আমি বিড়াল খুব অপছন্দ করি। ছোট্ট তুলতুলে শরীর, সাদা-কালো কিংবা খোয়রি লোম, ছোট্ট ছোট্ট পা আমাকে অসহ্য করে তোলে। বিশেষ করে কালো বিড়াল। এই বস্তুটির নাম শুনলেও মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠে। কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় যদি কালো বিড়াল দেখি, আমি বাসায় ফিরে যাই। না, এমন নয় যে আমার জন্ম থেকেই বিড়ালের প্রতি ঘৃনা ছিলো। আমি বিড়াল ভালবাসতাম। খুব ভালবাসতাম এই প্রাণীটি কে। কিন্তু এক বিভৎস ঘটনা আমার এই ভালোবাসাকে ঘৃণায় পরিবর্তন করে। ঘটনাটা আপনাদের বলি।
তখন আমি ক্লাস ফোরে পরি। বাবা মা আর আমি একটা পুরনো বাড়ির তিনতলায় ভাড়া থাকতাম। দোতলায় থাকতেন বিধবা বাড়িওয়ালী। বয়স ষাটোর্ধ্ব হবে। বেশ মিশুক মহিলা। মা আর আমি প্রায়ই উনার ফ্ল্যাটে দেখা করতে যেতাম। বেশ সুন্দর ছিমছাম করে সাজানো মহিলার ফ্ল্যাট। মা আর উনি যখন গল্প করতো আমি তখন দেওয়ালে ঝোলানো ছবি, শোকেসে সাজানো আকর্ষণীয় নানান জিনিস পত্র অনেক মনোযোগ নিয়ে দেখতাম। আরেকটি জিনিস আমার নজর কাড়লো এই ফ্ল্যাটে আসার দ্বিতীয় দিন। লিভিং রুমের পাশের ঘরে অন্ধকারে কি যেনো জল জল করছে। সবুজ দুটো চোখ। আমি এগিয়ে গেলাম। প্রাণীটিও এগিয়ে আসলো। একটি কালো বিড়াল।
মায়া ভরা চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে। ওর হলদেটে সবুজ চোখ জোড়া দেখে বড় মায়া হয়। আমি হাত বাড়াতেই কোলে উঠে পড়ল বিড়ালটা। সেদিনের পর প্রায়ই বাড়িওয়ালীর ফ্ল্যাটে যেতে শুরু করলাম। উদ্দেশ্য শিমির সাথে খেলা করা। মাও কিছু বলতেন না। বৃদ্ধ বাড়িওয়ালিও খুব খুশি হতেন আমাকে দেখে। নানান গল্প শোনাতেন। তবে কিছুদিন ধরে শিমি কে কেমন অদ্ভুত লাগতে শুরু করলো। ওর চোখে কিছুদিন যাবত সেই মায়া ভরা ভাবটা খুঁজে পাই না। সেখানে যেনো হিংস্র একটা চাহনী। ওকে কোলে নিতে ভয় হতে শুরু করলো। মনে হতো এই বুঝি মুখটা খামচে র'ক্তা'ক্ত করে দেবে।
এরপর প্রায় দুই সপ্তাহ কেটে গেলো। স্কুলে পরীক্ষা চলছিল। পড়াশোনা নিয়ে ব্যাস্ত থাকায় বাড়িওয়ালীর সাথে দেখা হয়নি। শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে বাড়ি ফেরার পর মা বললো বাড়িওয়ালী খুব অসুস্থ। নড়াচড়া করতে পারছেন না তাই রান্নাবান্নাও করছেন না। শুনে খুব মন খারাপ হলো। গতকাল মা দু বেলার খাবার দিয়ে এসেছিল। তিনি বললেন আমি যেনো সন্ধায় রাতের খাবারটা দিয়ে আসি। সন্ধায় খাবারের বাটি নিয়ে মহিলার দরজায় কড়া নাড়লাম দরজা কেউ খুললো না। কিছুক্ষন অপেক্ষা করে দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো। ভেতরে উকি দিয়ে দেখি জমাট অন্ধকার। দেওয়াল হাতড়ে লাইটের সুইচ জ্বালালাম। ভেতরে কারো সারা শব্দ নেই। বারিওয়ালির ঘরে ঢুকতেই নাকে বিকট দুরগন্ধ এলো আমি তাড়াতাড়ি বাড়িওয়ালির ঘরে সুইচ হাতড়ে লাইট জ্বালালাম। তারপর যে দৃশ্য দেখলাম সেটা দেখার পর নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। বিকট চিৎকার করে জ্ঞান হারালাম।
জ্ঞান ফিরতে দেখলাম আমি আমার বিছানায়, মা পাশে বসে আছে। মনে পড়ে গেল ওই ভয়ানক দৃশ্যটি আল্লাহ কি করে যে আপনাদের বলি! সে বিভৎস দৃশ্য আমার এখনো মনের গেঁথে আছে। বাড়িওয়ালির ঘাড়ের দিক থেকে বেশ কিছু অংশের মাং'স কেউ যেন খুবলে খেয়েছে। র'ক্ত ঝরছে এবং পচা গন্ধ আসছিল তারই থেকে। মহিলাটি যে বেঁচে নেই তা তার খোলা চোখ দেখেই বোঝা যায়। মহিলা যে রকিং চেয়ারের উপর এক দিকে ঘাড় কাত করে বসেছিলেন তার পেছন থেকেই সেই কালো বিড়ালটি হেঁটে আসে। তখন বুঝতে পারিনি তার মুখের কাছে কি যেন চকচক করছিল হয়তো তার কালো রঙের জন্যই বুঝতে পারিনি। ওটা ছিল র'ক্ত। মা বললেন, তারা আমার চিৎকার শুনে দৌড়ে যায়। বাড়িওয়ালির ফ্লাটে গিয়ে দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে বেডরুমের দরজার সামনে পড়ে আছি। পুলিশকে ফোন করতেই তারা দ্রুত এসে বাড়িওয়ালীর লাশটি নিয়ে যায় ও ঘরে বিভিন্ন পরীক্ষা করে সিল করে দেয়। যেন কেউ ভিতরে ঢুকতে না পারে। পরবর্তীতে জানা যায় অতিরিক্ত খিদের কারণেই বাড়িওয়ালির বেড়ালটি বাড়িওয়ালির ঘাড়ের কাছটার মাং'স খুবলে খেয়েছে। বাড়িওয়ালী অসুস্থ হওয়ার কারণে চলাফেরা করতে পারছিল না। তাই বিড়াল কেউ ঠিকমতো খাবার দিতে পারছিল না।
এই ঘটনাটার আমার মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাবের ফলেই আমি এখন পর্যন্ত কোন বিড়ালই সহ্য করতে পারি না। কালো বেড়াল তো একদমই না। কিন্তু দেখুন আমার কপালটা! যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হলো আমার কলিগ, তার বিড়াল খুবই পছন্দ যা আমি আগে জানলে তাকে কখনোই বিয়ে করতাম না। বিয়ের প্রথম রাতে ঘরে ঢুকে দেখি আমার যেখানে বসার কথা ঠিক সেখানেই একটা কালো বিড়াল ঘুমিয়ে আছে। আমি চেঁচিয়ে ওঠার আগেই পেছন থেকে সজীব এসে হাসতে হাসতে বলল,"আমার বিড়াল খুব পছন্দ তোমাকে বলা হয়নি। এটা আমার পোষা বিড়াল ক্যাথি।" নিজের রাগ সংযত করে চুপ করে রইলাম।
এক সপ্তাহ কেটে গেল। আমার স্বামীর প্রতি আমার বিরক্তি যেন বেড়েই চলেছে। তার কারণ ওই বিড়ালটাই। সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে সজীব তার প্রিয় প্রাণীটিকে নিয়েই খুনসুটি করতো,তার যত্ন আঁত্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। ক্যাথিকে আমি ঠিকসময় মতো খাবার না দিলে আমার উপর বেশ বিরক্ত হত। অথচ আমি তার নববিবাহিতা স্ত্রী। আমার দিকে তার কোন নজরই নেই। দিন দিন সহ্যের সীমা আমার ক্রমেই কমে চললো। আমার স্বামীকে আমার একদম অসহ্য মনে হতে লাগলো। আমাকে বিশেষ পছন্দ করত না তা ওর আচরণে বুঝতে পারতাম। মনে হতো লাগলো এই বিড়ালটাই যত নষ্টের মূল। যদি বিড়ালটাকে কোনোভাবে সরিয়ে দিতে পারি তবেই আমি আমার স্বামীর কাছে আদর ভালোবাসা পাবো। মনে মনে একটা ফোনদি এটে ফেললাম। যখনই সজীব বাসায় থাকবে না তখনই এ বিড়ালটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আর কি ব্যবস্থা করব সেটাও ঠিক করে রাখলাম। সকালে সজীব অফিসে চলে যাওয়ার পর আমি দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম হাতে একটা বড় চটের ব্যাগ। জোর করে কালো বিড়ালটার মুখ বেধে ওকে ব্যাগের ভেতর ভরে নিলাম। ব্যাগের মুখটাও শক্ত করে রশি দিয়ে আটকে নিলাম। তারপর চৌরাস্তার মোড়ে গিয়ে বস্তা খুলে দিতেই ক্যাথি দৌড়ে আমার দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেল। মনে মনে হাসলাম ভয় পেয়েছে বেচারা। ও আর ফিরছে না কারণ ওই বাড়ির উল্টো পথে দৌড়ে পালিয়েছে। বাড়িতে এসে নিশ্চিন্তে আমার স্বামীর পছন্দের খাবারগুলো রান্না করতে শুরু করলাম।
সন্ধ্যার পর ও বাড়ি ফিরল। বেশ ক্লান্ত। হাত মুখ ধুয়ে একটু পরে ও ক্যাথিকে খুঁজতে শুরু করল। আমাকে প্রশ্ন করতেই আমি নিরীহর মতন জবাব দিলাম,"কই জানিনা তো কোন দিকে গেছে! দোতলা বাড়ি, হয়তো জানালা দিয়ে বেরিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে আবার ফিরে আসবে চিন্তা করো না।" ও আর কিছু বলল না রাতের বেলা সজীব টেবিলে বসে ল্যাপটপে কি যেন কাজ করছিল। আমি ওর পাশে বিছানায় বসে চুপচাপ বই পড়ছি। খানিক বাদেই হঠাৎ বিড়ালের ডাক শুনতে পেলাম। চেয়ে দেখি ওর কোলে ক্যাথি নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে! আমার বিস্ময়ের আর সীমা রইল না। এত দূর থেকে ও রাস্তা চিনে এলো কি করে?
"কখন ফিরে এলো ক্যাথি?"
"বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে তো খেয়াল করোনি?"
আমি আর কিছু না বলে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝ রাতে ঘুম ভাঙতেই হাতে লোমস কিছু একটার ছোঁয়া পেতেই আঁতকে উঠলাম। দেখলাম ক্যাথি আমার আর ওর মাঝখানেই শুয়ে আছে। রাগে আমি ওকে জোরে টেনে মাটিতে ছুড়ে মারতে যাব এমন সময় ও আচমকা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। খামচে র'ক্তা'ক্ত করে দিল আমার মুখ। আমার চিৎকারে আমার স্বামী ঘুম ভাঙতেই দ্রুত উঠে আমাকে বাঁচানোর জন্য ক্যাথিকে আমার উপর থেকে সড়ালো। আমি রাগে দুঃখে কাঁদতে শুরু করলাম। আমার স্বামীও ক্যাথির উপর বিরক্ত হলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে মুখে সেভ্লন লাগিয়ে দিল। এই প্রথমবার যেন মানুষটার স্পর্শ পেলাম। তার ওপর থেকেও রাগটা যেন কমতে শুরু করল। আর যাই হোক তাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। এখনই বিড়ালটাই যত নষ্টের মূল ও আমার সংসার থেকে গেলে আমরা অনেক ভালো থাকবো।
এর মাঝেই আমি অনেকবার অনুরোধ করেছিলাম সজীবকে ক্যাথিকে যেন কোথাও ফেলে আসে কিংবা কাউকে দিয়ে দেয় । ও কোন ভাবেই রাজি হয়নি ক্যাথি আমাকে এভাবে আঘাত করলো তারপরও। একপর্যায়ে আমার মাথা বেশ গরম হয়ে গেল স্বামীর সঙ্গে যে কোন বিষয়ে মনোমালিন্য শুরু হয়ে যেত। আমি জানিনা ক্যাথিকে দু-দুবার বস্তা বন্দি করে দূরে ফেলে আসার পরও কি করে ফিরে আসতো। তৃতীয়বার যখন ফিরে এলো তখন বুঝতে পারলাম আর কোন উপায় নেই ওকে খুন করা ছাড়া। সেদিন রাতে সজীব বাসায় ছিল না অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে ছিল। এটাই যেন আমার সুযোগ। হাসপাতাল থেকে ব্যাগেই এককৌটো ক্লোরোফরমেনে রেখেছিলাম যেন ক্যাথিকে ধরে বেঁধে মারতে কষ্ট না হয়। ওর নাকে একটু ক্লোরোফরম লাগিয়ে দিলেই খানিক পরে ঘুমিয়ে পড়বে তখনই কেচি দিয়ে ওর গলায় একটা ছিদ্র করে দেব সিদ্ধান্ত নিলাম। তারপর ওকে একটা বস্তায় আটকে নিয়ে দূরে কোন খালে ফেলে দিব ভেবে নিলাম। তবে সারাদিন রোগী দেখে ক্লান্ত ছিলাম তাই একটু বিশ্রাম নিলাম।
ঘুম ভাঙতেই দেখি ঘর একদম অন্ধকার কোন আলো আলো জ্বালতে গিয়ে দেখি কারেন্ট নেই। আবছা আলোয় পাশে তাকিয়ে দেখলাম ক্যাথি শুয়ে রয়েছে। এই জানোয়ার টার সঙ্গে আমি এতক্ষন ঘুমাচ্ছিলাম ভাবতে গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। রাগের মাথায় এই অন্ধকারে ব্যাগ থেকে কেচিটা বার করে নিলাম। তারপর সজোরে কেচির ধারালো অংশ দিয়ে ক্যাথির শরীরে আঘাত করতে শুরু করলাম। অনবরত যেন মৃ'ত্যু নিশ্চিত হয়। হয়তো ঘুমের ঘোরেই মৃ'ত্যু ঘটছে ওর এই ভেবে হাসলাম। হঠাত একটা পুরুষের ক্ষীণ আর্তনাদ যেন কানে ভেসে এলো। বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠলো। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না দ্রুত খুঁজে ফোনটা হাতে নিয়ে ফ্লাশ লাইট জ্বালালাম।
হে আল্লাহ! এ আমি কি করলাম সজীব এখানে কি করে এলো ক্যাথির বদলে আমি সজীব কে মে'রে ফেললাম?! পাগলের মত দেখতে লাগলাম সজীব এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিনা। হাতের শিরা পরীক্ষা করলাম। না ওর দেহে আর প্রাণ নেই। এখন আমি কি করবো! কি করে বাঁচবো আমি? এই পৃথিবীতে তো একমাত্র সজীবই ছিল আমার আপনজন। বাবা মাকে তো কবেই মে'রে ফেলেছি। ফোনের স্ক্রিনে একটা মেসেজ দেখতে পাচ্ছিলাম, সজীব লিখেছিল রাত আটটার দিকে, "কাজ আগেই শেষ হয়ে গেল তাই সন্ধ্যায় গাড়িতে উঠলাম রাত বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাব তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।" আমার সজীব! চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলাম। ফ্লাশ লাইটের হালকা আলো তখনও জ্বলছিল। বারান্দার দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম ক্যাথির হলদেটে সবুজ চোখ জোড়া আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। মনে হলো ওর ঠোঁটে একটা আনন্দের হাসি।
( সমাপ্ত )
Writer: Fatema Tasnim