Leave a message
> বুধবারের আহ্বান পর্ব ৭
-->

বুধবারের আহ্বান পর্ব ৭


সায়রা সিড়ি বেয়ে উঠে নিজের ফ্লাটের সামনে যেতেই বিদ্যুৎ চলে গেলো। ফ্লাটের দরজা পুরোপুরি খোলা অবস্থায় ছিলো। সায়রা ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে অন্ধকারে টর্চ বা চার্জার লাইট কিছু খুঁজে পেলোনা। ড্রয়ারে মোমবাতি আর ম্যাচ পেয়ে মোমবাতি জ্বালালো। আগুনের শিখা ভালোভাবে জ্বলে উঠার আগেই জানালা দিয়ে দমকা হাওয়া এসে নিভিয়ে দিয়ে গেলো। সায়রা ব্যস্তভঙ্গিতে আবার মোমবাতি জ্বালতে গেলো, আর ঠিক সে সময় সে তার পিঠের পিছনে কারো শীতল হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, "কে?"
কোনো উত্তর পেলোনা। হাতের ছোঁয়া পিঠ বেয়ে নিচে নেমে কোমরে আসতেই সায়মা ছিটকে সরে গিয়ে পিছন ফিরলো। অন্ধকারের মধ্যে স্পষ্ট কোনো পুরুষের অবয়ব বোঝা গেলো। সায়রা চেহারা না দেখেই পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেলো এটা অভ্র হতে পারেনা। সুনীল সাহেব নিশ্চয়ই দরজা খোলা পেয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়েছেন। সায়রা দৌড়ে খাবার টেবিলের ওপর থেকে ফল কাটার ছুরিটা নিয়ে সামনের দিকে তাক করে ধরলো, "কে আপনি?"
পুরুষালি ভারী কন্ঠে আওয়াজ এলো, "সায়রা, আমি আপনার কোনো ক্ষতি করবোনা। ভয় পাবেন না। কিন্তু আপনি যদি আমার কথা না রাখেন, তবে আমি আপনার ক্ষতি করতে বাধ্য হবো।"
সুনীল সাহেবের কন্ঠ তো এমন নয়! তবে কে হতে পারে? সায়রা দ্রুত বোঝার চেষ্টা করলো।
"আমাকে চিনবেন না। আমি এ জগতের কেউ নই। আমার বসবাস অন্য জগতে। আমি শুধু একটা কথা বলে চলে যাবো!"
সায়রা কি বলবে বুঝতে পারছেনা। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
"কিছুক্ষণ আগে যে মেয়েটাকে নিয়ে আপনি তার বাসায় দিয়ে আসলেন, এই মেয়েটাকে এরপর কখনো মাঝরাতে দেখলে আপনি তার কাছে যাবেন না। আপনার ক্ষতি হবে।"
আঁধারীর মাঝে মৃদু ছায়া-কায়ায় অবয়বটা অস্পষ্ট হয়ে দেখা যাচ্ছিলো। ধীরে ধীরে আরো বেশি অস্পষ্ট হয়ে আসলো ছায়াটা। একসময় মৃদু আঁধারের সাথে মিশে কর্পূরের মতো উবে গেলো। অবয়বের প্রস্থানের প্রায় সাথে সাথে বিদ্যুৎ চলে আসলো। সায়রা যেখানে ছিলো সেখানে ঠিক সেভাবেই ছুরি তাক করে দাঁত আছে। কিছুক্ষণ পূর্বে কি হয়েছিলো তা তার কাছে ঘোলাটে, অস্পষ্ট এক ভয়ঙ্কর অনুভূতি হয়ে হৃদয়ে তোলপাড় তুলছে। সায়রা একটা কড়া মিষ্টি ধরনের গন্ধ পেতে লাগলো। আচমকা মনে হতে লাগলো, যে পুরুষের অবয়ব তার কাছে এসেছিলো তা তার খুব আপন কারো ছিলো। অভ্রর থেকেও আপন কেউ ছিলো।
.
.
রাত তিনটা বারো বাজছে। আজ রাতেও অভ্র বাসায় ফিরেনি। সায়রা তার ঘরের বিছানায় বালিশ খাঁড়া করে হেলান দিয়ে বসে কালচে খয়েরী মলাটের ডায়েরির পাতা ওল্টাচ্ছে। ডায়েরিটার মলাটের মাঝ বরাবর আড়াআড়ি দুইটা লম্বা দাগ। দাগ দুটো নীলচে রঙের। অন্ধকারের মাঝেও নীল রঙটা জ্বলজ্বল করে। এই চিহ্নটাকে ক্রুশিফিক্স চিহ্ন বলে। ডায়েরির পাতাগুলো কালো রঙের। সাদা কালিতে অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু শব্দ লেখা প্রতিটা পাতাজুড়ে। কিছু শব্দ অন্য কোনো ভাষার অক্ষরে লিখা। কিছু কিছু সায়রা বুঝতে পারছে। এই ডায়েরিটা সায়রার মা তাদের দুইবোনকে দিয়ে গিয়েছিলো। সায়রার যখন কেবল তিন বছর বয়স তখন তার মা মারা যায়। সায়রা বাবার কাছে দশ বছর বয়স পর্যন্ত থাকে। দশ বছর বয়সে এক্সিডেন্টে বাবা মারা গেলে সে আর তার বোন আশ্রমেই বড় হয়!
.
ডায়েরির প্রথমে দুটো নাম লেখা। তাদের দুবোনের নাম। সায়রা ক্রুশ্চেভ ও নিকিতা ক্রুশ্চেভ।
পরবর্তী পৃষ্ঠার লেখাগুলো সায়রার প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। কত হাজারবার এগুলোর অর্থ বের করার চেষ্টা করেছে সে। পারেনি। এগুলোর অর্থ একমাত্র আশ্রমের ফাদার বলতে পারতেন। কিন্তু সায়রা ছোট থাকতে এসব নিয়ে তেমন ভাবেনি আর ফাদারকে প্রশ্ন করলেও তিনি কিছু বলতেন না৷ আজকের অবয়বের ঘটনার পর থেকেই সায়রার বারবার মনে হচ্ছে এ ডায়েরির অর্থ জানলে অনেককিছু জানা যাবে। এ নিয়ে শুধুমাত্র ফাদারই তাকে বলতে পারবেন। কলেজে উঠে সে শহরে হোস্টেলে চলে এসেছিলো। তারপরে আর আশ্রমে যায়নি কখনো সে। এতবছর পর সে হঠাৎই ফাদারের সাথে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো।
.
.
তুহান নাতাশাকে নিয়ে প্রচন্ডরকম হতাশায় ভুগছে। রাতে সে কোথায় যায়, কি করে কোনোকিছুই সকালে আর তার মনে থাকে না। তুহান কখনো আধিভৌতিকে নিশ্বাস করেনি। কিন্তু নিকিতার মৃত্যুর পূর্বের ঘটনাগুলো আর এখন নাতাশার এমন অদ্ভুত সব ঘটনায় তার ধীরে ধীরে আত্মা, ভর করা এসব বিষয়ে বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করেছে। তার মনে হয় নাতাশার ওপর খারাপ কোনোকিছু ভর করছে। তাকে দিয়েই রাতের বেলায় মানুষের ক্ষতি করছে। গোয়েন্দা বিভাগের তদন্ত কমিটি আজ সকালের খবরে জানিয়েছে এপর্যন্ত যতগুলো খুন হয়েছে, প্রতিটিই বুধবার মাঝরাতে করা হয়েছে। তারা আগামী বুধবার শহরজুড়ে কারো কাছেই সে এসব কথা বলতে পারছেনা। কারো সাহায্যের খুব প্রয়োজন এসময় তার। নিকিতার অভাব সে প্রতিমুহূর্তে অনুভব করছে।
.
.
সায়রা পরদিন সকালে অভ্র ফিরতেই তার আশ্রমে যাওয়ার কথাটা তাকে জানালো। অভ্র অফিস থেকে ছুটি পাবেনা। সায়রা একাই আশ্রমে গিয়ে ফাদারের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলো। আচমকাই কাল রাতের ঘটনা তাকে খুব উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। অভ্রকে এ বিষয়ে কিছু বললোনা সে। অভ্রও তেমন কিছু প্রশ্ন করলোনা, কেনো হঠাৎ আশ্রমে যেতে চাইছে সে। একা একা প্রতিদিন থাকতে থাকতে হয়তো পুরনো কথা মনে পড়ছে ভেবে বাঁধাও দিলোনা!
.
সায়রা সকাল সকাল চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। সব অনেক বদলে গিয়েছে। সায়রার ভয় ভয় হতে লাগলো। ফাদার বেঁচে আছেন তো! পুরনো মানুষদের কেউ নেই আশ্রমে। সায়রাকে কেউই চিনতে পারলোনা। চেনার কথাও না। কতবছর পেরিয়ে গিয়েছে। ফাদারের খোঁজ করতেই জানা গেলো তিনি বৃদ্ধপ্রায়৷ আশ্রমের পিছনের দিকের একটা ঘরে থাকেন। নানান রোগ ব্যাধিতে ভুগতে ভুগতে মুমূর্ষুপ্রায় অবস্থা! সায়রা ফাদারের ঘরের দিকে এগোলো। ঘরের দরজাটা হালকা ভিজানো। দরজার কড়া নেড়ে সায়রা বললো, "ফাদার আসবো?"
ভিতর থেকে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ফাদার বললো, "সায়রা, আসো!"
সায়রা থমকে দাঁড়ালো। ফাদারের কোনোভাবেই জানার কথা না সায়রা আসবে। আর আসলেও তাকে কন্ঠ চেনার কথা না। সেই কবেই সে আশ্রম ছেড়ে গিয়েছিলো। সায়রা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। কঠোর, শক্ত মানুষটা বয়সের ভারে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। চোখজোড়া কতটা শান্ত; পুরনো সেই কাঠিন্য নেই। বিছানার ওপর জবুথবু হয়ে শুয়ে আছে। সামনের টেবিলের ওপর নানান রকমের ওষুধের পাতা ছড়ানো ছিটানো। ঘরের দুটো জানালাই বন্ধ। কেমন ভ্যাপসা একটা গরম ঘরজুড়ে। সায়রা ঘরের কোণার চেয়ারটা টেনে নিয়ে বিছানার পাশে গিয়ে বসলো।
"ভালো আছেন ফাদার?"
মেকি হাসির ঢেউ খেলে দিলে ফাদার বললো, "আছি মা!"
"আপনি জানলেন কিভাবে দরজার ওপাশে আমিই ছিলাম!'
"আমি জানতাম তুমি নয়তো নিকিতা আসবে একদিন আমার কাছে! নিকিতা তো চলে গিয়েছে বছর খানেক হলো। এখন তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম!"
"আপা চলে গিয়েছে মানে?"
"নিকিতার সাথে যোগাযো ছিলোনা তোমার?"
"না। আপা অন্য শহরে থেকে কলেজে ভর্তি হয়; আর আমি আলাদা। অনেকভাবে যোগাযো করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু খোঁজ পাইনি আপার!"
"তোমার আপার মৃত্যুর ছয়বছর হয়ে যাচ্ছে!"
"আপনার কাছে সে পরে আর এসেছিলো?"
"না।"
"তাহলে তার মৃত্যুর খবর পেলেন কিভাবে?"
"পেয়েছি। জানি আমি। সব জানি আমি!"
সায়রা ভ্রু কুঁচকে তাকালো ফাদারের দিকে। কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে খুলতে ধরতেই ফাদার বললেন, "অনেকদুর থেকে এসেছো। হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে বিশ্রাম নাও।
" অস্থির মন নিয়ে এসেছিলাম, ফাদার। মন সায় দিচ্ছেনা সব না জানা পর্যন্ত!"
"সময় খুব কম যদিও। খুব কম! বলবো আমি। সব বলবো!"
সায়রা ব্যাগের চেইন খুলে ডায়েরিটা বের করলো। ফাদারের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, "এই ডায়রির লেখার অর্থ আপনি বলতে পারেন, ফাদার?"
"পারি!" উঠে বসতে বসতে বললেন ফাদার।
"কাল রাতে খুব অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে আমার সাথে। আমি কাউকে নললে হয়তো বিশ্বাস করবেনা। কিন্তু আমার ধারণা আপনি বিশ্বাস করবেন এবং এর ব্যাখাও একমাত্র আপনিই আমাকে দিতে পারবেন।"
সায়রা গতকাল রাতের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বললো তাঁকে। ফাদারের চেহারায় স্পষ্ট আতঙ্ক ফুঁটে উঠলো। বিড়বিড় করে শুধু বললো, "বিপদ! সামনে বড় বিপদ। তাঁরা এসে গেছে!"
সায়রা কিছু বললোনা। কিন্তু বুঝতে পারলো, ফাদারই তাকে সাহায্য করতে পারবে।
"কাল রাতে তুমি যে মেয়েটিকে রাস্তায় দেখেছিলে মেয়েটি নিকিতার মেয়ে। তোমার আপার মেয়ে!"
সায়রা এধরনের কিছু শুনবে কল্পনাতেও ভাবেনি। হতভম্ব চেহারায় ফাদারের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।
"নাতাশার জন্মের কয়েকদিন পরে নিকিতা আত্নহত্যা করে; করতে বাধ্য হয়! নাতাশা কোনো স্বাভাবিক মানবশিশু নয়! তুহান তার ঔরসজাত পিতা নয়!"
"ফাদার কি বলছেন আপনি?"
.
.
চলবে.....


Writer:- নবণীতা ফেরদৌস
 

Delivered by FeedBurner

a