Relationship |
অফিস থেকে ফেরার পথে অয়নের হাতে এক থোকা গোলাপ দেখে বেশ অবাক হলাম। আমি অয়নের দ্বিতীয় স্ত্রী। বিয়ের পাঁচ মাস চলছে। কবুল বলার পর থেকে আজ পযর্ন্ত দুজন একসঙ্গে বসে খাবারও খাই নি। অয়ন আর তৃণা আপুর ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়ে আছে, তাঁর নাম তিতলি। ঘরের বাইরে আমি তিতলিকে আমার মেয়ে হিসেবেই পরিচয় দেই। আর সে সারাক্ষণ মা মা করে সারা ঘর মাতিয়ে রাখে।
ফুলগুলো টবে রাখতেই জিজ্ঞেস করলাম "আজ হঠাৎ ফুল আনলে"?
সে জবাব না দিয়েই বলছে, "তিতলি ঘুমিয়েছে"?
_ হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
_ আচ্ছা!
ফ্রেশ হয়ে ডিনার শেষে বারান্দায় বসে সিগারেট ধরাতে দেখে বেশ অবাক হলাম। তৃণা আপু মারা যাওয়ার পর সে কখনো সিগারেট খায় নি। তাহলে আজ কি তাঁর তৃণা আপুর কথা খুব বেশি মনে পড়ছে!
_অয়ন! তোমার কি মন খারাপ?
_ নাহ! তুমি খেয়েছো?
_ তুমি তো অপেক্ষা করা পছন্দ করো না তাই আর বাড়াবাড়ি করিনি।
_ অপেক্ষা করলেই কি সবাই থেকে যেতে পারে? আচ্ছা বাদ দাও! তিতলি কিছু বলেছে তোমায়?
_ কি ব্যাপারে?
_কাল আমরা ঘুরতে যাচ্ছি।
_ কিন্তুু তোমার অফিস?
_ ছুটি নিয়েছি।
খুবই ভালো লাগছে এভাবে বাইরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়ে। কাল কি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। বিয়ের পর এই প্রথম অয়নের সাথে বাইরে বের হবো ভাবতেই ভালো লাগছে।বাবা, মেয়ে না জানিয়ে কতো কিছুর আয়োজন করলো কিন্তুু ফুলের ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। অনেক রাত হয়েছে অয়ন বোধহয় বারান্দায় বসে আছে কাল নয়তো জিজ্ঞেস করে নিবো।
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই দেখছি টকটকা লাল রঙা একটা শাড়ি আলমারির একদম সামনে রাখা। আলমারি খুলেই প্রথম শাড়িটা চোখে পড়বে। পেছন থেকে অয়ন এসে বলছে," পরে নাও"!
_ কোথা থেকে আনলে? শাড়িটা কিন্তুু বেশ সুন্দর!
_ তৃণার শাড়ি! "পরে নাও"!
এই রকম চাপা স্বভাবের মানুষ নিয়ে আমি সংসার করি ভাবলেই অনেক রাগ হয়।
তিতলিকে তৈরি করে নিজেও তৈরি হয়ে নিলাম। ড্রাইভারকে ডাকতেই ড্রাইভার গাড়ি বের করলো।
গাড়িতে উঠেই আমি প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত।হঠাৎ খোপায় টান লাগতেই পাশে ফিরে দেখি বাবা মেয়ে আমার খোপায় লাল গোলাপ গুঁজতে চেষ্টা করছে।
অয়নকে হাসতে দেখে ভালো লাগছিল। দুজন বেশ মজা পাচ্ছিলো।
গাড়ি থেকে সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে।
অয়নকে একটা বার জিজ্ঞেস ও করলাম না আমরা কোথায় যাচ্ছি!
গাড়ি থেকে নেমেই তিতলির পেছন পেছন ছুটছি। বালিতে হাঁটা যায় না কিন্তুু তিতলি দৌড়ে সামনে চলে যাচ্ছে। অয়ন এসে তিতলিকে কোলে তুলে নিতেই সে বলছে" বাবা সমুদ্দ। আমি পানিতে নামবো"।
এদিকে সে মেয়েকে বুঝিয়ে বালিতে খেলতে ছেড়ে দিয়েছে। তিতলি বালিতে পা ছড়িয়ে বসে ঘর বানাচ্ছে। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তাঁর ঘরের উপর তারপর ঘর মিশে যাচ্ছে বালিতে।
অয়ন খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে আর আমাকে বলছে, "মিরা, আমাদের জীবনও এমন তাই না?"
প্রসঙ্গ পাল্টে জিগ্গাস করছি," তোমার কি তৃণা আপুর কথা মনে পড়ছে?" মুহুর্তেই চেহারা মলিন হয়ে আসে।
আমাকে বলতে থাকে, তুমি কি আজ আমার সব কথা শুনবে?
শোনার পরও কি আমার পাশে থাকবে?
_ কি হয়েছে বলো।এই যে আমি তোমার সামনে বসে আছি সব শোনতে চাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে।
তৃণাকে সব না জানিয়ে তাঁকে বিয়ে করা উচিত হয় নি আমার। তোমার বেলায় এমনটা সারাজীবন বয়ে বাঁচো তা আমি চাই না।
যাকে ভালোবাসতাম তাঁকে হারানোর পর খুব ভেঙে পড়েছিলাম। মামা, মামি সবটা জেনেও আমার সাথে জোর পূর্বক বিয়ে দেয় তৃণার। আমি তৃণার সাথে কোন কথা বলতাম না। তাঁর দিকে তাকাতামও না। কিন্তুু পরিস্থিতি খুবই নিরুপায়। মানুষের সামনে সুখি সংসার গড়ার নাটক করতে করতে মায়ায় আটকা পড়ি। তারপর অতীতেরা শুধু রাতে আসতো, তৃণা ঘুমিয়ে পড়লে তারপর।
মন থেকে কেন যেন তাঁকে মেনে নিতেই পারতাম না কিন্তুু একসঙ্গে থাকতে হতো।সুখি স্বামী স্ত্রীর নাটক করতে হতো। তৃণাকে প্রায় ইঙ্গিতে বোঝাতাম আমার অতীতের কথা যাতে সে আমায় ছেড়ে চলে যায়। অন্য কারো কাছে গিয়ে সুখি হয়। কিন্তুু ধীরে ধীরে জানতে পারি তিতলি আসছে আমাদের সংসারে।
ততদিনে আমি তৃণাকে মনে মনে মেনেও নিয়েছি। কিন্তুু সে সবটা মেনে নিতে পারেনি। আমার অতীত বলে বলে তাঁকে এক প্রকার অত্যাচার করতে থাকি। সব ছেড়ে দিয়ে আমরা সুস্হ নবজাতককে পৃথিবীতে আনার কথা ভাবি। সব সময় পাশে থাকতাম কিন্তুু তিতলিকে দুনিয়াতে আনতে যে তাঁকে হারাতে হবে তা আমি কখনো দুঃস্বপ্নেও ভাবি নি।
_অয়ন," আজ থাক"। আমরা ঘুরতে এসেছি।মেয়েটাকে সময় দেওয়া উচিৎ।
_তোমায় কি বিরক্ত করছি, মিরা?
_না তা বলছি না। অয়ন আমার শরীর খারাপ করছে তুমি ড্রাইভারকে তাড়াতাড়ি ডাকো প্লিজ।
তাড়াহুড়োয় বাসায় পৌঁছেই মিরা ঘুমিয়ে পড়লো। দুপুরের খাওয়া বাইরেই হয়েছে। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো মিরার কোন সাড়াশব্দ নেই।
অয়ন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না তাঁর জন্য মিরার কিছু হলে। তাঁর জন্যেই তো এমনটা হয়েছে ঘুরতে গিয়ে কি কেউ অতীত নিয়ে আলোচনা করে! না কাজটা মোটেও ঠিক হয় নি।
এদিকে মিরা ঘুমের মধ্যে চেঁচিয়ে উঠছে, "আমি সমুদ্রে যাবো না। তুমি কথা রাখো নি। তুমি আমায় আবার ফেলে দিবে!"
অয়ন ঘুমের ঘোর কাটাতে চোখে পানি ছিটকে দিতেই মিরা চিৎকার করে উঠে।
_কি হয়েছে মিরা?
_ এই সমুদ্র আমার খুব চেনা। কেন মনে হচ্ছে সে আবার আমার হাত ধরে মাঝ সমুদ্র আমায় ফেলে আসবে।
_ কিসব বলছো কে ফেলে দিবে।
মিরার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আর সে বলছে "আমি সমুদ্রে যাবো না। সে কথা রাখেনি।আমায় ফেলে দিবে!
সবটা জানি বলে মিরাকে আর প্রেসার দেই নি। তাছাড়া ডাক্তার বাবুও বলেছিলেন তাঁকে যেন মানসিক চাপ মুক্ত রাখি। রাতে খেতে বসে মিরা প্লেট থাকা ভাত নাড়াচাড়া করছে।কিছুটা সুস্হ এখন সে। আচমকা জিজ্ঞেস করে উঠলো, তুমি সমুদ্র পছন্দ করো তাই না?
সমুদ্রের প্রসঙ্গ ভুলানোর চেষ্টা করছি কিন্তু সে বারবার সমুদ্র নিয়েই কথা তুলছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, পছন্দ করতাম!
_ এখন পছন্দ করো না?
মিরা খেয়ে নাও তোমার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।
আচ্ছা অয়ন তুমি কি একটা ব্যাপার খেয়াল করেছো?
_ কি ব্যাপার?
_ বিয়ের ৫ মাস পর আজ আমরা একসঙ্গে বসে ডিনার করছি আর আজই আমরা সমুদ্রে গিয়েছি।
মিরা তুমি এতো সমুদ্র সমুদ্র করছো কেনো বলতো! তুমি কি সমুদ্র খুব বেশি পছন্দ করো?
_নাহ, আমি ভয় পাই। অয়ন বিশ্বাস করো সমুদ্র আমার খুব চেনা।কেনো যেন বারবার মনে হচ্ছে আমি এর আগেও সেখানটায় গিয়েছিলাম।খুব চেনা,,, বলতে বলতেই মিরা জিজ্ঞেস করো উঠলো, তুমি আমায় ঠিক কোথায় পেয়েছিলে অয়ন?
_ কিসব বলছো তুমি মিরা!
_ অয়ন আমি তোমার পুরনো ডায়েরিটার কিছু পাতা পড়েছিলাম। আমাদের হঠাৎ দেখা হয়েছিল।
_ আরেহ ধুর দেখা হওয়ার পরেই তো বিয়ে হয় তাই না! তুমি খামোখা কথা গোলাচ্ছো। উঠো তোমাকে ঔষধ খেয়ে ঘুমাতে হবে।
মিরা ঘুমিয়েছে দেখে অয়ন বারান্দায় গিয়ে সিগারেট হাতে ভাবছে, "মিরা কি করে তাঁর ডায়েরিটা পেলো। আর কিছু পাতা পড়লেই তো মিরা সবটা জেনে যেতো"। অয়ন একমুহুর্তও না ভেবে সমস্ত ডায়েরি পুড়িয়ে দিয়েছে। কারণ আবার যেকোন দিন এই ডায়েরি পেলে মিরা নিজেই কষ্ট পাবে।
ডায়েরিটা অয়নের চোখের সামনে পুঁড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে আর বারান্দার অন্ধকার কাটিয়ে আবছা আলোয় অয়নকে খানিকটা দেখা যাচ্ছে।
সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছে মিরা সমুদ্র নিয়ে কথা তুললে সে কি করে সামলাবে ব্যাপার টা। সে যে মিরাকে সমুদ্রের ধারেই পেয়েছিল!
সমুদ্রের কাছেই অফিসের কাজে এসেছিল অয়ন।মাঝ পথেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। সমুদ্রের খুব কাছ ঘেসেই অয়ন হাঁটছিল। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে পরিপাটি পোশাকে একজন কিশোরী বালিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে । বৃষ্টির পানি তাঁর গাল গড়িয়ে বালিতে মিশে যাচ্ছে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছে কিন্তুু কাছে যেতেই অয়ন থমকে যায়। সারা শরীর রক্তে মাখা, কাপড় ও বেশ খানিকটা ছেঁড়া।দেখেই বোঝা যাচ্ছে ধর্ষণ করা হয়েছে। অয়ন কিছুমাত্র বিলম্ব না করে তাঁকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। সাধারণত এইসব মামলার বিষয় বলেই ডাক্তাররা চিকিৎসা করার রিস্ক নেন না।
ডাক্তার জিজ্ঞেস করতেই অয়ন বলে চলছে,
নাম: মিরা।
বয়স: ১৯
ডাক্তার সাহেব রোগীর অবস্থা বেশি ভালো না যা করার তাড়াতাড়ি করুন।
_ আপনারা কি নিউলি মেরিড?
_ জ্বি,মেম।
কম বয়স্কা ডাক্তার খুবই গম্ভীর ভাব নিয়ে অয়নের দিকে তাকিয়ে থেকে লম্বা লিস্টের একখানা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেন। অপরিচিত এই মেয়েটাকে এখানে একা রেখে যাওয়া ঠিক হবে না তাও কিছু বখশিশ দিয়ে একজন নার্সকে বলে গেছে মিরার খেয়াল রাখতে।
অয়ন ঔষধ আনার ফাঁকে মিরার ব্যাপারে জানতে চেষ্টা করছে। তাঁকে যেখানে পেয়েছিল সেখানে ফিরে গিয়ে অয়ন জানতে পারলো মিরা তাঁর প্রেমিকের সঙ্গে ঘুরতে এসেছিল। কিন্তুু সেই অতি বিশ্বাস্য পুরুষ তাঁকে রক্ষা করতে তো পারলোই না এখন তাঁকে খুঁজছে মেরে ফেলার জন্যে।
অয়ন এক মুহুর্তও দেরি না করে মিরাকে নিয়ে বাসায় চলে এলো। এদিকে ডাক্তার জানিয়েছে মিরা স্মৃতি শক্তি হারিয়েছে। অয়ন সব দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে বাসা পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। লোক জানাজানি হওয়ার আগেই অয়ন মিরাকে বিয়ে করে নেয়।
এদিকে অয়নের আপনজন বলতে তাঁর পাশে আছে ছোট্ট তিতলি। অয়ন মিরাকে আশ্রয় দিয়েছিল, ব্যস্ততা দেখিয়ে তাঁর থেকে দুরে থাকতো কিন্তুু আজ যখন সব মিটমাট করে নতুন করে বাঁচতে চাওয়ার পথ খুঁজে নিচ্ছিলো ঠিক তখনই মিরা সব পরিকল্পনা নিমিষেই ছাঁই করে দিয়েছে। অয়নের সামনে জ্বলতে থাকা ডায়েরির মতো।
অয়ন এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোর হতেই অয়ন ফ্রেশ হয়ে মিরাকে তৈরি হয়ে নিতে বলে।
_ কোথায় যাবো আমরা?
_ নতুন শহরে,নতুন বাসায়।
_ কি বলছো আমরা এখানে থাকবো না কেনো? এতো সুন্দর পরিপাটি বাসা।
_ তোমাকে বলছি তৈরি হয়ে নিতে।
মিরা গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। অয়ন চুপচাপ পাশে বসে আছে আর মিটমিট হাসছে।
_কি হয়েছে অয়ন?
_ কিছু না। তোমায় খুব সুন্দর লাগছে!
_ সুন্দর লাগলে মানুষ হাসে?
_ খোলা চুল বাতাসে তোমার মুখে এসে পড়ছে আর তুমি বিরক্ত হচ্ছো কিন্তুু তোমার চাহনি যথেষ্ট শান্ত। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মা-মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। অয়ন ভাবছে, আমি মিরার অতীত হজম করে বাঁচবো। এখানে থেকে গেলে আশেপাশের মানুষ মিরাকে প্রশ্ন করতে পারে "সমুদ্রকে ভয় পাওয়ার কি আছে"!
আমি চাইনা আমার জীবন যেমন অর্ধেকটা সময় অতীত নিয়ে অন্ধকারে পড়েছিল মিরার বেলাতেও তাই হোক।
সে আমার কাছে পবিত্র এক সত্তা। আমার কাছে "ধর্ষিতা" শুধু মাত্র একটা শব্দ। নিজের ইচ্ছায় দেহ বিলিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকটা মানুষ পবিত্র, এক একটা সতেজ প্রাণ।
অয়নের ঘুম পাচ্ছে, গাড়ি চলছে নতুন গন্তব্যে। অয়ন মিরার হাত শক্ত করে ধরে বলছে "ভালোবাসি" "ভালোবাসি" আর মুহুর্তেই তাঁরা স্বপ্নাদেশে চলে যায়। গাড়ি চলছে নতুন গন্তব্যে।নতুন একটা সকালের অপেক্ষায় আছে কিছু পবিত্র সত্তা। তারপর ভোর হবে আর শুরু হবে নতুন জীবন।
( সমাপ্ত )
লেখা: সাদিয়া ইসলাম বৃষ্টি