> স্ত্রী - Golpo - Boipoka365
-->

স্ত্রী - Golpo - Boipoka365



হাত পাখায় স্বামীকে বাতাস করতে করতে অপর হাতে শাড়ীর আঁচলে ললাটের ঘাম মুছলো আছিয়া। ভরদুপুরের এই ভ্যাপসা গরমে খেতে বসেছে মান্নান দর্জি। সেই যে কাকডাকা ভোরে বিদ্যুৎ গেলো আর আসার নাম নাই। মান্নান দর্জির কড়া আদেশ বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে কাজের জন্য। স্বামীর সেবায় যেন সামান্য ও হেরফের না হয়। মেয়ে মানুষ দাসীতূল্য। ঊনিশ থেকে বিশ হলেই ছেলে-মেয়েদের সামনেই হাত তুলে আছিয়া খাতুনের উপর। আর অকথ্য গালিগালাজ তো নিত্যকার চালচিত্র।
' শুনছেন, কয়দিন ধইরা বুকটায় খুব ব্যাথা। নিঃশাস আটকাইয়া আসে। ডাক্তারখানায় নিয়া যাইবেন একটু? বেশ সাহস যোগার করেই বললো কথাটা।
ভাতের লোকমা মুখে দিতে গিয়েও পাতে রেখে দিয়ে গমগমে আওয়াজে বললো, ' বাড়ীত আইস্যা তো শান্তি পাইনা তোর প্যানপ্যান ঘ্যানঘ্যানের জ্বালায়। খুব টাকা দেখছোস আমার, খালি তোরে গলায় ঝুলাইয়া দৌড়াইমু। বুক ব্যাথা তো কী হইছে? আজাইরা ঘরে বইসা তাল পাসনা? এক দমে কথাগুলো বলে থামলো মান্নান দর্জি।
এটুকু শুনেই চুপ হয়ে গেলো আছিয়া। স্বামীর মুখের উপর এক বাক্য বললেই রণক্ষেত্র হয়ে যাবে। সন্তানের সামনে এমন অপমানিত হওয়ার চেয়ে চুপ থাকা ঢের ভাল। কোনরকম দিন পার হোক। একদিন সব না পাওয়া নিয়েই শেষ ঠিকানায় চলে যাবে। ভাবতে ভাবতে আঁচলে চোখ মুছলো।
খাওয়া শেষ করে কাঁধে পাঞ্জাবী ফেলে বাজারের পথ ধরলো মান্নান দর্জি। ছোট্ট একটা দোকানে সেলাই মেশিন নিয়ে বসেছে। যা আয় হয় তাতে এক ছেলে আর বউ নিয়ে ভালোই দিনকাল চলে। আরেক ছেলে বউ নিয়ে আলাদা থাকে। আর দুইমেয়ের বিয়ে হয়েছে।
গামছার এক কোণা দিয়ে ধূলোময়লা ঝেড়ে চেয়ারে বসে পড়লো। পাশের বিশাল বড় কাপড়ের দোকানের সিরাজ মিয়া দোকানের শাটার বন্ধ করতে করতে জিজ্ঞাসা করলো, ' কী মিয়াভাই , এমন ভরদুপুরে এত রোদের মধ্যে কিছুক্ষণ বাড়ীতে বিশ্রাম নিলেও তো পারেন। একটু বেলা গড়াইলে কাজে আসবেন। ভাবীর সাথে দুইটা সুখ-দুঃখের গল্প করবেন। জীবনটা ভাই কয়দিনের! খালি টাকার পিছনে দৌড়াইলেই সুখ না। মাঝেমাঝে ঘরওয়ালীর সাথে সুন্দর সময় কাটানোর মাঝেই আসল সুখ।
' ধুর মিয়া এইসব মাইয়া মানুষের সাথে কিসের এত আলাপ! ঘরের কাম করবো আর ভাত খাইবো। সারাদিন প্যানপ্যান এই রোগ সেই রোগ। কত ভাল্লাগে এইগুলা শুনতে! বেশ বিরক্তি নিয়েই বললো কথাগুলো মান্নান দর্জি।
' কখনো সময় নিয়ে শুনেছেন ভাবী সাহেবার কথা? চার-পাঁচটা সন্তান জন্ম দিয়ে একটা মানুষ রোগের কথা বলবেনা? আচ্ছা এটা বলেন, কখনো একসাথে খেতে বসেছেন? নিজে হাতে মাছের টুকরোটা তার পাতে বেড়ে দিয়ে বলেছেন তোমারও এসব খাওয়া উচিৎ? আমার তো মনে হয়না কখনো এরকম করেছেন। আপনি পুরুষ তাই আপনি মানুষ। সে মেয়ে তাই সে মানুষ না, তাইতো? এত অবিচার কেন ভাই? শেকড় উপড়ে সব মায়া ত্যাগ করে আপনার কাছে চলে এসেছে আপনার ঘর সাজাতে। মৃত্যু সুনিশ্চিত জেনেও আপনাকে বাবা ডাক শুনিয়েছে। আপনার সন্তানকে লালন-পালন করেছে। আপনার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবার দেখাশোনা, মেহমানদারী করেছে। আপনার সেবা করছে। সর্বোপরি সে আপনার জীবনটাই পাল্টে দিয়েছে। এইযে দুটো পয়সা কামিয়ে নিশ্চিন্তে পেটপুরে খেয়ে শান্তির ঘুম দেন সবটাই তার উসিলায়। এরপরেও বলবেন সে কোন কাজের না? এরপরেও বলবেন সে প্যানপ্যান করে, শান্তিতে থাকতে দেয়না? কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে বললেন সিরাজ মিয়া।
বয়সে ঢের ছোট সিরাজ মিয়ার কথা শুনে কেমন লজ্জা অনুভূত হচ্ছে মান্নান দর্জির।
সিরাজ মিয়া আবারও বললেন, ' সে আছে আপনার চোখের সামনে তাই তার মূল্যায়ন করতে পারছেননা। আসলে আপনি এত উচ্চতর মানুষের মূল্যায়ন করার মত যোগ্যই না। যেদিন চলে যাবে ঘর খালি করে সেদিন বুঝবেন। চোখ ঘুরিয়েই কাউকে পাবেননা। সবকিছু আর প্রস্তুত পাবেননা। বুঝবেন ভাই বুঝবেন এই প্যানপ্যানানি কতটা মধুময় ছিলো। কতটা অভিযোগ নিয়ে ঘুমিয়ে যাবে ভাবতেও পারবেননা। বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলো।
আচমকা এমন কথা শুনে বুক ধড়ফড় করে উঠলো। কেমন ঘেমে গেলো। আছিয়ার জন্য এত মায়া আগে অনুভব করেনি। সে একা করে চলে গেলে কি করে থাকবে! ভাবতেই বিন্দু বিন্দু ঘাম কপালে জমে গেলো। অস্থিরতায় আবার দোকানের শাটার বন্ধ করে বাড়ীর পথ ধরলো।

রবিন বারান্দার পিছনদিকে আমগাছের নিচে বাঁশের মাচায় বসে মোবাইল টিপছে। গরমের জন্য ঘরে টিকা দায়। পিছন থেকে আছিয়া কান্নামাখা গলায় ডাক দিলো, ' বাবা, আমার বুক ব্যাথাটা বাড়ছে। একটু ডাক্তারের কাছে নিয়া যা। টাকা আছে আমার কাছে। দম আটকায়া আসতেছে।
' যাওতো মা ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো। শান্তি দিবানা নাকি? একটু বুক ব্যাথা হইলেই বলা লাগে? আমি এখন পারবোনা যাইতে। চোখমুখ কুঁচকে কথাগুলো বলে মাচা থেকে নেমে বাড়ীর আঙিনার বাইরে চলে গেলো।
মুখের উপর এত শক্ত কথা নিতে পারলোনা আছিয়া। বুকে হাত দিয়ে কোনরকমে হাতড়ে গিয়ে ঘরে উঠলো। নিঃশাস আর বাড়ছেনা। এই বাড়ীতে কেউ এক আনার দাম ও দেয়নি কখনো। না স্বামী, না সন্তান। সবাই বিরক্ত সবাই বিরক্ত বিড়বিড় করতে করতে নিস্তেজ হয়ে গেলো।
পা চালিয়ে হাঁটছে মান্নান দর্জি। কেন যেন কিছুতেই মনটা শান্ত হচ্ছেনা। কিছু একটা হারিয়ে ফেলার মত অনুভূতি হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাড়ীতে চলে এলো। ঘরে ঢুকতে চমকে উঠলো আছিয়াকে মেঝেতে নিথর পড়ে থাকতে দেখে। হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে। যেন কোন শক্তি নেই। দু'কদম এগিয়ে গিয়ে ধরবে সেই শক্তিটুকুও পাচ্ছেনা। কিছুটা শক্তি সঞ্চার করে বেশ জোরে ডাক দিলো, ' আছিয়া, এই আছিয়া উঠ্। তোর না বুক ব্যাথা? আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। আর হেলাফেলা করবোনা। বলেই দৌড়ে গিয়ে মাথার কাছে বসে মাথাটা কোলে তুলে নিলো।
চিৎকার শুনে পাশের বাড়ীর লোকজন চলে আসলো। একে অন্যকে বলাবলি করছে ' আহারে, কত কষ্টই না করলো জীবনে। এবার শান্তিতে থাকবে।
আস্তে আস্তে লোক জড়ো হচ্ছে। আছিয়ার ছেলেমেয়েরা সবাই চলে এসেছে। তাদের কান্নার আওয়াজে ভারী হয়ে আছে বাড়ীর আঙিনা। শুধু কাঁদছেনা মান্নান দর্জি আর তার ছেলে রবিন। অনুশোচনায় জ্বলেপুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। রাতের মাঝেই দাফন কার্য সমাধা করে সবাই যার‍যার বাড়ী চলে গেছে।
মধ্যরাত। মান্নান দর্জি ভিড়ানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো। বুকটা ধক করে উঠলো। এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো মৃত্যুপুরীতে চলে এসেছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে এক চিলতে আলো জ্বালানোর মানুষটাও নেই। আলো জ্বালাতে গিয়েও আবার না জ্বালিয়েই বসে পড়লো খাটে। হাহাকার করছে বুকটা। আছিয়া আঁধার ঘরে শুয়ে আছে একা। মান্নান দর্জিও ঘর আঁধার করে শুয়ে পড়লো। বিছানা হাতড়ে ওপাশটা শূণ্যতা ছাড়া কিছুই পেলোনা। এত মানুষ চারপাশে, এত সন্তানাদি কেউই নেই পাশে।
ছটফট করে উঠে পড়লো বিছানা ছেড়ে। উযু করে জায়নামাজে গিয়ে দাঁড়ালো। দু'রাকাআত নামায পড়ে মুনাজাতে হাত উঠিয়ে ডুকরে কেঁদে ফেললো। ' আরেকটা সুযোগ কেন দাওনি আল্লাহ? তাকে দেওয়া সারাজীবনের যন্ত্রণা এখন আমি প্রতিটি লমহায় লমহায় ভুগ করছি। বড্ড ভারী লাগছে এই যন্ত্রণা। আমার বদ্ধঘরে ছটফটানো বুকে শীতল হাতের পরশ দেওয়ার জন্য হলেও তাকে প্রয়োজন। আর একটাবারের জন্য দিয়ে দাও তাকে। অভিযোগ করার কোন পথ রাখবোনা। এই কয়েকঘন্টায় বুঝে গেছি জীবনসঙ্গিনী কাকে বলে! কতটা প্রয়োজন সে আমার জন্য। স্ত্রীকে কেউ কখনো কষ্ট দিতোনা যদি সে বুঝতো জীবনে চলার পথে একটা কোমল হাত কতটা অনুপ্রেরণা দেয়।



Writer:- সাদিয়া আফরিন
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner