> হিমুর কোয়ারেন্টাইন
-->

হিমুর কোয়ারেন্টাইন


কোনো এক বিচিত্র কারণে গত ২০ দিন ধরে হিমু (আমি)মাজেদা খালার বাসায়। বাইরে একটি পলকের জন্যেও বের হচ্ছে না। বিচিত্র কারণটা গোটা বিশ্বের সবারই জানা। বিশ্ব এক অস্থিতিশীল মহামারীর দ্বারা ভারাক্রান্ত। যার নাম Corona Virus( Covid 19)
হঠাৎ খালুর ডাক পড়ল। উনি আমাকে ছাদে যেতে বলেছেন। আমার অনুমানবিদ্যাকে সবসময় ঠাট্টায় উড়িয়ে দিলেও প্রয়োজনের সময় ঠিকি আমার উপরেই নির্ভর করেন।
ছাদে গিয়ে দেখি উনি থানকুনি পাতার গাছের দিকে মনোযোগের সহিত তাকিয়ে আছেন।
আমি আসতেই খালু বললেন, " হিমচন্দ্র, কিছু বলো তো এই গাছটা সম্পর্কে? "
আমি বললাম, " এটা থানকুনি পাতা। শরীরের জন্য উপকারী। "
খালু বললেন," তোমার ঘোড়ার ডিম মার্কা ফিলোসফি দিয়ে কাজ নেই। এটা করোনা রোগের ঔষধ।"
আমি বুঝে গেলাম উনি হয়ত ফেসবুক/ ইউটিউবের ভূয়া নিউজ পড়েছেন। আর তাছাড়া রাতে উনি লিমিটের বেশি পেগ উগলে দিয়েছেন।
তাই চুপচাপ কেটে পড়লাম।
ছাদ থেকে নেমেই বাদলের ঘরে গেলাম। সে দেখি সাহিত্য সাধনায় মজে আছে।ধারে গিয়ে বললাম, " কি লিখছিস?"
বাদল বলল, " ছোট্ট একটা কবিতা।"
বাদলের এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবার কথা ছিল। ইচ্ছে করে যে দেয়নি তা নয়। বরং করোনার প্রকোপে পরীক্ষা স্থগিত। কবে হবে সেটা কারো জানা নেই।
বাদলের কবিতা মাত্র আট লাইন লেখা শেষ হয়েছে। শুরুটা এরকম,
" শূন্য ডিগ্রী কোণে মাথা রেখে
দীর্ঘদিন যুদ্ধের শেষে
গোসল বিহীন ঘুমোবোর সময় হয়েছে।
কংক্রিট বিহীন বাশ -মৃত্তিকার
ছাদ হবে উপরে..... "
আমাকে শেষ করতে না দিয়েই বাদল বলে উঠল, " দেখেছেন গুরুমশাই, আমি দিন দিন দার্শনিক হয়ে যাচ্ছি। কোয়ারেন্টাইন শেষ হলে এবার আমাকে অবশ্যই আপনার ভ্রমণসঙ্গী করবেন।
বাদল বোধহয় আমার মুখের প্রশংসা সূচক এক্সপ্রেশন এক্সপেক্ট করেছিল।তবে আমি তা না করেই বললাম, " টেলিফোনটা তোর ঘরে নিয়ে আয়।"
বাদল এনে দিল। ভাবতে লাগলাম কাকে কল করা যায়।
তখনি মনে পড়ল অনেকদিন রূপাকে দেখা হয় না কথাও হয় না তাকেই কল দিই।
" হ্যালো রূপা? কেমন আছো?"
ওপাশ থেকে রূপা বলল, " আমার কথা কি কখনো মনে পড়ে একবারও যে আমাকে কল দিয়েছেন। প্রশ্নের উত্তর তো তাকেই দেওয়া যায় যার মনে প্রেয়সীর প্রতি অনুভূতি বলে কিছু থাকে। আপনার.. ".
কল কেটে দিলাম। রূপার গলার আওয়াজ বেশিক্ষণ কানে গেলে মায়ায় পড়ে যাব।আমার বাবা আমাকে মায়ায় পড়তে নিষেধ করে গেছেন।
( বাবা হিমালয়, মহাপুরুষদের মায়া থাকতে নেই।মায়ায় পড়ে বীর হারিয়েছে তার যৌবনদিপ্ত গাত্র। রাজা হারিয়েছে তার রাজ্যের জৌলুস।)
নাহ বাবার কথা মনে করা যাবে না। মায়ায় পড়ে যাব। উনার আমাকে মহাপুরুষ বানাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।
ঠিক তখনি মাজেদা খালার কাছে গেলাম। গিয়ে বললাম, " মাস্ক আছে? মাস্ক & ৫০০০ টাকা দাও আমাকে।"
মাজেদা খালার জবাব," কিহ..! তুই বাইরে যাবার বাহানা করছিস। জানিস না একবার বাইরে বেরোলে তুই আর আসতে পারবি না। তোর খালুর কড়া কথা।এই বাড়ির দাড়োয়ান কেও বাড়ির বাইরে যেতে দেয়নি। তার পরিবারের কাছেও না। আর ৫০০০ টাকা দিয়ে কিই বা করবি শুনি? কেন দিব তোকে টাকা?"
আমি ফটাফট বললাম, " আমি তোমাদের ঘরে থাকায় এই ঘরে করোনা ভাইরাস প্রবেশ করতে পারেনি। সেজন্য আমার ফি চেয়েছি। দিয়ে দাও চলে যাব।"
ঠিক তখনি মাজেদা খালার বাড়ির কাজের মেয়ে হাজির। নাম কুলসুম। বয়স খুব বেশি না।ওর বাবা মারা যাওয়ায় গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে। খাওয়া - পড়ায় থাকে কোনো বাড়তি বেতন নেই।ও এসে বলল, " আফা আফা, করোনার ক তে কোরআন রো তে রোজা আর না তে নামাজ।"
মাজেদা খালার মত মানুষ এতে বিশ্বাস করে এই নিয়ে পড়ে গেল। কিন্তু করোনা যে বাংলা ভাষা থেকে আসেনি সেটা কে বুঝাবে।
বিরক্তিভাব নিয়ে বাইরে চলে এলাম।
বাইরে গেটের কাছে আসতেই দেখলাম দাড়োয়ান সিকিউরিটি রুমে বসে ফোনে কাদছে।
পুরুষদের কান্না বহিরাগত লোকের কাছে দৃশ্যমান হয় না সচরাচর। তবে সংকটের সময় অশ্রু আটকাতে অপারগ হয়ে যায় ।
আমাকে দেখেই ফোন কেটে দিয়ে বলল," কি হিমু ভাই আপনে এখানে। আমি খেয়াল করি নাই। "
পকেটে ১০০ টাকা ছিল দাড়োয়ানের হাতে দিয়ে বললাম, " তোমার বাসায় শুধু চাল নেই। আর যা আছে তাতে আজকের টা চলে যাবে। যাও চাল কিনে দিয়ে আসো।আমি আছি এখানে। "
দাড়োয়ান খুশিতে আটখানা & অবাক দুটোই হলো। সে আমার অনুমানবিদ্যা দেখে অভ্যস্ত নয়।
দাড়োয়ান তার বাসার পথে রওনা দিতেই আমি ফুট করে বেরিয়ে পড়লাম। ১ মাস না যেতেই ঢাকা শহরের এত পরিবর্তন।
হাটতে হাটতে যাত্রাবাড়ী চলে এলাম। পথে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মামুনকে দেখতে পেলাম। উনি আমাকে ডাক দিয়ে বললেন," হিমু নাকি? যাচ্ছ কই? মাস্ক নাই, জুতা নাই , হ্যান্ড গ্লাভস নাই।"
আমি বললাম, " আমি যতটুকু রাস্তা হেটে এসেছি ততটুকু রাস্তার ধারেকাছে কোনো প্রাণ হরণকারী ভাইরাস নেই। "
ওসি মামুনের পাশে থাকা কনস্টেবল শফিক ঘেউ ঘেউ করে বলে উঠল, " শালাকে কয়েকটা ডান্ডার বারি দিয়ে নিই। তখন বুঝবে পুলিশের মুখের উপর কথা বলার পরিণাম কি হয়।"
ওসি সাহেব ঝামেলা পাকাতে না দিয়ে আমাকে ১ জোড়া মাস্ক দিয়ে যেতে বললেন।
যাবার সময় শফিককের দিকে তাকিয়ে বললাম, " আপনার মেয়ের নাম প্রেমা। স্ত্রী দশ বছর আগে মারা গেছে। বাসায় কল দিয়ে দেখুন মেয়ের সাথে আর কেউ আছে কিনা।"
শফিক বলল, " আমার ঘরের খবর তুমি জানো কেমনে? কি বলতেসো আনতাজে এসব? "
ওসি সাহেব বুঝে গেছে। তাড়াতাড়ি কনস্টেবল শফিকের বাসায় পুলিশ পাঠিয়ে গ্রেফতার চোর করে আনা হল। চোর মেয়েটিকে রেপ করার চেস্টা করেছিল। হিমুর এ ভবিষ্যৎবাণীর কারণে এত বড় অনিস্ট এর থেকে এ যাত্রায় কনস্টেবল শফিক বেচে যায়।
কনস্টেবল শফিককে ওসি বললেন, " এ হচ্ছে হিমু। কোত্থেকে যেন ছুটে চলে এসে মুশকিল আছান করে দেয়। যেন খোদার ফেরেশতা। "
কনস্টেবল শফিকের পকেট থেকে আমি ঠপ করে সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে বললাম, " লাইটার আছে? দিন তো? ".
শফিকের থেকে লাইটার নিয়ে বললাম, " এগুলা এখন আমার সম্পত্তি। আপনাকে বাচিয়েছি তার মানে এই না যে শুধু ধন্যবাদে চলবে। গেলাম।"
কনস্টেবল শফিক বলল," হিমু ভাই, আপনার যদি কিডনীর প্রয়োজন হয় কখনো আমারটা নিয়েন। আপনে আমাকে বাচাইসেন।"
কিছু না বলেই চলে এলাম। হঠাৎ দেখি মানুষের এক জটলা জমে আছে একটা পিকআপ ভ্যানের চারপাশে।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলছে। উপস্থিত গরিব,নিন্ম মধ্যবিত্ত , এতিম শুধু এক ব্যাগ ত্রাণের জন্য জীবন ঝুকি নিয়ে ভীড় জমাচ্ছে।
আমি দেখতে গেলাম কি হয়েছে। যেই বেশে এসেছি তা দেখে এক স্বেচ্ছাসেবক এক মিনি বস্তা ত্রানের প্যাকেট হাতে ধরিয়ে মার্জিত ভাষায় ঘরে যেতে বলল।
এর জায়গায় কোনো পলিটিশিয়ানের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম হলে বোধহয় নতুন নতুন গালি শেখা হয়ে যেত।
আমি হেটে যাচ্ছি মাজেদা খালার বাসার উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে বোধহয়। ভারী বস্তা নিয়ে হাটা মুশকিল তাও খালি পায়ে।
শেষমেস মাজেদা খালার বাড়িতে গিয়ে দেখি গেটের সামনে খালু পিস্তল নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমাকে গুলি করার জন্য। আমি কোনোরূপ ভ্রুক্ষেপ না করে এগুচ্ছি।
খালু বললেন, " থাম হিমু। আর এক পা বাড়ালে গুলি করে দিব কিন্তু। "
মাজেদা খালা ঠপ করে পিস্তল কেড়ে নিয়ে নিচে ফেলে দিলো। আর, দাড়োয়ান সেটা ধরে ড্রেনে ছুড়ে মারল।
খালুকে খালা সামলিয়ে ঘরে নিয়ে গেল। আমি ত্রাণের মিনি বস্তাটা দাড়োয়ানের হাতে দিয়ে বললাম, " আজকে না হয় তোমার পরিবারের চুলো জ্বলবে। কাল থেকে আগুন জ্বালাবার জন্য জ্বালানী দিলাম। তোমার ১৫ দিন হয়ত চলবে। "
দাড়োয়ানের মুখ থেকে কিছু বের হচ্ছিলো না।তবে চোখ থেকে নোনা জ্বল বেরিয়ে এলো। জড়িয়ে ধরতে গেলে আমি চলে এলাম। গোসল টা সেরে নিতেই বাদল টেলিফোনটা আমাকে দিল। রূপার কল এসেছে।
ওপাশ থেকে রূপা বলল, " তুমি আজকে অনেক ভালো কাজ করেছো। আমি সব জানি। অনুমানবিদ্যা শুধু তোমারই না।আমারও আছে। বাদলের ফোনে ১০,০০০ টাকা বিকাশ করেছি।লাগলে আরো দিব। আশেপাশের মানুষকে একটু চুলা জ্বালাবার ক্ষুদ্র চেস্টা কইরো। রাস্তার পাহারাদার কুকুরদের কথা ভুললে খবর আছে কিন্তু। বায়"
পাজামার পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালালাম। মনে প্রশ্ন উঠছিল , তবে কি আমি মহাপুরুষ হবার পথ থেকে সরে গেলাম?
মনে মনে বললাম,
ভালো থাকুক এ পৃথিবী ও তার ভিতরের সবকিছু। 


সমাপ্ত


Writer:- Sidratul Amin Tonmoy
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner