> রক্ত পিপাসা পর্ব ১ - boipoka365 - Bangla new story - Golpo
-->

রক্ত পিপাসা পর্ব ১ - boipoka365 - Bangla new story - Golpo



রক্ত পিপাসা 


এলাকার পাড়া প্রতিবেশিরা প্রায় আমাকে বলতো, এই টুটুল, তোকে কিন্তু তোর মা কুড়িয়ে পেয়েছে! আমি বাড়ি ফিরে যখন আমার মাকে বলতাম, মা আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলতেন, বাবা, ওদের কথায় কান দিবিনা, ওরা তোর সাথে মজা করে। তুই তো আমারই সন্তান। বলে মা কাদঁতেন। আমিও পরম শান্তিতে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।
সেসব বেশ আগের কথা। স্কুল শেষ করে চলে আসি পাশের গ্রামে সরকারি কলেজে। গ্রামের পাশে হলেও আদতে তা আমার পাড়া থেকে বেশ দূরে। তাও কয়েক কিলোমিটার কাঁচা পথ তো হবেই, তাই সেখানে এক চাচার বাড়িতে উঠি, চাচা আমার বাবার আপন খালাতো ভাই, আমাকে অনেক ভালোবাসেন, আর মেট্রিকে অত্র এলাকার মধ্যে স্ট্যান্ড করায় তিনি যেন আমাকে আরো বেশি বেশি আদর করেন, যদিও আমার কেন জানি মনে হয় তিনি আমাকে তার মেয়ের সাথে ভবিষ্যতে বিয়ে দেবার পরিকল্পনা করছেন।
তনিমাকে যে আমার খুব পছন্দ ছিল তা নয়। কিন্তু এখানে আসার পর ওর ওকে আমার ভালো লাগতে থাকে। বেশ বড় হয়েছে ও, এবার মেট্রিক পরীক্ষা দেবে, আমার চাইতে এক দেড় বছরের ছোট। বাড়ন্ত শরীরে যৌবনের ছোয়া লাগতে আরম্ভ করেছে, সেটাকে চোখের পলকের আড়াল হতে দেয়াও যায়না, প্রকৃতির অদ্ভুত নিয়ম। সময় পেলেই আমি তনিমাকে অংক আর ইংরেজিটা দেখিয়ে দিতাম।
তনিমার সাথে দিনে দিনে খুব ভাব হতে থাকে। এদিকে আমিও সমানতালে নিজের পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে থাকি। হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সবে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছেন। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভাল ছিলনা তখন। যদিও আমাদের গ্রামাঞ্চলের দিকে ততটা প্রভাব পড়েনি।
ইন্টার প্রথম বর্ষের পরীক্ষার ফলাফলে আমি প্রথম স্থান অর্জন করি। সেদিন বন্ধুদের সাথে এই সেই আড্ডা দিতে গিয়ে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। আমি একা একা বাড়ি ফিরছিলাম। ভয় ডর যে ছিলনা তা নয়, ছিল বেশ কিছুটা। কিন্তু সেটাকে আমলে নিইনি।
আমার চাচার যে বাড়িতে বর্তমানে থাকা হয়, সেটা উনি নতুন করেছেন, ব্যবসায় ভালো রকমের উন্নতি স্বরুপ বলা চলে, আর পুরোনো বাড়িটা ঠিক একটু পেছনের দিকে বাঁশ ঝাড়ের পাশে। সেখানে কেউ থাকেনা।
নতুন বাড়িতে যেতে হলে এই পুরোনো বাড়ি পাশ কাটিয়েই যেতে হয়, রাতের বেলা এর আগেও এই জায়গা পার হয়েছি কিন্তু সেটা এত রাতে কখনো ছিলনা, মেট্রিকে স্ট্যান্ড করায় আমার এই চাচা আমাকে একটা নতুন দামী ক্যাসিও হাতঘড়ি কিনে দিয়েছেন যাতে আবার আলোও জ্বলে, ঘড়িটা খুব প্রিয় তাই এটার কথা জানানো প্রয়োজন মনে করলাম। আর ঘড়িতেই সময় দেখেছিলাম, তখন রাত সাড়ে তিনটে বাজে।
নাটকীয়তা জিনিসটা আমার ধাতে সয়না। কিন্তু আজ যা বলছি তা নাটকীয়তার ঊর্ধ্বে। আজ যা বলছি, তা আগে কখনোই বলিনি। আমার মৃত্যু খুব শীঘ্রই ঘনিয়ে আসছে। তাই হাতের কাছে একটা নোট পেয়েছি, সেখানেই যা বলার বলে যাচ্ছি, যদি কেউ কখনো এটা পায়, তবে তার কাছে আমার অনুরোধ সে যেন এটা পড়ে কাগজটাকে পুড়িয়ে দেয়। যদি তা না করে, তবে এর পরিণাম ঠিক কি হতে পারে, তা আমারও জানা নেই।
-
পুরোনো বাড়িটা পার হচ্ছিলাম, মনে হলো বাঁশ ঝাড়ের মধ্য দিয়ে কিছু একটা দূর্দান্ত গতিতে ছুটে গেল। চিকা জাতীয় কিছু ভেবে মনকে শান্তনা দিলাম কিন্তু হঠাৎ করে বাঁশির মোহনীয় সুর বেজে উঠলে আমার সকল মনোযোগ সেদিকে ধাবিত হলো, ভয় পাবো কি, মনে হলো, এই বাঁশির সুর যেন আমার কতকালের চেনা, আমি ধীর লয়ে বাঁশ ঝাড়ের দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। যে বাঁশ ঝাড়ে দিনের বেলা যেতেও মানুষ ভয় পায়, আমি সেদিকে তরতর করে হেঁটে যাচ্ছি, আমার যেন কোনো ভাবান্তর নেই।
একটা বাঁশের কুঞ্চি আমার মাথায় আঘাত করলে আমার সংবিৎ ফিরে আসে, নিজেকে আবিষ্কার করি বাঁশ ঝাড়ের গভীরতম কোথাও, যেখান থেকে দিনের বেলাতেও ফিরে আসা কঠিন। পকেটে একটা ছোট্ট টর্চ লাইট ছিল, ফিরে আসার সময় বোরহান আমাকে দিয়ে বলেছিল, একা একা যাবি, এটা নিয়ে যা, কাল দিয়ে দিস।
প্রচন্ড ভয়ে যখন জ্ঞান হারাবার দশা, ঠিক তখন মনে হলো, আমার মাথার ওপর কেউ একজন ভেসে আছে, আমি সৃষ্টিকর্তার নাম নিতে নিতে উপরে তাকাতেই দেখি সাদা কাফনের কাপড় পরে আমার দিকে তাকিয়ে সেই মুখখানা হাসছে। আমি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি।
জ্ঞান ফিরে আসার পর চারপাশে মানুষের কোলাহল আঁচ করতে পারলেও রাতের ভয় তখনো আমাকে গ্রাস করে ছিল। আমি চোখ বুজেই ছিলাম, যদি আবারো সেই মুখখানা আমাকে দেখতে হয়?
পাশ থেকে কে যেন বলছিল, “ওকে মনে হয় আলোভোলাতে ধরেছিল, পথ ভুলিয়ে বাঁশ বাগানে নিয়ে ভয় দেখিয়েছে। ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে!”
আসলেই কি আলোভোলা ছিল? যে মুখখানা দেখেছিলাম, সেকি তবে আমার মনের ভুল? নাকি অন্য কিছু? যাইহোক, আমি সেটাকে আলোভোলা মনে করেই ভুলে গেলাম ও পড়াশোনাতে মনোযোগী হলাম, সাথে তৈরী হলো কিছু বাধ্যবাধকতা, রাত ৮টার পরে বাড়ির বাইরে থাকা যাবেনা, বাঁশ বাগানের দিকে নজর দেয়া যাবেনা এবং পুরোনো বাড়ির আঙিনায় পা রাখা যাবেনা। এই তিন বাধ্যবাধকতা তৈরী করে দিলেন এই গ্রামের মওলানা কাদের চাচা।
মাঝেমধ্যে যে মাঝরাতে ভয়ে আতঁকে উঠতাম না তা না, এভাবেই কয়েক মাস পার হয়ে গেল, কোনো সমস্যার মুখোমুখি আর হইনি। সমস্যা আর হয়নি তার মানে কি এটাই যে সমস্যা আর আসবেনা। আমার কানে তখনো বাজছিল, মওলানা চাচা আমার চাচাকে চলে যাবার সময় বলেছিলেন, “রাতের খাওয়া শেষে খাবারের থালা হাতে টুটুল যেন কখনোই থালার দিকে না তাকায়”
সেদিন ভাত খাওয়া শেষ করে আমি থালার দিকে এক পলক তাকিয়েছিলাম মাত্র, অমনি আমি সেই মুখখানা আবার দেখতে পাই, আমি প্রচন্ড ভয়ে হাতের থালা মেঝেতে ফেলে দিলে থালা পড়ার শব্দে আমার চাচা, চাচী আর তনিমা তিনজনেই ভয়ে কেঁপে ওঠে।
বুক তখনো ধড়ফড় করছিলো ভয়ে, চাচী আমার পাশে এসে দোয়া দুরুদ পড়তে থাকেন। আমার বুকে দোয়া পড়ে ফুঁক দিতে থাকেন। আমি চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, চাচা, সেদিন মওলানা চাচা কি আপনাকে কিছু বলে যায়নি? আমি আসলে কাকে দেখি?
আমার চাচা আমাকে বললেন, ভাইজান কিছু বলে যায়নি ব্যাটা, তবে আমি কাল জিজ্ঞেস করবো। ব্যাটা তুই কাকে দেখিস? তুই তো কাউকে কিছু বলিসনি।
সেদিন আমি নিজেই বেশ অবাক হয়ে যাই চাচার কথাতে। আসলেই তো, আমি আজ অব্দি কাউকেই বলিনি যে আমি সেদিন রাতে একটা মুখ দেখেছিলাম, আজই কেবল মনের ভুলে বের হয়ে গেল যে আমি কাউকে দেখতে পাই, আর এই কারণেই কি তবে মওলানা চাচা মানা করেছিলেন খাবার শেষে খালি থালার দিকে তাকাতে? তবে কি মওলানা চাচা আসল সত্যটা জানেন? কই, আমি তো কাউকে বলিনি?
আমি আমার চাচার কাছে কাউকে দেখার ব্যাপারটা চেপে গেলাম, সেদিন রাতে এটা সেটা ভেবে ঘুমিয়ে পড়লাম, খুব বেশি চাপ নিলাম না, কেননা সকাল হলেই আমি মওলানা কাদের চাচার কাছে দৌঁড় দেবো, এই রহস্যের সত্যটা আমাকে জানতেই হবে!
-
সকাল হতে না হতেই খবর এলো, মওলানা চাচা নাকি মধ্যরাতে বমি করতে করতে মরে গিয়েছেন! ব্যাপারটাকে আমি কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না, আমার চাচার সাথে উনার লাশ দেখতে গেলাম, উনার পরিবারের মতে উনি সুস্থ সবল মানুষ, কোনো রোগ বালাই নাকি ছিলনা আল্লাহর রহমতে, হঠাৎ মাঝরাতে প্রসাব করতে যান, সেখান থেকে ফিরে এসে বমি করতে করতে মরে যান। তবে মরে যাবার আগে নাকি কিসব বিড়বিড় করে বলছিলেন যা কেউ আন্দাজও করতে পারেনি।
মওলানা চাচার মৃত্যুটা আমাকে বেশ ভাবুক করে তুললো। আমি বুঝতে পারলাম যে এক অপার রহস্য জড়িয়ে আছে আমার উনার সাথে দেখা করতে চাওয়া এবং উনার মৃত্যুর সাথে। দুটো একই সুঁতোয় বাঁধা। এটা কি সহজেই অনুমেয় নয় যে আমি উনার কাছ থেকে প্রকৃত রহস্য জানতে যেতে চাইছিলাম বলে ঐ অদৃশ্য শয়তানটা উনাকে মেরে ফেলেছেন?
আমি আসলে ওটাকে শয়তান ছাড়া আর কি বলবো তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। কারণ, তার অস্তিত্ব সম্পর্কে আমার কোনো সন্দেহ নেই আর, তবে সে যে কি তা আমি জানিনা, জ্বীন নাকি ভূত-প্রেত, পরিষ্কার নই। তবে সবচাইতে অবাক ব্যাপারটা হলো, আমার ভেতরের ভয়-ডর দিনে দিনে উধাও হয়ে যেতে লাগলো। মাঝরাত এলেই আমার ভেতর থেকে কেউ যেন আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতো, আমাকে কোথাও যেন টেনে নিয়ে যেতে চাইতো! আমি বুঝতে পারতাম না। যদিও সেটা বুঝতে আমার খুব বেশি সময় লাগলো না।
প্রতিদিন রাত এলেই আমার অস্থিরতা বাড়তে শুরু করে। দূর গ্রামে যখন খেকশিয়ালের দল ডাকাডাকি করে, আমি তখন আরো বেশি অস্থির হয়ে পড়ি। মনে হতে থাকে, আমি যেন ওদেরই কেউ।
একদিন মনের সকল বাঁধা পেরিয়ে, দরজা খুলে দূর গ্রামের শেয়ালের দলের দিকে অগ্রসর হই।
মধ্যরাত। চাঁদটাও মাঝ গগণে। মেঘের সাথে লুটোপুটি খেলছে।
ঘাসের জঙ্গল পেরিয়ে দূর গ্রামে পৌছাতেই দেখি শেয়ালের দল আমাকে দেখে ভয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি, আমি ওদের কেউ নই, কিন্ত ওরা আমাকে আকর্ষিত করেই যাচ্ছে, ওরা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। নিজেকে খুব বেশি ক্ষুধার্ত মনে হল। ক্ষানিকটা পরেই সত্যটা আবিস্কার করি, ওদের রক্ত আমার ভীষণ প্রয়োজন!!
জানিনা আমার মধ্যে কি হলো, হিংস্র বাঘের মতন ওদের একটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। পিপাসার্ত চাতক পাখির মতন দাঁত দিয়ে কামড়ে দিলাম ঘাড়ে, গলগল করে রক্তের স্রোত বইতে লাগলো। সেই রক্তে আমি স্পষ্ট চাঁদের প্রতিফলন দেখতে পেলাম, আর সাথে সেই মুখখানা, আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, কতদিনের চেনা সেই মুখ, কতদিনের চেনা সেই হাসি।


চলবে...


লেখকঃ- Zannat Ul Ferdous
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner