হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো মক্কার কাফিরেরা। মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জব্দ করবার ভালো একটা মওকা মিলেছে এতোদিনে।
মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে একত্ববাদের বাণী সর্বত্র বিলিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাতে তারা বিরক্ত আর বিব্রত। হাজার চেষ্টা করেও আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদকে তারা থামাতে পারছে না। আরো অদ্ভুত ব্যাপার হলো— দিনের পর দিন তাঁর দল কেমন যেন ভারিই হচ্ছে! আগে তো তা-ও গরিব-দুঃখীরা ভিড় করতো তাঁর ধর্মে, কিন্তু এখন সমাজের উঁচু শ্রেণী, মাথা-ওয়ালারাও ভিড় জমাতে শুরু করেছে নতুন ধর্মটায়। ফলে, নতুন একটা ধর্মের এমন উত্থান যে কাফিরদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে— তা তো জানা কথা-ই।
মক্কার কতিপয় মুশরিকেরা দ্বারস্থ হলো আহলে কিতাব তথা মক্কার ইয়াহুদিদের। যদিও উভয়ের ধর্মের মাঝে যোজন যোজন পার্থক্য, তথাপি মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঠেকাতে 'শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু' নীতিতে তারা ইয়াহুদিদের কাছে ধর্ণা দিতে কার্পণ্য করলো না।
ইয়াহুদিদের মাঝে যারা তাদের কিতাবের ব্যাপারে পারদর্শী, তাদের কাছে এসে মক্কার মুশরিকেরা বললো, 'আমাদের গোত্রে একজন লোকের আবির্ভাব ঘটেছে যে নিজেকে নবি দাবি করছে। সে আরো দাবি করছে যে— আমাদের পালন করে আসা ধর্ম নাকি পুরোটাই মিথ্যা আর আমাদের দেব-দেবিরাও নাকি জড় পদার্থের সমষ্টি ব্যতীত আর কিছুই নয়। তার এহেন দাবিতে আমরা বিরক্ত, বিব্রত। অনেকভাবেই আমরা তাকে আটকাতে চেয়েছি। এমনকি, তার সাথে আপোসে আসার ব্যাপারেও আমরা রাজি ছিলাম। কিন্তু লোকটা নিজের মতবাদে এমন একাট্টা যে— দুনিয়া উল্টে গেলেও নিজের অবস্থান থেকে একবিন্দু সরে আসবে না। তাকে থামাবার আমাদের প্রায় সকল উপায়, সকল কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। আজ আমরা আপনাদের কাছে এসেছি সাহায্যের ব্যাপারে। আপনারা তো এক সু-প্রাচীন ধর্মের অনুসারী, আপনারা কী আমাদের এমন কোন কৌশল বা এমন কোন প্রশ্ন বলতে পারেন যা মুহাম্মাদকে জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দিতে পারবে না? যদি সে সঠিক উত্তর দিতে না পারে, তাহলে আমাদের সমাজে সে মিথ্যুক সাব্যস্ত হবে এবং আশা করছি তখন তাকে আমরা মিথ্যাবাদি হিশেবে জব্দ করতে পারবো। তাকে যদি মিথ্যেবাদী প্রমাণ করা যায়, তাহলে দলে দলে তার অনুসারীরা তাকে পরিত্যাগ করবে'।
ইয়াহুদি প্রধান সবকিছু শুনে বললো, 'লোকটা কী কোন কিতাবের কথা বলে?'
মুশরিকেরা বললো, 'হ্যাঁ, সে দাবি করে যে— তার কাছে নাকি আল্লাহর কাছ থেকে বাণী নাযিল হয়'।
- 'আচ্ছা। তাকে তোমরা তিনটে প্রশ্ন করবে। যদি প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর সে দিতে পারে, তাহলে আশা করা যায় যে সে যা বলছে তা সত্য। যদি না পারে, ধরে নিতে হবে তার দাবি মিথ্যা বৈ কিছু নয়।'
- 'কোন তিনটা প্রশ্ন?'
- 'তাকে সে-সকল যুবকদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে যারা নিজেদের ঈমান বাঁচাতে জনপদ ত্যাগ করেছিলো। তাদের পরিণতি কী হয়েছিলো জানতে চাইবে। তাকে সেই মানুষটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে যে পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম পরিভ্রমণ করেছিলো। তার কাছে রূহ সম্পর্কে জানতে চাইবে'।
ইয়াহুদি প্রধানের প্রশ্নগুলো নিয়ে মুশরিকেরা বাক বাকুম করতে করতে ফিরে এলো। তারা ধরে নিলো—এইবার জব্দ হবে মুহাম্মাদ!
মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে তারা বললো, 'ইয়া মুহাম্মাদ, তোমাকে আমরা তিনটে প্রশ্ন করতে চাই। যদি ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারো তো বিশ্বাস করবো যে তোমার যাবতীয় দাবি সত্য। যদি না পারো, তাহলে তুমি মিথ্যুক সাব্যস্ত হবে সকলের কাছে।'
মুশরিকদের এ-ধরণের প্রশ্ন-প্রশ্ন খেলা নতুন কিছু নয় নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে। তিনি স্মিত হেসেই বললেন, 'বলো কী প্রশ্ন?'
তারা বললো, 'আমাদের প্রথম প্রশ্ন হলো— ওই সকল যুবকদের কী হয়েছিলো শেষপর্যন্ত যারা নিজেদের ঈমান বাঁচাতে জনপদ ত্যাগ করেছিলো?'
- 'তারপর?'
- 'আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো— ওই মানুষ সম্পর্কে আমাদের জানাও যে পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম পরিভ্রমণ করেছিলো'।
- 'এরপর?'
- 'তৃতীয় প্রশ্ন হলো— রূহ কী?'
তাদের প্রশ্নগুলো শুনে নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'ঠিক আছে, আগামিকাল এসো, তোমাদেরকে উত্তর জানাবো'।
মুশরিকরা প্রস্থান করলো। আগামিকাল তারা সদলবলে আবার উপস্থিত হবে এখানে। একটা দফারফা এবার হবেই হবে।
কিন্তু, আগামিকাল এলো ঠিক-ই, তবে মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুশরিকদের উত্তর জানাতে পারলেন না। এভাবে একদিন, দু'দিন, তিনদিন করে পনেরো দিন অতিবাহিত হয়ে গেলো, তবুও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা জিবরাঈল আলাইহিসসালামকে পাঠালেন না। জিবরাঈল যদি আল্লাহর কাছ থেকে ওহী নিয়ে না আসে, মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোত্থেকে জানবেন প্রশ্নগুলোর উত্তর?
সবার মনে নানান প্রশ্ন। মুশরিকদের মনে খুশির হিল্লোল। মুহাম্মাদকে তারা এবার সত্যিই জব্দ করলো বলে! এদিকে, মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও চিন্তায় পড়ে গেলেন। কী এমন ঘটলো যে জিবরাইল ওহী আনা বন্ধ করে দিলো?
টানা পনেরো দিন পরে জিবরাঈল আলাইহিসসালাম ওহী নিয়ে এলেন। মুশরিকদের প্রশ্নগুলোর প্রতি-উত্তরে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা নাযিল করলেন সূরা আল-কাহাফ।
তবে, মাঝখানের এই ওহী-বিরতির কারণ কী? কেনো মুশরিকদের প্রতি-উত্তরে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা সাথে সাথে ওহী নাযিল করে তাদের জবাব দেন নি?
কারণ— মুশরিকদের সাথে কথা বলার একপর্যায়ে নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলেন আর তা হলো— ইন শা আল্লাহ।
নবিজী বলেছিলেন, 'ঠিক আছে, আগামিকাল এসো। তোমাদেরকে উত্তর জানাবো'। তিনি এখানে 'ইন শা আল্লাহ' বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। কেবল এই ভুলটার কারণেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা পনেরো দিন যাবত জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে ওহী সমেত পাঠান নি। এই একটা কারণে মুশরিকরা সাময়িক আনন্দোৎসবে মেতে উঠবার সুযোগ লাভ করেছিলো।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা নবিজীকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, 'কোন বিষয়ে বলো না যে, 'ওটা আমি আগামিকাল করবো', ইন শা আল্লাহ বলা ব্যতীত'।- আল কাহাফ ২৩-২৪
'ইন শা আল্লাহ' শব্দটাকে শুনতে যতোখানি হালকা শোনায়, শব্দটা এতোটাই হালকা নয় কিন্তু। বরঞ্চ, শব্দটা তাওয়াক্কুলের একটা বিশাল অর্থ বহন করে চলেছে।
'ইন শা আল্লাহ' মানে হলো— যদি আল্লাহ চান। যখন ভবিষ্যতের কোনোকিছু নির্দেশ করা হবে, যা সংঘটিত হয়নি, তখন আমরা বলি 'ইন শা আল্লাহ'। আমরা বলি যে— 'যদি আল্লাহ চান তো হবে, নয়তো হবে না'।
এই কথাটা বলে আমরা আমাদের তাকদিরে বিশ্বাসের স্বীকৃতি দিই এভাবে যে— আল্লাহ যদি তাকদিরে রাখেন তো হবে, নাহয় হবে না'।
এই কথাটা বলে আমরা গায়েবের জ্ঞান যে কেবলমাত্র আল্লাহর কাছে, তারও স্বীকৃতি দিই। ভবিষ্যতে ওটা আদৌ হবে কি-না, তা আমরা বর্তমানে বসে বলতে পারি না। ভবিষ্যতের জ্ঞান তো আমাদের কাছে নেই। সেটা আছে কেবলমাত্র আলিমুল 'গায়িব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালার কাছে। সুতরাং, আমরা যখন 'ইন শা আল্লাহ' বলি, তখন আমরা এই স্বীকৃতি দিই যে— 'ভবিষ্যতের ব্যাপার তো আল্লাহর হাতে। আল্লাহই ভালো জানেন ওটা হবে কি-না'।
'ইন শা আল্লাহ' বলে আমরা সকল কর্তৃত্ব আল্লাহর দিকে সোপর্দ করে দিই। এর আরেকটা অর্থ— 'আল্লাহ তাওফিক দিলেই তা হবে, না দিলে হবে না। সকল ক্ষমতার মালিক তো আল্লাহ।'
'ইন শা আল্লাহ' বলে আমরা আমাদের ভরসাটাকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দিই। এটা বলে আমরা বুঝাই— 'আল্লাহ চান তো হবে, নয়তো হবে না। ভালো আর মন্দের জ্ঞান যেহেতু আল্লাহর কাছেই, তাই আল্লাহ যদি কল্যাণের মনে করেন ওটাকে, তখন হবে। অকল্যাণের মনে করলে হবে না, ব্যস'।
'ইন শা আল্লাহ' শব্দটা ঈমানের শাখা-প্রশাখার মাঝে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। শুনতে হালকা হলেও শব্দটার ভারত্ব ব্যাপক।
বাস্তব জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখুন। করোনায় মারা গেছে এমন কতো মানুষ গত বছরের জানুয়ারিতে স্বপ্ন দেখেছিলো এই বছরের জানুয়ারিতে কতো কী করার! কতো মানুষ ছেলে-মেয়ের বিয়ে, সন্তানদের পড়াশুনা, ভ্রমণ, হজ্ব, উমরা সহ কতো কী ভেবে রেখেছিলো। কিন্তু, তারা কী কল্পনাতেও ভাবতে পেরেছিলো যে, করোনা নামের একটা ভাইরাস এসে সবকিছু উল্টেপাল্টে দেবে? ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি কেউ। কারণ, কারো কাছেই গায়েবের জ্ঞান নেই আল্লাহ ছাড়া। তারা ভাবতেই পারেনি যে— ২০২১ এর জানুয়ারিতে তাদের কবরে থাকতে হবে।
সুতরাং, ভবিষ্যতের ব্যাপারে যেহেতু আমাদের কোন জ্ঞান নেই, আমাদের হাতে কোন নিশ্চয়তা নেই, সেহেতু ভবিষ্যতের সকল ব্যাপার আমাদেরকে অবশ্যই আল্লাহর দিকে সোপর্দ করে দিতে হবে। আমরা বলবো না যে, 'আমি এটা করবো', 'ওটা হবে', 'এটা থাকবে'।
আমরা বলবো— 'আমি এটা করবো ইন শা আল্লাহ', 'ইন শা আল্লাহ, ওটা হবে', 'ইন শা আল্লাহ এটা থাকবে'।
নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম 'ইন শা আল্লাহ' বলতে ভুলে গিয়েছিলেন বিধায় স্বয়ং নবিজীর কাছেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা ওহী পাঠানো বন্ধ রেখেছিলেন। আমরা যারা প্রতিদিনকার ভবিষ্যতের কাজকারবারের ফর্দ বর্ণনায় 'ইন শা আল্লাহ' বলতে ভুলে যাই, আমাদের সাথে আল্লাহ তাহলে কেমন আচরণ করবেন?
এমনও হতে পারে, আমাদের ভবিষ্যতের অনেক জল্পনা-কল্পনা সত্যি হয়না কেবল এই 'ইন শা আল্লাহ' না বলার কারণেই।
Writer:- Arif Azad