৬.
ভাইয়া আসলো বিকেলের দিকে । কিন্তু সে একা আসেনি নতুন মেম্বার নিয়ে এসেছে । সেই নতুন মেম্বার আর কেউ না মামুর ছোট মেয়ে আফসানা রিহায়াত ।
সে অবশ্যি এমনি এমনি আসেনি একটার ওপর আরেকটা সম্পর্কের নাম এবং অধিকার নিয়ে এসেছে ।
আমার ভাই তানভীর রিহায়াতকে বিয়ে করে বউ বানিয়ে ঘরে তুলেছে ।
সদর দরজায় ভাইয়ের সাথে রিহায়াতকে দেখে মা যতটা না খুশি হয়েছিল ঠিক ততখানি, নাহ না তার চাইতে হাজার গুণ বেশী রেগে আছে সম্পর্কের নতুন নাম শুনে ।
ভাই যে একা একাই বিয়ে করবে এটা মা কেনো আমরা কেউ কখনো ভাবতেই পারিনি ।
আপাতত ড্রয়িংরুমে সবাই বসে আছি । ভাই-ভাবী মাথা নিচু করে মায়ের সামনের সোফায় বসে আছেন ।
মায়ের পাশে ফুপ্পি মায়ের মাথায় আইসপ্যাক ধরে আছেন আর আস্তে আস্তে বলছেন_ভাবী শান্ত হও যা হবার তা তো হয়েছেই..
কিন্তু মা'র রাগ কমছে না । উনি মাথা নিচু করে ফুঁসছেন শুধু ।
আমি বুঝতে পারছি না এতে এতোটা রাগ করার কি আছে? ভাই এডাল্ট , রিহা এডাল্ট ।
ভাই জব করে অনেক ভালো , রিহা মামুর বিজনেসে হাত দিয়েছে , মামুর সয় সম্পত্তির অভাব নেই এবং ছোটবেলা থেকে বিদেশে বড় হওয়া সত্বেও রিহা কি সুন্দর বোরখা পরে এসেছে ।
আবার বোরখার নিচে শাড়িও , কি সুন্দর মাথায় আঁচল টেনে বসে আছে মেয়েটা!
সব দিক দিয়েই পারফেক্ট ম্যাচ তাহলে মায়ের এখানে রাগ করবার কারণ কি?
,
আমাকে আর বেশি ভাবতে হলো না , তার আগে মা ই চিল্লিয়ে উঠলেন । দাঁতে দাঁত চেপে বললেন_
-- ফ্যামিলির ভেতর বিয়ে আমার একদমই পছন্দ নয় । রক্তের মিল থাকলে বাচ্চা হয়না তাছাড়াও ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে মনমালিন্য হলে ভাইবোনের মধ্যে সম্পর্কও নষ্ট হয় । তানভীর আমি কি তোমাকে প্রথমেই বলিনি যে এই সম্পর্ক আমি মেনে নিবো না?
তাহলে কেনো তুমি ওকেই বিয়ে করে নিয়ে আসলে?
সম্পর্ক চালিয়ে গিয়ে তো আমার কথার অবাধ্য হয়েছো ই এখন বিয়ে করে ঘরে অবধি তুলেছো?
কি আমাকে তোমাদের মানুষ মনে হয়না? আমার কথা কেউ ধরোনা কেনো তোমরা?
,
ওহ্ হোওও তারমানে এই সমস্যা?
এই সিরিয়াস ব্যাপারে মায়ের মান্ধাতা আমলের কথা শুনে আমার হাসি পেয়ে গেলো কিন্তু কি মনে করে সাথেসাথেই রাইদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম ।
রাইদ ভাই এতক্ষণ ছাগলের মতো আপেল গিলছিলেন কিন্তু এখন তার দৃষ্টি আমাতে নিবদ্ধ , এই দৃষ্টিতে স্পষ্ট কিছু আনওয়ানটেড প্রশ্ন যার উত্তর আমি মরে গেলেও তাকে দিতে পারবো না ।
আমি তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম ।
ভাই আস্তে করে এগিয়ে এসে মায়ের পায়ের কাছে বসলেন ।
নরম গলায় বলতে শুরু করলেন_
-- আম্মু আমি জানি আমি ভুল করেছি কিন্তু কি করতাম বলো? ভালোবাসা জিনিসটাই এমন , আমি রিহাকে খুব বেশীই ভালোবাসি । এখন ওকে ছেড়ে আসা আমার পসিবল ছিলোই না । ও সুইসাইড আ্যাটেম্পট করেছিল জানো?
আমি চলে আসার দু'দিন আগে অনেক গুলি স্লিপিং পিলস খেয়ে ফেলেছিল মেয়েটা ।
মামু আমার পায়ে পড়েছিলেন ওকে আপন করে নেবার জন্য ।
নিজের চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষটার এই অবস্থা আর মামুর আর্তনাদ আমি সহ্য করতে পারিনি মা ।
তুমি আমাকে মাফ করো আম্মু , আমি আশা করেছিলাম তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না ।
রিহাকে তুমি প্রচন্ড ভালোবাস এটা আমি জানি ।
আমি ভেবেছিলাম বিয়ে করে আনলে তুমি ওকে মেনে নিবেই ।
কিন্তু..
আম্মু একটা সুযোগ অন্তত ওকে দিয়ে দেখো? প্লিইজ!
রিহাও মায়ের কাছে এসে কেঁদে ফেললো ।
আমারই তো মায়া হচ্ছে এদের জন্য!
,
মা অনেক কঠিন মানুষ , ওনার মনের বরফ গললো না ।
মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন , আমি জানি মায়ের একটাই ভয় পরিবারের ভেতরে বিয়ে হলে যদি সন্তান নিতে সমস্যা হয়?
তবে মায়ের মুখভঙ্গি দেখে আমার মনে হলো তার মনের বরফ খুব জলদিই গলতে শুরু করবে শুধু রিহাকে মায়ের মন মতো চলতে হবে তাহলেই হবে ।
হাহ্ সব্বাইকে মা মেনে নিচ্ছেন শুধু আমার ক্ষেত্রেই তার অনীহা!
,
মা যাওয়ার পর ফুপ্পি রিহা আর ভাইকে উঠে বসালেন , চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন_ চিন্তা করিস না বাবা সব ঠিক হয়ে যাবে ।
তারপর আমাকে ইশারায় খাবারের ব্যবস্থা করতে বললেন ।
আমিও খুশি মনে উঠে গিয়ে ফ্রীজ থেকে মিষ্টি আর পানি নিয়ে আসলাম জলদি জলদি ।
রিহার পাশে বসে চামিচে করে মিষ্টি নিয়ে ওর মুখের সামনে ধরে হেসে বললাম_ বিয়ের মিষ্টি তো তোরা আনলি না আমার হাতেই খা!
রিহা আমার দিকে ছলছল চোখে তাকালো , আমি জোর করে ওর মুখে মিষ্টি পুরে দিতেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো ।
আমারও চোখ ছলছল করছিলো , পরিস্থিতিকে হালকা করতে ভাইকে বললাম_ দেখেছো তোমার বউ আমাকে বেশি ভালোবাসে । কেমন জোরসে জড়িয়ে ধরেছে দেখো?
আমার কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো ।
রিহাকে বললাম ফ্রেশ হয়ে নিবি চল?
ভাইয়ার রুমটা আগেই পরিস্কার করে রাখা হয়েছিল ।
ওদের রুমটা আমার রুমের পাশেই ।
রিহাকে ফ্রেশ হতে বলে যখন আমি চলে আসবো তখন ভাইয়া ডেকে ওঠে_ বুড়ি কেমন আছিস?
আমি এই ডাকটার অপেক্ষা করছিলাম । ছুটে ভাইয়ার বুকে গিয়ে হু হু করে কেঁদে দেই ।
ভাইয়া মাথায় হাত বুলিয়ে বলে_ স্যরি বাচ্চা এই ক'দিন ঝামেলায় তোর খোঁজ নেয়া হয়নি ।
লান্ডান যাবার ব্যাপারে বাবাকে কিছু বলেছিস?
আমি ভাইয়ার দিকে অবাক চোখে তাকাই।
ভাইয়া হেসে বলে_ আমি আমার একমাত্র বোনটার সব খবরই রাখি!
বলে আমার মাথায় একটা চুমু খায় ।
আমি ভাইয়াকে বলি_ তোমাকে অনেক মিস করেছি ভাইয়া!
-- আমিও করেছি পাগলী , এখন তো এসে গেছি । আর একদম কাঁদিস না ।
-- হু ।
আচ্ছা তুমিও ফ্রেশ হও এখন আমি তোমাদের খাবারের ব্যবস্থা করছি ।
-- আচ্ছা যা ।
,
ভাইয়ার রুম থেকে আমি সোজা কিচেনেই চলে আসি ।
আজ ভাইয়ার পছন্দের রান্না হবে সব ।
ফ্রীজ থেকে মাছ মাংস বের করে ভিজিয়ে রেখে শাক সবজি কাটছিলাম ।
আব্বু ফোন করে , জানায় আজ রাতে উনিও আসছেন । আমার কিছু লাগবে কি না?
ছোট বেলার মতোই আবদার করি আমার জন্যে চকলেট আর আইসক্রিম নিয়ে আসবে কিন্তু!
আব্বু হেসে বলেন নিয়ে আসবেন ।
ফোনটা রাখতেই কেউ একজন বলে ওঠে_এখনো চকলেট আইসক্রিম খাইতে হবে? তুই কি বাচ্চা?
আমি পেছন ঘুরে দেখি এই কেউ একজন টা আর কেউ নয় রাইদ ভাইয়া ।
ঐ সবজি কাটতে কাটতেই আমি বলি_ চকলেট আইসক্রিম কি শুধু বাচ্চাদের জন্যই নাকি?
সবাই ই খায় ।
-- ওগুলো খাওয়ার জিনিস? সব অখাদ্য কুখাদ্য!
নাক সিটকিয়ে বলে রাইদ ভাইয়া ।
আমিও হেঁসে বলি_
-- ক্যান হিংসে হয় কেউ এনে দেয়না জন্য?
-- এহ্হ আসছে আমার নাকি হিংসে হবে এসব অখাদ্যের জন্য! রাইদের এতো ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে হিংসে হয়না । হিংসুটে তো তুই বিরাট বড় হিংসুটে ..
-- কিইহ্ আমি হিংসুটে? কে বলেছে আপনাকে?
-- আচ্ছা তুই হিংসুটে না তাইনা? ভুলে গেছিস সব? আমি যখন সেকেন্ড স্ট্যান্ডারে তখন আমার ফ্রেন্ড কিছু নোটস দিতে বাসায় আসলো আর এসে আমায় প্রপোজ করলো তাও আবার রজনীগন্ধা দিয়ে? আর তুই কি করলি তখন? দৌড়ে এসে ওর হাত থেকে ফুল নিয়ে ছিঁড়ে ফেললি আর চুল ধরে টানাটানি করে কি কি বললি?
ওনার কথায় আমি অতীতে ফিরে গেলাম যেন , কোন তালে আমিও বলে ফেললাম_ আরেহ্ বেচারির নাকি ১৩৬ টা চুল ছিঁড়েছি সে গুণতে ছিলো তবে ভালোই করেছি । এহ্ শখ কত সে তোমায় প্রপোজ করতে এসেছিলো । আহা আমিও যেন ছেড়ে দিতাম ।
দু'জনেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম ।
-- কি নিয়ে এতো হাসাহাসি হচ্ছে শুনি?
কিছুক্ষণ বাদেই ফুপ্পির গলা শুনে আমার হাসি থেমে যায় ।
আমাদের হাসাহাসির শব্দ শুনেই ফুপ্পি এসেছেন রান্নাঘর অবধি!
-- আরেহ্ তেমন কিছু না । ছোটবেলার কথা মনে করছিলাম ফুপ্পি!
আমি বললাম ।
রাইদ ভাইয়েরও হাসি থেমে গেছে । উনি এবার সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন ।
ওনার চোখে একটাই প্রশ্ন_ আমাকে নিয়ে তোর পোজেসিভ চিন্তাভাবনা তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে কেনো তুই?
আমিও মনে মনেই বললাম_একদিন সব জানতে পারবেন আপনি আর সেই দিনটা বেশী দূরে নয় ।
.
আজকে ফুপ্পি সব রান্না করেছেন , তাকে অবশ্যি আমি হেল্প করেছিলাম৷
দুপুরে খাওয়ার টেবিলে সবাই আসলেও রাইদ ভাই অনুপস্থিত ছিলেন ।
ভাইয়া ওনার খোঁজ করেছিল তখন ফুপ্পি বললেন কোন জানি কাজে তাকে বাইরে যেতে হলো!
এটা শুনে ভাইয়া একটু দুঃখ প্রকাশ করলেন , সবাই একসাথে কতদিন পর অথচ সে এখন না খেয়ে বাইরে ।
মা চুপচাপই খেয়ে চলে গেছেন , ভাইয়া-রিহা ওনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও উনি পাত্তা দেননি ।
ফুপ্পি বললেন আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে , মন খারাপ না করতে । আমরাও আশাবাদী
আপাতত দরজা জানালা বন্ধ করে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছি । ভাবছি আমি আসলে কাকে ভালোবাসি বা বাসতাম?
এটা আমাকে স্বীকার করতে হবে আমার আকৈশোর স্বপ্নে পুরোটা জুড়ে ছিলো রাইদ ভাই ।
আমার আকাঙ্খার যুবক!
সে আমারই হতো কিন্তু একটা ঝড় এসে সব লন্ডভন্ড করে দিলো সেসময় ।
ভেঙে পড়েছিলাম আমি । ভাঙা হৃদয়ের একাংশে ঠাই নিলো ফয়সাল ।
তাকে যখন পুরোটা দিতে চাইলাম তখন সে অন্যকারো হয়ে গেলো ।
অন্যকারো মানুষকে নিয়ে আমি ভাবতে চাইনা কারণ এটা অন্যায় ।
আজ খুব বেশীই মনে পড়ছে এই সবকিছুর সূচনার দিনটা ।
যেটা এক নিমিষেই তিনটে জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছিল ভ্রান্তির অগোচরে...
না কেউ বুঝতে পেরেছি আর না..!
বাকি কথা থাক আজ।
৭.
আমাকে তো আট বছর বয়সেই ফুপ্পির বাসায় রাখা হয়েছিল তাই স্কুল জীবনটা পুরোটাই আমার ফুপ্পির বাসাতেই কাটে এমনকি কলেজ জীবনটাও ।
তো আজ থেকে সাত বছর আগের কথা তখন আমি ক্লাস স্যাভেনে/এইটে পড়ছি । আমি , ফুপা আর ফুপ্পি থাকি বাসায় । রাইদ ভাইয়া পড়াশোনার খাতিরে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন ।
ভাইয়া নেই জন্য সারাটাদিন ফুপ্পির আমাকে নিয়েই কাটতো ।
ফুপ্পি আর ফুপা খুব ভালোবাসতেন আমায় , আমরা সুখেই ছিলাম কিন্তু আমাদের সুখ বেশিদিন সইলো না ।
ফুপা হঠাৎ একদিন সকালে হার্ট আ্যাটাক করে মারা গেলেন ।
বাসায় কান্নাকাটির রোল পড়ে গেলো ।
আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করবো! পরে বাবাকে কল করে বললাম ফুপা আর নেই তুমি জলদি চলে আসো ।
বাবা তৎক্ষণাৎ রওয়ানা হলেন মা সহ!
কান্নাকাটি শুনে বাসার ভাড়াটিয়ারা সবাই চলে আসলো ।
রাইদ ভাইয়াকে জানানো হলো , মানুষটা খুব শক্ত মনের । তিনি ওখানে থেকেই শান্ত স্বরে ফুপ্পিকে বোঝাতে থাকলেন , স্বান্তনা দিতে থাকলেন ।
তার আসতে লাগলো পুরো দু'দিন , উনি আসার আগের দিনই মাটি হয়ে গেছিলো । মৃত বাবার জানাযাটাও করার সুযোগ পাননি উনি ।
উনি যখন বাসায় এসে উপস্থিত হলেন তখন ওনার চোখেমুখে অদ্ভুত ক্লান্তি আর কঠোরতা ভর করে আছে ।
ওনাকে দেখে বাবা, ফুপ্পি সবাই কান্নাকাটি করলেন কিন্তু ওনার কোনো হেলদোল নেই ।
আমাকে বলছেন কাজের লোকদের ডেকে লাগেজ ঘরে নিয়ে যেতে তারপর চা বানিয়ে দিতে ইত্যাদি ইত্যাদি ।
আমিও অবাক অথচ কাঠের পুতুলেন ন্যায় ওনার কথা মেনে চলছি ।
উনি এসেছিলেন বুধবার ,তো পুরো দু'টো দিন উনি নিজের ঘরে শান্তিমত রেস্ট নিয়ে কাটালেন । আমাদের কথা তেমন হয়নি ।
শুক্রবার দিন তার মাঝে হালকা পরিবর্তন আসলো ।
সক্কাল সক্কাল সে উঠে নাশতা বানালো, ফুপ্পিকে ডাকলো আমাকে ডাকলো ।
নাশতা খেতে দিলো নিজেই তারপর আমাকে একটুখানি ধমকে পড়তে বসার হুকুম দিলো ।
আমার কেনো জানি খুব বেশীই ভালো লাগছিলো আবার কষ্ট হচ্ছিল এটা ভেবে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে ছেলেটা ।
সবাই জানতো রাইদ ভাই তার বাবাকে ঠিক কতখানি ভালোবাসে অথচ এই ছেলের চোখে একফোঁটা পানি নেই??
হালকা পাতলা পড়াশোনা করে আমি বাইরে বেরিয়ে দেখলাম জনাব গাছে পানি দিচ্ছেন সুন্দর ।
বেশ আগ্রহ নিয়ে আমি গিয়ে বললাম_"ভাইয়া আমি হেল্প করি?"
আমার কথা শুনে উনি দিলেন একটা কড়া ধমক , বললেন_" তোরে আমি পড়তে বলছিনা? তুই আমারে হেল্প করতে আসছস? আমি চাইছি হেল্প?"
খালি ফাঁকিবাজি না? যাহ পড়তে বস!
ওনার এক ধমকে আমার অবস্থা কাহিল ।
সেদিন নামাজে যাওয়ার আগে পর্যন্ত উনি আমাকে পড়িয়েছেন ।
তারপর নামাজ পড়তে গেলেন , কিন্তু দুপুরবেলা তার বাসায় আসার নাম নেই ।
আমরা অপেক্ষা করছিলাম তার জন্য কিন্তু না সে আসলো আর না ফোন ধরলো ।
ফুপ্পিকে এটাসেটা বুঝিয়ে খাইয়ে ঘুমোতে পাঠিয়ে আমি নিজের ঘরে বসে অপেক্ষা করছিলাম ।
বলে রাখি ক্লাস স্যাভেন এইটে পড়ুয়া হলেও খুব অল্প বয়সেই আমি ম্যাচিওর হতে শুরু করেছিলাম ।
আমি তো আর অন্য পাঁচটা স্বাভাবিক ফ্যামিলির মতো বাবা-মা দু'জনের ভালোবাসা পাইনি তাই আমি বুঝতে শিখেছিলাম একা একা চলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে ।
ঐ বয়সে বুঝতে শেখাটাকে মানুষ পাকনামির নাম দিয়ে দিতো , সে ব্যাপারে আমার বিশেষ সমস্যাও ছিলো না ।
আর আমার গ্রোথ ছিলো ভালো , বেশ লম্বাচওড়া এবং স্বাস্থ্যবান মেয়ে আমি।
যাহোক আমি বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম ওনার জন্য ।
আসরের নামাজের একটু পরেই আসলেন তিনি বাসায় ।
এসেই সোজা রুমে ঢুকে গেলেন ।
মুখের নকশা ক্যামন পাল্টানো ছিলো!
আমি ভয়ে ভয়ে ওনার পেছনে গেলাম , দরজা ভেজানো ছিলো । হালকা নক করেই ভেতরে গেলাম , রাইদ ভাইয়া তখন পাঞ্জাবি ছেড়ে খালিগায়ে শুধু প্যান্ট পরে শুয়ে আছেন ।
উপুড় হয়ে শুয়ে থাকার দরুণ তার মুখটা ভালোমতো দেখা যাচ্ছিল না ।
আমি আস্তে করে ডাকলাম_ রাইদ ভাইয়া?
প্রথমে উনি জবাব দিলেন না ।
সাহস সঞ্চয় করে বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম এবং আবার ডাকলাম_ভাইয়া খাবেনা?
সে এবারে মাথা উঁচু করে তাকালো ।
চমকে উঠলাম আমি , টকটকে লাল চোখ , জল ছলছল করছে সেই চোখ দুটি তে ।
আমার ভয় উবে গেলো আর খুব মায়া হলো ।
উনি নিজে থেকে বললেন_ মিথি একটু বস তো?
একটু সরে গিয়ে আমায় বসার জায়গা করে দিলেন ।
আমিও বসে পড়লাম কি মনে করে!
পা ভাঁজ করে বসেছিলাম আমি , কয়েক মুহুর্ত পরেই উনি এসে আমার কোলের ওপর মাথা রাখলেন ।
আমি খানিক চমকে গেলে উনি বললেন_ চুলগুলো টেনে দে মাথা ব্যাথা করছে খুব ।
আমি কালবিলম্ব না করে দিচ্ছি বলে ওনার মাথার চুলগুলি টেনে দিতে লাগলাম ।
-- কোথায় গেছিলে? ফুপ্পি অপেক্ষা করছিল তো..
উনি কিছু বললেন না । কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো উনি কাঁদছেন , ব্যতিব্যস্ত হয়ে আমি কিছু বললে শব্দ করে কেঁদে ফেলেন আর বলতে লাগেন_আমার বাবাকে খুব দেখতে মন চাইছে , ওয়াদা করেছিলাম বাবাকে বাড়ি বানিয়ে দিবো একটা । আগের দিনও কথা হলো তবে কেনো হঠাৎ এতসব হয়ে গেলো? আমার বাবাকে চাই মিথি , একটা বিকেল বাবার সাথে কাটাতে চাই৷ কত হতভাগা ছেলে আমি , বাবাকে একনজর দেখতে অবধি পাইনি মৃত্যুর আগে উফফ এতো যন্ত্রণা আমি কাকে বলি?
ডুকরে কেঁদে উঠলেন রাইদ ভাই । আমি অবাক হয়ে গেলাম ওনার কান্না দেখে , খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন ।
কান্না করতে করতে মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ।
আমি রাত আটটা পর্যন্ত ওনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি , খেয়ালই ছিলো না ক'টা বাজে! পরে ফুপ্পি ডাকায় হুঁশ হলো ।
পরে নিজের রুমে আসার পর আরো খারাপ লাগছিল আমার , আমার প্রথম দেখা কোনো ছেলের কান্না ছিলো সেটা ।
,
রাতের দিকে সে খেতে না আসায় আবার যখন ডাকতে গেলাম তখন দেখি সে বিছানায় শুয়ে গোঙ্গাচ্ছে ।
কাছে গিয়ে দেখি গায়ে ভীষণ জ্বর ।
মহা মুসিবত! ফুপ্পিকে সাথেসাথেই ডেকে মাথায় পানি ঢালা হলো , জল পট্টি দেয়া হলো ।
এসব করতে করতেই রাত বারোটা পার ।
ফুপ্পি বারবার আমাকে ঘুমোতে বলছিলেন , আক্ষেপ করে বলছিলেন ছোট মেয়েটা কত কষ্ট করছে আমাদের জন্য কিন্তু আমার ওরকম কোনো ফিলিংস হচ্ছিল না ।
জ্বরটা যখন নিয়ন্ত্রণে আসলো তখন আমি জোর করে ফুপ্পিকে খাইয়ে শুতে পাঠালাম ।
রাইদ ভাইয়ার কাছেই আমি বসেছিলাম , এক ধ্যানে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম ।
সেদিন প্রথম তাকে অত কাছে থেকে মনযোগ দিয়ে দেখা ।
স্যাভেন-এইটের মেয়েরা কিন্তু ফ্রেন্ডদের অনুকরণ করে খুব বেশীই ।
স্কুলে গেলে প্রায় প্রতিদিনই দেখতাম নাইন টেন বা কলেজ পড়ুয়া ভাইদের সাথে বান্ধবীদের প্রেম ।
ঐ বয়সেই তাদের এক্সও তৈরি হয়ে গেছে ।
ওদের প্রথম দেখা , গোলাপ দিয়ে প্রপোজ , চিরকুট আদানপ্রদান আবার সুদর্শন বয়ফ্রেন্ড এর নানারকম গল্প শুনে আমারও মন চাইত কারো সাথে প্রেম করতে ।
প্রেম আসলে কি এটা আমি তখন অত গভীর না বুঝলেও বুঝতাম আই লাভ ইয়ূ বলা আর লজ্জা পেলেই গোলাপ , চিরকুট পাওয়া যায় ।
এগুলো পাওয়া খুশির ব্যাপার!
হাস্যকর হলেও এগুলো সত্যি ।
যাহোক সে রাতে রাইদ ভাইকে মনযোগ দিয়ে দেখার পর আমার মনে হলো ভাইয়া দেখতে অনেক সুন্দর , ইশশ যদি সে আমার চিরকুট দেয়া মানুষ হতো!
আমার আকাশ কুসুম চিন্তা শুরু হয়েছিল তখনই ।
আনুমানিক রাত ২-৩ টার দিকে আবার গোঙাতে লাগলেন উনি ।
আমি তড়িঘড়ি করে কপালে হাত ছুঁইয়ে দেখলাম ভীষণ জ্বর!
কি আর করার! ফের জলপট্টি দেয়া শুরু হলো , আশ্চর্য ভাবে আমার একদম ক্লান্তির সৃষ্টি হয়নি ।
উনি জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকছিলেন ।
বারবার বলছিলেন আমার বাবাকে এনে দাও প্লিজ , একবার দেখতাম ।
কিছু বলার ছিলো না , আমি শুধু ওনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছিলাম ঘুমিয়ে পড়ো প্লিজ ।
,
আমার কন্ঠ শুনে উনি চুপ করে গেলেন কিছুক্ষণ ওভাবেই থাকলেন ।
তারপর যখনই আমি ভেজা রুমাল ওনার কপালে ছোঁয়ালাম তখন ডান হাত দিয়ে আমার হাতটা চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বললেন_ তুই এতো পিচ্চি কেনো মিথি? আর একটু বড় হতে পারলি না? আমার কষ্ট যন্ত্রণা আমি সব জোর করে তোকে দিয়ে দিতাম , তোর মনেও তো অনেক কষ্ট । কাটাকাটি হয়ে ভ্যানিশ হয়ে যেত , বিষে বিষক্ষয়!
,
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম এটা শুনে ।
মনে মনে ভাসতে লাগলো এটার কি খুব সুন্দর একটা মিনিং থাকতে পারে??
.
এরপর দিন থেকে রাইদ ভাইয়ের সাথে আমার বেশী কথা হলো না ।
উনিও চুপচাপ , হঠাৎ করেই বললেন আবার ব্যাক করবেন ছুটি শেষ ।
ফুপ্পি যেতে দেবেন না কিন্তু উনি জোর করে গেলেন যাবার আগে শুধু বললেন_ এখানে থাকলে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে , পাগল পাগল লাগে ।
আমার যে পাগলামি থামাতে বাইরে পাঠিয়েছিলে সেই পাগলামি দ্বিগুণ হলে আমি নিজেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবো মা এবং কথাগুলো উনি সম্পূর্ণ আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন ।
আমি তখন ওসবের মানে না বুঝলেও সবটাই বুঝেছি ঠিক দু'বছর পর ।
দু'বছর পর থেকেই আমার আর রাইদ ভাইয়ের গল্পের শুরু।
৮
দু বছরে বিশেষ কিছু বদলায়নি শুধু সবকিছু উন্নত হয়েছিলো ।
ফুপ্পি স্ট্রংলি ব্যবসায় হাত লাগিয়েছিলেন , বেশ সফলতা লাভ করছিলেন তিনি ।
আমিও স্কুল চেইঞ্জ করেছিলাম আসলে করেছিলাম না করানো হয়েছিল এবং এই শুভ কাজটা করিয়েছিলেন রাইদ ভাই ।
এব্রডে গিয়েই উনি বাসায় ফোন দিয়ে বলেছিলেন মিথিকে আজই স্কুল চেইঞ্জ করাবে , যত টাকা লাগে লাগুক!
জনাবের কথাই শেষ কথা তো কি আর করার!
নতুন স্কুলে এসে বিশেষ পরিবর্তন টা আমার মাঝে হয়েছিল এটা আমি উপলব্ধি করতে পারছিলাম ।
এই স্কুলের বান্ধবী রা আরো বেশী স্টাইলিশ ছিলো , এদের বয়ফ্রেন্ড এর সংখ্যাও স্বভাবত বেশী আর সবথেকে খারাপ একটা জিনিস এদের হাতে ফোন ছিলো ।
আমাদের ক্লাসের ম্যাক্সিমাম ছেলেমেয়ে একসাথে মিলে বসে অশ্লীল ভিডিও দেখতো ।
আমার সর্বোচ্চ খারাপ একটা গুণ হলো আমি মানুষের খারাপ গুণগুলি আয়ত্ত করতে পারি এবং স্বভাবতই আমি করলাম ।
তবে আমি ঐ শ্রেণীর সাথে মিশলাম না যারা সত্যিকার অর্থেই খারাপ বরং ঐ শ্রেণীর সাথে মিশলাম যারা লেখাপড়া এবং আদারস সাইড ব্যালেন্স করে চলতে পারে ।
অর্থাৎ সিমিদের গ্রুপ , ওদের গ্রুপে তিনজন মেয়ে সিমি , শায়লা আর মাইশা ।
এরা অনেক স্টাইলিশ এবং ক্লাসি ছিলো তার পাশাপাশি পড়াশোনাতেও এগিয়ে ।
তিনজনই ফার্স্ট, সেকেন্ড এবং থার্ড হতো প্রতিবার ।
সিমি সবচাইতে বেশী মিশুক ছিলো তাই ওর সাথেই আমার বন্ধুত্ব বেশী গাঢ় হয়েছে ।
খুব ভালো সময় কাটতে লাগলো আমার ওদের সাথে ।
প্রতিদিন ক্লাস , টিফিন টাইমে আড্ডা আর ছুটির পর লাইব্রেরিতে গিয়ে অকারণে বসে থাকা ।
শায়লা ছিলো পড়ুয়া , ওকে বই পড়ার সময় ডিস্টার্ব করা আমাদের অধিকার ।
ওদের সাথে মেশবার পর আমি কার্লি চুল রিবন্ডিং করে ফেললাম , কালো চুলের রঙ পাল্টে হলো হালকা বাদামী ।
তো সেইবার ফুপার মৃত্যুবার্ষিকীর প্রায় এক সপ্তাহ আগে সন্ধ্যপবেলা রাইদ ভাই ফুপ্পির সাথে ভিডিও কলে কথা বলছিলেন ।
আমি মাত্র কোচিং ক্লাস থেকে ফিরেছি , দেখছি ফুপ্পি কথা বলছেন ।
নাচতে নাচতে ফুপ্পির পাশে বসে বললাম_ ফুপ্পিইই কি করোওও?
ফুপ্পিও হেসে বললেন _তোর রাইদ ভাইয়ার সাথে কথা বলি , তুইও আয়?
আমি কেনো জানি গেলাম না সামনে , বললাম নাহ খুব টায়ার্ড পরে কথা বলবোনে ।
রুমে যাবার সময় সাইড থেকে শুধু একবার উঁকি মারলাম আর এটাই হলো কাল ।
রুমে ঢোকার আগেই ফোনে রাইদ ভাই জোরে করে বললেন_ আম্মা ওরে এদিকে আসতে বলো ত?
আমিও শুনেছিলাম কিন্তু ভয়ে যাইনি , জলদি রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছি ।
ফুপ্পি যখন এসে ডাকলেন তখন বললাম_আমি তো গোসলে , তুমি কথা বলো আমি একটু পরে নাহয়..!
ফুপ্পি ঠিকাছে বলে চলে গেলেন ।
আমিও ঐ মুহুর্তের জন্য হাফ ছেড়ে বাঁচলাম ।
ফ্রেশ হয়ে এসে ফোনে গেম খেলছিলাম তখন ডুয়ো তে কল আসে , রাইদ ভাইয়ের নাম্বার "প্রিয়" দিয়ে সেভ করা ছিলো ।
স্ক্রিনে প্রিয় নামটা দেখে আমি শুকনো বিষম খেলাম ।
কি আশ্চর্যের কথা!
ভয়ে তো আমি কল রিসিভ করতে পারছি না ।
একবার বাজতে বাজতেই কল কেটে গেলো এবং আবার কল আসলো ।
দ্বিতীয় বার আমি ভয়ে ভয়ে কল রিসিভ করলাম ।
ফোন রিসিভ করা মাত্রই বিশাল এক ধমক_ "ফোন পেয়ে নিজেকে হিরোইন ভাবতে শুরু করে দিছিস? কল করার জন্যও এপয়েন্টমেন্ট নেয়া লাগবে সবাইকে!"
আমি মিনমিন করে বললাম_ না আমি ওটা না..
-- কোনটা না? আবার ধমকে উঠলেন উনি ।
-- নায়িকা না!
মাথা নিচু করে বললাম ।
-- নায়িকা না তো কি? হলিউডের মডেল? ঢং করো তুমি ঢং? কতগুলা বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেললে শুনি?
,
একথা শুনে আমি অবাক হয়ে তাকালাম ফোনের স্ক্রিনে ।
সে রাগীভাবে তাকিয়ে আছে , দাঁত চিবিয়ে বললো_
-- চুলগুলো তো ঘোড়ার লেজ বানিয়ে ছেড়েছিস আবার রঙচঙ মেখে জোকার সেজেও বসে আছিস । এতো ঢং পাস কোথা থেকে রে?
-- কি বলছেন রাইদ ভাই?
-- ওহ হো কি বলছি বুঝতে পারছেন না আপনি? চুলে কালার করেছিস কেনো? চুল গুলো স্টেইট করেছিস কেনো?
-- এটা ফ্যাশন রাইদ ভাই৷
-- স্কুলে পড়তে যাস তুই ফ্যাশন করতে না , লাভ লেটার পেতে না । সাফ সাফ বলে দিচ্ছি তিনদিন পর আমি ব্যাক করছি দেশে । এবার যদি হাফ ইয়ার্লিতে ফার্স্ট না হতে পারিস তাহলে তোর লেখাপড়া বন্ধ করে দিবো আমি । আ্যান্ড আই মিন ইট!
বলেই খট করে ফোনটা কেটে দিলেন উনি ।
আমি তো তব্দা খেয়ে গেলাম ।
তবে প্রথমে উনি বেশ রাগ করে ফেলছিলেন , আবার কথার মাঝেই নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করে নিলেন ।
রাইদ ভাইয়ের এই দিকটা আমার প্রচন্ড ভালো লাগে ।
,
পরদিন সকালে আমি স্কুলে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বললাম ওদের ।
ওরা সবাই এবার আমাকে বোঝাতে থাকলো নিশ্চয়ই পজেটিভ সাইন এগুলো ।
সেও তোকে ভালোবাসে অমুক তমুক ।
আমি এবার নতুন স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করে দিলাম ।
দু'দিন কেটে গেলো স্বপ্নের মতো তাকে নিয়ে ভাবতেই ।
যেদিন রাইদ ভাই আসবেন ঠিক সেদিন স্কুলে একটা বিরাট ঝামেলা হলো ।
আমাদের ক্লাসের সব থেকে বাজে মেয়ে অনু আর আমার ফোনটা একদম সেম ।
তো ও ক্লাসে বসে বাজে ভিডিও দেখছিলো ঐ সময় আমাদের স্কুলের ক্লাবের চেয়ারম্যান ক্লাস ভিজিট করতে আসলেন ।
অনু বসেছিল আমাদের এক বেঞ্চ পেছনে ।
ও ইয়ারফোন লাগিয়েই ফোন দেখছিলো , যখন চেয়ারম্যান স্যার আসলেন তখন তো সবাইকে দাঁড়াতে হলো এবং এই ফাঁকে ওর হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো ।
ইয়ারফোনটাও খুলে গেলো ।
ফোনটা পড়েছিল আমারই পায়ের কাছে , স্যার ভেতরে আসামাত্র আপত্তিকর শব্দগুলো বাজতে শুরু করলো ।
সবাই তো অবাক ।
আশেপাশে খুঁজতে লাগলো সবাই আসলে কোথা থেকে শব্দ আসছে ।
অনুই চিল্লিয়ে বললো _স্যার ম্যাম এই দেখেন মিথির পায়ের কাছে ফোন!
ব্যাস হয়ে গেলো এবার!
ক্লাসে তো হাসাহাসি আছেই তারপর আমাকে অফিস রুমে নিয়ে যাওয়া হলো । এই ফাঁকে বলতেই পারলাম না আমার ফোন আমার ব্যাগে আছে ।
প্রিন্সিপাল ম্যাম বললেন গার্ডিয়ান কল করা হবে ।
আমি ভয়ে কাঁদছিলাম , কিছুই বলিনি কারণ আমি তো কিছু করিনি ।
আমার সামনেই গার্ডিয়ান কল হলো , ভাবলাম ফুপ্পি আসবে আমাকে তো বুঝবে ।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ফুপ্পি না রাইদ ভাই আসলেন ।
প্রিন্সিপাল ম্যাম যখন ওনাকে বলছিলেন ওসব তখন আমার জাস্ট লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো ।
সব শোনার পর উনি আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললেন_ মিথি এ ব্যাপারে তোর কিছু বলার আছে?
আমি কেঁদে কেঁদে হেঁচকি তুলে ফেলেছি । তারপরও ওভাবেই ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললাম_ আমি কখনো ওসব করিনি । আমার আর অনুর ফোন সেম , আমার ব্যাগেই আমার ফোনটা আছে ব্যাগটা আনলেই দেখতে পাবেন ।
আমার কথা শুনে ক্লাস থেকে ব্যাগ এবং অনুকে আনা হলো ।
ব্যাগ খুলে দেখা গেলো আমার ফোন আমার ব্যাগেই আছে ।
এবার রাইদ ভাই ম্যামকে কয়েকটা কড়া কথা শোনালেন । ওনারা আমাকে টিসি দিতে চাইছিলেন ,রাইদ ভাই রেগে বললেন আপনাদের টিসি দিতে হবেনা আমিই ওকে এই স্কুলে পড়াবো না ।
আমার ব্যাগ নিয়ে আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসলেন ।
উনি এতো জোরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন যে ব্যাথায় আমার অবস্থা শেষ ।
আমি না পেরে বললাম_ টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কেনো! ব্যাথা পাই তো ।
কথাটা শেষও হয়েছে আর উনি ঘুরে ঠাস করে বসিয়ে দিয়েছেন একটা গালে ।
বেশ রেগে ধমকে বলেছেন_ স্কুলে ফোন আনতে বলছে কে তোরে হ্যাঁ?
ফাজিল মেয়েলোক । তোর লেখাপড়া আজকে থেকে বন্ধ ।
ধাক্কে গাড়িতে বসিয়ে হাইওয়ে দিয়ে আন্দাজি কোথায় যেতে শুরু করলেন ।
আমি তো কেঁদেকেটে অস্থির , গালে তিনটে আঙুলের ছাপ পড়েছে ।
প্রায় অনেক্ষণ কাঁদার পর আমার দূর্বল লাগছিল , ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিলো ।
সিটে হেলানি দিয়েই আমি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।
তবে এক সময় আমার মনে হচ্ছিল আমি ঐ মুহুর্তে কারো বুকে আছি , ধুকপুক শব্দ শোনা যাচ্ছে ।
কেউ পরম যত্নে গালে নরম করে ছুঁইয়ে দিচ্ছে আর বলছে_ স্যরি বাচ্চাটা , খুব স্যরি । এতোটা ব্যাথা পাবা বুঝতেই পারিনি। এবং আরো অনেক কিছু ।
আমি জানিনা সেই স্পর্শ সত্যি নাকি স্বপ্ন তবে ঐ মুহুর্তে আমার মনে হচ্ছিল আমি একটা রাজকুমারী এবং এই মানুষটা আমার একচ্ছত্র রাজকুমার।
চলবে...
Writer:- Sinin Tasnim Sara