আমার"বর্ষণ সঙ্গিনী, জানো তো বৃষ্টি পড়ার সময় টা যে অনেক রোমাঞ্চকর?কাঁথা মুড়ি দিয়ে তোমার মাথা আমার পাজোরে রেখে বৃষ্টির শব্দের সাথে সাথে আমাদের দুজনের গল্পের আসোর কিন্তু ভালোই জমবে।তাই না?এই উইশটা কিন্তু অবশ্যই পূরণ হবে।আজকে একটাই ইচ্ছে বললাম। আস্তে আস্তে সব জেনে যাবে।প্রতিদিন ভার্সিটিতে যেয়ো কিন্তু। মাঝে মাঝে মিস দেও কেনো?তাহলে তো আমিও আমার বর্ষণ সঙ্গিনীকে মিস করি।আর মাত্র তো কিছু দিন।এরপর থেকে আর মিস করতে হবে না আমার বর্ষণ সঙ্গিনী কে।আজকের মতো এখানেই আল্লাহ হাফেজ।
তোমার"বর্ষণ সঙ্গী"।
ম্যাসেজটা পড়ে শোয়া থেকে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম। ছিঃ!ছিঃ!ছিঃ!এই ব্যাটার সাথে আমি কোন দুঃখে এক কাঁথা মুড়ি দিতে যাবো।এই লোক তো বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে।লোকটাকে আমি রিপ্লাই দিলাম,,,
--আপনার কাঁথায় আপনি শুয়ে থাকেন। মন চাইলে কাঁথা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খান।কিন্তু আমাকে আর ম্যাসেজ দিবেন না, আর ডিস্টার্ব করবেন না।আর একবার যদি ম্যাসেজ দিয়েছেন তাহলে আমি আর আমার বান্ধবী মিলে আপনার চোখ কোটর থেকে বের করে মারবেল খেলব।
উফ!!!আজাইরা পাবলিক যত্তসব!!!৪-৫দিন তো ভালই ছিলাম। কোনো ম্যাসেজের ম ও তো আসতো না। আজকে কোথা থেকে উদয় হলো এই লোক?অনেক সময় অপেক্ষা করেও লোকটার কোনো রিপ্লাই আসেনি।
মাগরিবের নামাজ পরে স্যান্ডউইচ বানালাম।সচারাচর বাসায় বার্গার-স্যান্ডউইচ বানানো হয় না। নিয়াজ ভাইয়া অফিস থেকে আসার সময় মাঝে মাঝে নিয়ে আসে।আবার আমাদের বাইরে গিয়েও খাওয়া হয়। তাই বাসায় বানানো ওইভাবে হয়ে ওঠে না।আমার জন্য, বাবার জন্য বানিয়ে আর একটা ভাইয়ার জন্য তুলে রাখলাম।বাসায় সামান্য নুডলস রান্না করলেও তা থেকে কিছুটা ভাইয়ার জন্য তুলে রাখি।ছোটবেলা থেকেই ভাইয়াকে রেখে না আমি কিছু খেতাম আর না ভাইয়া আমাকে রেখে কিছু খেতো।
রাতের বেলা বসে বসে পড়ছি।রুমে একেবারে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। ফ্যানের ঘটর ঘটর শব্দটা পর্যন্ত নেই।তার প্রধান কারণ হলো বাইরে টিপটিপ ছন্দে বৃষ্টি পড়ছে। তার অস্তিত্ব কে জানান দেওয়ার জন্য চারপাশকে শীতল করে তুলেছে।এমন সময় বিকেলের ওই ম্যাসেজ এর কথা মনে পড়তেই শরীরে কেমন শিহরণ বয়ে গেল।ঠিক তখনই বিছানায় থাকা মোবাইল টা বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখি"রানু মন্ডলের ২য় ভার্ষণ"আমাকে কল দিচ্ছে।অর্থ্যাৎ আমার প্রানপ্রিয় বান্ধবী। কল রিসিভ করে আমি হ্যালো বলার আগেই সাদু বলে উঠলো,,,
--জানছ সাদমান ভাইয়ার না পা মচকে গেছে।
আমি আমার প্রিয় মানুষগুলোর মনোভাব অতি সূক্ষ্ম ভাবে পরখ করতে না পারলেও এটুকু অন্তত বুঝতে পারি কখন তাদের মনটা ভালো আর কখন তাদের মনটা খারাপ। যেমন এখন সাদুর কন্ঠেই প্রকাশ পাচ্ছে ওর সাদমান ভাইয়ের জন্য খারাপ লাগছে।
ওকে আমি বললাম,,,
--কীভাবে হলো?
--সন্ধ্যা থেকেই তো বৃষ্টি হচ্ছে একটু একটু।সাদমান ভাইয়া তাদের বাড়ির গেটের সামনে রিকশা থেকে নামতে নিয়ে পিছলে পরে যায়।হাত পা তো ছিলে গেছে সাথে বা পা মচকে গেছে। (সাদু)
--ফোন দিয়েছিলি?(আমি)
--না।আমিই তো নাম্বার ব্লক করে রাখছিলাম।এখন একটু কেমন জেনো লাগতেছে তাকে ফোন দিতে। (সাদু)
--ভালোবাসিস কিনা সেটা তুই ই জানছ।কিন্ত আমি জানি তোর তাকে পছন্দ। আর এইটাও জানি তোর ইচ্ছে হচ্ছে তাকে কল দিতে।দেরি না করে তাড়াতাড়ি কল করে খবর নে।(আমি)
--যাহ্।আমি তো নিজে থেকে কোন দিন তাকে কল করি নাই।এখন আমি করলে কি ভাববে?(সাদু)
--ভাববে তার প্রিয় মানুষটা তার সাথে আছে,তার ভালোবাসায় জোড় আছে।(আমি)
--আচ্ছা তাহলে কল করি?(সাদু)
আমি একটু মৃদু হেঁসে বললাম,,,
--কর কল।আমি রাখলাম।
সকালে উঠে নাস্তা বানিয়ে নাস্তা খেয়ে ভার্সিটি যাওয়া,এসে বাবার সাথে দুপুর এর খাবার খাওয়া,বিকেলে ঘুমানো অথবা বই পড়া অথবা সাদুর সাথে ফোনে ওর আর সাদমান ভাইয়ের প্রেমগল্প শোনা, রাতে ভাইয়া আসলে খেয়ে দেয়ে পড়া শেষ করে ভাইয়ার সাথে গল্প করে ঘুমাতে যাওয়।এইভাবেই এক সপ্তাহ কেটে গেল।
আজ আমরা সবাই গ্রামে যাবো।পরশু ভাইয়া আর তাসফি আপুর গায়ে হলুদ অনুষ্ঠিত হবে। আমার নানা আর দাদা হলো ছোট কালের বন্ধু। একই গ্রামের ছেলে। তারউপর বাজারের এপার আর ওপার দুজনের বাড়ি। সখ্যতা তাদের একটু বেশি ই।দুই বন্ধু মিলেই দাওয়াত এর কাজ সহ বিয়ের আরো কাজের দেখাশোনা করছে। তাসফি আপু চলে গেছে গ্রামে আরো দুই দিন আগে।হলুদের একদিন আগে যাওয়ার কারণ ভাইয়ার চাকরি। অফিস তো আর নিজের না।তাই নিজ ইচ্ছায় ছুটিও কাটানো যায় না।সব মিলে ভাইয়া ছুটি পেয়েছে কেবল ৮ দিনের।তাই আমরা হলুদের একদিন আগে যাচ্ছি।
আমাদের সাথে সাদু, আন্টি আর রাফিদা আপু যাবে। আঙ্কেল বলেছে বিয়ের দিন আসবে। সার্থক ভাইয়া আসবে কি না তা সিওর না।
একেবারে ছোট থেকেই আমাদের দুই পরিবারের পরিচয়। ছোট থেকেই একই স্কুলে পড়ার সুবাদে আমার আর সাদুর ঘনিষ্ঠতা যেমন বেড়ে যায় আমাদের দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতাও তেমন বেড়ে যায়। আমাদের দুই পরিবারের রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও রয়েছে আত্মার সম্পর্ক। গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য সাদুর আব্বুর পরিচিত একজন লোকের কাছ থেকে আমরা মাইক্রো ভাড়া করেছি। সকাল সাতটার দিকে তৈরি হয়ে আমি, নিয়াজ ভাইয়া আর বাবা সাদুদের বাসার সামনে আসি।মূলত গাড়ি আসবে ওদের বাসার সামনে। এসে দেখি ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছে। আমি গিয়ে সাদুর হিজাব ধরে টানাটানি শুরু করে দিলাম। আর বললাম,,,
--কিরে আজকেই তো আমার ভাইয়ের বিয়া হইয়া যাইতাছে না। এত সাজছোস কেন?
--কই সাজছি আমি?খালি তো একটু আইলাইনার দিছি।চোখে কি বেশি দেখছ?(সাদু)
--আগে কবি না? আমিও দিয়া আইতাম। (আমি)
কথা বলতে বলতেই আমরা গাড়িতে উঠলাম। আমাদের গাড়িটা কিছুদূর গিয়েই মেইনরোডে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। তখনি দেখি হুর হুর করে সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়া গাড়িতে উঠলেন। সামনের সিটে নিয়াজ ভাইয়া আর ড্রাইভার আঙ্কেল বসেছিলেন। তাদের পিছনে আন্টি, রাফিদা আপু আর বাবা বসেছে।তাদেরও পিছনে আমরা দুই বান্ধবী শান্তি মত গল্প করতে করতে যাওয়ার জন্য বসেছিলাম। কিন্তু সেই শান্তি আর কপালে জুটল না। আমরা দুই বান্ধবী ৩ সিটে আরাম করে বসে ছিলাম সেখানে সজল ভাইয়া আলআবি ভাইয়া এসে ভাগ বসালো। আমাদের দুই জনের বদলে ৪ জন চাপাচাপি করে বসতে হলো। মাঝখানে আমি আমার বাম পাশে আলআবি ভাইয়া আর ডান পাশে সাদু। আলআবি ভাইয়ের পাশেই সজল ভাইয়া।নিয়াজ ভাইয়া আন্টির সাথে সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়ার পরিচয় করিয়ে দিল।
আমার পাশের গবেটটা গাড়ি বা বাসে উঠলেই ঘুমিয়ে পড়ে। আমাদের গাড়ি কিছুদূর যাওয়ার পরে সাদু ওর মাথা আমার কাঁধে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পরল। আমার গা ঘেষে কেউ বসলে বা দাড়ালে অস্বস্তি বোধ হয়। এই মুহূর্তেও হচ্ছে। একেতো সাদু পারলে আমার কোলে এসে বসছে তার ওপর আবার আরেক পাশে আলআবি ভাইয়া। এই মুহূর্তে খুবই অসহ্যকর লাগছে পরিস্থিতিটা। হঠাৎ করেই দেখি আলআবি ভাইয়া আমার একটু কাছে এসে আমার উপর দিয়ে হাত নিয়ে সাদুর মাথাটা সরিয়ে জানালার সাথে ঠেকিয়ে দিল।তার কাজে অত্যন্ত অবাক হলাম।উনি বুঝলো কীভাবে? আমার জায়গায় যে কেউই থাকলে অবাক হতো। আমি তাকে প্রশ্ন করেই বসলাম,,,
-- ওকে সরিয়ে দিলেন কেন?
--ইচ্ছে হলো তাই?(আলআবি ভাইয়া)
তার জবাব দেয়ার ধরন দেখে মনে হল সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেক জোর করে গলা থেকে শব্দ বের করলেন
-- ইচ্ছে হলেই সরাবেন? (আমি)
--হ্যাঁ সরাবো। কারণ... (আলআবি ভাইয়া)
--কারণ?(আমি)
--নট ইন্টারেস্টেড টু সে।(আলআবি ভাইয়া)
আমি নিজেই বিড় বিড় করে বললাম,,,
--হ্যা তাতে ইন্টারেস্ট থাকবে কেন? ইন্টারেস্ট থাকবে তো শুধু "ক্লিন ইট ক্লিন ইট" করতে।
-- আমি তোমার থেকে একশো হাত দূরে নই। আমার কান আছে সবই শুনতে পাই।(আলআবি ভাইয়া)
এতক্ষণ আমরা আস্তে আস্তেই কথা বলছিলাম। হঠাৎ করে আলআবি ভাইয়া এই কথাটা একটু জোরে বলে ফেললেন। তখন পাশ থেকে সজল ভাইয়া বলে উঠলেন,,,
-- কি শোনাশুনি করছ তোরা?
তখন নিয়াজ ভাইয়াও পিছনে তাকালেন। বলতে গেলে সবাই আমাদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। তখন আলআবি ভাইয়া নিয়াজ ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,,,
--তোর বোন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নাক ডাকছিল। আমি বলেছি নাক জেনো না ডাকে।ও অস্বীকার করছ ও নাকি নাক ডাকে না।
হায়! হায়! মুহূর্তের মধ্যেই এমন একটা ডাহা মিথ্যে কথা উনি কিভাবে বললেন। এই বুঝি সত্যবাদী? তখন নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলেন,,,
-- কিরে নাক ডাকিস কবে থেকে?
আমি জবাবে বললাম,,,
-- আমি নিজেও জানিনা।
ভাইয়া আর কথা না বাড়িয়ে সামনে মুখ করে বসে পড়লো। আমার পাশে তাকিয়ে দেখি সাদু মরা ঘুম ঘুমিয়েছে। যার জন্য এত কাহিনী তারই কোনো খবর নেই। ওর এই ঘুম এখন আমার আর সহ্য হচ্ছে না। ইচ্ছা করেই ওকে জোরে একটা গুঁতো মেরে উঠিয়ে দিলাম। সাদু বিরক্তি নিয়ে উঠে বলল,,,
--কি ?কি সমস্যা তোর? ঘুমের মধ্যে এত গুতাগুতি করছ কেন?
আমিও ওকে শুনিয়ে দিলাম,,,
--ইচ্ছে হলো তাই।
লেগে গেলো আমাদের দুজনের ঝগড়া। আমাদের শান্তির ঝগড়ার এক পর্যায়ে অশান্তি নিয়ে এলো আলআবি ভাইয়া। উনি হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন,,,
--জাস্ট স্টপ ইট!
এমন এক চিৎকার শুনে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। তাকে সব সময় আস্তে কথা বলতে শুনেছি। এই প্রথম জোরে ধমক দিলেন সামনাসামনি। তার বাজখাঁই ধমকে আমি আর সাদু দুজনেই চুপ হয়ে গেলাম।রাফিদা আপু তখন বলে উঠলো,,,
--কোন জায়গায় গেলে শান্তি মত থাকতে পারিস না তোরা? আগে ওখানে পৌঁছে নেই তারপর দুইটাকে একরুমে আটকে রাখবো। তখন যত খুশি একটা আরেকটার চুল ছেড়াছেড়ি করিস।
এরপর থেকে আমরা দুজন একেবারে পিনপতন নীরবতা পালন করলাম। আমাদের নীরবতা পালন শেষ হলো একেবারে নানু বাড়িতে এসে। নানু বাড়িতে প্রথমে আসার কারণ কালকে আমরা নানু বাড়ির সবাইকে নিয়ে দাদু বাড়িতে যাব।
আমরা যখন নানু বাড়ি এসে পৌঁছালাম তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় তিনটার ঘরে। নানু বাড়িতে খালামণি আর খালু ও এসে পড়েছেন। আমাদের গাড়ি বাড়ির উঠোনে আসতেই সবাই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। উঠানেই কুশল বিনিময় শেষ করে আমরা বাড়িতে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নেই। সবাই মিলে একসাথে খাব বলে আমার নানা বাড়ির সবাইকে না খাইয়ে রেখেছে। তার কথা আমরা বাড়িতে পৌঁছালেই দুপুরে সবাই একসাথে খাব। আন্টি আর সাদু এর আগেও একবার আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসেছিল।
আমার নানু বাড়িতে খাবার রুম আলাদা। এখানে সবাই আমরা একসাথে মাটিতে মাদুর পেতে বসে খাই। আমার সাথে সাদু বসেছে আর আরেক পাশে বসেছে রাফিদা আপু। আমদের খাওয়ার মাঝামাঝি পর্বে হঠাৎ করে বিকট শব্দে বেজে ওঠে,,,
"দয়াল তোওওওওওওর লাইগা রেএএএএ"
তখন আমি কেবল পানির গ্লাস টা নিয়ে এক ঢোক পানি মুখে দিয়েছিলাম। হঠাৎ এমন শব্দ হওয়া তে আমার বিষম লেগে যায়। মুখের পানিটাও পড়ে যায়। সাদু বসে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে মাছের কাঁটা বেছে বেছে খাচ্ছিল হঠাৎ সাদুও কিছুটা লাফিয়ে উঠে। আমার খালামণি মাছের তরকারি নিয়ে নানার প্লেটে দিচ্ছিল। খালামনির হাত ফসকে মাছের টুকরো টাও প্লেটের বাইরে পড়ে যায়।সজল ভাইয়া আয়েশি ভঙ্গিতে একটা গরুর হাড্ডি চাবাচ্ছিলেন।হাড্ডি টা পড়তে পড়তে গিয়ে এক পর্যায় বেঁচে যায়।সবাই ই রিতীমতো চমকিয়ে একপ্রকার লাফিয়ে ওঠে।
--তোমার ফোন যদি আমি ভেঙে গুঁড়া
গুঁড়া না করেছি আজকে।
আমাদের সবার মাঝে থেকে খালামনি আমার খালুকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা গুলো বলে উঠলো। আমাদের সকলের পূর্ণদৃষ্টি পড়লো খালুর উপর। উনি কিছুটা দুঃখী দুঃখী হয়ে আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে তার পর খালামনিকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,
--আরে শামিমা বেগাম, রাগছো কেন?ফোনে কল আসলে শুনতে পাইনা বেশিরভাগই। তাই এই রিংটন লাগিয়েছি।
খালামনি আবার চেঁচিয়ে বলে উঠলো,,,
--সারাদিন গলায় গরুর ঘন্টার মতো ওইটা ঝুলিয়ে রেখেও শোনো না কীভাবে তুমি?
--শুনতে পারি যেনো তাই বলেই তো গলার সাথে বেধে রাখি এইটা।(খালু)
কথা গুলো বলে মোর্শেদ খালু তার গলায় ঝুলানো ফোনটা কানে নিয়ে চলে গেলেন কথা বলতে।খালু আসলে একটু অন্য কিসিমে’র লোক।তার ছোট খাটো একটা ব্যবসা আছে।অতি ব্যস্ত মানুষই তাকে বলা চলে।বিয়ে শাদি বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো অকেশোন ছাড়া তার দেখা মেলা যায় না।যতটুকু সময়ই তাকে দেখা যাবে, তার গলার ঝুলানো ফোনটা কানেই দেখা যাবে।ফোনে কথা বলতে থাকলে তার হুশ থাকে না। বিগত তিন বছরে তার চার খানা মোবাইল খোয়া গেছে। তিনি চারটা টা মোবাইলই হারিয়েছেন ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে ।কথাতে তিনি এতই মশগুল ছিলেন যে তার হাতের উপর থেকে ফোন নিয়ে ছিনতাইকারী উধাও হয়ে গিয়েছে তারপর সে টের পেয়েছে তার ফোন খোয়া গেছে। বলতে গেলে তার একটু খেয়াল কম। এতকিছুর মাঝেও আমার খালামনিকে সে প্রচুর ভালোবাসে।সাথে হালকা পাতলা ভয়ও পায়।খালামনি রেগে গেলে খালু তাকে শামিমা বেগাম বলে ডাকে।
যতোই জার্নি করে আসি না কেন গ্রামে আসলে ক্লান্ত থাকলেও তা গায়ে খুব একটা লাগে না।গ্রাম্য পরিবেশ মনকে ফুরফুরে বানাতে বাধ্য করে। আমার মতে, মনের ক্লান্তি হলো আসল ক্লান্তি।মন যখন ক্লান্তি থেকে কয়েকশো গজ দূরে থাকে তখন দেহের ক্লান্তিও জানালা দিয়ে পলায়ন করে।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে সুমনা আপু কে কল করে বলি আমরা এসে পড়েছি। সুমনা আপু কে বলি আমাদের নানু বাড়ি চলে আসতে। নানুবাড়ি আর দাদু বাড়ির দূরত্ব কম হওয়ায় একটু সময় পরে সুমনা আপু সুমাইয়া আর আঁখিকে নিয়ে চলে আসে। আমি রুমে এসে দেখি সাদু ঘুমাচ্ছে। ওকে টেনেটুনে ঘুম থেকে উঠালাম। সাদু ঘুম থেকে উঠে ঘুমঘুম কন্ঠ বলে উঠল,,,
--বইন আমি কি কোন জন্মে তোর সতীন আছিলাম?
-- সতীন না হইলেও এই জন্মে তো আমার বান্ধবী। আর তোরে কি এই জাগায় আমি ঘুমানোর লেইগা আনছি? (আমি)
-- তো কি আমারে কুতকুত খেলতে আনছোস?তোর ভাইর তো এহনি বিয়া হইয়া যাইতাছে না।(সাদু)
-- এই না হইলো আমার বান্ধবী। ঠিক কইছোস।তোরে কুতকুত খেলতেই আনছি।ওঠ তাড়াতাড়ি। সুমনা আপুদের নিয়া কুতকুত খেলমু।কতদিন খেলিনা।(আমি)
--কতদিন ধইরা তো ছোটবেলার মতো সবার সামনে সেন্টু গেঞ্জি আর হাফপেন্ট পইড়া ঘুরছ না।এহন মন চাইলে কি ওগুলি ও পইড়া ঘুরবি?(সাদু)
--হ।আমার মন চাইলে পড়মু।তোর সমস্যা? (আমি)
--দোস্ত ইমেজিন কর।তুই সেন্টু গেঞ্জি আর হাফপেন্ট পইড়া ঘুরতাছোস।কেমন দেহাইবো?(সাদু)
কথাটা বলেই সাধু হু হা করে হাসতে হাসতে একেবারে কুপোকাত হয়ে গেল।এর মধ্যে আমার সাদুর কয়েক দফা মারামারিও হয়ে গেল। দুজন মাড়ামাড়ির পর্ব শেষ করে একসাথে বাইরে আসলাম। এসে দেখি সুমনা আপুরা খেলার জন্য উঠোনে মাটিতে দাগ কেটে ঘরের মতো সাজিয়েছে। আসলে কুতকুত ছোটবেলায় দু-একবার খেলেছিলাম। তাই স্পষ্ট করে কোন কিছু মনে নেই। গ্রামে এসেই উঠোনে খালি পায়ে যখন হাঁটছিলাম তখন হঠাৎ করে মনে হল এখানে দাগ কেটে কুতকুত খেলা যায়। তাই এই প্ল্যান করলাম। সুমনা আপু দেখিয়ে দিল কিভাবে খেলতে হবে। আকাশের দিকে তাকিয়ে অথবা চোখ বুজে দাগ কাটা ঘরগুলো পার করতে হবে। দাগে পা লাগলে সে আউট হয়ে যাবে। একেক কদম ফেলার সাথে সাথে মুখে বলতে হবে আছি নাকি?[বিঃদ্রঃ লেখিকারও সঠিক নিয়ম স্পষ্ট মনে নেই। যতটুকু মনে করা সম্ভব হয়েছে তা দিয়েই লেখেছি]
একে একে সবাই খেলতে শুরু করলাম। সাদুর আগে আসলো আমার পালা। উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি প্রথম কোর্টে পা রেখে বললাম "আছি নাকি" তারপর পরের কোর্টে আবারও পা ফেলে বললাম "আছি নাকি"। ওরাও সাথে সাথে হ্যাঁ হ্যাঁ করছে। কয়েক ঘর পার করার পর লক্ষ্য করলাম কারো কোন শব্দ নেই। হঠাৎ করেই কোন কিছুর সাথে ধাক্কা লেগে মাটিতে ধপ করে বসে পড়লাম। তৎক্ষণাৎ পেছন থেকে খিলখিলিয়ে সবার হাসির শব্দ পেলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি আলআবি ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে।লক্ষ্য করলাম আমি খেলার কোর্ট থেকে নাহলেও দশ হাত দূরে। তখন আলআবি ভাইয়া বলে উঠলো,,,
--এই পৃথিবীতে আছো তো তুমি?
আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে জামা ঝাড়তে ঝাড়তে তার দিকে কটমট করে তাকালাম আর বলে উঠলাম,,,
-- চোখে কি কম দেখেন নাকি?ওহ্ চোখে তো আপনি কমই দেখেন। বেশি দেখলে তো ডাক্তার আপনাকে আর চশমা দিত না।
কথাগুলো আমার বলতে দেরি কিন্তু তার হুংকার ছাড়তে দেরি হয়নি। তিনি অগ্নিমূর্তি হয়ে বলে উঠলেন,,,
-- এই মেয়ে! কি বললে? আমি চোখে কম দেখি?
তার এমনভাবে বলায় আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি আবারও বলে উঠলেন,,,
-- চোখে যদি কমই দেখতাম তাহলে তোমার জায়গায় আমি থাকতাম।ইডিয়েট!
বলেই উনি কালো ফ্রেমের চশমাটা তার এক আঙ্গুল দিয়ে একটু ঠেলে নিলেন।তারপর হন হন করে বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন।আলআবি ভাইয়ার প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গেই চারদিকে হাসির রোল পড়ে গেল। ওরা সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে।সাদু বলল,,,
-- বান্ধবী আরেকটু খেলবি?কুতকুত!
লাস্টের শব্দ টা ও একটু ব্যঙ্গ করেই বললো। তখন কোথা থেকে যেন মোর্শেদ খালু এসে হাজির হলেন। সাথে তার বিখ্যাত ফোনের রিংটোন নিয়ে "দয়াল তোর লাইগা রে"। দেখি সে বাড়ির গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে আর তার গলায় ঝোলানো ফোনটা বেজে চলেছে। এইরকম মুহূর্তে এইরকম একটা ফোনের রিংটোন আমার মেজাজ ১০৪ ডিগ্রি করে দিল। রাগে-দুঃখে ওখান থেকে চলে আসলাম। এসেই ফ্রিজ খুলে এক লিটার ঠান্ডা পানির বোতল বের করে বোতলে মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে পানি খেতে শুরু করলাম।
চারদিকে থেকে মাগরিবের আযানের ধ্বনি কানে বাজছে।সন্ধ্যা নেমে এসেছে বলে সুমনা আপু, সুমাইয়া আর আঁখি কে মামী ওদের বাড়ি যেতে দেয়নি।
রাতের বেলা আমরা সবাই একসাথে খেতে বসে ছিলাম। তখন আমার নানাভাই মোর্শেদ খালু কে উদ্দেশ্য করে বলল,,,
--মোর্শেদ ফোনটা যদি গলা থেকে নামিয়ে রুমে রেখে আসতে তাহলে মনে হয় ভালো হতো।
আমার পাশেই ছিলো সাদু। নানা ভাইয়ের কথা শুনে মুখ চেপে হাসতে দেখলাম ওকে।সুমনা আপু,সুমাইয়া আর আঁখি ও দেখি হাসছে। তখনই খালু বলে উঠল,,,
-- জি আব্বা রেখে আসছি।
আসলে খালু তার ব্যবসাটা একাই সামলায়। সে মনে করে সে দূরে থাকলে তার কর্মচারীরা কাজে গাফিলতি করবে। সে জন্যই একটু পর পর সে ফোন দিয়ে সব খোজ খবর রাখে
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা যে যে যার যার রুমে চলে আসলাম। সবাই অন্যদিনের তুলনায় আজকে একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল। কারণ পরশুদিন যেহেতু গায়ে হলুদ কালকে থেকে টুকটাক কাজ শুরু করে দিতে হবে।
আমার রুমে আমিসহ সাদু, সুমনা আপু,সুমাইয়া আঁখি আর রাফিদা আপুকে ঘুমানোর জন্য দেওয়া হয়েছে। দুই বান্ধবী এক হলে আমাদের কথা শেষ হয় না আর আজ তো আমরা পাঁচ থেকে ছয় জন একসাথে একরুমে ঘুমাবো। ঘুম তো হবেই না বরং গল্প হবে বেশি। খাটের উপরে বসে আমরা সবাই গল্প করছিলাম। মাঝে একটু গানের কলি ও খেলেছি। প্রায় সাড়ে দশটার দিকে রাফিদা আপু বলে উঠলো,,,
-- সাদিয়া! জুই! এখন ঘুমাই চল।এখানে তো সকালে বেলা করে ঘুমানো যাবে না। তাড়াতাড়িই উঠতে হবে।
তখন সুমনা আপু বলল,,,
--আচ্ছা তোমরা শুয়ে পড়ো আমি একটু বাথরুমে যাবো।
--ওমা! টুরু সাহস দেখি তোমার।(সাদু)
--আমরা গ্রামে থেকে অভ্যস্ত তো তাই। কিন্তু এখন আর বাইরের টায় যাবো না।ভিতরের বাথরুমে যাবো। (সুমনা আপু)
--আমিও যামু।তোমরা কেউ যাবা?(আঁখি)
--না। যাও তোমরা।(আমি)
সুমনা আপু আর আঁখি ওয়াশরুমের জন্য চলে গেলে আমরা যে যার বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়লাম। ওরা বাইরে যাওয়ার প্রায় পাঁচ থেকে ছয় মিনিট পরে বিকট চিৎকার ভেসে আসলো।
"ওমা গো"
আমি, রাফিদা আপু, সাদু আর সুমাইয়া ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়লাম কারণ কণ্ঠ শুনে বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা সুমনা আপু আর আখির কণ্ঠ। তাড়াতাড়ি করে আমরা বাইরে বের হয়ে আসলাম।
বাইরে এসে দেখি আমাদের উঠোনের আমগাছ টার উপর মোর্শেদ খালু বসে ফোনে কথা বলছেন। পরনে তার হাঁটু পর্যন্ত একটা সাদা কালো শর্ট পেন্ট।গায়ে তার সেন্টু গেঞ্জি। নিচেই খেয়াল করলাম তার লুঙ্গি আম গাছের তলায় রাখা।
উঠানের মাঝখানে চোখ বোলাতেই দেখি আঁখি আর সুমনা আপু একটা আরেকটার হাত ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে।ওদের কাছে যেতেই বুঝতে পারলাম ভয়ের চোটে ওরা মুখ দিয়ে সূরা বলার চেষ্টায় আছে। কিন্তু মুখ দিয়ে যে ওদের কি বের হচ্ছে ওরা নিজেরাই জানেনা। আঁখি বলছে "সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ" সুমনা আপু চোখ বুজে বুজে বলছে "আল্লাহু আল্লাহু"। অতি শোকে যেমন পাথর হয়, ওরা হয়েছে অতি ভয়ে পাগল।
এখানে যে কি হয়ে যাচ্ছে সেদিকে মোর্শেদ খালুর কোন চিন্তাই নেই। আমরা চারজন এগিয়ে গিয়ে ওদের দুজনকে ধরলাম। তখন পিছনে দেখি বাড়ির সবাই এসে পড়েছে।নিয়াজ ভাইয়া, আলআবি ভাইয়া, সজল ভাইয়া, মামা-মামী। কেবল নানাভাইকে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ করে মোর্শেদ খালু বলল,,,
-- কি হয়েছে তোমরাও বের হয়ে এসেছ কেন?
খালামণি চেঁচিয়ে বলে উঠলো,,,
-- একি অবস্থা তোমার? বোধ বুদ্ধি কি সবই লোপ পেয়েছে ?
তখন খালু ধীরেসুস্থে নেমে এসে তার লুঙ্গি টা ভালো করে পড়ে বললেন,,,
-- আরে হয়েছে কি ফোনে নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলাম না বুঝেছ। তখন উঠোনে ঘুরতে ঘুরতে আমগাছটা চোখে পড়ল। উঠে গেলাম আমগাছে।আরে তুমি তো জানো না একেবারে ফোরজি নেটওয়ার্ক ওখানে। লুঙ্গি পড়ে তো গাছে উঠতে পারছিলাম না তাই ওটা খুলেই উঠে পড়েছি।
--একেবারে উদ্ধার করেছ আমায় তুমি।(খালামনি)
-- ও শামিমা বেগাম রাগ হচ্ছো কেন?(খালু)
--আনন্দের ঠেলায়।যত্তসব! তোমার ওই গরুর ঘন্টা যদি রুমে নিয়ে আসো সাথে করে তাহলে আজকে তোমার একদিন কি আমার একদিন(খালামনি)
খালামণির কথা শেষ হতে না হতেই বেজে উঠল,,,
"দয়াল তোওওওর লাইগা রেএএএএ"
খালামণি কপট রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন। একে একে সবাই খালুকে ফোনটা একটু কম ব্যবহার করতে বলে রুমে চলে গেল। তখন খালু এসে আমাদের সামনে দাড়িয়ে সুমনা আপু আর আঁখি কে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,
--ওদের দুজনের আবার কি হয়েছে?
খালুকে বললাম তাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে ওরা দুজন ভয় পেয়েছে। তখন খালু ওদের সরি টরি বলে চলে গেলেন। পরে জানতে পারলাম বাড়ির ভেতরের ওয়াশরুমে কেউ একজন ছিল যার জন্য ওরা দুজন বাইরের ওয়াশরুম ব্যবহার করতে গিয়েছিল। আর এত কাহিনী ঘটলো।
পরেরদিন বিকেলের দিকে আমরা সবাই মিলে নানা বাড়ি থেকে দাদু বাড়ি চলে আসলাম। সন্ধ্যার দিকে স্টেজ সাজানোর জিনিসপত্র সাথে সাউন্ড বক্স চলে এসেছে। আজ অবশ্য মোর্শেদ খালু খালা মনির সামনে তার মোবাইলটা ছুঁয়ে ও দেখেনি। কিন্তু তারপরও সেটা গলায় ঝুলিয়ে রেখেছিল। আজকের দিনটা আমাদের ভালোই কেটেছে। রাতের বেলা ঘুমানোর সময় এসে সাদু দুষ্টুমি করে আঁখিকে বলল,,,
--কি গো ওয়াশরুমে আজকে যাবা না?
তখন আঁখি জবাব দিল,,,
--সন্ধ্যার পরপরই তো সব কাজ শেষ করে ফেলেছি। রাতে ওয়াশরুমে যাওয়ার সাধ মিটে গেছে।
ওর কথায় আমরা সবাই হেসে দিলাম।
আজ একেবারে সকাল থেকেই সবার ব্যস্ততা আর ছুটছে না। কারণ সন্ধ্যায় ভাইয়ার গায়ে হলুদ। দুপুরবেলা আমরা সবাই পুকুর পাড়ে এসেছি গোসল করার জন্য। তখন রাফিদা আপু আর সুমনা আপু দুজনে সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতা করবে বলে ঠিক করেছে। আমার প্রাণ প্রিয় বান্ধবী বলে ওঠে সেও সাঁতার পারে। ওর বলার ভঙ্গিতেই আমি বুঝে গেছি যে চাপা মারছে ও।আর আমি এটাও জানি ও পুকুরে গোসল করতে কিছুটা হলেও ভয় পায়। রাফিদা আপু বলে ওঠে,,,
-- মিথ্যে একটু কম কইরাই বল।
সাধু তখন বলে ওঠে,,,
--দেখবে আমি যে সাতার পারি।
এটা বলেই ও পানির মধ্যে ডান পা দিয়ে বাম পা দেয়ার সময় পিছলে পড়ে যায়। সুমনা আর রাফিদা আপু দুজন মিলে ওকে টেনে হিঁচড়ে উপরে তোলে। ওকে তোলার পড়েই আমরা সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি।সাদু রাফিদা আপুর দিকে তাকিয়ে বলল,,,
--কেমন বোইন তুমি। আমিতো ভাবছি তুমি আমারে ধইরা রাখবা। তাই তো একটু সাহস দেখাইতে গেলাম।
সন্ধ্যার দিকে আমাদের পুরো বাড়ির চেহারাই পাল্টে গেল। চারদিকে একেবারে বিয়ে বিয়ে গন্ধ লাগছে। আমরা সবাই গোল্ডেন কালার পাড় যুক্ত অফ হোয়াইট শাড়ি পড়লাম।সাথে গোল্ডেন কালার ব্লাউজ। অন্য সময় ভারী মেকআপ পছন্দ না হলেও যেকোনো বিয়ে বা অকেশনে মেকআপ করা আমার ভালই লাগে। কারণ বিয়ে বাড়িতে সবাই সেজেগুজেই আসে। সেখানে নিজেকে একমাত্র সাজগোজ বিহীন দেখতে খুব একটা ভালো লাগে না। বলে রাখা ভালো যে, আমি খোঁপাতে বেলিফুল দিয়েছি। যেটা নিয়ে সাদু আর আমার সাথে একদফা মারামারি হয়ে গিয়েছে। সব ঠিকঠাক করে সেজেগুজে বাহিরে আসলাম। তখন মামী ডেকে বলল মিষ্টির ট্রে নাকি আমার রুমে রেখেছে আমি যেন একটু নিয়ে আসি।
রুমে ঢুকে মিষ্টির ট্রে নিয়ে আসার সময় হঠাৎ বিছানার উপর চোখে পড়ল ঈষৎ হলদে রঙের গোলাপ ফুল একটা বেলি ফুলের মালার সাথে লেপ্টে আছে। তার নিচেই আছে একটা কাগজ। সেখানে কিছু একটা লেখা দেখা যাচ্ছে। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে কাগজটা নিচ থেকে বের করে নিলাম। সেখানে দেখলাম খুব সুন্দর করে লেখা আছে,,,
" আমারো পরানো যাহা চায় তুমি তাই গো"
হাতের লেখাটা জ্বলজ্বল করছে। মনে হচ্ছে লেখাটাও কথা বলছে।হাতের লেখার ধরণ চিনতে আমার একটুও অসুবিধা হলো না। এটা সেই লোকটার।সে এখানেও পৌঁছে গিয়েছে? কিন্তু কীভাবে?তাহলে কি সাদুর ধারণাই ঠিক ছিল? সত্যি কি আলআবি ভাইয়া লোকটাকে সাহায্য করছে? আমি কি আলআবি ভাইয়াকে সরাসরি জিজ্ঞেস করবো?যদি সে আমাকে কিছু না বলে?কিন্তু সে যদি এসবের পেছনে না থাকে? তখন তো আমাকে নিয়ে সে নেগেটিভ কিছু ভাববে।ভাবনার মাঝেই মামীর ডাক পড়লো।
--আসছি মামী।
মামীকে জোড়ে জবাব দিয়ে ফুলগুলো রেখে কাগজ টা লুকিয়ে রাখলাম। কেন যেন কাগজ টা ছিঁড়ে ফেলতে বা ফেলে দিতে ইচ্ছে করলো না।
আমার দাদা বাড়িটা বেশ বড় জায়গার মধ্যে তৈরী করা।সেই সুবাদে বাড়ির ছাঁদ টাও বিশাল বড়।ছাঁদেই নিয়াজ ভাইয়ার হলুদের স্টেজ করা হয়েছে।ছাঁদে বক্সে গান বাজছে ফুল ভলিউমে। সুমনা আপু, সাদু ওরা সবাই অলরেডি ছাঁদে চলে গেছে।একহাতে মিষ্টির ট্রে টা নিয়ে আরেক হাতে শাড়ির কুঁচি ধরে সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠছি।শাড়ি পড়ে ততটা অভ্যস্ত নই বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কিছু টা অসুবিধা হচ্ছে। এমন সময় মনে হলো আমার পেছনেও কেউ সিঁড়ি দিয়ে উঠছে।পেছনে ঘাড়টা হালকা ঘুড়িয়ে দেখি আলআবি ভাইয়া আমার পেছন পেছন উঠছেন। পড়নে তার রঙ চঙ বিহীন একটা শুভ্র পাঞ্জাবি।সাথে সেই শুভ্র রঙেরই পায়জামা। বুকের কাছটায় সোনালি রঙের কয়েকটা বোতাম উঁকি দিচ্ছে। তার দাঁড়িতে যে ঈষৎ ঘনত্ব বেড়েছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মাথার চুল গুলোতেও পরিপাটির ছোঁয়া লাগিয়েছেন।তার ভরাট পাপড়ির চোখদুটো কিছুটা সংকুচিত করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।এই প্রথম তাকে এতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। এক প্রকার স্ক্যান করা বলা চলে। তাকে দেখে এই প্রথম মনে হলো তাকেও সুদর্শন পুরুষের তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা যায়। হঠাৎ সে আমাকে লক্ষ্য করে তার এক ভ্রু ঈষৎ উচু করলেন। যার দ্বারা সে স্পষ্ট বোঝাতে চেয়েছেন "কি"?। তার এরূপ কাজে আমার সম্বিত ফিরে এলো। তাকে কিছু না বলে আমি সিঁড়ির একপাশে চেপে গেলাম। সে যেন উপরে উঠতে পারে তাই।
আলআবি ভাইয়া আমাকে পাশ কাটিয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে চলে গেলেন।আমি পুনরায় আমার শাড়িটা ধরে উপরে ওঠার জন্য যখন উদ্যত হলাম, ঠিক সেই মুহুর্তে হুটকরেই আলআবি ভাইয়া আমার সামনে এসে দাড়িয়ে পড়লেন। আমার হাত থেকে মিষ্টির ট্রে টা নিয়ে সে আমার মত করেই সিঁড়ির এক পাশে চেপে গেলেন। তার এমন অদ্ভুত কাজে অবাক চাহনি নিয়ে তার দিকে তাকালাম। তখন আলআবি ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,,,
--শাড়ি সামলানোর গুন তো নেই।
কথাটা বলেই তিনি এক ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে আমার অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়লেন। আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে হুট করেই তিনি আমার পেটের অংশের দিকে থাকা শাড়ি টেনে দিলেন। এমনটা হওয়ায় কিছুটা হকচকিয়ে উঠলাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে আমি দুই ধাপ সিঁড়ি নিচে নেমে গেলাম। আসল ব্যাপারটা কি হয়েছে তা বুঝতে পারার পর মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলাম। আলআবি ভাইয়ার সামনে এমন হওয়ায় এখন প্রচুর পরিমাণে লজ্জা লাগছে। ইশ ওনার সামনে এমনটা না হলেও তো পারতো। লজ্জার কারনে তার দিকে দৃষ্টি দিতে পারছিনা। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে লজ্জাবতী গাছ ও আমার থেকে লজ্জা কম পায়। এমন সময় আবার আলআবি ভাইয়া কড়া গলায় বলে উঠলেন,,,
-- সেফটিপিন টাও অবশ্য আমি মেরে দিব না। যাও নিচে গিয়ে ঠিকঠাক হয়ে এসো।
কথাগুলো বলে তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।আমি তো লজ্জায় পা ও নাড়াতে পারছি না। হঠাৎ আলআবি ভাইয়া বাজ খাই গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,,,
--কি হলো যাও!
তার চিৎকারে ভয় পেয়ে দ্রুত দুইহাতে কোনো মতে শাড়ি ধরে নিচে নেমে আসলাম।রুমে এসে ভালো করে সেফটিপিন লাগিয়ে নিলাম।যেখানে একটা লাগবে সেখানে দুইটা করে লাগিয়ে নিলাম। রুম থেকে বের হওয়ার আগে আরও একবার ভালো করে নিজেকে পর্যবেক্ষন করে তার পর ছাঁদের দিকে হাঁটা ধরলাম।
ছাদের ঠিক মাঝখানে ভাইয়াকে বসিয়ে হলুদ দেয়ার জন্য স্টেজ করা হয়েছে।স্টেজের পিছনের অংশে রাখা হয়েছে খাওয়ার স্পেস।আর স্টেজের সামনে রাখা হয়েছে সারি সারি চেয়ার।বাড়ির উঠোনে জায়গা একটু কম বলে সেখানে বাবুর্চি দিয়ে রান্না চাপানো হয়েছে। উঠোনটা আরেকটু বড় হলে উঠোনেই স্টেজ সাজানো হতো।
ছাঁদে ওনেক পরিচিত অপরিচিত মুখ দেখা যাচ্ছে। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম স্টেজ এর এক পাশে সাদু, রাফিদা আপু, সুমাইয়া, সুমনা আপু, আঁখি সবাই মিলে সেলফি তোলায় ব্যস্ত।ওদের কাছে গিয়ে সাদুর মাথায় একটা চাপড় দিলাম।সাদু একটু রেগে গিয়ে বলল,,,
--আমার লগে এতো গুতাগুতি কিসের? যা যাইয়া নিজের জামাইর লগে গুতাগুতি কর।
--বুজছ না, তোর লগে গুতাগুতি কইরা প্রেকটিস করি।(আমি)
--কিরে পেত্নী তোরে দেখি আজকে ভালোই লাগতাছে। আলগা কি মাইরা আইছোস আবার?(সাদু)
--দিবি তুই?(আমি)
--হ!হ! কি দিছোস ক।আমি দিমু।(সাদু)
--বান্দরের গু দিছি।দিবি? (আমি)
আমার কথা শুনে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
চলব...
Writer:- হুমাশা এহতেশাম