> ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব ৩৯, ৪০ - Bangla Love Story - ভালবাসার গল্প - Love Story Bangla - প্রেমের গল্প
-->

ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব ৩৯, ৪০ - Bangla Love Story - ভালবাসার গল্প - Love Story Bangla - প্রেমের গল্প

মনে পড়ে গেলো দুইমাস আগের রাতের কথা.......
সেদিন ইফাজ জরুরি একটা কাজ করছিলো ল্যাপটপে।আর নিহা ড্রেসিং টেবিলে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিলো।চুল আঁচড়ে খোপা করে ইফাজের সামনে গিয়ে বলল,'কফি খাবে?'

ইফাজ ল্যাপটপে চোখ রেখেই বলল,'হ্যাঁ খাওয়া যায়।'

কিছুক্ষণের মধ্যেই নিহা নিজের জন্য আর ইফাজের জন্য দুই মগ কফি নিয়ে আসে।ইফাজ নিজের কাজ করতে করতে কফি খাচ্ছিলো।কফি শেষ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হলো কোনো ঘরের মধ্যে চলে গেছে!মাথাটা ঘুরছিলো!সামনে আবছা চোখে নিহাকে কাছে আসতে দেখেছিলো।এরপর আর কিছুই মনে নেই!সেদিন নেশাগ্রস্ত হয়ে কি করেছিলো কিচ্ছু মনে নেই ইফাজের।তবে যখন সকাল বেলা নিজেকে অনাবৃত অবস্থা দেখেছিলো তখনই বুঝেছিলো যা হওয়ার নয় তাই হয়েছে।

তারপর থেকে দুইদিন ইফাজ বাড়িতেই আসে নি।নিহা কাউকে কিছু বলতেও পারছিলো না কারণ বাসার সবাই জানে ইফাজ জরুরী কাজে বাইরে গেছে।সত্যিটা নিহা জানে।

দুইদিন ধরে ইফাজের চিন্তায় ঘুম আসছিলো না।দুইদিন পর যখন ইফাজ রাত একটার সময় বাড়িতে আসে তখন নিহা বাদে সবাই ঘুমিয়ে ছিলো।ঘরে আসতেই নিহা ইফাজের পা ধরতে নিলেই ইফাজ দ্রুত নিহার হাত ধরে ফেলে।নিহা কাঁদতে কাঁদতে বলল,'আমাকে ক্ষমা করো ইফাজ।আমি মানুষের কথা আর নিতে পারছিলাম না।সব কাজিন আত্মীয় স্বজন সবাই তোমার নামে বাজে বাজে কথা বলছিলো।আমি আর সহ্য করতে না পেরে...

নিহা আর বলতে পারলো না কান্নায় কন্ঠ রোধ হয়ে গেছে।ইফাজ আচমকাই নিহাকে জড়িয়ে ধরে বলল,'না নিহা তোমার জায়গায় তুমি ঠিক আছে।আমিই তোমার যোগ্য নই।না তোমাকে শান্তি দিয়েছি না নিজে শান্তি পেয়েছি।আমি তোমার ক্ষমা পাওয়ারও যোগ্য নই।'

সেদিন বেশ কিছুটা সময় দুজনেই কেঁদেছিলো।তারপর থেকে আস্তে আস্তে ওদের সম্পর্ক ঠিক হতে থাকে।কিন্তু সত্যি এটাই সম্পর্ক ঠিক হলেও ভালো তো কেবল একজনকেই বাসা যায়!

'হেই ডাক্তার সাহেব কোথায় হারালেন?'
নিহার কথায় সম্বিত ফিরে পেলো ইফাজ।ফিরে এলো দুইমাস আগের অতীত থেকে।নিহাকে কোল থেকে নামিয়ে একবার আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,'অনেক খুশী হয়েছি নিহা।'

নিহা মুখ বাঁকা করে বলল,'নাহ!শুধু খুশি হলে হবে না।আমাকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে।এখন থেকে বাবুর আর আমার যত্ন নিতে হবে।'

'যথাআজ্ঞা ম্যাম।'ইফাজ হেসে বলল।

বাড়ির সবাই খুশী নতুন অতিথির আগমনে।ইয়াফ খান তো খুশীর ঠ্যালায় মিলাদও পড়িয়েছে।সবার জল্পনা কল্পনা চলছে ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে।এই নিয়ে বাড়িতে দুটো দলও হয়ে গেলো।যেমন ইয়াদ,ইয়াফ খান,ইরিন একদল তাদের মতে ছেলে হবে।
সাইদা খান আর নিহা একদল তাদের মতে মেয়ে হবে।আর ইফাজ আল্লাহ যেটা দেয় সেটাই আলহামদুলিল্লাহ!
ইফাজের কোনো দল নেই সে নিরপেক্ষ।
----------------
সবকিছু ভালোই চলছিলো।এতোকিছুর মধ্যেও ইয়াদ সবসময় মধুকে মনে করে।রাতের অর্ধেকটা সময় চলে যায় ওকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই কিন্তু পাষাণীটা এতো নিষ্ঠুর!

আজকে সাইদা বেগম কেনো জানি ইয়াদকে ক্লাস শেষ করে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বলেছিলো।যেহেতু মায়ের আদেশ তাই ইয়াদ ক্লাস শেষে বাড়িতে আসলো।কিন্তু বাড়ি এসেই মাথা ঘুরে গেলো।পাঁচ/ছয় জন নতুন মানুষকে দেখা যাচ্ছে।কারা এরা!আবার এদের দেখি আপ্যায়নও করা হচ্ছে।ইয়াদকে ঢুকতে দেখে সাইদা খান এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো।তারপর সামনে বসা মানুষদের উদ্দেশ্য করে বলল,'এই হলো আমার ছোটো ছেলে।'
ইয়াদ কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে।তবুও সালাম দিলো।কিন্তু হঠাৎ করে চোখ পড়লে সামনের সোফায় বসা একটা মেয়ের দিকে।মেয়েটা একটু পরপর ইয়াদের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।ব্যাপারটা খেয়াল করতেই বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে গেলো।একটা ছেলে দেখলেই এভাবে তাকতে হবে!আজব!মেয়েটার জায়গায় যদি মধু থাকতো তাহলে অনুভূতিটা বিরক্তির হতো না বরং ভালোলাগার হতো!

ইয়াদ মায়ের দিকে জিগ্যাসু দৃষ্টিতে তাকালো।সাইদা খান ইয়াদকে উঠে একটু সাইডে আসতে বললেন।ইয়াদ সাইডে এসে মা'কে জিগ্যেস করলো,'এগুলো কি হচ্ছে মা?'

'ওরা তোকে দেখতে এসেছে।আমি আর তোর বাবা গতকাল ওদের বাসায় গিয়ে মেয়েকে দেখে এসেছিলাম।তাই ওরা আজকে এসেছে।'

ইয়াদ তীব্র রাগ নিয়ে চাপাকন্ঠে বলল,'এগুলে কে করতে বলেছে তোমাকে?তুমি জানো না আমি মধুকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না।তুমি ওদের চলে যেতে বলো।'

'ইয়াদ বেশি বাড়াবাড়ি করবি না!আমরা তোর ভালোর জন্যই করছি এগুলো।যদি তুই উল্টাপাল্টা করিস আমিও গলায় দড়ি দেবো মনে রাখিস।মায়ের কথার দাম ছেলে না দিলে মা হয়ে আর বেঁচে থেকে কি লাভ!'

এটা বলেই সাইদা খান চলে গেলো মেয়েপক্ষের সামনে।মায়ের এসব কথাবার্তা শুনে ইয়াদ মনেমনে খুব কষ্ট পেলো।একদিকে পরিবার অন্যদিকে ভালোবাসা!এর চেয়ে বেশি অসহায়ত্ব আর কি হতে পারে?

চুপচাপ গম্ভীর মুখে সোফায় গিয়ে বসলো ইয়াদ।ওরা আজকেই এঙ্গেজমেন্টে সেরে ফেলতে চায়।ইয়াদ কিছু বলতে নিলেও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারে নি।এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেলো!

ওরা যাওয়ার পর ইয়াদ আর কারো সাথেই কথা বলল না।চুপচাপ ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।ঘরে এসে এঙ্গেজমেন্টের রিং টা ছুড়ে ফেলে দিলো।

এরপর একান্তে কতক্ষণ মধুর ছবির দিকে চেয়ে চোখের জল ফেললো।
-----------
সন্ধ্যায় ইফাজ বাসায় এসে সাইদা খানকে বলল,'মা ইয়াদ কোথায়?'

'ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে।'

'কেনো?'

সাইদা খান ইফাজকে সবটা খুলে বলার পর ইফাজ গম্ভীর মুখে বলল,'মা কাজটা একদম ভালে করো নি।জোর করে সংসার হলেও ভালোবাসা হয় না।'

এতটুকু বলেই ইফাজ ইয়াদের দরজায় নক করলো।ইয়াদ ভেতর থেকে কোনো রেসপন্স করলো না।

ইফাজ আবার নক দিয়ে বলল,'ইয়াদ!দরজা খোল।'

এবার ইয়াদ জবাব দিলো,'ভাইয়া আমার কিছু ভালো লাগছে না।আমি তোমার সাথে পরে কথা বলবো।'

'আচ্ছা।'
ইফাজ নিজের ঘরে চলে গেলো।
--------------
রাত নয়টার সময় ইয়াদকে বের হতে দেখে সাইদা খান বললেন,'কোথায় যাচ্ছিস?'

'চিন্তা করো না।পালাচ্ছি না।তোমাদের পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করে তবে মরবো।'

এটা বলেই ইয়াদ বেরিয়ে গেলো।ইয়াদের কথায় সাইদা খান কষ্ট পেলো কিন্তু এটা তো তিনি ছেলের ভালোর জন্যই করছেন।আর কতোদিন ছেলেটা এভাবে ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরবে একটা মেয়ের জন্য?

বাসা থেকে বের হওয়ার মূল কারণ হলো বাসায় দমবন্ধ লাগছিলো।তাই খোলা রাস্তায় হাটতে বের হলো।হাঁটতে হাঁটতেই ছোটোবেলার বন্ধু অভির সাথে দেখা হলো।ওর ভালো নাম অভিরুপ রায়।ছেলেটা বেশ মেধাবী!অবশ্য স্কুল পর্যন্ত পড়ে ও আলাদা হয়ে যায়।এরপর  দেখা হলে সৌজন্যমূলক কথা ছাড়া আর কথা হয় নি।অভিকে দেখেই ইয়াদ প্রথম কথা বলল,'আরে অভি কেমন আছো?'

'ভালো। তুমি?'

'এইতো ভালোই আছি।বৌদি কেমন আছে?'

'ভালোই আছে।তুমি বিয়েশাদি করো নি?'

'না এখনো না।তা কোথায় যাচ্ছো?'

'অফিসে।'

ইয়াদ অবাক হয়ে বলল,'কিহ!এতো রাতে অফিস।'

'হ্যাঁ,আমাদের ডিউটি রাতেই।আমি রেডিও তে জব করি।আর আমার শো রাতেই হয়।দশটা থেকে দুইটা পর্যন্ত একটা শো হোস্ট করবো।'

'ওহ!আচ্ছা।যদি কিছু মনে না করো তাহলে আজকে একবার তোমার অফিস ঘুরে আসা যাবে?না মানে আমার বহুদিনের ইচ্ছে রেডিও স্টেশন কেমন হয় দেখার।'

অভি মৃদু হেসে বলল,'সমস্যা নেই চলো।'

তারপর দুজনে হাটতে হাটতে লাগলো।হাঁটতে হাঁটতেই অভি বলল,'তা বয়স তো কম হচ্ছে না।বিয়ে করছো না কেনো?'

ইয়াদ উদাস গলায় বলল,'বিয়ে তো করতে চাই কিন্তু যাকে চাই তাকে তো পাই না।'

'লাভ স্টোরি মনে হচ্ছে।'

ইয়াদ হাসলো।অভি হাসিতে তাল মিলিয়ে বলল,'সংক্ষেপে একটু বলতো তো তোমার প্রেম কাহিনি।'

'প্রেম কাহিনি সংক্ষেপে বলা যায় না অভি।অনেক অনুভূতি,ভালোবাসা,ভালোলাগা,প্রতীক্ষা থাকে বলে সংক্ষেপে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।তবুও যদি তুমি শুনতে চাও তবে বলবো সে মধু ছিলো আর আমি মৌমাছি কিন্তু মধুটা মৌমাছি কে একা করে যে কোথায় চলে গেলো!'

অভি একটু হাসলো।বলল,'ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে!আসবে একদিন গেস্ট হয়ে আমার শো তে তোমার ভালোবাসার গল্প বলতে।'

'আমার ভালোবাসা তো অপূর্ণ তাকে ছাড়া।তাকে পেলে অবশ্যই আসবো।'

এরপর আরো অনেক কথা বলতে বলতে ওরা রেডিও স্টেশনে পৌঁছে গেলো।শো শুরু হতে পাঁচ মিনিট বাকি!সব ঠিকঠাক করে দশটা বাজতেই মাইক্রোফোন কানে দিয়ে অভি স্পিচ দেওয়া আরম্ভ করলো,'হ্যালো,আপনারা শুনছেন বাংলা রেডিও ৯৫.২ এফ এম।শুরু হয়ে গেলো আমাদের আজকের অনুষ্ঠান 'মনের কথা'।এখানে আপনি আমাদের জানাতে পারবেন আপনার মনের কথা।আমি আপনার বন্ধু অভি বসে আছি আপনার কথা শোনার জন্য।এখন ফোন দিন *******এই নাম্বারে।'

স্পিচ শেষ হতেই একজনের ফোন কল পেলো।অভি রিসিভ করে কথা বলা শুরু করলো।আর পাশে বসে ইয়াদ অভির সাথে সাথে কথাগুলো শুনতে লাগলো।যথারীতি অভি একটা ফোন কল রিসিভ করে বলল,'হ্যালো বন্ধু,কে বলছেন?কোথা থেকে বলছেন?'

'হ্যালো,আমি তয়ত্রি রহমান।'

এতটুকু শোনার পরই ইয়াদ চমকে গেলো।পরিচিত কন্ঠ!মধুর কন্ঠ এটা!


মধুর কন্ঠ'টা কানে লাগতেই ইয়াদের বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করতে লাগলো।ইশ!কতোদিন পর এই কন্ঠটা আবার কানে বাজছে।ইয়াদের চোখে অজান্তেই পানি চলে এলো।মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করছে,'কেন মধু?কেনো আমাকে ছেড়ে গেলে?কোন ভূলের শাস্তি দিচ্ছো আমাকে?'
কিন্তু না কান্না আটকে নিজেকে শান্ত রাখারা চেষ্টা করলো।অভিও পুরোটা বুঝতে না পারলে কিছুটা বুঝতে পারলো ইয়াদের উৎকন্ঠার কারণ।মধুর সম্পর্কে অনেক কিছুই বলেছে ইয়াদ।তার থেকে ধারণা করাই যায়।অভি ইয়াদ হাত ধরে ভরসা দিলো।তারপর ওপর পাশে মধুর উদ্দেশ্যে বলল,'বন্ধু শুনতে পাচ্ছেন আমাকে?'

ওপাশ থেকে উত্তর এলো,'জ্বি শুনতে পাচ্ছি।'

'কষ্ট করে আপনার নামটা আরেকবার বলুন প্লিজ।'

'আমার নাম তয়ত্রি রহমান মধু।'খুব ক্ষীণ কন্ঠে উত্তর দিলো মধু।

'খুব সুন্দর নাম আপনার।আচ্ছা মধু আপনি কোথায় থাকনে?'

'ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া থাকি।'

'আচ্ছা বেশ।আপনি আপনার মনের কথা বলুন আমিসহ আমার সকল বন্ধুরা আপনার কথা শুনতে চাই।'

মধু এক মিনিট চুপ থেকে চোখের কোটরে জমে থাকা পানি মুছে বড় একটা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,'আচ্ছা এতো ভালোবেসেও কেনো দিনশেষে ভালোবাসাগুলো পরিপূর্ণ হয় না।কেনো দুঃখ নামক শব্দটা ভালোবাসার অনুভূতিকে ফিকে করে দেয়?কেনো নিষ্ঠুর বাস্তবতা মানতে হয়?কেনো না চাইতেও ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে আসতে হয়?কেনো?'

বলতে বলতেই মধু কেঁদে ফেলল।স্টুডিও তে অভির পাশে বসে কাঁদছে ইয়াদ আর মাইক্রোফোনের অপরপাশে বসে কাঁদছে মধু।দুমিনিট পর নিজেকে শান্ত করে মধু আবারও বলতে শুরু করলো,'জানেন আমাদের দুচোখ ভার্তি কতো রঙিন স্বপ্ন ছিলো!দুজনে একটা সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখতাম।একটা ভালোবাসা,শ্রদ্ধা,বিশ্বাসের ঘর বাঁধতে চেয়েছিলাম।কিন্তু সব স্বপ্ন ভেঙে,তাকে ছেড়ে দূরে চলে এসেছি।এখন আর সংসারের স্বপ্ন দেখি না।আমার স্বপ্নের আকাশে অমাবস্যায় ছেয়ে গেছে আর কখনো সেখানে চাদ উঠবে না।'

এইপর্যায়ে আবারও মধু থামলো।বাম হাতে চোখের পানি মুছে বলল,'আমাদের সম্পর্ক চারবছরের।একবছরের মাথায় সে পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে চলে যায়।তবুও আমাদের যোগাযোগ হতো।প্রতিদিন নিয়ম করে ফোন দিতো।ও সারাদিন পড়াশোনা আর কাজে ব্যস্ত থাকতো আমি জানি তবুও মাঝেমধ্যে ওর সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলতাম এরপর আবার নিজেরই আফসোস কিন্তু সে কখনো আমাকে বকা দিতো না অভিযোগ করতো না।তো সব মিলিয়ে বেশ ছিলাম!তার আসার সময় হচ্ছিলো।আর আমার এক্সাইটমেন্ট বাড়ছিলো।কথাছিলো সে আসলেই বিয়ের পিড়িতে বসবো।এবার তাকে নিজের বর করেই ছাড়বো।ও আসার দশদিন আগে রাতে ফোন দিয়েছিলো।বলেছিলো আরো একবছর অপেক্ষা করতে হবে।ভিসা-পাসপোর্টে কি একটা সমস্যা হয়েছে এইজন্য।এমনিতেই এই তিনবছর তাকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হয়েছিলো।তার ওপর এখন আবার একবছর অপেক্ষা করতে হবে এটা শুনেই রেগে খুব বাজে ব্যাবহার করেছিলাম।কিন্তু তখনও বুঝতে পারি নি যে সে আমার সাথে মজা করেছিলো।পরেরদিন তার বোনকে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম আমাকে সত্যিটা কিন্তু তবুও ভান করলাম আমি কিছু জানি না।সারাদিনে আর ফোন ধরি নি।ভেবেছিলাম রাতে কথা বলবো কিন্তু সেদিন সন্ধ্যার সময় টিউশনি করিয়ে আসছিলাম।প্রতিদিন আমি ওই সময়ই বাসায় ফিরি।সেদিনও ফিরছিলাম।সন্ধ্যার আজান পড়ায় রাস্তায় তখন তেমন একটা মানুষ ছিলো না।আমি দ্রুতই হাটছিলাম কিন্তু কিছুদূর হাটার পর কয়েকটা বখাটে ছেলেদের দেখতে পেলাম।ওরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিলো।আমি যথাসম্ভব রাস্তার পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটছিলাম।আর মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম যেনো ওরা আমাকে খেয়াল না করে।কিন্তু কে জানতো বিপদ আমার চারপাশে ঘুরঘুর করছে।যেটা চাইনি সেটাই হলো।ওরা আমার পিছু নিলো।আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম পেছনে কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।আমার বুক কাপছিলো ভয়ে বারবার মা,ছোটো বোন আর ভালোবাসার মানুষটার মুখ সামনে ভাসছিলো মনে হচ্ছিলো মরণ বুঝি সামনে কিন্তু সেদিন আমার মরণ হয় নি,আমার আত্মার মরণ হয়েছিলো।'

এতটুকু বলে মধু থামলো।নিঃশব্দে চোখের পানি মুছলো।এদিকে ইয়াদও দাঁত মুখ খিচে নিজেকে শক্ত রেখেছে কিন্তু ওপরে শক্ত দেখালেও ভেতরে যে পাঁজরের হাড়গুলো ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে সেটা বাইরে থেকে কেউ টের পাবে না।

সময়টা থমকে গেছে।ফোনের ওপশেও কথা নেই এপাশেও কথা নেই।আধ সেকেন্ডের জন্য বোধহয় সবাই নিরবতা পালন করছিলো।মিনিমাম আধ সেকেন্ড পর মধু ভেজা গলায় নাক টেনে আবার বলতে শুরু করলো,'ওরা পেছন থেকে এগিয়ে এসে আমাকে রোধ করে ফেলে।চারজন চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে।তারপর আমি চিল্লানোর আগেই সুযোগ বুঝে আমাকে চেতনানাশক দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে।তারপর ওরা আমাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিলো আমি জানি না।কিন্তু যখন জ্ঞান ফেরে তখন নিজেকে ঘরে আবিস্কার করি।রুমে ম্লান হয়ে যাওয়া হলদেটে একটা আলো জ্বলছিলো।চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম রুমের এককোনায় চারটা ছেলে বসে নেশা করছে।হঠাৎ নিজের শরীর দিকে তাকিয়ে পিলে চমকে উঠলো।সারা শরীর অনাবৃত অবস্থায় পড়ে আছে।নিজের ঘৃণা হতে লাগলো নিজের শরীরের ওপর।'

এতটুকু বলেই মধু মুখে হাত দিয়ে গোঙাতে লাগলো।প্রাণপণে কান্না গিলতে চেষ্টা করলো কিন্তু সে ব্যর্থ!হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।অভির চোখেও জল চলে এসেছিলো।কি নির্মম আর্তনাদ!বাঁধভাঙা কান্না!অভি চেষ্টা করও স্বান্তনা দিতে পারলো না।কি বলবে যেখানে নিজেরই কষ্টে চোখে জল চলে এসেছে সেখানে অপরজনকে কি স্বান্তনার বাণী শোনাবে?মধু মিনিট দুইয়েক নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো।

তারপর চোখমুছে আবার বলতে শুরু করলো,'সরি,আসলে নিজেকে আটকাতে পারছিলাম তাই কান্না করে দিয়েছি।'

অভি ভরসা আর স্বান্তনার গলায় বলল,'সমস্যা নেই।আপনি শুরু করুন।'

'সেদিন রাত আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ কালো রাত ছিলো এরচেয়ে যদি মৃত্যু হতো তবুও আমি খুশি হতাম।প্রথমবারের মতো নিজের অসহায়ত্ব অনুভব করলাম।সারা শরীর অপবিত্রতায় ছেয়ে গেলো।হাত,পা,মুখ বাঁধা ছিলো।কিচ্ছু করতে পারছিলাম না শুধু নিজের সর্বনাশ দেখতে পাচ্ছিলাম চোখের সামনে!কি অসহ্য বেদানায় কাতরাচ্ছিলাম কেউ কখনো উপলব্ধিও করতে পারবে না!যখন সর্বনাশের আর কিছু বাকি নেই তখন ভোর।আলো ফুটতে শুরু করেছে।ওরা কেউ তখন রুমে ছিলো না।আর আমার হাত,পা ও খোলা ছিলো।আমি তাড়াতাড়ি উঠে কোনোরকম জামা কাপড় পরে দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে গেলাম।কিন্তু রাস্তায় আসার পর জায়গাটা আমি চিনতে পারলাম না।কোথায়? কিভাবে যাবো তাও জানি না।এদিকে শরীর ক্রমেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে।কোনোমতে একটা রিকশা নিয়ে সরাসরি বাসার সামনে এসে পড়ি।বাসার সামনে এসে আবার জ্ঞান হারাই।তারপর যখন জ্ঞান আসে তখন দেখি আমি নিজের ঘরে। মাথার পাশে মা বসে আছে।মা'কে সব বললাম।তারপর সেদিনই হাসপাতালে গেলাম।গাইনি ডাক্তারের পরামর্শে পরীক্ষা করলাম।এবং দুইদিন পর গিয়ে রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই।ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বলেছিলেন গণধর্ষণের ফলে আমার ওভারিতে সমস্যা হয়েছে।যার জন্য আমি মা হতে পারবো না।...'
শেষের কথাটা বলে মধু থামলো।চোখের জল মুছলো না।শুধু ঠোঁট কামড়ে ধরে রইলো।একমিনিট পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,'ডাক্তারের মুখে ওই কথাটা শোনার পর আমি দ্বীতিয়বারের মতো মরেছি।সেদিন বাসায় এসে অনেক ভেবেছি কি করবো!দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম।আত্নহত্যাও করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারি নি।আমার সেই সাহস নেই!
নিজেকে কেনো জানি অপরাধী মনে হচ্ছিলো।আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের চেহারা দেখতেও নিজের ঘৃণা লাগতো।ওইসময়ে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।নিজের ফোন বন্ধ করে দিয়েছিলাম।মা আর বোনকে নিয়ে শহর ছেড়ে আসি।আমি চাই না এগুলো ও জানুক।আমি চাইনা আমার নষ্ট জীবনের সাথে ও জড়িয়ে পড়ুক।আমি ওকে কিছুই দিতে পারবো না।তাই চিরদিনের জন্য ওর জীবন থেকে চলে এসেছি।আমি জানি ও আমাকে অনেক ভালোবাসে।আমাকে খুঁজবে পরে একসময় না পেয়ে নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিবে আর আমি এটা চাই।ভালো থাকুক আমার ভালোবাসা!...'

কথা শেষ করে মধু নিজেই ফোন কেটে দিলো।অভি স্টুডিও থেকে কয়েকবার হ্যালো,হ্যালো করেছিলো কিন্তু সংযোগ না থাকায় যোগাযোগ হয় নি।
---------------------
আজ অনেকদিন পর মন খুলে কষ্টের কথাগুলো বলতে পেরে ভালো লাগছে মধুর।বারান্দার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে অবিরাম ধারায় চোখের পানি ফেলছে।

ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া মধুর দাদার বাড়ি।অনেক বছর ধরে বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ নেই।মধুর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে এখানে আর আসা হয়নি।এখানে দুই শতাংশ জায়গা আছে মধুর বাবার নামে।চাচারা এই জায়গার দেখাশোনা করে।

মধু যখন শহর ছেড়ে কোথায় যাবে ভেবে পাচ্ছিলো না তখন ওর মা ওর দাদার বাড়ির কথা বলে।দাদার বাড়ি সম্পর্কে কেউই তেমন কিছু জানে না।আর ইয়াদও কখনো জানতে চায় নি মধুও বলে নি।এখন সেখানে যাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত মনে হলো।যাতে ইয়াদ ওকে খুঁজে না পায় আর যাওয়ার সময় একটা মিথ্যা বিয়ের কার্ড আর ইয়াদের দেওয়া রিং টা আরিয়ার কাছে দিয়ে এসেছিলো ইয়াদকে দেওয়ার জন্য যেনো ও বিশ্বাস করে মধুর বিয়ে হয়ে গেছে এবং মধু ওকে ঠকিয়েছে!

'কাঁদিস না মা।'আইরিন রহমান মধুর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।

মধু মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের বুকে মাথা রেখে বলল,'মা আমার এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো?সবসময় আমার সাথেই কেনো এমন হয়?না মরতে পারছি না বাঁচতে পারছি!



চলবে...



Writer:- Arshi Ayat


NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner