Bangla Funny Story |
কয়েকদিন আগে নতুন একটা টিউশনি পেলাম। ছাত্রী ভয়ংকর রকমের সুন্দরী। মাঝেমধ্যে বলতে ইচ্ছে করে ঘরের লাইটটা একটু অফ করে দাও। তোমার আলোতেই সব দেখা যাবে। কী দরকার বিদ্যুৎ অপচয়ের। কিন্তু ছাত্রীকে এসব বলা যায় না।
ছাত্রীর সৌন্দর্য অসৌন্দর্য নিয়ে আমার কিছু হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু এই মেয়ের বেলায় হচ্ছে। পড়া বুঝানোর সময় চোখের দিকে তাকানো যায় না। এত সুন্দর মেয়ের দিকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকলে বলবে স্যারের ক্যারেক্টার খারাপ।
এছাড়াও আরেকটা প্রবলেম আছে। আঙ্কেল-আন্টি এমনিতে অনেক ভালো। কিন্তু পড়ানোর সময় একটু পরে পরেই একজন একজন করে যে ঘরে পড়াই সে ঘরে আসতে থাকে। টেবিলের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। একবার আন্টি আসে, একবার আঙ্কেল, ছাত্রীর ছোটভাই, দাদী, আবার বাসার কাজের মেয়ে। কোনো সন্দেহ করে কি-না কে জানে!
এসবে এখন আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। অন্য দিকে তাকিয়ে ছাত্রীকে পড়াই। কেউ রুমে আসলে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকি। কলমের সৌন্দর্য দেখি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি কোন কোম্পানির। কালি কতটুকু আছে। এই কালিতে আরো কতদিন যাবে।
গতকালের কথা। আমি অন্য দিনের মতোই ছাত্রীর দিকে না তাকিয়ে তাকে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছি। ছাত্রীও যথারীতি হুম হ্যাঁ করছে। কিন্তু আজকে এখনো এই ঘরে কেউ আসছে না। এমনকি বাড়িটাও কেমন যেন শুনশান। কেমন দম বন্ধ পরিবেশ।
আমি আর কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরেই জিজ্ঞেস করে ফেললাম, 'কী ব্যাপার সবাই কই আজকে?'
ছাত্রী সিনেমায় নতুন বউয়ের ভূমিকায় অভিনয় করার মতো করে মাথা তুলল। তারপর একটা কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে চোখ মিটমিট করতে করতে বলল, 'একটা বিরাট প্রবলেম হইছে, স্যার?'
-প্রবলেম! কী হইছে, আশা?
-সরি স্যার। আপনি বাইরের মানুষ, আপনাকে বলা বোধহয় ঠিক হবে না।
-আচ্ছা, প্রবলেম থাকলে থাক। বলতে হবে না।
আমি না করায় ছাত্রী যেন হঠাৎ উদগ্রীব হয়ে গেল। আমার দিকে ঝুঁকে বলল, 'না না স্যার, তা না। আপনাকে বলা যাবে না কী জন্য! আপনি হলেন আমার গুরুজন। মা-বাবার পরেই তো শিক্ষকের স্থান। আপনাকে অবশ্যই বলা যাবে।'
ছাত্রীর আমার প্রতি ভক্তি দেখে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম। মোশাররফ করিমের মতো দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে বলতে ইচ্ছে করছে আমার ইত আবেগ ক্যারেএএএ..ইত আবেগ ক্যারে...
আমি আমার আবেগের ঘোড়ায় লাগাম টেনে বললাম, 'ওহ্ আচ্ছা! তা কী হয়েছে বলো?'
-আসলে স্যার, কিভাবে যে বলি! আসলে..আমার আব্বু আম্মুর আজকে ঝগড়া হয়েছে।
-ওহ্! ব্যাপার না, আশা। এইগুলা সবার ঘরেই হয়। মন খারাপ করো না।
আমার উত্তর শুনে ছাত্রী আমার দিকে আরো ঝুঁকে গেল। ফিসফিস করে বলল, 'না স্যার। একদম তা না। আমার আব্বু আম্মুর দুইদিন পর পরই লাগে।'
-ওহ্..
-কিছু মনে না করলে একটা কথা বলব, স্যার?
-হুম, অবশ্যই।
-আমার আব্বু না মানুষটা সুবিধার না।
-মানে?
-মানে..ঘরে সবসময় ক্যাচক্যাচ ফ্যাসফ্যাস করে। আমার আম্মুর সাথে সারাক্ষণ ঝগড়াঝাটি করে। আমাদের বকাঝকা করে। এমনকি জানেন স্যার?
-কী?
-ঘরের কোনো কাজে হেল্প করা দূর থাক নিজের কাজগুলাও ঠিকঠাক মতো করে না। এমনকি গোসল শেষে বাথরুমে নিজের পরনের লুঙ্গিটা পর্যন্ত ফেলে আসে।
-থাক আশা। বাইরের মানুষের কাছে এসব বলতে নেই।
-ওমা..আমি কখন বলতে চাইলাম! আপনিই না শুনতে চাইলেন।
-আমি?
-হুম, আপনি।
-আচ্ছা, আমি। পড়ো এখন।
আমি পড়ো বললেও ছাত্রী আমার পড়ছে না। বারবার আড় চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে।
আমি এবার একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, 'কীহ্! কিছু বলবে?'
ছাত্রী মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে সুবোধ বালিকার মতো মাথা ঝাঁকাল। আমি সেই হাসিতে গলে গিয়ে বললাম, 'হুম, বলো..'
-আরেকটা কথা স্যার, আমার আম্মুও না বেশি সুবিধার না।
-যেমন?
-যেমন..সারাদিন টিভির রিমোট নিয়ে পড়ে থাকবে। স্টারপ্লাস, স্টার জলসার সবগুলা সিরিয়ালের সব ডায়ালগ মুখস্থ। আমি পড়াও এত ভালো করে মুখস্থ করি না, স্যার।
-আর?
-আর স্যার..সারাক্ষণ ফোনে কথা বলে, শাড়ি-গহনা এইগুলা নিয়ে বোনদের সাথে। আব্বুর কোনো কেয়ারই নেয় না। ঠ্যাকায় পড়ে সংসার করছে এমন একটা ভাব। আমাদেরও না। আমাদের দুই ভাইবোনের কোনো যত্ন-আত্তি নাই।
-কিন্তু তোমার আব্বু-আম্মুকে দেখে তো মোটেই এমনটা মনে হয় না। কত ভালো মানুষ উনারা!
-বাইরের মানুষে তাই ভাবে, স্যার। ফ্যামিলির একটা প্রেসটিস আছে না! ভং ধরে থাকে সবার সামনে।
-আসলেই মানুষের ভিতরে কী চলে আর বাইরে কী বুঝা মুশকিল। মহীনের ঘোড়াগুলোর গান শুনো নাই..মানুষ চেনা দায় রে, মানুষ চেনা দায়! যাইহোক আশা, দুঃখ করো না, পড়ো।
আশা পড়ছে। কিন্তু একটু পরেই খেয়াল করে দেখলাম ও আবার মিটমিট করে হাসছে। আমি একটু ধমকের সুরেই বললাম, 'কী ব্যাপার, আশা?'
-কিছু না, স্যার। একটা কথা; কিন্তু বলতে লজ্জা লাগছে।
-আচ্ছা থাক, লজ্জা লাগলে বলা লাগবে না।
-না স্যার, মানে আমি বিয়ের পর আমার হাজবেন্ডর সাথে কখনো এমন করব না।
কথাটা বলেই আশা লজ্জাবতী গাছের মতো মিইয়ে যায় যায় অবস্থা। আমি বিরক্তি নিয়েই বললাম, 'পড়োওওওও এবার।'
আশা প্যাঁচার মতো মুখটা করে বইয়ের দিকে তাকাল। কিন্তু মিনিট কয়েক পরেই কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে গালগুলো ফুলিয়ে বলল, 'স্যার, আপনিও তো মানুষটা ভালো না।'
-মানে?
-মানে..আপনার মনটা তো পাথরের মতো। ইট, কাঠ, লোহা, স্টিলের মতো।
-কী জন্য?
-কী জন্য মানে! একটা মেয়ের মা-বাবার একটু আগে ঝগড়া হয়েছে, আর আপনি তাকে জোর করে বসিয়ে পড়াচ্ছেন।
-তাহলে পড়বে না আজকে?
-আপনার মনে তো আসলেই মায়া-দয়া বলতে কিছু নেই, স্যার। আপনি আবার জিজ্ঞেস করছেন পড়ব কি-না।
-আচ্ছা আচ্ছা। পড়তে হবে না আজকে। আমি তাহলে কাল আসব।
আমি মন খারাপ নিয়ে আশাদের বাসা থেকে বেরিয়ে আসলাম। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পড়লেও আমার মন এতটা খারাপ হয় না। আহারে মেয়েটার কত কষ্ট। বাবা-মায়ের মিল না থাকলে কী আর মনে সুখ থাকে!
এরপরে আরেকটা টিউশনি আছে। আগে বের হওয়ায় একটা দোকানে বসে চায়ের অর্ডার দিলাম। তখুনি আশার আম্মু ফোন দিল।
-হ্যালো আশিক, তোমার শরীরটা এখন কেমন?
-জি আন্টি, ভালো।
-ওহ্..শুনো বাবা, আজকে আর কোনো টিউশনিতে যাইয়ো না। বাসায় চলে যাও।
-আচ্ছা আন্টি।
-আর শুনো, বাসায় ফেরার সময় কিছু ফলফ্রুট আর স্যালাইন নিয়ে যেও।
আমি একটু কনফিউজড হয়ে গেলাম। আন্টি কী আসলে আমাকেই ফোন দিল। সেই কনফিউশান নিয়েই বিড়বিড় করে বললাম, 'স্যালাইন কী জন্য আন্টি?'
-ওমা! একটু আগে আমি তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে গেলাম। নিয়ে দেখি তুমি নেই। আশা বলল, তোমার নাকি পেট খারাপ। আজ আর পড়াবে না, তাই নাকি চলে আসলে।
-মানে! কিন্তু আন্টি, আশা যে আমাকে অন্য কিছু বলল।
-কী বলল?
-বলেছে..
-কী বলছে, বলো..
-কিভাবে যে বলি, আন্টি!
-আরে বাবা, আমার সাথে অত ইতস্তত করার কী আছে? বলে ফেলো।
-আসলে..আশা বলল, আপনার আর আঙ্কেলের না-কি আজকে ঝগড়া হয়েছে। ওর মন খারাপ, আজকে পড়বে না।
-কীহ্! বেয়াদব, দাঁড়াও ওর বেয়াদবি আমি ছোটাচ্ছি। তুমি কাল আসার সময় একটা কাজ করতে পারবে, বাবা?
-জি আন্টি, বলেন?
-আগামীকাল আসার সময় এক ডজন জালিবেত কিনে নিয়ে আসবে। টাকা আমি দিব। এই জিনিস না থাকলে তুমি ঐটারে মানুষ করতে পারবা না।
আমি হাবলার মতো কেবলা হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'মানে আন্টি?'
-মানে! তোমার আঙ্কেলের সাথে আমার মনেহয় না লাস্ট দশ বছরেও একবার ঝগড়া হইছে। আর আজকে বাসার সবাই একটা দাওয়াতে গিয়েছে। আমার শরীরটা খারাপ ছিল, তাই একটু শুয়ে ছিলাম। তোমাকে শুধু যেটা বললাম সেটা করো, কাল মনে করে বেত নিয়ে আসবা কিন্তু।
-আচ্ছা আন্টি।
আন্টিকে আচ্ছা বললাম; কিন্তু জালিবেতের কথা মনে পড়তেই আমার পেছনে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ে গেল।
স্কুলজীবন ফেলে বাস্তব জীবনে ফিরে আসতেই দেখলাম ব্যথাটা আসলে পিছনে না। সামনে। পেট মোচড় দিচ্ছে। এক্ষুণি টয়লেটে যাওয়া দরকার। আর সহ্য করতে পারছি না। রাস্তাঘাটে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি কোনোক্রমে এক বক্স স্যালাইন কিনে বাড়ি ফিরলাম।
এই মেয়ে তো দেখি ডেঞ্জারাস মেয়ে। এর মুখটা তো শুধু সুন্দরই না, যথেষ্ট খারাপও। যা বলে তাই লেগে যায়। আচ্ছা, আঙ্কেল-আন্টির কী অবস্থা? আহারে! তাদের লাস্ট দশ বছরেও নাকি একবার ঝগড়া হয় নাই, কী জানি হয় আজকে।
( সমাপ্ত )
Writer: Rajib Debnath