গোলাপ আর গাদা ফুল তাদের সুবাস চারদিকে ছড়িয়ে পরিবেশটাকে মাতিয়ে তুলেছে। সেইসাথে আকাশে উঠেছে গোলাকার থালার ন্যায় চকচকে এক চাঁদ। ক্ষণে ক্ষণে কিছু দল মেঘ এসে চাঁদটাকে ঘিরে ফেলছে আবার ক্ষণে ক্ষণে চাঁদ তার চকচকে রূপ নিয়ে হাজির হয়ে যাচ্ছে আমাদের সামনে।
ছাঁদে মানুষের আনাগোনার সাথে সাথে বেড়েছে কিছু চ্যাংড়া ধরনের ছেলেদের আনাগোনা। গ্রাম হোক বা শহর, প্রায় বিয়ে বাড়িতেই কিছু কিছু ছেলেদের দেখা যায় দাওয়াত বিহীন তারা এসে তাদের চাঁদমুখ খানা একবার দেখিয়ে যায় সবাইকে। এরাও তাদের দলেরই অন্তর্ভুক্ত। সব বিয়ে বাড়িতেই যে এরকম হয় তাও কিন্তু নয়।
অনুষ্ঠান চলাকালীন দেখি সার্থক ভাইয়া আর আংকেল মানে সাদুর আব্বু এসে হাজির। আজকের দিনে তাদেরকে আমরা মোটেও আশা করিনি। কারণ তাদের আসার কথা ছিল কালকে। আমরা সবাই মিলে স্টেজের সামনে রাখা চেয়ারগুলোতে বসেছিলাম আর নিজেদের মতো গল্প করছিলাম। কারন এখন বড়দের হলুদ দেওয়ার পালা চলছে। একটু পরেই আমরা হলুদ লাগাবো। তখন সার্থক ভাইয়া এসে রাফিদা আপুর পাশে বসে আপুর কাঁধে ভাইয়ার বাম হাত তুলে দিয়ে বলে,,,
-- কি বড় বউ সারপ্রাইজ কেমন দিলাম?
আপু সার্থক ভাইয়ার হাত সরিয়ে একটু রাগী ভাব নিয়ে বলে,,,
-- লাজ শরম কি গাজীপুরে সব রেখে আসছো?
--আরে বউ,আমি তো জন্মের আগেই লজ্জা শরম আল্লাহর কাছে রেখে আসছি।(সার্থক ভাইয়া)
--আমার কাছে আসলে লজ্জা শরম সব নিয়া তারপর আসবা। বুঝছ?(রাফিদা আপু)
আমরা সবাই ভাইয়া আর আপুর এমন কথাগুলো ভালোই এনজয় করছিলাম।তখন আমাদের ডাক পড়লো হলুদ ছোঁয়ানোর জন্য।নিয়াজ ভাইয়া একটা সাদা সেন্টু গেঞ্জি পড়া ছিল। একটা টাওয়াল গায়ের উপর দেওয়া ছিল।আর সাথে একটা লুঙ্গি পড়া ছিল।
একে একে রাফিদা আপু,সার্থক ভাইয়া, আলআবি ভাইয়া, সুমনা আপু, আঁখি, সুমাইয়া সহ আরো কিছু ছেলে মেয়ে হলুদ ছোঁয়ালো ভাইয়াকে।সব শেষে আমি, সাদু আর সজল ভাইয়া স্টেজে উঠলাম হলুদ ছোঁয়ানোর জন্য।আমরা তিনজন একটু একটু করে হলুদ দিলাম। হুট করেই আবার সাদু হাতে এক গাদা হলুদ নিয়ে নিয়াজ ভাইয়ার পুরো মাথায় লাগিয়ে দিলো।আমি একগাদা হলুদ নিয়ে ভাইয়ার গালে কপালে লেপ্টে দিলাম।সজল ভাইয়া নিয়াজ ভাইয়ার পুরো শরীরে হলুদ দিয়ে ভরে ফেলল।এইমুহূর্তে নিয়াজ ভাইয়া আর সজল ভাইয়া বসে বসেই একপ্রকার ধস্তাধস্তি করছে।নিয়াজ ভাইয়া নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় আছে আর সজল ভাইয়া হলুদ লাগানোর চেষ্টায়।একপর্যায়ে নিয়াজ ভাইয়া না পেরে সজল ভাইয়াকেও হলুদ দিয়ে ভূত বানিয়ে দিল।এখন আমরা দুই হলুদ মানব রূপী ভূতের মাড়ামাড়ি উপভোগ করছি। তাদের কান্ড দেখে তো আমরা সবাই হেঁসে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছি।আসলে এটা আমাদের তিন জনেরই একটা প্লেন ছিল।এর মাস্টার মাইন্ড হলো সজল ভাইয়া। নিয়াজ নামক হলুদ ভূতের কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম।একটু পরে তাসিফা আপুকে ছবি গুলো হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিব বলে।
হাসাহাসির একপর্যায় সাদুর সাথে আমার ধাক্কা লাগে। আমি ছিলাম ওর সামনে। স্টেজের সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাচ্ছিলাম।আর সাদু ছিল আমার পিছনে। ধাক্কা টা সামলাতে না পেরে আমি সামনের দিকে পড়ে যাই।আপনাআপনি আমার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম আমি পড়ে যাইনি। উপলব্ধি করতে পারছি একজোড়া বলিষ্ঠ হাত আমাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। আমার হাত জোড়াও কোন একটা স্থানে গিয়ে পড়েছে। কিন্তু কোথায় তা ঠিক বুঝতে পারছিনা। তাড়াতাড়ি করে চোখটা খুলে ফেললাম। আমার সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে মনে হচ্ছে আমার চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসবে। দেখি আলআবি ভাইয়া তার হাত জোড়া আমার কোমরে চেপে ধরে রেখেছেন। আমার সমস্ত শরীরের ভর তার হাত জোড়ায়। আমার হাত জোড়া গিয়ে আলআবি ভাইয়ার শুভ্র রাঙা পাঞ্জাবির সারি সারি বোতামের দুইপাশে পড়েছে। অর্থাৎ এক হাত তার বাম পাশের বুকে আর এক হাত ডান পাশের বুকে। তাড়াতাড়ি নিজেকে ঠিক করে দাড়িয়ে পড়লাম। দাঁড়িয়ে পুনরায় অবাক হলাম। কারণ আমার দুই হাতে লেগে থাকা কাঁচা হলুদের ছাপ আলআবি ভাইয়ার পাঞ্জাবিতে লেপ্টে আছে। তার শুভ্র পাঞ্জাবিতে কাঁচা হলুদের একজোড়া হাতের ছাপ জ্বলজ্বল করছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি নিয়াজ ভাইয়া, সজল ভাইয়া, সাদু ব্যাতীত আমাদের আর কেউ লক্ষ্য করেনি। তিনজনই আমাদের দিকে অবাক করা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে।মাথা নিচু করে আমি আমতা আমতা করে বললাম,,,
--আ..আসলে আমি খেয়াল করিনি।
আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,
--সে সরি।
আমি হকচকিয়ে তার দিকে তাকালাম। আমি তার থেকে এমন কোনো উত্তরই আশা করছিলাম না। এরকম পরিস্থিতিতে যে কেউ ই বলবে "ইট'স ওকে" অথবা বলবে "আমি কিছু মনে করিনি"। এই লোকটা এমন কেন? আর আমিই কি ইচ্ছে করে তার উপর পরতে গিয়েছি নাকি?কিছু টা অভিমান নিয়েই বললাম,,,
--সরি!
বলেই আমি স্টেজ থেকে নেমে এককোনায় চেয়ারে গিয়ে বসে রইলাম।বসে বসে তাসফি আপু কে নিয়াজ ভাইয়ার ছবি গুলো পাঠাচ্ছি আর আমাদের তোলা ছবি গুলোও দেখছি।তখন সাদু এসে আমার পাশে বসলো।কিন্তু ওর সাথে কথা বললাম না।ওর সাথে রাগ করেছি।ধাক্কা টা ওর সাথে লেগেই তখন ওই রকম একটা সিচুয়েশন তৈরি হয়েছিল।তকন সাদু বলল,,,
--কিরে মুখ টা ওমন কেন?
-- আমার মুখ আমার ইচ্ছা। (আমি)
আমার সামনে সাদু ওর হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে এনে কিছুটা মাইকের মত করে ধরে বলল,,,
--আচ্ছা বাই দ্যা ওয়ে, রোমান্টিক একটা সিন এর পর আপনার অনুভূতি কি? যদি দর্শকদের একটু বলতেন?
ওর এই কথায় আমি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাম।ও যে আমার মজা নিতে এসেছে আমি তা ভালোই টের পেয়েছি। শুরু হয়ে গেল আমাদের মারামারি।এর মধ্যেই হঠাৎ করে খেয়াল করলাম কেউ গিটারে টুংটাং শব্দ করে সুর তোলার চেষ্টা করছে। স্টেজের দিকে চোখ পড়তেই দেখি আলআবি ভাইয়া একটা চেয়ারের উপর বসে হাতে গিটার নিয়ে সেটা বাজাচ্ছে। পড়নে তার সেই পাঞ্জাবি যেটা আমি নষ্ট করে দিয়েছি। গিটার হাতে তাকে আমার কাছে দেখতে খুব ভালো লাগছে । মনে হচ্ছে তার দিকে তাকিয়েই থাকি । পরক্ষনেই মনে হলো ছি!ছি! এগুলো কি ভাবছি।
গিটারের শব্দ টা ভালই লাগছে। সবাই একসঙ্গে স্টেজের সামনে জটলা পাকালো।আমারও নড়েচড়ে বসলাম। তখন আলআবি ভাইয়া গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করলেন,,,
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
তোমারে দেখিতে দেয় না
মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না
মোহমেঘে তোমারে
অন্ধ করে রাখে
তোমারে দেখিতে দেয় না
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?
ক্ষনিক আলোকে আঁখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে ক্ষনিক আলোকে আঁখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে হারাই-হারাই সদা হয় ভয়
হারাই-হারাই সদা হয় ভয়
হারাইয়া ফেলি চকিতে
আঁশ না মিটিতে হারাইয়া
পলক না পড়িতে হারাইয়া
হৃদয় না জুড়াতে
হারাইয়া ফেলি চকিতে
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?
ওহে কি করিলে বলো পাইব তোমারে?
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে
ওহে কি করিলে বল পাইব তোমারে?
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে
ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ
এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ
তোমারে হৃদয়ে রাখিতে
আমার সাধ্য কিবা তোমারে
দয়া না করিলে কে পারে?
তুমি আপনি না এলে
কে পারে হৃদয়ে রাখিতে?
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?
ওহে আর কারো পানে চাহিব না আর
করিব হে আজই প্রাণপণ
ওহে আর কারো পানে চাহিব না আর
করিব হে আজই প্রাণপণ
ওহে তুমি যদি বল এখনি করিবো
তুমি যদি বল এখনি করিবো
বিষয় বাসনা বিসর্জন
দিব শ্রীচরণে বিষয়
দিব অকাতরে বিষয়
দিব তোমার লাগি বিষয়
বাসনা বিসর্জন
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?
কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে?
কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে?
তোমারে দেখিতে দেয়না
মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয়না
মোহমেঘে তোমারে
অন্ধ করে রাখে তোমারে
দেখিতে দেয়না
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?
তার গানের কন্ঠ মাশাল্লাহ! এতক্ষণ মনে হচ্ছিল কোন এক মোহে পড়ে গিয়েছিলাম । তার গান শেষ হতেই করতালির শব্দে মুখরিত হলো চারপাশ। পুরো গানটাই আলআবি ভাইয়া চোখ জোড়া বন্ধ করে গেয়েছেন। করতালির শব্দে চোখ মেলে তাকালেন। তিনি চোখ খুলতেই আমাদের দুজনের মধ্যে চোখাচোখি হয়ে গেল। গানটা শেষ করে সে আর অপেক্ষা করলেন না। স্টেজ থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে একেবারে নিচে চলে গেলেন। তার যাওয়ার পরে কয়েকটা ছেলে স্টেজে উঠে নাচলো। একটা মেয়ে গান গেলো।এভাবে রাত বাড়তে বাড়তে দুইটায় এসেও পর্যন্ত নাচ-গানের পর্ব শেষ হলো না।আমি অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। প্রচুর ঘুমও পাচ্ছে। ঘুমের জন্য বারবার চোখের পাতা নেমে আসছে। সাদুকে সহ ওদের সবাইকে একবার জিজ্ঞেস করলাম ওরা কেউ নিচে যাবে কিনা। সবাই বলল না। তাই আমি একাই নিচে আসার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। কিছুটা ঘুম ঘুম চোখেই ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসলাম। দেখি উঠোনে সব বড়রা বসে গোল মিটিং এর মতো কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে। পাশেই ডেকোরেশন এর জিনিসপত্র গুছানো হচ্ছে। কারণ আমাদের বাড়িতে আর অনুষ্ঠান হবে না। এর পরের দুই দিন সেন্টারেই অনুষ্ঠান হবে। তাই বাড়িতে কোন ঝামেলা নেই। উঠোনের দিকে চোখ বুলিয়েই আমার রুমের দিকে পা বাড়ালাম।ঘুমে আমার চোখ ভেঙে আসছে। এখনই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়বো।
ফ্রেশ হয়ে একটা ঢিলেঢালা থ্রি পিছ পড়ে নিলাম। কারণ আজকে গরম একটু বেশিই পড়েছে। বিছানায় এসেই আমার মহা মূল্যবান সময় গুলোকে নষ্ট না করে বাকিদের জন্য জায়গা রেখে দ্রুত শুয়ে পড়লাম। শুয়ে চোখটা বন্ধ করেছি কিছু সময় হবে। আমার চোখটা লেগে এসেছিল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ মনে হলো কোন শীতল বস্তু আমার দুই গালে আর কপালে স্পর্শ করছে। হঠাৎ করে কানে একটা পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে আসলো,,,
--গজদন্তিনী!তুমি কি জানো তোমার গজ দাঁত বিশিষ্ট হাসি দেখলে তোমার গজদাঁতে আমার ওষ্ঠদ্বয় ছুয়ে দেয়ার প্রবল ইচ্ছে জাগে।
কানে কোন অপরিচিত কন্ঠ আর এমন একটি কথা ভেসে আসতেই আমি সটান হয়ে বসে পরলাম। জোরে জোরে শ্বাস ক্রিয়া চালাচ্ছি।রুমের লাইটটা অন করে পুরো রুমটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। কিন্তু কাউকেই পেলাম না। এবার মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেল মনে মনে ভাবছি কোন প্রেতাত্মা এসে পড়ল না তো রুমে?আয়নায় চোখ যেতেই আমার চোখ কপালে ওঠার উপক্রম। আমার গালে আর কপালে তিন আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে হলুদ ছোঁয়ানো।এটা দেখে ভয়ে রীতিমতো কলিজার পানি শুঁকিয়ে গেছে। অনুষ্ঠানে সবাই সবাইকে যেই হলুদ লাগিয়েছিলাম আমি তো তা ভালোভাবেই ধুয়ে এসেছিলাম।এখন আবার এই হলুদ আসলো কীভাবে?আমার আকাশকুসুম ভাবনার মধ্যে ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠলো। তাড়াতাড়ি করে ফোনটা নিয়ে দেখি একটা মেসেজ এসেছে,,,
"আমার বর্ষণ সঙ্গিনী"
" সবার পরের ছোঁয়াটা আমিই দিলাম। যদি সবার আগে তোমায় হলুদ ছোঁয়া দিতাম তবে অন্য সকলের স্পর্শে আমার ছোঁয়াটা ঢেকে যেত। এখন আমার ছোঁয়া টাই থেকে যাবে।"
"তোমার বর্ষণ সঙ্গি"
আমি মোহতারাম হাবিব রহমান এর পুত্র নিয়াজ রহমান মোহতারাম এনামুল হক এর কন্যা তাসফি হক কে **টাকা দেনমহর ধার্য করিয়া নিজের স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করিলাম।
--বলুন কবুল।(কাজী)
--কবুল(নিয়াজ ভাইয়া)
--বলুন কবুল(কাজী)
--কবুল(নিয়াজ ভাইয়া)
--বলুন কবুল (কাজী)
--কবুল(নিয়াজ ভাইয়া)
--আলহামদুলিল্লাহ... আমিন।আপনাদের বিবাহ সম্পন্ন হইলো।(কাজী)
নিয়াজ ভাইয়া আর তাসফি আপুর বিয়ে টা হয়ে গেল।তারাও নতুন এক পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে গেল।অবশেষে তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেল।
বিয়ে সম্পন্ন হতেই সবাইকে খেজুর দেয়া হলো।তাসফি আপু তো কবুল বলেই কান্নায় ভেঙে পরেছে।একপাশে নিয়াজ ভাইয়া আর আরেক পাশে তাসফি আপুর বাবা বসে তাসফি আপকে সামলাচ্ছে। এভাবে কিছু সময় পরে তাসফি আপুকে স্বাভাবিক করলো।
শুরু হলো আমাদের ছবি অধিবেশন।স্টেজের পিছনের দেয়াল লাল গোলাপ দিয়ে সম্পূর্ণ রূপে ঢেকে রাখা। এক ফোটা ফাঁক ফোকড় নেই। আমরা সকলেই শাড়ি পড়েছি ।তবে কারো সাথে কারো শাড়ির মিল নেই। আমরা সবাই শাড়ির সাথে হিজাব পরেছি। কেবল এই একটা দিকেই মিল আছে। আমরা সব মেয়েরা একসাথে ছবি তুলেছি। ছেলেরা একসাথে তুলেছে। আবার আমার পারিবারিক ছবিও তুলেছি। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমাদের ক্যামেরাম্যান ছিল আলআবি ভাইয়া। তার নাকি ছোটকাল থেকেই ফটোগ্রাফির শখ ছিল। আর সে ছবিও খুব সুন্দর তোলেন।বিদায় বেলায়ও তাসফি আপু কান্না করেছিল।
ঘড়ির কাটায় প্রায় দশটা ছুঁই ছুঁই। বর্তমানে আমি, সাদু, রাফিদা আপু, সার্থক ভাইয়া, সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়া কাঁচা মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে আমাদের বাড়ি যাচ্ছি। আমাদের এভাবে হেঁটে যাওয়ার একমাত্র কারণ হল আমার প্রাণ প্রিয় বান্ধবীর ইচ্ছা পূরণ। আসলে আমারও কিছু টা ইচ্ছে ছিল। আমাদের বাড়ির সামনে যে রাস্তা আছে তার ১০ থেকে ১৫ মিনিট পার হলে বড় রাস্তা অর্থাৎ মেইনরোড পাওয়া যায়। আমরা বরযাত্রীর গাড়িতেই আসছিলাম। সুমনা আপুরা অন্য গাড়িতে ছিল।তখন সাদু বায়না করে ও এখান থেকে হেঁটে যাবে। ওর আর বসে থাকতে নাকি ভালো লাগছে না। ওর সাথে আমারও গাড়িতে বসে থাকতে ভাল লাগছিল না। যখন রাফিদা আপুকে বললাম তখন রাফিদা আপুও আমাদের সাথে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তখন আমাদের বডিগার্ড হিসেবে নিয়াজ ভাইয়া আলআবি ভাইয়া, সজল ভাইয়া আর সার্থক ভাইয়া কে পাঠিয়ে দিল।
পরিবেশটা খুব শীতল সরু কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আমরা ছয় জন। রাস্তার দুই ধারে রয়েছে গাছপালা। মাঝে মাঝে দু একটা ডোবা দেখা যাচ্ছে। চারপাশ থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। রাফিদা আপু আর সার্থক ভাইয়া সকল এর পিছনে গল্প করতে করতে আসছে। ওদের সামনেই সজল ভাইয়া আর সাদু দুজন বিয়ের ছবি ক্যামেরায় দেখতে দেখতে আসছে। সকলের সামনে আমি আর আলআবি ভাইয়া প্রায় দুই হাতের মতো দূরত্ব রেখে হেঁটে যাচ্ছি। হাঁটার একপর্যায়ে পায়ের নিচে কিছু একটা বেধে যাওয়ায় আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নেই। সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে আলআবি ভাইয়া আমার ডান হাতের বাহু ধরে নেয়। এই যাত্রায় আমি পড়ে যাওয়া থেকে বেঁচে যাই। আমি নিজেকে ঠিক করে ভালো ভাবে দাঁড়িয়ে আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তখন সে বলে উঠল,,,
--চোখ কোথায় রেখে হাঁটো?
আমি তার কথার প্রতি উত্তরে বলি,,,
--ধন্যবাদ ভাইয়া।
তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম কপালে তার কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়েছে। ভ্রু যুগলও হালকা কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমার এরূপ আচরণ বা কথা হয়তোবা তিনি হজম করতে পারেননি। তিনি আশা করছিলেন আমিও কিছু বলবো। কিন্তু তার সাথে এখন ঝগড়া করার কোন মুডই আমার নেই। কারণ এখন আমার খুব পানি পিপাসা লেগেছে। আমাদের কাছে পানিও নেই। বাড়িতে গিয়ে তারপর পানি খেতে হবে। আর তাকে কোন কথা বলেও লাভ হবে না। জানতাম সে হয়তো বলবে "সে সরি"আর না হলে বলত "ধন্যবাদ বল। এটা ম্যানার্স এর মধ্যে পড়ে"। উনি পারে তো শুধু এগুলোই বলতে। তিনি আর কিছু বললেন না আমরা পুনরায় হাঁটা শুরু করলাম।
বাড়ি এসে সকলে লেগে পড়লাম বাসর ঘর সাজানোর কাজে।আমি,সাদু রাফিদা আপু সুমনা আপু,আঁখি, সুমাইয়া,সার্থক ভাইয়া আর সজল ভাইয়া মিলে বাসর ঘর সাজাচ্ছি।সাদু বলে উঠলো,,,
--ইশ কারা যে আমার বাসর ঘর সাজাবে।
--বিয়াই তো করলি না।বাসর ঘরের প্ল্যান ও কইরা ফালাইছোস?(আমি)
--শালিকা তো আমার বড় হয়ে গেছে। (সার্থক ভাইয়া)
--আব্বুর কাছে নাকি রফিক আঙ্কেল বলছিল তার ছেলে ময়লা ওয়ালাদের সিনিয়র পদ পাইছে।মানে এখন তার ছেলের আন্ডার সাতজন ময়লাওয়ালা কাজ করে। (রাফিদা আপু)
--আপু রফিক আঙ্কেল বাসায় বাসায় থেকে ময়লা নেয়। তার ছেলেও তো ময়লা নেয়। তাদের কথা এইখানে টাইনা আনার মানে কি?(সাদু)
-- পড়ালেখা শেষ না কইরাই বাসর বাসর করলে তোর কপালে ওই ময়লাওয়ালাই জুটব।(রাফিদা আপু)
রাশিদা আপুর কথা শুনে হাসতে হাসতে আমাদের পেট ব্যথা হয়ে গেল। তখন দরজায় কেউ কড়া নাড়লো। দরজা খুলে দেখি আন্টি মানে সাদুর আম্মু এসেছে দেখার জন্য আমাদের সাজানো হয়েছে কিনা। আমরা সবাই একসাথে বললাম আরেকটু সময় লাগবে।
আন্টি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আঁখিকে দিয়ে নিয়াজ ভাইয়া কে বাসর ঘর সাজানো হয়েছে যে রুমে সেখানে নিয়ে আসলাম। নিয়াজ ভাইয়া এসে বলল,,,
-- আমার আগে দেখি আমার বউকেই বসিয়ে রেখেছিস। বাহ এত সুন্দর করে ঘর কিভাবে সাজালি তোরা?
আমি বললাম,,,
-- হাত দিয়ে।
তখন সাদু নিয়াজ ভাইয়ার সামনে এগিয়ে দুই হাত পেতে বলল,,,
--এবার কী দিবেন দেন?
-- তোদের সবাইকে একটা করে এক টাকার চকলেট গিফট করবো নে। এখন যা।(নিয়াজ ভাইয়া)
তখন রাফিদা আপু, সার্থক ভাইয়া, সুমাইয়া, আঁখি সুমনা সহ আমরা রুমের যারা ছিলাম সবাই একসঙ্গে ভাইয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একেক জন একেক জনের মতো করে টাকা চাইতে লাগলাম। কেউ বলছে টাকা দেও! কেউ বলছে টাকা চাই! কেউ বলছে ভাইয়া চিটিং করবেন না! কেউ বলছে বাসর ঘর কিন্তু আমরা ভেঙে দিয়ে যাব! যে যে যার যার মতো করে প্রলাপ শুরু করলাম। একেবারে মাছের বাজার বানিয়ে ফেললাম। ভাইয়া আর সহ্য করতে না পেরে দুই হাতে কান চেপে চিৎকার করে বলে উঠলো,,,
--স্টপ!!!!
ভাইয়ার এক চিৎকারে আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম। আমরা সবাই সবার দিকে একবার একবার করে তাকিয়ে আবার ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। তখন ভাইয়া বলল,,,
--ওকে ফাইন!টাকা কত লাগবে বল।
তখন সাদু বলে উঠল,,,
-- পঞ্চাশ হাজার টাকা মাত্র!
ওর কথা শুনে আমি নিজেই বোকা বনে গেলাম। কারণ আমাদের বাজেট এত ছিল না। ওর কথা শুনে সার্থক ভাই ও বলে উঠলো,,,
-- হ্যাঁ! হ্যাঁ! আমাদের পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে। এর থেকে পয়সাও কম না।
আমাদের কথার মাঝেই আলআবি ভাইয়া ঘরে প্রবেশ করল। ভাইয়াকে দেখেই নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলো,,,
--ভাই আমারে গরু জবাই করার মতন জবাই করতেছে তাড়াতাড়ি বাঁচা।
আলআবি ভাইয়া একবার আমাদের সবার দিকে দৃষ্টি দিয়ে আরেকবার নিয়াজ ভাইয়ার আর দিকে দৃষ্টি দিলেন। তারপর বলে উঠলেন,,,
-- বিয়ে তোর!বউ তোর! বাসর তোর! তাড়াও তোর।ওদের তো আর তাড়া নেই। তাই যা চাচ্ছে তা দিয়ে দে।
আলআবি ভাইয়ার কথা শুনে আমাদের খুশি আর দেখে কে। আমরাও সবাই হাসি হাসি মুখ করে নিয়াজ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।তখন নিয়াজ ভাইয়া বলল,,,
--আমি কি ব্যাংক নাকি যে পঞ্চাশ হাজার টাকা সাথে নিয়ে ঘুরব।এখন এতো নেই আমার কাছে।
--ওকে তাহলে কত দিবে? (আমি)
--আপাতত বিশ।(নিয়াজ ভাইয়া)
--আচ্ছা আমাদের তবে বিশ হাজারই দে। আজকের রাতটা তাসফির ছবি নিয়ে ঘুমা।বাকি ত্রিশ যেদিন দিবি সেদিন বউটাও নিয় নিস।(সার্থক ভাইয়া)
--শালা তুই বিয়ে করে তো পাড় পেয়ে গেলি।বিয়ে না করলে আমিও ভবিষ্যতে দেখাইয়া দিতাম তোরে।( নিয়াজ ভাইয়া)
-- ভাইয়া বাসর রাতটা কি ইনজয় করতে মন চাচ্ছে না আপনার? তারাতারি টাকা টা দেন।(সাদু)
--আগে তোরা অ্যামাউন্ট টা কমা। প্লিজ ভাই আমার বোন আমার এমন করিছ না তোরা।(সাদু)
-- আচ্ছা ভাইয়া তাহলে ফিফটি-ফিফটি দাও। পঁচিশ হাজার দাও।( রাফিদা আপু)
-- ওকে পঁচিশ হাজার। বাকি পঁচিশ হাজার কিন্তু মাফ।(নিয়াজ ভাইয়া)
--আরে ব্যাটা আগে টাকা বাইর কর তুই। (সার্থক ভাইয়া)
ভাইয়া টাকা বের করে আমাদের দাওয়ার পর আমরা সবাই বের হয়ে আসলাম। আমরা কাঙ্খিত ঘটনার জন্য সবাই দরজার বাইরে অপেক্ষা করছি। আলআবি ভাইয়া সামনে এগিয়ে কেবল ৪-৫ কদম ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে নিয়াজ ভাইয়ার রুম থেকে বিকট আওয়াজ ভেসে আসলো। আমরা সবাই এটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে গেল।
আমরা সবগুলো হাসতে হাসতে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছি। তখন আলআবি ভাইয়া আমাদের এমন অবস্থা দেখে পিছিয়ে এলেন। এসে নিয়াজ ভাইয়ার রুমে ঢুকলেন। একটু পরে তিনিও বের হয়ে আমাদের মতো দমফাটা হাসি তে ফেটে পড়লেন। এই প্রথম লোকটাকে এত সুন্দর করে হাসতে দেখলাম। হাসলে তার চোখ গুলো ঈষৎ সংকুচিত হয়ে যায়। তিনি শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছেন। মনে হচ্ছে তার সাথে তার চোখ দুটোও হাসছে। এক গালে তার হালকা করে একটা টোল পড়ে। এই রকম দৃশ্য দেখে আমার নিজের হাসিই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে।
এর মধ্যেই নিয়াজ ভাইয়া আর সজল ভাইয়া রুম থেকে বেড়িয়ে আসলেন। তাদের দুজনকে দেখে আমাদের হাসির মাত্রা আরও বেড়ে গেল। কারণ নিয়াজ ভাইয়ার পাশে সজল ভাইয়া শাড়ি পরে দাড়িয়ে আছে।সবচেয়ে বেশি হাসি পাচ্ছে সজল ভাইয়াকে শাড়ি পরা দেখে।সজল ভাইয়ার মুখেও অট্টহাসির ছাপ।
আসল কাহিনী হলো সাদুর আম্মু চলে যাওয়ার পরে আমরা সবাই মিলে সজল ভাইয়াকে তাসফি আপুর শাড়ির মতো একটা শাড়ি পড়িয়ে বড় একটা ঘোমটা দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেই। তারপর নিয়াজ ভাইয়া কে ডেকে নিয়ে আসি। এটা আমাদের সকলেরই মিলিত পরিকল্পনা ছিল।
ধীরেসুস্থে আমাদের হাসির মাত্রা কমিয়ে নিলাম। এরপর সার্থক ভাইয়া বলল,,,
--ভাই দশ হাজার টাকা হবে?
--এহ্ আমি কি টাকা বিতরণ করতে আসছি। আর তুই যেমনে চাইলি এমনে তো ফকিরও টাকা চায়না।(নিয়াজ ভাইয়া)
-- আচ্ছা যা তাইলে এখন কোলবালিশ নিয়ে ঘুমা। তাসফির একটা ছবিও দিবো না তোরে।(সজল ভাইয়া)
--ভাই একটু রহম কর। আজকে এই মুহূর্তে তোদের আমি আর টাকা দিতে পারব না। যা প্রমিস করলাম কালকে তোদের দশ হাজার দিব।
--সত্যি তো?(সুমনা আপু)
--হ।তোদের বাড়ির বিলাইটার কসম।(নিয়াজ ভাইয়)
আমরা সবাই একসাথে বলে উঠলাম,,,
"কি?"
--আব...না মানে দিব দিব। কালকেই দিয়ে দেবো।(নিয়াজ ভাইয়া)
আমরা সবাই এরপর তাসফি আপুকে নিয়াজ ভাইয়ার কাছে রেখে এসে বাড়ির ছাদে উঠলাম।উদ্দেশ্য হলো সবাই মিলে আমরা ছাদে গল্প করব। আমরা ছাদে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই মোর্শেদ খালুর সেই বিখ্যাত ফোনের রিংটোন কোথা থেকে যেন বেজে উঠল।
চলবে...
Writer:- হুমাশা এহতেশাম