উনি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। ছোট্ট শিশুটি হাত মুঠি পাকিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। সুস্বাস্থ্যের কারণে মনে হচ্ছে বাচ্চাটিকে বসিয়ে দিলে অনায়াসে সে বসা বা দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। বাচ্চাটা থেমে থেমে অনবরত কাঁদছে। হঠাৎ আম্মার মনে হলো বাচ্চার মুখের ভেতর সাদা সাদা কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। ময়লা ভেবে আম্মা একটা পরিষ্কার ভেজা কাপড় দিয়ে সেটা বের করতে গিয়ে বুঝতে পারলেন,
বাচ্চার উপরের পাটিতে দুটি দাঁত আছে।
বাচ্চার উপরের পাটিতে দুটি দাঁত আছে।
হায় বাচ্চাটি যদি Hydrocephalus এ আক্রান্ত না হতো! Hydrocephalus এর কারণে বাচ্চাটির মাথা অস্বাভাবিক বড়। যা তার পুরো শরীরের চেয়েও দ্বিগুণ বড় ও উঁচু। বিশাল মাথার মাঝে ছোট্ট একটা নিস্পাপ মুখ। একটু পরপর কেঁদে উঠছে। সেদিন যদি শিশুটি সুস্থ্য হতো, আমাদের পরিবারে কতোই না সুখ নেমে আসতো।
বিকেলে আমার ফুপুরা এলেন, অস্বাভাবিকতার কারণে কেউ শিশুটিকে কোলে নিতে চাইলো না। আব্বু বাচ্চাটির জন্য দুধ কিনে নিয়ে এলেন। আম্মা অল্প অল্প করে বাটি চামচ দিয়ে তাই খাইয়ে দিচ্ছিলেন। বড় আম্মার পাতা বিছানায় একসময় বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পরলো।
আম্মা, চাচি, আব্বু আর ছোট চাচার মধ্যে মিটিং হলো। শিশুর এই অস্বাভাবিকতা কোনমতেই আপুকে বলা যাবে না। এমন শিশু দেখতে অনেকেই হসপিটালে ভিড় জমাতে পারে। তাই রুম সবসময় লক করা থাকবে। কেউ যেন বাড়ি বয়ে এসে জিজ্ঞেস করে বিব্রত না করতে পারে, তাই চাচি, বড় আম্মা, আম্মু কেউ বাসায় যাবেন না। আব্বু ও ছোট চাচা বাসা থেকে সব জিনিসপত্র আনা নেয়া করবেন।
বাড়ির বাচ্চাদের জন্য দুইজন মহিলা আছে, আমার ফুপুরাও আমাদের দেখবেন। তাই কাউকে বাইরে যেতে হবে না।
বাড়ির বাচ্চাদের জন্য দুইজন মহিলা আছে, আমার ফুপুরাও আমাদের দেখবেন। তাই কাউকে বাইরে যেতে হবে না।
ভাইয়ার অফিসে অডিট এসেছে, তাই উনি ১৫ তারিখের আগে আসতে পারছেন না। উনাকে জানানো হলো। উনি যেন দ্রুত চলে আসেন।
রাত দুটোর দিকে আপুকে বেডে দিয়ে গেলো । সাদা ফ্যাকাসে মুখ। রক্ত দেয়া হচ্ছে, স্যালাইন চলছে। এমন সময়ে ডাক্তার এলেন। উনি থেমে থেমে যা বললেন।
' আমি অন্যান্য সিজারিয়ানের মতোই প্রথমে পেশেন্টের পেটের নিচের দিকে কাটি, সাধারণত চার ইঞ্চি কাটলেই বাচ্চা বের করা সম্ভব হয়। আমি অনেক টেনেও বাচ্চা বাইরে আনতে পারিনি। আমি প্রথমে বাচ্চার শরীরের যেখানে হাত দিয়েছি। আমার ধারণা ছিলো,, সেটা বেবির পিঠ। আসলে সেটা ছিলো বেবির মাথার একটা অংশ। তাই বাধ্য হয়ে আমি আপনাদের আত্মীয় ডাক্তার কে ভেতরে ডাকি। পরে ডিসিশন নেই
উপর দিকে আরো তিন ইঞ্চি লম্বালম্বি ভাবে পেট কাটার। তারপর বেবি বের করে আনতে সক্ষম হই।
উপর দিকে আরো তিন ইঞ্চি লম্বালম্বি ভাবে পেট কাটার। তারপর বেবি বের করে আনতে সক্ষম হই।
মায়ের জ্ঞান ফিরলে খুব সাবধানে থাকবেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও মানসিক চাপ, তার শরীরের জন্য খুব ক্ষতিকর। এই মুহূর্তে বাচ্চা সমন্ধে কিছু না জানানোই ভাল মনে করেন উনি।
পরদিন সকালে আপুর জ্ঞান ফিরলো। উনি বাচ্চা দেখতে চাইলো। বড় আম্মা বাচ্চাকে প্রায় ঢেকে শুধু মুখের একটু কোণা বের করে বললেন 'দেখো।' আপু কাপড়ের পুঁটলি ছাড়া কিছুই দেখলেন না। এর মাঝেই উনার অপারেশন পরবর্তী ব্যাথা শুরু হলো। দ্রুত প্রেথিডিন ইঞ্জেকশন দিয়ে আপুকে ঘুম পারিয়ে দেয়া হলো। লোকজন আসছে। আপু বেশি অসুস্থ্য বলে, বাইরে থেকে বিদায় দেয়া হচ্ছে। সেদিন রাতে আপুর ভালভাবে জ্ঞান ফিরলো। উনি বাচ্চার কথা ভুলে ভাইয়ার জন্য কাঁদতে লাগলেন।
আম্মাকে বললেন, ' নিতু আন্টি, ও আগেই বলেছিল
আমার বিপদে জামান সাহেব থাকবে না। দেখলেন তো! জামান সাহেব আমার কাছে নেই। '
আমার বিপদে জামান সাহেব থাকবে না। দেখলেন তো! জামান সাহেব আমার কাছে নেই। '
নার্স এসে আপুকে আবার ইঞ্জেকশন দিলো, উনি ঘুমিয়ে গেলেন। সেদিন ছিলো ১৪ই মে'র রাত। রাত বারোটার দিকে পুরো হসপিটাল ঘুমন্ত। হঠাৎ বাচ্চার পায়ের পাতা এবং হাতের তালু নীল হয়ে গেলো। আম্মা দ্রুত ইমার্জেন্সী ডাক্তারকে খবর দিলেন।
ডাঃ জানালেন বাচ্চার শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা হচ্ছে। অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে এমন হচ্ছে। উনি দ্রুত বাচ্চাকে অক্সিজেন দিলেন। আস্তে আস্তে ভোর হলো।
শিশু ডাক্তার বাচ্চাকে দেখে জানালেন, বাচ্চার অবস্থা তেমন ভালো না। তার বাবাকে জরুরী কল করুন।
সকাল দশটার মাঝেই ভাইয়া চলে এলেন। উনি ঢাকা এসে, ঢাকা টু রাজশাহী প্লেনে এসেছেন। উনি গোসল সেরে, বাচ্চা কোলে নিলেন। বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে ঝরঝর করে কাঁদছেন আর দোয়া পড়ছেন।
সকাল দশটার মাঝেই ভাইয়া চলে এলেন। উনি ঢাকা এসে, ঢাকা টু রাজশাহী প্লেনে এসেছেন। উনি গোসল সেরে, বাচ্চা কোলে নিলেন। বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে ঝরঝর করে কাঁদছেন আর দোয়া পড়ছেন।
আপা চোখ মেলে ভাইয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো-
'জামান সাহেব, ওরা আমার বাচ্চাটাকে কোলে দেয় না। আপনি দেবেন! ভাইয়া কাঁদতে কাঁদতে বললেন
'তুমি সুস্থ্য হও, তারপরে সারাদিন বাবুকে কোলে রাখবে।
'তুমি সুস্থ্য হও, তারপরে সারাদিন বাবুকে কোলে রাখবে।
'একটু দেখান না দেখি বাবুকে।
ভাইয়া উঁচু করে বাবুকে দেখালেন, আপু বিছানায় শুয়ে তোয়ালে ছাড়া আর কিছুই পেলেন না।
আম্মা আর চাচিকে বললেন বসিয়ে দিতে। ডাক্তার না করলেন। বললেন
' বিকেল বেলা বসিয়ে উনাকে এক কাপ চা খেতে দেবেন। তারপরে রাতে একটু একটু করে নতুন করে হাঁটতে শেখাবেন। অন্তত দুইজন শক্ত মানুষ ধরে রাখবেন। নইলে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন।'
বিকেলে, বাবুকে আরেকজন শিশু বিশেষজ্ঞ এর কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। এই ফাঁকে ভাইয়া আপুকে ধরে বসালেন। বসার পরেই আপু বাচ্চাকে খুঁজতে লাগলো।বাবু তখন ডাক্তারের কাছে। তাই উনি বাচ্চাকে দেখতে পারলেন না।
ডাক্তার বললেন ' আপনারা সাবধানে থাকবেন, বাচ্চার যে কোন সময়ে ইনফেকশন হতে পারে। বাচ্চার নানাবিধ সমস্যা নিয়ে কথা বললেন। কিন্তু কোন ওষুধ দিলেন না।
আপু রাতে উনার বিছানা বাচ্চার কাছে নিয়ে যেতে বললেন। আব্বু আর ভাইয়া তাই করলো। উনি হাত বাড়িয়ে বাচ্চা খুঁজছিলেন। ভাইয়া উনার আঙুল বাবুর ছোট্ট হাতের মাঝে দিলেন। কি আশ্চর্য বাচ্চা তার মায়ের আঙুলটা মুঠি পাকিয়ে ধরে থাকলো। আপু বারবার বলতে লাগলেন ' জামান সাহেব দেখেন, আমার ছেলে আমার হাত ধরে আছে। দেখেন আমার ছেলের কি বুদ্ধি। ' ভাইয়া সজল চোখে মাথা নাড়ছেন।
আপু বললেন ' আমার ছেলের নাম কি জামান সাহেব!'
আপু বললেন ' আমার ছেলের নাম কি জামান সাহেব!'
ভাইয়া চুপ করে থাকলেন। এতো বিপদে কেউ বাচ্চার নাম ভাবেনি। ' আপু কাঁদছেন আর বলছেন ' আমি জানতাম আমার ছেলেকে কেউ পছন্দ করবে না। তাই বলে একটা নাম ও রাখবেন না! কেমন বাবা আপনি! '
নার্স আসলো আপু'কে হাঁটাতে। উনি এক'পা দুই'পা হাঁটেন আর বাবুর দিকে তাকান। বাচ্চা তখন মশারিতে ঢাকা। আব্বু আপুকে বোঝালেন, বাচ্চার গায়ে মশা কামড়ালে বাচ্চা কষ্ট পাবে। অসুস্থ্য হয়ে যেতে পারে।
তাই এই ব্যবস্থা। হাঁটার ক্লান্তিতেই আপু একটু পরেই ঘুমিয়ে গেলেন।
তাই এই ব্যবস্থা। হাঁটার ক্লান্তিতেই আপু একটু পরেই ঘুমিয়ে গেলেন।
বাচ্চাটা দ্রুত বেশি অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে । সিদ্ধান্ত নেয়া হলো পরদিন এ্যাম্বুলেন্স করে আপু সহ বাচ্চাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হবে। আব্বু সব রেডি করতে বাসায় চলে গেলেন। দুই রাত জেগে উনি প্রচণ্ড ক্লান্ত ও ছিলেন।
রাত দশটার দিকে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হলো। ঝড় থামলো রাত বারোটায়। বাচ্চাটি অল্প অল্প কাঁদছিলো, আম্মা একটু দুধ খাওয়াতে চাইলেন। বোঝা যাচ্ছে বাচ্চাটি খুব কষ্ট পাচ্ছে। সে একটা চিৎকার দিলো। তার হিসুর বদলে ',এক ফোঁটা রক্ত, বের হয়ে এলো। ' বড় আম্মা বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বসে আছেন, আম্মা আর চাচি দুই দিক থেকে উনাকে ঘিরে বসে দোয়া পড়ছেন।
এমন সময়ে আপার ঘুম ভেঙে গেলো। উনি জেগেই বলতে লাগলেন, আমি স্বপ্ন দেখেছি প্রচণ্ড ঝড়ে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বন্যার পানিতে সব ডুবে গেছে ঝড় ও থামছে না। ' ভাইয়া উনাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে 'বাবু আল্লাহ্র কাছে চলে গেলো। '
আপু বললেন, ' আমি বাথরুমে যাবো, হেঁটে হেঁটে যাবো। আমাকে ধরো তোমরা। '
আম্মা, চাচি, বড় আম্মা কেউ নড়লো না। ভাইয়া একা আপুকে কোলে করে বাথরুমে নিয়ে গেলেন।
বড় আম্মা কাঁদতে কাঁদতে আম্মাকে বললেন ' নিতু তুমি এখুনি বাচ্চা'টাকে নিয়ে বাসায় চলে যাও। আমার
প্রথম নাতি মারা গেলো। অন্তরার শারীরিক অবস্থা এতো খারাপ, ও বুঝতে পারলে, নিজেও মারা যাবে।'
প্রথম নাতি মারা গেলো। অন্তরার শারীরিক অবস্থা এতো খারাপ, ও বুঝতে পারলে, নিজেও মারা যাবে।'
আম্মা বিনাবাক্য ব্যয়ে মৃত শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন। চাচি, আম্মার হাত ধরে আছেন।, দুজন চুপিসারে হসপিটাল থেকে বের হয়ে এলেন। হায় তারা যদি জানতেন কি আছে তাদের কপালে।
পুরো হাসপাতাল নিস্তব্ধ। রাত তখন দুইটা বাজে।
আমাদের ইসলাম ধর্মেও বলা আছে এই সময়টা মানুষ ঘুমাবে কারণ এই সময়ে জ্বীন জাতি চলাফেরা করে।
আমাদের ইসলাম ধর্মেও বলা আছে এই সময়টা মানুষ ঘুমাবে কারণ এই সময়ে জ্বীন জাতি চলাফেরা করে।
হাসপাতালের গেটে কেউ নেই। দূরে একজন টুলে বসে ঝিমুচ্ছে। আম্মা বা চাচি কেউ তাকে ডাকলেন না। হাসপাতালের একজন আয়া সাথে এলো। উনি একজন গার্ডকে ডেকে নিয়ে এলেন। গার্ড বললেন, উনি সাথে যাবেন। উনার হাতে একটা বড় টর্চ। আম্মা মৃত শিশুটি কোলে হাঁটা শুরু করলেন।
হাসপাতালের সীমানা পার হওয়া মাত্র দুইটা কুকুর আম্মার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। আর একটু এগোতেই কুকুর বাড়লো। একসময় খুব জোড়ে কয়েকটা কুকুর ডেকে উঠলো। আম্মার গায়ে প্রবল গরম বাতাসের একটা ধাক্কা লাগলো। চাচি ভয়ে আম্মাকে জড়িয়ে ধরলেন। পাশ থেকে তিনচারটি কুকুর লাইন ধরে এদিকে আসতেই আগের কুকুরগুলি কুঁইকুঁই করতে করতে, পালালো।
আমার আম্মার বর্ণনা...
আমি হাঁটছি, আমার কোলে একটি মৃত শিশু। কুকুরগুলি আমাদের ঘিরে রেখেছে। তাই খুব আস্তে আস্তে হাঁটছি। একটু আগে ঝড় হবার কারণে রাস্তা ছিলো জনশুণ্য। এমনকি সারারাত জ্বলা চায়ের দোকানের চুলাগুলিও বন্ধ। কুকুরগুলির উচ্চতা ছিলো মাটি থেকে বড়জোর আধ হাত উঁচু। তারা কোন শব্দ করছিলো না। তারা মাঝেমাঝে আমার হাতের দিকে তাকাচ্ছিল। তাদের চোখ হলুদাভ, সেই চোখগুলো আগুনের মতো জ্বলছে।
আমি প্রাণপণে বাচ্চাটিকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরেছিলাম। গার্ড আলম বারেবারে কুকুরগুলোর উপরে টর্চের আলো ফেলতে চাচ্ছিলো ।
সে যেদিকেই টর্চ ধরে, কুকুরগুলি অন্যদিকে সরে যায়।
সে যেদিকেই টর্চ ধরে, কুকুরগুলি অন্যদিকে সরে যায়।
একসময় কুকুরগুলি একদম আমার গা ঘেঁসে দাঁড়ালো। আমি একমনে আল্লাহ্ কে ডাকছি। আল্লাহ্ আপনি এই ফেরেশতা শিশুটিকে বাঁচান। কুকুরগুলি
খানিকক্ষণ একটু দূরে গেলো। তারপর তারা একসাথে আমাদের ঘিরে ধরলো, চারপাশ থেকে
খানিকক্ষণ একটু দূরে গেলো। তারপর তারা একসাথে আমাদের ঘিরে ধরলো, চারপাশ থেকে
( চলবে )...
Writer:- Adrita Mehzabin