> একজন মাস্টারশেফ কিশোয়ার আর লক্ষ কোটি অজানা অচেনা বাংলাদেশী - কিশোয়ার চৌধুরী - MasterChef - Kishwar chowdhury
-->

একজন মাস্টারশেফ কিশোয়ার আর লক্ষ কোটি অজানা অচেনা বাংলাদেশী - কিশোয়ার চৌধুরী - MasterChef - Kishwar chowdhury

কত মানুষকে দেখলাম ৫ বছরও হয় নাই বাংলাদেশ ছেড়ে আসছে, অথচ পুরোদমে অষ্ট্রেলিয়ান, ক্যানাডিয়ান সাজতে চায়। দেশের কথা উঠলেই, 
 

‘My God, ওখানে মানুষ থাকে? আল্লাহ্‌ বাঁচাইছে জান নিয়ে চলে আসছি।’
 

একজনকে একবার দেখলাম ৩০ মিনিট কারেন্ট নাই দেখে পোস্ট দিছে, “Oh Allah! ৩০ মিনিট কারেন্ট নাই। লিফট চলে না। বাসার নিচে দাঁড়ায়ে আছি। আমার কী হবে? হ্যা আল্লাহ্‌ রহম করো!” অথচ সারাজীবন ৮ ঘন্টার লোড-শেডিং এ থাকতো!
  

আরেকজন, “বাংলাদেশে হাসপাতালে গিয়ে কোন সেবা পাবেন? ইমার্জেন্সিতে মানুষ মরে পড়ে থাকে।” আমি বললাম কোন হাসপাতালের কথা বলেন? আমি তো অহেতুক কাউকে মরে পড়ে থাকতে দেখি না। বরঞ্চ এখানকার হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে যেয়ে একদিন ৪ ঘন্টা বসে থেকে এমনি সুস্থ হয়ে চলে আসছি, কারও দেখা পাই নাই। 
  

সেদিন একজন কথায় কথায় বলল, “ভাই আপনি পৃথিবীর ১২ নাম্বার টপ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, ছাত্রদের পড়ান, বুঝেন এদের শিক্ষার মান, আমাদের দেশের অবস্থা দেখেন, খালি দলাদলি, আর টেন্ডারবাজি।” 
  

আমি উনাকে বললাম ভাই আপনি কোন জমানার মানুষ। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করছি ১৫ বছর হয়ে যাচ্ছে, তখনও এসব দেখি নাই। আর কোয়ালিটির কথা বলেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত একাডেমিক পড়ালেখার দিক দিয়ে অন্যদের সাথে পাল্লা দিয়ে পারি নাই, অথচ এরপর ব্র্যাক আর এখানে, যত উপরের র‍্যাংকিং এর কথাই বলেন না কেন সবার চাইতে নিজেকে কোন অংশে কম মনে হয় নাই, বরঞ্চ টপই মনে হয়। আমতা আমতা করে সেই ভদ্রলোক বিদায়। 
  

এই হচ্ছে দেশ থেকে চলে আসা ‘যদি, কিন্তু, তবু’ ভাই-বোনদের অবস্থা। এক লাইন ইংরেজি লিখতে পারে না (আমার মতোই), কিন্তু ক্যানাডিয়ান বাংলাদেশীদের গ্রুপগুলাতে দেখি দিস্তার পর দিস্তা আতলামি পোস্ট দিয়েই যাচ্ছে। দেশে থাকলে জীবনেও তাদের এসব হীনমন্য ভাবনাকেন্দ্রিক লেখা কাউকে পড়াইতে অথবা চিন্তা কাউকে শোনাইতে পারত কিনা সন্দেহ (মানের কারণে), আর এখানে এসে শিয়াল বনে রাজা হইছে সবাই (মানের যদিও কোন উন্নতি হয় নাই!)। 
  

এই হইতেছে লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশী, বিশেষত যারা শিক্ষিত, পয়সাওয়ালা; এবং আমেরিকা, ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলাতে আছে, তাদের অবস্থা। 
  

এর বাইরে অনেকেই আছে দেশে থাকতে জীবনে কোথাও কোন ভূমিকা রাখে নাই, এখানে এসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে হাসপাতালের ডাক্তার, পুলিশ, সাংবাদিক সবাইকে চোর ছ্যাঁচোড় বলতে বলতে গলার রগ ছিঁড়ে ফেলতেছে। এরা প্রত্যেকেই ভাবে তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবার যোগ্য, নিদেনপক্ষে একজন সচিব তো বটেই। 
 

অথচ দেশ নিয়ে তেমন গর্ব নাই, দেশের প্রচার-প্রসারও নাই। বিভিন্ন ডিনারে, আড্ডায়, মিটিং এ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলবে, 
  

“You know the health system of Bangladesh, terrible!”
 
“You know the civil service, corrupted!”
 
“You know people there? uncultured, uncivilized.”
 
“Are you seriously planning to go to Bangladesh? Don’t go. There are mosquitoes, robbers, heat, ISIS and dengue!”
 

যেসব বিদেশীদের এসব কথা বলা হয়, পরবর্তীতে ঘনিষ্ঠ হবার কারণে দেখেছি, সেই সব বিদেশীরাই এসব মানুষকে পছন্দ করে না নিজের দেশকে সম্মান না করার জন্য।  
 

অথচ তুই ব্যাটা ঠিকই প্রতিবছর দেশে যেয়ে তোর বাপের হাড়-ভাঙ্গা খাটুনির জায়গা-জমি সব বেঁচে এখানে এসে খরচ করে তারপর দেশকে গালিগালাজ করিস!  
  

এত কথা বলতেছিলাম আসলে অষ্ট্রেলিয়ান মাস্টারশেফ প্রতিযোগি কিশোয়ারের কথা বলার ভূমিকা হিসেবে। অষ্ট্রেলিয়ায় বেড়ে উঠা মানুষটির কথা যত শুনি, যত পড়ি, তত শ্রদ্ধা হয়, ভালোবাসা জাগে। যাদের দেশের জন্য হাহাকার করার কথা ছিল, দেশকে মাথার উপর তুলে নাচার কথা ছিল, যারা বাংলাদেশের স্বাধীন মাটিতে জন্ম নিয়ে ধন্য হবার কথা, তারাই 'ফাকা কলসি বাজে বেশী' স্টাইলে বিদেশী সাজতে চায়, অথচ কিশোয়ারের যেখানে সব সুযোগই ছিল বাংলাদেশকে ভুলে যাবার, অস্বীকার করার, সেখানে তিনি সেই সুযোগকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে হৃদয়ে বাংলাদেশকে আঁকড়ে ধরেছেন। 
 

যেখানে আলু ভর্তাকে ‘স্ম্যাসড পটেটো’ (ম্যাশডও কয় না, স্ম্যাসড কয়), 
গরু-পরোটাকে ‘বিফ পারাঠা’, রুটিকে ‘দেশী রোঠী’, সিঙ্গারাকে 'সামোসা', দই-বড়াকে ‘দাহি-বাড়া’ বলতে বলতে আল-জিহবা শহিদ করে ফেলতেছে কিছু কুলাঙ্গার প্রবাসী বাংলাদেশী, সেখানে কিশোয়ার অষ্ট্রেলিয়ার মাটিতে পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি পান্তা ভাত, আলু ভর্তা, মাছ তরকারি, লাউ চিংড়ি, বেগুন ভর্তা, খিচুড়ি, মাছ ভাজা, আমের টক, খাসির রেজালা রান্না করে এবং দেশী নাম ব্যবহার করে স্বমহিমায় প্রতিযোগীতার ফাইনালে উঠে এসেছেন। ডেজার্টে আমাদের অতি চেনা পান দিয়ে বানিয়েছেন মুখরোচক মিষ্টি খাবার। 
  

যেখানে দেশে থাকতে সারাক্ষণ পাকিস্তান ও ভারতকে গালি দেয়া বাংলাদেশীরা এখানে পাকিস্তানী আর ভারতীয় দেখলে তেল-চর্বিতে গদ গদ হয়ে উর্দু আর হিন্দিতে ‘বাত-চিত’ শুরু করে দেয়, সেখানে কিশোয়ার দেশের যেই জিনিসগুলো নিয়ে তথাকথিত বাঙ্গালীরা লজ্জা-শরম পায়, ঠিক সেই সব উপাদান দিয়েই অষ্ট্রেলিয়াসহ বিশ্ব টিভি পর্দায় বাংলাদেশকে সুন্দর করে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, নতুন উচ্চতায় তুলে ধরছেন। 
  

ভাবতেই ভালো লাগে অষ্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশীরা কতই না গর্ব করছেন তাঁকে নিয়ে। 
  

আপনি কান ফেস্টিভ্যালে, নাকি অষ্ট্রেলিয়ার টিভি পর্দায়; হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি না দুবাইয়ের বুর্জ খলিফায় স্বীকৃতি পান, সেটা আপনার শারীরিক অবস্থান আর ব্যক্তি পরিচয় দিয়ে নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় আপনি দেশকে ভালোবাসেন কিনা, দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন কি না সেটা দিয়ে। দেশের পরিচয় ছাড়া, হাইব্রিড পরিচয় নিয়ে কাউকে কিছু করতে দেখিনি, পেতে দেখিনি, দিতেও দেখিনি। 
  

তাই মাস্টারশেফ কিশোয়ারকে স্যালুট জানাই। ভালোবাসা জানাই। 
  

আপনাকে দেখে লাখো বাঙ্গালী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো আত্মপরিচয় ফিরে পাক, সেই কামনা করি।   


 

Writer:- শামীম আহমেদ 

NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner