ভরা মজলিশে আলআবি ভাইয়া যে এমন দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিবেন তা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। আলআবি ভাইয়া আমার ডান হাতের কব্জি ধরে দৌড়াচ্ছেন। আমিও তার পিছনে পিছনে দৌড়ে যাচ্ছি। এমন মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে কেউ পিছন থেকে বলবে "ভাগ সিমরান ভাগ"। এই মুহূর্তে আমার ভেতরের অনুভূতিটাও এমনই হচ্ছে। আমারও মনে হচ্ছে "জিলুঙ্গি আপনি জিন্দেগি"।
কিছুক্ষণ আগে,,,
জায়েফের কণ্ঠ শুনেই ফোনের স্ক্রিন থেকে সামনে দৃষ্টি রাখি। আমার মুখোমুখি হয়ে সামনের চেয়ারটায় বসে আছে জায়েফ। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেই আমার সামনে বসে আছে। কারণ এই মুহূর্তে সে চোখে কালো সানগ্লাস পড়ে, মুখে মাস্ক পড়ে, তার হুডি দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে। তার হাবভাব দেখেই আমি আন্দাজ করতে পারছি চারপাশের উপচে পড়া জনতার জন্য সে এই বেশভূষা গ্রহণ করেছে।
তাকে দেখে না যতটুকু ভয় করছিল এখন তার বলা বাক্যটি শুনে তার থেকে বেশি রাগ হচ্ছে। নিজেকে সংযত করে তাকে বললাম,,,
-- আমাকে একদম বোকা ভাববেন না আর বোকা বানাতে ও আসবেন না। আমি জানি আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।
সে তার পূর্বের ভঙ্গিমাতেই আবার বলে উঠলো,,,
--ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। ক্ষমা তো হয়নি।
আমি স্বাভাবিক কন্ঠে তাকে বললাম,,,
--ক্ষমা করার কথা ছিল কোন দিন? আপনার ব্যবহার তো এখনো ঠিক নেই। একটু আগেই আপনি আপনার ভদ্রতার পরিচয় দিয়েছেন।
--আসলে কি বলতো? ফ্লার্ট না করলে একদমই ভালো লাগেনা। এইটুকু অন্তত জানই যে আমি বড় হয়েছি বাইরের দেশে। তোমাদের কালচারের সাথে অভ্যস্ত না।
তার সামনে বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না। কিছুটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। এমন সময় তড়িৎ গতিতে আলআবি ভাইয়া এসে আমার পাশে ধপ করে বসে পড়লেন। জায়েফ আর আলআবি ভাইয়া দুজন দুজনকে কিছুটা মুহূর্তের জন্য ভাল করে পরখ করে নিলেন। এরপর জায়েফ সবার আগে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,,,
--হ্যালো! আমি জায়েফ এহমাদ।
আলআবি ভাইয়া একপলক জায়েফের পানে তাকিয়ে আরেক পলক তার হাতের দিকে তাকালো। এরপর সেও হাত বাড়িয়ে বলে উঠলো,,,
--হায়! আমি আলআবি মাশরুখ।
জায়েফ আলআবি ভাইয়া কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,,,
--চিনেছেন নিশ্চয়ই?
তখন আমি আলাবি ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। দেখি সে কেমন একটা বিটকেল মার্কা হাসিমুখে ঝুলিয়ে বলল,,,
--না। চিনতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। ওয়েট!
কথাটা বলেই আলআবি ভাইয়া একটু দাঁড়িয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে গিয়ে হুট করে জায়েফের মুখের মাস্ক টান দিয়ে নিচে নামিয়ে দিল। সাথে সান গ্লাসটা ও নিয়ে নিলো। হঠাৎ করেই এক বাজখাঁই গলার স্বরে আলআবি ভাইয়া চেঁচিয়ে বলে উঠলো,,,
--ও মাই গড! জায়েফ এহমাদ!
সঙ্গে সঙ্গে উৎসুক জনতার উপচে পড়া ঢল নামলো জায়েফের উপর।সবাই জায়েফ জায়েফ করে চেঁচিয়ে তার দিকে ছুটে আসছে।এমুহূর্তে বেচারার মুখটা দেখার মতো হয়েছে। ঠিক তখনই আলআবি ভাইয়া আমার হাত ধরে আমাকে একপ্রকার টেনে তুলে দৌড়াতে শুরু করলো।আর তখনি আমর সিমরানের কথা মনে পরলো।
একটু আগে আলআবি ভাইয়ার করা কাজটি আমার তখন বোধগম্য না হলেও এখন হচ্ছে।আমরা দুজনে এখন চতুর্থ ফ্লোরে এসে লিফট থেকে নেমেছি।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছি।তখন চোখের সামনে ঘড়ি পরিহিত একজনের লোমশ হাত দেখতে পেলাম, যেই হাতে রয়েছে একটা পানির বোতল।হাত অনুসরণ করে দেখি আলআবি ভাইয়া থমথমে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বোতল টা আমার সামনে ধরে রেখেছেন। তাকে দেখে কেউ উপলব্ধিই করতে পারবে না সে যে একটু আগে এতো বড় কান্ড ঘটিয়ে এলো। পানির বোতল টা নিয়ে ধীরে সুস্থে খেয়ে নিলাম।হঠাৎ আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,
--যেখানে অস্বস্তি হচ্ছিল সেখানে বসে থাকার দরকার কি ছিল?
তার দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখি সে প্রশ্নসূচক চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।সে যে আমার থেকে পাল্টা উত্তর আশা করছে তা আমার বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না।কিন্তু এমুহূর্তে আমার মাথায় ঘুরছে অন্য ভাবনা।আলআবি ভাইয়া কেনো এমন একটা কান্ড করলেন? তার সাথে যেহেতু আগের থেকে কথাটা এখন একটু বেশি বলি,যেহেতু তার সাথে সহজ হয়ে এসেছি তাই তাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম।
--আচ্ছা আপনি ওমন কেন করলেন? (আমি)
উনি হতাশাগ্রস্ত এক চাহনি দিয়ে আমাকে বললেন,,,
--যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর!
সে আবারো বলে উঠলেন,,,
--তোমার ছোট মাথায় ঢুকবে না।চলো তোমার ভাই আবার তোমাকে এতোসময় না দেখলে ভাববে তার ফিডার খাওয়া বোন নিয়ে আমি ভেগেছে।
তার এরূপ কথায় আমি রেগে গেলাম।তাকে কটমট করে বললাম,,,
--হ্যাঁ! আমি ফিডার খেলে আপনি এখনো ডায়াপার পরে বেড়ান।
বলেই হনহনিয়ে তিন তলায় চলে গেলাম।একা এসেও পরে গেলাম মুসিবতে।ভাইয়ারা কোন স্টলে বুঝবো কীভাবে? তাই প্রত্যেকটা স্টলেই ঘুড়ে ঘুড়ে ওঁদের খুঁজে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ করেই কেউ আমার হাত ধরে সোজা হেটে যাচ্ছে। একমুহূর্তের জন্য মনে হলো আমার কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে। কিন্ত হাত ধরে হাটতে থাকা লোকটার পানে তাকিয়ে আলআবি ভাইয়াকে দেখে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
একটু সামনে এগিয়ে এসে ভাইয়াদের পেয়ে গেলাম।আমাদের দেখে সজল ভাইয়া বলে উঠলেন,,,
--আলুবাবু?ফুডকোর্টের খাবার কি সব একলাই খেয়ে এসেছিস?
কথাটা আমার কর্ণপাত হতেই হাসতে হাসতে আমার গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা হয়ে গেলো।কথাটা যে আলআবি ভাইয়াকেই বলা হয়েছে তা বুঝে গিয়েছি।আমার সাথে তাসফি আপুও হেঁসে উঠলো। কিন্তু আপু হাসিটা চেপে রাখছে।আমি কোনো মতেই হাসি থামাতে পারছি না।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে নিয়াজ ভাইয়া আমাদেরকে চুপ থাকতে বললেন।কিন্তু আলআবি ভাইয়া কোথায় যেন চলে গেলেন। আমি সজল ভাইয়া কে বললাম,,,
--কি হলো?
সজল ভাইয়া বলতে লাগলো,,,
--ওকে আলুবাবু বললে রাগ করে।আসলে ও ছোট বেলায় খুব স্বাস্থ্যবান ছিল।বুঝই তো ছোট গলুমলু বাচ্চাদের আদর করে সবাই একটু আকটু আলু খালু বলে ডেকে থাকে।ওর বেলাতেও ব্যতিক্রম হয়নি।আমরা ফ্যামেলি মেম্বাররা, কাজিনরা এখনো দুষ্টমির ছলে ওকে আলুবাবু বলে ডাকি।আজকে আসলে ভুলটা আমারই।ওকে কাজিন সার্কেলের বাইরে আলু খালু বলে ডাকতে ও একদম নিষেধ করে দিয়েছে।রাগটা আজকে মনে হয় ও একটু বেশিই করে ফেলেছে।এখান থেকে গিয়ে ওকে সরি বলতে হবে।
--ও তাহলে এই ব্যাপার।আমার হাসাটা উচিৎ হয়নি তাই না?(আমি)
--একক্ষেত্রে উচিৎ হয়নি আবার আরেক ক্ষেত্রে হয়েছে। দেখ তুমি তো আর জানতে না তাই না।আর তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে সেও তোমার মতো রিয়েক্ট করতো।
সব শপিং শেষ করে আমরা মলের বাইরে এসে দেখি আলআবি ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে।নিয়াজ ভাইয়া বলল,,,
--তাসফি ফুচকা খাবে?
তাসফি আপুর আগেই আমি বলে উঠলাম,,,
--হ্যাঁ!হ্যাঁ!হ্যাঁ!অবশ্যই খাব।এগুলো কি আবার বলা লাগে?
নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলো,,,
--এহ ভাব দেখ! মনে হয় যেনো আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছি।
--আমি তো হ্যাঁ ই বললতাম।আমার টা জুইঁ বলে দিয়েছে। একই তো হলো।(তাসফি আপু)
--হ্যাঁ।বলে দিয়ে আমার রোমান্স টাইম স্পয়েল করে দিল।কোথায় আমি একটু বলব "তাসফি ফুচকা খাবে"? তখন তুমি আমার কাছে ওর মতো বাচ্চামো করে লাফিয়ে লাফিয়ে ফুচকা খেতে চাইবে।আর আমি তখন ওই দৃশ্য দেখে আমার মন জুরাবো।আহা!
কথা গুলো বলেই আমার মাথায় দুই আঙুল দিয়ে গুঁতো মেরে বলল,,,
--মাথায় শুধু গোবর ভরা তোর।
আমি সবার প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করতে আড় চোখে সবাইকে দেখছি।তখন দেখি তাসফি আপু একটু রাগী রাগী চেহারা করে দেখছে ভাইয়াকে।সজল ভাইয়া তার মুখে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে আর আলআবি ভাইয়া একমনে পারলে মোবাইলের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। তখন আলআবি ভাইয়া মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে বলে উঠলেন,,,
--তোর বাচ্চা বোন কি জানে তার ভাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে রোমান্স শুরু করে দিবে।আর তোর রাস্তায় রোমান্স জাগে কীভাবে ভাই?
আলআবি ভাইয়ার বাচ্চা বলায় তাকে জোড় গলায় বলে উঠলাম,,,
--বাচ্চা কে?
--১৮ বছরের নিচে সকল ছেলে-মেয়ে কে সরকার বাচ্চা বলে ঘোষণা করেছে।আই মিন শিশু বলে।যেখানে তোমার নামও আছে।(আলআবি)
--আর কয়েক মাস পরেই আমার ১৯ হবে।আর ১৮ যেহেতু চলে সেহেতু আমি আর শিশু নই।(আমি)
--মাশাল্লাহ! জানতাম না তো? তাহলে বিয়ে করাই যায়।বয়স হয়েছে। (আলআবি)
তার মুখে এরূপ কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি।মুহূর্তের মধ্যেই বিষন্নতা এসে ঝেকে বসলো।বিয়ে নামক শব্দটাই তো আমার জীবন বিষিয়ে তুলেছে। একবার এই শব্দ টার সঙ্গে পরিচিত হয়ে জীবনের এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা আর অধ্যায়ের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। যার স্বাদ দ্বিতীয় বার আর নিতে চাই না।
হঠাৎ আমার সম্বিত ফিরে এলো ভাইয়ার কথায়।
--দয়া করে এখন ফুচকা খেতে চল?
ফুচকা খেতে এসে চুপচাপ শুধু খেয়ে যাচ্ছি। আজ আর ফুচকায় তৃপ্তি বলে কিছু খুজে পাচ্ছি না।দু একবার আলআবি ভাইয়ার দিকে নজর পরেছে।তাকে দেখলাম একটা চেয়ারে বসে কিছুটা ঝুকে মাথা নিচু করে দুই হাতের কনুই দুই হাটুর উপর ভর দিয়ে নিচের দিকে দৃষ্টি রেখে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে।
রাতে বারান্দায় বসেছিলাম তখন ভাইয়া এসে দরজায় নক করে।দরজা খোলাই ছিলো।সচারাচর খোলাই থাকে।শুধু রাতে দরজা বন্ধ করে ঘুমাই। ভাইয়া দরজা খোলা থাকা সত্ত্বেও নক করে আসে।ভাইয়া এসে আমার পাশেই বসে পরলো।
--আজ জায়েফ এসেছিলো আমি জানি।
ভাইয়ার কথায় অবাক করা দৃষ্টিতে তাকালাম।ভাইয়া আবারও বলতে শুরু করলো,,,
--কখনো অতীত আর ভবিষ্যৎ নিয়ে পরে থাকতে হয় না।বর্তামানে তুই কি করছিস তা হলো মুখ্য বিষয়।যখন কেউ একটা জামা পরিধান করে তখন তার ওড়না ঠিক আছে কিনা, পায়জামা ঠিক আছে কিনা, জামাটা আয়রন করা কিনা,জামাটার সাথে কোন ব্যাগ বা হিজাব টা মানাবে তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।জামাটা পরিধানের আগে যেই জামা টা সে পরে থাকে সেটা হয়তো পুড়নো হলে ফেলে দেয় অথবা ধুয়ে আলমারিতে তুলে রাখে।কখনো দেখেছিস সে এক জামার সাথেই দুইটা ওড়না বা দুইটা পায়জামা এক সাথে পরেছে।আবার অপর দিকে সে ভবিষ্যতের জন্য ভালো জামা গুলো তুলে রাখছে।সঠিক সময় সঠিক স্থানেই সেগুলো পড়বে বলে।তোকে কেবল উদাহরণের জন্য জামা দিয়ে বুঝালাম।এখন কতটুকু তুই বুঝেছিস তা তোর ব্যাপার।
ভাইয়ার সাথে আরো কিছুসময় কথাবার্তা বলে ঘুমিয়ে পরলাম।ভোরের দিকে মেঘের গর্জন এসে জানান দিলো বৃষ্টি হচ্ছে।ঘুম ভাঙতেই দেখলাম ঘড়িতে ৫ টা বেজে ১০ মিনিট। বাইরে তুমুল বেগে ঝড় হচ্ছে। নামাজ টা পড়ে খেয়াল করলাম, বৃষ্টির গতি এতই বেশি যার ফলে বৃষ্টির ঝাপটা এসে বারান্দা পেড়িয়ে কিছুটা বারান্দার দরজার সামনের জায়গা টুকু কেও ছুঁয়ে দিচ্ছে। দরজা টা বন্ধ করার জন্য বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতেই চোখে পরলো নীল রঙের একটা বক্স।নীল রঙের বক্স বললে ভুল হবে কারণ বক্সটা মুলত নীল রঙের একটা রেপিং পেপারে মোড়ানো। তার উপরে হালকা হলদে রঙের একটা গোলাপ ফুল। গোলাপ টাকে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। নীল রঙের রেপিং পেপারে মোড়ানো বক্সটাতে ফোঁটা ফোঁটা জল কণা জমেছে। কাছে গিয়ে বক্সটা নিয়ে রুমে এসে পরলাম। বক্সটার উপর কাগজের টুকরোর ন্যায় কিছু একটা লক্ষ্য করলাম।ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলাম নীল কালিতে লেখা "বর্ষণ সঙ্গিনীর জন্য"যা বৃষ্টির পানিতে অস্পষ্ট হয়ে আছে।তবে লেখাটা বোধগম্য হচ্ছে।
হঠাৎ করে ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রীনে একটা আননোন নাম্বার ভেসে উঠেছে।নাম্বার টা কিছুটা পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। আবার অপরিচিত মনে হচ্ছে। ফোনটা দুইবার বেজে বেজেই বন্ধ হয়ে গেলো।তিনবার এর বার ফোনটা রিসিভ করলাম। ফোনের ওপাশের লোকটার কন্ঠ আমার চিনতে অসুবিধা হলো না। অন্য সময় হলে হয়তো রাগ হতাম বা ভয় পেতাম। তবে আজ আর তেমন কিছু হলো না। আগে থেকেই একটা ধারনা ছিল এমন কিছু হতে পারে।
--জুইঁফুল!
জায়েফ কেমন যেন এক কাতর কন্ঠে বলে উঠলো।
হ্যাঁ।জায়েফ ই কল করেছে।আমি আগে থেকেই ধারণা করে রেখেছিলাম সে আমাকে অবশ্যই বিরক্ত করবে।নিয়াজ ভাইয়ার রাতের কথাগুলো কেও ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছি। কোন প্রকার ভঙ্গিমা না করেই তাকে সোজাসাপ্টা উত্তর দিলাম,,,
--জ্বী বলুন।আমি শুনছি।
সে পূর্বের ন্যায় বলল,,,
--আই এম রিয়েলি সরি।
আমি তাকে কঠিন গলায় জবাব দিলাম
--কিসের জন্য?
--আমার করা অন্যায়ের জন্য।(জায়েফ)
--যেই আমি সামান্য আঘাতটুকু ভুলতে পারি না,সেই আমি কি করে একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষের দেয়া আঘাত ভুলে যাবো?(আমি)
-- তুমি আমাকে তার বদলে আঘাত দাও, শাস্তি দাও। আমি হাসিমুখে সব মেনে নিব।(জায়েফ)
-- একদমই না। আমাকে আপনার মত ভেবে থাকলে আপনি ভুল করছেন। খুনের বদলে কখনোই খুন হয় না, আমার মতে। আমাকে আঘাত দেয়ার কারণে আপনাকে আঘাত দিলে আপনার আর আমার মধ্যে পার্থক্য রইল কোথায়।(আমি)
-- ঠিক আছে। তাহলে অন্যায়ের তো শাস্তি হয় তুমি আমাকে না হয় শাস্তিই দাও।(জায়েফ)
-- এত করে যখন আপনি শাস্তি চাচ্ছেন তাহলে শুনে রাখুন - আমি আপনাকে কখনো ক্ষমা করতে চাইনা। হয়তোবা কখনো ক্ষমা করতে পারবও না। আর এটাই হবে আপনার শাস্তি।(আমি)
-- জুঁইফুল তুমি এটা বলতে পারলে? (জায়েফ)
--হ্যাঁ পারলাম। কারণ আপনি যদি জেনে শুনে অন্যায় করে বলতে পারেন আপনি অন্যায় করেছেন এখন আপনি ক্ষমা চাচ্ছেন তাহলে আমিও বলতে পারি। শুনে রাখুন আপনি আমার অতীত। অতীত কে আমি অতীতই রাখতে চাই। আর আমি বলে দিয়েছি আপনার শাস্তি কি তাই দয়া করে আমাকে আর বিরক্ত করবেন না।(আমি)
আর এক মুহূর্তের জন্যেও কথা না বাড়িয়ে ফোনটা কেটে দিলাম। মোবাইলটা বালিশের উপর রেখে বিছানায় নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম। আজ মনে হচ্ছে আমারও আম্মু থাকলে বুঝি এরকম টা হত না। আজ আমারও আম্মু থাকলে তার কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে তাকে আমার সব দুঃখ, কষ্ট,বেদনার অংশ ভাগ করতাম। আজ আমারও আম্মু থাকলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে প্রতিরাতে এক নিশ্চিন্তময় ঘুমের রাজ্যে পাঠিয়ে দিত।
আজ মনে হচ্ছে এই এক শব্দের মা নামক ব্যক্তি টা থাকলে বুঝি সব অসম্ভবই সম্ভব হয়ে যেত। মা নামক ছোট্ট শব্দের মহান ব্যক্তির মাঝে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা' নিহিত থাকে। যে ভালোবাসা মা ছাড়া পৃথিবীর আর অন্য কোনো ব্যক্তির কাছেই থাকে না। এখন মনে হচ্ছে চিৎকার করে বলি আমারও কেন একটা মা নেই। হাটুর উপর বালিশ রেখে মুখ গুঁজে অঝোর ধারায় কান্না করে যাচ্ছি।
অনেকটা সময় পর নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসলাম। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়েই বিছানার উপর সেই বক্সটা চোখে পড়ল। বক্সের পাশে গোলাপ ফুলটা পড়ে রয়েছে। বিছানার উপর আরাম করে বসে বক্সটি খুলতে লাগলাম। মনের মাঝে হাজারো প্রশ্নের পাহাড় জমে গিয়েছে। বক্সটা কে রাখল? বারান্দায় কে দিল বক্স টা? সত্যিই কি আমার জন্য? নাকি অন্য কারো? ধুর! অন্য কারো হবে কেন? আমার বারান্দায় রেখেছে অবশ্যই আমার জন্য হবে।
বক্সটা খোলার সাথে সাথে বেলি ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ আমার নাকে এসে ধাক্কা দিল। দেখালাম বক্সের ভিতরে একটা বেলি ফুলের মালা। মালাটার নিচে কাগজে লেখা কিছু একটা গুঁজে দেওয়া হয়েছে। বেলীফুল দেখে মনটা আনন্দে একেবারে বাকবাকুম হয়ে গেল। বেলি ফুল আর তার ঘ্রাণ আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমার বারান্দায় অবশ্য বেলি ফুলের গাছও রয়েছে। ফুল টার নিচে একটা হালকা আকাশী রঙের শাড়ি ও দেখা যাচ্ছে। শাড়ীটায় হাল্কা আকাশী রঙের সাথে হালকা গোলাপি রঙের পাড় রয়েছে। শাড়িটার ভেতরের অংশে ও হালকা গোলাপী রঙের স্টেপ রয়েছে। সাথে আরও দেখতে পেলাম একটা এন্টিকের কোমর বন্ধনী। এটাকে হয়তোবা কোমর বিছাও বলে থাকে। এতক্ষণে আমার চোখ পড়ল কাগজ টার দিকে। যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে কিছু একটা লেখা রয়েছে। কাগজটা নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।
"আমার #বর্ষণ_সঙ্গিনী,
তুমি কি জানো তুমি যে নিজের অজান্তেই কত বড় একটা ভুল করে বসে আছো? তুমি কি জানো তুমি যে তোমার নিজের অজান্তেই আমার হয়ে গেছো? তুমি কি জানো তোমার সুবাস যে শুধু আমার জন্যই? তুমি কি জানো তোমার ওষ্ঠদ্বয় এর নিচের ঈষৎ গর্তে কতটা মাদকতা জড়িত? তুমি কি জানো তোমার হরিণী আঁখিদ্বয় কতটা বিমোহিত করে আমায়? জানো না তুমি। তুমি এর কোন কিছুই জানোনা।জেনে রাখ, তোমার বেদনাসিক্ত চেহারা আমায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। তোমার চোখের এক এক ফোটা অশ্রু বিন্দু আমার বুকের বা পাশে লাভার ন্যায় গড়িয়ে পড়ে। সব শেষে শুধু এতোটুকুই জেনে রাখ যে, আমার জীবনের #বর্ষণ_সঙ্গিনী শুধু তুমিই হবে। অপেক্ষা শুধু সঠিক সময়ের।
তোমার বর্ষণ সঙ্গি"।
লেখাটা পড়ে মনে হচ্ছে আমার চারপাশ ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। হায়! হায়! এমন পাগল আবার কোথা থেকে উদয় হল? আমি তো বাঁচি না আমার দুশ্চিন্তায়। তার উপর নতুন পাগলের আমদানি। উফফ কি যে হচ্ছে আমার সাথে। ভার্সিটির ও সময় হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে সাদু কে বলতে হবে এগুলো।
হালকা-পাতলা কিছু নাস্তা করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হলাম। সাদু আর আমার একটা নির্দিষ্ট জায়গা আছে। ওখানেই দুজনে একত্রিত হই তারপর একসাথে ভারসিটি যাই। দূরে থেকেই দেখতে পাচ্ছি সাদু দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুখে বিরক্তির ভাব একেবারে স্পষ্ট। ওর কাছে যেতেই ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো,,,
--কোন বিমান দিয়া আইছোস তুই?এই জায়গার থেইকা এই জাগায় আইতে এতো সময় লাগে?
--আমি না হয় দেরি কইরা আসলাম। তুই কোন বিমান দিয় এতো তাড়াতাড়ি আইছোস?কি কেসটা কি বাবু?কার লগে দেখা করতে এতো তাড়াতাড়ি বেড় হইছোস?(আমি)
--তোর শশুর এর লগে দেখা করতে আইছি।(সাদু)
--নাউজুবিল্লাহ! ছিঃ!ছিঃ!ছিঃ!আর মানুষ পাছ নাই? শেষ পর্যন্ত বুড়া বেডার লগে দেখা করতে আইলি। বাসায় জানে?(আমি)
সাধু আমার দিকে কটমট করে কতক্ষণ তাকিয়ে হাটা ধরল। ওর পিছন পিছন আমিও হাঁটা ধরলাম। এরপর আমরা দুজন রিক্সা দিয়ে ভার্সিটির সামনে এসে নামলাম। ক্লাসের ফাকে ফাকেই সাদুকে সকালের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বললাম।সাথে জায়েফ এর কথাও বললাম। যে কাগজটায় লেখা ছিল সে কাগজ টা ভার্সিটি আসার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম।সাদুকে সেটাও দেখালাম।
-- বাহ! তোর জীবনে তাহলে নতুন দিওয়ানার এন্ট্রি হইলো। ভেরি ইন্টারেস্টিং। আই লাইক ইট।(সাদু)
-- বাট আই ডোন্ট লাইক ইট। এইসব দেখলে এখন আমার গা চুলকায়। যাই হোক, আজকের পরে যদি এমন কোন কান্ড আবার ঘটেরে তাইলে দেখিছ সোজা ভাইয়ারে বইলা দিব।(আমি)
-- তোর মধ্যে কি কোন রস কস দেয় নাই আল্লাহ। দেখ তোরে কত সুন্দর সুন্দর গিফট দিছে। সামনে আরো দিলে আরো ভালো হইবো। মজা হইবো রে! আমারেও দিছ একটু ভাগ(সাদু)
-- আয় তোরা ভাগ দেই।
কথাটা বলেই সাদুর চুল ধরে টানাটানি শুরু করে দিলাম।সাদুও আমার হিজাব ধরে টানাটানি শুরু করে দিলো। মারামারি করতে করতে আমরা যে যার বাসায় চলে আসলাম।
বাসার সামনে এসে আরেকদফা ঝাটকা খেলাম। আমাদের বাসার গেটের সামনে এসে দেখি আলআবি ভাইয়া দাঁড়ানো। মুখমন্ডল তার গম্ভীরতায় ছেয়ে গিয়েছে। তাকে কিছু বলার আগেই সে আমার হাত ধরে গেটের ভিতরে নিয়ে এলো। এরপর এক বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে বলে উঠলো,,,
--রাস্তায় কিভাবে চলতে হয় সেই ম্যানার্স টুকুও নেই?
তার এরূপ ব্যবহার দেখে অনেকটা ভড়কে গিয়েছি আবার একটু ভয়ও লাগছে। আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে আবারো জোর গলায় বলে উঠলো,,,
--ভার্সিটিতে কি যাও ঝগড়া করার জন্য?
তার এমন আচরণ আর এমন কথাবার্তার কোন কিছুই আমার কাছে বোধগম্য হচ্ছে না মাথা তুলে তার দিকে কিছুটা প্রশ্নসূচক ভাবে তাকালাম। তার কপালে বিন্দুবিন্দু ঘামের ছোঁয়া রয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ক্লান্ত অথবা খুব দ্রুততার সঙ্গে কোন কাজ করেছে যার জন্য সে হাঁপিয়ে উঠছে বারবার। আমি তাকে কিছু বলার আগেই সে হন হন করে গেট দিয়ে বের হয়ে বাইকে করে চলে গেল। আজকে আমার সাথে ঘটা আজব আজব কান্ড দেখে মনে হচ্ছে নিজেই পাবনায় টিকিট কেটে চলে যাই।
বাসায় এসে দেখি কমলা আন্টি রান্না করছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম,,,
--আজকে তুমি হঠাৎ রান্না করছো যে? (আমি)
--মনে চাইলো তোমারে একটু রাইন্দা খাওয়াই। ডেইলি তুমিই তো রান্দো।( কমলা আন্টি)
দুপুরে ভাইয়া বাসায় লাঞ্চ করে না। আমি আর বাবাই লাঞ্চ করে থাকি। মাঝে মাঝে কমলা আন্টিও থাকে আমাদের সাথে। দুপুরে খাচ্ছিলাম আমরা। আজকে কমলা আন্টিও আমাদের সাথে খাচ্ছে। তখন বাবা বলে উঠলো,,,
-- জুই তোদের সব শপিং শেষ হয়েছে?
-- হ্যাঁ হয়েছে তো সব।
এরপর আমাদের মধ্যে আর কোন কথা হল না। ভাইয়া এখনো বাবার সাথে কথা বলে না। ভাইয়াকে অনেক বলেছি যা হওয়ার তা তো হবেই। এখন কথা না বলে লাভ কি? বাবা ও তো এখন কষ্ট পাচ্ছে। সে তো বুঝতে পেরেছে। তখন ভাইয়া আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। এড়িয়ে চলে গিয়েছিল।
বিকেলের দিকে সেই বক্সটা আর চিঠিটা সুন্দর করে গুছিয়ে আলমারিতে রেখে দিলাম। ফুল গুলো বাইরেই রাখলাম। রাতে ভাইয়া আসার পরে ডিনার করে একটু বই-খাতায় চোখ বুলিয়ে ভাইয়ার সাথে কিছু সময় গল্প করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
এভাবেই রুটিনমাফিক তিন চার দিন চলে গেল। একদিন বিকেলবেলা বারান্দায় বসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী গল্পটা পড়েছিলাম। হঠাৎ করে ফোনে একটা মেসেজ আসলো। মেসেজটা চেক করতে গিয়েই চমকে উঠলাম। কারণ মেসেজটায় লেখা ছিল,,,
"প্লিজ চুলগুলো একটু বেঁধে নাও। না হলে আমি আর পারছিনা। তোমার খোলা এলোমেলো চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে এতটা ইচ্ছে করছে যা তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না।"
চলবে...
Writer:- হুমাশা এহতেশাম