ঘুম থেকে জাগবার পরে আসহাবে কাহাফের যুবকদল নিজেদের মধ্যে আলোচনায় লিপ্ত হলো। একজন জিজ্ঞেস করলো, 'তোমরা কতোক্ষণ ঘুমালে?'
কেউ উত্তরে বললো, 'হতে পারে পুরো একটা দিন অথবা একটা দিনের কিছু অংশবিশেষ'।
এই উত্তরটা আসার পর, ওই যুবকদলের মধ্য থেকে কেউ একজন তৎক্ষনাৎ বললো, 'তোমরা কতোক্ষণ ঘুমিয়েছো তা তোমাদের রব-ই ভালো জানেন।' সুরা আল কাহাফ ১৯
আয়াতের পরম্পরা খেয়াল করলে দেখা যায়, তারা যে ব্যাপারে আলোচনায় লিপ্ত হয়েছিলো, অর্থাৎ কতো সময় ধরে তারা ঘুমিয়েছে— সেই আলাপ ওই মুহূর্তে ওখানেই থেমে যায়। মানে, তাদের ভিতর থেকে যখন কেউ একজন বললো, 'কতো সময় ধরে ঘুমালাম তা আল্লাহ-ই ভালো জানেন', তখন যাবতীয় তর্কের, এ-ব্যাপারে যাবতীয় দ্বিধার সেখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে যায়। কেউ আর ও-বিষয়ে একটা শব্দও তুলেনি। ওই আলোচনার ওখানেই সমাপ্তি টেনে দিলো তারা। তারা যদি তা নিয়ে আরো আলাপ চালিয়ে যেতো, তাহলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা তা অবশ্যই আমাদের জানাতেন। যেহেতু জানান নি, সেহেতু ধরেই নেওয়া যায় যে— যুবকদল ওই ব্যাপারে আর কোন কথা বাড়ায় নি।
'আল্লাহ-ই ভালো জানেন'— এই কথাটা শুনতে সহজ, কিন্তু অন্তরের ভেতর থেকে এই কথার স্বীকারোক্তি দেওয়াটা অতো সহজ নয়৷ বিশেষ করে এখনকার সময়ে তো তা আরো কঠিন।
বর্তমান সময়ে আমরা এমন একটা ভাব নিয়ে চলি— যেন আমরা একেকজন সকল জ্ঞানের আধার। দুনিয়ার সবকিছু নিয়ে, সকল ব্যাপারে আমরা কথা বলতে সিদ্ধহস্ত। যেকোন ইস্যুতে, যেকোন ঘটনায় জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতে না পারলে আমরা যেমন শান্তি পাই না, তেমনি শান্তি পায় না আমাদের কী-বোর্ডও।
আমরা যে দুনিয়ার সকল ব্যাপারে মন্তব্য না করলে শান্তি পাই না তা শুধু নয়, আমরা এ-ও ধরে নিই— কোন একটা ব্যাপারে, কোন একটা ইস্যুতে আমি যা জানি বা আমি যা বুঝি কেবল তা-ই ঠিক। আমাদের হাবভাব এমন— আমার জানার বাইরে আর কোন জানা থাকতেই পারে না। আমার বুঝটাই দুনিয়ার এক এবং একমাত্র সহীহ বুঝ।
আমরা আরো বিশ্বাস করি— আমার বুঝের মতো করে যে বুঝবে না, সে আসলে বিভ্রান্ত। আমার জানার উৎসকে যে অস্বীকার করবে, মানতে চাইবে না, সে আসলে স্পষ্ট গোমরাহিতে আছে।
ফলে, সবকিছুর সমীকরণ দিনশেষে যে ফলাফল দেয় তা হলো— দুনিয়ায় আমিই একমাত্র হকের ডিলার। আমার বুঝটাই একমাত্র সহীহ বুঝ। আমার দলটাই একমাত্র সহীহ দল। এর বাইরে আর কোন বুঝ নেই। এর বাইরে আর কোন হক নেই। এর বাইরে আর কোন দল নেই।
সুতরাং, যুগটাই যখন নিজের জ্ঞানের বাহাদুরি প্রদর্শনের, সেখানে নিজের জানার ঘাটতিটাকে 'আল্লাহ-ই ভালো জানেন' বলে যাবতীয় তর্ক থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার মতোন মানসিকতা ক'জনের আছে আজকাল?
'আল্লাহ ভালো জানেন' এই কথাটা শোনার পর আসহাবে কাহাফের যুবকদল যখন যাবতীয় তর্ক থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিলো, আমি তখন বিস্ময়াবিভূত হয়ে গেলাম! কী অসাধারণ মানসিকতা! কী সুন্দর তাদের আল্লাহর প্রতি ধারণা!
কল্পনা করুন তো— আপনি আর আপনার বন্ধু মিলে কোন একটা ব্যাপার নিয়ে তর্ক করছেন। তর্কের এক জায়গায় কেউ এসে বললো, 'থামো, মূল ব্যাপার কী সেটা আল্লাহ-ই ভালো জানেন', তখন আপনি এবং আপনার বন্ধু— উভয়ে কী করবেন আসলে?
আপনি বলবেন, 'আরে ভাই, আমি বলছি ব্যাপারটা আমি জানি। এ-ব্যাপারে আমি একশতো ভাগ নিশ্চিত'।
আপনার বন্ধু বলবে, 'তার মানে, তুমি বলতে চাইছো যে আমি ভুল জানি? তোমার কী ধারণা পড়াশুনা কেবল তুমি একাই করো, দুনিয়ায় আর কেউ করে না?'
খুব পরিচিত মনে হচ্ছে না তর্কের ধরণটাকে? হ্যাঁ, মানুষ আসলে এমন-ই। সে নত হতে চায় না। আধুনিক যুগে তো তর্কে জেতার ব্যাপারে সে আরো বেশি উদগ্রীব, আরো বেশি তৎপর। যদিও কাগজে-কলমে সে এটা মানে যে— আল্লাহই সকল ব্যাপারে ভালো জানেন, তথাপি— নিজের ঘাটতিটাকে সে কোনপ্রকারেই আল্লাহর সেই জানার দিকে ঘুরাবে না, সে মরিয়া হয়ে তর্কে জয়লাভ করতে চাইবেই চাইবে।
অথচ দেখুন— কতো লম্বা একটা ঘুম থেকে জাগবার পরে, আসহাবে কাহাফের যুবকদলের মনে হলো তারা হয়তো কেবল একটা দিন অথবা একটা দিনের কিছু সময় কেবল ঘুমিয়েছে। যেহেতু আল্লাহর পরিকল্পনার ব্যাপারে তারা কোনোকিছুই জানে না, সুতরাং তাদের কাছে তাদের ধারণাটাই স্বাভাবিক।
পাশ থেকে কেউ একজন যখন বললো, 'কতো সময় ঘুমিয়েছো তা আল্লাহ-ই ভালো জানেন', তখন কিন্তু তারা চাইলে পাল্টা তর্কে জড়াতে পারতো এই বলে যে, 'আরে, আমরা সকালে না ঢুকলাম গুহায়? বাইরে গিয়ে দেখো সন্ধ্যা নেমেছে। তার মানে আমরা অর্ধেক দিন-ই তো ঘুমালাম। বলো তো, এতে ভুলের কী আছে?'
নিজেদের বুঝ বা ধারণার ওপর নির্ভর করে তারা চাইলে এমন একটা তর্কে জড়াতে পারতো। কিন্তু তারা তা করেনি। যখন কেউ বললো, 'কতো সময় ঘুমিয়েছি তা আল্লাহ-ই ভালো জানেন', তখন তারা সেখানেই থেমে গেলো। আর একটা কথাও ওই ব্যাপারে তারা বলেনি। ওই কথাটাকেই তার মেনে নিলো যে— আসলে আল্লাহ-ই ভালো জানেন।
'আল্লাহ ভালো জানেন' এটা আমরা বলি এবং বিশ্বাসও করি, কিন্তু ধারণ করি না। আমরা আসলে ধারণ করি আমাদের সীমাবদ্ধ ধারণা এবং অতি-সীমাবদ্ধ জানাকে। যদি আমরা 'আল্লাহ ভালো জানেন' এই কথাটাকে সত্যিকারভাবে ধারণ করতাম, তাহলে নিজের জানাটাকে কখনোই একেবারে নির্ভুল ধরে নিয়ে, অন্যের জানাটাকে খাটো করে দেখে তাকে তর্কে হারিয়ে জিতবার খেলায় মেতে উঠতাম না।
আসহাবে কাহাফের যুবকেরা নিজেদের ধারণা এবং জ্ঞানকে আল্লাহর জ্ঞানের ওপরে প্রাধান্য দেয়নি বলেই তারা নিজেদের ওই তর্ক থেকে নিবৃত করতে পেরেছিলো সেদিন। আমরা তা পারি না বলেই জীবনের বেশিরভাগ সময় আমরা তর্কে পার করি।
Writer:- Arif Azad