দুপুর ২ টা। মামুদের বাসায় ঢুকতেই শুভ্র ভাইয়ার হাসির শব্দ কানে এলো। ধীর পায়ে উনার রুমের পাশে উঁকি দিতেই চোখে পড়লেন উনি। খুব মনোযোগ দিয়ে বিছানা গুছাচ্ছেন আর ফোন লাউডে রেখে কারো সাথে কথা বলছেন উনি। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করতেই শুভ্র ভাইয়ার কথা কানে এলো।
- দেখ শালা। রাগ উঠাবি না বলে দিলাম।
- আরেহ্ কি যে বলো মামু। তোরে রাগানোর তো এটাই বেস্ট টাইম। ক্যাম্পাসে থাকলে তো কিছু বললেই মাইরা ভর্তা বানাস। বাট এখন তো মারতে পারবি না আর তুই তো আবার গালি দেস না। সো, তোরে শান্তিতে জ্বালানো যেতে পারে। তবে দোস্ত! বিশ্বাস কর। আজ আমি তোরে জ্বালাইতে ফোন দিই নি।
- তো এতক্ষণ ধরে কি আমার সাথে প্রেম করছিস? ডাফার!
- দোস্ত! লাবনির লগে ঝগড়া লাগছে। ফেসবুক,ইন্সটাগ্রাম,নাম্বার সব ব্লক মারছে। দোস্ত তুই একটু ফোন দিয়া ক না। এই লকডাউনে কি সিংগেল জীবন ভাল্লাগে ক? একটু হেল্প কর না মামা প্লিজ।
- আস্তাগফিরুল্লাহ! জীবন থাকতে না। তোর ওই গার্লফ্রেন্ডের নাম আমার সামনে নিবি না একদম। শালা..এটা মাইয়া নাকি অন্য কিছু? আমি "হ্যালো" বললে সে "আই লাভ ইউ " ভেবে গলায় ঝুলে পড়বে।
- দোস্ত ওমন করছ কেন? তুই ওর ক্রাশ হের লাইগা এমন করে। আর ক্যাম্পাসের মাইয়ার লগে প্রেম করলে একটু আধটু সহ্য করতে হয় বুঝলি? তুমি তো মামা...মাইয়া গোর পাত্তায় দেও না। ওই আবৃত্তি না কি জানি নাম.... মাইয়াটা কি চিজ ছিলো মামা। তোমারে আইসা প্রোপোজ করলো আর তুমি বোন ডাইকা দিলা? কেমনে পারিস তুই? তোর সব ঠিক আছে তো?
- রোজার দিন লুচ্চামি থামা। সামনে থাকলে থাপড়াইয়া দাঁত ফালাই দিতাম। একটা গার্লফ্রেন্ড সামলাইতে পারিস না আবার সং ঢং করিস। শালা আবুল।
- আবুল তোর শশুড়। আমার গার্লফ্রেন্ড তো আর তোমারটার মতো বাচ্চা না। তুমি তো চড় মাইরা চুপ করাইয়া বসায় রাখো আর আমি? আমি চড় মারলে হেতি আমারে উল্টো লাত্থি মাইরা দিবো।
- আসলে কি জিসান? তুই না এক্চুয়েলি লাত্থি খাওয়ারই যোগ্য। আর কি বললি?আমার শশুড় আবুল? এক্চুয়েলি বন্ধু,, ভালো বলছিস। আবুল হতেও পারে.... তবে হ্যা,শশুড় নিয়ে বলছিস ভালা কথা বউ নিয়া কিছু বললে খবর আছে।
- দেখাইছিস কখনো বলবো? ফোনে তো পিকও রাখস না। তোর ফোনটা একদম ভাজা ফ্রাই বানাই ফেলছি তাও কোনো পিক খুঁজে পাই নাই। তবে একটা হাফ পিক পাইছিলাম। খালি দাঁত বের করা হাসি।তবে দোস্ত হাসিটা কিন্তু জোস ছিলো। ওইটা দেইখাই বুঝা যায় ভাবি আমাগো সেই হিট।
- হারামি কোথাকার। তোরা আমার ফোন চেক করিস? আর কিসের ভাবি হ্যা? আমার বউরে তোরা বোন ডাকবি বুঝছিস? তোগোর ভাবি ডাকের মাঝেই গলদ। সব কটা একেকটা লুইচ্চা।
- তোর মতো সবাই আদর্শ পুরুষ হইলে ভার্সিটির মাইয়ারা প্রেমিকহীনতায় ভুগবো বুঝছিস? এখন এগ্লা বাদ দিয়া লাবনি রে একটা কল দে..
- পারবো না। মেয়েদের ধারে কাছেই নাই আমি। আর ওইসব চিপকু মাইয়াদের ধারে কাছে তো আরো না। ম্যাসেঞ্জারেই কথা বলি না আবার ফোনে? মেয়ে মানে এক্সট্রা ঝামেলা।।আসিফরে বল যা...
- আরে বা*, আসিফের কথা শুনবে না। তোর কথা শুনবে। প্লিজ মামা,প্লিজ।
- দেখ দোস্ত। আমার ফুলের মতো পবিত্র চরিত্রটাকে এভাবে নির্যাতনের মধ্যে ফেলিস না। আমি আমার পিচ্চিকে নিয়েই ভালো আছি। তোর লাবনি টাবনির মধ্যে ফেলিস না আমায়।প্লিজ।
- আরে মামা। তুই বন্ধুর জন্য এইটুকু করতে পারবি না? তোরে কি প্রেম করতে বলছি? তুই জাস্ট বোঝাবি....প্লিজ দোস্ত প্লিজ। আর শোন? আমার ফোন কাটিস না। এমনি ফোন দে...শুনি কি বলে।
- শালা বাটপার। আচ্ছা লাইনে থাক...
আমি এবার দরজায় হেলান দিয়ে বেশ আরাম করে দাঁড়ালাম। উনি ফোনটা হাতে নিয়ে আবারও টেবিলের উপর রেখে দিলেন। বিছানার উপর রাখা শার্টগুলো গুছাতে গুছাতে শান্ত এবং ধীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
- আসসালামু আলাইকুম, লাবনী বলছো?
- জি আপনি কে?
- আমি শুভ্র। জিসানের ফ্রেন্ড।
- ওহ্ মাই গড্। শুভ্র ভাইয়া? আপনি আমাকে ফোন দিয়েছেন? আমি জাস্ট বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনি আর আমাকে? ওহ মাই গড।
শুভ্র ভাইকে দেখে মনে হচ্ছে উনি বেশ আনইজি ফিল করছেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠলেন,
- আসলে লাবনি ফোনটা জিসানের জন্য করেছিলাম। ছেলেটা তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমি ওকে ইগনোর করছো তাই বেচারা মনমরা হয়ে বসে আছে। হয়তো বা কান্নাকাটিও করেছে। কি একটা অবস্থা বলো। আজকালকার যুগে কি এমন ছেলে পাওয়া যায় বলো? আর তাছাড়া মান অভিমান তো হবেই তার জন্য এতো রাগ করলে চলে? ও তো একটু ভবঘুরেই বাট তুমি তো বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। অল্পতে রাগ করা বুদ্ধিমতীদের মানায় না। তুমি প্লিজ ওকে আনব্লক করে ওর সাথে একটু কথা বলো।।
- ভাইয়া আপনি যখন বলেছেন অবশ্যই করবো। দেখেছেন আপনি কতো সুইট করে স্মোথলি কথা বলেন। আর জিসান? অলওয়েজ ধমকা ধমকি করে। ভাইয়া প্লিজ ওকে একটু আপনার মতো কথা বলতে শিখাবেন?
- সবাই একরকম হয় না। ও ওর মতো পার্ফেক্ট লাবনী।
- তবু ভাইয়া প্লিজ। আপনার সবকিছুই কতো কুল। ওকে একটু আপনার মতো শিখিয়ে দিয়েন প্লিজ প্লিজ।
- আচ্ছা শেখাবো। এখন রাখছি তুমি প্লিজ ওকে আনব্লক করে দিও।
- আনব্লক না করলে কি আবার ফোন দিবেন?
শুভ্র ভাইয়া যেন এবার বিষম খেলেন । কোনো মতে বলে উঠলেন,
- নাহ্। আমি কাউকে বারবার রিকুয়েষ্ট করি না। তোমাকে বললাম এবার বাকিটা তোমার উপর নির্ভর করছে। রাখছি।
- একমিনিট। ভাইয়া? আপনার কি গার্লফ্রেন্ড আছে? না মানে, ক্যাম্পাসে তো কখনো দেখি না তাই বললাম। আপনাদের ফ্রেন্ড সার্কেলে তো আনিকা আপু আর মিলি আপুকেই দেখি বাট আপনার সাথে আলাদা কাউকে কখনো দেখি নি। আছে কি?
- নাহ। গার্লফ্রেন্ড নাই তবে বউ আছে। প্রেগনেন্ট বউ।
- আপনি মজা করছেন ভাইয়া?
- জি না। মজা করছি না। তুমি চাইলে জিসানকে জিগ্যেস করতে পারো। নাম্বারটা আনব্লক কর তাড়াতাড়ি জিগ্যেস করে নাও কেমন?রাখছি..আল্লাহ হাফেজ।
ফোনটা তাড়াহুড়ো করে কেটেই জোরে একটা শ্বাস ফেললেন উনি। রাগী কন্ঠে বলে উঠলেন,
- শালা হারামি। তোর গার্লফ্রেন্ডের কানের নিচে মারা উচিত।
- দোস্ত! পাইলে আমিই মারতাম। শালী বলে কি? দেখছিস? তোর লগে কতো লাফায় লাফায় কথা বললো আর আমি ফোন দিলে মনে হয় কেউ ওরে ইন্দুরের ফ্রাই খাওয়াই দিছে।
কথাটা শুনেই ভুবন কাঁপানো হাসিতে ফেটে পড়লাম আমি। এতোক্ষণ কতো কষ্টে যে হাসি চেপে রেখেছিলাম, আল্লাহ মালুম। আমার হাসির শব্দে পেছন ফিরে তাকালেন শুভ্র ভাই। মুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকে এলো উনার। ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
- মামু, কে রে? ভাবি? তোর ফোনে যে হাসির রেকর্ডিং আছে তার লগে তো মিলে যায়তাছে।
- শালা ফোন রাখ।
কথাটা বলেই ফোন কেটে দিলেন উনি। টাওজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠলেন,
- কি? এই বিকেল বেলা আমার বাড়িতে রোদেলা দুপুর এসে হাজির। কাহিনী কি? আর এভাবে বেক্কলের মতো হাসছিস কেন? তোকে না বলছি এভাবে হাসবি না। হাসি থামিয়ে বল,এখানে কি?
- আম্মু পাঠিয়েছে তাই এসেছি। মামানি নাকি অসুস্থ? মামু বাড়ি নেই। তাই আম্মু বললো আমি যেনো আজ মামানির সাথে থাকি।
- ওহ! রোজা রেখেছিস?
- হু।
- গুড। রোজা আর নামাজ মিস গেলে মাইর খাবি। আচ্ছা বল তো কি রান্না করা যায়? আজ ইফতারি আমি বানাবো।
- আমি থাকতে আপনি কেন বানাবেন? তাছাড়া,আম্মু আমাকে রান্নার জন্যই পাঠিয়েছে।
- পাঠাক। পিচ্চি পিচ্চির মতো থাক। রান্না ঘরে ঢুকে গরম তেল ছিটিয়ে মরতে চাস? এবার চুপচাপ আমার সাথে রান্নাঘরে চল। দূরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখবি সব ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা। বিরিয়ানি, বেগুনী, বুট দিয়ে চলবে না? আমি এগুলোই পারি। যদিও বেগুনীর রেসেপিটা ইউটিউবে একবার দেখতে হবে।
আমি আর শুভ্র ভাই রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে আছি। পেঁয়াজ -মরিচ -মাংস- বেগুন সব কেটে দিয়েছি আমি। উনি ইউটিউব দেখে বিরিয়ানিও রান্না করে ফেলেছেন ইতোমধ্যে। বেশ ভালোই ঘ্রান আসছে মনে হয়। কালারটাও মোটামুটি খারাপ না। এখন বেগুনী বাজছেন আর ইউটিউবের মহিলাটাকে বকা দিচ্ছেন। উনার ধারনা মহিলা নির্ঘাত কিছু কারচুপি করেছেন যার কারণে তার বেগুনীগুলো মহিলাদের মতো ফুলছে না। কেন ফুলছে না? ফুলবে না কেন? ফুলতে হবে!! আমি উনার কান্ড দেখে হাসিতে কুটিকুটি। এমন সময় গুটি গুটি পায়ে মামনি এলে দাঁড়ালেন পাশে। দুর্বল হাসি দিয়ে বললেন,
- কি করছিস তোরা?
আমি লাফিয়ে তাকের উপর থেকে নেমে মামানির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মামনিকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলাম,
- আমি কিছু করছি না মামানি। সব তোমার গুণোধর ছেলে করছে। তোমার ছেলের তো বহুত গুণ, সবই পারে। তাহলে মা শুধু শুধু আমায় কেন পাঠালো বলো তো ?
- তোকে আমার ছেলের গুণ দেখতে পাঠিয়েছে। দেখে নে, আমার ছেলের অনেক গুণ। (মুচকি হেসে)
মামানির কথার উত্তরে কিছু একটা বলতে যাবো ঠিক তখনই শুভ্র ভাইয়া বলে উঠলেন,
- ফুপি জানে তার ভাতিজার কি চায়। তাই তোকে পাঠিয়েছে। আই মিন, রান্নাটা নাহয় আমিই করলাম থালা-বাসন ধোয়া, আমার কাপড় ধোয়া, ঘর গুছিয়ে দেওয়া, খাবার সার্ভ করা এসব আমার কর্ম নয়। তাই তোকে পাঠানো হয়েছে। যাহ্ কাজে লেগে যা। (একটু ভেবে) নাহ এখনই না। ইফতারের পর শুরু করবি। ননস্টপ ওয়ার্কিং। আমি সেটা দিয়ে নাটক বানাবো "কাজের মেয়ে রোদেলা" আহা! হিট হিট হিট।
- মামানি! দেখছো কেমন করছে। আমি নাকি কাজের মেয়ে। থাকবোই না আমি।
- শুভ্র! একটা চড় দিবো। তুই সবসময় ওর পেছনে লাগিস কেন শুনি?
- আজব! আমি কি করলাম? ওকে আমি যা বলি তাতেই সে ফেচফেচ করে কাঁদে নয়তো চিৎকার করে। এই দেখো আমি কাজের মেয়ের জায়গায় যদি বলি "ঘরের বউ রোদেলা" তবু চোখ পাকিয়ে তাকাবো। বিশ্বাস করলা না? ওই দেখো...ওই যে!
আমি দাঁতে দাঁত চেপে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মামানি এবার মিষ্টি হেসে আমার হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
- রাগ করে না। দ্বিতীয় কথাটা তো খারাপ বলে নি,রাগ করছিস কেন? যায় হোক ইফতার টাইম তো হয়ে এলো। তোদের কাজ কতদূর?
শুভ্র ভাই গ্যাসটা বন্ধ করে দিয়ে কিচেন থেকে বের হতে হতে বলে উঠলেন,
- আমার রান্না তো শেষ। এবার সার্ফ করার দায়িত্ব বাড়ির বউয়ের। তাহাকে বলো... আমি আর নাই।
কথাটা বলেই রুমে ঢুকে গেলেন উনি। মামানিও মুচকি হেসে নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলেন। আমি একা এক অবলা নারী দাঁড়িয়ে আছি রান্না ঘরে। উনি কি বুঝিয়েছেন তা যে বুঝি নি তা নয়। বুঝেছি কিন্তু এমনটা কেনো বললেন সেটা বুঝতে পারছি না। সবসময় অদ্ভুত কথা বলেন কেন উনি?
ইফতার শেষে শুভ্র ভাইয়ের রুম গুছাচ্ছিলাম। মামানি উনাকে বাইরে কিছু কিনতে পাঠিয়েছেন। বুক সেল্ফের বইগুলো গুছানো যখন শেষের দিকে ঠিক তখনই কানে এলো ফোনের একটা টোন। টোনটা কানে যেতেই ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরে তাকালাম। বিছানার উপর শুভ্র ভাইয়ার ফোন। কৌতূহল নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো "A message from Anika" উনার পাসওয়ার্ড জানা ছিলো আমার। কয়েকমুহূর্ত দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে ম্যাসেজটা সিন করেই ফেললাম আমি। ম্যাসেজটা দেখে কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছিলো আমার। কেমন অনুভূতি হচ্ছিলো জানি না। শুধু মনে হচ্ছিলো এই মুহূর্তে শুভ্র ভাইকে মেরে ফেলি আমি। মাত্র কয়েকটা লাইনের ম্যাসেজ ছিলো ওটা কিন্তু এ কটা লাইনই অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়েছিলো আমায়। সেখানে লেখা ছিলো,
"❤
অনেকটা বছর কাটিয়ে দিলাম একসাথে। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলো পুরো ভার্সিটি লাইফ। তোমার হাতে হাত রেখে এতোটা দিন পাড়ি দিয়েছি ভাবতেই অবাক লাগে এখন। তোমার দেওয়া শিউলি ফুলের মালা খোপায় জড়িয়ে অনভ্যস্ত হাতে শাড়ি পড়ে কতটা অজানা পথ পাড়ি দিয়েছি আমরা। এখনও তুমি হাত ধরলে কেঁপে উঠি আমি। মনে হয় এটাই সেই প্রথম স্পর্শ।। দিনগুলো ধীরে ধীরে স্মৃতিগুলোকে পুরাতন করে তুললেও ভালোবাসাটাকে কিন্তু আরো গভীর করে তুলছে। তাই এতো বছর পরও কতো শিহরণ নিয়ে বলছি তোমায়। " ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি শুভি।"
ম্যাসেজটা পড়েই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। চোখ দুটো উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরছে এদিক সেদিক। চোখের পানি পড়তে যে মানা আমার। ফোনটা হাতে নিয়েই ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎই শুভ্র ভাইয়া রুমে ঢুকলেন। আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,
-- কি রে? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
কান্নায় চোখ ভেঙে আসছিলো আমার। তবু কন্ঠ পরিষ্কার করে ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে শক্ত গলায় বলে উঠলাম আমি,
-- ঘর গুছাচ্ছিলাম শুভ্র ভাই।
কথাটা বলেই পাশ কাটিয়ে বুক সেল্ফের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাকি বইগুলোও তাড়াহুড়ো করে গুছাতে লাগলাম আমি। যেন কাজ ফুরালেই রেহাই আমার। এই লোকটাকে আমার এক মুহূর্ত সহ্য হচ্ছে না আর! এক সেকেন্ডের জন্যও না। উনি ফ্যানের সুইচ দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুয়ে থেকে চট করে ওঠে বসে শীতল কন্ঠে ডাকলেন,
-- রোদ!
আমি কোনো কথা না বলে বই গুলো গুছানো শেষ করে বললাম,
-- উফফ, শেষ! আপনার ঘর গুছানো শেষ শুভ্র ভাই। এবার আসি আমি। দেরী হয়ে গেছে...বাসায় যাবো।
কথাটা বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতেই খপ করে হাত ধরে ফেললেন উনি। করুণ গলায় বলে উঠলেন,
-- তুই আমার কথাটা শোন।
-- শুভ্র ভাই আমার দেরী হচ্ছে, হাত ছাড়ুন।
-- তততুই যেমনটা ভাবছিস তেমন কিছু নয়। আমি...
-- আপনার কাছে কোনো এক্সপ্লেইনেশন চাই নি আমি শুভ্র ভাই। আপনার লাইফে কে থাকবে আর কে থাকবে না সেটা নিতান্তই আপনার ব্যাপার। প্লিজ ছাড়ুন আমায়। আর হ্যা, ফোন টাচ করার জন্য সরি!
-- দেখ রোদ। তুই কিন্তু আমাকে ভুল বুঝছিস।
-- আশ্চর্য! আমি আপনাকে ভুল বুঝবো কেনো? ছাড়ুন তো...জাস্ট লিভ মি! আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না। ছাড়ুন।
কথাটা বলে উনার হাতটা ছাড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতেই টেনে দরজার সাথে দাঁড় করিয়েই গালে বসালেন চড়। আমি হতভম্ব হয়ে উনার দিকে তাকালাম। মুহূর্তেই চোখদুটো টলমল করতে লাগলো জলে। না ব্যাথা নয়...এই কান্না তো লজ্জার! চরম লজ্জার! উনি দু'হাতে নিজের চুল খামচে ধরে জোড়ে শ্বাস টেনে কিছুটা শান্ত হয়ে আমার গালে হাত রেখে বলে উঠলেন,
-- সরি! কাঁদিস না প্লিজ। দরকার হলে আমায় দুটো মার তবু প্লিজ কাঁদিস না। সবসময় এত জেদ কেন করিস তুই? কখনো তো আমার কথাটা শোন।
আমি আচমকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম উনাকে। আমাকে আবারও ধরার আগেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম আমি। ড্রয়িংরুমে যেতেই দেখা হলো মামানির সাথে। উনি অবাক চোখে বললেন,
-- কোথায় যাচ্ছিস? আর গালে ওমন লাল হয়ে আছে কেন?
-- বাসায় যাচ্ছি মামানি। এলার্জির সমস্যা হচ্ছে খুব। টেবলেট নিতে হবে। দেখো না গাল চুলকিয়ে লাল করে ফেলেছি। অন্য একদিন এসে থাকবো, আজ যাই।
-- একা যাবি নাকি? শুভ্রকে পাঠাই ও গিয়ে টেবলেট আনুক। তোর যেতে হবে না।
-- না মামানি। আমি বাসায় যাবো।
কথাটা বলে সামনে এগুতেই আমাকে আর মামানিকে অবাক করে দিয়ে আবারও হাত চেপে ধরলেন শুভ্র ভাই। মামানি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। আমি রাগী চোখে তাকাতেই বলে উঠলেন উনি,
-- দেখ রোদ। ওর সাথে আমার সম্পর্কটা...
-- হাতটা ছাড়ুন শুভ্র ভাই।
-- রোদ প্লিজ।
-- আমি বাসায় যাবো শুভ্র ভাই। হাতটা ছাড়ুন। ( ঠান্ডা গলায়)
শুভ্র ভাই কি ভেবে মাথা নিচু করে হাতটা ছেড়ে দিলেন। হয়তো মামানিকে খেয়াল করেন নি এতোক্ষণ। আমি আর কিছু না বলে চুপচাপ বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। চারদিকে জমাট অন্ধকার তারসাথে অন্ধকার আমার চোখে মুখেও। রাস্তায় পথচারী খুবই কম যেন, বিলুপ্ত প্রায় কোনো শহর। এই নিস্তব্ধতা বড্ড প্রয়োজন ছিলো আমার। বড্ড বেশিই প্রয়োজন। বাসায় এসেই দরজায় ছিটকানি টেনে শুয়ে পড়লাম আমি। সবকিছু ভেঙেচুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে আমার। সেই ভাঙাচুরা আটকাতেই এই ভাঙাচোরা মন নিয়ে কাঁথার নিচে ঠাঁই নিলাম আমি। ফুঁপিয়ে কেঁদে কমিয়ে নিলাম এক আকাশ সমান কষ্ট। তারসাথে করে নিলাম আরো একটা প্রতীজ্ঞা! এ জীবনে আর উনার ধারে কাছে যাবো না আমি। কিছুতেই না।
বিকাল ৩ টা। রুমে বসে চিপস খাচ্ছি । তখনই শুভ্র ভাইয়ার কথা কানে এলো। দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে কানে পেতে রইলাম, কি বলে শুনবো বলে। কয়েক সেকেন্ড পর আবারও কানে এলো রাফিয়ার কন্ঠ,
-- আরে শুভ্র ভাইয়া। কেমন আছেন? অসুস্থ নাকি? চোখ- মুখ কেমন একটা লাগছে।
-- না। ঠিক আছি। রোদ কোথায় রাফিয়া?
-- রোদ তো রান্না ঘরে ছিলো। কেনো ভাইয়া?
-- কিছু না।
তারপর আবারও নিশ্চুপ। আমি এবার বিছানায় গিয়ে বসলাম। গত তিনদিন ধরে উনার সামনে যাওয়া বন্ধ করেছি আমি। উনি বাসায় এলেই দরজা বন্ধ করে বসে থাকি। মামানি যেতে বললেও কোনোভাবে কাটিয়ে দিই উনাকে। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার এমনকি ফোন নাম্বারও ব্লক লিস্টে রেখে দিয়েছি যেনো উনার সম্মুখীন না হতে হয়। কিন্তু এবার তো উনি সরাসরিই খোঁজ করছেন আমার। উনার কথার আওয়াজে ঘোর ভাঙলো আমার। বাইরে থেকে হালকা কথার আওয়াজ ভেসে আসছে। আমি কান পাততেই,
-- রোদ তো রান্না ঘরে নেই রাফিয়া। কোথায় ও? প্লিজ বলবা?
-- আই থিংক রুমে আছে ভাইয়া। দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ।
রাফিয়ার কথায় উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
-- ওহ! ফুপ্পি কোথায়?
-- জেঠীমনি তো ছাদে গিয়েছিলো। ওই তো, ওই যে জেঠীমনি।
-- আরে শুভ্র! কখন এলি? ভাবির শরীর কেমন রে এখন? চোখ- মুখ এমন লাগছে কেন? জ্বর টর উঠেছে নাকি?
-- নাহ ফু্প্পি। জ্বর উঠে নি। আম্মুর শরীরটা তেমন ভালো না। তাই রোদকে নিতে পাঠিয়েছে আম্মু। বাবা বাসায় নেই রাতে মার কাছে কেউ তো থাকা উচিত। আমি তো আর থাকতে পারি না.... তাই..
-- তা তো ঠিকই। আমি তোকে বললাম ভাবিকে নিয়ে ক'দিনের জন্য আমাদের বাসায় চলে আয়। তা তো শুনলি না। দাঁড়া রোদকে ডেকে দিচ্ছি আমি।
তারপর শুনা গেল পায়ের শব্দ। কিছুক্ষণ পরই মায়ের গলা ফাঁটা চিৎকার।
-- রোদ? রোদ? দরজাটা খোল। শুভ্র তোকে নিতে এসেছে।
-- আমি যাবো না মা।
-- যাবি না মানে কি? তোর মামানি অসুস্থ আর তুই যাবি না? এটা কোন ধরনের ব্যবহার রোদ?
-- মা? এটা খুব ভালো ধরনের ব্যবহার। আমি যাবো না মানে যাবো না। রাফিয়াকে বলো ও চলে যাবে।
আমার কথায় রাফিয়া যেন আস্ত চাঁদ হাতে পেয়ে গেলো। লাফিয়ে উঠে বলে উঠলো,
-- হ্যা জেঠীমনি, আমি যেতে পারি। আমার কোনো সমস্যা নেই।
-- তুই সমস্যা নেই বললেই হলো? তুই আমার বাসায় মেহমান আর আমি তোকে আমি আমার ভাবির সেবার জন্য পাঠাবো? নিজের দু' দুটো মেয়ে থাকতে অন্যের মেয়ে পাঠাতে হবে আমায়?রোদ? বের হ বলছি।
-- মা? মামুর বাসায় যাওয়ার জন্য অলওয়েজ আমাকেই কেন চোখে পড়ে তোমার? তোমার বড় মেয়েকে পাঠাও৷ সে সর্বদা গোছালো মেয়ে। আরো ভালো সেবা করতে পারবে। আমাকে বিরক্ত করো না।
আমার কথার উত্তরে মাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শুভ্র ভাইয়া বলে উঠলেন,
-- সরি ফুপ্পি। তোমাদের প্রবলেমের মধ্যে ফেলে দিলাম আমি। বাদ দাও...আই উইল টেইক কেয়ার অফ হার। ছেলে থাকতে আর মায়ের কি চিন্তা। আসছি!
উনার কথাটা যেন বুকে গিয়ে লাগলো। সত্যিই কি মামানি অনেক বেশি অসুস্থ? নিজের জেদ ধরে রাখতে গিয়ে কি বেশি বলে ফেললাম আমি? কথাটা ভেবেই বিছানা থেকে ওড়না আর ফোনটা নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাম আমি। রাফিয়া আর মা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাদের দেখেও না দেখার ভান করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। শুভ্র ভাইয়া তখন গেইটের কাছেই ছিলেন। আমি উনাকে পাশ কাটিয়ে হাঁটা দিলাম। উনি আমাকে দেখেও কিছু বললেন না। রাস্তা ধরে হাঁটছি। আমি সামনে আর উনি আমার পেছনে। হঠাৎ করে কোথা থেকে সাইম এসে হাজির। আমাকে দেখেই দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো,
-- কেমন আছো রোদাপু?
-- ভালো, তুমি?
-- একদম ফার্স্টক্লাস। মুরগী কিনতে গিয়েছিলাম। বার্বিকিউ বানানো শিখেছি, আজ বানাবো। খাবে রোদাপু?
-- আজ নয়। অন্য কোনোদিন।
সাইম হাসলো। আমার পেছনে শুভ্র ভাইয়াকে থেকে একরকম লাফিয়ে উঠলো সে। এলাকার প্রিয় "শুভ্র ভাই" বলে কথা! উনাকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে বলে উঠলো,
-- ভাইয়া কেমন আছো?
-- আমি সেকেন্ডক্লাস আছি শালাবাবু।
উনার মুখে "শালাবাবু" শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম । উনি সামিয়া আপুর সাথেও কোনো রিলেশনে আছেন নাকি? কথাটা মনে পড়তেই রাস্তার ইট তুলে এক বাড়িতে মাথা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে উনার। আমার পেশীতে পেশীতে যখন রাগ রি রি করছে ঠিক তখন সাইম সবকিছুকে উড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
-- কোথায় গিয়েছিলে ভাইয়া? আজকে বারবিকিউ করবো....চলো না আমার বাসায়।
-- তোর বোনের বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম। এখন সোজা বাসায় যেতে হবে। অন্য কোনোদিন তোর বানানো বারবিকিউ খাবো। তোকে নতুন রেসিপিও শিখিয়ে দিবো। এবার বাড়ি যা।
-- আচ্ছা ভাইয়া।
কথাটা বলেই মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে চলে গেলো সাইম। আমি একবার উনার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আবারও হাঁটা দিলাম। উনি আমার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলেন। কয়েক পা এগুতেই বলে উঠলেন,
-- ইশ! চারপাশে কি গরম।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে উনার দিকে তাকাতেই কেঁশে উঠলেন উনি। জোড়পূর্বক হাসি টেনে নিয়ে বললেন,
-- গরম লাগছে তো। তাই বললাম আরকি। অন্যকিছু নয়।
উনার কথায় রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পনেরো মিনিটের রাস্তা দশ মিনিটে পাড় করলাম। দরজায় কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলেন মামানি। আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলে উঠলেন,
-- রোদরাণী এসেছে দেখছি। মামানিকে ভুলে গেছিস একদম?
-- তোমাকে ভুলা তো ইম্পসিবল মামানি। এখন ঝটপট বলো কি কি খাবে ইফতারে। টাইম অনেক কম।
-- ওরে বাবা। পিচ্চিটার কি বড় বড় কথা। বিয়ে দিয়ে দেওয়া যাবে এখনই। (গাল টিপে) কিন্তু আর পাকামো করতে হবে না তোমায়। চুপচাপ বসে থাক। আমি রান্না করছি।
-- একদম না। আমি এসেছি যখন আমিই রাঁধবো। নয়তো এখনই চলে যাবো। এই গেলাম কিন্তু...যাবো?
আমার কথায় হেসে উঠলেন মামানি। একহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন,
-- হয়েছে আর নাটক করতে হবে না। তুই-ই রান্না কর আমি পাশে বসে দেখি। আ...
মামানির কথার মাঝপথেই শুভ্র ভাইয়া ঘরে এলেন। মামানিকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,
-- তোমাকে এখানে বসতে হবে না আম্মু। তুমি এমনি অসুস্থ এই গরমে চুলোর কাছে যাওয়ার মানেই হয় না। যাও রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।
-- আমি অতো টাও অসুস্থ নই শুভ্র। তুই যা... মা-মেয়েকে কাজ করতে দে।
-- আম্মু!( করুণ কন্ঠে) বুঝো না কেন?
কথাটা বলেই মামানিকে টেনে নিয়ে কানে কানে কি সব ফুসুরফুসুর করলেন আল্লাহ মালুম। মামানিও মুচকি হেসে শুভ্রর হাতে একটা চড় বসালেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- শুভ্র এতো করে যখন বলছে আমি বরং রেস্টই নিই। তুই দেখ কি রান্না করবি।
কথাটা বলে একমুহূর্ত দাঁড়ালেন না মামানি। ধীর পায়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকেই গেলাম রান্না ঘরে। বিরিয়ানির জন্য পিঁয়াজ - মরিচ কাঁটছি এমন সময় শুভ্র ভাই পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমি দেখেও না দেখার ভান করে কাজ চালাতে লাগলাম। উনি কিছুক্ষণ ভদ্র ছেলের মতো দাঁড়িয়ে থেকেই শুরু করলেন উনার ফাজলামো।হালকা কেশে বলে উঠলেন,
-- এখনো রেগে আছিস রোদপাখি?
আমি কিছু বললাম না। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে আমার। রাগ করার মতো কাজ করে রেগে আছি কি না জিগ্যেস করা হচ্ছে। বাহ্ অসাধারণ! আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে কাছে এসে ঘাড়ে ফু দিতে লাগলেন উনি। উদ্দেশ্য আমাকে বিরক্ত করা। কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় আমার পেটে কোমরে চিমটি দিতে লাগলেন উনি। সাথে সাথেই রাগটা চরমে পৌঁছে গেল। উনাকে ধাক্কা দিয়ে ফ্রিজের সাথে দাঁড় করিয়ে হাতের চাকুটা উনার গলার কাছে ধরে বলে উঠলাম,
-- কি শুরু করেছিস তুই? হুম? কিছু বলি না বলে যা ইচ্ছে তাই করবেন? চাঁকু দিয়ে গলা কেটে ময়মনসিংহের মার্কেটে ঝুলিয়ে রাখবো। আনিকা তোর জানের জান তো ওর কাছে যা না...আমার কাছে কি হ্যা? আমার কাছে কি? ইচ্ছে তো করছে একদম খুন করে ফেলি। আমা..
এটুকু বলতেই বামহাতে শক্ত করে কোমর জড়িয়ে ধরে ডানহাতে হাতের চাকুটা ছিনিয়ে নিয়ে চেপে ধরলেন আমার গলায়। ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন,
-- জানু! তোমার সাহস তো দেখি খুব বেড়ে গেছে। এতো সাহস কোথায় পাও তুমি? (ভ্রু নাচিয়ে) এবার কি হবে সোনা? চাঁকু তো আমার হাতে, মেরে ফেলি? জন্মানোর পর থেকে জ্বালাচ্ছিস আমায়। আগে আমার পিছু পিছু ঘুরে আমায় জ্বালাতি এখন আমাকে পিছু ঘুরিয়ে জ্বালাচ্ছিস।(চাকুটা আরেকটু চেপে ধরে) তুই যে ইচ্ছে করে জ্বালাস আমায় সেটা কিন্তু আমি জানি। তোর কি ধারনা আমি বুঝি না? ইচ্ছে তো করে চাকু দিয়ে কেটে কুঁচিকুঁচি করে বোয়ামে ভরে রুমে সাজিয়ে রেখে দিই। এটলিস্ট সামনে তো থাকবি। আল্লাহ্ যদি একটা খুন মাফ করতো বিশ্বাস কর আমার হাতে খুন হতি তুই। একদম শেষ করে ফেলতাম তোকে। জীবনে বোঝার চেষ্টা করছিস আমায়? কে না কে একটা ম্যাসেজ দিলো তাতেই পৃথিবী উল্টে ফেলছিস। তোর কি ধারনা আমি জানি না তোর ফোনে কি চলছে? প্রতিদিন একটা না একটা আবেগমাখা ম্যাসেজ আসে তোর কাছে। একমাস ধরে একটা ছেলে একটানা তোর ফোনে দিন- রাত সময় করে " আই লাভ ইউ " ম্যাসেজ পাঠায়। মাঝে মাঝে ফোন দেয়। তুই "হ্যালো" বলিস আর সে কন্ঠ শুনে কেটে দেয়। অন্যকেউ তোর কন্ঠ শোনার জন্য কল দিচ্ছে তা জানার পর আমার জাস্ট তোর এই গলাটায় কেটে ফেলতে ইচ্ছে করে। তবু আমি কিছু বলেছি? বলি নি কারণ তাতে তোর কোনো রেসপন্স ছিলো না। আর যদি তোর রেসপন্স থাকতো তাহলে তোকে সেই কবেই খুন করে ফেলতাম। আমি এতোটা রাগচটা মানুষ হয়ে চুপ থাকতে পারলে তুই কেন পারবি না? একটা ম্যাসেজ দেখেই সামনে আসা বন্ধ করবি কেন?
-- ছাড়ুন। লাগছে আমার..
-- লাগার জন্যই দিচ্ছি। তোকে আদর করছি না যে তোর ভালো লাগবে। চুপচাপ দাঁড়া নয়তো গলা কেটে আলাদা করে ফেলবো। (কোমরে চাপ দিয়ে) সেদিন কোন সাহসে বেরিয়ে গেলি বাসা থেকে? ওহ ওয়েট...আগে আপনার ভুল ধারনা ভেঙে নিই তারপর সারারাত শাস্তি চলবে আপনার। আপাতত শাস্তি স্টপ।
কথাটা বলে আমাকে ছেড়ে দিয়ে কাউকে ফোন লাগালেন উনি। ফোনটা লাউডে দিয়ে আমার সামনে ধরলেন। আমি একহাতে কোমর আরেক হাতে গলা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। দুই জায়গাতেই ব্যাথা করছে খুব। কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে সুমিষ্ট কন্ঠে কথা বলে উঠলো একটা মেয়ে,
-- হ্যালো?
-- তোর হ্যালো মাই ফুট। এতো দেরী হলো কেন ফোন ধরতে অসভ্য মহিলা।
-- আরে ইফতার বানাচ্ছিলাম। পুড়ে যাবে তো তাই....
-- আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তুই ইফতার পুড়া বাঁচাচ্ছিস? বেয়াদব।
-- আরে ব্যস! আমি আবার কি করলাম।
-- হারামি! জানিস না কি করছিস? ওই থার্ডক্লাস মার্কা ম্যাসেজ কেন পাঠিয়েছিস আমায়? এখন আমার জীবন নিয়ে টানাটানি। বিয়ের পর জামাইয়ের মাইর খাবি তুই, দেখে নিস।
-- ওহ্ শিট৷ রোদ এখনও রেগে আছে নাকি?
-- নাহ! তোমার অতো সুন্দর ম্যাসেজ দেখে রোদ রেগে থাকবে না আমাকে এসে আদর করবে। ডাফার!
-- আমি কি জানতাম নাকি এতোকিছু হয়ে যাবে। জিসানকে বা আসিফকে এই ম্যাসেজ পাঠাইলে ওরা এটা নিয়া ট্রল করতো। তুই তো ওমন না তাই তোরে পাঠাইছি। আর তাছাড়া তোরে নিয়ে প্রেমময় বাক্য বলা যায়, ফিল আসে।
-- চুপ কর বইন। সব ফিল তোর জামাইয়ের জন্য তুলে রাখ। আমি তোর নিজের ভাইয়ের মতো। আমার দিকে ফিল ফিল নজরে তাকিয়ে আমার সুখের সংসার ধ্বংস করে দিস না। রোদ আমার সামনে চাকু হাতে দাঁড়িয়ে আছে। যেকোনো সময় ঢুকিয়ে দিবে পেটে।
-- রোদ তোর সামনে বুঝি? আচ্ছা ওকে দে..ব্যাপারটা আমি বিশ্লেষণ করছি।
-- বিশ্লেষণ করে ফেল ও শুনছে।
-- হ্যালো রোদ?
-- জি আপু!
-- কেমন আছো আপু?
-- জি ভালো, আপনি?
-- আমিও ভালো। এই দেখো না, আমার জন্য তোমাদের মধ্যে কি একটা ঝামেলা হয়ে গেল। আমি আসলে এতোকিছু ভেবে দিই নি ম্যাসেজটা। আমাদের ক্যাম্পাসের গ্রুপে ট্রুথ ডেয়ার হচ্ছিল। দুর্ভাগ্যবশত আমি ডেয়ার নিই। আর আমাকে কোনো ছেলেকে রোমান্টিক একটা ম্যাসেজ সেন্ড করতে বলা হয় এবং প্রমাণ হিসেবে তার স্ক্রিনশটও দিতে বলা হয়। আমি পড়ে যায় ফ্যাসাদে, জিসান, আসিফ,আনিকেত ওদের দিলে ওরা এটা নিয়ে ট্রল করতো। আমাকে ইচ্ছে মতো পঁচাইতো কিন্তু সেদিক থেকে শুভ্র সেইভ। শুভ্র কখনোই এমন টাইপ কাজগুলো করে না। তাই আর কিছু না ভেবে ওকেই সেন্ড করে দিলাম। আর তুমি সেই ম্যাসেজটা দেখেই রেগে বোম হয়ে গেলে। শুভ্র সেদিন আমায় কি পরিমান ঝাড়ছে জানো তুমি? প্লিজ আর রাগ করে থেকো না নয়তো শুভ্র আমায় সত্যি সত্যি তোমাদের ব্রক্ষ্মপুত্রে চুবাবে। রোদ শুনছো?
-- জি আপু শুনছি।
-- গ্রেট! তো ফটাফট তোমার রাগে পানি ঢালো। আর আমার দোস্তটাকে একটু শান্ত করো। ওর মাথাটা গেছে।
-- একটা থাপ্পড় মারবো। আমার মাথা গেছে না? ফারদার এমন গদগদ টাইপ ম্যাসেজ পাঠালে তোকে আমি গুণে গুণে ১০০ বার ব্রক্ষ্মপুত্রে চুবাবো বলে দিলাম।
-- শিক্ষা হয়ে গেছে রে। জীবনে আর ট্রুথ অর ডেয়ারই খেলতাম না আমি।
-- ভালো ডিসিশন এবার যা গিয়ে ইফতার পুড়া।
-- ওহ শিট! আমার ইফতার। বাই রে। আর এইযে শুভ্রর পুচকি? তোমার উনি কোনো মেয়ের দিকে তাকায় না বুঝলা? সো তোমার এই ছোট্ট মাথা এতো ঘামিও না তো। কুল বেবি।
-- এই তুই যাবি?
-- ধমকাস কেন হারামি। যাচ্ছি তো, বাই রোদ।
উনি ফোনটা কেটে আমার দিকে তাকালেন। আমি মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। চড় টর খাওয়ার জন্য আমি মানুষিকভাবে প্রস্তুত। কিন্তু আমার এতোসব প্রস্তুতিতে জল ঢেলে উনি চুলোর পাশে পা ঝুলিয়ে বসে পড়লেন। আমার গায়ে একটা পেঁয়াজ ছুঁড়ে মেরে বলে উঠলেন,
-- কি রে? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? রান্না কর। এখন কিছুই করবো না। রোজাদার ব্যক্তি হয়ে ওসব কিছু করা যাবে না। আগে ইফতার শেষ হোক তারপর বুঝবি।
আমি সন্দেহী চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনার মাথায় কি চলছে তা বুঝার সাময়িক চেষ্টা মাত্র। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারও ব্যর্থ হতে হলো আমায়। আর এই কথাটা বিশ্বাস করে নিতে হলো যে, " উনাকে বুঝা আমার সাধ্যে নেই " একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিঁয়াজ কাঁটতে কাঁটতে জিগ্যেস করলাম,
-- ফ্রিজে টক দই আছে?
উনি গেইম খেলছিলেন। ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলেন,
-- কেন খাবি?
-- নাহ্ বিরিয়ানিতে লাগবে।
আমার কথায় ছোট্ট করে বললেন "ওহ!" নেমে গিয়ে ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে বাটিতে ঢাললেন। আমার হাত থেকে চাকুটা কেড়ে নিয়ে লেবু কেটে লেবুর রস ঢাললেন দুধে। চাকুটা আবারও আমার হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলেন,
-- তুই পেঁয়াজ কাটতে কাটতে টক দই হয়ে যাবে।
কথাটা বলে দুধের বোতলটা ফ্রিজে রেখে আমার সামনে মিষ্টির বাটি রাখতে রাখতে বললেন,
-- খেতে খেতে কাজ কর। কালো মিষ্টি তো তোর প্রিয়।
আমি অবাক চোখে উনার দিকে তাকালাম। এটা কি সত্যি শুভ্র ভাই তাই বোঝার চেষ্টা। রোজার দিন খেতে বলার মানুষ তো উনি নন। তাহলে?
আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে উঠলেন উনি,
-- এভাবে তাকানোর কিছু নেই। আমি জানি তুই রোজা না। তোর সাথে দেখা না হলেও তোর সম্পর্কে সবই জানা আমার। সো ভাব না মেরে খা। রোজা যেহেতু রাখিস নি শুধু শুধু না খেয়ে থাকার তো কোনো মানে হয় না।
-- আপনি কি করে জানলেন?(অবাক চোখে)
আমার কথায় বাঁকা হেসে চোখ টিপলেন উনি। উনার হাসি দেখেই গা জ্বলে গেল আমার। বিরবির করে বললাম, " অসভ্য। " আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে আবারও গেমস্ খেলায় মেতে উঠলেন উনি। বিরিয়ানি রান্নার প্রায় শেষের দিকে হঠাৎই বলে উঠলেন,
-- আচ্ছা? ঈদের শপিং করবি না?
-- না।
-- না মানে? না কেন?
-- বাসা থেকেই বের হবো না তো ঈদের জামা দিয়ে কি করবো? ঈদের জামা পড়ে কি কম্বলের নিচে শুয়ে থাকবো?
-- তাই বলে কিছুই কিনবি না? এটা কিছু হলো? শুন এবার জামা না কিনে শাড়ি কিনবি। একদম কালো জামদানী। তারসাথে পড়বি ছোট্ট কালো টিপ। চোখে গাঢ় করে কাজল। ঠোঁটে হালকা গোলাপী লিপস্টিক। আর চুলগুলো খোলে দিয়ে হয়ে যাবি মায়াবতী। আমি সেদিন তোর খোঁপায় দশটা কালো গোলাপ গুঁজে দিবো।
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে উনার দিকে তাকালাম। তারপর বললাম,
-- দরকার নেই। আমার মায়াবতী রূপবতী কোনোকিছু হওয়ারই শখ নেই। আপনার এতো মায়াবতী দেখতে ইচ্ছে করলে আপনার বউকে গিয়ে বলুন যান।
আমার কথায় হেসে উঠলেন উনি। মাথায় চাটি মেরে বলে উঠলেন,
-- এজন্যই তো তোকে বললাম গাধী।
আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ উনাকে দেখে গেলাম । তারপর বিরিয়ানি নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আসলে ব্যস্ততার মাঝে একরাশ লজ্জা লুকানোর ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলাম। ব্যস্ততার আড়ালে লজ্জা লুকানোর কি অপরিসীম ব্যস্ততা আমার!
Writer:- নৌশিন আহমেদ রোদেলা