> হ্যালো ফ্রাইডে
-->

হ্যালো ফ্রাইডে


রাত দুটোর সময় ফ্রিজে খাবার খুঁজতে গিয়ে শুনি ভাইয়া-ভাবীর রুম থেকে ভাবীর ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। আড়ি পাতার প্রয়োজন পড়লো না, ডাইনিংরুম থেকেই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে সবকিছু। ফ্রিজ থেকে কেক বের করতে করতে সেদিকে মনোযোগ দিলাম। ভাবী বলছে ভাইয়াকে;

- সারাদিন বাসায় কত কাজ থাকে জানো? তোমার বোন তো নামমাত্র হেল্প করেই অনলাইন ক্লাসের অজুহাত দেখায়৷ আসলে যে তার কিসের এত ব্যস্ততা, তা আমি কিছু বুঝি না মনে করেছো? সব বুঝি, সব দেখি। তবুও কিছু বলি না। 

প্রতিউত্তরে ভাইয়া শীতল গলায় ভাবীকে থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে;

- আহ্, রাত বিরাতে এসব কি শুরু করলে শিউলি? থামো না এবার। ঘুমোতে দাও একটু। 

- হ্যাঁ, সে'ই তো। শুরু তো সব আমিই করি, শেষটা আবার তোমাদের ইচ্ছেতেই হয়। এদিকে বুয়াটাও তিনদিনের ছুটি নিয়েছে ছেলের অসুস্থতার জন্য। শেষবারের মত বলে দিচ্ছি, কাল শুক্রবার আছে। তুমি বাসায় থেকে তোমার বোনকে দিয়ে ঘরের সব কাজ করিয়ে নিবে। কাল আমি সারাদিন রেস্ট নিব। কথাটা যেন মনে থাকে। 

তারপর ঠুস করে ভাইয়া-ভাবীর রুমের লাইট অফ হয়ে গেলে আমি কেকের উপর মনোযোগ দিলাম এবার। হার্টশেপ রেড ভেলভেট কেক, ভাবীর খুব পছন্দের। আজ সন্ধ্যায় ভাইয়া অফিস থেকে ফেরার সময় নিয়ে এসেছে৷ হয়তো ভাবীরই ফরমায়েশ ছিল। সবাই খাওয়ার পর বাকি কেকটা ভাবী ফ্রিজে যত্ন করে রেখে দিয়েছিলো কাল আবার আয়েশ করে খাবে বলে। কিন্তু আমার এখনের ক্ষিদেটা না মেটালে রাতে আর ঘুমই আসবে না৷ ফ্রিজে চকলেট ছাড়া আর কিছু দেখতেও পাচ্ছি না৷ জানি, এ কেক নিয়ে সকাল সকালই তুমুল অশান্তি শুরু হয়ে যাবে বাসায়। তা হোক গিয়ে। ঠিকঠাক ঘুম হলে এ ধরনের অশান্তি সামলে উঠতে আমার তেমন বেগ পেতে হয় না। 

সকাল সাড়ে নয়টা৷ ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার খোলার উচ্চশব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। নয়তো আরো এক দু'ঘন্টা কোনোরকম হিসেব ছাড়াই ঘুমিয়ে কাটাতে পারতাম। ধীর পায়ে বিছানা ছেড়ে নেমে পাঞ্চক্লিপ দিয়ে চুল বাঁধতে বাঁধতে পাশের রুমে উঁকি দিয়ে দেখি, ভাবী চোখমুখ কঠিন করে রেখে হাতে লোশন মাখছে আর ভাইয়া বেচারা তার থেকে এক হাত দূরত্বে বসে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে দেখছে সে দৃশ্য। নিজের উপস্থিতি জানান দেয়ার উদ্দেশ্যে মুখ খুলে বড় করে একবার হাই তুললাম। ভাইয়া ভাবী দুজন একসাথে আমার দিকে তাকালো। ভাইয়া কিছু বলার আগেই আমি জিজ্ঞেস করলাম,

- তোমাদের চা খাওয়া কি হয়ে গেছে? আমাকে ডাকলে না যে?

ভাবী এগিয়ে এলো আমার দিকে। 

- না গো হয়নি এখনো। যাও না, চায়ের পানিটা বসিয়ে দিয়ে নাস্তা বানানো শুরু করে দাও। কিচেনে তো সবকিছু রাখাই আছে। তুমি শুধু হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিবে। 

আড়মোড়া ভেঙে আমি বললাম,

- কি যে বলো না ভাবী! ঘুম থেকে উঠেই কিচেনে দৌঁড় দিলে স্কিনের বারোটা বেজে যাবে না? গত সপ্তাহেই কতগুলো স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট কিনেছি, দেখেছো তো তুমি। 

ভাবী নিজের ভেতরের রাগটুকু সামলে নিয়ে জানতে চাইলো,

- সেই প্রোডাক্টগুলোর মধ্যে কোনো সানস্ক্রিন ছিল না?

- ছিল তো কিন্তু বাসায় বসে থেকে শুধু শুধু এত দামী ক্রিম মেখে রাখার কোনো দরকার আছে বলো! যাই, ফ্রেশ হয়ে আসি। অনেক বেলা হয়ে যাচ্ছে৷ 

যাওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে ভাবীকে আবার বললাম,

- ভাবী, নাস্তায় ডিমভাজিতে লবণ একটু কম দিও৷ এত লবণ খেতে পারি না আমি। 

আমি ও'ঘর থেকে চলে আসার পর কি কি হয়েছে, তা আন্দাজ করে নিতে পারছি ভাইয়াকে এখন চা-নাস্তা বানাতে দেখে। ভাবীকে অবশ্য আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। হয়তো রুমের মধ্যে ঝিম মেরে বসে আছে। আমি পড়েছি বিপদে। কি করবো বুঝতে পারছি না। ভাবীর কাছে গেলে কিছু তেতো কথা শুনিয়ে দিবে আর ভাইয়ার কাছে গেলে সব কাজ নিজের করতে হবে। ছোট বোন ঘরে থাকতে বড় ভাইকে রান্নাঘর সামলাতে হচ্ছে, বিষয়টা যথেষ্ট দৃষ্টিকটু। কিন্তু একই কথা তো ভাবীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ঘরে সুস্থসবল বউ থাকতে বরকে রান্নাঘর সামলাতে হচ্ছে; এটা আরো বেশি দৃষ্টিকটু ব্যাপার। এরমধ্যে ভাইয়া ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে আমাদের। সাথে শব্দ শুনতে পারছি, ডাইনিং টেবিলে সকালের নাস্তার আয়োজন চলছে। ভাবী রুম থেকে বের হওয়ার আগে আমি বের হলাম। তারপর অবাক হওয়ার ভান ধরে গালে হাত রেখে বললাম,

- আরে কি করছো তুমি ভাইয়া? আমাকে দাও, আমি করছি। ভাবী কোথায়?

ভাইয়া হালকা ইতস্ততবোধ করে উত্তর দিল,

- তোর ভাবীর শরীর খারাপ লাগছে আজ। তাই আমিই...

- তাই বলে তুমি এসব করবে! আমাকে বললেই তো হত। 

এমন সময় ভাবীর আগমন ঘটলো। চিন্তিত মুখ নিয়ে ভাবীর দিকে তাকালাম আমি।

- কি হয়েছে তোমার ভাবী? শরীর কি বেশি খারাপ?

চেঁচিয়ে উঠলো ভাবী,

- শরীর খারাপ কে বললো? আমি ঠিক আছি। 

আমাদের আর কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে ভাইয়া তাড়া দিতে শুরু করে দিল নাস্তা করতে বসে যেতে। 

বাসার পরিস্থিতি ধীরেধীরে বেগতিক হতে শুরু করেছে। দুপুরের রান্নাসহ ঘরদোরের বাকি কাজগুলোতে এখন পর্যন্ত কারো হাত পড়ছে না। গতকাল রাতে ভাবীর ওই কথাগুলো না শুনতে পেলে ঠিকই আমি আজ ভাবীকে ছুটিতে রাখতাম। সকালে ভাবী যখন চায়ের পানি বসিয়ে দিতে বললো, অন্য সময় হলে ভাবীর কথামতো রান্নাঘরের পথ ধরতাম। কিন্তু রাতেই জেদ চেপে গিয়েছিলো৷ বাসায় থাকলে ভাবীকে কতভাবে সাহায্য করে দিই সব কাজে, অথচ কাল রাতে আমার নামে কিরকম ডাহা মিথ্যে অভিযোগ করে দিল ভাইয়ার কাছে! এর একটুখানি শোধ তো তুলতেই হবে। আমার যেমন ভাই, তারও তো তেমন স্বামী। নিজের ভাইকে বউয়ের মন খুশি করার জন্য এভাবে খাটতে দেখে আমার যেমন খারাপ লাগছে, তারও নিশ্চয়ই একইরকম অনুভূতি হচ্ছে। কিন্তু পার্থক্য শুধু একটাই। ভাবী ভাবছে, ভাইয়া এগুলো আমাকে বাঁচাতে করছে। 

ম্যাসেঞ্জার গ্রুপকলে ফ্রেন্ডদের সাথে কথা শেষ করে উঠে গিয়ে রুমের বাইরে নজর দিলাম একবার। ভাবী এখনো রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছে না, নিজের রুমেই জেদ ধরে বসে আছে। বসে বসে অনলাইনে মেকআপ প্রোডাক্টস দেখছে নিশ্চিত। কোন পেইজে ভালো জামদানী এসেছে, সে খবর রাখতেও ব্যস্ত থাকতে পারে। আরেকটু কান খাড়া করতেই রান্নাঘরে খুটুরমুটুর শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম আমার ভাইয়ের অবস্থান। বেচারা! মানুষটা বড্ড শান্তিপ্রিয় স্বভাবের। আমাকে কাজে হাত লাগাতে বললে আমি যে ভাবীকে ছেড়ে কথা বলবো না, তা ভাইয়া ভালো করেই জানে। সেজন্যই আমার হেল্প চাচ্ছে না বা কিছু করে দিতে বলছে না। কিন্তু বিয়ের আগে ভাইয়ার রান্নার হাত যথেষ্ট ভালো থাকলেও বিয়ের পর আর চর্চায় না থাকার কারণে নিশ্চয়ই আজ কিছু একটা গন্ডগোল করে ফেলবে সে। আমি অপেক্ষায় আছি সেই ধামাকা দেখার। এসব ভাবতে ভাবতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে সাবধানী ভঙ্গিতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। জরুরী কাজটা সেরে ফেলতে হবে এখনি।  

এতদিন পর ভাইয়ার হাতের রান্না খেয়ে যেন বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। স্বাদ বদলায়নি একটুও! কিন্তু তবুও মন ভালো হতে গিয়েও হল না। দুটো দিন মাত্র ছুটি পায়। আজকের দিনটায় রেস্ট না নিয়ে গাধার খাটুনি খাটতে হল মানুষটাকে। শত হলেও নিজের ভাই তো। কষ্ট তো লাগবেই। সহানুভূতিও কাজ করছে হালকা। ভাবীকে দেখলাম মনোযোগ দিয়ে গরুর হাড্ডি চিবুচ্ছে। খেতে খেতে হঠাৎ গতরাতের কেকের কথা মনে পড়ে গেলে চিন্তা করতে লাগলাম, এটা নিয়ে এখন অব্দি কোনো কাহিনী হয়নি কেন! হওয়ার তো কথা। নাকি হয়েছে? আমি হয়তো টের পাইনি। 

রবিবার সকালে ভাইয়া অফিসে চলে যাওয়ার পর...

ভাবী নিজের বেলকনি রেখে আমার বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়ে  গরম কফির মগে চুমুক দিচ্ছে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আমি। ভাবী চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো,

- ভিডিওটা কি করে করলে?

আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম,

- কেন, ঠিকঠাক হয়নি?

- খুব হয়েছে৷ তোমার ভাইয়া কিছু টের পায়নি তো?

- আরে না। এরকম কাঁচা কাজ করি না আমি কখনো। 

- হুম। টাকাটা পেয়েছো?

- হ্যাঁ কাল রাতেই তো এসে আমার টেবিলের উপর রেখে গেলে। কিন্তু এত টাকা একসাথে তুমি কোথায় পেলে ভাবী? আগে থেকেই ছিল তোমার কাছে?

- ধুর, আগে থেকে থাকলে তো তোমাকে এডভান্সই দিয়ে রাখতাম।

- তাহলে?

ভাবী সুখকর একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো;

- ব্ল্যাকমেইল, বুঝলে? 

ভ্রু কুঁচকে গেল আমার।

- মানে?

- তোমাকে দিয়ে তোমার ভাইয়ার রান্নার ভিডিওটা করিয়েছি আমাদের কাজিনদের চ্যাটগ্রুপে দেয়ার জন্য। কাজিনরা সবাই তাদের হাজবেন্ডদের রান্নার প্রশংসা করে সবসময়৷ কিন্তু আমি করলেই ওরা মজা নেয়া শুরু করে দেয়। বলে, তোমার ভাইয়া রান্না করতে পারে এটা নাকি তাদের বিশ্বাস হয় না। তাই তো এত নাটক তামাশা করে এই ভিডিওটা তোমাকে দিয়ে করালাম।

- ঠিক আছে। কিন্তু এখানে ব্ল্যাকমেইলের কি আছে বুঝলাম না?

- উঁহু, এই ভিডিও দিয়েই আবার তোমার ভাইয়াকে ব্ল্যাকমেইল করেছি। হুমকি দিয়েছি, পাঁচ হাজার টাকা না দিলে পুরো ভিডিওটা চলে যাবে গার্লস গ্রুপগুলোতে। যেখানে তার কলিগদের বউসহ পরিচিত আরো অনেকে আছে। বন্ধুমহলে তার ইমেজ নষ্ট হোক, এটা সে কখনোই চাইবে না। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ফেললাম।

চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলাম,

- ভাইয়া জানতে চায়নি ভিডিওটা কে করেছে?

- জিজ্ঞেস করার সুযোগ দিইনি।যাই হোক, তুমি তোমার ফ্রেন্ডদের সাথে ডে'ট্যুরের সব খরচ পেয়ে গেছো আর আমিও আমার জিনিস পেয়ে গেছি। দুজনেরই প্রয়োজন মিটে গেছে। সুতরাং আমরা আবার আগের ফর্মে ব্যাক করবো। 

- অবশ্যই। তা আর বলতে। তাছাড়া আমি কিছু শুনিনি মনে করেছো? আমার নামে মিথ্যে নালিশ দেয়া হচ্ছিলো ভাইয়াকে! আমি নাকি তোমাকে কাজে হেল্প করি না। অবশ্য একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। নয়তো নাটকের ব্যাপারটা ভুলেই বসেছিলাম। তোমার নালিশ শুনেই না মনে পড়লো। 

ভাবী এবার ঠোঁট উল্টে ফেললো,

- করোই তো না। সব কাজ তো আমাকেই করতে হয়।

আমিও আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। কোমরে হাত রেখে একদফা ঝগড়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম,

- বুকে হাত দিয়ে বলো তো ভাবী...

পরদিন বিকেলবেলা...

ভাবী হন্তদন্ত হয়ে আমার রুমে ছুটে এলো।

- এই অর্পা, আমার কাজিনরা তো এখনো বিশ্বাস করছে না যে তোমার ভাই রান্না করতে জানে। 

আমি মোবাইলের স্ক্রিনেই চোখ রেখে বললাম,

- দেখো ভাবী, তুমি আমাকে সকালবেলা কফি দাও নি, চা দিয়েছো। সুতরাং খুব তাড়াতাড়ি আমার কাছ থেকে আর কোনো হেল্প আশা করো না। 

ভাবীর গলার স্বর ঝাঁঝালো হয়ে গেল;

- তুমিও তো কাল রাতে আমার সাথে টিকটক করতে রাজি হওনি। তাই তো সকালে আমিও কফি দিই নি তোমাকে। 

পরক্ষণেই আবার নিচু স্বরে বলতে লাগলো ভাবী,

- আচ্ছা ঠিক আছে, ভুল হয়ে গেছে। আর এমন করবো না। প্লিজ উপায় বলো অর্পা।

আমি মনে মনে মুচকি হেসে শুধু বললাম,

- নেক্সট ফ্রাইডে'তে তোমার কাজিনদের ইনভাইট করো বাসায়। বাবুর্চিকে স্বচক্ষে দেখার সুযোগ করে দাও তাদের। 

কথাটা বুঝতে ভাবীর হয়তো খানিকটা সময় লাগলো। কিন্তু বুঝার পর ঠোঁট জুড়ে প্রশস্ত হাসি এনে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,

- তার মানে আবারও নাটক জমাতে হবে!



( সমাপ্ত )





Writer: Nusrat Khan Ani

NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner