১০.
নিস্তেজ পায়ে নিজ ফ্ল্যাটে এসে হাজির হলো হৈমন্তী। তাকে ফিরে আসতে দেখে অবাক হলেন আসরাফ সাহেব। জিজ্ঞেস করলেন,
--- "কিরে মা, ফিরে এলি যে?"
--- "ভালো লাগছে না বাবা। যাবো না।" নিষ্প্রভ স্বরে জবাব দিলো হৈমন্তী।
রাবেয়া ভ্রু কুঁচকালেন,
--- "যাবি না মানে? এই না কি সুন্দর যাচ্ছিলি। আবার কি হলো?"
--- "মাথা ব্যথা করছে মা। ঘুমাবো।"
--- "ঘুমাবি মানে? আমার রাগ উঠাস না হৈমন্তী! চুপচাপ সবার কাছে যা।"
হৈমন্তী বিরস চোখে একপলক মায়ের দিকে তাকালো। অতঃপর কথা অমান্য করে চলে গেল নিজ রুমে। হালকা শব্দে লাগিয়ে দিলো দরজা। রাবেয়া রোষপূর্ণ চাহনি মেলে ধরলেন হৈমন্তীর যাওয়ার পথে। কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
--- "দেখেছো তোমার মেয়েকে? একটা কথাও শুনে না। একে নিয়ে যে আমি কি করি!"
আসরাফ সাহেব দিরুক্তি করে উঠলেন,
--- "আহা! এত কথা বলো না তো! ওর হয়তো সত্যিই মাথা ব্যথা করছে। তুমি বরং এক কাজ করো। ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে ঠান্ডা পানি খাও। মাথা ঠান্ডা হয়ে যাবে।"
_____
রুমে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো হৈমন্তী। ঠোঁটে তার লাল রঙা লিপস্টিক। যাওয়ার সময় রাবেয়া জোড় করে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। রুক্ষ শক্তিতে বাম হাতের উলটো পিঠে ঠোঁট মুছে নিলো সে। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটের আশপাশ, হাতের তালু সল্প লালে আচ্ছাদিত হলো। হৈমন্তী সটান হয়ে শুয়ে নিষ্পলক চেয়ে রইলো সিলিংএর দিকে। চেয়ে রইলো প্রায় অনেক্ষণ। নির্জীব, অনুভূতি শূণ্য হয়ে। বুকের ভেতরটা কেমন ভারী হয়ে আসলো। আচ্ছা, সব দোষ কি সত্যিই তার? সবকিছুর জন্য শুধুমাত্র সে-ই কি দায়ী? হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল হৈমন্তীর। নয়ন জোড়ায় অশ্রু খেলতে লাগলো। গাল বেয়ে গলা অব্দি ছুটতে লাগলো সেগুলো।
-
তখন শীতের মাস। চারিদিক কুয়াশায় আচ্ছন্ন। হৈমন্তীর স্পষ্ট মনে আছে তারিখটি। ১২ই ডিসেম্বর। এই দিনটিতেই অচেনা এই রংপুরের পাঁচ তলা বিশিষ্ট বিল্ডিংয়ে থাকতে এসেছিল হৈমন্তীর পরিবার। সেদিনই প্রথম সে তুষারকে দেখেছিল। উঠোনের এক কোণে, এক বেঞ্চে কপালে হাত রেখে শুয়ে আছে এক যুবক। হৈমন্তী একপলক সেদিকে তাকায়। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নেয় ধীর গতিতে।
হৈমন্তী প্রকৃতি প্রিয় মানুষ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির নির্মল বাতাস উপভোগ করা যেন তার নিত্যদিনের অভ্যেস। প্রতিদিনকার মতো বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতি উপভোগ করার পাশাপাশি একটা জিনিস ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করে তাকে। রোজ উঠোনের মধ্যিখানের এক বেঞ্চে একটা ছেলেকে বসে থাকতে দেখে সে। একদম চুপচাপ, মাথা নিচু করে, মলিন মুখে। ভার্সিটি যাওয়া আসার সময়ও ছেলেটির নিশ্চুপ অভিব্যক্তিতে ওভাবেই বসে থাকা বিশেষ ভাবে খেয়ালে আসে তার। ছেলেটির কি কোনো কাজ নেই? প্রতিদিন ওভাবে চুপচাপ বসে থাকে কেন? কৌতূহল জাগলেও হৈমন্তী কখনো আগ বারিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে যায় নি। কেমন জড়তা কাজ করতো ওর মাঝে। কেননা ছেলেটিকে দেখতে তার চেয়ে বড়ই মনে হতো হৈমন্তীর।
এভাবে বেশ কিছু দিন চলল। একদিন হেমন্ত থেকে জানতে পারলো, ছেলেটি তার চেয়ে ছোট। অনার্সে ভর্তি হয়েছে এবার। বাড়িওয়ালার একমাত্র ছেলে। মুহুর্তেই হৈমন্তীর সব জড়তা কেটে গেল। অজানা কৌতূহলগুলো গভীর ভাবে জেঁকে বসল মস্তিষ্কে। ছেলেটা তো তার ছোট ভাইয়ের মতোই। সে হিসেবে কথা তো বলাই যায়!
এরপর থেকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হৈমন্তী সূক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করতো ছেলেটিকে। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হলে তুষার ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে থাকতো কিছু সেকেন্ড। তারপর যখন দেখত, হৈমন্তী তার থেকে চোখ সরাচ্ছে না, তখন বিরক্ত সহিত চলে যেত সেখান থেকে। ছেলেটাকে জ্বালাতে হৈমন্তীর বেশ লাগত। সে ইচ্ছে করে আরও বেশি তাকিয়ে থাকতো তুষারের মুখপানে।
এরপর একদিন সাহস করে তুষারের কাছে যায় হৈমন্তী। তুষারের পাশে বসে কোনো ভণিতা ছাড়াই জিজ্ঞেস করে,
--- "আপনার নাম কি?"
তুষার একপলক তাকায়। গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়, "তুষার।"
--- "ওহ্! আমার নাম হৈমন্তী।"
তুষার তখন আপন মনেই অস্পষ্ট কণ্ঠে আওড়ায়, "হৈমন্তীকা।"
যা শুনতে পেয়ে হেসে ফেলে হৈমন্তী। বলে,
--- "আমার নাম হৈমন্তীকা না তো। হৈমন্তী। আর আমি কিন্তু আপনার চেয়ে অনেক বড়। তাই আমাকে আপু বলে ডাকবেন।"
প্রতিউত্তরে তুষার হ্যাঁ, না কিছুই বললো না। হৈমন্তী আবার জিজ্ঞেস করল,
--- "আচ্ছা তুষার, আপনি সবসময় এভাবে চুপচাপ বসে থাকেন কেন? বিরক্ত হন না?"
এবারো নিশ্চুপ তুষার। তুষারের ব্যবহারে তেমন ভাবান্তর ঘটলো না হৈমন্তীর। সে ভেবেই রেখেছিল এমন কিছু ঘটবে। সুতরাং, হৈমন্তী তার মতোই বকবক করতে লাগলো।
মাসখানেক যেতেই তুষারের ব্যবহারে পরিবর্তন এলো। আগে শুধু হৈমন্তীই কথা বলতো। তুষার চুপচাপ বসে শুনতো শুধু। কোনো কথা বলতো না। মাথা নিচু করে রাখতো সবসময়। কিন্তু এখন সেও হৈমন্তীর সঙ্গে মন খুলে কথা বলে। হঠাৎ হঠাৎ গালে হাত রেখে নিমেষহীন চেয়ে রয় হৈমন্তীর মুখপানে। মাঝে মাঝে এমন সব আবেগমাখা কথা বলে, হৈমন্তী ভীষণ অস্বস্তিতে পরে যায়। তবে অত ঘাটায় না ব্যাপারগুলো। কিন্তু দিনে দিনে তুষারের আচরণ আরও পাগলাটে হতে শুরু করে। হৈমন্তীর প্রতি তীব্র অধিকার বোধ যেন তার মাঝে সর্বদা বিরাজমান। তাই তো হৈমন্তী সরে এসেছিল তুষারের থেকে। রুঢ় আচরণে নিজেকে শক্ত করে রেখেছিল। চড়ও তো মেরেছিল তুষারকে। তাহলে সে দোষী কিভাবে হলো? এক পর্যায়ে হৈমন্তীর মনে হলো, না! সব দোষ তারই। তুষারের সঙ্গে আগ বারিয়ে কথা বলাটাই ছিল তার দোষ, মারাত্বক ভুল। যার শাস্তি হিসেবে অন্যের কথা শুনতে হচ্ছে তাকে।
_____
রাতে বেশ দেড়ি করে ঘুমায় হৈমন্তী। ফলসরূপ সকালে উঠতে দেড়ি হয়ে যায় তার। ফজরের নামায কাজা হয়ে যায়। ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে নামায আদায় করে সে। এরপর অলস পায়ে সোফায় গিয়ে বসে। আসরাফ সাহেব সেখানেই বসে বসে খবর দেখছিলেন। মেয়েকে নিজের পাশে বসতে দেখে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। স্নেহভরা স্বরে বললেন,
--- "শরীর ঠিক আছে তো মা? মাথাব্যথা আছে এখনো?"
--- "না বাবা।"
কথাটা বলে কিছুক্ষণ চুপ রইলো সে। হাসফাস করতে লাগলো। এরপর ক্ষীণ আওয়াজে বললো,
--- "বাবা? এ বাসাটা আর ভালো লাগছে না আমার। অন্য বাসা দেখো।"
আসরাফ সাহেব অবাক হলেন,
--- "কেন মা?"
রাবেয়া মাঝখান দিয়ে ফোড়ন কেটে উঠলেন,
--- "কেন? বাসা পাল্টাবে কেন? কি সুন্দর ছাদে গাছ রাখার সুবিধা আছে এখানে। কি খোলামেলা! তার উপর প্রতিবেশীদেরও কি সুন্দর আচরণ।"
রাবেয়ার কথায় তাল মিলিয়ে আসরাফ সাহেবও বললেন,
--- "হ্যাঁ, মা। তাছাড়া তোর ভার্সিটি, আমার অফিস আর হেমন্তর স্কুলও তো এখান থেকে কাছে। তাহলে অসুবিধেটা কোথায়?"
আসরাফ সাহেব এমন ভাবে বললেন, যে আর দিরুক্তি করতে পারলো না হৈমন্তী। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাত্র।
সেদিন আর ভার্সিটি যাওয়া হলো না তার। ঘর থেকেই বের হলো না। বিকেলের দিকে একটু ছাদে যেতেই ছাদের এককোণে তুষারকে দেখে থমকে গেল হৈমন্তী। তুষার তখনো দেখেনি তাকে। তড়িৎ গতিতে উলটো পায়ে আবার ফিরতে নিলেই, পেছন থেকে তুষার গমগমে স্বরে ডেকে উঠল,
--- "দাঁড়ান, হৈমন্তীকা।"
১১.
'দাঁড়ান, হৈমন্তীকা' তুষারের বলা এই একটি বাক্য শুনে ভড়কে গেল হৈমন্তী। তুষার দেখে ফেলেছে তাকে। ডাক শুনেও দাঁড়ালো না সে। বরং পায়ের গতি আরও বাড়িয়ে দিলো। পেছন থেকে তুষার অনবরত ডেকে যাচ্ছে। হৈমন্তী তবুও থামলো না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, সে তুষারের সাথে কথা বলবে না। তুষারের সামনেই যাবে না আর।
ডাকতে ডাকতে একসময় চুপ হয়ে গেল তুষার। কিন্তু তার পায়ের শব্দ তীব্র ভাবে শুনতে পাচ্ছে হৈমন্তী। তার সঙ্গে সঙ্গে তুষারও সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামছে। তিন তলায় আসতেই তুষারকে নিজের কাছাকাছি অনুভব করলো সে। আরও দ্রুত পা চালানোর আগেই, পেছন থেকে তার হাত খপ করে ধরে ফেললো তুষার। শক্ত বাঁধনে আবদ্ধ করে নিলো। হৈমন্তী ভীষণ চমকালো। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
--- "এগুলো কি ধরণের অসভ্যতা তুষার? হাত ছাড়ুন।"
--- "আপনাকে এতগুলো ডাক দিয়েছি আমি, শুনেন নি?"
হৈমন্তী মুখ শক্ত করে জবাব দিলো,
--- "না।"
--- "কালকে আসেন নি কেন হৈমন্তীকা?"
তুষারের কণ্ঠে কোনো রাগ নেই। কণ্ঠস্বর একদম শীতল, ঠান্ডা। তবে অভিমানে ভরপুর। হৈমন্তী অন্যদিকে চেয়ে উত্তর দিলো,
--- "ইচ্ছে হয় নি তাই। এবার ছাড়ুন।"
বলে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো সে। তুষার হাতের বাঁধন আরও শক্ত করলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ-ই হৈমন্তীকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো নিচে। হৈমন্তীর পরনে ঘরের এক আধপুরোনো সবুজ রঙা কামিজ। মেচিং ছাড়া নীল ওড়না এবং সাদা পায়জামা। এই অবস্থায় তুষার তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? বিরক্তিতে মুখ পাংশুটে হয়ে গেল হৈমন্তীর। ইতিমধ্যে বিল্ডিংয়ের বাহিরে এসে গেছে তারা। দারোয়ান চাচার সামনে দিয়ে যখন তুষার তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, দারোয়ান চাচা কিভাবে হাসছিলেন তখন। ভাবতেই লজ্জা লাগছে হৈমন্তীর। সে আবারও হাত ছাড়ানোর ব্যর্থ প্রয়াস করতে লাগলো। রাগী গলায় ধমক দিলো,
--- "আপনার সমস্যা কি তুষার? আমার হাত ছাড়ুন! নইলে আবার চড় খাবেন আমার হাতে। বেয়াদব কোথাকার!"
তুষার জবাব দিলো না। রাস্তার ওপাশে নিয়ে গেল। বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন মানুষের যাতায়াত রাস্তায়। তাদেরকে এভাবে হাত ধরা অবস্থায় দেখে ওরা কি ভাববে? তুষার কি নির্বোধ হয়ে গেছে? হৈমন্তী আরও বেশ কয়েকবার হাত ছাড়তে বললো। তুষার আগের মতোই নিশ্চুপ, নির্বিকার, নির্লিপ্ত। হৈমন্তী নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না। মুক্ত হাতটি দিয়ে জোড়ে চড় মারলো তুষারের ডান গালে। ভাবলো, তুষার হয়তো এবার হাত ছাড়বে। কিন্তু আশানুরূপ তেমন কিছুই ঘটলো না। তুষারকে আগের চেয়েও বেশি নির্লিপ্ত দেখালো এবার। হৈমন্তীর দিকে একবার তাকালো না পর্যন্ত। তবে চোয়াল খানিক শক্ত হয়ে এলো তার।
তুষার একটা রিকশা ডাকলো। অগোছালো হৈমন্তীকে নিয়ে যেতে লাগলো কোনো এক জায়গায়। ততক্ষণে হৈমন্তীও প্রশ্ন করতে করতে ক্লান্ত। হাল ছেড়ে চুপচাপ বসে আছে তুষারের অল্প দূরত্বে। তুষার তখনো তার হাত ছাড়ে নি। আঙুলের ভাঁজে আঙুল রেখে সামনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে।
_____
কোনো এক নদীর তীর। ছোটখাটো কিছু নৌকা, স্টিমার নদীর বুক চিঁড়ে ছুটে চলছে। পানিতে পানিতে তান্ডব ঘটছে। তীব্র ভাবে ঢেউ বহমান। বাতাসের আনাগোনা প্রচন্ড। কোনোমতে করা খোপা ঢিলে হয়ে কাঁধে এসে ঠেকেছে হৈমন্তীর। ছোট চুলগুলো উন্মুক্ত কাঁধে বিঁধে গিয়ে কি ভীষণ চুলকাচ্ছে! হৈমন্তী আবারো হাত খোপা করতে লাগল। তার পাশে দাঁড়ানো তুষার মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল প্রেয়সীর চুল বাঁধা। একমনে চেয়েই রইলো, পলক ফেলছে না একদমই। হৈমন্তীর খেয়ালে এলো তা। হাত নামিয়ে, ক্রুদ্ধ চোখে জিজ্ঞেস করলো,
--- "বারবার মানা করা সত্ত্বেও আমাকে এখানে এনেছেন কেন?"
হৈমন্তী থেকে চোখ সরালো সে। নদীর দিকে তাকিয়ে আওড়ালো,
--- "ধরুন, আপনি একটা পিকনিকের আয়োজন করলেন। সবাই জানলো, পিকনিকটা আপনি করেছেন আপনার কাজিনদের জন্য। অথচ আপনার মনে অন্য কিছু। প্রতিদিনের চেয়ে আরেকটু বেশি সময়ের জন্য একজনকে দেখার তাড়নায় পিকনিকটি আয়োজন করেছেন আপনি। ওই একজনকে বারবার ডেকে পাঠিয়েছেন পিকনিকে আসার জন্যে। তবুও সে আসলো না। এবং আপনি তবুও অপেক্ষা করে গেলেন ওই একজনের জন্য। একসময় পিকনিক শেষ হয়ে গেল। তখনো তার আসার নাম নেই। তাকে একটা বার দেখার ব্যাকুল ইচ্ছায় আপনি তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন প্রায় ভোর অব্দি। কিন্তু ফলাফল শূণ্যই রয়ে গেল। তখন আপনার কেমন অনুভূতি হবে? কষ্ট হবে না? দহন সৃষ্টি হবে না মনে?"
একটু থামলো তুষার। হৈমন্তীর চোখে চোখ রেখে বললো,
--- "আমি অপেক্ষা করেছিলাম, হৈমন্তীকা। আপনি আসেন নি।"
মুহুর্তেই হৈমন্তীর বক্ষস্থলে বয়ে গেল এক নিদারুণ যন্ত্রণাময় অনুভূতি। কেমন দোটানায় পরে গেল সে। কেন যেন মনে হতে লাগল, তুষারের জন্য তার মনে অন্য এক অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে হৈমন্তীর আমি নামক ব্যক্তিটি গোপনে চিৎকার করে উঠল, 'এ পাপ হৈমন্তী। এ অসম্ভব।'
হৈমন্তী দমে গেল। অতি সন্তপর্ণে ক্ষীণ অনুভূতিগুলো আড়াল করে ঝাঁঝালো স্বরে বললো,
--- "আমি এখনই বাসায় যাবো।"
বুক চিঁড়ে এক সুগভীর, পীড়াদায়ক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তুষারের। কিছু সময় নির্নিমেষ চেয়ে দেখল হৈমন্তীকে। এরপর বললো, "চলুন, হৈমন্তীকা।"
_____
রিকশা এসে থামলো বিল্ডিংয়ের সামনে। গেটের মাঝে বড় বড় করে লেখা 'তৈমুর ভবন'
তুষার তৈমুর। তুষারের পুরো নাম। তুষারের নামেই এই বিল্ডিংটি তৈরি। আফতাব সাহেব ভীষণ ভালোবাসেন তার ছেলেকে। তেমনি শাসনও করেন। তিনি নিশ্চয়ই তার ছেলের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ভেবে রেখেছেন। সেখানে তার ছেলে তো তার কথা শুনছেই না। বিপথে হাঁটছে। নিজের চেয়ে বড় মেয়েকে ভালোবাসা তো কোনো সঠিক কাজ নয়। সমাজ কি বলবে, আত্মীয় কি বলবে, তারচেয়ে বড় কথা ভবিষ্যতের কি হবে? ছোট ছেলের সঙ্গে কি চিন্তাধারার মিল হবে? তাছাড়া হৈমন্তীর বাবারও হৈমন্তীকে নিয়ে অনেক আশা। সে আশা কিভাবে ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ করবে সে?
হৈমন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তুষার তার পাশেই হাঁটছে। একেবারে দু'তলা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো সে। দরজার কাছাকাছি এসে হৈমন্তী যেতে নিলেই তুষার সুপ্ত আবদার করে উঠলো,
--- "আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি হৈমন্তীকা?"
বলে উত্তরের আর অপেক্ষা করলো না সে। হুট করে জড়িয়ে ধরলো হৈমন্তীকে। নিজের বুকের সঙ্গে গভীর ভাবে ঠেকিয়ে রাখলো ওর মাথা। হৈমন্তী শক্ত হয়ে গেল। চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। তুষারের বুকে ধাক্কা দিয়ে কাঁপা গলায় তেজ ঢেলে আদেশ দিলো,
--- "স-রু-ন, তুষা-র..."
তুষার একটু নিবিড় হতেই হৈমন্তীর কণ্ঠ থেমে গেল।
১২.
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে বাহিরে। বাতাসের তীব্র তান্ডবে তীর্যকভাবে বৃষ্টির এক একেকটা ফোঁটা গায়ে লাগছে। নিস্তব্ধ, নির্জন রাস্তার মধ্যিখানে হাঁটছে তুষার। রাত আনুমানিক ন'টা হবে। বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না তার। আবার না যেয়েও উপায় নেই। ধীর স্থির ভাবে হাঁটতে থাকা পায়ের গতি আরও কমিয়ে দিলো সে। আরও ধীরে হাঁটতে লাগলো। শার্টের কাঁধের অংশটা ভিঁজে গেছে ইতিমধ্যে। একটু পরে সে নিজেই কাকভেঁজা হয়ে যাবে। রাস্তার এক লোক সেদিক দিয়ে যাচ্ছিল। তুষারের এহেন উদাসীন ভাব দেখে তাড়া দিয়ে বললো,
--- "এত আস্তে হাঁটছেন কেন ভাই? বৃষ্টি আরও বাড়বে। তাড়াতাড়ি পা চালান।"
লোকটির কথায় কোনোরূপ ভাবান্তর ঘটলো না তার। সে আগের ন্যায়ই নিশ্চুপ। একমনে হেঁটে চলছে সামনের পথে।
আরেকটু পথ অতিক্রম করতেই লোকালয়ের কাছাকাছি চলে এলো তুষার। রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধা প্রতিদিন চুড়ি বেচাকেনা করেন। আজ বৃষ্টি হওয়ায় চুড়িগুলো একটা থলের ভেতর ঢুকিয়ে রাখছিলেন তিনি। সেদিকে তাকিয়ে আপনা-আপনি থেমে গেল তুষারের পা। রঙ-বেরঙের চুড়িগুলোর দিকে চেয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো সে। কল্পনা করলো, একদিন তার দেওয়া চুড়ি, শাড়ি পড়ে হৈমন্তী তার কাছে আসবে। তাকে দেখেই লজ্জা পেয়ে কপালে পরে থাকা চুলগুলো কানে গুঁজে নিবে। কাঁচের চুড়িগুলো একটার সঙ্গে একটা বারি খেয়ে টুংটাং শব্দ করবে তখন। তুষার মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে তা।
ভাবতেই ঠোঁটে ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠল তার। পরক্ষণেই কি ভেবে হাসিটা মিলিয়ে গেল। এর বদলে বেরিয়ে এলো কয়েকটি দীর্ঘশ্বাস।
বৃদ্ধার কাছে এগিয়ে গেল তুষার। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে হাঁটু ভেঙ্গে বসলো। অতঃপর চুড়ি দেখতে লাগলো। বৃদ্ধা তখন ব্যস্ত হয়ে বললেন,
--- "কইনগুলা নিবা বাজান? তাত্তাড়ি কও। বৃষ্টি আইছে। বাসায় যামু।"
তুষার হালকা হাসার চেষ্টা করলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
--- "নীল চুড়িগুলো দিন তো দাদী।"
দাদী বলায় বৃদ্ধা খুশি হলেন যেন। মুখ ভরে হাসলেন। ডাজনখানেক চুড়ি একটা পলিথিনে করে তুষারকে দিলেন। এক হাতে চুড়ির থলে নিয়ে অন্যহাতে পকেট হাতড়ে মানিব্যাগ বের করল তুষার। বললো,
--- "কত টাকা দাদী?"
--- "তিরিশ।"
তুষার ত্রিশ টাকা দিলো না। বরং পঞ্চাশ টাকা ধরিয়ে দিলো বৃদ্ধাকে। বৃদ্ধা প্রথমে নিতে চাইলেন না। জোড় করতেই বললেন,
--- "চুড়িগুন কি তোমার বউর লাইগা নিতাছো বাজান?"
তুষার মলিন হাসলো। জবাব দিলো,
--- "না, প্রেয়সীর জন্য।"
_____
তুষার বাসায় ফিরলো রাত ১টা ৫৬ মিনিটে। ড্রইংরুমের সোফায় আফতাব সাহেব থমথমে মুখ নিয়ে বসে ছিলেন। সে ভেতরে ঢুকতেই বাজখাঁই গলায় ধমক দিয়ে উঠলেন,
--- "কয়টা বাজে তুষার? এখন বাসায় আসার সময় হলো তোমার? কোথায় ছিলে এতক্ষণ?"
তুষার দাঁড়ালো। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
--- "বাহিরে ছিলাম।"
--- "বাহিরে কোথায়? দিন দিন তুমি কিন্তু মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছ তুষার। এতরাত পর্যন্ত বাহিরে কি কাজ তোমার? আসলে কি জানো, দোষ তোমার না। ওই মেয়েটার। ওই মেয়ে তোমার জীবনে আসার পর থেকেই তুমি এমন পাগলাটে ধরণের হয়ে গেছ। কি করো, না করো, সেটা কি তুমি নিজে জানো? তোমার মাথাটা একেবারে খেয়ে ফেলেছে মেয়েটা।"
তুষার এতক্ষণ শান্ত থাকলেও এবার খানিকটা রেগে গেল যেন। বিরক্ত সহিত বললো,
--- "এখানে ওর কথা আসছে কোত্থেকে? যা করছি আমি নিজ ইচ্ছেতেই করছি। সব বিষয়ে ওকে টানবে না বাবা।"
আফতাব সাহেব বড় বড় চোখে তাকালেন। ঝাঁঝালো কণ্ঠে হেনার উদ্দেশ্যে বললেন,
--- "দেখেছো তোমার ছেলেকে, হেনা? পরের মেয়ের জন্য কি দরদ উতলে পরছে! নিজের বাবার সঙ্গে এভাবে কথা বলতেও মুখে বাধছে না ওর।"
হেনা করুণ চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। এ বিষয়ে কোনোরূপ উত্তর দিলেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন স্বামীর পাশে। তুষার একবার নিজ মাকে দেখছে তো একবার বাবাকে। ভীষণ বিরক্তি লাগছে তার। মনে হচ্ছে, আশেপাশে কোনো সিরিয়ালের নাটক চলছে। ঘুম পাচ্ছে বড্ড। আর কোনো জবাব দিলো না তুষার। সবকিছু সূক্ষ্ণ ভাবে অগ্রাহ্য করে চলে গেল নিজের রুমে। আফতাব সাহেব কিন্তু তখনো থামেন নি। উঁচু গলায় অনবরত বকে যাচ্ছেন তাকে।
তুষার ফ্রেশ হয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। টেবিলে রাখা চুড়িগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, কি ভেবে ফোন হাতে নিলো। অতঃপর হৈমন্তীর নম্বরে মেসেজ টাইপ করলো, "কাল শাড়ি পরে আসবেন হৈমন্তীকা?"
পরক্ষণেই হাতের কঠিন চাপে লিখাটা আবারো কেটে দিলো সে।
_____
রবিবার।
আজ রোদের তাপটা একটু বেশিই। সূর্য যেন তার সহস্র ক্রোধ ঢালছে পৃথিবীতে। মানুষসহ কাকপক্ষীরও গরমে আজ বেহাল অবস্থা। বাসে বসে থাকা হৈমন্তী বাম হাতের পিঠে কপালের ঘাম মুছে নিলো। শহরের রিকশা চালকদের আজ কি হয়েছে কে জানে! আধঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেও একটা রিকশা পায় নি সে। বাধ্য হয়ে বাসে উঠতে হয়েছে তার। ভেবেছিল, জানালার পাশে বসলে হয়তো একটু হলেও বাতাসের ছোঁয়া গায়ে লাগবে। কিন্তু কই? গরমে যেন শরীর থেকেই তাপ বের হচ্ছে!
হৈমন্তী ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলল। বাস থেমেছে। কনডাক্টর যাত্রী নিচ্ছে। সেদিকে চেয়ে হৈমন্তী আবারো জানালা গলিয়ে বাহিরে তাকাতেই হঠাৎ কোত্থেকে তুষার এসে বসে পরল তার পাশে। কোনো কিছু না বলেই হৈমন্তীর ওড়না দিয়ে নিজের ঘর্মাক্ত ললাট মুছতে মুছতে আওড়ালো,
--- "কি ভীষণ গরম পরেছে, তাই না হৈমন্তীকা?"
হৈমন্তী চমকালো, ভড়কালো, তাজ্জব বনে গেল। বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে আশ্চর্য কণ্ঠে বললো,
--- "আপনি এখানে?"
তুষার বিস্তর হাসলো। প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উলটো জিজ্ঞেস করলো,
--- "পানি হবে আপনার কাছে?"
হৈমন্তীর হাতেই পানির বোতল ছিল। সেটা তুষারকে দিতেই সে আগের মতোই মুখ লাগিয়ে পান করলো তা। এরপর পানির বোতল ফেরত দিয়ে অনুমতি চেয়ে বললো,
--- "আপনার হাতটা একটু দিন তো হৈমন্তীকা।"
তুষার কি অনুমতি চাইলো তার কাছে? নাকি আদেশ করলো? ঠিক আন্দাজ করতে পারলো না হৈমন্তী। জোড়ালো গলায় প্রশ্ন ছুড়লো, "কেন?"
তুষার এবারো প্রশ্নের জবাব দিলো না। নিজেই টেনে নিলো হৈমন্তীর হাতজোড়া। কোলে রাখা পেকেট থেকে একটা একটা করে চুড়ি বের করে পরিয়ে দিতে লাগলো তার দু'হাতে। হৈমন্তী কেন যেন বাঁধা দিতে পারলো না। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো ক্ষীণ লাজুক নয়নে।
চুড়ি পড়ানো শেষ হতেই হৈমন্তীর হাত টেনে উঠে দাঁড়ালো তুষার। হৈমন্তী জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। ঠোঁটের কোণে দূর্বোধ্য হাসি ফুটিয়ে তুষার আওড়ালো,
--- "চলুন হৈমন্তীকা। বাইকে করে আজ সারা শহর ঘুড়বো।"
চলবে...
Writer:- ঈশানুর তাসমিয়া মীরা