> মায়ের কৌতূহল
-->

মায়ের কৌতূহল


সকালের নাস্তা সেরে পড়তে বসছি। পাশের রুম থেকে মা এসে আচলে হাত মুছে বললো,
-কয়টা বাজে দেখতো?
হাতে ঘড়ি নেই, বালিশের নিচ থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখে বললাম,
-সাত'টা চল্লিশ বাজে।
সময়ের কথা শোনেই মা বিরবির করে কিছু একটা বলতে লাগলো। স্পষ্ট শুনতে পেলাম না।
-কি বলো মা একা একা?
মা উত্তর দিলেন না। হেঁটে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। আমিও আবার বই মেলে পড়তে বসি।
গত কয়েকটা দিন খেয়াল করছি মায়ের মনটা ভালো নেই। বিষন্নতায় কাটে সারাক্ষণ। এক দৃষ্টিতে আনমনা হয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রতিদিন রাত হলে ঘুমানোর সময় মা হাসিমুখে রুমে এসে বলতো, বেশি রাত না জেগে শুয়ে থাকিস। অথচ কয়েকদিন ধরে রাত্রি বেলায় ঘুমানোর আগে রুমে ঠিকই আসে। কিন্তু আগের সেই হাসিটা থাকেনা। কারণ জানতে চাইলে মা অভিনয় করে হেসে বলে, কই কিছু নাতো!
মা সকালের খাবার রান্না করছে। এক ঘন্টার মতো পড়া হয়েছে প্রায়। আবার মায়ের ডাক পরলো। বই বন্ধ করে মায়ের কাছে যাই।
-আবার কি হয়েছে?
লক্ষ করি আগুনের তাপে মায়ের কপাল বেয়ে বেয়ে ঘাম পড়ছে। ঘাম মুছে বললো,
-আজকে কতো তারিখ দেখতো?
-সাথে মোবাইল নাই মা। রুম থেকে নিয়ে আসি।
মা রাগান্বিত ভাবে তাকিয়ে বললো,
-মোবাইল সাথে রাখতে সমস্যা হয় তোর? মোবাইল তোর কাছে কি ভাত মাছ চায়?
রাগান্বিত কণ্ঠস্বর শোনে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম। মা আবার বললো,
-যা মোবাইল নিয়ে আয়।
আমি দৌড়ে মোবাইল নিয়ে আসি। তারিখ ও সময় দেখে বললাম,
-আজ ১৯ তারিখ।
মা একটু সস্থির নিঃশ্বাস ফেললো। নুছনি দিয়ে ভাত নামাচ্ছে। আমি বললাম,
-মা, গত কয়েকদিন লক্ষ করি তুমি চিন্তিত। ব্যাপার কি বলোতো?
সঠিক জবাব না দিয়ে উল্টো ঝারি মেরে বললো,
-তোকে এখানে কে আসতে বলেছে। যাহ্ গিয়ে পড়তে বস।
রুমে এসে টেবিলে বসে বসে ভাবছি, মা যেতে বললো সাথে সাথে গেলাম। উল্টো ঝাড়িও দিলো। হাতে মোবাইল দেখলে বকা দিতো, কিন্তু এখন মোবাইল না রাখলে বকা দেয়। ভাবনা সব বিপরীত হচ্ছে।
দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুম দিলাম। ঘুম থেকে উঠেই মনে হলো বন্ধুর থেকে কয়েকটা বইয়ের ছবি নিতে হবে। মোবাইল চার্জে লাগিয়ে ঘুমাই। চোখ মেলে তাকাতেই অবাক হই। দেখি মোবাইল নেই। খুব চিন্তিত হলাম। অসময়ে কে আসবে রুমে? বিকেল ঘনিয়ে আসছে। মা'কে ডাকতে লাগলাম। সারা পেলাম না। অনেক খুঁজে অবশেষে মায়ের দেখা মিললো বাড়ির পাশে বটগাছটার নিচে। দেখি বসে বসে আমার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। পেছন থেকে মা'কে বললাম,
-এখানে বসে আছো কেন মোবাইল হাতে নিয়ে?
-দেখতো বাবা তোর মোবাইল বন্ধ না চালু?
নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আর মনে মনে ভাবলাম, মা এমন করছে কেনো? মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি মোবাইল চালুই আছে। খেয়াল করি বন্ধুর কয়েকটা মিসডকল ভেসে আছে। মা'কে বললাম,
-ফোন আসছিল তুমি দেখো নাই?
মুহূর্তেই মা'র মাঝে পরিবর্তন আসে। শান্ত ভাবে বসে থাকলেও এখন উত্তেজিত হয়ে বললো,
-কে ফোন দিয়েছিল বাবা?
-আমার বন্ধু সাকিব ফোন করেছিল।
বন্ধুর কথা শোনে মনে হলো আকাশ থেকে ছিটকে পড়লো। মা বিরবির করে বলতে থাকে,
-ফোন দেয়ার আর সময় পায়না।
অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসি।
রাত নয়টা, পড়তে বসছি। পাশে মা'ও বসা। কিছুক্ষণ পরপর বলছে, কেউ ফোন দেয় কিনা আমাকে জানাস। খুব বিরক্ত হতাম। মা ভেবে চুপচাপ সহ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এমন সময় মা টেবিলের উপর থেকে আমার মোবাইল হাতে নিলো। আমি থমকে গেলাম। বই বন্ধ করে চেঁচিয়ে বললাম,
-কি সমস্যা তোমার? সকাল থেকে শুধু শুধু অস্থির হচ্ছো। কি হয়েছে বলো আমাকে?
রাগে আমি ফুঁপাতে লাগলাম। মা কাঁপা কাঁপা সুরে মাথা নিচু করে বললো,
-এমনি বাবা, নে তোর মোবাইল।
মোবাইল টেবিলের উপর রেখে মাথা নিচু করে চলে যায়। ভীষণ অসস্থি অনুভব হচ্ছিল। মায়ের সাথে বাজে ব্যবহার করাটা মোটেও ঠিক হয়নি। গুণিজনের মুখে শুনতাম, সকল নারীই খারাপ হতে পারে, পৃথিবীতে একটি মা'ও খারাপ না। মায়ের কাছে ছুটে গেলাম। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে যা দেখলাম, তা দেখে হতভম্ব হই। দেখি বড় ভাইয়ের ছবি দেখে দেখে কান্না করছে। মা'র পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত মেজাজে বললাম,
-কি হয়েছে মা বলো?
বয়স্ক মা চোখের পানি মুছে বললো,
-তোর ভাই(জাবেদ) ফোন করে না?
বড় ভাই শেষ ফোন করেছিল এক বছর আগে।বিয়ের দের বছর পরেই টাকার লোভে শ্বশুর বাড়ি চলে যায়। ওখানেই তার বসবাস। এটা যদি মা'কে বলি তাহলে সারারাত কান্না করবে। বাধ্য হয়েই মায়ের মুখে হাসি ফোঁটাতে বললাম,
-করেছিল এক সপ্তাহ আগে। তুমি বাড়িতে ছিলে না আর ভাইও ব্যস্ত ছিল। আবার ফোন করবে বলেছে।
-আমার কথা বলে জাবেদ? আমার সাথে কথা বলতে চাইনা ও?
মায়ের আবেগী কথা শোনে লুকিয়ে আমিও দু'ফোঁটা চোখের পানি ফেলে বললাম,
-তোমার সাথে কথা বলতে চাইবে না কেনো? তুমি তো জন্মদানকারী। সেদিনও বড় ভাই তোমার কথা বলে কান্না করলো। কিন্তু তার কাজের অনেক চাপ, তাই সে আসতে পারছে না।
মা দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করেনি। চোখ মুছে মুচকি হেসে বললো,
কান্না বিহীন পৃথিবী,
এক মেয়ের সমতূল্য।
পৃথিবীর চেয়েও ভারী,
সত্বী মেয়ের মূল্য।

(সমাপ্ত)

Writer:- জহিরুল ইসলাম
 

Delivered by FeedBurner

a