Leave a message
> স্মৃতি
-->

স্মৃতি


"আচ্ছা চাচা, মেয়েরা এত নিষ্টুর হয় কেন?"
মতলব চাচা হো হো করে একটা অট্টহাসি দিলেন ইনানের কথা শুনে। ইনান অন্যমনস্কভাবে পিলারের গায়ে হেলান দিয়ে সামনের লাইনে ইঞ্জিন শান্টিং দেখছে। আবেগের নানারকম ঝড় বয়ে যাচ্ছে আজকে। উইদাউট নোটিশ বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। বৃষ্টির ফোঁটা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা জনশূন্য ট্রেনটার ছাদে পুরোদমে ঝাপটা দিয়ে চুরমার হয়ে প্ল্যাটফর্মে পড়ছে; ভিজে গেছে প্ল্যাটফর্মের ধার।
"তোমারে কেডা কইলো মাইয়া মানুশ নিষ্টুর, ভাইস্তা?"
"কেন চাচা, আপনার সন্দেহ আছে?"
"আরে বোকা পোলাডা কয় কি। তোমার আম্মার কথা ভাবো দেখি; তুমারে সেই সক্কালে উইডা খাওন বানায়া দেয় তুমি কলেজে আইবা বইলা। আরো কত্তো কী! সব শুরু করলে বাবা একখান বই লেখন যাইব"
পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা ইটের টুকরোতে লাথি মারলো ইনান,"আরে চাচা, মা তো আলাদা। মা তো মা-ই। কিন্তু ইয়ে..মানে অন্য মেয়েরা কেন এমন নিষ্ঠুর? আমাদের আবেগগুলো বুঝেই না"
"তুমার কাছে পানি আছে নি?"
"আছে, এই নিন"
বোতলটা নিয়ে হাত ধুয়ে মতলব চাচা তার নেভিব্লু প্যান্টে হাত মুছলেন। কমলাপুর রেলস্টেশনে আজকে দুপুরে মানুষের আনাগোণা কম। রাজশাহীতে কী একটা এক্সিডেন্টের কারণে বনলতা এক্সপ্রেস বন্ধ। চট্টলা স্টেশন ছেড়ে গেছে প্রায় মিনিট পনরো আগে। কোন লোকালও নেই।
"অন্য মাইয়া বলতে? প্রেমে ট্রেমে পড়সো নি বাবা?"
"না চাচা, মানে ইয়ে, হ্যাঁ, কিন্তু মেয়েটা এক্সেপ্ট করলো না, আমি কত কান্না করেছি জানেন?"
আবার মতলব চাচার অট্টহাসি। ইনানের মনে হলো সে এখনি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলবে। মতলব চাচার সাথে সব কথা বলে সে। মতলব চাচা শান্টিংয়ের আগে ট্রেন থেকে ইঞ্জিন বিচ্ছিন্ন করার কাজ করেন। প্রায়ই স্টেশনে ট্রেন এলে ইনান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইঞ্জিন খোলা দেখতো; ইঞ্জিন খুলতে লাগাতে মহাব্যস্ত বৃদ্ধটি কাঁধে ব্ঢ়াগ ঝোলানো ক্রিম কালার শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা নটরডেমের ছাত্রটিকে বেশ খেয়াল করতেন। আস্তে মতলব চাচার সাথে পরিচয় হলো।
"শুনো বাবা, পিরিত টিরিতের সময় এখন না, বুঝলা? সময় আইলে সব করবা। অখন তুমার পড়ালেখা করনের সময়, মনোযোগ দিয়া হেইডা করো। আবেগ টাবেগ এগিলা বাজে জিনিস বুজলা। আমারে দেখো ভাইস্তা, বললে বিশ্বাস করবা আমি আমার কেলাশে ফাস্ট বয় আছিলাম?"
"উমম...করবো চাচা, আপনি মিথ্যা বলতে পারেন না"
আবার অট্টহাসি, হাসিটা কেমন ঝনঝনে, একইসঙ্গে তার মাঝে কৌতুক আর বিষাদ মিশে আছে। মাথায় আটকে থাকে শব্দটা।
"আমি মিছা কইতে পারুম না ক্যান? পারুম। কিন্তু তুমাগো আবেগ বেশি, হেজন্য তুমরা এমনে চিন্তা করো, যারে ভালো ভাবো, সে যে খারাপ হইতে পারে সেইডা চিন্তা করবার পারো না"
"কী জানি, আপনি এত ভাবের কথা যে কই পান!"
"মাইয়ার নাম কী বাবা?
"অনিলা"
"ওহ আইচ্ছা, সুন্দর। দোয়া করি, কোনদিন তুমি অরে পাইয়া যাও, কিন্তু এখন না। এখন নিজেরে গড়ো"
"ট্রেনের খবর জানেন? আসবে কোনটা?"
"মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস আহনের কথা অখন, দেখো"
"আচ্ছা"
"মন খারাপ তুমার? চলো চা খাইবা"
একটু চুপ করে থেকে উঠে দাঁড়ালো ইনান।
.....
"অনি"
"হুমম বলো"
"কেমন লাগছে?"
"কেমন লাগছে মানে? কমলাপুর রেলস্টেশন কি কোন দর্শনীয় স্থান হলো? ফকিরঝকিরে ভর্তি নোংরা জায়গা"
"রেগে যাচ্ছো ক্যান রে বাবা?", ইনান কণ্ঠ নরম করলো আরো।
"ঢং করছিলাম, স্টেশনে আসলেই ভালো লাগছে, এর আগে পাঁচ ছয়বার এসেছি, কিন্তু ট্রেনে ওঠার ব্যস্ততা, মানুষের ভিড়ে পরিবেশটা বুঝতে পারি নি। কিন্তু এখানে কেন?"
"চলো আমার সাথে"
কিছুক্ষণ আগে একটা লোকাল ট্রেন এসেছে। সেটার শান্টিং হবে। পায়ে পায়ে অনিলাসহ এগোলো ইনান। যেমনটা কল্পনা করেছিল, তেমনটাই চোখে এল।
সেই নেভিব্লু প্যান্ট আর হালকা খয়েরি শার্ট। চুলের পাক ধরাটা অনেক বেড়েছে বুড়োর। ইনান ডাকলো,
"মতলব চাচা"
বৃদ্ধ মনোযোগ দিয়ে একটা নাট খুলছিলেন, একপলক তাকিয়ে বললেন,"কেডা আপনে?"
"ভাইস্তা যে এসে এসে সব বলতো, ভাইস্তাকেই ভুলে গেছেন, ভাইস্তার বলা কথাগুলো তো তাহলে আর দুনিয়ায় নাই"
এবার বৃদ্ধ ভালো করে তাকালেন,"ইনান বাবা তুমি! কী খবর! আরে মা, তুমার নাম অনিলা না?"
অনিলা কীরকম প্রতিক্রিয়া করবে বুঝতে পারছে না, অতি সাধারণ ঘটনা, পুরনো পরিচিত লোকের সাথে দেখা করতে এসেছে ইনান, কিন্তু কোথায় যেন একটা আবেগের সমুদ্র এসে ভিড় করছে অনিলার মনেও।
উইদাউট নোটুশ বৃষ্টি পড়ছে, মতলব চাচা ইনানকে জড়িয়ে আছেন, মতলব চাচার হাতে মোবিল লেগে ছিল, সেটা ভুলে গিয়ে তিনি ইনানকে আঁকড়ে ধরে আছেন। ইনানের শার্টের পেছনে আঙুলের কালো কালো দাগ লেগে গেছে। তাতে কী আসে যায়! বৃষ্টি ঝরছে তো বেশ!

Writer:- Omar Ibn Alam
 

Delivered by FeedBurner

a