Leave a message
> সে ফিরে এসেছে
-->

সে ফিরে এসেছে

 


ভয়ে আরো একজন হুজুর পালিয়ে গেলেন।

ছোটবেলায় আমাকে আরবি পড়াতে যত জন হুজুর আসতেন তারা সবাই-ই কোনো না কোনো অজুহাত দেখিয়ে চলে যেতেন। মোট কথায় পালিয়ে যেতেন। 

আমার দাদু বলতেন তারা নাকি ভয় পেতেন আমাকে দেখে। কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না তারা কি দেখে ভয় পেতেন।আমি ত অন্য সকলের মতই স্বাভাবিক ছিলাম। তাহলে ভয় কেন পেতেন? কই আমার স্কুলের শিক্ষকগণ ত আমাকে দেখে ভয় পেতেন না?

আমাদের বাড়ি ছিল একেবারে খাঁটি মুসলিম বাড়ি। পাঁচ ওয়াক্ত সকলেই নামাজ আদায় করতেন। বাড়ির পুরুষেরা মসজিদে যেতেন নামাজ আদায়ের জন্য। আমিও বাবা বা দাদুর সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরতাম। আমার দাদু ছিলেন একজন পরহেজগার মানুষ তিনি চেয়েছিলেন আমাকে মাদ্রাসায় পড়াতে কিন্তু আব্বুর ইচ্ছার কাছে হার মেনে আমাকে সাধারণ স্কুলেই ভর্তি হতে হলো।

তখন আমার বয়স ছয় কি সাত বছর। সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছি শিশু শ্রেণীতে। আমার একই সাথে আরেকজন ও ভর্তি হয়েছিল আমাদের ক্লাসে। 

নন্দিনী নাম ছিল তার। আমার প্রথম বন্ধুত্ব হয়েছিল সেই মেয়েটার সাথে। বড় বড় চোখ, গোল গাল, চ্যাপা নাক আর ধবধবে গায়ের রঙ ছিল তার। হিন্দু বাড়ির মেয়ে ছিল।প্রতিদিন মাথার কোকড়ানো ঘন চুলগুলোতে দুই ঝুটি করে স্কুলে আসতো।

আমরা আমাদের টিফিন ভাগাভাগি করা থেকে শুরু করে নিজেদের প্রিয় কার্টুন নিয়েও ক্লাসে আলোচনা করতাম সেই সাথে কল্পনার রঙিন দুনিয়ায় হারিয়ে যেতাম।

তখন অবশ্য হিন্দু মুসলিম কি তা বুঝতাম না। ভাবতাম আমাদের মত বুঝি সকলেই নামাজ পড়ে।

আর তাই বাড়িতে গিয়ে প্রায় নন্দিনীকে নিয়ে কথা বলতাম।

আমার দাদু অবশ্য বিষয়টা পছন্দ করতেন না। তিনি প্রচুর পরিমাণে ধর্ম বিদ্বেষ মানুষ ছিলেন। অন্য ধর্মের মানুষদের অন্য চোখে দেখতেন। তাই একদিন তিনি আমাকে একরকম ধমক দিয়েই বললেন নিজের ধর্মের বন্ধু বানাতে।

দাদুর ভয়ে অবশ্য এরপর আর নন্দিনীর নাম বাড়িতে উচ্চারণ করিনি। কিন্তু নন্দিনীর সাথে আমার বন্ধুত্ব টা আরো গাড়ো হলো।

দুর্গাপূজার কিছুদিন আগের কথা।

নন্দিনী আমাকে তাদের পূজার কথা বললো। আর আমারো কেমন যেন লোভ হলো পূজা দেখতে যাওয়ার।কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকায় কিভাবে যাব তা বুঝতে পারিনি।

স্কুল বন্ধ থাকলে প্রতিদিন বিকেলে আমরা স্কুলের মাঠে খেলতে যেতাম তাই আমরা ঠিক করলাম স্কুল মাঠ থেকে আমরা পূজা মণ্ডপে যাব।

দশমী ছিল সেদিন।

টকটকে লাল রঙের জামা পড়ে কোঁকড়ানো চুলগুলো খুলে রেখে নন্দিনী মাঠে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।

বাড়িতে খেলার কথা বলে নন্দিনীর সাথে পূজা মন্ডপে চলে গেলাম আমি।

দেবীর বিদায়ের সময় ছিল সেদিন। সকলেই দেবী বিসর্জনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। 

নন্দিনী র সাথে আমি তাদের পূজামণ্ডপে গেলাম। সকলে দেবীকে নিয়ে ঘাটে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। 

নন্দিনীর মা নন্দিনীকে ঘাটে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু দেবীকে কিভাবে বিসর্জন দেওয়া হয় তা দেখার জন্য আমার শিশুমন বারবার উতালা হয়ে উঠছিল।আমার উতালা দেখে নন্দিনীও ঠিক করলো যে তার মাকে না জানিয়ে সেও নদীর ঘাটে যাবে।

ঘাটে তখন প্রচুর ভীড়। 

দেবীকে নৌকায় তোলা হচ্ছে। আর এটা দেখার জন্য সকলেই মুখিয়ে আছে।

আমি অবাক হয়ে দেখলাম অনেক পুরুষ মহিলা কাঁদিয়ে বুক ভাসাচ্ছে। এর কারণ আমি তখন বুঝতে পারিনি।

সকল ভীড় ঠেলে আমি আর নন্দিনী নৌকার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বেশ বড সড একটা নৌকা ছিল। দেবীকে উঠানোর পর অনেকেই সেই নৌকায় উঠতে লাগলো।চারপাশ থেকে আরো কয়েকটি নৌকা এলো। এবার বাকি মানুষগুলো সেই নৌকায় উঠতে লাগলো। অনেকের দেখাদেখি আমিও এক নৌকায় উঠে পড়লাম। নন্দিনী আমাকে মানা করলো কিন্তু আমার জোড়াজুড়ি দেখে সেও নৌকায় উঠে পড়লো।

দূর্গা ভাসানোর পর সকলের সাথে আমি আর নন্দিনী ও ফিরে আসলাম এ পাড়ে।

আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হলো। মুহূর্তেই তা ভারী বর্ষণে রূপ নিলো।

সকলে দৌড়ে যার যার ঠিকানায় চলে যাচ্ছে।

আমি আর নন্দিনী একটা বড় গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছিলাম।

প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে তখন।বৃষ্টি অনেকটাই কমে গেছে।

ঘাটে কোনো লোকজন নেই। শুধু আমি আর নন্দিনী। 

হঠাৎ দূরে নদীর দিকে তাকিয়ে নন্দিনী বললো যে সে নদীর মাঝে দুর্গার প্রতিমা ভেসে উঠতে দেখেছে। ভালো করে তাকিয়ে আমিও কিছু একটা ভাসতে দেখলাম।

ভাসন্ত প্রতিমা দেখার লোভ সামলাতে না পেরে নন্দিনী বাইনা ধরলো যে সে নদীর মাঝে যাবে।

ঘাটে তখন শুধু একটা নৌকা ই ছিল।কিন্তু কোনো মাঝি ছিল না।

আমার আর নন্দিনী র কাছে  নৌকাটা চালানো খুব সহজ মনে হলো কারণ এটা অনেক ছোট একটা নৌকা ছিল। 

প্রায় বিশ মিনিট পর আমরা মাঝ নদীতে পৌছালাম।আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হালকা বৃষ্টি পড়ছে। দূর দূরান্তে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।এ যেন এক অতিপ্রাকৃত দৃশ্য।  যা আমাদের দুজনকে টানছে।

পুরো নদীতে শুধু আমরা দুজন আর প্রতিমা।

আমাদের নৌকাটা প্রতিমার সাথে ধাক্কা খেলো।

নন্দিনী দুর্গার মুখটা ভালো করে দেখার জন্য নৌকার যে পাশটা প্রতিমার সাথে লেগেছে সে পাশটায় গিয়ে দাঁড়ালো। 

হঠাৎ আমার মনে হলো যে পাশটা প্রতিমার গায়ের সাথে লাগানো সে পাশটা কেমন দূলে উঠেছে। আমি ভয়ে নন্দিনীকে ডাক দিয়ে যেই ওর চেহারার দিকে তাকালাম অমনি আমার বুকটা ধক করে উঠলো। 

নন্দিনীকে দেখতে কেমন অশরীরী লাগছে। হালকা বৃষ্টিতে তার লাল কামিজটা গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।মাথার কোঁকড়াচুলোগুলো সব বাতাসে উড়ছে। আর নন্দিনীর মুখে এক অশরীরী হাসি লেগে আছে। যা দেখলে যে কারোই বুকে ছুড়ির মত এসে বিঁধবে। নন্দিনীকে অসম্ভব সুন্দর লাগতে লাগলো।যেন এই সৌন্দর্য এই জগতের মানুষের ভোগ করার জন্য নয়। যেন অন্যকোনো জগৎ থেকে উড়ে এসেছে এই সৌন্দর্য। 

আমার ভয় হতে লাগলো নন্দিনীকে দেখে।

এবার আমি অবাক হয়ে দেখলাম নন্দিনী তার দুই হাত দুই দিকে তুলে ধরেছে। তারপর চোখদুটো বন্ধ করে এক ঝাপে নদীতে পড়ে গেলো।

আমি শুধু দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলাম। দূর্গা আর নন্দিনী একইসাথে ডুবে যাচ্ছে ধীরেধীরে। 

এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। সকালে যখন আমি চোখ খুলি তখন চোখের সামনে অনেকগুলো অপরিচিত মুখ দেখতে পেলাম। 

পরে জানতে পেরেছি জেলেরা সকালে আমাকে নদীর কিনারায় খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু আমি ত নৌকায় ছিলাম তাহলে ভেসেয় বা এলেম কি করে? আর নন্দিনীই বা কোথায় গেল?

আমার দাদু আর বাবা খবর পেয়ে আমাকে সেখান থেকে নিয়ে গেলেন।

।পুরো রাত তারা আমাকে খোজাখুজি করেছেন। পরে সেখানে আমার বাবার একজন বন্ধু আমাকে চিনতে পেরে তাদেরকে খবর দেন।আর তারা আমাকে ঘরে নিয়ে যান।

নন্দিনীর কোনো খবর পাওয়া যায় নি। 

এরজন্য পুলিশ কেইস ও হয়েছিল।

আমার নাম বা আমাদের বাড়ির নাম এই কেইসে জুড়ে যেতে পারে বলে রাতারাতি আমরা গ্রাম বদলে শহরে চলে আসি।

এর ঠিক এক বছর পর...

দুর্গাপূজার ১ম দিন,

আমি অনুভব করতে থাকি আমার চারপাশে কেউ আছে। আর সেদিন রাতেই আমি প্রথমবারের মত আয়নাতে আমার প্রতিবিম্বের পেছনে নন্দিনীর প্রতিবিম্ব দেখি। সেই অতিপ্রাকৃত হাসি।কিন্তু সেটা দেখে আমি একটুও ভয় পাই নি। আমি বোধহয় জানতাম সে আসবে।নন্দিনী আমার সাথে দশমী পর্যন্ত ছিল। আর দুর্গা বিসর্জনের দিন যে সে চলে গিয়েছিল সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।

আর এই দশ দিনে আমার প্রথম হুজুর কিছু দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে যান।

আমার ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি দুর্গাপূজাতে নন্দিনী আসতো।আর বিসর্জনের দিন চলে যেত। এটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল নন্দিনীর জন্য অপেক্ষা করা।

এরপর অবশ্য আমি নন্দিনী কে অনুভব করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।তাই বোধহয় সে আর আসেনি কিংবা আসতে চায়নি।

এত বছরে আমি বড় হয়ে গেলেও নন্দিনী সেই ছয় বছরের ছিল।

নন্দিনীকে দেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার তিন বছর পর...

আজ সোমবার,

দাদু আরো এক সপ্তাহ আগে মারা গেছেন। তাই বাড়িতে মিলাদ পড়ানো হচ্ছে।এই কয়েক বছরে আমি নন্দিনীর কথা ভূলে গিয়েছি। কারণ মনে করার কোনো কারণ ছিল না। না আমি তাকে অনুভব করতাম না দুর্গাপূজার সময় কেউ আমাকে দেখে ভয় পেতো।

কিন্তু আজ এত বছর পর পুনরায় আরো একজন হুজুর আমার থেকে একপ্রকার পালিয়ে বাঁচলেন। কিন্তু আমি ত নন্দিনী কে অনুভব করিনি। তাহলে কি দেখে ভয় পেলেন?

আজ ভার্সিটির প্রথম দিন আমার।

ক্যাম্পাসে এসেই সোজা ক্লাসে ঢুকছিলাম। 

এমন সময় আমার চোখ দূরে একটা মেয়ের উপর গিয়ে পড়লো। মেয়েটা অসম্ভব সুন্দরী। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো ঘন চুল। ধবধবে সাদা গায়ের রঙ।

কোনো এক অজানা আকর্ষণে আমি মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলাম। মেয়েটাও এক পা এক পা করে আমার দিকে এগিয়ে এলো।

মেয়েটার মুখে এক অতিপ্রাকৃত হাসি লেগে আছে। মেয়েটার সৌন্দর্য দেখে আমার গা দিয়ে কেমন যেন শিরশির ঘাম বয়ে যাচ্ছে। এক পারলৌকিক সৌন্দর্যের অধিকারি এই মেয়েটাকে দেখে আমার ভয় হচ্ছে। যেন এর সৌন্দর্য এখনি আমার উপর ঝাপিয়ে পড়বে।

হঠাৎ মেয়েটা একটা মায়াবী হাসি দিয়ে নিজের হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে অতি শান্ত কিন্তু গভীর নিরিবিলি একটা আওয়াজে বললো

- আমি নন্দিনী...  আর তুমি?

( সমাপ্ত )




Writer: Ashraf Tanvir

 

Delivered by FeedBurner

a