Ghost Story |
"কে? কে ওখানে?"
"আমি। আমি সিরাজ।"
"কোন সিরাজ?"
"দুইবছর আগে মারা যাওয়া সিরাজ। সিরাজুল ইসলাম।"
আসগর সাহেব চমকে গেলেন। কিন্তু ভয় পেলেন না। তিনি যুক্তিবাদী মানুষ বলেই ভূতপ্রেতে বিশ্বাস তাঁকে মানায় না। এই জগতে যুক্তির বাহিরে কিছু হওয়া সম্ভব না বলেই তিনি মনে করেন। তাই তিনি এই ঘটনাটিকে একটা যুক্তির উপর দাড় করালেন। এই মূহুর্তে তার মস্তিষ্ক কিছুটা উত্তপ্ত। এই লোকটি নিশ্চয়ই তাঁর উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা। অথবা কোনো মানুষ তাঁর সাথে মজা করছে। কিন্তু এত রাতে এই নির্জন জায়গায় কে-ই বা তাঁর সাথে মজা করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে?
ঘটনাটিকে আরো কিছু দূর গড়াতে দিয়ে ঘোলাটে না করে চলুন ফিরে যাই এখন থেকে বিশ মিনিট আগে। বোঝার চেষ্টা করি কেন আসগর সাহেবের মস্তিষ্ক উত্তপ্ত।
সন্ধ্যা থেকে একনাগাড়ে দুই-তিন ঘন্টা ঝুম বৃষ্টি পড়ার পর যখন সেটা একটু হালকা হয়ে এসেছে তখন বৃদ্ধ আসগর সাহেব বাজার থেকে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলেন। তাঁর সাথে কোনো ছাতা নেই। হাতে একটা ছোট লাইট। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেই লাইটের চার্জ প্রায় শূন্য। তাই তখন থেকে নিবু নিবু করতে করতে একসময় সেটা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। গ্রামে যেহেতু বৃষ্টি আসার আগেই কারেন্ট চলে যাওয়ার নিয়ম সেহেতু এই মূহুর্তে কারেন্ট নেই সেটা আশ্চর্য হওয়ার মতো ঘটনা না। আকাশে মেঘ অবশিষ্ট থাকায় চাঁদও মুখ লুকিয়ে বসে আছে। তাই আসগর সাহেবকে বাধ্য হয়ে অন্ধকারেই পথ চলতে হচ্ছে।
বাজার থেকে তাঁর বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। হেঁটে হেঁটে আসলে খুব বড়জোর দশ-বারো মিনিট লাগে। কিন্তু প্রায় বিশ মিনিট হাঁটার পরও যখন তিনি বাড়িতে এসে পৌঁছালেন না, তখন তাঁর মনে কিঞ্চিত সন্দেহ হলো যে তিনি পথ ভুল করেছেন। এখন যেই পথে এসেছেন সেই পথেই ফিরে যাবেন নাকি আরো একটু এগিয়ে দেখবেন সেটাই বুঝতে পারছেন না। এই কথা ভাবতে ভাবতেই তাঁর মস্তিষ্ক কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে গেছে।
শেষ পর্যন্ত সেই পথেই আরো কিছুক্ষণ এগোবার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভারী বৃষ্টিতে মাটির রাস্তাটা একেবারে কাঁদায় ভর্তি হয়ে গেছে। হাঁটার সুবিধার জন্য তিনি তাঁর পায়ের জুতো জোড়া হাতে তুলে নিলেন। পায়জামা ভাঁজ করে হাঁটুতে উঠালেন।
তারপর কাঁদা ভেঙে ভেঙে আস্তে আস্তে এগুতে যাবেন ঠিক তখন রাস্তার পাশের বিশাল বাঁশঝাড়টা সজোরে কেঁপে উঠলো। এরপরই এই লোকটির আবির্ভাব যিনি নিজেকে ভূত দাবি করছেন। এবার ঘটনাটিকে গড়াতে দেওয়া যাক।
ঘোর অন্ধকারের কারনে আসগর সাহেব লোকটির মুখ দেখতে পারছেন না। শুধু লোকটার কন্ঠস্বর ভেসে আসছে তাঁর কানে। কন্ঠস্বরের দূরত্ব অনুমান করার চেষ্টা করলেন তিনি। বুঝলেন খুব বেশি দূরে নয়। লোকটা যে তাঁর দশ হাতের ভেতরেই তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
তিনি স্বাভাবিক কন্ঠে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?"
লোকটি বলল, "আপনার সাথে মজা করার দুঃসাহস আমার নেই। আপনি মুরুব্বি মানুষ। মুরুব্বিদের সাথে বেয়াদবি করার আমাদের নিয়ম নেই।"
আসগর সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন, "ভূতদেরও নিয়মের মধ্যে চলতে হয় নাকি!"
লোকটা মৃদু হেসে বলল, "শুধু ভূতদের নয়। এই বিশ্বভ্রম্মান্ডের সকল প্রাণীদেরই নিয়ম মেনে চলতে হয়।"
লোকটার মুখে এই কথা শুনে আসগর সাহেব উচ্চ শব্দ করে হেসে উঠলেন।
লোকটি সন্দেহপ্রবণ গলায় বলল, "আমি যে মৃত তা কি আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?"
"না।"
"তাহলে আমাকে আপনার কি মনে হচ্ছে?"
"কিছুই না। শুধুমাত্র একটা কন্ঠস্বর শুনছি আমি। এটা আমার মতিভ্রম।"
"তাহলে আপনি বলতে চাইছেন আমি শুধুই একটা কন্ঠস্বর?"
"হুমম।"
কিছুক্ষণ নিরব থেকে লোকটি বলল, "যদি আপনি আমাকে স্বচক্ষে দেখতে পারেন তাহলেও কি একই কথা বলবেন?"
আসগর সাহেব এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না। একটা কন্ঠস্বরকে পাত্তা তিনি দিতে চান না। কিন্তু তিনি শত চেষ্টা করেও লোকটাকে দেখার লোভ মনে মনে যখন সামলাতে পারলেন না তখন বললেন, "দেখি তাহলে আপনাকে।"
আসগর সাহেবের কথা শেষ হতে না হতেই আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো। সেই আলোয় এক ন্যানো সেকেন্ডের জন্য তিনি লোকটিকে দেখতে পেলেন। এত অল্প সময়ের জন্য দেখেও লোকটির শরীরের যেই বিষয়টা তাঁকে চমকে দিল তা হলো গাঁয়ের রং। লোকটির পুরো শরীর ধবধবে সাদা। এছাড়া আর কোনো বিশেষত্ব নেই। বিদ্যুৎ চমকানির আলো চলে যাওয়ার পরও গায়ের রংয়ের কারনে এই অন্ধকারের মধ্যেও লোকটিকে আবছা আবছা বোঝা যাচ্ছে।লোকটি বলল, "দেখতে পেলেন?"
আসগর সাহেব ক্ষীণ স্বরে জবাব দিলেন, "হুমম।"
"এবার বিশ্বাস হলো যে আমি শুধুই কন্ঠস্বর নই?
আমি দুইবছর আগে মারা যাওয়া একজন মানুষ।"
"তুমি শুধুই কন্ঠস্বর নও এটা প্রমাণ হলো। কিন্তু তুমি যে আমাদের সেই মৃত সিরাজ তা তো প্রমাণ হলো না। তোমার মুখ তো সিরাজের মতো না।"
লোকটি বলল, "আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার চেহারা আর আগের মতো নেই। আমরা ইচ্ছে করেই নিজেদের চেহারা পরিবর্তন করতে পারি।"
আসগর সাহেব কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন।
লোকটি বিস্মিত গলায় বলল, "আপনি এখনো আমার কথা বিশ্বাস করছেন না?"
"না।"
"এখন আমাকে কি মনে হচ্ছে?"
"মানুষ। একজন জীবিত মানুষ।"
লোকটি কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর বলল, "মানুষ হলে তো আমাকে আপনার স্পর্শ করতে পারার কথা। তাই না?"
"হুমম।"
"তাহলে আমি আপনার কাছে আসছি। আপনি আমাকে স্পর্শ করে দেখান।"
বলেই লোকটি আস্তে আস্তে আসগর সাহেবের কাছে আসতে লাগল। আসগর সাহেব আবছা আবছা লোকটিকে দেখতে পেলেন। লোকটা যখন তাঁর নাগালের ভেতরে এলো তখন লোকটাকে স্পর্শ করে একটা বিজয়ীর হাসি হাসবেন এরকম একটা মনোভাব নিয়েই তিনি তাঁর হাত রাখলেন লোকটার কাঁধে। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা!
লোকটার কাঁধ গলে গিয়ে আসগর সাহেবের হাত নিচে নেমে এলো। তিনি লোকটার বুক স্পর্শ করতে চাইলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন আবারো। হাত স্পর্শ করতে চাইলেন। এটাও পারলেন না।
আসগর সাহেবের কর্মকাণ্ড দেখে লোকটা মৃদু হেসে বলল, "এবার বিশ্বাস হলো?"
আসগর সাহেব জবাব দিলেন না। তিনি এই মূহুর্তে প্রচন্ড পরিমাণে দ্বিধান্বিত। তাঁর মস্তিষ্ক যেন কাজ করছে না। তাঁর মনে ক্ষীণ সন্দেহ হলো। তাহলে কি লোকটি সত্যি কথাই বলছে? কিন্তু তা কি করে হয়? যুক্তি ছাড়া কোনো কাজ তো এই পৃথিবীতে সম্ভব না। কিন্তু নিজের চোখকেই বা তিনি অবিশ্বাস করবেন কীভাবে?
"তুমি আমার কাছে কি চাও?"
আসগর সাহেবের প্রশ্ন শোনে লোকটি বলল, "আপনার সাহসের তারিফ করতে হয়। একটা ভূতের সাথে কথা বলতেও আপনার ভয় করছে না। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে কাপড় অপরিষ্কার করে ফেলত।"
একটু থেমে আবারো বলল, "এতদিন আমি যা চেয়ে এসেছি তাই চাই আপনার কাছে।"
"সেটা কি?"
"একটা ন্যায় বিচার।"
বিস্মিত কন্ঠে আসগর সাহেব বললেন, "কিসের ন্যায় বিচার?"
লোকটি বলল, "আমার মৃত্যুর।"
"তোমার মৃত্যুর! তোমার মৃত্যুর আবার কিসের ন্যায় বিচার? তুমি তো আত্মহত্যা করেছো।"
লোকটি এবার শক্ত কন্ঠে বাঁধা দিয়ে বলল, "না। আমি আত্মহত্যা করিনি।"
"আত্মহত্যা করোনি? তাহলে?"
"আমাকে মেরে তারপর ঐভাবে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছে ওরা।"
আসগর সাহেব চমকে গেলেন, "কি বলছো এসব! কারা করেছে এ কাজ?"
লোকটি বলল, "এটা বলব না। এটাই তদন্ত করে বের করবেন আপনি। তারপর ঐ লোকগুলোর শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। আমার এইটুকু অনুরোধ আপনি রাখতে পারবেন না?"
আসগর সাহেব কিছু না ভেবেই জবাব দিলেন, "পারব।"
লোকটি আনন্দিত গলায় বলল, "আমি জানতাম। আমি জানতাম আপনি রাজি হবেন।আপনার মতো মানুষ হয় না।"
আসগর সাহেব কিছু বললেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। নিরবতা ভেঙে লোকটি বলল, "আপনি তাহলে এখন বাড়ি যান। অনেক রাত হয়ে গেছে।"
আসগর সাহেব বললেন, "আমি বাড়ি যাওয়ার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি।"
লোকটি বলল, "আপনার হাতের টর্চ লাইটটা জ্বালান। তাহলেই খোঁজে পাবেন।"
"টর্চ লাইটটা বন্ধ হয়ে গেছে। চার্জ নেই।"
"আপনি আবার সুইচটা চাপুন। এবার জ্বলবে।"
লোকটির কথামতো আসগর সাহেব আবারো টর্চ লাইটটার সুইচ চাপলেন। অবিশ্বাস্য হলেও দেখলেন টর্চ লাইটটা এবার সত্যি সত্যি জ্বলে উঠেছে। তারপর টর্চ লাইটের আলো ফেললেন চারপাশে। আশেপাশে কাউকেই দেখতে পেলেন না। শুধু দেখলেন তিনি মস্ত বড় একটা বট গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। এটা সেই বট গাছ যেখানে দুই বছর আগে সিরাজ নামের এক যুবকের মৃতদেহ ঝুলেছিলো।
( সমাপ্ত )
লেখাঃ আরিফুল ইসলাম।