Leave a message
> কনে দেখা আলোয় পর্ব ১
-->

কনে দেখা আলোয় পর্ব ১


"শুনতে হাস্যকর হলেও আমার আর ওনার প্রেমটা আমাদের বড় মেয়ের বিয়ের দিনই প্রথম হয়েছিলো।হ্যাঁ,হয়ত পঁচিশটা বছর তার সঙ্গে এক ছাদের নিচে কাটিয়েছি,তবে এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের মধ্যে যা সৃষ্টি হয়েছিল তাকে খুব বড়জোড় সাংসারিক মায়া নামটা দেওয়া যায়।ভালোবাসা,ভালোলাগা,প্রেম শব্দটা ওনি আর আমি এই বুড়ো বয়সে এসেই প্রথম অনুভব করলাম!"
দাদি শ্বাশুড়ির মুখে কথাটা শুনে কিনঞ্জল খানিকটা অবাকই হলো।সত্যিই কি ভালোবাসা বিহীন পঁচিশটা বছর কারো সংসার টিকে থাকতে পারে?এই কথাটাই কিনঞ্জলের মাথায় ঢুকছে না।তবে কি সে নিজেও পারবে ভালোবাসা ছাড়াই বাকিটা জীবন ওই নিষ্ঠুর,বদমেজাজি,বজ্জাত সাক্ষর ভাইয়ের ঘর করতে?
সাক্ষর ভাই!
বিরিয়ানি খাওয়ার সময় মুখে এলাচ পড়লে মেজাজের যেমন ১২টা বেজে যায় ঠিক তেমনি সাক্ষর নামের এই মানুষটার কথা মনে পড়লেও আমার মেজাজের ১২টা বেজে যায়।
সম্পর্কে তিনি একাধারে আমার ভাইয়ার ছোটবেলার বেষ্টফ্রেন্ড আবার আমার বাবার বাল্যবন্ধুর একমাত্র ছেলে।সেই হিসেবেই তিনি সম্পর্কে আমার ভাই হন।আমার বাবা আর সাক্ষর ভাইয়ের বাবা দুই বন্ধুর মধ্যেই ব্যাবসায়িক সমস্যার দরুন দীর্ঘ ১২ বছর দুই পরিবারের মধ্যে কোন সম্পর্ক ছিলো না।গতবছর সেই সমস্যার সমাধান হওয়ার পরপরই সাক্ষর নামের এই অদ্ভুত প্রাণীটি আমার জীবনে আবির্ভূত হয়।তবে তার সঙ্গে পরিচয়ের মাত্র এক বছরেই সে আমার জীবনটাকে পুরো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছে।একমাত্র তার জন্যই আমার পড়াশোনা পুরো বন্ধ হয়ে গিয়েছে,একমাস পুরো নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছিলাম আমি,একবার সুইসাইড করতেও গিয়েছিলাম এমনকি আমার তিন বছরের রিলেশনের সমাপ্তিও ঘটেছে একমাত্র এই সাক্ষর নামের জল্লাদটার জন্য।তবে এগুলোর ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না।
আমি কিনঞ্জল।পাহাড়ি ঝর্নার মতই প্রানোচ্ছল একটা মেয়ে।সেই সাথে একটু ইঁচড়ে পাকাও বটে।সেজন্যই হয়ত কলেজে প্রথম বর্ষে থাকাকালীন সময়েই আমার রিলেশনের বয়স পাক্কা তিন বছর।নুহাশ আমার কিশোরী মনের প্রথম ভালোলাগা ও ভালোবাসা।জেএসসি এক্সামের কয়েকমাস আগে শেষ সময়ের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বাবা আমাকে একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দেয়।আর সেখানেই প্রথম পরিচয় নুহাশের সাথে।নুহাশ সেই কোচিং এর ইংলিশ টিচার ছিলো।সদ্য জা.বিতে চান্স পাওয়া মেধাবী ছাত্র নুহাশ।লম্বা-চওড়া সুঠাম দেহের অধিকারী নুহাশকে দেখে যে কারো বুকে ধাক্কা লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু ছিলো না।ঘন কালো ভ্রু যোগোলের নিচে বাচ্চাবাচ্চা দেখতে ছোট চোখ দুটোতে ভারী ফ্রেমের চশমা আর সেই চশমার ভেতর দিয়ে ফর্সা গালের একটু উপরের দিকে ডানপাশের ছোট্ট কালো তিলটার উঁকি দেওয়াটাই যেনো কিনঞ্জলের প্রথম দৃষ্টি কেড়েছিলো।নুহাশের সবকিছুই কিনঞ্জলের ভালো লাগতো।মাথার চুল থেকে পায়ের পাতাতেও যেনো হাজারো মুগ্ধতা খুজে পেতো কিনঞ্জল।কিশোরী মনের প্রথম ভালোলাগা বা ভালোবাসা যাই নাম হোক না কেনো এর?এক মাসের মাথায় কিনঞ্জল নিজের ভালোলাগাটা নুহাশের কাছে বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ করলেও নুহাশ ছেলেমানুষী ভেবে প্রথম প্রথম তেমন পাত্তা দেয়নি।তবে বোর্ড এক্সামের বেশ কিছুদিন পর কিনঞ্জলের ঘ্যানঘ্যানানির কারনে বিরক্ত হয়ে এমনিতেই হ্যাঁ বলে দিয়েছিলো নুহাশ।ভেবেছিলো প্রতিদিন ইগনোর করলে এসব বাচ্চা বয়সের আবেগ একাই কেটে যাবে।তবে কিনঞ্জলের বাচ্চামো,দুরন্তপনা, নুহাশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা নুহাশকে কিনঞ্জলের ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য করেছিলো।সেই থেকেই চুটিয়ে প্রেম চলেছে দুজনের।নাইন-টেন এই দুবছর পুরো সাভার চষে বেরিয়েছে দুজন। জা.বি ক্যাম্পাসের প্রতিটা অলিগলিতে ওদের খুনসুটি মাখা ভালোবাসার পদচারণ রয়েছে।কখনো মহুয়া তলায় মিনারের সিড়িতে একসাথে বসে বাদাম খাওয়া কখনোবা মুক্তমঞ্চে ভালোবাসার মানুষটার কোলে মাথা রেখে গল্পে মেতে উঠা।কিশোরী মনের এই আধপাগল প্রেমিকাকে চাইলেই নুহাশ বিছানা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারত তবে নুহাশের কিনঞ্জলের প্রতি ভালোবাসাটা ছিলো সদ্য ফোটা ফুলের মতই পবিত্র।যদিও নুহাশ কখনই কিনঞ্জলের সামনে একজন প্রেমিক হওয়ার অভিনয় করতো না।নুহাশ সবসময় কিনঞ্জলের সামনে একজন আদর্শ গাইডলাইন হিসেবেই নিজেকে উপস্থাপন করেছে।তবুও নুহাশের ভালোবাসার গভীরতা কিনঞ্জল ঠিকই আঁচ করতে পারতো।নুহাশ কিনঞ্জলকে তুই করে সম্বোধন করতো আর কিনঞ্জল নুহাশকে তুমি করে।হাজার বলেও কিনঞ্জল নুহাশের মুখ দিয়ে তুমি শব্দ বের করতে পারেনি।ওদের দুজনের একাকী কাটানো সময়গুলোর বেশির ভাগ সময়ই কেটে যেতো কিনঞ্জলের পড়াশোনার ব্যাপারে কথা বলতে বলতে।এই নিয়ে কিনঞ্জলের নুহাশের প্রতি অভিযোগের শেষ ছিলো না।কিনঞ্জলের অভিযোগগুলো শুনে নুহাশ কেবলই হাসতো আর বলতো,
"শোন রেণু,আমাকে তুই একজন আদর্শ প্রেমিক আর আদর্শ স্বামী হিসেবে বিয়ের পরেই পাবি।এখন আমি তোর টিচার বা গাইডলাইন হিসেবেই ঠিক আছি।তোর মতো একটা পিচ্চিকে সামনে বসিয়ে রেখে আমার অতো পুতুপুতু রোমান্টিক কথা আসে না আর তোর ওই প্যাতপ্যাতা গালে অতো চুমুটুমুও আমি খেতে পারবো না বুঝলি!"
নুহাশের মুখে এসব শুনে কিনঞ্জল কেবলই গাল ফুলিয়ে বসে থাকতো।নুহাশ কিনঞ্জলকে রেণু বলেই ডাকতো।কিনঞ্জল শব্দের অর্থ হলো ফুলের রেণু আর সেখান থেকেই নুহাশের রেণু নামে ডাকা।ওদের দুজনের তিন বছরের সম্পর্কে নুহাশ কেবল একবার কিনঞ্জলকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু একে দিয়েছিলো আর সেই দিনটাই ছিলো কিনঞ্জলের জীবনে সবথেকে অভিশপ্ত দিন।
ঠিক সেই দিন থেকে গুনে গুনে এক মাসের মাথায় ঢাকঢোল পিটিয়ে সাক্ষরের সাথে কিনঞ্জলের পারিবারিক ভাবে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।পরিবারের কেউ একবার কিনঞ্জলের মতামতটাও জানতে চায়নি।আর কিনঞ্জলের জন্য সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিলো বিয়েতে সাক্ষর ভাইয়ের কোন আপত্তি ছিলো না।যে কিনা কিনঞ্জলকে দুচোখে দেখতে পারতো না।
পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতেই দাদির ডাকে ধ্যান ভাঙে কিনঞ্জলের।
"কিরে মুখ পুড়ি!কখন থেকে ডাকছি কথা কি কানে পৌছায় না নাকি?"
"স্যরি দাদি।একটু পুরোনো কথা মনে পড়ে গিয়েছিলো।তা তুমি তোমার আর দাদার প্রেম কাহিনীটা বলো?"
"সে এক বিশাল গল্প!আরেকদিন সময় করে বলবো ক্ষন।এতগুলো বছরতো আর এমনি এমনি চলে যায়নি।যা মন্টু বোধহয় বাসায় এসে গেছে।তুই নতুন বউ ওর কাছে কাছে থাকবি বুঝলি।"
কিনঞ্জল হালকা হেসে বলল,
"সেকি বুড়ি,তুমি সাক্ষর ভাইকে এখনো মন্টু বলে ডাকো?"
"আরে পাঁজি আমাকে বুড়ি বলা হচ্ছে।সাক্ষর দাদুভাইকে আমি আদর করে মন্টু বলে ডাকি বুঝলি আর তুই হলি গিয়ে আমার মন্টুর বউ।
আমি কিন্তু এখন আর তোর শুধু দাদি নই সম্পর্কে তোর দাদি শ্বাশুড়ি হই।তাই একদম উল্টোপাল্টা বকবি না!আমি এখনো তোর চেয়ে ঢের সুন্দরী।এখনো আমি হেটে গেলেনা তোর বরের মতো কত ছেলে কাত হয়ে যাবে।"
"তো সুন্দরী দাদি তোমার সাক্ষর দাদুভাইকে তোমার গলাতেই মালাটা দিতে বলতে।শুধুশুধু আমার পায়ে শেকল পড়াতে গেলে কেনো?"শেষের কথাটা কিনঞ্জল মিনমিনিয়ে বললেও দাদি ঠিকই শুনতে পেয়েছে।তিনি কিনঞ্জলের হাতদুটো নিজের কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
"বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধন কখনো কারো পায়ে শেকল পরায় না বরং দুজন নর-নারীর দুটো পা একসাথে বেঁধে দেয় যাতে বাকিটা জীবন দুজন একসাথে পায়ে পা মিলিয়ে সকল প্রতিকূলতা পেরিয়ে জীবনের সমস্ত আনন্দটুকু উপভোগ করতে পারে।"
~নাজমুন নাহার তৃপ্তি
এখন তুই তোর এই নতুন জীবনটাকে আনন্দময় নাকি বিষাদময় করবি তা সম্পুর্ন তোর উপরে নির্ভর করে।বুঝলি মুখ পুরি!
দাদির মুখে কথাটা শুনতেই কিনঞ্জলের মুখের হাসিটা আবার দপ করে নিভে গেলো।যে মানুষটার নাম শুনলেই কিনঞ্জলের মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তার সঙ্গে কি আদোও কিনঞ্জল ঘর করতে পারবে?দাদিকে বিদায় জানিয়েই রুম থেকে বের হয়ে গেলো কিনঞ্জল।পরনে নতুন ভাঁজখোলা গঙ্গা-যমুনা রঙের তাঁতের শাড়ি।শাড়িটার আঁচল খুটতে খুটতেই নিজের রুমে ঢুকলো উহু ভুল বললাম সাক্ষর ভাইয়ের রুমে ঢুকল।রুমে ঢুকে দেখে সাক্ষর ভাই মাত্রই বাইরে থেকে এসে গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলে মেঝেতে ফেলে সেন্ডো গেঞ্জি গায়ে ফ্যানের নিচে বসেছে।কিনঞ্জলের উপস্থিতি সামনের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখতে পেয়েই সাক্ষর চেঁচিয়ে বলল,
"এই যে মহারাণী,বেশতো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছেন।এদিকে আমি যে তোর বউভাতের রিসেপশেন এর ব্যবস্থা করতে গিয়ে খেটে মরছি সে খেয়াল আছে?এদিকে আয়,আমার পাশে বসে আমার হাত-পা টিপে দে।বিয়ে তো কালই হয়ে গেছে।আর কত রেস্ট নিবি?ফাঁকিবাজ,কামচোর একটা!"
সাক্ষরের কথাটা শুনেই কিনঞ্জলের মুখে ভীষণ ভয়াবহ রকমের একটা গালি অটোমেটিক চলে আসলেও কিনঞ্জল নিজেকে সামলে নিলো।কেননা এই জল্লাদ এর সামনে টু ছাড়া টা শব্দটা করলেও নিজের মাথার চুল যে একটাও আস্ত থাকবে না তা কিনঞ্জল বেশ ভালো মতই জানে।তাই অগ্যতা কোন উপায় না পেয়ে সাক্ষর ভাইয়ের হাত-পা টিপে দিতে লাগলো।এমনকি গতকাল বাসর রাতেও কিনঞ্জলকে দিয়ে সাক্ষর হাতপাখা দিয়ে মাঝরাত পর্যন্ত বাতাস করিয়েছে আর নিজে নাক ডেকে ঘুমিয়েছে।বাকি সবার ঘরে এসি থাকলেও সাক্ষরের ঘরে ইলেকট্রিক ফ্যান লাগানো।জন্ম থেকেই সাক্ষরের ঠান্ডার ধাচ বেশি।আর এসির ঠান্ডা ওর একদম সহ্য হয় না।বাসর ঘরের খাট সাজানোর জন্য সাক্ষরের কাজিনরা মূলত ঘাটের স্টান্ড ব্যাবহার না করে ফ্যানের থেকে ফুল টাঙিয়ে পুরো মানদাদ আমলের ডেকোরেশন করেছিলো আর পুরো রুমের দেয়াল জুড়ে স্টার,হার্ট,মুন শেইপের টুইংকেল লাইট লাগিয়েছিলো।সেজন্যই কাল রাতে ফ্যান চালাতে পারেনি ওরা।এদিকে গরমে সাক্ষরের নাজেহাল অবস্থা।কিনঞ্জল বিয়ের শাড়ি ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে আসতেই সাক্ষর কিনঞ্জলের হাতে পাখা ধরিয়ে দিয়ে নিজে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়েছে আর কিনঞ্জল বাতাস করেছে।যেই না একটু বাতাস করা থামিয়েছে সাথে সাথে সাক্ষর একগাদা শক্ত কথা শুনিয়ে দিয়েছে কিনঞ্জলকে। উপায় না পেয়ে প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত নিরবে চোখের পানি ফেলেছে আর সাক্ষরকে বাতাস করেছে কিনঞ্জল।কান্নাকাটি করার কারনে কিনঞ্জলের চোখ বেশ জ্বালা করছিলো তাই একপর্যায়ে কিনঞ্জল পাশের বালিশটাতে হেলান দিয়ে সাক্ষরের পাশেই কাল রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।

(চলবে)

লিখা~ নাজমুন নাহার তৃপ্তি
 

Delivered by FeedBurner

a