> নীল চিরকুট পর্ব ৬, ১০ - ভালবাসার গল্প - গল্প - বাংলা লাভ স্টোরি - রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প - নৌশিন আহমেদ রোদেলা
-->

নীল চিরকুট পর্ব ৬, ১০ - ভালবাসার গল্প - গল্প - বাংলা লাভ স্টোরি - রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প - নৌশিন আহমেদ রোদেলা

শহরে ভোর নেমেছে প্রায় দু' ঘন্টা হলো। ঘড়িতে সাতটা কি আটটা  বাজে। খানিকবাদেই  গ্রীষ্মের সোনালি রোদে ঝলমল করে উঠবে জনাকীর্ণ ঢাকা শহরের গাঁ। ধানমন্ডির ছয় নম্বর রোডে সাদা রঙের বিশাল বিল্ডিংয়ের পার্কিং-এ দাঁড়িয়ে আছে নম্রতার বন্ধুরা। তাদের সামনে কালো রঙের চমৎকার এক প্রাইভেট কার। সাদা একটা ন্যাকড়া দিয়ে নিরন্তর গাড়িটির গাঁ মুছে চলেছেন একজন ড্রাইভার। বিরসমুখী ড্রাইভারের গাঁয়ে ঝকঝকে সাদা ইউনিফর্ম। চিমসে যাওয়া গাল দুটো লেগে আছে গালের দু'পাশের চ্যাপ্টা হাড়ে। থেবড়ানো নাকে হাজার টন বিরক্তি। ছোট ছোট চোখে মাত্রাতিরিক্ত প্রভূভক্তি। রঞ্জনের গায়ে কালো রঙের পোলো শার্ট। পরনে অফ হোয়াইট জিন্স। পায়ে ব্ল্যাক কেডস। পুরু ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত। 

'  শালা! এই অন্তু মরছেটা কই? খোঁজ-খবর নাই কোনো।' 

নাদিম গিটারে সুর তোলার চেষ্টা করছিল। গায়ে পরা নীল-কালো চেকশার্টটির উপরের বোতামদুটো খোলা। ঘন চুলের এক গাছি পড়ে আছে কপালে। কাগজের মতো সাদা মুখে বিরক্তির ছাপ। রঞ্জনের কথায় কপালের চুলগুলোকে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়ে গেইটের দিকে তাকাল নাদিম। নম্রতা ট্রলি ব্যাগের উপর গালে হাত দিয়ে বসে ছিল। ফু দিয়ে নিজের কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো উড়িয়ে দিতে দিতে আকাশ-পাতাল ভাবছিল। ঠিক এমন সময় গেইট পেরিয়ে ভেতরে এলো অন্তু। কালো গায়ে ঝকঝকে সাদা রঙের টি-শার্ট। পরনে ছাই রঙের ঢিলাঢালা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট। পিঠে ট্যুরিস্ট ব্যাগ। চুলগুলো খাঁড়া করে পেছন দিকে আঁচড়ানো। পেটানো, প্রশস্ত বুকের ছেলেটি ঘেমে অস্থির। পার্কিং-এ বন্ধুদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো অন্তু। রাগান্বিত বন্ধুরা কিছু বলার আগেই ভুবন ভুলানো হাসি হাসল। গায়ের রং কালো হলেও নিজের হাসিটা যে মারাত্মক সুন্দর সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন অন্তু। শুধুমাত্র এই মায়াভরা, ইনোসেন্ট হাসিটার জন্যই অসংখ্যবার অঙ্ক স্যারের ভয়ানক মার থেকে বেঁচে গিয়েছে সে। সে হাসলে আশেপাশের মেয়েরা যে বারবার ঘুরে তাকায় তা একটু বয়স হতেই নিজ জ্ঞানে বুঝে নিয়েছে অন্তু। কিন্তু হায় নিয়তি! একমাত্র নীরাকেই এই হাসির মায়ায় কাবু করতে পারল না সে। রঞ্জন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

' শালা! এতোক্ষণ লাগে আসতে? আমরা হল থেকে চলে এলাম আর তুমি ধানমন্ডিতে থাকা সত্ত্বেও ঠিক টাইমে পৌঁছাতে পারো না। খারাপ কথা মুখে আসছিল একখান।' 

অন্তু বিগলিত হেসে বলল,

' আরে, বাসায় একটু ঝামেলা হইছিলো। আব্বায় হঠাৎ বাজারে পাঠাই দিছিল।' 

কথাটা বলে এদিক-ওদিক তাকাল অন্তু। নম্রতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

' কী রে? আরগুলা কই?' 

নম্রতা সরু চোখে তাকাল। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,

' আরগুলা? নাকি নীরা?' 

রঞ্জন হাসল। নাদিম গিটারে রোমান্টিক টুন দেওয়ার চেষ্টা করল। অন্তু মাথা চুলকে গরম চোখে তাকাল। কপট রাগ নিয়ে বলল,

' খোঁচা মারস কেন হারামি? খালি নীরার কথা জিগ্যেস করব কেন? ছোঁয়াও তো নাই। রওনা দিবি কখন?' 

অন্তুর প্রশ্নের মাঝেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো ছোঁয়া আর নীরা। তাদের পেছনেই ছোঁয়ার বাবা-মা প্রফেসর সালাম হক এবং সিঁথি হক। ছোঁয়ার বাবা মার উপস্থিতিতে বন্ধুমহলের প্রশ্ন-উত্তর পর্বে ভাটা পড়ল। সবাই হঠাৎ করেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। প্রফেসর সালাম হক ছেলে-মেয়েদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে ড্রাইভারকে বিস্তর বোঝালেন। কিভাবে সাবধানে তাদের কক্সবাজার পর্যন্ত পৌঁছে দিবেন তার বিস্তর উপদেশ দিলেন। সিঁথি হক আর সালাম হকের খবরদারিতে ছোঁয়া ব্যতিত বাকি পাঁচজনেরই ভ্রু কুঁচকে এলো। নাদিম মুখ কাঁচুমাচু করে নিচু গলায় বলল,

' মামা? মনে তো হইতাছে আমরা কেজি স্কুলে পড়ি। প্রথম প্রথম স্কুল কী জিনিস দেখতে যাইতাছি। বাল!  এতো ঢং-এর মানে কী?' 

রঞ্জন উত্তর দিল না। অন্তু মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে চুপ করে রইল। বাবা-মায়ের বাধ্য মেয়ে ছোঁয়া সময় নিয়ে বাবা-মার থেকে বিদায় নিলো। বন্ধুরা কুঁচকানো ভ্রু আর একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে গাড়িতে উঠল। গাড়ি যখন ধানমন্ডি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জের রাস্তায় ছুটলো তখন সূর্যের যৌবনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে পথঘাট, পথচারী। প্রায় আধঘন্টা চলার পর থমথমে গলায় আদেশ করল রঞ্জন,

' মামা? গাড়ি ঘুরাও। আমরা কেরানীগঞ্জ যাব। পুরাতন ঢাকা।' 

রঞ্জনের কথায় চরকির মতো ঘুরে এসে তার মুখের উপর স্থির হলো পাঁচ জোড়া চোখ। বিস্মিত ড্যাবড্যাবে চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো রঞ্জন। কে, কী বুঝলো জানা নেই। নাদিম জোরের সাথে বলল,

' হ্যাঁ, হ্যাঁ। মামা গাড়ি ঘুরাও। কেরানীগঞ্জের রোড ধরো। পুরাতন ঢাকায় যামু।' 

ওদের কথায় ড্রাইভার অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। তার চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে, সে মহাপাপীদের সাথে বসবাস করছে। এই পাপীদের সাথে বসে থেকে সে প্রচন্ড কুন্ঠিত, লজ্জিত এবং রাগান্বিত। রঞ্জন আবারও বলল,

' কী হলো মামা? গাড়ি ঘুরাতে বললাম না?' 

ড্রাইভার ডাঁট হয়ে বসে রইল। চোখদুটো সামনের দিকে নিবদ্ধ। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে থমথমে কন্ঠে বলল,

' ম্যাডাম কইছে, ডিরেক্ট কক্সবাজার যাবা। হেতেহুতে অযথা থামাইবা না। আমিও থামাইতাম না। সিদা কক্সবাজার যাওম। গাড়ি ঘুরামু ক্যান? ম্যাডাম তো কেরানীগঞ্জ যাইতে কয় নাই।' 

অন্তু-রঞ্জন একে অপরের দিকে তাকাল। দু'জনের ভ্রুই কুঞ্চিত। নাদিম তিক্তমুখে বলল,

' একটু জোরে চালান মিয়া। এমনে ভ্যান গাড়ির মতো চালাইতাছেন ক্যান? আর একটা ফার্স্টক্লাস গান দেন। এভাবে কেউ ট্যুরে যায়?' 

' গাড়ি ঠিক গতিতেই চলতাছে। ম্যাডাম কইছে গাড়ির গতি ত্রিশের উপরে না নিতে। আর গান দেওন যাইত না। ম্যাডাম কইছে গানে ফোকাস নষ্ট হয়। ফোকাস নষ্ট করুন যাইত না।' 

বিরক্তিতে কুঁকড়ে উঠলো নাদিম। বিরবির করে বলল,

' বাল যাইত না। অসহ্য! অসহ্য!' 

অন্তু জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,

' পুরাতন ঢাকায় আমাদের এক বন্ধু আছে। সাথে যাবে। ওখান থেকে ওকে তুলে নিয়ে তারপর কক্সবাজার যাব। গাড়ি ঘুরান।' 

ছোঁয়া কিছু বলবে তার আগেই চোখ রাঙাল নাদিম। যার অর্থ, কথা কবি তো চড়াই দাঁত ফেলাই দিমু! ড্রাইভার লাফিয়ে উঠে বলল,

' ম্যাডাম তো কইছিল ছয়জন যাইবো। আপনারা কারে নিতে চাইতাছেন? আপনাগো হাব ভাব সুবিধার লাগে না তো। আমি ম্যাডামের অনুমতি ছাড়া কোনোহানে যাইতাম না।' 

রাগে রঞ্জনের ফর্সা গাল দুটোতে লাল রঙের আভা ফুটে উঠল। ছোঁয়া ড্রাইভারের পাশে বসেছিল। পেছনে নম্রতা, নীরা আর রঞ্জন। একদম পিছনের দিকটাই অন্তু আর নাদিম। রঞ্জন নম্রতার দিকে ঝুঁকে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,

' কেমন মুডে আছিস নমু?' 

নম্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। চোখদুটো ছোট ছোট করে বলল,

' মানে?' 

' এডভেঞ্চার মুড?' 

' এনিটাইম।' 

নম্রতা হাসল। রঞ্জন বাম চোখটা টিপে দিয়ে হাসল। নীরাকে ইশারা করে বলল,

' গ্যাঞ্জাম নাম্বার ৩।' 

নম্রতা সেই কথাটাই নীরার কানে পৌঁছাল। হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে নিচু গলায় বলল,

' গ্যাঞ্জাম নাম্বার ৩, হবে?' 

নীরা চোখ ঘুরিয়ে তাকাল। কোনো প্রশ্ন না করেই দুনিয়া অন্ধকার করে চেঁচিয়ে উঠল। নম্রতা অস্থির গলায় বলল,

' নীরু? কী হয়েছে? এমন করছিস কেন!' 

নীরা দমবন্ধ গলায় বলল,

' ব... মি। বমি পাচ্ছে। গাড়ি থামাও। নি..নিশ্বাস আটকে আছে আমার! ওয়াক...' 

ড্রাইভার চোখ বড় বড় করে নীরার দিকে তাকাল। নীরার চোখ দুটো উল্টো যাওয়ার উপক্রম। কপালের আশেপাশে ঘাম। কি বিভৎস দৃশ্য। মেয়েটা মরে টরে যাবে না তো! নাদিম খেঁকিয়ে উঠে বলল,

' ওই মিয়া! থামাতে বলতাছে শুনো না? মাইয়ার কিছু হইলে তোমারে খাইছি।' 

ড্রাইভার কয়েক সেকেন্ড দ্বিধা-দন্দে থেকে গাড়ি থামাল। নম্রতা ছোঁয়ার গায়ে পর পর দুটো চড় বসিয়ে দিয়ে বলল,

' তোর ড্রাইভারকে বল একটা মেডিসিনের দোকান থেকে দুটো দুটো....'

এটুকু বলে থেমে গেল নম্রতা। অসহায় চোখে বন্ধুদের দিকে তাকাল। অন্তু ফট করে বলল,

' দুটো নাপা এক্সট্রা ট্যাবলেট আনতে বল।' 

নম্রতা সাই দিয়ে বলল,

' হ্যাঁ। নাপা এক্সট্রা আনতে বল।'

পরক্ষণেই অবাক হয়ে বলল,

' অ্যা! নাপা এক্সট্রা!' 

বন্ধুদের কার্যকলাপ দেখে চোয়াল ঝুলে পড়ার অবস্থা ছোঁয়ার। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলল,

' হ্যাঁ? নাপা এক্সট্রা! নাপা এক্সট্রা দিয়ে...' 

এটুকু বলতেই আবারও আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে বমির ভঙ্গিমা করল নীরা। ছোঁয়া আৎকে উঠল। মাথার চিন্তাশক্তি গুলিয়ে গেল। অন্তু ধমক দিয়ে বলল,

' ওই তব্দা? তোর ড্রাইভারকে ট্যাবলেট আনতে বলবি? নাকি থাপড়া খাবি? নীরুর কিছু হলে তোর দোষ।'

ছোঁয়া থতমত খেয়ে ড্রাইভারকে মেডিসিন কিনতে পাঠাল। ড্রাইভার একরাশ দ্বিধা আর বিরক্তি নিয়ে মেডিসিনের দোকান খুঁজতে গেল। নাদিম এতোক্ষণ চিন্তিত মুখে ম্যাগাজিন দিয়ে নীরার চোখে-মুখে হাওয়া দিচ্ছিল। ড্রাইভার নেমে যেতেই থেমে গেল তার হাত। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে দেখল। তারপর ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। তার সাথে সাথে নেমে দাঁড়াল অন্তু,রঞ্জন। অসুস্থ নীরাও চোখের পলকে সুস্থ,সবল হয়ে উঠল। এক মুহূর্ত নষ্ট না করে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। ছোঁয়া হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করল,

' কী করছিস তোরা? কোথায় যাচ্ছিস? গাড়ি থেকে নামছিস কেন? নীরা? তুই না অসুস্থ!'

সবাই উল্টো পথে দৌঁড় লাগাতে লাগাতে বলল,

' গ্যাঞ্জাম নাম্বার ৩, বলদ। এখনও বুঝস নাই?'

ছোঁয়া দিশেহারা কন্ঠে বলল,

' কিন্তু কেন!' 

নীরা উঁচু গলায় বলল,

' জানি না। আসলে আয় নয়তো তব্দার মতো বসে থাক।' 

বন্ধুদের থেকে জুতসই উত্তর না পেয়ে ব্যাগ কাঁধে নিজেও দৌঁড় লাগাল ছোঁয়া। বন্ধুদের হাবভাব বুঝতে না পেরে মাথা ভনভন করছে তার। আশ্চর্য! কী করতে চাইছে ওরা? ওরা কী ট্যুরে যাবে না? না গেলে বললেই হয়। এতো নাটক কেন? কিছুদূর আসার পর বাস ধরলো ওরা। জনাকীর্ণ বাসে দাঁড়াবার মতো জায়গা নেই। বাসে কোনোরকম ঠেলেঠুলেই দাঁড়িয়ে পড়ল ছয়জন। এই কোণঠাসা বাসে ছোঁয়ার অবস্থা বেকাহিল। ঢাকার লোকাল বাসগুলোতে উঠার অভ্যাস তার নেই বললেই চলে। রঞ্জন বাসের দরজায় ঝুলে রইলো। ওদের তিনজনকে ঘিরে দাঁড়াল অন্তু আর নাদিম। কিছুক্ষণের মাঝেই আড্ডায় মজে উঠল পাঁচজন। একপর্যায়ে গিয়ে পেছন থেকে মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক বাজে ভাবে স্পর্শ করল ছোঁয়ার স্পর্শকাতর স্থানে। ছোঁয়া অসহায় চোখে বন্ধুদের দিকে তাকাল। নাদিমের দিকে কিছুটা সরে আসার চেষ্টা করল। অন্তু নম্রতাকে ইশারা করতেই ছোঁয়ার জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল নম্রতা। বাসে ঝাঁকি লাগতেই পেছনের দিকে হেলে পড়ে দানবীয় ভাবে লোকটির পা মাড়িয়ে দিল নম্রতা। পেন্সিল হিলের ভয়ানক আঘাতে আর্তনাদ করে উঠল লোকটি। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কিছু বলবে তার আগেই অন্তু বলল,

' আহা চাচা। বাসে উঠলে একটু আধটু ধাক্কা খেতেই হয়। ওমন চেঁচামেচি করলে তো চলে না।' 

কিছুক্ষণ পর আবারও একই কাজ করল নম্রতা। লোকটি প্রতিবাদ করতেই নাদিম খেঁকিয়ে উঠে বলল,

' ফাইজলামি পাইছেন মিয়া? ধাক্কাধাক্কি সহ্য না হলে নাইমা যান। কেউ ইচ্ছে করে ধাক্কা দিব ক্যান আপনারে? এতো ফেচফেচ করতাছেন ক্যান?' 

লোকটি আর কথা বাড়াল না। বন্ধুরা আবারও আড্ডায় মাতলো। দুপুরের শেষ ভাগে কেরানীগঞ্জ গিয়ে পৌঁছাল তারা। সেখান থেকে পুরাতন ঢাকা। দুপুর আড়াইটার দিকে পুরাতন ঢাকার একটা রেস্টুরেন্টে পেট পুড়ে খাবার খেলো সবাই। ছোঁয়া উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,

' হেই গাইস? আই থিংক, আই এম ইঞ্জয়িং দিস ট্যুর!' 

নাদিম বিরক্ত কন্ঠে বলল,

' আবার ইংরেজি মারাস। বাংলায় কথা কইতে পারিস না তুই? ইংরেজের বাচ্চা!' 

নীরা হাই তুলতে তুলতে বলল,

' ঝগড়া রাখ। আমরা কী কক্সবাজার যাচ্ছি? নাকি যাচ্ছি না? এতো ঢং করে এখানে আসারই বা কারণ কী?' 

রঞ্জন টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,

' যাচ্ছি।' 

' তাহলে গাড়ি ছাড়লাম কেন?' 

অন্তু দাঁত কেলিয়ে বলল,

' ওইটা ট্যুর ছিল? ওই ড্রাইভারকে সাথে নিলে ট্যুরের বারোটা বাজত। আমরা কক্সবাজারে যাচ্ছি লঞ্চে করে। ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। পাঁচটায় লঞ্চ।' 

ছোঁয়া আৎকে উঠে বলল,

' লঞ্চ! আমি কখনো লঞ্চে উঠি নি। লঞ্চ যদি ডুবে যায়? আর লঞ্চে করে কক্সবাজারে কিভাবে?' 

নাদিম বিরক্ত হয়ে বলল,

' সবাই যেভাবে যায় সেভাবে।' 

নম্রতা খাবার চিবোতে চিবোতে বলল,

' যেতেই তো দু'দিন লাগবে। কক্সবাজার থাকব কখন?' 

রঞ্জন ঠোঁট উল্টে বলল,

' তাই কী? কক্সবাজার তো বহুত গিয়েছি। এবার না হয় আশেপাশের জায়গাগুলোতেই বেশি থাকলাম। সদরঘাট থেকে হালুয়া ঘাট। ওখান থেকে দশটার লঞ্চে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম একরাত থেকে পরের দিন কুতুবদিয়া হয়ে কক্সবাজার। দুইদিনে যাব। একদিন কক্সবাজারে থাকব। চতুর্থদিন সড়কপথে ফিরে আসব।' 

ছোঁয়া হা-হুতাশ করে বলল,

' মাম্মা কে কী বলব? মাম্মা আমাকে মেরে ফেলবে।' 

নাদিম বিরবির করে বলল,

' শুরু হইছে ম্যা ম্যা।' 

সারাদিন পুরাতন ঢাকার এখানে সেখানে ঘুরে, আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিল নম্রতারা। সন্ধ্যা পাঁচটায় সদরঘাটে পৌঁছে নির্দিষ্ট লঞ্চে উঠল তারা। রঞ্জন  দুটো কেবিন বুক করেছে। একটা মেয়েদের জন্য। অন্যটি ছেলেদের জন্য। লঞ্চ সদরঘাট ছাড়লো সন্ধ্যা ছয়টার দিকে। ধীরে ধীরে দৃষ্টি সীমার আড়ালে পড়ল শহরের দূষিত বাতাস। সবাই যার যার মতো ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এসে বসলো রাত আটটার দিকে। কিছুক্ষণ আড্ডা চলার পর হঠাৎই মন খারাপ হয়ে গেল নম্রতার। বন্ধুদের রেখে ডায়েরি হাতে ধীরে ধীরে নিচে নেমে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল সে। রাতের আকাশে মস্ত এক চাঁদ। দিগন্ত বিস্তৃত জলধারায় চকচকে জ্যোৎস্নার আলো। গা কাঁপানো তীব্র বাতাস। নম্রতা বুক ভরে শ্বাস নিলো। টলমলে অনুভূতি নিয়ে ডায়েরিটা খুলে পড়ার চেষ্টা করল। বুক ভরে চিঠির গায়ে থাকা সুঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করল। নম্রতাদের প্রেমের এক পর্যায়ে 'সে' নামক ব্যক্তিটি চিঠির গায়ে সুন্দর এক সুগন্ধি ব্যবহার করত। চিঠি খুলতেই অসাধারণ এক সুগন্ধে বুক ভরে আসত নম্রতার। নম্রতা জিগ্যেস করায় বলেছিল, 

' তুমি যে চিঠিগুলো অসংখ্যবার পড়ো ,জানি। চিঠিগুলো যখন খুলবে। এই গন্ধটা যখন  নাকে লাগবে। ঠিক তখনই, আমার খুব কাছে থাকার অনুভূতি হবে তোমার। তাছাড়া! নীল চিরকুটের সুগন্ধ কী সাধারণ কাগজের মতো সাধারণ হলে চলে? শ্যামলতাই বা বারবার কাগজের এই বিশ্রী গন্ধটা কেন নিবে? শ্যামলতা মানেই তো হাজারও বেলীর সৌরভ!' 

নম্রতার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। চোখদুটো বোজে নিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলো। ঠিক তখনই পেছন থেকে প্রচন্ড ধাক্কায় সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল নম্রতা। এক হাতে রেলিং আঁকড়ে ধরে নিজেকে রক্ষা করলেও হাতের ডায়েরিটা গিয়ে পড়ল টলমলে নদীটিতে। নম্রতা আৎকে উঠলো। সারা শরীর কেঁপে উঠল। ডায়েরিটাকে ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে দেখে মাথা ঘুরে উঠল তার। রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,

' আমার ডায়েরি। নীরু! নীরু! আমার ডায়েরি। রঞ্জন!' 

 নম্রতাকে রেলিং-এর ঝুঁকে পড়তে দেখে পেছন থেকে শক্ত একটি হাত আকঁড়ে ধরল নম্রতার ডান হাত। বিস্ময় নিয়ে বলল,

' আরে! করছেন কী? পড়ে যাবেন তো!' 


শক্ত হাতের টানে রেলিং থেকে সরে দাঁড়াল নম্রতা। চোখে-মুখে আতঙ্ক। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম জল। শরীরটা ভয়ানকভাবে কাঁপছে। নম্রতার ফ্যাকাশে মুখ দেখে সামনে দাঁড়ানো শ্যামবর্ণ মানুষটি আৎকে উঠল। আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,

' আপনি ঠিক আছেন?' 

নম্রতা হিংস্র দৃষ্টিতে সামনে দাঁড়ান মানুষটির দিকে তাকাল। শ্যামকায় দীর্ঘদেহী পুরুষ। শক্তপোক্ত গড়ন। পুরু ভ্রুজোড়ার নিচে গভীর দুটো চোখ। গায়ে বাদামী রঙের পাতলা শার্ট। হাতাদুটো কনুই পর্যন্ত গুটানো। ডানহাতে ল্যাপটপ। নম্রতা বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল মানুষটির ওপর। হাত থেকে ল্যাপটপটা ছিনিয়ে নিয়ে  রেলিং-এ দুই দফা আছাড় লাগাল। শ্যামকায় মানুষটি বিস্ময়ে হতভম্ব। নম্রতা ল্যাপটপটা নদীতে ছুঁড়ে ফেলতেই সম্বিৎ ফিরে এলো মানুষটির। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে ভয়ানক গমগমে কন্ঠে বলল,

' পাগল আপনি? কী করলেন এটা? আপনার কোনো ধারণা আছে? আমার কত বড় ক্ষতি করলেন আপনি।' 

ততক্ষণে নম্রতার বন্ধুরা নিচে নেমে এসেছে। নম্রতাকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে বিস্মিত তারা। রঞ্জন আতঙ্কিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

' নমু? ঠিক আছিস? কী হয়েছে? এভাবে কাঁপছিস কেন?' 

নাদিম ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

' এই শালায় কিছু করছে নাকি তোরে? ক খালি। এইহানেই পু্ঁইতা ফেলুম। কি হইছে?' 

নাদিম আর রঞ্জনের উঁচু কন্ঠে আরো কিছু যুবক পেছনে এসে দাঁড়াল। সামনের দিকে উঁকি দিয়ে কপাল কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়লো তাদের একজন,

' এনিথিং রং আরফান? কি হয়েছে রে?'

রাগে স্তব্ধ আরফান রক্তলাল চোখে বন্ধুর দিকে তাকাল। 

' শী ড্যামেজড মাই ল্যাপটপ।' 

' মানে?' 

' নদীতে ছুঁড়ে ফেলেছে ল্যাপটপ। ভাবতে পারছিস? আমার রিসার্চের পুরো ফাইল ছিল ল্যাপটপে।' 

' কিহ! কিন্তু কেন? এই মেয়ে? পাগল নাকি আপনি? আপনার কোনো ধারণা আছে কী করেছেন আপনি? এসব পাগল ছাগলকে লঞ্চে উঠতে দেয় কে?' 

নীরা ফুঁসে উঠে বলল,

' একদম ফালতু কথা বলবেন না। নমু অযথা হাঙ্গামা করার মেয়ে নয়। আপনার বন্ধু কী করেছে সেটা আগে বিবেচনা করুন। লঞ্চে উঠেও থার্ডক্লাস স্বভাব যায় না আপনাদের? দেখে তো ভদ্রলোকই মনে হচ্ছে। কী করেছেন আমার ফ্রেন্ডের সাথে? বলুন।' 

দুই দলের মধ্যে তুমুল হট্টগোলের মধ্যেই হাউমাউ কান্নায় ভেঙে পড়ল নম্রতা। মুহূর্তেই থেমে গেল হট্টগোল। সবাই বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল কান্নারত মেয়েটির চোখে-মুখে। নম্রতার বন্ধুরা অস্থির হয়ে উঠল। লঞ্চের পাটাতনে হাঁটু গেঁড়ে বসে থাকা নম্রতার পাশে ধপ করে বসে পড়ল নীরা-ছোঁয়া। নম্রতা দু-হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে ডুকরে উঠছে। কান্নার শব্দটা বিশাল জলরাশিতে ঘুরেফিরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কী বিষাদময় সে কান্না! আরফানের বন্ধুরা কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করল,

' কী হচ্ছে এসব দোস্ত? কাহিনীটা কী? কাঁদছে কেন এই মেয়ে?' 

আরফান বিপন্ন কন্ঠে বলল,

' আমি কী করে বলব? কেবিনে যাচ্ছিলাম হঠাৎ ইশতিয়াক ধাক্কা দিল। ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারি নি। উনার সাথে শরীরটা একটু লাগতেই দেখি নিচের দিকে ফিরে চিল্লাপাল্লা করছেন। ভাবলাম পড়ে যাচ্ছেন। হাত টেনে সরিয়ে আনতেই নাটক শুরু করল। উফ! আমার রিসার্চ রিপোর্ট!' 

নীরা অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বলল,

' এই নমু? এভাবে কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে? বল আমাদের।' 

কান্নায় শ্বাস আটকে আসছে নম্রতার। জোরে জোরে শ্বাস টেনে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল নম্রতা। জড়ানো কন্ঠে বলল,

' আম আমার ডায়েরি!' 

এটুকু বলেই গগনবিহারী চিৎকারে কান্নায় ভেঙে পড়ল নম্রতা। অন্তু কপাল কুঁচকে বলল,

' কী হয়েছে ডায়েরির?' 

' পা পা পানিতে ফেলে দিয়েছে এই লোক।' 

আরফান অবাক হয়ে বলল,

' আমি! কখন!' 

আরফানের বন্ধু কড়া মেজাজে বলল,

' ফাজলামো পাইছেন নাকি? একটা ডায়েরির জন্য আপনি গোটা ল্যাপটপ ছুঁড়ে ফেলবেন? ল্যাপটপের দাম জানেন? একটা ল্যাপটপে কত ইম্পোর্টেন্ট ডকুমেন্টস থাকতে পারে ধারণা আছে?' 

এবার রেগে উঠল নাদিমও। খেঁকিয়ে উঠে বলল,

' একটা ডায়েরি মানে কী? আপনার ল্যাপটপ থেকে ওর ডায়েরি কম দামী নয়। ফিল দ্যা ইমোশন।' 

রাগে মাথার ভেতরটা ধপধপ করছে আরফানের। নাদিমের কথায় রাগটা যেন দপ করে জ্বলে উঠল তার। অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের কন্ঠে বলল,

' আচ্ছা! আপনাদের কাছে নিজেদের বস্তাপঁচা আবেগ এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে অন্যের.... ' 

এটুকু বলতেই অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে গেল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে হিংস্র বাঘিনীর মতো আরফানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করল নম্রতা। হতভম্ব আরফান দু'পা পিছিয়ে দাঁড়াল। নম্রতার হাঁতের আচঁড়ে কব্জির ওপর দিকটার চামড়া উঠে জ্বালাপোড়া করছে। রঞ্জন দু'হাতে জাপটে ধরে নম্রতাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাল। নম্রতা চেঁচিয়ে উঠে বলল,

' খবরদার বস্তাপঁচা আবেগ বলবেন না। আমার ডায়েরি আমার আবেগ নয়, ভালোবাসা।' 

নীরা দু'হাতে মুখ চেপে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম নম্রতাকে এমন উদ্ভট আচরণ করতে দেখছে সে। নম্রতার মতো বিচক্ষণ, প্রাণোবন্ত মেয়ে এমন গেঁয়ো, অসভ্য আচরণ কী করে করতে পারে? বিশ্বাস হয় না নীরার। কয়েকটা চিঠি আর কয়েকটা বছরে কী থেকে কী হয়ে গেল মেয়েটা? রঞ্জন নম্রতাকে জোরপূর্বক পাঁজাকোলে নিয়ে নিজেদের কেবিনের দিকে হাঁটা দিল। যেতে যেতে আরফানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

' সরি ভাইয়া। আসলে ও একটু ডিপ্রেসড।' 

আরফান জবাব দিল না। আরফানের পাশে থাকা বন্ধুটি ঝাঁঝ নিয়ে বলল,

' নিজের ডিপ্রেসড গার্লফ্রেন্ডকে সামলায় রাখেন মিয়া। লঞ্চ না তো নাট্যশালা। নাটক শুরু করে দিছে একেকজন। আজাইরা।' 

নাদিম খেঁকিয়ে উঠে বলল, 

' তুই সরি কইলি ক্যান? নমুর এই অবস্থা না থাকলে শালাগো দেইখা দিতাম আজকে।' 

অতঃপর আবারও কথা কাটাকাটির সূত্রপাত হলো। রঞ্জন দাঁড়িয়ে না থেকে নম্রতা, নীরাকে নিয়ে তিন তলায় নিজেদের কেবিনের দিকে রওনা দিল।

কেবিনের পাটাতনে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে নম্রতা। মাথাটা হাঁটুর ওপর নুয়ানো। কান্নার দামকে কিছুক্ষণ পর পরই কেঁপে উঠছে শরীর। কেবিনের দরজায় হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জন। তারপাশে চিন্তিত অন্তু। ছোঁয়া-নীরা বিছানার উপর বসে আছে। নাদিম বারান্দার রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মুখই থমথমে। স্তব্ধ নীরবতাকে ঠেলে দিয়ে কথা বলে উঠল ছোঁয়া। হতাশ কন্ঠে বলল,

' কী একটা কাহিনী করে ফেলল নমু। ছিঃ মানুষ কী ভাবছে! এতোটা সীনক্রিয়েট করার কী প্রয়োজন ছিল? এমন গেঁয়ো আচরণ কী নমুর সাজে? আমাদের কতটা লো ম্যান্টালিটির ক্ষেত ভাবছে তারা।' 

ছোঁয়ার কথার জবাবে টু শব্দটি পর্যন্ত করল না কেউ। কেবল কড়া চোখে তাকাল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভয়ানক রাগে ধমকে উঠল নাদিম,

' তুই তো জন্মগত ক্ষেত ম্যান্টালিটির মহিলা। বন্ধুর দুঃখে তোর মানসম্মানের প্রশ্ন আসছে। তোরে এই মুহুর্তে লঞ্চ থেকে ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। নদীতে হাবুডুবু খেতে খেতে ম্যান্টালিটি বিচার করবি। বেয়াদব।'

নাদিমের কথায় নিভে গেল ছোঁয়া। বেচারী এতোদিক ভেবে বলেনি কথাগুলো। কী থেকে কী হয়ে গেল! বিরবির করে বলল,

' লোকটা তো আর ইচ্ছে করে ডায়েরি ফেলে দেয় নি। ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছে। নমু যে তার ল্যাপটপটাই ফেলে দিল।'  

নাদিম কপাল কুঁচকে বলল,

' তো? যেভাবেই ফেলুক। ফেলেছে তো? আর নমুই বা ইচ্ছে করে ফেলল কোথায়? রাগের মাথায় ফেলে দিয়েছে। রাগ উঠলে মানুষ যেকোনো কিছু করতে পারে। অত ধরতে আছে? ওই শালাদের উচিত নমুর  পা ধরে মাফ চাওয়া। এদের নামে আমি মামলা করব। মানহানির সাথে ডায়েরিহানির মামলা।'

এমন একটা পরিস্থিতিতেও নাদিমের কথায় ঠোঁট চেপে হেসে ফেলল সবাই। নাদিম সব সময়ই এমন। বন্ধুরা হাজার দোষ করলেও সব দোষ মাফ। এমনকি পরীক্ষায় নাম্বার কম পেয়ে বন্ধুদের মন খারাপ হয়ে গেলেও সব দোষ স্যারের। বন্ধুরা তো পরীক্ষা দিয়েছিলই শালার স্যার যদি নাম্বার না দেয় তাহলে বন্ধুদের কী দোষ? এসব স্যারকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া উচিত। নম্রতাকে হাজার বুঝানোর পরও যখন তার কান্নার গতি কমলো না। তখন সবার মিলিত সিদ্ধান্তে একা ছেড়ে দেওয়া হলো তাকে। পাঁচজনে গিয়ে বসল বারান্দায়। কীভাবে নম্রতাকে স্বাভাবিক করা যায় তা নিয়ে চলল তুমুল আলোচনা। আধঘন্টা- একঘন্টার মাঝে কান্নার বেগ কিছুটা কমে এলো নম্রতার। বামপায়ে থাকা সাদা পায়েলটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে খুলে নিল হাতে। পায়েলটাকে খুব যত্ন করে বুকের সাথে চেপে ধরে চোখ বোজল। দীর্ঘসময়ের কান্নায় মাথাটা ধপধপ করছে তার। চোখদুটো ভয়ানক জ্বলছে। সেই সাথে জ্বলছে অবুঝ, অভাগা মন।

তখন এপ্রিল মাস চলছিল। বাংলায় বসন্ত। ঋতুরাজ সেবার রাজার মতোই দাপট নিয়ে এসেছিল নম্রতার জীবনে। ষোলো বসন্ত পেরিয়ে  সতেরোতে এসে সুগন্ধি ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিয়েছিল নম্রতার জীবন। নম্রতাদের প্রমালাপনের তখন প্রায় দেড় বছর চলে। কারো মুখে ভালোবাসার শব্দ উচ্চারিত না হলেও দু'জনেই জানে ভালোবাসাহীন শব্দগুলোর গভীরতা। ভালোবাসার স্পষ্ট প্রকাশও খুব বেশিদিন চাপা থাকতে পারল না। ওপাশের মানুষটি খামে পুড়ে পাঠাল উথাল-পাতাল প্রেম বার্তা। নম্রতার এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছিল মাত্র। প্রথম পরীক্ষাটা দিয়েই মা-বাবাকে ছাইপাঁশ বুঝিয়ে চলে গিয়েছিল শাহাবাগ। ক্লান্ত শরীরে এক ঝাঁক আশা নিয়ে হাতে তুলে নিয়েছিল চির পরিচিত বইটি। প্রত্যাশিত চিঠিটা পেয়ে বুক ভরা উত্তেজনা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল সে। বাড়ি ফিরে চিঠিটা খুলেই চমকে উঠেছিল নম্রতা। লজ্জায় লাল হয়েছিল। আবেগে কেঁদে-কেটে চোখ ফুলিয়েছিল। অপরিচিত মানুষটার সেই প্রেমময় চিঠি পড়লে আজও একই রকম কেঁপে কেঁপে উঠে নম্রতা। পাগল করা অনুভূতিতে দমবন্ধ হয়ে আসে। আচ্ছা? কী এমন মেশানো ছিল সেই চিঠিতে? নম্রতা জানে না। কিন্তু সেই চিঠিটা পড়লে আজও রাতে ঘুম হয় না। চিঠির শব্দবানে আহত হয়ে ঘুম কাতর নম্রতার রাতের ঘুম হারাম হয়। সারাটা রাত ক্ষণে ক্ষণে চিঠিটা পড়ে কেঁদে বুক ভাসায়। আবার কখনো লাজুক হাসিতে মত্ত হয়। নম্রতা চিঠির লাইনগুলো মনে করার চেষ্টা করল। মুহূর্তেই মুখস্থ হয়ে যাওয়া লেখাগুলো চোখের পাটাতনে স্পষ্ট হয়,

' প্রিয়.....

চলো একবার প্রেমে পড়ি। অদ্ভুত নীল ব্যথায় মড়িয়া হয়ে উঠি দুটো প্রাণ। দিনশেষে তুমি একটু কাঁদো। চোখের নিচে ছড়িয়ে পড়া কাজল রেখায়, আমি একটু মুগ্ধ হই। দীর্ঘ বিচ্ছেদ শেষে হঠাৎ দেখা হলে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ঠিক সেভাবেই আমার রুক্ষ বুকটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ো। আমার বুকে চলা নিত্য দিনকার টানাপোড়েন, চেনা জানা ঝড়গুলো একবারের জন্য হলেও থেমে যাক। তোমার কান্নাভেজা ফোলা চোখে একটি বার আমি ডুবে যাই। লাল-নীল ব্যথাগুলো রক্তে রক্তে ঘুরে বেড়াক। তোমাকে পাওয়ার তীব্র বাসনায় আমি একটু ছিন্নভিন্ন হই। তোমাকে দেখার আকুতিতে চোখের ঘুমগুলো মুক্তি পাক। তোমাকে হারানোর ভয়ে গভীর রাতে আমার পুরুষ চোখে জল নামুক। চলো শ্যামলতা, আমরা একবার প্রেমে পড়ি। মারাত্মক প্রেমে আহত হয়ে যাই দুজনেই। প্রেমময় ব্যথায় কেঁপে কেঁপে উঠি। 

ইতি 
শ্যামলতার ব্যক্তিগত সে '

সেই চিঠিতেই প্রথম নিজের সম্বোধনে কিছু একটা লিখছিল সেই মানুষটি। চিঠির সাথে কসটেপে আটকে দিয়েছিল অসম্ভব সুন্দর এক পায়েল। সেই সাথে ছিল কয়েকটি চ্যাপ্টা হয়ে থাকা বেলীফুল। কী তীব্র সুগন্ধ ছিল সেই বেলীফুলের। নম্রতা সারারাত নাকের কাছে নিয়ে বসেছিল সেই চিঠি। পায়েলটা পায়ে জড়িয়ে অযথায় ঘুরে বেড়িয়েছে পুরো ঘর জুড়ে। যখনই পায়েলে রিনঝিন শব্দ উঠেছে তখনই মনে হয়েছে সেই মানুষটি হাসছে। নম্রতার পাগলামোতে ঝংকার দিয়ে হেসে উঠছে সে। সারারাত ছটফট করে পরের দিন সকালেই গ্রন্থাগারে ছুঁটে গেল নম্রতা। গ্রন্থগারের গেইটে বিশাল তালা ঝুলতে দেখে মনে পড়ল, আজ শুক্রবার। শনিবারেও বন্ধ থাকবে গ্রন্থাগার। হতাশ, চঞ্চল, অস্থির নম্রতার পরের দু'দিন পড়াশোনা কিছু হলো না। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষাটা সে কোনোরকম না পড়েই সমাধা করল। দিন-রাত 'সে' 'সে' করেই মন- মস্তিষ্ক জমাট বেঁধে গেল তার। রবিবার সকালে উঠেই গ্রন্থাগারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। গ্রন্থাগার খুলতেই নীল রঙা খামে নিজের পায়েল পরা পায়ের একটা ফটো রেখে দিল নম্রতা। ধুরুধুরু বুক নিয়ে গ্রন্থাগার থেকে বেরিয়েই সেকী লজ্জা তার। কে জানে? পায়ের ছবি দেখে কী ভাববে সে? ছবিটা পাঠানো কী ঠিক হলো? এমন সব দ্বিধামাখা প্রশ্ন নিয়েই কেটে গেল প্রায় একটা সপ্তাহ। অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তা নিয়েই একের পর এক পরীক্ষা সমাধা করল নম্রতা। পুরোপুরি এক সপ্তাহ পর আকাঙ্খিত চিঠিটা এলো। টকটকে নীল রঙা দুটো কাগজ ভরে শুধু একটাই লাইন,

' তোমার পায়ের তিলটা নেশাতুর। ভাবনাতীত সুন্দর।' 

সেই এক লাইন দিয়ে ভর্তি চিঠিটা পেয়ে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল নম্রতার। বুকের ভেতর থাকা হৃদপিণ্ডটা কী দ্রুতই না কাঁপছিল। আজও, আজও উপলব্ধি করতে পারে নম্রতা। আজও তার শরীরে ঘাম ছুটে। মুখটা হয় লজ্জায় রক্তিম। তারপর চিঠির উল্টো পাশে লেখা ওই লাইনটা, ' আমি মারাত্মক প্রেমে আহত। শ্যামলতাকে না পেলে এই প্রেমিকের মৃত্যু অনিবার্য!'  ইশ! মানুষটা কী অসভ্য কথা লিখেছিল সেদিন। প্রতিটি শব্দকে লজ্জার সাগরে জিইয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মেরেছিল নম্রতার সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত শরীরে। এই লজ্জাবান কী মারাত্মকভাবেই না বিঁধেছিল নম্রতার প্রেমাহত মনে!  নম্রতা শিউরে উঠে। ডায়েরি হারানোর ব্যথায় ভেতরটা চিনচিন করে উঠে! এই নিষ্প্রয়োজন জীবনটা নিয়ে কী করবে নম্রতা?


সকাল সাতটায় লঞ্চ হালুয়াঘাটে এসে পৌঁছাল। কেবিনের বিছানায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা নম্রতার ঘুম ভাঙল সবার পর। বন্ধুরা তখন ব্যাগ কাঁধে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। নম্রতা ভারী মাথা নিয়ে উঠে বসল। নীরা নিজের আর নম্রতার ব্যাগটা পাশে রেখে নম্রতার কপালে হাত রাখল। কপাল কুঁচকে বিজ্ঞদের মতো মুখভঙ্গি করে বলল,

' জ্বর তো কমই মনে হচ্ছে। হাঁটতে পারবি?' 

নম্রতা কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। আশ্চর্য! রাতে তার জ্বর এসেছিল? নীরা আবারও একই প্রশ্ন করতেই মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল নম্রতা। মাথাটা ভার ভার লাগছে। চোখে-মুখে পানি ছিঁটাতে পারলে হয়ত কিছুটা শান্তি লাগত। চোখদুটোতেও ব্যথা হচ্ছে খুব। নীরার সহযোগীতায় চোখে-মুখে পানি দিয়ে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে কেবিন থেকে বেরুতেই একটা পেটমোটা ডায়েরি ধরিয়ে দেওয়া হলো হাতে। নম্রতা প্রশ্নমাখা চোখে বন্ধুদের দিকে তাকাতেই নাদিম দাঁত কেলিয়ে বলল,

' এই ডায়েরিতে মোট পয়ত্রিশটা চিঠি আছে দোস্ত। কাল রাত জাইগা এই চিঠিগুলো লিখছি আমরা। যখনই মন খারাপ হবে বসে বসে পড়বি। আমরা কী কম সুন্দর চিঠি লিখি নাকি? তোর পত্রপ্রেমিক থেকে একটু কম ভালো হলেও ভালোই লিখি।' 

কথাটা বলে থামল নাদিম। নম্রতার দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে গলা খাঁকারি দিল। তারপর ফিসফিস করে বলল,

' শোন, আমার চিঠিগুলাতে দু-একটা বানান ভুল হইতে পারে।' 

নম্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাতেই ঠোঁট উল্টে বলল,

' আচ্ছা যা সাত-আটটা ভুল হইতে পারে। ব্যাপারটা ইগনোর করিস। চিঠি লেখাটাই ফ্যাক্ট। কয়টা বানান ভুল হলো সেটা কিন্তু ফ্যাক্ট না।' 

নম্রতা ঠোঁট চেপে হাসল। হাতে থাকা রোদ চশমাটা পরে নিয়ে বাঁকা হাসল অন্তুও। কৌতুক করে বলল,

' তোর ফিসফিসানি কথা পুরো লঞ্চের মানুষ শুনছে ভাই। মানসম্মান আর রাখলি না। ঢাবির স্টুডেন্ট হয়ে বাংলা বানান ভুল? আস্তাগফিরুল্লাহ!' 

নাদিম গুজগুজ করে বলল,

' ধুর বাল! ইংরেজিতে এসাইনমেন্ট লিখতে লিখতে মাতৃভাষা ভুলে যাচ্ছি। ইউ শ্যুড প্রটেস্ট, বুঝলি? এই স্যারেরা কোনো কাজের না। আকামের ঢেঁকি সব।' 

নাদিমের কথায় ঠোঁটে হাসি নিয়ে মাথা নাড়ল সবাই। ব্যাগ কাঁধে লঞ্চ থেকে নামার উদযোগ করল। নাদিম লঞ্চ থেকে নামতে নামতে অন্তুর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,

' আজ এতো মাঞ্জা মারছ মামা? কাহিনী কিতা? কোন সুন্দ্রীকে গায়েল করতে চায় তোমার মন? হ্যাঁ হ্যাঁ?' 

অন্তু চমৎকার এক হাসি দিয়ে বলল,

' তোর বোনেরে। হেব্বি দেখতে। আমার হাতে তুলে দে। পরের বছরেই মামা ডাকার সু্যোগ-সুবিধা ফ্রী।' 

নাদিম অন্তুকে লাথি দিয়ে বলল,

' তুই আসলেই খারাপ। শালা হারামখোর।' 

অন্তু হু হা করে হেসে উঠে বলল,

' শালা ডাকছ কেন শালা? দুলাভাই ডাক। শালা তো ডাকুম আমি। শালা, ও শালা। শালা মশাই।' 

অন্তুর কথায় অন্তুকে ধাওয়া করল নাদিম। ভীরে মাঝে ছুটতে ছুটতে বলল,

' তোরে তো আজ খাইছি।' 

অন্তু-নাদিমের কথায় হেসে উঠলো বাকিরা। ভীরের মাঝে উচ্ছল হাসি নিয়ে ছুটতে থাকা দু'জন তরুনের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল অনেকেই। ছোঁয়া-নীরা কিছুটা এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে দৌঁড়ে এসে নম্রতার পাশাপাশি হাঁটতে লাগল রঞ্জন। নম্রতার হাত থেকে লাগেজটা নিজের হাতে নিয়ে অন্যহাতে সানগ্লাস পরল। নম্রতার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকাল,

' কী রে? খুদা টুদা পেয়েছে তোর?' 

নম্রতা ম্লান হেসে মাথা নাড়ল। নাদিমের দেওয়া ডায়েরিটির দিকে দৃষ্টি রেখে বুক ভরে শ্বাস নিল। ঠোঁটের হাসি ধরে রেখে বলল,

' আমি ঠিক আছি দোস্ত। চিন্তা করিস না।' 

রঞ্জন প্রথমেই কিছু বলল না। সামনের ভীরটা অতিক্রম করার পর মুখ খুলল,

' ভাগ্যে বিশ্বাস করিস নমু?' 

' হু, করি।' 

' তাহলে সবটা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দে। সবকিছুর পেছনেই তো কোনো না কোনো কারণ থাকে। তোর কিশোরী বয়সের প্রথম প্রেমিক হারিয়ে যাওয়া। স্মৃতিময় ডায়েরিটা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া সবকিছুর পেছনেও নিশ্চয় কারণ আছে। সৃষ্টিকর্তা হয়ত এমন কিছুই চাইছেন। লাইফে মুভ অন কর। অতীত খামঁচে ধরে পড়ে থাকলে তো চলে না। অন্য কাউকে সুযোগ দে। সুযোগ না দিলে বুঝবি কী করে? মানিয়ে নিতে পারবি নাকী পারবি না?' 

নম্রতার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। রঞ্জনের চোখের দিকে তাকাতেই জমে থাকা জলটুকু মুক্ত হলো। সূর্যের আলোয় ফর্সা গালে জলের রেখাগুলো চিকচিক করে উঠল। রঞ্জনের পুরুষ মন ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

' যে প্রেমিকের তরে এই রমণীর চোখ ভাসে। সেই নিঃস্ব প্রেমিকের কী কখনও মন হাসে?' 

দূর থেকে নাদিমের দৃষ্টি আকর্ষণময় ডাকে ভাবনা কাটল রঞ্জনের। তাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা রেস্তোঁরার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নাদিমরা। রঞ্জন তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তেই দৃঢ় কন্ঠে বলল নম্রতা,

' জীবনের সব পরিস্থিতিতে যুক্তি খাটে না দোস্ত। অনুভূতির মামলায় যুক্তি বেচারা বড্ড অসহায়। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। আমি পারছি না সরে আসতে। আর না পারতে চাইছি। আর না এই বিষয়ে কোনরূপ ডিসকাশন শুনতে চাইছি। চারটা বছর ধরে এইসব কথায় শুনে আসছি আমি। আর কত?' 

এক দমে কথাগুলো বলে নিয়েই দ্রুত পা চালালো নম্রতা। রঞ্জন দৌঁড়ে গিয়ে ওর সঙ্গ নিল। বলল,

' আচ্ছা বেশ। আলোচনা-সমালোচনার দরকার নেই। তুই যেমন আছিস থাক শুধু হ্যাপি থাক। মন খারাপ করে থাকিস না। আচ্ছা, গান শুনবি?' 

নম্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। সুদর্শন রঞ্জন মন ভুলানো হাসি দিয়ে গলা ছেড়ে সুর টানলো,

' আমার কাছে তুমি মানে সাত রাজার ধন
আমার কাছে তুমি মানে অন্যরকম।
আমার কাছে তুমি মানে আমার পোষা পাখি,
দিনে রাইতে চোখ বুজিয়া তোমায় আমি দেখি।
তোমার কাছে হয়তো বন্ধু আমি কিছু না,
তাইতো তোমার স্বপ্নে বন্ধু আমি আসি না।
আমি মানে তুমি আর তুমি মানে আমি,
আমার কাছে আমার চেয়ে বন্ধু তুমি দামী।' 

রঞ্জনের গান শুনে সেখান থেকেই গিটারে সুর তুলল নাদিম। উটপটাং লাফাতে লাফাতে চেঁচাতে লাগল,

' আহা! আহা!' 

অন্তু মসৃণ ছিটি বাজিয়ে সুন্দর হাসল। নম্রতা হেসে ফেলে রঞ্জনের ধুমধাম কিল বসাল। হাসি ফুটল নীরা আর ছোঁয়ার ঠোঁটেও। রঞ্জনের গান থামল না। রেস্তোরাঁয় কোণার একটা টেবিল ঘিরে বসে একের পর এক গান চলতে লাগল আড্ডায়। নাদিম গিটার আর অন্তু টেবিল বাজিয়েই আড্ডা জমিয়ে তুলল। রঞ্জনের অদ্ভূত গানে কখনও বা সুর মেলাতে লাগল, কখনও-বা হেসে কুটি কুটি হতে লাগল নীরা-নম্রতা-ছোঁয়া। রেস্তোঁরায় থাকা অধিকাংশ খদ্দের মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল সোনালি সকালে ফুটে উঠা একদল উচ্ছল তরুণ-তরুণীদের। সকালের নাস্তা এলো ডিম,পরোটা আর দই। ধীরে সুস্থে নাস্তা শেষ করে চারপাশটা ঘুরে ফিরে দেখল ওরা। কিছুক্ষণ পা ছড়িয়ে ঘাটে বসে রইল। সমস্বরে গান গাইল। সারাটাক্ষন ফূর্তিতে মেতে রইল প্রতিটি প্রাণ। দশটায় লঞ্চ আসতেই তাড়াহুড়ো করে উঠে গেল তাতে। উদ্দেশ্য কুতুবদিয়া। লঞ্চ ছাড়ার পর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল সবাই। ঠিক তখনই মন খারাপের মেঘ এসে জমা হলো নম্রতার আকাশে। সেই সাথে এলো কান্না। এতোক্ষণ চেপে রাখা আক্রোশগুলো চামড়া ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইল।চিঠির ওপাশের মানুষটির কলার চেপে বলতে ইচ্ছে করল, ' কেন করলে তুমি এমন? সত্যিই হারালে? নাকি ধোঁকা দিলে? আমাকে মরণ যন্ত্রণায় ফেলে এভাবে পিছুতে পারলে তুমি? একটুও কষ্ট হলো না?' এই উত্তরগুলোর জন্য হলেও নম্রতা তাকে খুঁজতে চায়। অপেক্ষা করতে চায়। এই উত্তরগুলো না পেলে যে তার ভালো থাকা হচ্ছে না। কিছুতেই না। তাছাড়া, ওই বেয়াদব লোকটিকেও ছাড়বে না নম্রতা। আবার দেখা হলে, শক্ত কয়েকটা চড় লাগাবে। ধাক্কা দিয়ে ডায়েরি ফেলে দিয়ে আবার আবেগ নিয়ে ছেরখানি! এতো বড় সাহস! 

কুতুবদিয়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হলো। এখানকার স্থানীয় একটা হোটেলে উঠেছে তারা। আজকের রাতটা কাটিয়ে সকালের লঞ্চে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পৌঁছাবে। অন্ধকার আকাশে মেঘ করেছে। ঝড় হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। চারপাশে উলোট পালোট হাওয়া। সেই হাওয়ায় উড়ে চলেছে নীরার অস্থির চুল, ওড়না। বারান্দার থামে ঠেস দিয়ে ফোনালাপ সারছে সে। চোখে-মুখে চাপা উৎকন্ঠা। হরিণীর মতো টানাটানি চোখে অল্পবিস্তর দ্বিধা। খানিক দূরে বসে থেকে এসবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল অন্তু। আড্ডায় মশগুল রঞ্জন, নাদিম একপর্যায়ে থেমে গেল। অন্তুর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে নীরার দিকে তাকাল। দু'জনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে একে অপরের দিকে তাকাল। নাদিম ফট করে বলে ফেলল,

' এইবার ঢাকায় ফিইরা তোগো দুইডারে কাজি অফিসে ঢুকাইয়া তালা মাইরা দিমু। খুলতাম না। তোগো এসব পারু-দেবদাসের কাহিনী আর ভাল্লাগতাসে না।' 

অন্তু কপাল কুঁচকাল। দৃঢ় কন্ঠে বলল,

' ক্যারা দেবদাস? ওর জন্য দেবদাস হওয়া লাগব? এতো বাজে দিন আসে নাই আমার।' 

' হ। ওইডা তো তোর চোখ দেখলেই বুঝা যায়। দোস্তের দিকে এমন কামুক দৃষ্টিতে তাকাইতে তোর বিবেকে বাজে না?' 

অন্তু নিরুত্তাপ কন্ঠে বলল,

' প্রথম যখন তাকাইছিলাম তখন তো আর দোস্ত ছিল না। সাধারণ সুন্দরী মেয়ে ছিল। দেখতেই প্রেমে পড়ে গেলাম। আর সেও আমাকে ফ্রেমেবন্ধী করার পায়তারা করতে লাগল। এই মেয়ের যন্ত্রণাতেই মরে যাব একদিন, দেখিস।' 

রঞ্জন ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

' বুঝিয়ে বললেই পারিস।' 

' আর কত বুঝাব? তিনটা বছর ধরে তো বুঝাচ্ছিই। আমি কী দেখতে খুব খারাপ? আমার মধ্যে পছন্দ করার মতো কিচ্ছু নাই? একটা গুণও না?' 

কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠল অন্তুর। চোখদুটো হয়ত একটু টলমলও করে উঠল। রঞ্জন অন্তুর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,

' কি বলিস এগুলো? তুই আর খারাপ দেখতে? মাইয়ারা তাহলে কী দেইখা পটে যায়, বল তো মামা। ফালতু চিন্তা বাদ দে। নীরা বুঝবে। সময় দে ওরে।' 

নাদিম অসহায় চোখে তাকাল। হতাশ কন্ঠে বলল,

' এল্লায় ভাল্লাগে না বাল। নীরুর জায়গায় অন্যকেউ হইলে থাপড়া মাইরা ঠিক কইরা ফেলতাম। কিন্তু নীরুও তো আমাগোই দোস্ত। কারে কী কই বল তো? যন্ত্রণার এক শ্যাষ। শালা তুই প্রেমে পড়ার জন্য আর কোনো মেয়ে পাইলি না?' 

অন্তু ঠোঁটে চাপা হাসি নিয়ে বলল,

' পাইছিলাম তো। তোর বোনেরে। দিলি না। ছ্যাঁকা!' 

নাদিম ওর দিকে তেড়ে এসে বলল,

' তোর লাইগা হুদ্দাই সেমপ্যাথি আসে। তোরে তো মাইরা ফেলানো উচিত।' 

' তোর বোনের জন্য জান কুরবান শালা মশাই।'

রঞ্জন এবার হুহা করে হেসে উঠে। নাদিমের মুখ তখন রাগে আগুন।


ছাই রঙা বিশাল আকাশে রুটির মতো গোলকার এক চাঁদ। জ্যোৎস্না যেন ঠিকরে পড়ছে। সমুদ্রের হিংস্র ঢেউগুলোর গাঁ চিকচিক করে উঠছে উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার রূপালী আলোয়। বিশাল ঢেউগুলো শুভ্র ফ্যানা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বালিময় তীরে। নগ্ন পায়ে  অগোছালো পদক্ষেপগুলো জলের তোড়ে মিশিয়ে দিয়ে মহমান্বিত গর্জনে কাঁপিয়ে তুলছে চারপাশ। অন্ধকার মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাউগাছগুলো প্রচন্ড বাতাসে তির তির করে কাঁপছে। কাঁপছে নম্রতার লম্বা চুল, ওড়নার আঁচল। মুগ্ধ চোখদুটো তাকিয়ে আছে বহুদূরে। বিশাল আকাশ আর সমুদ্র,  পরম ভালোবাসায় যেখানে মিলেমিশে একাকার হয়েছে ঠিক সেখানটাতে। কী আশ্চর্য সুন্দর এই পৃথিবী! কী আশ্চর্য সুন্দর আকাশ আর সমুদ্রের এই স্বর্গীয় মিলন! নম্রতা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ফোনালাপে ব্যস্ত রঞ্জন। চোখে-মুখে চাপা তৃপ্তির আভাস।

' কী করছ?' 

' বিচে আছি। বালির ওপর খালি পায়ে হাঁটছি। যখনই ঢেউ এসে পা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই তোমাকে প্রচন্ড মিস করছি।' 

ওপাশ থেকে নারীকণ্ঠী অভিমানী কন্ঠে বলল,

' চাপা! মিস করছ না ছাই।' 

' আরে! সিরিয়াসলি খুব মিস করছি। এই মুহূর্তে তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। তুমি জানো, তোমার রঞ্জন মিথ্যা বলে না।' 

ওপাশের কন্ঠস্বরটা এবার খানিক নরম হলো। আবেগী কন্ঠে বলল,

' আমিও।' 

রঞ্জন মন খারাপ ভাব নিয়ে বলল,

' তোমাকে বললাম সাথে এসো। রাজি হলে না। কী হতো এলে?' 

ওপাশ থেকে মৃদু হাসির শব্দ পাওয়া গেল। মিষ্টি কন্ঠে বলল,

' বন্ধুরা মিলে ট্যুরে গিয়েছ সেখানে গার্লফ্রেন্ডের কী কাজ? সবারই একটা পার্সোনাল স্পেস দরকার। আমি তোমায় ভালোবাসি বলে যে তোমাকে সবসময় আমার মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখব তা ঠিক নয়। আমার বাইরেও তোমার একটা জগৎ আছে। বন্ধুমহল আছে। আমার সাথে কাটানো সময়গুলোতে যেমন তুমি শুধু আমার থাকো। আমাকেই ভাবো। তেমনই ফ্রেন্ডদের সাথে সময় কাটানোর সময় শুধু এই তুমিটা শুধু ওদের হয়েই থাকা উচিত। আমি সাথে থাকলে তুমি কাকে রেখে কাকে সময় দিতে?' 

রঞ্জন হাসল। চাঁদের আলোয় ফর্সা মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠল। মুগ্ধ কন্ঠে বলল,

' তুমি এখন সামনে থাকলে ঝাঁপিয়ে পড়ে চুমু খেতাম তোমার গালে। এইজন্যই তোমাকে এতো ভালোবাসি পূজা। পরিস্থিতিগুলোকে এতো ভালোভাবে বুঝো কিভাবে বল তো?' 

পূজা লাজুক হেসে বলল,

' কই বুঝি? তুমি আমায় যতটা বুঝো ততটা তো বুঝে উঠতে পারি না। আচ্ছা? তোমার বন্ধুরা নেই পাশে?' 

' আরে নাহ। সব কটা নাক ঢেকে ঘুমাচ্ছে। বিচে শুধু আমি আর নমু। ওর নাকি ঘরে দম আটকে আসছিল। মেয়েটা ঠিকঠাক ঘুমায় বলেও মনে হয় না আমার। কতটা পাগল হলে কিছু চিঠিকে পুঁজি করে বছরের পর বছর অপেক্ষা করা যায় ভাবো!' 

পূজা দুঃখী কন্ঠে বলল,

' ওর ডায়েরিটার জন্য খুব খারাপ লাগছে আমার। সেদিন সব শোনার পর কী মনে হয়েছিল জানো?' 

' কী?' 

' আমার কাছে ম্যাজিক থাকলে। চোখের পলকে ডায়েরিটাকে নদী থেকে তুলে হাতে ধরিয়ে দিতাম তার। খুব খুশি হতো না?' 

রঞ্জন শব্দ করে হেসে উঠল। আদুরে কন্ঠে বলল,

' পাগলী।' 

' আচ্ছা? ওই লোকটাকে কী কোনোভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না? আমি কালই পূজো দেব।  প্রার্থনা করব নম্রতা যেন খুব শীঘ্রই তার পত্রপ্রেমিককে পেয়ে যায়। ভগবান আমার কথা না রেখে পারবেই না।' 

' এইতো শুরু হলো তোমার অন্ধ বিশ্বাস।' 

' আচ্ছা? তুমি কী নাস্তিক?' 

' নাস্তিক কেন হব?' 

' তাহলে সবসময় ধর্মের কথায় নাক সিটকাও কেন? জীবনেও তো মন্দিরে যেতে দেখলাম না।' 

' নাস্তিক না হলেই তোমাদের মন্দিরে গিয়ে মাথা কুটতে হবে? কী আশ্চর্য! শুনো, আমি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি, একজন আছেন যিনি আমায়, এই পুরো সৃষ্টিজগৎকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু.... ' 

পূজা অধৈর্য্য হয়ে বলল,

' হয়েছে। আপনার এই যুক্তি বহুত শুনেছি। একদম মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দয়া করে, আমার বাবার সামনে এসব কথা বলো না। আমার বাবা কিন্তু  গোঁড়া হিন্দু। তোমার এসব কথায় চেঁতে যেতে দু-মিনিটও লাগবে না।' 

রঞ্জন প্রত্তিত্যুরে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে নম্রতাকে দেখতে না পেয়ে আৎকে উঠে বলল, 

' নমুকে আশেপাশে দেখছি না পূজা। আমি তোমাকে পরে কল করি?' 

পূজা বিস্ময় নিয়ে বলল,

' সে-কি! আচ্ছা, ঠিক আছে। খুঁজে পেলে ইনফর্ম করো।' 

' আচ্ছা।'

কথাটা বলেই তাড়াহুড়ো করে ফোন কাটল রঞ্জন। ভয়ার্ত চোখে এদিক-ওদিক তাকাল। যতদূর চোখ যাচ্ছে জনমানবহীন বালুকাময় তীর। মুহূর্তেই কোথায় চলে গেল মেয়েটা? 

সমুদ্র তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে কতদূর পৌঁছে গিয়েছে নিজেও জানে না নম্রতা। শুধু জানে সমুদ্র তাকে টানছে। অদ্ভুত সুন্দর এই জলরাশি জ্যোৎস্না স্নান করতে করতে নিবিড়ভাবে হাতছানি দিচ্ছে তাকে। পরনের লাল ওড়না আর লম্বা চুলগুলো উচ্ছল কিশোরীর মতো লাফালাফি করছে। শরীর থেকে ছিঁটকে হাওয়ায় হাওয়ায় মাতোয়ারা হতে চায়ছে। নম্রতা সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ  উদাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বেশ কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে হাঁটু ছুঁই ছুঁই পানিতে গিয়ে দাঁড়াল। সমুদ্রের শীতল বাতাস ঝাপটে পড়ছে নম্রতার গায়ে। নম্রতা চোখ বোজলো। বুক ভরে শ্বাস টেনে নিয়ে দু'পাশে দু-হাত প্রসারিত করল। নম্রতার মোমের মতো ফর্সা মুখটা চাঁদের আলোয় ঝলক দিয়ে উঠল। নম্রতার হঠাৎ করেই মনে হলো, সে উড়ছে। বাতাস, চুল, উড়নার আঁচলের সাথে তার হালকা পাতলা শরীরটাও যেন ভাসছে। চারপাশে সমুদ্ররাজ ভয়ানক গর্জন তুলে হাসছে। নম্রতার চোখের পাতায় ভেসে উঠল সে-ই আশ্চর্য সুন্দর দিনটি। নম্রতার 'সে' নম্রতাকে প্রেম নিবেদন করার পর পরই শুরু হয়েছিল তাদের সুখময় প্রেম। কী সুন্দর ছিল সেই দিনগুলি। নম্রতা একবার খুব আবেগ নিয়ে লিখেছিল, 

' শুনো,

আমরা একটা ঘর বাঁধব। ছোট্ট একটা ঘর। ছনের বনের চাল থাকবে। আধভাঙ্গা দেয়াল থাকবে। ভাঙা দেয়ালের ফাঁক গেলে এক পশলা জ্যোস্না আসবে। ছোট্ট ঘরের এক কোণায় পুরানো এক লন্ঠন থাকবে। হাতের তৈরি শিকা থাকবে। সেগুলোতে হরেক রকম রঙ থাকবে। আর শোন? পোষা একটা টিয়া থাকবে। আমাদের এই ছোট্ট ঘরে তারও ছোট্ট ঘর থাকবে। তুমি প্রতিদিন গঞ্জে যাবে.....আমার জন্য মুঠো ভরা লাল ফিতে আর আলতা আনবে। চাঁদের আলোয় গা ভিজিয়ে নদীর পানি ঝলমলাবে। সেই আলোতে মত্ত হয়ে আমার পায়ে আলতা আঁকবে। বৃষ্টি ভেজা রাতগুলোতে তোমার বুকে সিঁটিয়ে রাখবে। আর শোন? যখন ছোট্ট ঘরের পাঁচিল বেয়ে ঝরঝরিয়ে জল গড়াবে আমরা তখন ছোট্ট পাত্রে মিষ্টি সেই জল কুঁড়াব। আমাদের আধভাঙ্গা এক চৌকি থাকবে। নড়তে চড়তেই আনন্দে সে খিলখিলাবে। শক্ত একটা তোশক আর শিমুল তুলোর বালিশ থাকবে। সেই বালিশে মাথা রেখেই তুমি আমার মন ভুলাবে। ছোট্ট ছোট্ট হাঁড়ি-পাতিল আর ছোট্ট কিছু বাসন থাকবে। ছনের বেড়ায় গুঁজে রাখা ছোট্ট একটা আরশি থাকবে। মাঝ দুপুরে, তপ্ত সময় ফুঁড়ে দিয়ে প্রাণখোলে গান গাইবে। দুষ্টুমিতে মত্ত হয়ে ভালোবাসায় মাতাল হবে। আমি লজ্জা পাব, এত্ত এত্ত গাল ফুলাব। এই শুনছ তুমি? আমরা কিন্তু ছোট্ট একটা ঘর বাঁধব! 

ইতি 
শ্যামলতা' 

চিঠিটা লিখে নম্রতার সে-কি লজ্জা। পাঠাবে কী পাঠাবে না সে নিয়ে কতো যে দুর্ভাবনা। শেষ পর্যন্ত চিঠিটা পাঠিয়েছিল নম্রতা। দু'দিনের মাথায় কাঙ্ক্ষিত উত্তরও পেয়েছিল। নীল কাগজের পরিবর্তে সাদা কাগজের জমিনে লাল আলতা দিয়ে লেখা হয়েছিল সেই উত্তর। চিঠির ওপর পেঁচানো হয়েছিল লাল ফিতা। লাল আলতায় গুটি গুটি অক্ষরে লিখেছিল,

' শ্যামলতা! 

তুমি কী জানো? তুমি আমায় আজকাল বড্ড জ্বালাচ্ছ। আমি ঠিকঠাক পড়তে পারছি না। হুটহাট মন জুড়ে বর্ষা হয়ে ঝড়ে পড়ছ। সেদিন কী হয়েছিল জানো? গভীর রাতে আমি পড়ছি। ঘড়িতে একটা কী দুইটা বাজে। হঠাৎ দরজায় কড়া নেড়ে ঘুম ঘুম চোখে ডাকাডাকি করছে নিদ্রা। আমি বিস্ময় নিয়ে দরজা খুলতেই সে বলল, 'ভাইয়া?তোর কী অসুখ করেছে? কখন থেকে পড়ার মতো সুর করে বলছিস "শ্যামলতা, শ্যামলতা"। কাহিনী কী?' ওর কথায় আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। তুমি ভাবতে পারছ? আমি নাকি আধাঘন্টা যাবৎ পড়ার বদলে শ্যামলতা শ্যামলতা বলে জপ করছি অথচ আমি নিজেই জানি না। তারপর আবারও এক কান্ড ঘটালাম। কাল তোমার চিঠিটা পেয়েই ইচ্ছে জাগল তোমার পায়ে আলতা আর চুলে লাল ফিতা জড়াব। কিন্তু আমাদের এই অসম দূরত্বের প্রেমে সে এক প্রকার অসম্ভবই বলা চলে। কিন্তু মন বাবাজি সম্ভব-অসম্ভবের ব্যাখা শুনতে নারাজ। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আলতার রঙে চিঠি লিখব। সাথে থাকবে লাল ফিতে। এই আলতা জোগাড় করতে কত পেরেশানি করতে হয়েছে জানো? নিদ্রার যন্ত্রণায় ধরা খেয়ে গিয়েছি বাসায়। ছেলে পকেটে আলতা আর লাল ফিতা না ঘুরে বেড়াচ্ছে, মায়ের জন্য এ-যেন এক ভয়ানক কান্ড। বাসায় হুলস্থুল বাঁধিয়ে মান-সম্মান শেষ। কী লজ্জায় পড়তে হয়েছিল বুঝতে পারছ? দু'দিন ধরে সবাই কেমন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। আমি তাকাতেই মিটমিট করে হাসছে। তুমি আমার কী ভীষণ সর্বনাশ করলে বলো তো? এই সর্বনাশটা কী করে ঢাকব আমি? আচ্ছা শ্যামলতা? এই সর্বনাশা সর্বনাশ ঢাকার পরিবর্তে সমান তালে আরও কিছু সর্বনাশ করে ফেললে কেমন হয়? শ্যামলতার সর্বনাশের দায় নিয়ে সর্বনাশা, সর্বগ্রাসী হওয়ার মতো প্রাপ্তি কী আর কিছুতে আছে? 

বিঃদ্রঃ আলতা আর ফিতা কী তোমার পছন্দ হয়েছে? তোমার বাকি চাওয়াগুলো নাহয় দেখা হলেই পূরণ করব।

ইতি
শ্যামলতার ব্যক্তিগত সে' 

চিঠির কথাগুলো মনে পড়তেই নম্রতার ফর্সা গালে লাল আভা ফুটল। পরমুহূর্তেই খিলখিল করে হেসে উঠল নম্রতা। সমুদ্রের গর্জনে চাপা পড়ে গেল সেই উচ্ছল হাসির শব্দ। ঠিক তখনই ডানহাতের বাহু ধরে হেঁচকা টান দিয়ে সরিয়ে আনা হলো তাকে। বিস্মিত পুরাষালী কন্ঠ বলে উঠল,

' পাগল নাকি আপনি? তীরে লাল চিন্হ উড়ছে দেখছেন না? এখন ভাটার সময় । ঢেউয়ের টানে চোখের নিমিষেই হারিয়ে যেতে পারতেন। এই অসময়ে কেউ পানিতে নামে?'

নম্রতা চোখ তুলে তাকাল। কালো রঙের টি-শার্ট গায়ে সুঠাম দেহী এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। চোখে মোটাফ্রেমের চশমা। চাঁদের আলোয় চেহারা ভালো বুঝা যাচ্ছে না। তবুও চিনে ফেলল নম্রতা। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকেই ভ্রু কুঁচকে তাকাল। রাগান্বিত কন্ঠে বলল,

' আপনি!' 

সামনে দাঁড়ানো মানুষটাও বোধহয় খানিক চমকাল। কপাল কুঁচকে বলল,

' ওহ শিট্। আপনি লঞ্চের ওই পাগল মেয়েটা না?' 

নম্রতা যেন আরও একটু জ্বলে উঠল এবার। তেড়ে এসে বলল,

' আমাকে দেখে পাগল মনে হয়?' 

আরফান ভারি অবাক হয়ে বলল,

' মনে হয় মানে? আমি তো হান্ড্রেড টেন পার্সেন্ট শিওর যে আপনি পুরোদস্তুর পাগল।' 

নম্রতার ডায়েরি হারানোর জ্বালাটা আবারও তীব্র রূপ ধারণ করল। আরফানের দিকে তেড়ে যেতেই দু'পা পিছিয়ে গেল আরফান। এমন সময় দূর থেকে দৌঁড়ে এলো তিনটি ছেলে। নম্রতার কাছাকাছি এসে হাঁটুতে ভর করে জোরে জোরে শ্বাস নিল। নাদিম কোমরে হাত রেখে হাঁপাতে লাগল। গর্জে উঠে বলল,

' ওই হারামি! তোরে আজকে সমুদ্রের পানি খাওয়াইতে খাওয়াইতে মাইরা ফেলমু আমি। শালী!  তোরে খুঁজতে গিয়ে জীবন শ্যাষ! রঞ্জন তো ভয় দেখায় দিছিল বাল। উফ! মাইয়া মানেই যন্ত্রণা।' 

নাদিম থামতেই আরফানের পেছনে এসে দাঁড়াল একটি লোক। ফর্সাটে গোলগাল মুখ। চোখে-মুখে  জ্ঞানী জ্ঞানীভাব। ফর্সা চামড়ায় লাল টকটকে ঠোঁট। লোকটি হালকা ঝুঁকে নম্রতাকে নিরক্ষণ করে বলল,

' আরফান? কি হয়েছে দোস্ত? এভাবে ছুটে এলি যে?' 

বন্ধুর কথায় ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল আরফান। বিরক্ত কন্ঠে বলল,

' আর বলিস না। দু'দিন যাবৎ এক পাগলকে বাঁচাতে গিয়েই বারবার মানসম্মান খাওয়াতে হচ্ছে আমায়। '

' মানে? বুঝলাম না।' 

' এই ভাটার সময়ে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে সমুদ্র বিলাস করছিলেেন এই রমণী। আমি ভালো বুঝে বাঁচাতে গেলাম। সে উল্টো আমার ওপরই অখুশি। সাচ আ ফলিস গার্ল।' 

নম্রতা আবারও তেড়ে গিয়ে বলল,

' খবরদার বাজে কথা বলবেন না। আমার অতো বড় একটা ক্ষতি করে এখন মহৎ সাজতে এসেছেন?' 

আরফান দু-পা পিছিয়ে গিয়ে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল,

' দেখ নিষাদ। কেমন অসভ্য মেয়ে। কার্টেসী বলতে কিছু নেই। আমার ল্যাপটপটা ওভাবে ফেলে দিয়েও বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই। ইচ্ছে করছে....' 

নিষাদ হু হা করে হেসে উঠল। আরফানের কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকে শান্ত হতে বলল। নাদিম উশখুশ করে বলল,

' নমু? বাদ দে বইন। ঝগড়া টগড়া কইরা লাভ নাই। এই ভাই খুব একটা মিছা বলে নাই। তোর মাথায় এল্লা ওল্লা ছিট দেখা দিতাছে। এই রাইতে কেউ একলা একলা এতোদূর আহে? তারওপর পানিতে নামে?' 

নম্রতা চোখ-মুখ লাল করে নাদিমের দিকে তাকাল। রঞ্জন এক পা এগিয়ে গিয়ে আরফানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

' সৌভাগ্যবশত আপনাদের সাথে আবার দেখা হয়ে গেল। আর দূর্ভাগ্যবশত আবারও এমন একটা সীনক্রিয়েট হলো। সরি ভাইয়া, আসলে নমু একটু ডিপ্রেশড।' 

আরফান কিছু বলার আগেই পাশ থেকে নিষাদ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

' ইট'স ওকে। সুন্দরী মেয়েদের টুকটাক ভুল মাফ করা যায়। আমি নিষাদ আহমেদ নিরব। বর্তমানে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির লেকচারার। আর ও হলো ডক্টর আরফান আলম। বন্ধুদের সাথে ট্যুরে এসেছি। আর আপনারা?'  

রঞ্জন ডানহাতটা বাড়িয়ে দিয়ে মৃদু হাসল। বলল,

' আমি রঞ্জন চক্রবর্তী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজি থার্ড সেমিস্টারে পড়াশোনা করছি। ওরা আমার বন্ধু। নাদিম হোসেন, অন্তু তালুকদার আর নম্রতা মাহমুদ। আমরাও ট্যুরে এসেছি।' 

নিষাদ বিনয়ী হাসি দিয়ে বলল,

' তোমরা তো তাহলে আমাদের থেকে বেশ কয়েক বছরের জুনিয়র হবে। অলমোস্ট সাত/ আট বছর। তাই না আরফান?' 

আরফান ভদ্রতার হাসি দিয়ে মাথা নাড়ল। দু'পক্ষের পরিচিতি পর্ব শেষ হতেই বিদায় নিয়ে যার যার হোটেলে রওনা হলো। হোটেলের পথে ফিরতে ফিরতে হঠাৎই প্রশ্ন করল নাদিম,

' ওই লেকচারটাকে তুই চিনিস নমু?' 

নম্রতা অবাক হয়ে বলল,

' কোন লেকচারার?' 

' আরে, একটু আগে কথা হইলো না? নিষাদ না বিষাদ নাম কইলো।' 

নম্রতা আরেক দফা অবাক হয়ে বলল,

' আমি ওই ব্যাটাকে চিনব কেন?' 

নাদিম কপাল কুঁচকে বলল,

' তাহলে ওই পোলায় তোরে চিনে কেমনে?' 

নাদিমের কথায় তিনজোড়া চোখ তার উপর এসে নিবদ্ধ হলো। রঞ্জন চোখ ছোট ছোট করে বলল, 

' ওই ব্যাটায় নমুকে চিনে তোরে কে বলল?' 

' ফেরার সময় স্পষ্ট শুনলাম। এই লেকচারারে আরফান ভাইকে বলছে, " রাগিস না দোস্ত। ছেড়ে দে। মেয়েটা আমার পরিচিত।" ' 

নাদিমের কথায় তিনজনই অবাক চোখে একে অপরের দিকে তাকাল। নম্রতার কপালে ভেসে উঠল চিন্তার ভাঁজ। এই লোক কী করে চিনবে তাকে? কই?  সে তো চিনে না।


দুপুরের খাবার শেষ করে নম্রতাদের ঘরেই আড্ডা বসিয়েছে বন্ধুরা। বাইরে মুষলধারায় বৃষ্টি। পরিষ্কার কাঁচের জানালায় জমে আছে ফোঁটা ফোঁটা জল। উত্তাল সমুদ্রের গর্জন আর বৃষ্টির শব্দ মিলেমিশে তৈরি হয়েছে নতুন এক সুর। সেই সুরে মাতোয়ারা হয়েই প্রলংয়কারী নৃত্যে মত্ত হয়েছে ঝাউগাছের সারি আর নারিকেল গাছের বহর। কাল শেষ রাতের দিকেও তিন নম্বর বিপদ সংকেত ছিল সৈকতে। সকালের দিকেও আবহাওয়া ছিল চলনসই। কিন্তু দুপুর দিকে হঠাৎই কোথা থেকে উড়ে এলো এক আকাশ কালো মেঘ। শুরু হলো ভয়ানক বর্ষণ। সমুদ্র সৈকতে জারি করা হলো সাত নম্বর বিপদ সংকেত। দুপুরের পর পরই বাসের টিকেট কাটা হয়েছিল নম্রতাদের। পরশু থিওরি পরীক্ষা।রাতের মাঝে ঢাকায় ফেরা যখন চাই-ই চাই ঠিক তখনই শুরু হলো বৃষ্টিকন্যার ইচ্ছেবিলাস। বৃষ্টিকন্যার এহেন ন্যাকামোতে টিকেটগুলোর সাথে সাথে ধরা বাঁধা সময়টাও ভেস্তে গেল। নম্রতা, নীরা কফি হাতে বিছানার হেড বোর্ডে ঠেস দিয়ে বসে আছে। নাদিম বিছানার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। একটু পর পর হাতে থাকা গিটারে টুং টাং আওয়াজ তুলছে। ডানপাশের ধবধবে সাদা সোফায় বসে আছে রঞ্জন। এক হাতে কফি কাপ, অন্যহাতে ফোন। অন্তু কার্পেটের ওপর পা গুটিয়ে বসেছে। কোলের ওপর ল্যাপটপ। কোলের পাশেই ধোঁয়া উঠা কফি কাপ। ছোঁয়া বসে আছে বিছানার এক কোণায়। চশমাটা নাকের ডগায় এসে ঠেকেছে। গায়ে ভারী কম্বল জড়ানো। ছোঁয়া কফি কাপটি পাশের টেবিলে রেখে ঠোঁট উলটালো। কপাল কুঁচকে বলল,

' আচ্ছা? ওই লোকটা নমুর ওই পত্র প্রেমিক হতে পারে না? আই মিন, কো-ইন্সিডেন্সলি। পৃথিবীতে কতশত কাকতালীয় ব্যাপার ঘটছে। এটা কী তাদের মধ্যে একটা হতে পারে না?' 

ছোঁয়ার বোকা কন্ঠে বলা কথায় পাঁচজোড়া চোখ তার উপর এসে নিবদ্ধ হলো। প্রতি জোড়া চোখ পলকহীন তাকিয়ে আছে তার চেহারায়। ছোঁয়া অস্বস্তিতে পড়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,

' সরি! আসলে নমু সেদিন বলছিল, লোকটির নামের প্রথম অক্ষর 'এন' হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। আবার তোরা যে লোকটির কথা বলছিস, কী যেন নাম? নিরব-নিষাদ হোয়াটএভার সেই নামটাও 'এন' দিয়েই শুরু। তিনি ভার্সিটির লেকচারার। দেট'স মিন ব্রাইট স্টুডেন্ট। নমুর ভাষ্যমতে নমুর পত্রপ্রেমিকও ব্রাইড স্টুডেন্ট ছিল। বর্ণণাটা মিলে যায়। ওই হিসেবে, ভুল করেই বলে ফেলেছি কথাটা। আই থিংক, আই ওয়াজ রং। সরি!'

কেউ কোনো জবাব দিল না। আগের মতোই তাকিয়ে রইল চুপচাপ। তারপর হঠাৎ-ই সটান উঠে বসলো নাদিম। অতিরিক্ত উত্তেজনায় ছোঁয়াকে একটা শক্ত ধাক্কা দিয়ে সবার চোখে চঞ্চল দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

' হোয়াট আ থিংকিং! এভাবে তো ভাইবা দেখি নাই।' 

ছোঁয়া উলটে পড়তে পড়তে সামলে নিল। নাদিমের দিকে রক্তচক্ষু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিছানা থেকে সরে সোফায় গিয়ে বসল। রঞ্জন নম্রতার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ভ্রু নাচাল। কৌতুক মাখা কন্ঠে বলল,

' কি রে? হতে পারে নাকি এমন কো-ইন্সিডেন্স? কাল তো কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে ছিল। ফিল টিল পাসনি কিছু?' 

নম্রতা বিরক্ত কন্ঠে বলল,

'এটা কি কোনো সিনেমা নাকি যে পাশে দাঁড়ালেই লায়লীর মতো ফিল টিল চলে আসবে? আমি তাকে কখনই দেখিনি। পাশে দাঁড়ায়নি। কাছে যাইনি। তার বাহ্যিক কিছুই জানা নেই আমার। জানার মধ্যে জানি শুধু মন। তার মন পড়া ব্যতীত অন্যকিছু জানার সুযোগই হয়ে উঠেনি কখনও।' 

নাদিম মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে বলল,

' ছাতার মাথা প্রেমে করো তোমরা। এই যুগে এসে এমন রঙিলা প্রেম কাহিনি দ্বিতীয়টি দেখার সুভাগ্য কারো হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।' 

নম্রতা প্রত্যিত্তুরে কিছু বলল না। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জানালার বাইরের দিকটায়। সাদা সাদা বৃষ্টির ফোঁটায় ঝাপসা হয়ে এসেছে প্রকৃতি। সমুদ্রের উচ্ছ্বাসটা হয়ে উঠেছে লাগামহীন পাগলা ঘোড়া। অন্তু ল্যাপটপটা পাশে রেখে হাত-পা ছড়িয়ে বসল। ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

' নিষাদ নামক লোকটিই যদি নম্রতার প্রেমিক হয়ে থাকে তাহলে ব্যাটা চূড়ান্ত ধুরন্ধর। সে নিশ্চয় লুকিয়ে চুরিয়ে নমুকে দেখেছে। হয়তো ফলোও করেছে।' 

নীরা কপাল কুঁচকে বলল,

'লোকটা যদি নমুকে দেখেই থাকে তাহলে এই তিন-চারবছরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল না কেন? স্ট্রেঞ্জ!' 

নাদিম আবারও বিছানায় হাত-পা মেলে শুয়ে পড়ল। গিটারে একটা বিরহী টুন বাজিয়ে নিয়ে বলল,

' সবচেয়ে বড় কথা এই দুইটা আবালের ব্রেকআপ কেমনে হইল? ওই বলদ? তোগো ব্রেকআপ কেমনে হইলো রে?' 

' ব্রেকআপ হয়নি।' 

নাদিম সরু চোখে তাকাল। আরেক দফা ওঠে বসে বিস্মিত কন্ঠে বলল,

' হয়নি?' 

নম্রতা সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দুই দিকে মাথা নেড়ে জানাল, 'না, হয়নি।' নাদিম মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে আবারও বিছানায় গা এলালো। চোখ-মুখ বিকৃত করে বলল,

' একেই বলে পিরিত!' 

ছোঁয়া অত্যন্ত ঘৃণাভরা চাহনি দিয়ে বলল,

' ভাষার কি ছিঁড়ি! ছিঃ!' 

অন্তু অধৈর্য্য কন্ঠে বলল,

' তাহলে তোদের সম্পর্কের সমাপ্তিটা কোথায়?' 

' সমাপ্তি!' 

শব্দটা উচ্চারণ করেই উদাস ভঙ্গিতে বসে রইল নম্রতা। তারপর ধীর কন্ঠে বলল,

' সমাপ্তি তো হয়নি কখনও। এভাবে কী সমাপ্তি হয়? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা চলছিল তখন। এদিকে দেখা করার জন্য মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল 'সে'। সেইসাথে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিলাম আমিও। আমাদের দেখা হবে, কথা হবে, সম্পর্কটা নতুন এক রূপ পাবে এসব আলোচনায় চলছিল সপ্তাহের পর সপ্তাহ। দু'জনই দু'জনের জন্য বিরাট এক সারপ্রাইজ হিসেবে অপেক্ষা করছিলাম। সিদ্ধান্ত হয়েছিল ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষা শেষ হলে দেখা করার দিন-তারিখ ঠিক করব আমরা। রবীন্দ্র সরোবরেই দেখা হবে আমাদের। আমার পরনে থাকবে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি আর ওর গায়ে নীল পাঞ্জাবি। হাতে থাকবে বেলীফুলের মালা। সেই মালা  নিজ হাতে বানাবে সে। নিজ হাতেই পরিয়ে দেবে আমার খোঁপায়। খুশিতে আত্মহারা আমরা অপেক্ষার প্রহর গুণছিলাম। কবে ভর্তি পরীক্ষা শেষ হবে? কবে? এক সময় ভর্তি পরীক্ষা শেষ হলো। আমি তাকে চিঠি দিলাম কিন্তু চিঠির জবাব এলো না। একদিন, দু'দিন করে সপ্তাহ পেরুলো। মাস পেরুলো। আজ তিনটা বছর পেরিয়ে গেল, চিঠির জবাব এলো না।' 

এটুকু বলে থেমে গেল নম্রতা। ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগল ছয়টি মানুষের দীর্ঘশ্বাস। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর প্রশ্ন করল রঞ্জন,

' আমি একটা বিষয় বুঝতে পারছি না। তোদের চিঠি দেওয়া-নেওয়াটা এতো সময় চলল কী করে? লাইব্রেরিতে অনেক মানুষ যায়। অন্যকারো হাতে কেন পড়ল না চিঠিটা? তাছাড়া, বই পরিষ্কার করতে গিয়েও কি বইয়ের জায়গা পরিবর্তন হতো না? সেইসব চিঠি কারো চোখে পড়ত না? ব্যাপারটা কেমন সিনেম্যাটিক!' 

নম্রতা ম্লান হাসল। সোজা হয়ে বসে, বেশ উৎসাহ নিয়ে বলল,

' তুই বোধহয় গ্রন্থগারের বর্তমান অবস্থা জানিস না রঞ্জন। গ্রন্থগারের বই এখন হাতেগুনা কয়েকজন ছাড়া কেউ পড়ে না বললেই চলে। সবাই গ্রন্থগারে বসে নিজেদের নোট বুক, গাইড বুক মুখস্থ করে চাকরী বা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেই ব্যস্ত। পড়াশোনার জন্য গ্রন্থগারের পরিবেশ অতিরিক্ত ভালো বলেই গ্রন্থগারে এতো ভীর। সাহিত্যচর্চার জন্য নয়। তারওপর দর্শনের ওই পেটমোটা বই? কে পড়বে? আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলেই হয়তো চিঠিটা তার হাতে পৌঁছেছিল। নয়তো চিঠি বাবাজি সেখানেই ইতিহাস হয়ে রয়ে যেত। তাছাড়া, গ্রন্থগারে প্রত্যেক ক্যাটাগরির আলাদা আলাদা সেল্ফ থাকে। আমাদের চিরপরিচিত বইটা মাঝে মাঝে স্থান পরিবর্তন করলেও ঘুরেফিরে ওই একই সেল্ফের মাঝেই ঘোরাফেরা করত। খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হতো না।' 

রঞ্জন ঠোঁট উল্টে বলল,

' বাপরে!' 

ছোঁয়া হঠাৎই আর্তনাদ করে উঠে বলল,

' পরশু যে আমাদের সিটি আছে, মনে আছে তোদের? এই বৃষ্টিতে ফিরব কিভাবে আমরা? প্রিপারেশনও নেই একদম।' 

নাদিম দায়সারা কন্ঠে বলল,

' সিটির কথা আপাতত ভুলে যা। আজ আবহাওয়া ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। আর কাল বিকেলের আগে আমরা বাসে উঠছি বলেও মনে হচ্ছে না।' 

ছোঁয়া চোখ বড় বড় করে বলল,

' মানে! কিন্তু কেন?' 

রঞ্জন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,

' ওই ব্যাটা কোন হোটেলে উঠেছে জানি না। আশেপাশের কোনো হোটেলে উঠার সম্ভাবনাই বেশি। কাল সারাদিন হোটেলে হোটেলে ঘুরে ব্যাটাকে খুঁজে বের করব। রহস্যাদ্ধার করব। তারপর বিকেলের গাড়ি ধরে ঢাকা।' 

পড়াশোনায় অতিরিক্ত সিরিয়াস ছোঁয়া বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। নাদিম গিটারে রোমান্টিক টুন বাজিয়ে বেসুরে কন্ঠে তাল মেলাল। ছোঁয়ার রাগ তখন সপ্তম আকাশে। নাদিমকে জাস্ট সহ্য হচ্ছে না তার। এমন বেয়ারা ছেলে সে দ্বিতীয়টি দেখেনি। রঞ্জন ফোন হাতে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,

' এই ভেজা ভেজা আবহাওয়ায় আমার রেজিস্ট্রি ছাড়া বউটাকে ভীষণ মনে পড়ছে। আমি প্রেম করতে যাচ্ছি। খবরদার ডিস্টার্ব করবি না।' 

রঞ্জনের পিছু পিছু গিটার হাতে উঠে গেল নাদিমও। ছোঁয়া হতাশ কন্ঠে বলল,

' ইয়া মাবুদ! সিটির কী হবে তাহলে?'  

অন্তু এক গাল হেসে বলল,

' এতো বেশি পকপক করিস কেন বল তো? সিটি নিয়ে টেনশন নিস না। স্যারকে ম্যানেজ করে নেব কোনোভাবে। পানিশমেন্ট হিসেবে এক্সট্রা এসাইনমেন্ট করতে দিতে পারে। তাতেই বা কী? লাইব্রেরি তো আছেই। সবাই মিলে কমপ্লিট করে ফটোকপি করে নেব। কাহিনী খতম।' 

অন্তু যত তাড়াতাড়ি খতম করে ফেলল তত তাড়াতাড়ি খতম হলো না ব্যাপারটা। ছোঁয়ার গলায় মাছের কাঁটার মতো আটকে রইল। কিছুক্ষণ পর পর পরীক্ষার চিন্তায় ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে পড়তে লাগল। সবচেয়ে বড় কথা বাবা-মাকে কী অজুহাত দেবে সে? ছোঁয়ার মাথা ঘুরছে। এই লম্পট বন্ধুবান্ধবের চক্করে তার ছোট্ট বোকা বোকা মাথাটা প্রায়ই ঘোরাঘুরি করে। কখনও কখনও ভয়ে জ্ঞানও হারায়। তবুও বন্ধুদের ছাড়া যায় না। আর না তাদের থেকে গড়পরতার পাত্তাটুকু পাওয়া যায়। নম্রতা সেই কখন থেকেই নিশ্চুপ বসে আছে। শরীরটা মৃদু কাঁপছেও। গা জুড়ে জ্বর জ্বর বোধ হচ্ছে। সত্যিই কি ওই লোকটাই সে? আর যদি এমনটাই হয়ে থাকে তাহলে তাকে কী করে চিনে? আর যদি চিনেও থাকে তাহলে এত লুকোচুরি কিসের? এমন অপরিচিতের মতো ব্যবহারই বা কেন? আর কেন-ই বা এই হারিয়ে যাওয়ার খেলা? কষ্ট হয় না তার? নম্রতা আর ভাবতে পারে না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সারা শরীর ঝিমঝিম করে আসে। আচ্ছা? সে কি মারা যাচ্ছে? ভয়ানক কালমৃত্যু কি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে তাকে? না, তার তো মরে গেলে চলবে না। ওই মানুষটির মুখ থেকে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর না শুনে মরণের কথাটাও যে ভাবা যায় না। কিছুতেই না।

পরের দিন সকালের খাবার শেষ করেই নিষাদকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল সবাই। আকাশে তখন উজ্জ্বল সূর্য। আগের দিনের বৃষ্টির দাপটে চারপাশটা ঝকঝক করছে। আকাশও পরিষ্কার। গাছের পাতাগুলোও হয়ে উঠেছে স্বচ্ছ, সুন্দর। দশটা নাগাদ বেরিয়ে দু-তিনটা হোটেলে চক্কর কেটে দুপুর দুটোর দিকে নিষাদের সন্ধান পেল তারা। রিসেপশনিস্টকে জিগ্যেস করতেই বিনীত কন্ঠে উত্তর দিল, ' নিষাদ আহমেদ নীরব নামের লোকটি আজ সকালেই চেইক আউট করেছেন।' কথাটা শুনেই মাথায় বাজ পড়ল তাদের। যোগাযোগের জন্য নাম্বার চাইতেই উত্তর এলো, ' সরি, কারো নাম্বার দেওয়াটা হোটেলের নিয়ম বহির্ভূত।' রিসেপশনিস্ট মেয়েকে ইনিয়েবিনিয়ে উচ্চ মাপের প্রসংশা করেও নাম্বার পাওয়া গেল না। নাদিম রাগ নিয়ে বিরবির করে বলল,

' বালের রুলস। থাকুনের হোটেলে এতো কিসের রুলস! ন্যাকামোর একশ্যাষ। এই নর্তকী গো দিন-রাইতে চড়ানো উচিত। বেদ্দপ।' 

ব্যর্থ প্রতিপন্ন নম্রতারা আশেপাশের হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে চারটার দিকে গাড়িতে উঠল। ঢাকায় ফিরতে ফিরতে হলো গভীর রাত। নীরা-নম্রতা পড়ল বিপাকে। এতোরাতে হলে ঢুকতে দেবে না। রঞ্জন-নাদিমের জন্য সমস্যা না হলেও নীরা-নম্রতা থাকবে কোথায়? এদিকে ছোঁয়ার অবস্থাও বেকাহিল। বাবা-মা প্রচন্ড ক্ষেপে আছে তার। মেয়ে যে বাজে বন্ধুদের সাথে মিশে রসাতলে যাচ্ছে তা উপলব্ধি করতে পেরে উভয়ই চিন্তিত এবং ক্ষুব্ধ। সেই ক্ষুব্ধ বাবা-মায়ের সামনে দিয়ে এতো রাতে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘরে উঠা আর ছাঁদ থেকে লাফ দেওয়া দুটোই সমান। বাকি রইল অন্তু। এতোরাতে তিনজন মেয়ে বন্ধু নিয়ে বাসায় উঠলে তার মা যে পিঠে কয়টা ঝাঁড়ু ভাঙবে তারও কোনো ইয়াত্তা নেই। এখন যাবে তো যাবে কোথায়? টেনশনে ছয় জনেরই মাথায় হাত। এতোরাতে ছয়জন তরুন-তরুনী মিলে রাস্তায় বসে থাকাও যায় না, পুলিশের ভয়। অবশেষে, সমস্যার সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হলো পূজা। পরিস্থিতি সামলানোর অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে এই মেয়ে। নম্রতাদের পরিস্থিটাও চট করেই সামলে নিল। বাসায় কিছু একটা বুঝিয়ে রঞ্জনের তিন বান্ধবীকে রাত কাটানোর জায়গা করে দিল তার নিজস্ব শোবার ঘরে। রাত বলতে তখন এক-দুই ঘন্টা বাকি। ফ্রেশ হয়ে ঘুমুতে যেতে যেতে পূর্ব আকাশে লাল রঙ ফুটে উঠেছে। সারাদিনের ক্লান্তি বিছানায় যেতেই ডানা মেলল। চোখে ভর করল রাজ্যের ঘুম। সেই ঘুম যখন ছুটল তখন বেলা হয়েছে প্রচুর। ঘড়িতে নয়টা কি দশটা বাজে। তাদের উঠে বসতে দেখেই অস্থির ভঙ্গিতে বলে উঠল পূজা,

' তোমরা উঠেছ? ঠাকুর রক্ষা করল তবে। রঞ্জন ফোন দিতে দিতে অস্থির করে ফেলছে। তোমাদের নাকি সাড়ে দশটায় সিটি আছে?' 

ক্লাস টেস্টের কথা শুনতেই স্প্রিং এর মতো উঠে দাঁড়াল নম্রতা আর ছোঁয়া। নীরাকে লাথি-গুঁতো দিয়ে তুলে তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হলো। পূজা তাদের খাবারটা শোবার ঘরের টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,

' রঞ্জন আর নাদিম নিচে সিএনজি নিয়ে অপেক্ষা করছে। তোমরা খাবে কখন? দশটা পনেরো বাজে।' 

নম্রতাদের খাওয়া-দাওয়া আর হলো না। খাবার ফেলে রেখেই দৌঁড়ে নিচে নামল তারা। ওদের দেখেই গালির বহর ছুটল নাদিমের মুখে। কোন আলালের ঘরে দুলাল হয়েছে যে দশটা পর্যন্ত ঘুমোনো লাগে? এই সব মেয়েকে বঙ্গোপসাগরে বিসর্জন দেওয়া উচিত। এদের যন্ত্রণায় এদের জামাইরা বাসর রাতেই হার্ট অ্যাটাক করবে। যুব সমাজ ধ্বংস হবে। এরা সর্বনাশা, ঝঞ্জাটময় মেয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি শুনেই চল্লিশ মিনিটের রাস্তা এক ঘন্টায় অতিক্রম করল তারা। অফিস টাইম। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। সিএনজি ছেড়ে নিজেদের ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতেই এক ঘন্টার পরীক্ষার পয়তাল্লিশ মিনিট শেষ। অন্তুকে ডিপার্টমেন্টের সামনে মাঠে বসে ঘাস চিবোতে দেখা গেল। ক্লান্ত বন্ধুদের ছুটে আসতে দেখেই চমৎকার হাসি উপহার দিল সে। মুখের সামনে আঙ্গুল মেলে দিয়ে বলল,

' আট নাম্বার পানিশমেন্টের জন্য তৈরি হও মামা। স্যারের কাছে টাইম চাইবা আর পানিশমেন্ট খাইবা।' 

রঞ্জন ভ্রু কুঁচকে বলল,

' শালা!  তুই পরীক্ষা না দিয়ে এখানে বসে আছিস কেন?' 

অন্তু হাত ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল। এক গাল হেসে বলল,

' একা পরীক্ষা দিয়ে মজা আছে নাকি মামা? পরীক্ষা, পানিশমেন্ট সব বন্ধুদের নিয়ে করতে হয়। পরীক্ষা তো হলোই না। তার থেকে বরং  পানিশমেন্টটাই খাওয়া যাক। এই চশমারে দিয়া এসাইনমেন্ট করাব সব।' 

সবার মুখেই হাসি ফুটে উঠল। পরীক্ষার চিন্তা মুহূর্তেই মাথা থেকে উবে গেল। পরীক্ষা শেষ হওয়ার দশ মিনিট আগে ক্লাস রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল তারা। অত্যন্ত ইনোসেন্ট মুখে একশো একটা বাহানাও শুনাল। শক্ত স্যার গললেন না। ছয়জনকে আলাদা পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেওয়ার সাথে সাথে এই তিনবছরের আট নাম্বার পানিশমেন্টটা দিয়েই দিলেন। টপিক 'ম্যান্টাল সিকনেস'। হাসপাতালের ডাক্তাররা প্রতিদিন গড়ে কতজন মানসিক অসুস্থতায় শিকার রোগীর সাথে ডিল করেন তার এক সাধারণ জরিপ। নম্রতাদের কাজ হলো দু'জন দু'জন করে গ্রুপ তৈরি করে মোট ছয়জন ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎ করা এবং এই বিষয়ে তাদের মতামত জেনে এসাইনমেন্ট তৈরি করা। স্যার ভীষণ উৎসাহ নিয়ে তাদের ছয় জনকে তিনটি দলে ভাগ করে দিলেন। কে, কোন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করবে তার নাম, ঠিকানাও ধরিয়ে দিলেন হাতে। স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এসেই ক্লান্ত কন্ঠে বলে উঠল ছোঁয়া, 

' এটা কিন্তু স্যারের কাজ ছিল। স্যার সবসময় আমাদের ব্ল্যাকমেইল করে নিজের কাজ আদায় করে নেয়।' 

নাদিম এই প্রথম ছোঁয়ার কথার সাথে সম্মতি জ্ঞাপন করল। বিরসমুখে বলল,

' এই ফাউলডা অতিশীঘ্রই টাক হবে দেখিস। শালার আবার সুন্দরী একটা বউ আছে। আমি বুঝি না এই খাইচ্চরডারে কি দেইখ্যা বিয়া করল এই সুন্দরী? তার থেকে আমাকে বিয়া করলেও পারত। আমি না করতাম না। ব্যাটারে বদদোয়া, বউ ভাগবো হালার।' 

নাদিমের কথাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উচ্ছল কন্ঠে বলে উঠল অন্তু,

' নমু? দোস্ত? তোর তো ফাটবে রে।' 

নম্রতা কপাল কুঁচকে বলল,

' মানে?' 

' তোকে দেওয়া নাম দুটির মধ্যে একটা ডক্টর আরফান আলমের নাম।' 

নম্রতা-নীরা বিষয়টা ধরতে না পেরে বিস্ময় নিয়ে বলল,

' তো?' 

নাদিম হু হা করে হেসে উঠে বলল,

' চিনতাছো না মামা? এটা কোনো সাধারণ আরফান না বইন। এইটা লঞ্চের ধাক্কা আরফান।' 

নাদিমের কথায় বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল নম্রতার। নীরার সাথে দৃষ্টি বিনিময় হতেই আক্রোশ নিয়ে বলল,

' তুই একা যা। আমি যাবো না।' 

নীরা অসহায় চোখে বন্ধুদের দিকে তাকাল। বন্ধুদের ঠোঁটে তখন চাপা হাসির রেখা।


Writer:- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner