Leave a message
> কনে দেখা আলোয় পর্ব ২৭
-->

কনে দেখা আলোয় পর্ব ২৭



গ্রামে আসার আগে কিনঞ্জল ভেবেছিল প্রথমবারের মত যেহেতু গ্রামে যাচ্ছে এই সুযোগে পুরো গ্রামটা ঘুরে দেখবে।গ্রামের মানুষ,তাদের জীবনযাত্রা,গ্রামের সৌন্দর্য সব!সব ঘুরে দেখবে।কিন্তু কিসের কি আজ তিনদিন হলো ওরা গ্রামে এসেছে কিন্তু কিনঞ্জল এখন পর্যন্ত গোসল আর বাথরুমে যাওয়া ছাড়া একটাবারের জন্য বারান্দা থেকে উঠানে পর্যন্ত পা রাখতে পারছে না।সর্বক্ষণ দাদির রুমের ভেতর শাড়ি পরে মাথায় এক হাত ঘুমটা দিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে।আর পুরো রুম জুড়ে গ্রামের মানুষজন গিজগিজ করছে।এ বাড়ির নতুন বউ দেখতে প্রায় পুরো গ্রামের বয়স্কা মহিলা,তাদের ঘরের বউ,নাতি-নাতনিদের নিয়ে চলে এসেছে।সাক্ষরের মা সবাইকে চা-নাশতা দিচ্ছে আর দাদি সবার সঙ্গেই নিজের নাতবউ এর প্রশংসা করছে।কিনঞ্জলকে দেখে কেউ কেউ প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছে আবার কেউ কেউ আড়ালে আবডালে নতুন বউয়ের গায়ের রঙ,নাক,চুল,উচ্চতা নিয়ে গবেষণায় বসেছে।বিয়ের চার-পাঁচ মাস হয়ে এলেও এদের কাছে কিনঞ্জল যেনো নতুন বউটিই রয়ে গেছে।এই এত এত মানুষের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো কিনঞ্জলের।তখনই হুট করে কেয়ার টেকার চাচার মেয়ে জুথি এসে জানালো সাক্ষর নাকি বাসায় ফিরেছে আর কিনঞ্জলকে ডাকছে।কিনঞ্জলও যেনো এই সুযোগটার অপেক্ষাতেই ছিলো দাদিকে বলে নিজেদের রুমে যেয়েই আগে মাথা থেকে শাড়ির আঁচলটা ছেড়ে দিলো আর খোলা চুলগুলো হাতখোপা করে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল।গ্রামের এক বয়স্কা দাদি নতুন বউয়ের চুল দেখার জন্য কিনঞ্জলের খোপাটা খুলে দিয়েছিলো।ওই অত মানুষের মধ্যে আর দ্বিতীয়বার খোপা করেনি কিনঞ্জল কিন্তু একটু অস্থির লাগছিলো বটে!
.
"খুব অস্থির লাগছে?"
সাক্ষরের কথায় হুশ ফিরলো কিনঞ্জলের।সাক্ষর যে ওকে ডেকে পাঠিয়েছে সে কথা বেমালুম ভুলে গেছে।রুমে ঢুকেই তো ফ্যানের নিচে বসে গা জুড়াচ্ছিলো।শীত এখনো না গেলেও অত মানুষের ভীড়ে বেশ হাশফাস লাগছিলো কিনঞ্জলের।হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
"আপনি আমাকে ডেকেছিলেন?কিছু কি লাগবে?"
সাক্ষর নিজের ফোনটা চার্জে বসিয়ে কিনঞ্জলের ফোনটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসল।ফোনটা কিনঞ্জলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
"কিচ্ছু লাগবে না।ওই রুমে দেখলাম কাঠের পুতুলের মত বসে আছিস আর মানুষজন তোকে চিড়িয়াখানার আজব চিরিয়া ভেবে দলে দলে এসে ভীড় করে দেখে যাচ্ছে।ভাবলাম তোর অস্বস্তি হতে পারে তাই রুমে এসে বসার জন্য একটু সুযোগ করে দিলাম।"
"খারাপ তো একটু লাগছিলোই তবে নতুন বউ মানুষ তো দেখতে আসবেই।আর সবাই যখন আমার প্রশংসা করছিলো শুনতে মন্দ লাগছিলো না।তবে গ্রামটা ঘুরে দেখতে পারছি না বলে একটু মন খারাপ হচ্ছে।"
সাক্ষর বিদ্রুপ করে বলল,
"আহা!সবাই তোমার রুমে প্রশংসা করে উঠানে গিয়ে যে তোমার নাক,গায়ের রঙ,চুল নিয়ে রিসার্চ করে ফেললো সে খবর দেখি তুমি জানোই না টুকটুকি আফা।"
সাক্ষরের এমন কথায় কিনঞ্জল চোখ বাকিয়ে একনজর সাক্ষরকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।এই পিশাচ জীবনেও ভালো হবে না।সব কিছুতেই এর বাড়াবাড়ি।সাক্ষর কিনঞ্জলের এমন শকুনির দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে খাটে আধশোয়া হয়ে বলল,
"তোর ফোনে কয়েকটা নিউ মুভি,কিছু ওয়েব সিরিজ আর দুই-তিনটা বাংলা নাটক ডাউনলোড করে দিয়েছি।ফ্রী টাইমে এতিমের মতো বসে না থেকে এগুলো দেখিস।"
"নেট পেলেন কোথায়?এখানে নেটওয়ার্ক এর যা অবস্থা আমি তো আসার পর থেকে ফেসবুকেও ঢুকতে পারিনি আর বাসায়ও কল করা হয়নি।"
"আমি গ্রামের রাস্তায় ঢোকেই চাচ্চুকে মেসেজ করে দিয়েছিলাম।আর এগুলো বাজারে ওখানের একটা স্টুডিও আছে আর ওয়াই-ফাই লাইনও আছে।ওখানে বসে থেকেই ডাউনলোড করেছি।রাতে দুজনে মিলে দেখব।"
"ল্যাপটপ আনিনি তো।"
"সমস্যা নেই ফোনেই দেখব।দু'জনতো সমস্যা হবে না।সেসব বাদ দে,গোসল করে রেডি হয়ে থাকিস বিকেলে দুজনে বেরোবো।"
বেরোনোর কথা শুনতেই কিনঞ্জলের চোখ চকচক করে উঠল।চোখ মুখে একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,
"ঘুরতে যাবো কোথাও?"
"না,ভাটা খেলতে যাবো।"
কিনঞ্জল সাক্ষরের কথায় আঁতকে উঠল।আর সাথে সাথেই সাফ 'না' জানিয়ে বলল,
"একদম না!আমি নতুন বউ গ্রামে এসে খেলবো?লোকে কি বলবে?আমি কোথায় যাবো না।"
সাক্ষর কিনঞ্জলের এমন রিয়াকশন দেখে হেসে ফেলল।আধশোয়া থেকে উঠে বসে কিনঞ্জলের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
"ও মা..তাই নাকি?তা নতুন বউ তোমার গায়ে থেকে এখনো বুঝি হলুদের গন্ধও যায়নি।এদিকে আসোতো মামুনি শুকে দেখি।ছাগল কোথাকার!ভাটা খেলা মানে নৌকায় ঘুরাঘুরি করা।গ্রামের লোকজন এখানে ভাটা খেলা বলে।যদিও এখন নদীর পানি অনেকটা শুকিয়ে গেছে তবুও ভাবলাম গ্রামে যেহেতু এসেছি একটু ঘুরে যাই।বর্ষায় নাকি এখানে ভাটা খেলার জন্য নৌকা ঘন্টায় দুইশ করে ভাড়া দেয়।"
"কিন্তু আমি তো সাঁতার জানি না।"
"তাহলে তো ভালোই তোকে নদীতে ফেলে দিয়ে এসে এক মাসের মাথায় আরেকটা বিয়ে করব।এমনিতেও তোকে বিয়ে করেও সেই শোকেসে সাজিয়েই রাখতে হচ্ছে!আমার লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না।"
এই শুনে কিনঞ্জল সাক্ষরকে তেড়ে কিছু বলার আগেই সাক্ষর নিজেই আবার বলল,
"আমি গোসল করতে গেলাম।তোয়ালে আর কাপড়চোপড় দিয়ে আসিস।আর পিঠটাও আজকে ঘষে দিবি।গোসল শেষে পানি তুলে রাখব আমার পরেই গিয়ে গোসল সেরে নিবি।নয়ত তোলা পানি কেউ খরচ করে ফেলতে পারে।আমি আর পানি তুলে দিতে পারব না।আপনার তো আবার ননীর শরীর।কল চেপে পানিও তুলতে জানেন না!"
এই বলেই সাক্ষর রুম থেকে কেটে পড়ল।আর কিনঞ্জল ফোসফোস করতে করতে সাক্ষরের কাপড় ট্রলি থেকে বের করে নিজেও রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
.
"প্রথমে ডান হাতটা দিয়ে আমার হাতটা শক্ত করে ধর, তারপর কুচি সামলে উঠে পড়। ভয় নেই পড়বি না।"
কিনঞ্জল সাক্ষরের কথামতন নৌকায় উঠে মাঝের পাটাতনে বসে পড়ল।আর সাক্ষর দক্ষ মাঝির মত বৈঠায় টান দিতেই নৌকা চলতে আপনমনে চলতে লাগল।

লেখা:- নাজমুন নাহার তৃপ্তি
 

Delivered by FeedBurner

a