই চিঠিগুলোর কথা ভাবছে? ইশ! বেঁচে থাকা এতো আনন্দের কেন? অপেক্ষাগুলো এতো মিষ্টি কেন? আনন্দিত নম্রতা এবার খুশিমনে চিঠি লেখায় মন দিল। নীল কাগজের মসৃণ জমিনে কিশোরী আবেগের ঘটটা যেন উল্টে দিল। এক-দু শব্দ করে লিখে ফেলল দীর্ঘ এক চিঠি,

' সম্বোধনহীন চিঠি! বাহ রে! সম্বোধনহীন চিঠি লিখলে কিভাবে বুঝবো আপনার আর আমার সম্পর্কটা ঠিক কেমন? আমরা কি বন্ধু নাকি জীবনপথে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া দু'জন আগুন্তকঃ মাত্র? 

আচ্ছা? আপনি কখনো জ্যোৎস্না আলোয় স্নান করেছেন? আমি ছেলেবেলায় একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম খুবই অদ্ভুত এক ছেলে জ্যোৎস্না রাতে ছাঁদের পাটাতনে লম্বালম্বি শুয়ে জ্যোৎস্না বিলাশ করতো। তার সারা শরীরময় জ্যোৎস্নার মিষ্টি আলো ঝলমল করতো। একদম সিনেমার জ্যোৎস্নার মতো নীল দেখাতো তার গোটা শরীর। মাঝরাতের ঠান্ডা, শান্ত ঝিরিঝিরে বাতাসে কেঁপে উঠতো ছেলেটির উসকোখুসকো চুল। আমারও খুব ইচ্ছে জ্যোৎস্না স্নান করার। কিন্তু আম্মুর জন্য হচ্ছে না। মেয়েদের তো একা একা ছাঁদে থাকা বারণ তাই। আচ্ছা?  আপনারও কি রাতে ছাঁদে উঠা বারন? যদি বারণ না হয় তাহলে একদিন গভীর রাতে জ্যোৎস্না স্নান করবেন। তারপর সেই পূঙ্খানুপুঙ্খ অনুভূতিগুলো আমায় জানাবেন। কি, জানাবেন তো? আমিও অবশ্য জ্যোৎস্না স্নান করব। কিন্তু সে তো অনেক দেরী। জ্যোৎস্না বিলাস সবসময় একা একা করতে হয়। তবে পাশে যদি প্রিয়তম কেউ থাকতে চায় তাহলে অবশ্য দু'জন থাকার নিয়ম আছে। কথায় আছে না? এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। কিন্তু দু'য়ের অধিক থাকলে কিছুতেই জ্যোৎস্না বিলাস হয় না। সেটা ইংরেজি কম্পোজিশন 'দি মুনলিট নাইট' হয়ে যায়। আমি তো ছাঁদে একা যেতে ভয় পাই তাই বরের জন্য অপেক্ষা করছি। বিয়ের পর বরের সাথে জ্যোৎস্না স্নান করব। সুন্দর টলমলে জ্যোৎস্না থাকবে সেদিন। বিশাল আকাশটিতে থালার মতো হলদেটে এক চাঁদ থাকবে। আমার গাঁয়ে থাকবে সাদা পাতলা এক শাড়ি। হাত ভরা লাল চুড়ি আর চোখ ভরা মায়াবী ঘন কাজল। ছাঁদের একপাশে একটি বেলীফুলের গাছ লাগাব সেখানে দু-একটা ঝড়া বেলীফুল ঝলমল করে ওঠবে। আমি খোলা লম্বা চুলগুলো ছাঁদের পাটাতনে ছড়িয়ে দিয়ে আকাশ দেখব। ঝিরিঝিরি বাতাসে আমার চুলগুলো উড়বে। বাতাসটা ভরে যাবে বেলীফুলের অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণে। আমার পাশে শুয়ে থাকা প্রিয়তম হাতে হাত রেখে আবেগভরা কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলবে, ''শুনছো জ্যোৎস্না রাণী? আমি তোমাকে মায়াবী জ্যোৎস্নার মতো ভালোবাসি।" আহা! স্বপ্নটা সুন্দর না? 

বিঃদ্রঃ আপনি কি ভূতে ভয় পান? ভয় বাতিক থাকলে আমায় জানাতে পারেন। আমি দারুণ সব সূরা জানি। ওগুলো শুনলে ভূত দৌঁড়ে পালাবে। 

ইতি 
শ্যামলতা '

চিঠিটা লিখে জোরে শ্বাস টানল নম্রতা। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে চিঠির দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবল, এমন সুপ্ত স্বপ্নের কথাগুলো কি এভাবে লিখে ফেলাটা ঠিক হলো? লোকটা আমায় কী ভাববে? পরমুহূর্তেই অস্বস্তিটা উবে গেল নম্রতার। মনে পড়ে গেল চির চিরন্তন বাক্য, একদম অপরিচিত মানুষ ছাড়া মনের সুপ্ত কথা প্রকাশ করে আরাম নেই। অপরিচিত মানুষ থেকে অনুভূতি নিয়ে কাটাছেঁড়ার আঘাত পাওয়ার ভয় নেই। তারা শুধু শুনে, ভাবে তারপর ভুলে যায়। তার পত্রমিতার 'সে' ও-তো তার অপরিচিত কেউই। ভীষণ অপরিচিত 'সে'। তার কাছে অনুভূতি প্রকাশে ভয় নেই। একটুও না।

৪. 

সন্ধ্যার আযান পড়ছে। দূরে কোথাও সুকরুণ সুরে সৃষ্টিকর্তার গুণব্যঞ্জন করছেন স্রষ্টার প্রেমে কাতর মোয়াজ্জেম। কন্ঠে তার মোলায়েম বিষণ্নতা। রোকেয়া হলে নম্রতার জন্য নির্দিষ্ট ঘরটির সফেদ পর্দাটা হালকা-মৃদু কাঁপছে। ঘরের ভেতর থাকা আলোটা টিম টিম করে জ্বলছে। জানালায় ভর করেছে একঝাঁক ফ্যাকাসে অন্ধকার। নম্রতা সেই বিকেল থেকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে। হাতে পুরোনো, জীর্ণ ডায়েরি। চোখদুটো বোজা। ফ্যানের বাতাসে শুষ্ক চুলগুলো উড়ছে। চোখ বোজে রাখা  নম্রতাকে দেখাচ্ছে গ্রীক দেবীদের মতো প্রসন্ন। নির্ভুল সুন্দর। ঠোঁটের কোণায় তৃপ্তির হাসি। নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। প্রথমে মৃদু স্বরে। তারপর গলার স্বর খানিকটা চড়া করে নম্রতাকে ডাকল,

' এই নমু? ঘুমুচ্ছিস নাকি? আজান পড়ছে। বসে বসে কেউ ঘুমায়?' 

নম্রতা চোখ মেলে তাকিয়ে স্বচ্ছ হাসল। কেমন সুখী সুখী দেখাল তার চোখ-মুখ। নীরা সন্দিহান কন্ঠে বলল,

' ঠিক আছিস?' 

নম্রতা জোরালো শ্বাস ফেলে বলল,

' অবশ্যই।' 

' মন ভালো?' 

নম্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে প্রশ্ন করল, 

' খারাপ থাকার কথা ছিল নাকি?' 

নীরা উত্তর দিল না। এতো বছরের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এখনই নম্রতার মন ভালো হয়ে যাওয়াটা উচিত কথা নয়। নীরা সন্দিহান কন্ঠে বলল,

' টিএসসিতে যাবি? অন্তু,রঞ্জন,ছোঁয়া,নাদিম সবাই আসছে টিএসসিতে। ব্যাপক আড্ডা হবে। চল না যাই।' 

নীরা অবাক চোখে তাকাল। দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটিতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল,

' পাগল? সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। অলমোস্ট সাতটা বাজে। এখন গেলে ফিরবি কখন? হল সুপার ধরে পেদাবে।' 

নীরা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বিছানায় বসল। কুটিল হাসি দিয়ে বলল,

' আরে ধুর! ওই মহিলার কী? আমি ম্যানেজ করে নেব। তবুও ঢুকতে না দিলে, আজ রাতটা ছোঁয়াদের বাসায় থাকব। সমস্যা কই?' 

নম্রতা ক্লান্ত কন্ঠে বলল,

' এতো কাহিনী করার কী দরকার দোস্ত? কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।' 

পরমুহূর্তেই উৎসাহ নিয়ে বলল,

'তুই কী জানিস? আজকের দিনে ওর থেকে চতুর্থ চিঠিটা পেয়েছিলাম আমি।'

নীরা হতাশ চোখে তাকাল। নম্রতার হাত টেনে ধরে বলল,

' অলরেডি তিনবার শুনে ফেলেছি বইন। আর না, প্লিজ। সবাই অপেক্ষা করছে। চল তো।' 

নম্রতা উঠে দাঁড়াল। বাসায় পরে থাকা প্লাজুর ওপর স্কার্ট পরে টপস বদলে নিল। চুলগুলো উঁচুতে খোঁপা করে চোখে-মুখে পানি ছিঁটাল। গলায় স্কার্ফ পেঁচিয়ে ব্যাগ হাতে নিতে নিতে বলল, 

' বড্ড জ্বালাস তুই। চল।' 

নীরা ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাচ্ছিল। নম্রতাকে ডায়েরিটা ব্যাগে পুড়তে দেখে বিরক্ত কন্ঠে বলল,

' সব জায়গায় এই ডায়েরি না নিলে চলে না তোর? মানুষ জামাইরেও এমনে চিপকাই ধইরা থাকে না। আর এটা রেডি হওয়া হইলো? একটু সাজগোজ কর।' 

নম্রতা হাসল। নীরার মাথায় চাটি মেরে বলল,

' আড্ডা মারতে যাচ্ছি, বিয়ে করতে নয়। আর সেজেগুজে কী হবে? যার জন্য সাজব সে-ই তো হাওয়া। একবার খালি পাই। আমার সাজের ধরন দেখতে দেখতেই মরে যাবে শালা।' 

নম্রতা মাথায় চাটি দেওয়ায় লিপস্টিক ল্যাপ্টে গালে গিয়ে লাগল নীরার। নীরা লিপস্টিক হাতে কিছুক্ষণ ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো বসে রইল। দাঁত কিরমির করে বলল,

' আল্লার ওয়াস্তে তোর সেই পত্রমানবকে যদি একবার খুঁজে পাই। কসম, আমি নিজেই খুন করব তারে। ব্যাটার যন্ত্রণায় জীবনটা ত্যানা ত্যানা হয়ে গেল। কত্ত কষ্টে মেকাপ করেছিলাম তোর কোনো ধারণা আছে?' 

নম্রতা খিলখিল করে হেসে উঠল। ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বলল, 

' তুই না সাজলেও অন্তু তোর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে। আয় জলদি।' 

নম্রতার কথাটা কানে যেতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল নীরা। পরমুহূর্তেই তীব্র অস্বস্তি নিয়ে বেরিয়ে গেল। সংকুচিত মনে একটা কথায় ভাবতে লাগল, এই একটা নাম শুনেই এতো লজ্জা  কেন পায় সে? অন্তু তো আলাদা কেউ নয়। রঞ্জন আর নাদিমের মতোই খুব কাছের একজন বন্ধু। তবে? 

  

রাত বেশি নয়। মাত্রই সন্ধ্যা নেমেছে আকাশে। কোলাহলে পরিপূর্ণ টিএসসিতে দুটো ব্রেঞ্চ দখল করে বসে আছে অন্তু, রঞ্জন, নাদিম আর নম্রতারা। সবার হাতেই গরম সমুচার প্লেট। ভ্যাপ্সা গরমেও পাশে রাখা ধোঁয়া ওঠা গরম চা। রঞ্জন সমুচায় কামড় দিয়ে গান ধরল,

' তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা 
মোর জানো না।
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা। ' 

নাদিম গিটারে টুনটান শব্দ তুলেই মুখ কুঁচকাল। শার্টের কলার ঝেড়ে বলল,

' শালার গরমের জ্বালায় বাঁচি না বাল। শইল জ্বইলা যাইতাছে।' 

ছোঁয়া কপাল কুঁচকে বলল,

' ভাষা ঠিক কর। এসব থার্ডক্লাস শব্দ আমার সামনে বলবি না।' 

ছোঁয়ার কথায় আকাশ থেকে পড়ল নাদিম।  বলল,

' আমি তোর ভাষার কোন বা....'

ছোঁয়া চেঁচিয়ে উঠে বলল,

' আবার!' 

নাদিম গলা পর্যন্ত উঠে আসা শব্দটা গিলে নিল। মুখ কুঁচকে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বিরবির করে বলল,

' তোর প্রফেসার বাপের খাইঁসটে জ্ঞান দেখাস সারাদিন। ভাল্লাগে না বাল। যা কইলাম না।' 

ছোঁয়া ফুঁসে ওঠে বলল,

' তুই আবার বললি। আর খাইঁসটে কী? ছিঃ বমি আসছে আমার। এতো বাজে কথা বলিস তুই!' 

ছোঁয়ার কথায় নাদিমের মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। মানে কী? এই মাইয়া বলে কী? সে কী এমন বলল যার জন্য তাকে বমি করে দিতে হবে? একটা সিম্পল কথা নিয়ে এতো লাফালাফি! কিভাবে পারে এই মেয়ে? এই মেয়েকে তো দিনে রাতে থাপড়ানো উচিত। অসহ্য! অন্তু সমুচায় কামড় দিতে দিতে উদাস কন্ঠে বলল,

' ওরে ছাড় তো।  রঞ্জন গান ধরবে। তুই সুর তোল। পুরাই ছ্যাকা টাইপ গান , বুঝলি? অর্নাস থার্ড ইয়ারে উঠেও যদি জুনিয়রদের প্রেমলীলা দেখেই বুড়া হতে হয় তাহলে এই জীবন রেখে লাভ কী? এই নমু? তোদের কী একটুও মায়া হয় না? বন্ধু সিঙ্গেল থাকতে থাকতে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। একটা মেয়ে টেয়ে তো খুঁজে দিতে পারিস, নাকি? স্বার্থপর।' 

নম্রতা সরু চোখে তাকাল। হাতের কাপটা পাশে রেখে ডান পায়ের জুতোটা খুলে নিয়ে বলল,

' জুতো দেখছস? মাইর না খাবার চাইলে স্বার্থপর বলবি না। এই তিন বছরে কম ট্রাই করছি? তোর তো কোনোটাতেই মন ভরে না।' 

অন্তু কিছু বলার আগেই লাফিয়ে উঠলো নীরা। আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা লক্ষ্য করে বলল,

' আশেপাশে বহুত মেয়ে আছে দোস্ত। তুই খালি চুজ কর। পটাই দেওয়ার দায়িত্ব আমাগো। যেমনেই হোক পটামু। যা।' 

অন্তু আহত দৃষ্টিতে তাকাল। সেই দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এদিক-ওদিক থাকা মেয়েদের নিয়ে পর্যালোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল নীরা। অন্তুর চোখে-মুখে ফুটে উঠলো হতাশার ছাপ। ভার্সিটির প্রথম বছর থেকে নীরার প্রতি দুর্বলতা প্রদর্শন করে আসছে অন্তু। সেই দুর্বলতা গত দু'বছরে জীবন-মরণ ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে কিন্তু নীরা নারাজ। প্রথম বছরটা নীরাকে উঠতে বসতে প্রোপোজ করেছে অন্তু। নিজের আত্মসম্মানের জলাঞ্জলি দিয়েও নীরাকে ভালোবাসতে বাধ্য করতে পারে নি। শেষমেশ, পরাজিত সৈনিকের মতো জিগ্যেস করেছে, কেন পছন্দ করিস না আমায়? কোনো কারণ তো অবশ্যই আছে। একাধিক কারণও থাকতে পারে। বল শুনি। অন্য কোনো মেয়ে পটানোর আগে দোষগুলো ঠিকঠাক করা যায় কি-না দেখি।' নীরা হাসিমুখেই উত্তর দিয়েছে, ' তুই আমার থেকে চার মাসের ছোট।' কথাটা শুনে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে ছিল অন্তু। নীরা কি তার সাথে মজা করছে? এমন একটা লেইম কারণে বার বার তাকে রিজেক্ট করা হচ্ছে? বিশ্বাস হয় না অন্তুর। নম্রতার গানের সুরে ঘোর কাটল অন্তুর। অতি সন্তপর্ণে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হাসিমুখে নম্রতার গানের আসরে মন দিল। নম্রতা তখন অন্তরা গাইছে। চোখ বোজে নিবিষ্ট মনে সুর তুলছে,

' আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
আমার দিনগুলো সব রং চিনেছে, তোমার কাছে এসে।
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
তুমি চোখ মেললেই ফুল ফুটেছে আমার ছাদে এসে,
ভোরের শিশির খুব ছোঁয়ে যায়,
তোমায় ভালোবেসে। 
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।' 

নাদিম আলতো হাতে গিটার বাজাচ্ছে। সবাই নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। আশেপাশের অনেকেই কান খাঁড়া করে শুনছে নম্রতার কিন্নরকণ্ঠী গান। গান শেষ করে চোখ মেলে তাকাল নম্রতা। দাঁত বের করে হেসে বলল,

' যা গাইলাম। এখন হলো?' 

কেউ জবাব দিল না। রঞ্জন অদ্ভুত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

' দোস্ত! তুই যে কী পরিমাণ মারাত্মক গাইছিস, বুঝতে পারছিস? এতো আবেগ কোথা থেকে আসে তোর গলায়? এর আগে তো এতোটা আবেগ দিয়ে গাস নি তুই। তবে? নতুন প্রেমে টেমে পড়ছিস নাকি?' 

নম্রতা হাসলো। হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বলল,

' ধুর! আমি আর প্রেম? পুরাতন প্রেমে মজে মজেই শেষ হয়ে যাচ্ছি। আর তুই বলছিস নতুন?' 

নাদিম চোখ বড় বড় করে বলল,

' পুরাতন প্রেম মানে কী? তুমি মামা ডুবে ডুবে জল খাও? আমাদের বলিস নি পর্যন্ত!' 

নীরা সমুচার কোণা চিবোতে চিবোতে বলল,

' কেন? ওর ছ্যাঁকা খাওয়া কাহিনি শুনিস নাই? আজকেও তো ওর মন ভালো করতেই আড্ডা বসালি। তবু জানোস না?' 

রঞ্জন অধৈর্য্য হয়ে বলল,

' ছ্যাঁকা যে খাইছে তা জানি। কিন্তু পুরা কাহিনি জানি না। তোর এতো আবেগের পেছনে যদি ওই একটা মানুষ থাকে। তাহলে আমি ওই মানুষ সম্পর্কে জানতে চাই। শুরুটা কিভাবে? আর শেষটাই বা কী?' 

সবাই উৎসাহ নিয়ে নম্রতার দিকে তাকাল। নম্রতা বুক ভরে শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,

' শুরুটা হয়েছিল চিঠি দিয়ে। পত্রপ্রেম বলতে পারিস।' 

অন্তু কপাল কুঁচকে বলল,

' কলেজে ক্লাসমেট ছিল তোর? সেইম ইয়ার? বইয়ে বইয়ে পত্র বিনিময় টাইপ কিছু?' 

নম্রতা হেসে বলল,

' নাহ্।' 

ছোঁয়া চশমাটা ঠিক জায়গায় ঠেলে দিয়ে বলল,

' হোয়াট ইজ পত্রপ্রেম গাইস?' 

নাদিম ফুঁসে ওঠে বলল,

' ওই এই ইংরেজের বাচ্চারে চুপ করতে বল। ছোঁইয়ার বাচ্চা। বেশি কথা বললে চড় খাবি। যতটুকু বুঝবি ততটুকু মন দিয়া শোন। কথার মাঝে বাম হাত ঢুকাবি না।' 

ছোঁয়া মুখ ফুলিয়ে বলল,

' আমার নাম ঠিক করে উচ্চারণ কর। আমার নাম ছুঁইয়া না ছোঁয়া। সুন্দর নাম।' 

নাদিম ধারালো গলায় বলল,

' ওই তোরে চুপ করতে বলছি না? ছোঁয়া! সুন্দর নাম! এই সুন্দরের কী বুঝোস তুই? তোর নামটা টোটালি ক্ষেত!' 

রঞ্জন ওদের থামিয়ে দিয়ে বলল,

' চুপ কর তো তোরা। নমুকে বলতে দে। তাহলে শুরুটা কিভাবে? কলেজ সিনিয়র ছিল? বা স্কুল সিনিয়র?' 

নাদিম কথা কেড়ে নিয়ে বলল,

' বা পাশাপাশি বাড়ি। প্রতিবেশী ভাইয়া ছাইয়া?' 

নম্রতা হেসে ফেলে বলল,

' ওসব কিছুই না।' 

অন্তু অধৈর্য্য হয়ে বলল,

' তাহলে দেখলি কেমনে?' 

' দেখি নি।' 

নম্রতার বলা ছোট্ট শব্দটা কানে যেতেই চোখ বড় বড় করে তাকালো সবাই। শুধু নীরা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগল। রঞ্জন কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলল,

' দেখিস নি মানে? না দেখে প্রেম হয়?' 

' হলো তো।' 

' আমি কিছু বুঝতেছি না। দেখিস নি তাহলে চিঠি পেলি কিভাবে? কাহিনীটা কী? স্পষ্ট কর তো।' 

নম্রতা ধীরে ধীরে কাহিনি বর্নণা করতে লাগল। তাদের তৃতীয় চিঠি প্রাপ্তির ঘটনা পর্যন্ত শুনেই আৎকে উঠল রঞ্জন। নাদিম চোখ কপালে তুলে বলল,

' এভাবেও প্রেম হয় নাকি? সত্যি ঘটেছে এমনটা?' 

রঞ্জন ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,

' আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। তারপর কী হলো? ব্যাটার চতুর্থ চিঠি কবে পেলি হাতে?' 

নম্রতা হালকা হেসে আকাশের দিকে তাকাল। ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে আঠায় লাগানো চতুর্থ চিঠির পৃষ্ঠাটা বের করল। বন্ধুদের দিকে এগিয়ে দিয়ে আবারও অতীতে ডুবলো। 

নম্রতার হাতে যখন চতুর্থ চিঠিটা এলো তখন কলেজে গ্রীষ্মের ছুটি। বাসা থেকে বেরুনো একেবারেই নিষেধ। টিউশনিগুলোতেও সাময়িক ছুটি জারি করেছেন স্যারেরা। বাইরে বের হওয়ার অজুহাতের ঘট ফাঁকা। নম্রতা দিন-রাত ভূতের মতো পায়চারি করে আর ভাবে, কলেজগুলো এভাবে বন্ধ রাখার মানে কী? বছরে হাফ সময় যদি গ্রীষ্মের ছুটিই থাকে তাহলে পড়াশোনাটা হবে কখন? নাহ্ সরকারি কলেজের এহেন দূর্দশা আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। গভীর রাতে বাবাকে ডেকে তুলে বা নীরাকে ফোন দিয়ে উঠিয়ে গম্ভীর কন্ঠে আলোচনা করে নম্রতা, 'এইযে এতো টাকা দিয়ে টিউশনি করছি। লাভটা কী হচ্ছে? বছরের বেশির ভাগ সময় তো স্যারেরা গ্রীষ্মের ছুটিই কাটিয়ে ফেলছেন। গরম তো বাসায় বসে থাকলেও করবে শশুর বাড়ি বেড়াতে গেলেও করবে। গরম হাওয়া খাওয়ার জন্য অন্যের টাকা মেরে স্যারদের শশুরবাড়ি বসে থাকার মানে কী? আমাদের বাপের টাকা কী নদীতে ভেসে এসেছে? আসে নি। তাহলে এতোকিছু সহ্য করা কেন? টাকা দিয়ে যেহেতু পড়ছি আমাদের উচিত প্রটেস্ট করা। হ্যাঁ কি না?' নীরা আর নম্রতার বাবা ঘুমে ঝিমুতে ঝিমুতে বলেন, 'হ্যাঁ। অবশ্যই। লেটস প্রোটেস্ট।' এভাবে প্রায় এক সপ্তাহ কাটিয়ে দেওয়ার পর ফট করেই একটা অজুহাত পেয়ে গেল নম্রতা। মাকে গিয়ে রঙিয়ে চঙিয়ে মিথ্যে বলে চলে গেল শাহাবাগ। দু'তলার নির্দিষ্ট বইটির মাঝে কাঙ্ক্ষিত চিঠিটাও পেয়ে গেল। নম্রতা উত্তেজনায় ছটফট করে চেয়ারে গিয়ে বসল। গুটি গুটি অক্ষরে লেখা চিঠিটির দিকে তাকিয়ে দম বন্ধ হয়ে এলো। চিঠির এক জায়গায় চোখদুটো আঠার মতো আটকে রইলো। চিঠিতে লেখা, 

' আপনার স্বপ্নটা খুব সুন্দর শ্যামলতা। আমার কাছে জ্যোৎস্না বিলাস, বৃষ্টি বিলাস বড্ড ছেলেমানুষী বলে মনে হয়। কারণহীন, অকারণ বলে মনে হয়। কিন্তু আপনার বর্ণনা আর উৎসাহ দেখে কোনো এক জ্যোৎস্না রাতে ছাঁদে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে। কাকতালীয়ভাবে আমাদের ছাঁদের কিনারায় একটি বকুল গাছ আছে। বকুলের সাথে আরো কিছু ফুল গাছ আছে। সবই আমার ছোটবোন নিদ্রার লাগানো। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো সেই ফুলগুলোর ঘ্রাণ আমার ঘর পর্যন্ত এলেও কখনো খেয়াল করা হয় নি। আপনার চিঠি পড়ার পর খেয়াল করলাম। আর সম্বোধনের কথা বলছিলেন। সম্বোধন কী কখনো সম্পর্কের নাম হয় শ্যামলতা? আমার তো মনে হয় না। মানুষ মাত্রই তো আগুন্তকঃ। জীবনপথে প্রত্যেকেই ক্লান্ত, অপরিচিত পথিক। তুমি আমিও এর ব্যতিক্রম নই। 

বিঃদ্রঃ আমি ভূতে ভয় করি না। যে জিনিসের অস্তিত্ব নেই তাতে ভয় কিসের? আর আপনি অতো সূরা জানলে রাতের ছাঁদে আপনারই বা অতো ভয় কিসের ম্যাডাম?' 

নম্রতা চিঠিটা বেশ কয়েকবার পড়ল। তার লেখা 'তুমি' শব্দটাই বুক জুড়ে খুশির জোয়ার বয়ে গেল। কেন জানি ওই 'তুমি' শব্দটুকুই নম্রতার ভীষণ ভালো লাগতে লাগল। নম্রতার খুশি অবশ্য বেশিক্ষণ টিকল না। নম্রতার বলা মিথ্যে নিয়ে বাড়িতে বিরাট দূর্দশা লেগে গেল। নম্রতা মাকে চুপিসারে বলেছিল,

' নীরাকে দেখতে এসেছে মা। আমি ওর বেস্টফ্রেন্ড হয়ে যদি না যাই। তাহলে ব্যাপারটা কেমন হয়ে যায় না?' 

নম্রতার মা উৎসাহ নিয়ে জিগ্যেস করেছিলেন,

'ছেলে কী করে?' 

নম্রতা ফট করেই বলে ফেলেছিল,

'এইতো জেলা জাজ।' 

নম্রতার বলা এই কথাটাই যেন কাল হলো। নম্রতার মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। নীরার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে জেলা জাজের সাথে? এতোবড় খবর কী চুপিসারে রাখা যায়? নম্রতা বেরিয়ে যেতেই পাশের বিল্ডিং-এ থাকা নীরার খালার কাছে কথা চালান করলেন নম্রতার মা। ভীষণ বিনয়ী আর আনন্দিত কন্ঠে জিগ্যেস করলেন, 

' আপা? নীরার নাকি জেলা জাজের সাথে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। মাশাআল্লাহ। শুনে ভীষণ ভালো লেগেছে।' 

নম্রতার মায়ের কথায় নীরার খালার মাথাতেও আকাশ ভেঙে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিলের মতো ছোট্ট ঘটনাটা তালের মতো বৃহৎ আকার ধারণ করলো। নীরা আর নীরার মা ঘটনা শুনে হতভম্ব চোখে-মুখে বসে রইলেন। নম্রতার মিথ্যেটা খুবই ভয়ানকভাবে ধরা পড়ে গেল। এটুকু শুনে হু হা করে হেসে উঠল নম্রতার বন্ধুরা। রঞ্জন বলল,

' তুই তো সেইরকম বলদ ছিলি ছোটবেলায়। তারপর কী হয়েছিল? কেমন বাঁশ খেয়েছিলি? চিঠিপ্রেমের কাহিনী ফাঁস হয়ে গিয়েছিল নাকি তখন?' 

০৫.

নম্রতা হাসলো। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল,

' বলদ ছিলাম না। তবে এভাবে ধরা খেয়ে যাব চিন্তাও করিনি কখনো।' 

অন্তু শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে কলার ঠিক করলো। ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলো,

' তারপর কী হলো? এই বাঁশেই প্রেমিক পুরুষের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার হয়ে গেল তোর?' 

নম্রতা মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বলল,

' আরে ধূর! তখন উদ্ধার হলে কী আজ এই অবস্থা হয় আমার? চরম বাঁশ খাওয়ার পর কিছুদিন চুপচাপ ছিলাম। তবে, আমাদের প্রেমটা মূলত সেখান থেকেই শুরু। প্রেম নয় হয়তো বন্ধুত্বের শুরু। তখন থেকেই ধীরে ধীরে পাল্টে যায় আমাদের চিঠির ধরন।' 

' বাপরে! তো এতো প্রেম হঠাৎ উবে গেলো কীভাবে?' 

নাদিম অবাক কন্ঠে বলল,

' তুই সত্যি সত্যিই এই চিঠি-পত্রের সাথে প্রেম করে ফেললি? মানে, সত্যিই? ওই ব্যাটা যদি বুইড়া, টাকপড়া বা গাঞ্জা খোর হতো তো? ব্যাটার নাম কী?' 

নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

' জানি না।' 

নীরা ব্যতিত বাকী সবাই চেঁচিয়ে উঠে বলল, 

' জানিস না মানে? তুই ওই ছেলের নামটা পর্যন্ত জানিস না? তোকে আমরা এতোটা বলদও ভাবি নি। তোর মতো বুদ্ধিমতি মেয়ে এমন বলদামো কেমনে করল?' 

নম্রতা নিরাশ চোখে নিজের পায়ের দিকে তাকালো। ক্লান্ত গলায় বলল,

' কখনো জিগ্যেস করা হয় নি। দু'জনের কেউ-ই প্রয়োজনবোধ করি নি। তবে কথায় কথায় একবার বলেছিল, তাদের পরিবারের সবার নামের প্রথম অক্ষর নাকি 'এন' দিয়ে শুরু। অদ্ভুতভাবে, একদম দাদার বাবা থেকে 'এন' রীতি চলে আসছে তাদের। সে হিসেবে ওর নাম 'এন' লেটার দিয়েই হওয়ার কথা।'

ছোঁয়া বোকা বোকা গলায় বলল,

' "এন" দিয়ে তো বাংলাদেশেই অসংখ্য নাম আছে। কিভাবে বুঝবি কোনটা ওই লোকের নাম? আমাদের নাদিমের নামও তো 'এন' দিয়ে। এই নাদিম? তুই কিছু করিস নি তো?' 

নাদিম অত্যন্ত বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকাল। ধমকে উঠে বলল,

' তোরে আল্লায় মুখস্থ করার গুণ ছাড়া আর কিছু দেয় নি। তোর আই কিউ মাইনস জিরোর থেকেও কম। বালের কথা বলে অলওয়েজ।'

ছোঁয়া ফুঁসে ওঠে কিছু বলবে তার আগেই উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো রঞ্জন,

' ছেলে কই পড়তো জানিস? প্লিজ এবার এটা বলিস না যে, ওই ব্যাটা কই পড়াশোনা করত সেটাও জানিস না তুই।' 

নম্রতা অপরাধী চোখে তাকিয়ে থেকে চোখ নামাল। রঞ্জন আৎকে উঠে বলল,

' তারমানে তুই সত্যিই জানিস না?' 

নাদিম হাত উল্টে হতাশ কন্ঠে বলল,

' ওই পোলায় যে পড়াশোনা করত তারই বা কী গ্যারেন্টি আছে? আমার তো মনে হচ্ছে ওইটা কোনো পোলাই না। মাইয়া মানুষ ফাইজলামো করছে।' 

নম্রতা ব্যস্ত গলায় বলল,

' একদমই না। কোনো মেয়ে শুধু মজার ছলে গোটা আড়াই বছর নিয়ম করে চিঠি চালান করবে না। তাছাড়া, চিঠিতে থাকা আমাদের অনুভূতিগুলো সত্য ছিল। তোদের বোঝাতে পারছি না। তোরা ঠিক বুঝবি না। কিন্তু আমি বুঝি, আপাতত সেই সময়টাতে সে আমাকে ভালোবাসতো। কখনো কখনো আমার থেকেও বেশি ভালোবাসতো। আর ও তখন স্টুডেন্টই ছিল। ঢাকারই কোনো ভার্সিটিতে পড়তো তখন। 

অন্তু ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

' তুই কী করে জানলি? আন্দাজই?' 

নম্রতা অন্তুর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আন্দাজই তো নয়। বিশ্বাসে। নম্রতার বিশ্বাস চিঠিতে লেখা একটা কথাও সে মিথ্যে লিখে নি। সে মিথ্যে বলতে জানে না। 

তখন বর্ষার মাঝামাঝি। নম্রতাদের চিঠি দেওয়া-নেওয়ার বিষয়টি তখন সপ্তাহে গড়িয়েছে। কখনো বা সপ্তাহে দুটো। শ্যামলতা ও সে- এর মাঝে তখন প্রেম না চললেও চলছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। সম্বোধনের আপনি লেখা জায়গাটাতে তখন তুমিময় রাজত্ব। নম্রতার মাত্রই প্রি-টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বর্ষার ঝুম বৃষ্টিতে বাইরে যাওয়া বারণ। নম্রতারা তখন তাদের  ধানমন্ডির নতুন বাড়িটিতে থাকে। শাহবাগ থেকে ধানমন্ডির দূরত্ব খুব বেশি না হলেও এই বিশ্রী বর্ষাকালে অযথা জল-কাদা এক করার কোনো কারণ নেই। অন্তত মায়ের চোখে তো নেই-ই। সেই সময়টুকু ঘরে বসে পরীক্ষার শীট মুখস্থ করে, গলা ছেড়ে গান গেয়ে, পুরোনো চিঠিগুলো পড়ে আর নিরন্তর ঝড়ে পড়া বৃষ্টিকন্যাদের নৃত্য দেখেই কেটে যায় নম্রতার। প্রি-টেস্ট পরীক্ষার পর এক সপ্তাহ জ্বর আরেক সপ্তাহ মায়ের কড়া ইন্সট্রাকশনের কারণে শাহবাগে যাওয়া হয়ে উঠলো না নম্রতার। তাদের উত্তাল চিঠি আদান-প্রদানে ভাটা পড়ল। প্রায় দুসপ্তাহ পর কলেজ আর টিউশনিতে যাওয়ার অনুমতি পেয়েই শাহবাগে ছুটে গেল নম্রতা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেদিন ছিলো শনিবার। গ্রন্থাগারে ছুটির দিন। নম্রতার আর চিঠি পাওয়া হলো না। মন খারাপ নম্রতা মাঝরাতে ওঠে চিঠি লিখতে বসলো, 

' শুনো, 
আজ আমার মনটা খুব খারাপ। এত্তো কাঁদতে ইচ্ছে
করছে কী বলব! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কী জানো? আমার মন খারাপের নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। ভীষণ অগোছালো চিন্তা আজ মাথা জুড়ে। মানুষের বোধহয় বেঁচে থাকার জন্য সত্যিই একটা ভালোবাসার মানুষ প্রয়োজন, তাই না? যে মানুষটি শুধু আমার হবে। যাকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাড়া করবে না। পৃথিবীর যেকোনো কোণায়, যেকোনো পরিস্থিতিতে থেকেও জানব আমার একজন মানুষ আছে। আমারই থাকবে। আমার কিশোরী মনটা যখন ভয়ানক মেঘে ঢেকে যাবে তখন আমি জানবো ওই মেঘগুলোর আড়ালে আমার নিজস্ব এক সূর্য আছে। নিজস্ব এক পুরুষ আছে। তাহলে আর কষ্ট করে পড়াশোনা করা লাগতো না। প্রি-টেস্ট পরীক্ষাটা যা খারাপ হয়েছে। টেস্ট দিতে দেবে বলে মনে হচ্ছে না। এই দুঃখ-কষ্টময় জীবন দিয়ে কী হবে বলো তো? বাবা-মা তো বিয়ের কথাও ভাবছে না। ধূর! কিচ্ছু ভালো লাগছে না। 

[ বিঃদ্রঃ এতোদিন পর চিঠি পেলে। এই দিনগুলোতে মনে পড়েছিল আমায়?] 

ইতি 
শ্যামলতা '  

এবারের চিঠির জবাবটা দু'দিনের মাথাতেই হাতে পেয়ে গেল নম্রতা। প্রথম দফায় বিস্মিত হলেও পরমুহূর্তেই খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠলো। মনে মনে ভেবে নিলো, সেই মানুষটি হয়তো তাকেই ভাবছিল। তার চিঠির জন্যই ছটফট করছিলো নয়তো এতো তাড়াতাড়ি চিঠি পাওয়ার ভাগ্য কী নম্রতার হতো? নম্রতা চিঠি নিয়ে ফিরে গেল বাসায়। পুরোটা সময় অদ্ভুত এক উত্তেজনা চেপে থাকল বুকজুড়ে । না-জানি কী আছে চিঠিতে! কী লিখেছে ওই অদ্ভুত লোকটি? নম্রতা বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে দরজা দিয়ে চিঠি খুললো। সাথে সাথেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো গুটি গুটি অক্ষরে লেখা আনন্দময় শব্দগুচ্ছ গুলো। চিঠির অদ্ভুত সুন্দর শব্দগুলো মিলেমিশে তৈরি হয়ে গেল কাল্পনিক এক পুরুষালি মুখমন্ডল। গম্ভীর মুখভঙ্গিতে ধীরে ধীরে কথা বলছে সে। কথার মাঝে হাসছে। সেইসাথে হাসছে তার সুন্দর দুটো চোখ। 

' শ্যামলতা, 
তুমি এতো পড়াচোর কেন, বল তো? তোমার লাস্ট চিঠিটা পড়ে কত্ত হেসেছি কোনো ধারণা আছে তোমার? প্রথম দফায় ভাবলাম বাচ্চা মেয়েটার এতো কষ্ট দূর করতে একটা নিজস্ব পুরুষ মানুষ কিনে দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু শেষটা পড়ে তো আমি হতভম্ব। ম্যাডাম যে পরীক্ষার ভয়ে পুরুষ মানুষ চাইছে সে তো আমার কল্পনারও বাইরে ছিল।তবে, আমি কিন্তু পড়াশোনা ফাঁকি একদম পছন্দ করি না। আমি নিজেও ভীষণ পড়াকু তাই চাই আশেপাশের মানুষগুলোও ভীষণ পড়াকু হোক। আমার ইচ্ছে কী জানো? আমার ইচ্ছে আমাদের ভার্সিটিরই টিচার হিসেবে জয়েন দেওয়া। আমার বাবার ইচ্ছেটাও ছিল তাই। কিন্তু টাকা-পয়সার অভাবে বাবার ইচ্ছেটা আর পূরণ হয়ে উঠে নি। ভাইয়াও বাবার স্বপ্নটাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয় নি। তাই টিচিং প্রফেশনের দিকে না ঝুঁকে নিজের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে। এখন আমি আর নিদ্রাই বাবার একমাত্র ভরসা। নিদ্রা কিন্তু তোমার মতোই পড়াচোর। পড়াশোনা নাকি তার মাথার ওপর দিয়ে যায়। আমাকে বলে, আমি নাকি রসকষহীন রোবট মানব। যার ভেতর শুধু একটাই সফটওয়্যার। পড়ো, পড়ো এবং পড়ো। কিন্তু তোমার কাছে এসে ব্যাপারটা ভিন্ন। আমার পৃথিবীতে হাতেগুণা মানুষদের মাঝে তুমি একজন যে আমার বাইরেটা নয় ভেতরটা জানে। মস্তিষ্কের বাইরেও আমার যে একটা মন আছে তা তোমার সাথে কথা না হলে হয়তো ঠিকঠাক প্রকাশ পেতো না শ্যামলতা। এই যে তুমি পড়াশোনায় টালবাহানা করো। আমার কী মনে হয় জানো? মনে হয়, তোমার সাথে এমনটাই মানায়। তোমাকে ঠিক এমনটাই হওয়া উচিত। তোমার প্রাণোবন্ততার সাথে তো এমনটাই সাজে। তাই বলে, পড়াশোনায় অবহেলা কিন্তু ঠিক নয়। মেয়েদের তো আরো নয়। তোমার না দেশ ঘুরে-বেড়ানোর শখ? পড়াশোনা না করলে সেই দেশ ঘোরাটা কী আদৌ হয়ে উঠবে? তোমার সেই নিজস্ব পুরুষ মানুষ যে তোমায় সেই স্বাধীনতাটুকু দিবেই দিবে। তারই বা কী গ্যারেন্টি আছে? তাছাড়া নিজেকে শিক্ষিত, মার্জিত, আত্মবিশ্বাসী আর স্বাবলম্বী ভাবতেও তো অন্যরকম অনুভূতি হওয়ার কথা। আমার তো হয়। তোমার স্বাবলম্বী হতে ইচ্ছে করে না? কোনো এক ঘরের কোণায় সংসারের যাতাকলে পিষ্ঠ হয়ে থাকা শ্যামলতাকে ভাবলেই তো দমবন্ধ লাগে। তোমার লাগে না? 

বিঃদ্রঃ তোমায় মনে পড়েছে কি-না জানি না। তবে বেশ কিছুদিন যাবৎ হঠাৎ-ই আমার ঘরে বেলীফুলের সুবাস আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আজ আবার আসছে। বেলীফুলরা হয়তো জেনে গিয়েছে, আজ আমার খুশি হওয়ার দিন! ' 

সেই দমবন্ধ করা শেষ লাইনগুলো পড়ে বিস্ময়ে, আনন্দে কেঁদে ফেললো নম্রতা। আর সেদিন থেকেই পড়াশোনার প্রতি আলাদা দৃষ্টি তৈরি হলো তার। মাথায় খেলে গেল একটাই কথা। সত্যিই তো? পড়াশোনা করে স্বাবলম্বী না হলে কী করে চলবে তার? তার এতো এতো স্বপ্নগুলোকে পাখা দিতে ঠিকঠাক পড়াশোনা করা তো চাই-ই চাই। তাছাড়া তার 'সে' যে পড়তে ভালোবাসে। সে- এর ভালোবাসার জিনিসে নম্রতার এতো উদাসীনাতা মানায়? কক্ষনো না। 

' বাপরে! এদিক বিবেচনা করলে ওই ব্যাটাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া যেতেই পারে। এক চিঠিতেই তোকে ঢাবির স্টুডেন্ট বানিয়ে ছেঁড়ে দিলো? এটা একটা কাজের কাজ হয়েছে। ব্যাটা হিপনোটিজম ভালো পারে। গুড!' 

অন্তুর কথায় ঘোট কাটলো নম্রতার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসার চেষ্টা করলো। রঞ্জন হাতে থাকা কাগজের টুকরো দিয়ে বাতাস করতে করতে বলল,

' ব্যাটা বলল, সে ভার্সিটির টিচার হতে চায় আর তুই মেনে নিলি? মিথ্যাও তো বলতে পারে। পারে না?' 

নাদিম চিন্তিত কন্ঠে বলল,

' পোলায় সত্যি বললেও এতো অল্প ইনফরমেশনে কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পাবলিকে পড়তো নাকি প্রাইভেটে পড়তো সেটাও তো জানিস না বাল। ঢাকাতেই তো কত্তোগুলো ইউনিভার্সিটি।' 

নম্রতা অবাক হয়ে বলল,

' মানে কী? তোরা কী ওকে খোঁজার পরিকল্পনা করছিস নাকি?' 

নাদিম স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

' তো? খুঁজব না? ব্যাটায় আমাগো দোস্তরে ছ্যাকা দিয়া ব্যাকা বানিয়ে দিয়ে গেল আর আমরা চুপ থাকব? আপাতত দশ-বারোটা ঘুষিতে তার প্রাপ্য। নমু? তুই তাকে খুঁজার চেষ্টা করিস নি কখনও?' 

' কিভাবে খুঁজবো, কোথায় খুঁজবো বুঝতেই পারি নি। নামটাও তো জানি না।' 

' আচ্ছা। ওসব বাদ। বাকি গল্পটুকু বল। প্রেমের শুরুটা?' 

নম্রতা কিছু বলবে তার আগেই উঠে দাঁড়ালো ছোঁয়া। তাড়াহুড়ো করে বলল,

' মাম্মা আমাকে নয়টার মধ্যে বাসায় থাকতে বলেছিল। এখন অলরেডি নয়টা বিশ বাজে। আই হ্যাভ টু গো।' 

নাদিম খেঁকিয়ে বলে উঠল,

' তো যা না। তোরে এনে বসে থাকতে কইছে ক্যাডায়? সবসময় আজাইরা আলাপ বা..' 

ছোঁয়া তেজ দেখিয়ে বলল,

' খবরদার বাকিটা উচ্চারণ করবি না। আর ক্যাডায় মানে কী? ভাষার কী ছিঁড়ি! তোর গার্লফ্রেন্ড তোকে সহ্য করে কিভাবে বুঝি না আমি। থার্ডক্লাস কথাবার্তা।' 

নাদিম গোঁ নিয়ে বলল,

' আল্লায় দিলে মুখটা আমার পার্সোনাল। আমার মুখ দিয়া আমার যেমনে মন চায় তেমনে কতা কমু। তোর বাপের কী? শালা ইংরেজ কোথাকার!' 

ছোঁয়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। রঞ্জন শার্টটা টেনেটুনে ঠিক করে ওঠে দাঁড়াল। নম্রতাদের বন্ধু মহলে রঞ্জন সব থেকে সুদর্শন পুরুষ। গৌড়বর্ণ, সুঠাম দেহ। মাথা ভর্তি কোকরানো চুল। খাড়া নাকের নিচে পাতলা কালচে ঠোঁট। মুখভর্তি ছোট ছোট দাড়ির মেলা। সনাতন ধর্মাবলম্বী রঞ্জনের সবচেয়ে সুন্দর দেখতে ওর চোখ। রঞ্জন ছাড়া গলায় বলল, 

' চল তোরে রিক্সা করে দিই। একা যেতে পারবি? নাকি আমরা কেউ যাব সাথে?' 

ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

' পারব। তুই সাথে গেলেই বরং অস্বস্তি ফিল করব। মেয়েদের চোখে তো তুই মানুষ না। মিষ্টির দোকান। হা করে তাকিয়ে থাকে। বিরক্তিকর।' 

রঞ্জন হাসল। আবারও বসে পড়ে বলল,

' তাহলে একাই যা। এখান থেকেই রিক্সা নে। অন্তু দেখ তো রিক্সা আছে নাকি আশেপাশে।' 

ছোঁয়া রাস্তার দিকে পা বাড়িয়েও আবার ফিরে এলো। ব্যস্ত গলায় বলল,

' আরে! তোদের তো একটা ইম্পোর্টেন্ট কথা বলায় হয় নি। মাম্মা তাদের বুটিক হাউজ থেকে ট্যুরের প্ল্যান করেছে। দে আর গুয়িং টু কক্সবাজার। তোরা কী যেতে চাস? হোটেল রেন্ট আর যাতায়াত খরচ ফ্রি।' 

নাদিম ভ্রু কুঁচকে বলল,

' সারাদিন মাম্মা মাম্মা করছ কেন বাল? বাঙালী না তুই? খাঁটি বাঙালিদের কখনো ম্যা ম্যা করতে শুনছিস? খুব তো ভাষা নিয়ে হাদিস মারো। আবার ম্যা ম্যা করো। আমার সামনে ম্যা ম্যা করতে এলে চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব। বাঙালী মাইয়া তুই। মায়েরে আম্মা ডাকবি। অলটারনেটিভ হিসেবে মা ডাকবি। ম্যা ম্যা আবার কী? আর আমরা কোনো ম্যা ম্যা-এর সাথে পিকনিকে যাব না। ভাগ তুই।' 

ছোঁয়া ফুঁসে উঠল। রঞ্জন শান্ত গলায় বলল,

' না-রে ছোঁয়া। আন্টি-আংকেলের সাথে পিকনিকে জয়েন করাটা কেমন দেখায় না? ওদের সাথে থাকলে ইঞ্জয়ও করতে পারব না ঠিকঠাক। গার্ডিয়ানরা সুযোগ পেলেই তো ওয়ান, টু-এর বাচ্চাদের মতো ট্রিট করে। কী লাভ শুধু শুধু সময় নষ্ট করে?' 

' কিন্তু আব্বু আর মাম্মা কেউই তো যাচ্ছে না আমাদের সাথে। আমি শুধু আমাদের কথা বলছি। আমরা ছয়জন।' 

অন্তুর চোখদুটো উত্তেজনায় ধ্বক করে উঠল। উৎসাহ নিয়ে বলল,

' মানে? উনারে যাবে না কেন?' 

' মাম্মাদের প্ল্যানটা লাস্ট মোমেন্টে এসে ওয়াক করে নি। হোটেল, গাড়ি সব বুক করা হয়ে গিয়েছে। আগামী কালেরই প্ল্যান। কিন্তু আজ হঠাৎ একটা কাজ পড়ে গিয়েছে। বুকিং ক্যান্সেলও করা যাচ্ছে না। আর করলেও মাম্মা আমার এবং আমার বন্ধুদের জন্য অফারটা ছেড়ে দিচ্ছেন। তোরা রাজি?' 

নাদিম, অন্তু, রঞ্জন চেঁচিয়ে উঠে বলল,

' অবিয়েসলি!' 

নীরা বিরস মুখে বলল,

' বাসায় শুনলে কেলাবে। সম্ভব না। তোরা যা।' 

নম্রতা সায় দিয়ে বলল,

' আমার বাসাতেও মানবে না বোধহয়। কতদিনের ট্রিপ?' 

' তিনদিন।' 

অন্তু মুখ ভার করে বলল,

' এটা কোনো কথা? গেলে ছয়জনই যাব। নয়তো একজনও না।' 

রঞ্জন কুটিল হেসে বলল,

' সব্বাই যাচ্ছি। কাল সকাল সাতটাই দেখা হচ্ছে। এখন সবাই হলে গিয়ে ঘুমা।' 

নীরা আৎকে উঠে বলল,

' আম্মু আমায় মেরে ফেলবে। তোরা যা প্লিজ। আমি যাব না।' 

নম্রতা বিরবির করে বলল,

' আমারও মন ভালো নেই। আর আব্বু বোধহয় মানবে না।' 

নাদিম গিটার হাতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

' ধুরু! বাসায় জানলে তো কাহিনী ঘটবে। জানাবি না। ব্যস!' 

নীরা-নম্রতা চোখ বড় বড় করে বলল,

' কী বলছিস?' 

রঞ্জন তুড়ি বাজিয়ে বলল,

' সুন্দর আইডিয়া। তোদের বাপ-মা তো আর হলে এসে খোঁজ নিবে না। ফোনই করবে। আর ফোন তো তোদের কাছেই থাকবে। তিনদিনেরই ব্যাপার। বাকিটা আমরা সামলে নিব। রিল্যাক্স।' 

নীরা ভীত চোখে তাকাল। নাদিম নীরার মাথায় চাটি মেরে বলল,

' ভয় পাস না ভতী। ডর বাদুইরা কোথাকার। আমরা তো আছিই। সামলায় নিমু। কিন্তু তোগো ছাড়া যাইতাম না।' 

নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজি হলো। ওদের দুই জনের জন্য সবার আনন্দ নষ্ট করার কোনো মানে নেই। তাছাড়া এই ইট-পাথরের শহর থেকে দূরে গিয়ে কষ্টের ভার যদি একটু লাঘব হয়, তাহলে ক্ষতি কী? আলোচনা শেষে রঞ্জু আর নাদিম নম্রতা-নীরাকে হলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রওনা হলো। অন্তু ক্যাম্পাসের বাইরে থাকে বিধায় ছোঁয়াকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়লো অন্তুর ঘাঁড়ে। বন্ধুদের চেষ্টায় ক্ষণিকের জন্য অপরিচিত 'সে'- কে ভুলে গেল নম্রতা। কিছুক্ষণের জন্য বুকভরে শ্বাস নিলো। নতুন করে ভাবার চেষ্টা করল। কিন্তু নিয়তি কী আদৌ তাই চায়? 



Writer:- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner