বিনির মা গোসল শেষ করে বারান্দায় এসে দারিয়েছে। বারান্দার সামনের দিকে তাকাতেই তিনি দেখতে পেলেন ময়লা কাপুড় পরিহিতা একজন মহিলা, মহিলার পায়ে কোনো সেন্ডেল নেই।মাথার চুলগুলো উসকোখুসকো।বিনির মার আর বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা আজাদের মা।
আজাদ গ্রামের একটি অবহেলিত ছেলে সবার বিরক্তির কারণ। আজাদ এমন একটি ছেলে যে তার ইচ্ছে হলেই কারো থাকে খেলতে করতে পারে না, ইচ্ছে হলেই সবাই তাকে ধরে মারতে পারে।তবে নিজের প্রয়োজনে সবাই তাকে ব্যবহার করতে জানে।
আজাদের বাবার মাঠে কোনো জমি নেই।আর থাকলেও সেখানে তার চাষ আবাদ করে চলার সামর্থ্য তার নেই কারণ তার শরীর অস্বাভাবিক ভাবে চিকন। রোগা শরীর নিয়ে তিনি কোনো কাজই ঠিক মত করতে পারে না। কিছুদিন আগে তিনি ধারদেনা করে একটা ভ্যান কিনেছিলো কিন্তু তার ভ্যানে কেউ উঠতে চাইত না কারণ সে তার শরীর দিয়ে ভ্যানকে জোরে নিয়ে যেতে পারতো না।
ভ্যান জোরে না চালানোর কারণে অনেকে তাকে ঠাট্টা মসকরা করত। কিন্তু তার কোনো উপায় ছিলো না।এসব তার শোনাই লাগত।
সেদিন সন্ধায় ভ্যান চালিয়ে আজাদের বাবা বাড়ি এসে আজাদের মা কে ডাক দিলেন। কিন্তু বাড়িতে কাউকে না পেয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। আজদের মা আজাদকে খুজতে গেছে। তিনি অপেক্ষায় থাকে কিছুক্ষন। কিন্তু কাউকে না পেয়ে তিনি নিজেও খুজতে বেরিয়ে যান।
অন্যদিকে আজাদকে বিনির মা ঘরে বন্দি করে রেখেছেন কারণ আজাদ তার মেয়ের সাথে খেলা করতে করতে একটা কাচের গ্লাস ভেঙ্গে ফেলেছে। রাগে তাকে বিকেল খেকে ঘরবন্দি করে রেখেছে। আজাদ একাধারে চিৎকার করে কেঁদে চললেও বিনির মার তাতে মন নরম হয় না। আজাদের কান্নার আওয়াজে পাশের বাড়ির এক মহিলা এসে আজাদকে ছেড়ে দিয়ে যায় ।
আজাদ কাঁনতে কাঁনতে বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে। আজাদের তেলহীন মাথা ,ময়লা জামা এখুলো তেমন পরিবর্তন হয় না কারণ কেনার তেমন সার্মথ্য নেই
আসার পথে বাবা মার সাথে আজাদের দেখা হয়। বাবা একটু রাগ করলেও মা চর মারে আজাদকে। আর বলে আমাকে না বলে কোথাও যাবি না। কথাটি বলেই টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে আছে ।
আজাদকে নিয়ে প্রতি দিনই এমন সমস্যা হয়।আজাদের মা বলল,তোকে তো কেউ খেলতে নেয় না তো এতো ক্ষন কোথায় ছিলি?
আজাদ বলল ,বিনির মার একটা কাচের গ্লাস খেলতে গিয়ে ভেঙ্গে গেছিলো তাই ওর মা আমাকে ঘরে বন্দি করে রেখেছিলো ।
মা বাবার দুজনের চোখ দিয়েই পানি পরতে থাকে কিন্তু তারা যানে এতে তার কিছুই করার নেই সে জানে সমাজে তার কথার কোনো দাম নাই, তার কথা সবার কাছে মুল্যহীন।
আজাদের বাবা সিধান্ত নেয় তিনি বিনির মার গ্লাসের দাম পরিশোধ করে দিবে। কথা মত তিনি তিনি পরের দিন বিনির মা হাতে নতুন গ্লাস দিয়ে আসে। গ্লাস পেতে তিনি খুব খুশি হলেন।আজাদের বাবা কিছু না বলে সেখান থেকে চলে এলেন। বাড়ি এসে আজাদের মাকে বললেন, ওকে বাড়ি থেকে বের হতে দিবে না ।
সব সময় দেখে দেখে রাখবে কথাগুলো বলে তিনি ভ্যান চালাতে চলে গেলেন।
যদিও তার ভ্যানে কেউ উঠতে চায় না তবুও কেউ কেউ তাকে ফেলে দিতে পারে না,কারণ কিছু কিছু সময় ভ্যানের খু্বই প্রয়োজন হয়,আর তখন ভ্যান না পাওয়া গেলে আজাদের বাবার ভ্যানই হয় তাদের সম্বল ।
এই দিযে যে সামান্য টুকু টাকা হয় তা দিয়ে তার তিনজনের সংসার চলে না। প্রায় সময়ই কারো না কারো বাড়ি থেকে ঝাল, নুন, তেল ইত্যাদি চেয়ে আনতে হয়। এভাবে কোনো রকমে চলে তার সংসার।
আজাদ অনেক দুরন্ত ছেলে সে ঘরের কোণে থাকার ছেলে না বয়স আট বছর হলেও সামান্য তেল-জল না পাওয়াই তা বোঝা যায় না।
সেদিনও আজাদ খেলতে বেড়িয়েছিলো ,আর গ্রামের মাতব্বরের ছেলে কাসেম তখন গাছ থেকে আম পারাচ্ছিলো পাড়ার দুজন ছেলে দিয়ে, সেখান দিয়ে ছোট্ট আজাদ হাটতে হাটতে যাচ্ছিলো।আজাদকেে দেখে কাশেম বলল, ওই আজাদ। এই আমের ব্যাগ দুটো ধর আর ব্যগে আম ঢুকা। আজাদ কারো কথায় না করে না। না বলার সভাব তার মধ্য নেই।
আজাদ আম কুড়িয়ে ব্যগে রাখতে লাগল।
গাছের কিছু আম গাছ থেকেই পঁচে গেছে। তাই গাছে উঠে থাকা দুজন ছেলে কাসেম সাহেবকে বলল, আপনার কিছু আম তো পঁচে গেছে এগুলো দিয়ে কি করবেন? এগুলো দিয়ে কিন্তু গাছের চারা বানানো যায়।
কাসেম বলল ,আরে ওসব পঁচা পাচকে আম দিয়ে আর বাড়ি ঘর নোংরা করবো না, ওটা বরং আজাদকে দিয়ে দিব।
গাছের ছেলেগুলো বলল -এগুলো কেউ খেলে তো নিশ্চিত পেটে অসুখ করবে। কাসেম বললো আরে থাম এর কিছুই হবে না।
সেদিন আজাদের বাবা" ভ্যান চালিয়ে বাড়ি আসল "কিন্তু তিনি তার সঙ্গে ভ্যান আনতে পারলো না। আজাদের মা যখন বলল, ভ্যান কি হয়েছে? তখন আজাদের বাবা বলল, ভ্যান চুরি হয়েগেছে। অনেক খুজলাম কিন্তু কোথাও পেলাম না।
আজাদের বাবা মনে করে চোরটি হয়তো আমার চেয়েও অনেক অভাবি তাই সে আমার ভ্যান চুরি করে নিজের অভাব মিটিয়েছে।
রাতে শুয়ে ভাবে এখন তারা কিভাবে চলবে। এমনিতেই মানুষ তাদের পছন্দ করে না। অন্যদিকে এখন তার সামান্য রোজগার করার জন্য ভ্যানটাও নেই।তারা চলবে কিভাবে।
তবে গ্রামে দু একাটা বড় মনের মানষ আছে যে তাকে কিছুটা হলেও সাহায্যে করতে পারে। পরের দিন সকালে তিনি কিছু টাকা জোগার করতে পারল। কিন্তু তা ভ্যান কেনার জন্য যতেষ্ট পরিমানের কিছুই না। তাই তাকে বাধ্য হয়ে বসত বাড়ির বিনিময়ে গ্রাম্য মহাজনের নিকট থেকে নির্দিষ্ট সময়ে টাকা ফেরত না পেলে বসতবাড়ির মালিকানা মহাজনের হয়ে যাওয়ার শর্তে কিছু টাকা ধার নেয়।
এবং তা দিয়ে নতুন একটি ভ্যান তিনি কেনেন
এবং আবার ভ্যান চালানো শুরু করেন।
কিন্তু কিছুদিন পর এক সন্ধায় তিনি এই ভ্যানটাও হাড়িয়ে ফেলেন। তিনি তখন গ্রামের
মায়া ছেড়ে রাজধানীতে পালায়ন করে ।
সেখান থেকে আজাদের বাবা মা একটা বাড়িতে কাজ নেয় ।আর এভাবেই কিছুদিন তাদের থাকতে হয়। আর তাদের ছেলে আজাদের সরল মানুষিকতা দেখে সেই বাড়ির মালিক তাকে পড়ালেখার জন্য সাহায্যে সহযোগীতা করেন।
ভাগ্য তাদের সহায় ছিলো তাই আর অন্যর বাড়িতে গিয়ে কাজ করতে হলো না। কয়েক বছর পর আজাদ গ্রামে গেলো, এবং সেখানে একটি বাড়ি করলেন। তবে সেখানে আজাদ নিয়মিত থাকতে পারতো না ব্যবসায় কাজের চাপের জন্য। বছরে দু ঈদে আজাদ বাবা মা নিয়ে বাড়িতে আসতো ঈদ কাটাতে।
এইতো গত কোরবানির ঈদে গ্রামে এসে গরিবদের মাঝে জাকাতের টাকা দান করতে এসে তিনি দেখতে পেলেন। তার জাকাতের টাকা নেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন। তাদের মধ্য একজন বলল, সাহেব আমার টাকার দরকার নেই আপনি যদি আমার একটা ভ্যানের ব্যবস্তা করে দিতেন তো আমি সারা বছর সেখান থেকে আয় রোজগার করে সংসার চালতে পারতাম।আর আমাকে কারো কাছে টাকার জন্য হাত পেতে চলতে হতো না।
কথাগুলো আজাদের খুব পছন্দ হয় কারণ সে জানত তার বাবার কথা, তার বাবার কষ্টের কথা। আজাদ আর দেরি না করে তাকে ভ্যানের সমপরিমাণ টাকা দিয়ে দেয় আর আজাদের পাশে দাঁরানো আজাদের বাবার মুখে মিটি মিটি হাশি ফুটে উঠল কারণ সে দেখতে পেয়েছে একজন চোরকে যে গত বিশ বছর আগে তার দুটি ভ্যান চুরি করেছিলো ।
আজাদ সবাইকে শাড়ি লুঙ্গি বিতরণ করার সময় দেখতে পেলেন, একজন ৫০ পেরোনো মহিলার কাধে হাত দিয়ে একজন ৫৫ বছরের বৃদ্ধ শাড়ি -লুঙ্গি নিতে এসেছে ।
আজাদের বুঝতে অনুবিধা হলো না, এটা বিনির মা আর ওটা বিনির বাবা কাসেম।
.
লেখক:- মশিউর রহমান