Leave a message
> দ্বীপের নাম সেন্টিনেল অন্তিম পর্ব
-->

দ্বীপের নাম সেন্টিনেল অন্তিম পর্ব



আরিফ আর প্রজ্ঞা সেন্টিনেল দ্বীপে যাচ্ছে।। এই দ্বীপ এমন একটা দ্বীপ সেখানে কোনদিন সভ্য মানুষের পা পড়েনি, আবার শোনা যায় এই দ্বীপে নরখাদকেরা থাকে।। আজ পর্যন্ত যারাই এই দ্বীপে যাবার চেষ্টা করেছে, তারা কেউ আর জীবিত ফেরত আসে নি।। এমনকি তাদের লাশ পর্যন্ত কেউ উদ্ধার করতে পারে নি।। তবুও আরিফ আর প্রজ্ঞা কিসের টানে, কিসের আকর্ষণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই দ্বীপে যাচ্ছে, এটা এখনো অজানা।। শত বাঁধা অতিক্রম করে ওরা যখন সেন্টিনেল দ্বীপে পা রাখলো, তখন ঘটলো আরেক বিপত্তি, কোথা থেকে ওদের দিকে তীর ছুঁড়ে মারা হলো।। এই অবস্থায় আরিফ এক প্রকার ভয় পেয়ে প্রজ্ঞাকে ফেলেই সাগরে ঝাঁপ দিয়ে একটা নৌকায় আশ্রয় নিলো।। আরিফের কাঁধে প্রজ্ঞার ওয়াটার প্রুফ ব্যাগ ছিলো, নৌকায় বসে প্রজ্ঞার ব্যাগ খুলে একটা ডায়েরী পেলো, সেখানে এমন কিছু লেখা ছিলো, যা আরিফের কল্পনার বাইরে।। ওই লেখাগুলো পড়ে আরিফ, আবার দ্বীপে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।। না এবার সে প্রজ্ঞাকে উদ্ধার করবে, নয়তো সেন্টিনেলেই জীবন দিবে।।

এই ছিলো প্রথম দুই পর্বের অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।। আপনি যদি আগের দুই পর্ব পড়ে না থাকেন, তবে পড়ে নিতে পারেন।। আমি নিচে লিংক যুক্ত করে দিবো।।

আলো পরিষ্কার হয়ে দ্রুত সকাল হচ্ছে।। মাঝি সাগরে হারিয়ে যাচ্ছে, আরিফ আর পিছনে ফিরেও তাকালো না, মনে হলো কোন জীবন প্রদীপকে সে এড়িয়ে গেলো।। সতর্ক চোখে দ্বীপের সামনে তাকাচ্ছে, ডানে বামে তাকাচ্ছে।। দেখলো কাউকে দেখা যায় কিনা, নাহ্‌ কাউকে দেখা যাচ্ছে না।।

আরিফ এগিয়ে যাচ্ছে, স্বাভাবিক হাঁটার গতি কিন্তু চোখ কান বেশ সতর্ক।।

আচমকা সামনে তাকিয়ে যা দেখলো, তা না দেখলেও হতো।। আরিফ কি আবার পালাবে, আরিফের বিশ্বাস চেতন মাঝি এখনো সাগরে অপেক্ষা করছে ওর জন্যে কিংবা ওদের জন্য।।

আরিফ দেখলো, সামনে অদূরে পাঁচজন পুরুষ আদিবাসী ওর দিকে তীর তাক করে দাঁড়িয়ে আছে।। কিন্তু আরিফ ওদের চোখে হিংস্রতার বদলে কৌতুহল দেখতে পাচ্ছে।। প্রজ্ঞা এখন কোথায় আছে কে জানে, আরিফ আদিবাসীদের তাক করা তীরের সূচালো ফলার দিকে তাকিয়ে আছে, ওর কাছে মনে হচ্ছে একটা স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এভাবে নরখাদকের দ্বীপে আসতে পারে না।। একটা তীর লাগলেই তো জীবন শেষ, দ্বীপের ভিতরে কিভাবে যাবে আর প্রজ্ঞার ব্যাপারেই বা কিভাবে খোঁজ নিবে!! আরিফের ধারণা ও মানসিক ভারসাম্যহীন, সে এবার তীর থেকে চোখ সরিয়ে আদিবাসীদের গায়ের পোশাকে নজর দিলো।। যাক্‌ এই দৃশ্য সে বহু সিনেমায় দেখেছে, আসলেই এরা এমন নেংটি পরে থাকে, কিন্তু এই নেংটি কিসের তৈরি সেটা ধরতে পারছে না।। কাপড়ের হবার কথা না, এরা কাপড় পাবে কই!! কালো কুঁচকুচে ওই পাঁচ আদিবাসী আরিফের দিকে এগিয়ে আসছে, এগিয়ে আসা ভালো লক্ষণ, এর মানে তারা তীর ছুঁড়ে মারবে না।। তাহলে কি করবে, ওকে নিয়ে কি রান্না করে খাবে, কে জানে!!

আরিফ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, ওর ভয়-জড়তা কেনো যেনো আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে।। ওর মনে হচ্ছে, মরে গেলে গেলাম, কি লাভ আর ভয় ভয় পেয়ে।। ওই পাঁচজনের মধ্যে একজনকে দেখে আরিফের দলের প্রধান মনে হচ্ছে, লোকটা বেশ মোটাসোটা আর দেখতে একদম জল্লাদের মত।। আরিফ মনে মনে ভাবছে, এরা তো নিগ্রোদের থেকেও কালো, এত কালো কিভাবে সম্ভব।।

পাঁচজনের ওই ছোট দলটা, তীর নামিয়ে আরিফের কাছে আসলো, যাকে দলের প্রধান ভেবেছে সে আরিফের দিকে দাঁত খিঁচিয়ে বললো- নিকোই কুবারু রুদাম!!

আরিফ হ্যাঁ করে তাকিয়ে আছে, এই ছেলে হিন্দিই বুঝে টেনে টুনে, তাও বলতে পারে না।। আর এই আদিবাসীদের নিকোই কুবারু রুদামেরর কি উত্তর দিবে।। তবে ওর কথা বলার ধরণে বুঝে গেছে এটা প্রশ্ন।। এবার দলের প্রধান খেঁকিয়ে উঠে আবার বললো- নিকোই কুবারু রুদাম।।

আরিফ শেষ শব্দটাই মিন মিন করে বললো- রুদাম, রুদাম।।

ওরা একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো।। তারপর, নিজেরদের মধ্যে কি সব বলে একজন আরিফের হাত চেপে ধরলো।। আরিফের মনে হলো, কোন শিরিষ কাগজ দিয়ে ওর হাত মুড়ে ফেলা হয়েছে, এত খসখসা আর শক্ত হাত কি মানুষের হয়।। আরিফকে এক প্রকার টেনে নিয়ে দ্বীপের ভিতর যাচ্ছে, তবে সেই টানার মধ্যে অতিরিক্ত জোর নেই স্বাভাবিক ভাবেই যাচ্ছে।। আরিফ ভাবলো, রুদাম মনে হয় ভালো শব্দ।। বিপদে পড়লে রুদাম রুদাম বলা যাবে।।

গাছপালা, লতাপাতার ভিতর দিয়ে সরু এক রাস্তা, ফাঁকে ফাঁকে বাড়ি দেখতে পাচ্ছে।। বাড়ি বলতে, বাঁশের খুঁটির উপরে বিশেষ ভাবে ডালপালা রেখে মাটি দিয়ে লেপ্টে দিয়েছে।। অদ্ভুত এক দৃশ্য!! এখানের লোকসংখ্যা মনে হয় খুব কম, এই পাঁচজন মনে হয়ে এদের সীমান্ত রক্ষী, যাক্‌ সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা পড়ে আরিফের এখন ভালোই লাগছে।। প্রজ্ঞা কই আছে কে জানে, তবে প্রজ্ঞাকে ওরা মেরে ফেলে নি এটা সে বুঝে গেছে।।

সরু রাস্তা পেরিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় আসতেই, আরিফ বড়সড় ধাক্কা খেলো।। একি এদের মহিলাদের বুক তো একদম উদোম, শুধু ছেলেদের মত নিচে নেংটি পরা, আর এই নেংটি বিশেষ কোন গাছের লতাপাতার থেকে বানানো হয়েছে মনে হচ্ছে।। আরিফ লজ্জায় মহিলাদের দিকে তাকাতে পারছে না, সে ভাবতেই পারছে না চারদিকে এত এত অর্ধউলঙ্গ মহিলা থাকবে, এটা তার ভাবনার বাইরে ছিলো।। আরিফকে ওরা ওখানে নিয়ে যেতেই, সবাই নিজেদের মধ্যে কি সব বলা শুরু করে দিয়েছে।। যাকে বলে গুঞ্জন আর কি, কয়েকজন দুই পা ছড়িয়ে উপরে হাত তুলে কি সব অঙ্গভঙ্গি করছে, এই দৃশ্য দেখার মত।। আরিফ চারদিকে তাকিয়ে এখন বেশ মজা পাচ্ছে।।

আগের পাঁচসদস্যের একজন, আরিফকে দেখিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো- তিকোরা মিনি ঝুমা কামান্দি।।

সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।। আরিফ সবার হাসি দেখে, আরও মজা পেয়ে গেলো।। কয়েকজন ছোট ছেলে-মেয়ে এসে আরিফকে কাছ থেকে দেখছে।। আরিফ ভাবলো, এরা যদি এখন ওকে রান্না করেও খায় সমস্যা নাই, জীবনে এমন এডভেঞ্চারিং দৃশ্য দেখতে দেখতে মরলে কি বা আসে যায়।।

আরিফের দিকে তাকিয়ে সেই সম্ভাব্য সীমান্তরক্ষীদের প্রধান বললো- নিচুক কুরা ইলান।।

আরিফ তাকিয়ে আছে, সে বুঝলো এটাও প্রশ্ন!! কিন্তু সে এবার কোন ঝুঁকি নিচ্ছে না, দেখা গেলো নিচুক কুরা ইলান মানে, ঐ বেটা তোকে খাবো।। আর আরিফ ইলান বলে জবাব দিলো, যার অর্থ হয়ে গেলো, আচ্ছা খাও!! সে চুপ করে বুঝার চেষ্টা করছে, করুণ দৃষ্টিতে ওই আদিবাসীর দিকে তাকিয়ে আছে।। এবার সে নিচুক নিচুক বলে হাতের আঙ্গুল গুটিয়ে মুখে দেয়ার ভান করলো।। আরিফ বুঝে গেলো, ও কিছু খাবে নাকি তাই জিজ্ঞেস করেছে।। আবার ভাবলো, ওকেই খাবে কিনা তাই জিজ্ঞেস করলো নাতো!!

আরিফ কিছুই বলছে না, চুপ করে থাকাই শ্রেয়।। আরিফের জানা দরকার প্রজ্ঞা কই আছে, কিন্তু এই ব্যাপারে সে কিভাবে জানবে বুঝতে পারলো না।। আচমকা তারা আরিফকে নিয়ে আবার কই যেনো যাচ্ছে, আরিফ মনে মনে ভাবলো, সিনেমায় দেখা যায় এরা গোত্রের প্রধানের কাছে নিয়ে যায়, আমাকে এরা কই নিয়ে যাবে কে জানে!!

সত্যি সত্যি একটা বড় বাড়ির সামনে নিয়ে আসলো আরিফকে, বাড়ির একপাশ পুরো খোলা, তিনপাশে বেড়া আছে।। তবে অন্যদের বেশির ভাগ বাড়িতে শুধু উপরে চালের মত আছে, চারপাশ ফাঁকা।। এখানে বয়স্ক এক লোক মাটির কৃত্রিম টিপির উপরে পা ভাঁজ করে বসে আছে।। লো কমোডে আমরা যেভাবে বসি সেভাবে।।

এই লোকটা মনে হচ্ছে, ওদের সবার প্রধান হবে।। আর কেনো যেনো মনে হলো, আরিফকে যে এখানে আনা হবে, এটা এই লোক জানতো।। কেউ হয়তো তার কাছে আগেই খবর পৌঁছে দিয়েছে, বাহ্‌ এখানেও তবে গোত্র প্রধানের গুপ্তচর আছে।।

আরিফকে নিয়ে ওরা একদম প্রধানের সামনে নিয়ে দাঁড়ালো।। তারপর অদ্ভুতভাবে বুকে চাপড় দিয়ে কি যেনো বললো।। আরিফ বুঝে নিলো, এটা হয়তো সালাম বা স্যালুটের মতো কোন ব্যাপার হবে।। আরিফের কাঁধে দুইদিক থেকে দুইজন চাপ দিলো, আরিফ নিচু হতে হতে বুঝলো না ওরা এমন চাপাচাপি করছে কেন আচমকা।। পরে বুঝলো, যে এই প্রধানের সামনে নীল ডাউনের মত করে বসে থাকতে হবে।। আরিফও ওদের মত করে নীল ডাউন হয়ে বসে রইলো।।

বেশি কিছু ওদের নিজেদের ভাষায় কিসব কথা বার্তা হলো।। তারপর আরিফকে রেখে সবাই আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে।। শুধু গোত্র প্রধানের নিজের লোকগুলো এখানে আছে।। আরিফ উঠে একা একা দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে।। দ্বীপের পরিবেশটা আসলেই সুন্দর।। চারদিকেই জঙ্গল, শুধু মাঝে মাঝে ফাঁকা জায়গা।। যতদূর বোঝা যায়, এই ফাঁকা জায়গাগুলো গাছ, লতাপাতা কেটে কেটে বানানো হয়েছে।। এখানে লোকসংখ্যা আসলেই খুব কম, আরিফের মনে হচ্ছে এখানে ছেলের চেয়ে মেয়ের সংখ্যা বেশি হবে।।

প্রধান লোকটা তার অনুগতদের কি যেনো ইশারা করলেন।। ওদের মধ্যে দুজন এসে আবার আরিফকে কোথায় যেনো নিয়ে যাচ্ছে।। আরিফ ওদের সাথে যাচ্ছে, তবে ওদের টেনে নেয়ার লক্ষণ ভালো না, ওরা চাপাচাপি করে শক্ত করে দুইদিন থেকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।। একজন তো আরিফের গায়ের টিশার্ট মাঝে মাঝে ধরে ধরে দেখে, মনে হয় ভাবছে একি জিনিস পরে আছে রে বাবা!! আরিফ বুঝলো, ওর গায়ের এই লাল টি শার্ট নিশ্চিত এই লোকের কোন কারণে পছন্দ হয়েছে।। যাক্‌ বিপদে পড়লে এই জিনিস খুলে দেয়া যাবে।। প্যান্ট চাইলেও দেয়া যাবে, যে দ্বীপে ছেলে মেয়ে সবাই প্রায় ন্যাংটা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেখানে আরিফ ন্যাংটা হলেই বা কি!!

আরিফ এবার দেখলো, একটা ঘন জঙ্গলের দিকে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।। সেখানে কিছুদূর গিয়েই, সামনে মনে হলো কোন গর্ত হবে, আরিফকে টেনে গর্তের এখানে আনা হলো।। আরিফ গর্তের ভিতরে তাকিয়ে একদম চমকে গেলো।। দেখলো, প্রজ্ঞা!! মনে হয় পায়ের শব্দ পেয়ে উপরে তাকিয়ে আছে।। আজব তো, প্রজ্ঞা এই গর্তে কেন, আর এই গর্তের যে গভীরতা এখান থেকে তো উঠাও যাবে না।। লোকদুটো কই থেকে মোটা এক লতার রশি নিয়ে এলো, মনে হচ্ছে এই রশি আগেই যত্নে রাখা ছিলো।। তারপর আরিফকে রশিটা শক্ত করে ধরতে বললো।। কিন্তু আরিফ সেদিকে মন না দিয়ে প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে আরিফ বললো- ওই তোমাকে দেখে শান্তি লাগছে, তুমি গর্তে কেন??
প্রজ্ঞা একটা অদ্ভুত হাসি দিয়ে আরিফের দিকে তাকিয়ে আছে।। খানিক বাদে লোকদুটো আরিফের হাতে লতা দিয়ে বললো- উজাম্বা।।

আরিফ হ্যাঁ করে তাকিয়ে আছে।। প্রজ্ঞা নিচ থেকে বললো- ওইটা ধরো, নইলে ওরা তোমাকে ধাক্কা দিয়েই গর্তে ফালাবে।। এটা মনে করো ওদের জেলখানা।।

আরিফ বার কয়েক ঢোঁক গিলে লতার এক প্রান্ত শক্ত করে ধরলো।। ওরা আরিফকে নিচে নামার নির্দেশ করলো।। আরিফ লতা ধরে গর্তের দেয়ালের মাটি ঘেঁষে ঘেঁষে গর্তের মধ্যে নেমে গেলো।। সারা গায়ে ময়লা লেগে যা তা অবস্থা।। আরিফ বুঝলো, এদের অনেক শক্তি, দুইজন কি সাবলীলভাবে আরিফের পুরো ভর লতা দিয়ে টেনে রেখে দিলো।। গর্তে নামার সাথে সাথে প্রজ্ঞা বললো- ওয়েলকাম টু মাই হোম, ডিয়ার।।

আরিফ, উপরে তাকিয়ে দেখলো, ওরা নেই।। মনে হয় চলে গেছে।।

আরিফ ক্লান্ত, ক্ষুধায় জর্জরিত, তবুও প্রজ্ঞাকে দেখে যে প্রশান্তি পেয়েছে সেটা সে উপভোগ করছে।।

প্রজ্ঞা আবার বললো- এই ছেলে, তুমি না পালিয়ে গেলে।। আবার ফিরে এলে কেনো??

আরিফ, মাটির মধ্যে ধপাস করে বসে বললো- তুমি তো জানতেই আমি ফিরে আসবো, কি জানতে না।। তোমার ডায়েরী দেখলাম, তবে কি এই কারণেই এখানে আসা?? ওরা কি তাহলে আমাদের রান্না করে পুড়িয়ে খাবে??

প্রজ্ঞাও বসে পড়লো, আরিফের দিকে তাকিয়ে বললো- পুড়িয়ে খাবে কিভাবে, ওরা তো আগুন জ্বালানোই শেখে নাই।। কি কারণে আসা জানি না, বাবার এই ডায়েরী আমি পেয়েছি মাস খানেক আগে।। আমার এই দ্বীপ সম্পর্কে আবছা আবছা মনে ছিলো।। কিন্তু আমাকে সবসময় বুঝাতো এগুলো নাকি আমার মানসিক সমস্যা, মানে আমার বাবা মা আমাকে এগুলো ভুলে যাবার জন্যে সাহায্য করতো।। কিন্তু মাঝে মাঝেই আমার মনে হতো, আমি কোন দ্বীপের মেয়ে, আমি কোন জঙ্গলী মেয়ে।। এই যে আমার তামাটে গায়ের রঙ, তার সাথেও আমার বাবা মায়ের মিল পেতাম না।। বাবা ধরো তাও কালো, কিন্তু মা তো বেশ ফর্সা।। আমার নিজেরই সন্দেহ হতো, আমি কি সত্যিই উনাদের মেয়ে।। পরে বাবা একদিন সব বলে দিলো, সব।। এমনকি ওই ডায়েরীটা আমাকে হাতে তুলে দিলো।। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।। প্রথমবার যখন সাগরের পাড়ে এলাম, তখনই আমার মনে হয়েছে, এই সাগরের কোন এক দ্বীপে আমার আসল বাবা মা থাকে।। সাগরের পাড়ের মাটি আমাকে খুব টানতো, তাই এখানে আসা।। আমি নিজেও জানি না আমি তোমাকে কেন নিয়ে এসেছি।।

আরিফ সব শুনে চেয়ে আছে প্রজ্ঞার দিকে, তারপর বললো- তুমি একটু আমার কাছে এসে বসবা, আমাদের ভবিষ্যৎ কি এখন?? আর তুমি তাহলে ঐদিন রাতে মানুষের মাংস খাওয়া এসব বলছিলা কেনো, আমাকে ভয় দেখাচ্ছিলে যে।।

প্রজ্ঞা আরিফের কাছে চেপে এসে বসলো, গর্তের দেয়ালে আড়াআড়ি ভাবে হেলান দিয়ে বললো- আরে তোমার সাহস পরীক্ষা করলাম, তুমি তো একটা ভীতুর ডিম।। তোমার এত ভয় দেখে সেদিন কি যে মজা পাচ্ছিলাম।। আর শুনো বাবা আমাকে এখানে আসতে দিতে চায় নি, আমি অনেক বুঝিয়ে বলেছি আমি আন্দামানের অন্যান্য দ্বীপ ঘুরবো, প্লিজ আমাকে যেতে দাও, আমি কি পাগল আমি ওই সেন্টিনেলে যাবো।। তাই বাবা রাজী হয়েছে, মামা পাসপোর্ট ভিসা সব করিয়েছে, আমাকে সব খরচ দিয়েছে, বুঝলা!!

আরিফের সব হিসাব মিলে যাচ্ছে, কিন্তু এখানে এভাবে থাকতে থাকতে কি মারা যাবে নাকি সে, কিছুক্ষণ ভেবে বললো- আচ্ছা একটা দিক থেকে আমরা ভাগ্যবান রে, ওদের গায়ে তো কাপড়ই নাই, তাও ভালো আমাদের কাপড় খুলে নেয় নাই।।

প্রজ্ঞা আরিফকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো- সব ছেলেই বদ, নির্জনে মেয়ে পেলে হয় মহা বদ।। চুপ থাকো।।

আরিফ প্রজ্ঞার দিকে ঘুরে তাকালো, প্রজ্ঞা লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিয়েছে, তারপর প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো- আচ্ছা মাসুম এত তাড়াতাড়ি বিমানের টিকেট কিভাবে ম্যানেজ করলো এইটা আমার জানার ইচ্ছে ছিলো জানো।।

প্রজ্ঞা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো- কোন বিমানের টিকেট আবার মাসুম ম্যানেজ করলো??

-আরে ওই যে, কক্সবাজার থেকে ঢাকা এলাম না, এক মাস আগে যে ট্যুরে গেলাম, যেখান থেকেই তো তোমার আসার প্ল্যান।।

প্রজ্ঞা একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে- ও আচ্ছা, তাই বলো।। আসলে কি জানো, আমি আর মাসুম প্ল্যান করেছিলাম, আমরা বিমানে ঢাকা চলে আসবো, তাই দুটো টিকেট প্রি বুকিং দেয়া ছিলো।। ট্যুরের মধ্যে ঢাকা আসার প্ল্যান ছিলো কারণ ঐদিন বাবার জন্মদিন ছিলো।। ইচ্ছে ছিলো, মাসুমকে পরিচয় করিয়ে দিবো।। পরে, আবার বিমানে গিয়ে ট্যুরে যোগ দিবো।। কারণ বাবার জন্মদিনের কারণে ট্যুরেই আসতে চাই নি, মাসুমের কারণে পরে রাজী হয়েছিলাম।। কিন্তু আমি যখন সেন্টিনেল দ্বীপে যাবো, কক্সবাজার গিয়ে মাসুমকে এসব বললাম।। সে আমাকে এড়িয়ে যেতে থাকে, হয়তো আমাকে পাগল ভাবছিল কিনা কে জানে!! আমি কেনো তোমাকে বেছে নিয়েছি জানি না, আমার বিশ্বাস জন্মেছিলো, কেউ একজন আসবে,সেই একজন হলে তুমি।। আর আমার মনে হচ্ছিলো, আমার আদি রক্ত তো এখানে, জন্ম এখানে, আমাকে ওরা মারবে না।। আমরা রাতে নেমেছিলাম, তাই হয়তো বুঝতে না পেরে তীর মেরেছিলো।। তুমি তো পালিয়ে গেলে, তুমি কি জানো ওদের তীরের নিশানা কত নিখুঁত, আমি শুয়ে না পড়লে নিশ্চিত মারা পড়তাম।। পরে আর কি আমাকে ধরে এনে, ওদের এক রাজা আছে তার কাছে নিয়ে এলো, রাজা আমাকে এই গর্তে দিয়ে দিলো।। তুমি ভাবতে পারো আরিফ, এই দ্বীপে নিশ্চয় এমন একজন আছেন, যিনি আমার মা।। যার পেটে আমি বেড়ে উঠেছি, যার গর্ভে আমি জন্ম নিয়েছি, ভাবতেই কেমন লাগে তাই না বলো!!

আরিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, সে কথা খুঁজে পাচ্ছে না।। ওদের কেনো এভাবে গর্তে বন্দী করা হয়েছে, ওরা নিজেরাও জানে না।। ভাগ্য ভালো, গর্তটা মধ্যে পোকা মাকড় বা পিঁপড়া নেই, তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যেতো।।

আরিফ প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে বলল- তোমার ক্ষুধা লাগে নাই??

প্রজ্ঞা শুকনো মুখে বললো- হ্যাঁ রে লাগছে, জানো ওরা নারিকেল আর মাছ পেয়ে কি খুশি হয়েছে।। ওরা কিন্তু জানে তুমি আমাকে নিতে আসবা।। আমি ঠিক জানি না ওরা আমাকে কি বন্দী করেছে, নাকি এই গর্তেই থাকতে দিলো কে জানে।। তোমাকেও এই জন্যে কোন ক্ষতি করে নি, অথচ ওরা মনে হয় বাইরে থেকে আসা বেশি লোক একসাথে দেখলে ভড়কে যায়, ভাবে যে ওদের দিকে হামলা করবে, ওদের সব কেড়ে নিবে।। আমরা তো মাত্র দু’জন বা একজন একজন এসেছি, তাই আমাদের মারছে না হয়তো।।

আরিফ বললো- প্রজ্ঞা, তুমি কি তবে তোমার মায়ের খোঁজে এসেছো?? কিন্তু কিভাবে বের করবে??

প্রজ্ঞা অবনত মস্তকে জবাব দিলো- আমার শেকড়ের খোঁজে, মাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না হয়তো।। অনেক আগের কথা যে।।

প্রজ্ঞা আরিফের দিকে চেপে এলো, কাঁধে মাথা রেখে বললো- আমাকে তো তুমি ভালোবাসো তাই না!!

আরিফ প্রজ্ঞার গালে হাত দিয়ে বললো- না তো, বাসি না তো!! বলে মেয়েটাকে আরও একটু কাছে টেনে নিলো।।

……………
আজ প্রায় চারদিন হয়ে গেছে, ওরা এই দ্বীপে দিব্যি ভালোই আছে।। তবে সমস্যা একটাই, ওরা খাবার নিয়ে খুব বিপাকে আছে, এখানে লোকেরা কাঁচা ইঁদুর কেটে কুটে খায়, ব্যাঙ খায়, যা পায় তাই খায়।। সাগর থেকে মাছ ধরে খায় সব কাঁচা।। আরিফ আর প্রজ্ঞা কোনমতে ওদের দেয়া ফলমূল আর নারিকেলের পানি খেয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে।। ওদের থাকার জন্যে খোলা ঘর দেয়া হয়েছে, সেখানে ওরা থাকে।। ওদের বেশিসময় গর্তবাসী হয়ে থাকতে হয় নি, ওই দিন দুপুরের দিকে ওদের গর্ত থেকে তোলা হয়।। তারপর, সোজা নিয়ে যাওয়া হয় সেই প্রধানের কাছে।। প্রধান কি দেখে যেনো ওদের দিকে দয়া করলেন, ওদেরকে খাবার দেয়া হলো, প্রজ্ঞা বুঝালো সে এগুলো খাবে না, সে গাছের দিকে তাকিয়ে নারিকেল দেখালো।। তাদের নারিকেল দেয়া হলো, ওদের থাকার জন্যে ঘর দেয়া হলো।। একটা অদ্ভুত বন্ধুত্ব চলছে সবার সাথে, না প্রজ্ঞা বা আরিফ কেউ জানে না কেনো এত সহজে সব হলো।। আসলে আরিফের ধারণা প্রজ্ঞার মধ্যে কিছু একটা আছে, ওর প্রবল বিশ্বাস ছিলো ওকে দ্বীপবাসীরা কিছুই বলবে না, বাস্তবে ঠিক তাই হলো।।

তবে ওরা যেখানে থাকে, সেখানে কলাপাতা বিছিয়ে ঘুমাতে হয়, এই ঘরের দুইপাশে বেড়া আছে, আর দুইপাশে নেই।। প্রজ্ঞা আর আরিফের ঘনিষ্টতা বেড়ে একদম জমে ক্ষীর।। দু’জন সারাদিন রাত প্রায় একসাথেই থাকে।। তবে লজ্জার ব্যাপার হলো, মাঝে মাঝে দেখা গেলো ওরা হাঁটছে, কোন খোলা ঘরের ভিতরে দেখলো, কেউ কেউ সঙ্গমে লিপ্ত।। এখানে আসলেই মেয়েদের সংখ্যা বেশি, একজন পুরুষের অধীনে একাধিক মেয়ে থাকে, আবার এক মেয়ের সাথে এক পুরুষ বেশিদিন থাকে না, অদল বদল প্রথাও আছে।। হয়তো আমাদের কাছে এগুলো অসভ্যতা কিংবা নোংরামি কিন্তু ওদের কাছে এটাই নিয়ম, এটাই ধর্ম, এটাই সংস্কৃতি।। ওরা সূর্য আর বড় পাহাড়ের পূজা করে, আরিফ আর প্রজ্ঞা শখ করে ওদের পূজায় যোগ দিয়েছে বেশ করেকবার।। আরিফ একবার মজা করে বললো- প্রজ্ঞা শুনো, তোমার মাকে যদি খুঁজেও পাও পেতে পারো, কিন্তু বাবাকে খুঁজে পাবে না।। এখানে কি সুন্দর বউ বদল চলে।।

প্রজ্ঞা শুধু কটমট করে তাকায়।। এই যে এরা প্রায় নগ্ন, মেয়েদের উদোম বুক এসব দেখতে দেখতে আরিফ আর প্রজ্ঞার এখন কিছুই মনে হয় না।। বরং ওদের কাছে অল্প কিছু কাপড় আছে, এইগুলো দিয়ে যতদিন থাকা যায় থাকবে, তারপর চলে যাবে।। অন্তত এখানে নগ্ন হয়ে তো আর ঘোরা যাবে না।।

এখানে এসে আরিফ একটা মজার জিনিস খেয়াল করলো।। জুয়া খেলাটা মনে হয় মানুষের আদিম নেশা, মানুষ জুয়া খেলতে খুব পছন্দ করে।। এই দ্বীপেও মানুষ জুয়া খেলে, বিনিময়ে মাছ, ফলমূল, খাবার এগুলো বাজী ধরে।।

এখানে ওরা একটা জুয়ার আসর দেখতে পাচ্ছে।। আরিফ আর প্রজ্ঞা বোঝার জন্যে দাঁড়িয়ে রইলো, ওরা ঠিক কিভাবে জুয়া খেলে।। দেখলো-

চারজন লোক গোল হয়ে বসে আছে।। ওদের প্রত্যেকের পিছনে মাছ আছে কতগুলো, এগুলো মনে হয় যার যার শিকার করা মাছ।। তারা একটা করে পাতা তাদের সামনে মেলে রেখেছে।। চারপাশে মাছি ভনভন করছে, নিয়ম হলো, যার পাতায় সবার আগে মাছি বসবে, সে বাকী তিনজনকে একটা একটা মাছ বিলাবে।। এভাবে যদি কারও মাছ শেষ হয়ে যায়, তবে সে উঠে যাবে।। বাকী তিনজনের মধ্যে হবে, আবার যার পাতায় আগে মাছি বসবে, সে বাকী দুইজনকে মাছ বিলাবে।। যখন তারা গোল হয়ে বসে পাতা সামনে রাখে কেউ নড়াচড়া করে না তেমন, মাছি বসা মানেই বিরাট লস।। এভাবে একদম শেষে একজন থাকে, যে কিনা বাকী তিনজনের সব মাছ জিতে নেয়।। এই খেলা শেষ হতে অনেক সময় লেগে যায় মাঝে মাঝে, ওদের খেলা দেখে মনে হচ্ছে তাতে কি, ওদের এখানে খাওয়া, ঘুম আর সেক্স এই তিন কাজ প্রধান।।

আরিফ আর প্রজ্ঞা সবচেয়ে বিব্রত ছিলো, টয়লেট করা নিয়ে, পানি হিসেবে তারা নিয়মিত ডাবের পানিই পেতো, কিন্তু টয়লেট করার পানির খুব অভাব।। তারা জঙ্গলের গভীরে এই কাজ সেরে, সাগরে নেমে যেতো সোজা, কি আর করা যাবে আদিম জায়গায় থাকতে চাইলে অনেক কিছুই করতে হয়।।

দিন বিশেক হয়ে গেছে, ওরা এভাবেই এই দ্বীপে কাটিয়ে দিচ্ছে।। আসলে প্রজ্ঞা ফিরে যেতে চেয়েছিলো, কিন্তু আরিফ মনে মনে ওদের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছে।। আরিফ খেয়াল করলো, এখানে খুব বেশি ভাষার ব্যবহার নেই, অনেক কাজ শুধু ইশারা দিয়েই ওরা করে ফেলে।। আরিফ মনে মনে আসলে ভাবছে, যদি কোনভাবে প্রজ্ঞার মা’কে খুঁজে বের করা যায়।। আরিফের তো মাঝে মাঝে মনে হয়, কি হবে আর সভ্য জগতে ফিরে গিয়ে।। লোকের মতে কথিত অসভ্য এই জগতে তো বেশ আছি।। চলুক না এখানেই জীবন, কিন্তু প্রজ্ঞা চলে যেতে চায়, আর আরিফ পড়েছে দ্বীপের প্রেমে, এই জঙ্গল জীবনের প্রেমে।।

আরিফ এখন বেশ কিছু কথা রপ্ত করে ফেলেছে, সে এখন জানে শুরুতে যে তাকে বলা হয়েছিলো- নিকোই কুবারু রুদাম।। এর মানে হলো, তুই কি আমাদের বন্ধু।। আরিফ না বুঝেই বলেছিলো রুদাম, যার অর্থ বন্ধু।। ফলে সে যাত্রায় আরিফ বেঁচে গেছে।। এমন করে আরিফ দিন দিন বেশ কতটুকু ভাষা রপ্ত করে ফেলেছে।। আরিফ আর প্রজ্ঞা দিন দিন ওদের আদিমতায় মিশে গেছে, নিজেরাই মনে মনে বিয়ে করে ফেলেছে, আর স্বামী স্ত্রীর মতই থাকছে।। আসলে এটাই বাস্তব চারদিকে প্রবল আদিমতা থেকে এই দুই মানব মানবীর পক্ষে অনেক কিছুই আটকে রাখা সম্ভব নয়।।

আরিফ একদিন প্রজ্ঞাকে নিয়ে, সেই দ্বীপ প্রধান যার নাম উঙ্গুমা তার কাছে গেলো।। তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে জিজ্ঞেস করতে চাইলো, বুঝাতে চাইলো, তাদের দ্বীপ থেকে কেউ হারিয়ে গিয়েছে কিনা অনেক আগে।। উঙ্গুমা আরিফের কথা বুঝতে পারছে না, তবে অনেক আগ্রহ নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে।। আরিফও প্রাণপণ চেষ্টা করছে কথা বুঝিয়ে যেতে।।

এমন সময় উঙ্গুমা মনে হলো, কি যেনো ভেবে ইশারায় বুঝালো।। আরিফ কিছু আন্দাজ করতে পারছে, সে হয়তো ঠিক পথেই আছে।। ইস ভাষা না জানলে সামান্য কথা বোঝাতে কত কষ্ট করতে হয়।।

উঙ্গুমাকে আরিফ মনে হয় প্রায় বুঝিয়ে ফেলেছে, সে বার বার প্রজ্ঞাকে দেখিয়ে বুঝাচ্ছে, ছোট বেলায় সে হারিয়ে গেছে এই দ্বীপ থেকে।। উঙ্গুমার তাকানো দেখে প্রজ্ঞার মনে আশার আলো ফুটলো, উঙ্গুমা হয়তো বুঝতে পারছে, আরিফ ঠিক কি বোঝাতে চাচ্ছে।। কিন্তু না, কেনো যেনো ফাইনাল কানেশন হচ্ছে না, কই যেনো কথার মধ্যে ফাঁক আছে, যার ফলে উঙ্গুমা কি বুঝেছে তাও আরিফকে বুঝাতে পারছে না, বিরাট এক বিড়ম্বনা।।

………………...
আজ প্রায় সাতান্ন দিন হলো, তারা এই দ্বীপে আছে।। এখন দ্বীপের হাবভাব তাদের বেশ লাগছে, আরিফ তো এখন এই দ্বীপেই থাকতে চায়।। যদিও সে শুকিয়ে কালো হয়ে এই উপজাতীদের মতই হয়ে গেছে, প্রজ্ঞারও একই অবস্থা।। তবুও, এখানের জীবনে একটা বৈচিত্র আছে, ফোন নেই, ইন্টারনেট নেই, কম্পিউটার নেই, খুন নেই, ধর্ষণ নেই, ওদের মধ্যে বিশৃংঙ্খলাও খুব কম।। বাইরে বিশ্বে কি হচ্ছে জানার তাগাদা নেই, ভালোই তো আছে।। প্রজ্ঞার মধ্যে কি চলে কে জানে, সে হয়তো সভ্য জগতে ফিরে গিয়ে আরিফের সাথে ঘর বাঁধতে চায়, মাকে খুঁজার আশা উবে গেছে, ব্যাপারটা এত সহজ নয়।।

আরিফ আবার গেলো, সেই উঙ্গুমার কাছে, আবার সেই একইভাবে বুঝাতে চেষ্টা করছে।। আজ উঙ্গুমার চোখ চকচক করে উঠলো, সত্যি উঙ্গুমা এবার বুঝতে পেরেছে, কারণ তারা প্রতিবার সূর্য দেবের কাছে ওই সুনামীর মত ভয়াবহতা যেনো না আসে সেই প্রার্থনা করে।। তাদের অনেকেই তখন মারা যায়, আর একটা পিচ্চি মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যায় না।। আরিফ কিভাবে যেনো বুঝিয়ে ফেললো, এই প্রজ্ঞা সেই মেয়ে।। উঙ্গুমা কোন কথা বলছে না, শুধু বললো- রিমানু নিমাঙ্গা।। রিমানু নিমাঙ্গা!!

আরিফ আর প্রজ্ঞা এই রিমানু নিমাঙ্গার অর্থ জানে, তারা হতবাক হয়ে আছে, এটা কি তবে সত্যি।। এর অর্থ হলো, আমার মেয়ে, আমার মেয়ে!! ওরা যখন কারও বাচ্চা হয় তখন সেই বাচ্চা কিছুটা বড় না হলে বউ বদল করে না।। আবার অই বাচ্চা মেয়ে হলে খুব অল্প বয়সে অন্য পুরুষের কাছে দিয়ে দেয়, এখানে বিয়ে বলে কিছু নেই, ওরা পাহাড়ের সামনে রেখে সবার সামনে ওই পুরুষের সাথে মেয়ের সঙ্গম করায়, তারপর থেকে তারা একে অন্যের।। যদি ছেলেটা আরও বউ পেতে চায়, তবে প্রধানকে জানাতে হবে, প্রধানকে প্রচুর উপহার দিতে হবে, প্রধান অনুমতি দিলে সে আরও মেয়ে পাবে।। একই পদ্ধতিতে, বউ বদলের পরেও একই নিয়ম, পাহাড়ের সামনে প্রথম সঙ্গম।। এভাবেই চলে আসছে তাদের ধারা।। তবে গোত্র প্রধান তার বউদের ত্যাগ করেন নি, উনি সবাইকে নিজের জিম্মায় রাখেন।। উঙ্গুমা লোক দিয়ে এক মহিলাকে ডেকে আনালো, মহিলা আসার পর উঙ্গুমা মহিলাকে কি সব বললেন।। আরিফ বুঝে গেছে, প্রজ্ঞাও বুঝে গেছে এই মহিলা নিশ্চয় তার মা হবে।।

মহিলাটা উঙ্গুমার কথা শুনে অদ্ভুত ভাবে প্রজ্ঞার দিকে তাকালেন।। প্রজ্ঞার গায়ে টি শার্ট আর পায়জামা ছিলো, আচমকা মহিলা সেই টি শার্ট উঠিয়ে একটানে পায়জামা নামিয়ে ফেললেন।। প্রজ্ঞা লজ্জায় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলো, আরিফ ঘুরে অন্য দিকে তাকালো, মহিলা প্রজ্ঞার নিতম্বে তাকিয়ে একদম চিৎকার দিয়ে উঠলো, গগণবিদারী চিৎকার- রিমানু নিমাঙ্গা, রিমানু নিমাঙ্গা।।

প্রজ্ঞা কাপড় পরে নিলো, প্রজ্ঞা জানে, ওর নিতম্বের ওখানে কাটা প্লাসের মত একটা দাগ আছে।। এই দাগের রহস্য জানতো না, ভাবতো, জন্ম দাগ হবে, কিন্তু দ্বীপে এসে সে আগেই দেখেছে এই রকম দাগ বাচ্চা জোয়ান বুড়ো সবার আছে।। এটা তারা বাচ্চা জন্মের ক’দিন পরেই নিতম্বের মাংসের মধ্যে ফলা দিয়ে কেটে যোগ চিহ্নের মত এঁকে দেয়।। এটা হয়তো তাদের নিজেদের পরিচয় বহন করে।।

সত্যি প্রজ্ঞা তার জন্মদাত্রী মাকে এভাবে খুঁজে পাবে, কল্পনার বাইরে ছিলো!!

……………...
হুট করে একদিন রাতে, প্রজ্ঞা আরিফকে জোর করে জাগিয়ে তুললো।। তাদের বাড়ি বদল হয়েছে, তারা এখন গোত্র প্রধানের দেয়া নতুন ঘরে থাকে।। প্রজ্ঞা আরিফকে বললো, আমরা এখুনি চলে যাবো, ব্যাস কোন কথা বলবা না।। আমি আর থাকবো না।।

আরিফ অবাক হয়ে বলে- মানে কি, আমরা দ্বীপে আছি, কিভাবে যাবো, তুমি কি পাগল হইছো, গেলেও সবাইকে বলে বিদায় নিয়ে যাবো, তোমার মায়ের কাছ থেকেও।।

প্রজ্ঞা আরিফের কলার চেপে ধরে বলে- কোন কথা বলতে না করেছি না, ওদের ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা আছে, ওগুলোতে করে সাগরে নামবো, আর এই দ্বীপের চারপাশে কিছুটা দূরে দূরে কোস্টগার্ড থাকে, ওরা আমাদের উদ্ধার করবে ব্যাস।।

আরিফ বললো- কিন্তু এভাবে রাতে পালিয়ে কেনো, কাল সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পরে যাই।।

প্রজ্ঞা আরিফের গলায় চাপ দিয়ে বললো- কোন কথা না, এক্ষুণি চলো বলছি।।

আরিফ আগেও প্রজ্ঞাকে বুঝেনি, এখনও বুঝতে পারবে না।। সে বাধ্য হয়ে আস্তে আস্তে প্রজ্ঞার পিছু নিলো।। এই দ্বীপে মানুষ প্রায় সন্ধ্যা হলেই ঘুমায়, উঠে আবার ভোর সকালে।।

কিছুদূর গিয়ে আরিফ আর প্রজ্ঞা দ্বীপের অন্যদিকে গেলো, যেদিকে মাছ ধরার ডিঙ্গি নৌকা রাখা আছে, তবে সেই নৌকা পাহারায় লোক থাকা স্বাভাবিক।।

যা ভেবেছে তাই, একজন আদিবাসী লোক বসে আছে, কিন্তু আরিফ তাকে চিনে।। সে ঐ লোক, যে কিনা তার লাল টি শার্ট খুব পছন্দ করেছিলো।। আরিফ পরে এটা ওকে দিয়েও দিয়েছিলো।। সে ওই টি শার্ট পরেছিলো একদিন, কিন্তু সবাই হিংসা করে ওইটা টানাটানি করে ছিঁড়ে ফেলেছে।।

আরিফ আর প্রজ্ঞা খুব দৃঢ়তা নিয়ে লোকটার কাছে গেলো, লোকটা ওদের দেখে বিচলিত বোঝাই যাচ্ছে।। আরিফ তাকে বুঝালো, এই রাতে সে বউ নিয়ে সাগরে ঘুরবে, তার মন ভালো নেই।। লোকটা বাঁধা দিলো না, হাজার হোক এখন সবাই জানে প্রজ্ঞা দ্বীপ প্রধানের মেয়ে।। ডিঙ্গি নৌকায় উঠে পড়লো, আরিফ আর প্রজ্ঞা, এই দ্বীপের কেউ মিথ্যে বলে না, যাবার আগে আরিফ আর প্রজ্ঞা মিথ্যে বলে যাচ্ছে।। আরিফ ব্যাগ থেকে দুটো টি শার্ট বের করে লোকটার হাতে দিলো।। লোকটার চোখে হয়তো পানি, সে মনে হয় বুঝতে পেরেছে, ওরা চলে যাচ্ছে।। আরিফ আর প্রজ্ঞাকে থামিয়ে দিয়ে লোকটা কই যেনো ছুটে গেলো, খানিক বাদে দুটো ডাব ওদের নৌকায় তুলে দিয়ে বললো- পুরাঙ্গু থিমাস, উরিক ফাদি।। চলে যাও, ভালো থেকো।।
আরিফ জবাব দিলো- নিতা উরিক ফাদি।। তুমিও ভালো থেকো।।

……………
পোর্ট ব্লেয়ারের সিকিউরিটির আন্ডারে আপাতত বন্দী আরিফ আর প্রজ্ঞা।। সত্যি সত্যি সাগর থেকে তাদের কোস্টগার্ড উদ্ধার করে।। পরে যখন তারা সব খুলে বলে, কোস্টগার্ডের সদস্যরা অবাক হয়ে যায়।। তাদের মূল স্টেশন ব্লেয়ারের উর্ধতন কর্মকর্তারাও রীতিমত অবাক।। সরকার যেখানে সেন্টিনেল দ্বীপের সাথে সন্ধি করতে কিংবা যেতে ব্যর্থ, তাদের তথ্য আনতে ব্যর্থ, সেখানে এই দু’জন কিভাবে সম্ভব!! প্রজ্ঞা আর আরিফকে জানানো হলো, ওদের ভয় নেই, আইন ভঙ্গ করলেও ওদের জন্যে পুরষ্কার আছে।। ভারত সরকারের তরফ থেকে ওদের সম্মাননা দেয়া হবে, আবার দ্বীপের মধ্যে কাটানো দিনগুলো নিয়ে বিশেষ ফিচার ছাপা হবে।। আস্তে আস্তে চারদিক থেকে হইহই রইরই কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে।। দেশি বিদেশী জার্নাল মিডিয়াতে এই খবর ছেপে অল্প দিনেই ওরা পরিচিত লাভ করলো।।

আজ আরিফ আর প্রজ্ঞার বাসর রাত, যদিও আনঅফিসিয়ালি দ্বীপের প্রথম তিন রাতের পর সব রাতই ছিলো বাসর রাত।। কিন্তু সেটা ওদের নিয়মে, সভ্য জগতের নিয়মতো আলাদা।।

আরিফ খুব করে জানতে চেয়েছে, হুট করে এভাবে দ্বীপ থেকে পালিয়ে আসার কারণ কি।। প্রতিবার প্রজ্ঞা না বলে মুচকি হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।। আজ প্রজ্ঞা বললো- আরিফ জানতে চাও দ্বীপ থেকে কেনো ওভাবে পালিয়ে এসেছিলাম।।

আরিফ রাজ্যের কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে বললো- হুম, আজ বলবা।

প্রজ্ঞা মাথা নেড়ে বললো- বলবো, শুনো আমি আমার ঐ বাবা মায়ের কাছে শুনেছি, তারা নাকি তোমাকে আরও দুটো বউ দিয়ে পাহাড়ের সামনে ওগুলো করাতো।। আমি তোমাকে কারও সাথে শেয়ার করতে পারবো না আরিফ, সরি, তাই হুট করে তোমাকে নিয়ে চলে এসেছি!! ব্যাস।।

আরিফ থ মেরে গেছে, এই মেয়ে বলে কি!! আসলে, মেয়ের জন্ম জঙ্গলের অসভ্য দ্বীপে হলে কি হবে, বড় তো সে এই মাটিতেই হয়েছে!!

…………….
সমাপ্ত

Writer:- Razvi Rayhun Shovon
 

Delivered by FeedBurner

a