Leave a message
> কৃষ্ণকলি পর্ব ১ - Bangla Golpo
-->

কৃষ্ণকলি পর্ব ১ - Bangla Golpo


১.
এই নিয়ে সতেরোবারের মত পাত্রপক্ষ কলিকে দেখতে এসেছে।
কিন্তু কোনোবারই কেউ কলিকে পছন্দ করেনি।
কারণ কলির গায়ের রঙ কালো।কালো বলতে আবার কুচকুচে কালো নয়।শ্যামবর্ণ।
কলির সব আছে কাজল কালো মায়াবী বড় বড় চোখ, গোলাপের পাপড়ির মত ভরাট গোলাপি ঠোঁট আর আছে রেশমের মত লম্বা ঘন কালো চুল।
এসব কিছুতে যে কোনো ছেলেই ডুবে যেতে পারে।কিন্তু আজ অব্দি কেউ ডুবা ত দূরের কথা, কলির দিকে কেউ চোখ তুলেও তাকায় নি।কারণ কলি শ্যামবর্ণের।
আর আমাদের সমাজে শ্যামবর্ণকে ত কালো বলেই উপাধি দেওয়া হয়।
আমাদের সমাজের রীতি অনুযায়ী মেয়ে আর যাই হোক না কেন দুধে আলতা রঙ তার অবশ্যই হতে হবে।
আর একারণে সতেরোবার পাত্রপক্ষ দেখতে এসেও কেউ কলিকে পছন্দ করেনি।অনেকবার ত এমন হয়েছে যে কলিকে দেখতে এসে কলির ছোট বোনকে পছন্দ করে ফেলেছে।কিন্তু কলির পিতা মাতা কিছুতেই বড় মেয়ের আগে ছোট মেয়েকে বিয়ে দিতে চাননি।

কলি এবার ছাব্বিশ এ পা দিয়েছে।আঠারো বছর বয়স থেকেই তার জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে কিন্তু এখন অব্দি কেউ কলিকে পছন্দ করেনি।
কলি অনার্স শেষ করে আজ এক বছর যাবৎ ঘরে বসে আছে।এর মাঝে অনেকবার চাকরির চিন্তাও করেছে।কিন্তু আজকাল বাইরে বের হতে তার বড্ড বাজে লাগে।
পাড়াপড়শিরা কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকে তার দিকে।আর থাকবে নাই বা কেন? তার যে বিয়ে হচ্ছে না, সতেরোবার পাত্রপক্ষ যে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে এটা ত পাড়ার সকলেই জানে।তার থেকেও কমবয়সী মেয়েরা বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চার মা হয়ে গেছে আর তার এখনো বিয়েই হয়নি এটা যেন অনেক লজ্জার একটা বিষয়।
আজ কাল পাড়ার মহিলারা আবার কেমন করে যেন তাকাই তার দিকে।সেখানে কিছুটা তাচ্ছিল্য আর কিছুটা সহানুভূতি মিশ্রিত থাকে।তাদের এই নজর দেখে কলির বেশ লজ্জা করে।
এইতো সেদিনের কথা, এলাকার শেফালী খালা কলি র জন্য একটা সম্বন্ধ নিয়ে আসে।শেফালী খালার দেবরের সাথে কলির বিয়ের সম্বন্ধ।
শেফালী খালার দেবর বয়সে কলির দুইগুণ। তার উপর আবার বিপত্নীক দুই সন্তানের পিতা।বড় সন্তান আবার কলেজে পড়ে।
কলির মা আমেনা বেগম ত রাজি হয়ে যাচ্ছিলেন। যেন কলিকে ঘর থেকে বিদায় করতে পারলেই তিনি বাঁচেন।কিন্তু কলির পিতা শেফালী খালাকে ধমক দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন।
বের হওয়ার আগে শেফালী খালা পেছনে কলির দিকে তাকিয়ে মুখে তাচ্ছিল্যের সুর ফুটিয়ে বললেন
-এহ,যেই না তোমাদের মেয়ে আর যেই না তার গায়ের রঙ।জীবনেও বিয়ে দিতে পারবে না।
কথাটা সেদিন কলি গায়ে মাখায় নি।কারণ এত বছর ধরে তার গায়ের রঙ নিয়ে কথা শুনতে শুনতে সব গা সওয়া হয়ে গেছে।

কলির পিতা আনিসুল হক একজন শিক্ষক।হাইস্কুলে ইংরেজি পড়ান তিনি।
এলাকার প্রায় সকল ছেলেপুলেই তার ছাত্র।তাই এলাকায় বেশ একটা সম্মান রয়েছে তার।
আর কলি র মায়ের নাম আমেনা বেগম।তিনি একজন আদর্শ গৃহিণী।
আনিসুল হক আর আমেনা বেগম দুই মেয়ের মধ্যে কলিকেই বেশি ভালোবাসতেন।
কিন্তু দিনে দিনে কলির প্রতি আমেনা বেগমের ভালোবাসা অনেক কমে গেছে।তার অবস্থা এখন এমন হয়ে গেছে যে একে বাড়ি থেকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে পারলেই যেন বাঁচেন।কারণ কলির জন্য তার ভার্সিটি পড়ুয়া উনিশ বছরের বোন পাপড়ি র ও বিয়ের সম্বন্ধ দেখতে পারছেন না।কলিই যেন পাপড়ি র বিয়ে আটকে রেখেছে।
অবশ্য আনিসুল হক তার বড় মেয়ে কলিকেই বেশি ভালোবাসেন।কারণ হতে পারে তার বড় মেয়ে তার মতই শ্যামবর্ণ পেয়েছে।কিংবা কলি পড়ালেখা,খেলাধুলা, আচার ব্যবহার সবকিছুতেই চ্যাম্পিয়ন। কারণ যাই হোক, কলির প্রতি আনিসুল হকের ভালোবাসা দিন দিন বাড়ে বৈ কমেনি।


২.
সকালে ঘুম থেকে উঠেই কলি শুনতে পেলো আজ তাকে আবার পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে।
এই নিয়ে আঠারো বার।
কলি জানে যে এবারো তাকে পছন্দ করবেনা।

মামি র তাড়াহুড়োতে কলি উঠে বসে মা,খালা আর মামি র সাথে ঘর সাজানো তে হাত লাগায়।
সম্বন্ধটা নাকি কলির মামির কাছে নিয়ে এসেছে পাত্রের মা নিজ থেকেই।
পাত্র ইতালিতে পড়াশোনা করে।এখনো দেশে এসে গেছে বা এক দুই সপ্তাহের মধ্যে চলে আসবে।কলির তা জানা নেই।
কলি এও শুনলো পাত্রের বয়স নাকি তার সমান।ছাব্বিশ বছর।
কলি অবাক হয়ে যায় যে ছেলের বয়স এত কম,পড়ালেখা বিদেশে করেছে তার উপর নাকি আবার বনেদি পরিবার, সেই ছেলে তার মত কালো মেয়েকে কেন পছন্দ করবে?


নীল রঙের একটা শাড়ি পড়ে কলি বসে আছে।
তার মামি তাকে সাজিয়ে দিচ্ছে।
হাতে এক দলা পাউডার নিয়ে মামি পুরোটাই কলির মুখে মেখে দিলেন।
কলি হা হয়ে মামির দিকে তাকাতেই মামি বললেন
-মুখে পাউডার দিলে ফর্সা লাগবে।
কলিকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়ে কলির মামি চলে গেলেন।
আয়নার সামনে তাকিয়ে কলি তার মেকআপ দিয়ে ফর্সা করা চামড়া কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দেখলো।
তার মনে হলো এই সাদা চামড়া তার উপর মানাচ্ছে না, আগের সেই শ্যামবর্ণের চামড়াটাই তার জন্য ঠিক।
কলি তাই বাথরুমে গিয়ে মুখের উপর পানি ঢেলে মুখ পরিষ্কার করে ফেললো।
এরপর সে যেমন আছে তেমন ভাবেই শুধু চোখের নিচে একটু কাজল দিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে চলে গেলো।
কলি ভেবেছিল হয়তো পাত্রও আসবে।কিন্তু না, তিনজন মহিলা এসেছে কলিকে দেখতে।
কলি সালাম দিয়ে তাদের সামনে গিয়ে বসলো।
কলিকে দেখে পাত্রের মা নিজের পরিচয় দিয়ে বাকি দুজনকের পরিচয় দিলেন।একজন পাত্রের বড় ভাবি আর একজন পাত্রের বোন।
কলি এদের পোশাকাদির দিকে তাকালো।বেশ দামি আর সুন্দর পোশাক পড়ে এসেছে সকলে।দেখেই বুঝা যাচ্ছে অনেক বড় বনেদি পরিবারের মহিলা ইনারা।

পাত্রের মা এবার কলির দিকে তাকিয়ে বললেন
-তোমার নাম কি, মা?
-ইসরাত জাহান কলি।
-বাহ,বেশ সুন্দর নাম।তা কিসে পড়েছ?
-অনার্স শেষ করেছি।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "কৃষ্ণকলি" পড়েছ?
কলি চমকে তার সামনে বসা মহিলাটার দিকে তাকালো।মহিলাটা কি কোনোভাবে তার গায়ের রঙকে ইংগিত করতে চাইছেন? না, মহিলাটার হাসিমাখা মুখ দেখে তা মনে হচ্ছে না।
কলি ছোট করে উত্তর দিলো
-জ্বি পড়েছি।
-আমাকে কয়েক লাইন শুনাতে পারবে?
কলি মাথাকে একপাশে হেলিয়ে হ্যা জানালো।
-ঠিক আছে মা,তাহলে শুনাও ত দেখি।
কলি শুরু করলো
- " কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
কালো তারে বলে গায়ের লোক।
মেঘলাদিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের 'পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
এটুটুকু বলে কলি নিশ্বাস নেওয়ার জন্য থামতেই পাত্রের মা বললেন
-বাহ,তুমি ত বেশ ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারো।তুমি কি জানো কৃষ্ণকলি কাদের বলে?
কলি কিছু না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।
কলির নিরবতা দেখে মহিলাটা আবার বললেন
-কালো রঙেই যেসকল নারীদের সৌন্দর্য তাদেরকেই কবিগুরু কৃষ্ণকলি বলেছেন।আর অনেকের মতে কবিতার এই কৃষ্ণকলিই নাকি কবিগুরুর প্রথম প্রেম ছিল।
কলি কিছু না বলে তখনো নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।তখন মহিলাটা তখন হাত দিয়ে কলির থুতনি ধরে কলির মুখ উপরের দিকে তুলে বললেন
-মাশাল্লাহ, তুমি ত অনেক সুন্দর।বাহ,কি মায়ায় জড়ানো চোখ,কি সুন্দর চুল,কি সুন্দর চেহয়ারার গঠন।
কলি অবাক বিস্ময়ে তার সামনের মহিলাটার দিকে তাকিয়ে রইলো।এই প্রথম সে তার রূপের বর্ণনা পেয়েছে।
কলির হঠাৎ মনে হলো দূর থেকে কেউ গেয়ে উঠেছে
"কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি।"
কলির কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে।অনেক কষ্টে সে তার কান্না আটকে রেখেছে।
মহিলাটা এবার ব্যাগ থেকে একটা আংটি বের করে কলির আঙ্গুলে পড়িয়ে দিতে দিতে বললেন
-তোমাকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।আমার রোশান এর জন্য তোমার থেকে সেরা আর কেউ হতে পারে না।
কলি চমকে উঠলো।কলির সাথে সাথে কলির পরিবারের সকলেই চমকে উঠলো।
নিজেদের কানকে যেন তারা বিশ্বাস করাতে পারছেন না।কলির বিয়ে ঠিক হয়েছে তাও আবার এত বড় বাড়িতে।
সবাই একপ্রকার ধরেই নিয়েছে ছেলে ল্যাঙড়া,খোঁড়া, কানা,কিংবা বোবা হবে।কিন্তু মহিলার কথা শুনে মনে হচ্ছে তার ছেলে হাজারে এক।
মহিলা যাওয়ার আগে কলির কাছে একটা ছবি দিয়ে গেলেন।


পাত্রপক্ষরা অনেক আগেই চলে গেছে।
কিন্তু পাত্রের মায়ের দেওয়া ছবিটা কলি এখনো খুলে দেখেনি।তার মনে এক প্রকার ভয় হচ্ছে।যদি ছেলেকে তার পছন্দ না হয়? পরক্ষণেই কলির মনে হলো তার পছন্দ অপছন্দ দিয়ে কি যাই আসে?
কলি ধীরেধীরে ছবির প্যাকেটটা বের করলো।এরপর একহাত দিয়ে টেনে প্যাকেটটা খুলে ধীরেধীরে ছবিটা বের করলো।
ছবিটা চোখের সামনে ধরতেই কলি চমকে উঠলো।
কলি স্বপ্নে এমন কাউকেই খুঁজে এসেছে আজীবন।যে দেখতে রাজপুত্রের মত হবে,গায়ের রঙ তার মত শ্যামলা না হয়ে ফর্সা হবে,সূচালো নাক হবে আর হৃদয় ভূলানো হাসি থাকবে। কিন্তু তার স্বপ্নের মানুষ যে এভাবে তাকে ধরা দিবে সে সেটা বুঝতেই পারেনি।মুহূর্তেই আনন্দে কলির দু চোখ দিয়ে পানিয়ে গড়িয়ে পড়ে।একসাথে এত খুশি যেন সে সহ্য করতে পারছেনা।



৩.
রাতে অনলাইনে বসে কলি বিয়ের কিছু সাজ দেখছিল।
বিয়ের খবরটা পাওয়ার পর তার কি হয়েছে কে জানে সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুধু বিয়ের কথাই ভাবছে।
হঠাৎ তার ইমো নম্বরে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে অডিও কল এলো।
কতক্ষণ ভেবে নিয়ে কল ধরতেই অপরপাশ থেকে সুপুরুষ কণ্ঠে কেউ বললো
-আসসালামু আলাইকুম। কলি বলছেন?
-জ্বি।আপনি কে?
-আমি রোশান।
-কোন রোশান?
কথাটা বলেই কলি জিহবায় কামড় দিলো।পাত্রের নাম যে রোশান এটা সে কি করে ভূলতে পারে?
-আমি হচ্ছি সেই রোশান যার সাথে আপিনার বিয়ে ঠিক হয়েছে।
-হুম,বুঝতে পারছি।
-আপনার কণ্ঠ কিন্তু অনেক সুন্দর।
-ধন্যবাদ। আচ্ছা আপনি আমাকে কি দেখেছেন?
-না, দেখিনি।তবে আমার মায়ের উপর আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে।আমি জানি মা আমার জন্য সেরা মেয়েকেই বেছে নিবেন।আর আপনাকে মা যেহেতু আমার জন্য বেচে নিয়েছেন তাহলে আমি নিশ্চিত আপনি সেরাই হবেন।
-আমার নম্বর কোথায় পেয়েছেন?
-তোমার মামি আমার মাকে তোমার নম্বর দিয়েছে। আর মা আমাকে দিয়েছে যাতে তোমার সাথে কথা বলতে পারি।
-আপনি চাইলে ভিডিও কল করতে পারতেন।
-বললাম ত মায়ের উপর আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে।আর একেবারে বাসরঘরেই তোমার সুন্দর মুখখানি দেখবো আমি।
-তখন যদি আমাকে পছন্দ না হয়?
-মায়ের পছন্দই আমার পছন্দ।
-মাকে খুব ভালোবাসেন, তাইনা?
-হুম অনেক।
-দেশে কখন আসবেন?
-এইতো চার পাঁচদিন পর।
-কিন্তু পরদিনই ত আমাদের বিয়ে।
-কি করবো? টিকেট পেতে কষ্ট হয়েছে।আচ্ছা এখন রাখি।পরে কথা হবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে।আল্লাহ হাফেজ।
-আল্লাহ হাফেজ।
রোশানের সাথে কথা বলে কলির বুক যেন ঠান্ডা হয়ে গেলো।বারবার সে রোশানের ছবিটা দেখছে।বুঝতে পারছে সে,রোশানের প্রতি তার গভীর ভালোলাগা তৈরি হয়েছে।

রুম থেকে বের হতেই কলি দেখলো পুরো বাড়িতে সাজ সাজ রব।সকলে কলির বিয়ের আনন্দে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
কলির জন্য কলির মায়ের উবে যাওয়া ভালোবাসা যেন পুনরায় উদয় হয়েছে।
সকলকে তিনি বলে বেড়াচ্ছেন
-এত বড় ঘরে বিয়ে হবে বলেই ত আল্লাহ এতদিন আমার মেয়ের অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হতে দেননি।সব আল্লাহর ইচ্ছা।তিনি ত সকলের জোড়া বানিয়েই পাঠান।
মায়ের কথা শুনে পাড়ার শেফালী খালা মুখ বাকা করেন।কিন্তু কলির মা শেফালী খালাকে দেখে যেন আরো উৎসাহের সাথে কলির হবু শ্বশুর বাড়ির খবর শুনান।


(চলবে)....


Writer:- Ashraf Tanvir
 

Delivered by FeedBurner

a