চোখ মুছতে মুছতে কলেজের গেইট দিয়ে ঢুকতেছি হঠ্যাৎ করে কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেলাম। আসলে চোখের মধ্যে একটা ময়লা পড়েছিলো তাই চোখ মুছতে মুছতে হাটতেছি।
চোখ খুলে দেখি একটা মেয়ে আমার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়, আর উঠেই ঠাসসস ঠাসসস ২ টা ছড় বসিয়ে দেয়!
মেয়েঃ এই কুত্তার বাচ্চা দেখে চলতে পারিস না?
আমিঃ এই ভদ্রভাবে কথা বলেন, আমি ইচ্ছা করে ধাক্কা দিই নাই। আর আপনি দেখে চলতে পারেন না?
মেয়েঃ এই ছোট লোকের বাচ্ছা, তোর সাহস তো কম না। আমার মুখে মুখে তর্ক করিস।
আমিঃ এই আপনি আমাকে যা ইচ্ছা বলেন। মা বাবাকে কিছু বলবেন না। তাহলে কিন্তু।
মেয়েঃ তাহলে কি করবি তুই? তুই জানিস আমি কে? আমি চাইলে ১ সেকেন্ডের মধ্যে তোকে এই কলেজ থেকে বের করে দিতে পারি।
মেয়েটার কথা শুনে মুহূর্তেই রাগ উঠে গেলো, মনে মনে ভাবলাম আমি যদি একবার আমার আগের রূপ দেখাই তাহলে বুঝবি আমি কি জিনিষ। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম যে, আমি এখানে লেখাপড়া করতে আসছি, কোনো ঝামেলায় পড়তে নয়।
আমার চুপ করে থাকা দেখে মেয়েটা আরো কয়েকটা গালি আর কিছু হুমকি দিয়ে চলে গেলো। চারপাশে কিছু স্টুডেন্ট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতেছিলো। একজন বললো....
ছেলেঃ ভাই নিজের পায়ে নিজেই কুঠাল দিয়েছো।
আমিঃ মানে!
ছেলেঃ মেয়েটাকে চেনো?
আমিঃ না।
ছেলেঃ কলেজে আজ মনে হয় নতুন?
আমিঃ হুম, ট্রান্সফার নিয়ে আসছি। ৩য় সেমিস্টার,,,,
ছেলেঃ ও আচ্ছা, সেজন্যই তো। মেয়েটার বাবা এই কলেজের সভাপতি, অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তি। এক নামে সবাই চেনে, মেয়েটা বাবার ভয় দেখিয়ে যা ইচ্ছা তাই করে। ওর সাথে কেউ টাক্কা দিয়ে পারে না।
ছেলেটার কথা শুনে আমি হাসতেছি, তারপর ছেলেটা বললো...
ছেলেঃ কি ব্যাপার হাসছো কেন?
আমিঃ না এমনি, আচ্ছা যাই ভাইয়া পরে কথা হবে।
এরপর ক্লাসের দিকে হাটা দিলাম, চলেন এবার আপনাদের পরিচয় টা দিয়ে দিই। আমি জুয়েল, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়তেছি, আপাতত আমার কেউই নাই। এক ধরনের এতিম। আবার এটা ভাববেন না যে আমার বাবা মা নেই!
সবাই আছে, কিন্তু আমাকে বাসা থেকে বের করে দিছে। এখনো কিছু বুঝছেন নাতো? চলেন বুঝিয়ে বলি.....
আমি ছিলাম বখাটে ছেলেদের লিডার, এমন কোনো খারাপ কাজ নেই যেটা আমি করিনি, মারামারি, রাজনীতি এমনকি মাদকের ব্যবসাও করেছি। প্রতিদিন আমার নামে বাসায় বিচার আসতো, বাবা প্রতিদিন আমাকে অনেক বকাঝকা করতেন কিন্তু কোনো হতো না। এভাবেই দিন যাচ্ছিলো আর বাবা আমার উপর দিন দিন খেপে কাঠ হয়ে যাচ্ছিলো।
একদিন আমার এক বন্ধু একটা মেয়েকে প্রপোজ করে কিন্তু বন্ধু বখাটে বলে মেয়েটা রিজেক্ট করে দেয়, তারপর আমরা মেয়েটার বাসায় গিয়ে ওর বাবাকে মেরে মেয়েটাকে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসি। কিন্তু ভুলবশত কারনে মেয়েটা পালিয়ে যায়। পরে আমাদের সবার নামে মামলা দেয়, সেজন্য বাবাকেও থানায় যেতে হয়। অনেক কষ্টে জরিমানা দিয়ে বাবা আমাকে বাসায় নিয়ে আসে।
এরপর সবার সামনে ডান গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলে,,, "তোর মতো ছেলের দরকার নেই, আজ থেকে তুই এই বাসায় থাকতে পারবি না, আমি মনে করবো আমাদের কোনো সন্তান ছিলো না। তোর মতো কুলাঙ্গার কে জন্মদিয়েই আমি ভুল করেছি। বেরিয়া যা এখন বাসা থেকে, যদি জীবনে কখনো ভালো হতে পারিস তখন আমার সামনে আসবি। আর নহলে আমি মরে গেলেও আসবি না।
মা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখতেছিলো, কিছু বলার থাকলেও বলতে পারছে না, কারণ বাবার কথার উপর কথা বলার মতো সাহস আম্মুর আদো হয়ে উঠেনি। বাবার কথা গুলো সহ্য করতে না পেরে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।
সেদিন ভেবেছিলাম, বাসা থেকে বের হয়ে গেলে ভালো থাকতে পারবো কিন্তু না, যখন বাইরে চলে আসলাম দেখলাম আমার পাশে কেউই নেই, আমার রাজনীতি, গুণ্ডামি এলাকার বড় ভাই কেউই ছিলো না। রাস্তার কুকুর পর্যন্ত আমাকে ঘৃণা চোখে দেখেছে।
অনেক জনকে কল দিলাম, কেউই আমাকে সাহায্য করতে আসেনি। সেদিন রাতটা রাস্তার পাশে একটা ল্যাম্পপোস্ট এর নিচে কাটাই, আমি একা না, আমার পাশে কিছু কুকুরও ছিলো। তখন বুঝলাম মাথার উপরে বাবার ছায়াটা কতো গুরুত্বপূর্ণ।
তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে ভালোভাবে পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। আর আজ থেকে সব ধরনের রাজনীতি, গুণ্ডামি বাদ দিয়ে দিলাম, সাধারণ ভাবে চলবো। কোনো দিন বিপদে পড়লেও আর এই লাইনে আসবো না।
তারপর এক মামাতো ভাইয়ের সাহায্যে আগের কলেজ থেকে ট্রান্সফার নিয়ে এই কলেজে চলে আসলাম, এবং ২ টা টিউশনি নিলাম। ওগুলো দিয়েই নিজের খরচ চালিয়ে যাচ্ছি। আর আজকেই প্রথম দিন। প্রথম দিনই কি ঘটলো আপনারাতো দেখলেন,,,
আপনাদের পরিচয় দিতে দিতে প্রিন্সিপাল এর রুমে চলে আসলাম,,,,
আমিঃ আসসালামু আলাইকুম, স্যার আসতে পারি।
স্যারঃ হুম আসো! কি চাই,,,
আমিঃ স্যার আমাকে জাহিদ ভাই (মামাতো ভাই) পাঠিয়েছে। আপনার সাথে কথা বলার জন্য বলেছে।
স্যারঃ ও আচ্ছা আচ্ছা। তোমার কথা আমাকে জাহিদ বলেছিলো। কি যেন নাম তোমার?
আমিঃ জ্বি স্যার জুয়েল!
স্যারঃ আচ্ছা ভালো, এখানে কোনো সমস্যা হলে তুমি সরাসরি আমাকে জানাবে। আর কোনো কিছুর দরকার হলেও বলবে।
আমিঃ জ্বি স্যার অবশ্যই।
স্যারঃ ওকে এবার ক্লাসে যাও। ক্লাস রুম চেনো?
আমিঃ না স্যার নতুন তো, তাই চিনতেছিনা।
স্যারঃ সমস্যা নেই ৩ তলার শেষের রুম। আর আমি অন্যান্য স্যারদেরকে বলে দিবো তোমার কথা। সবার সাথে পরিচিত হয়ে নিও। যাও ভালো করে পড়ালেখা করো।
আমিঃ ধন্যবাদ স্যার। আসসালামু আলাইকুম,,,,
তারপর অফিস থেকে বের হয়ে ক্লাসে গেলাম, সবাইক অনেক চিল্লাচিল্লি করতেছিলো আমাকে দেখে সবাই ভুত দেখার মতো স্তব্ধ হয়ে গেলো। আসলে হওয়ারই কথা, ওরা এতোদিন ধরে ক্লাস করছে আমাকে তো এর আগে দেখেনি। আমি গিয়ে পেছনের একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। আমার পাশের জন আমাকে জায়গা দিয়ে সরে বসে গেলো এরপর মোবাইল টিপতেছে। আমিও কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে বসে আছি।
বাম পাশে তাকিয়ে দেখি ওই মেয়েটা যার সাথে একটু আগে আমার কথা কাটাকাটি হয়েছে। তারমানে মেয়েটার আমার সাথেই পড়ে! ধুর শালা যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। খেয়াল করে দেখলাম আমার দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
একটু পর স্যার আসলো, সবাই উঠে দাঁড়ালো, আমি উঠলাম, স্যার আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো..
স্যারঃ এই তুমিই জুয়েল?
আমিঃ জ্বি স্যার (দাঁড়িয়ে)
স্যারঃ আচ্ছা বসো। এই সবাই শোনো ও তোমাদের নতুন বন্ধু। ট্রান্সফার নিয়ে এসেছে, আজ থেকে তোমাদের সাথে পড়ালেখা করবে। ক্লাস শেষে সবাই পরিচয় করে নিও। এখন বই নাও,,,,
এরপর ক্লাস শুরু হলো, মনোযোগ সহকারে ক্লাস করলাম, জীবনে প্রথম এতো মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করলাম, ভালোই লাগলো। ক্লাস শেষে আমার পাশে থাকাটা ছেলেটা একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,,, হাই আমি ""হাকিম""
আমিঃ হ্যালো, আমি জুয়েল।
হাকিমঃ আগে কোথায় ছিলা?
আমিঃ (আগের ঠিকানা দিলাম)
হাকিমঃ ও আচ্ছা ভালো।
আমিঃ একটা কথা বলতাম।
হাকিমঃ হুম, বলো।
আমিঃ ওই মেয়েটা (ঝগড়া হওয়া সেই মেয়েটা)....
হাকিমঃ আরে ওর নাম তন্নি! এই ক্যাম্পাসের সবচেয়ে জেদি মেয়ে। কতো ছেলে যে চড় খাইছে ওর হাতে হিসেব নেই। ওর বাবার ক্ষমতা দেখিয়ে যেকোনো কাজ করে ফেলে। ভুলেও ওর কাছে যাবে না।
আমিঃ আরে না, এমনি জিজ্ঞের করলাম।
হাকিমঃ আচ্ছা ঠিক আছে থাকো, আমি চলে যাচ্ছি।
আমিঃ আর ক্লাস করবে না?
হাকিমঃ না, gf পার্কে বসে আছে। তাড়াতাড়ি না গেলে সমস্যা,,,
আমিঃ হা হা আচ্ছা ঠিক আছে যাও।
হাকিমঃ ওকে পরে দেখা হবে।
এরপর হাকিম চলে গেলো, আমি একা একা বসে রইলাম। আরো একটা ক্লাস করলাম।
বিরতির সময় আমি ব্যাগ ঘোচাচ্ছি এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন হাত ধরে টান দিলো। তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে...
মেয়েঃ আমি ফারিয়া!
আমিঃ জ্বি আ আমি জুয়েল।
ফারিয়াঃ ফ্রেন্ড.??? (হাত একটা বাড়িয়ে দিয়ে)
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম, আসলে জীবনে কোনো মেয়েই আমার ফ্রেন্ড হতে চায়নি। না হওয়ারই কথা বখাটে ছেলেদের কোনো মেয়েই পছন্দ করে না। কিন্তু সুন্দর মেয়ে গুলোর কপারে বেশিরভাগ বখাটে ছেলেই থাকে। আমার এই ভাবে চুপ করে থাকা দেখে ফারিয়া বললো...
ফারিয়াঃ ওই মিস্টার! জাস্ট ফ্রেন্ডশিপ করতে চেয়েছি। বিয়ে করতে নয়, এতো চিন্তা করার কি আছে।
আমিঃ না সরি। ওকে ফ্রেন্ড,,,
ফারিয়াঃ আচ্ছা আজ থেকে একজন অন্যজনকে তুই করে বলবো। আপনি বা তুমি এগুলো আমার পছন্দ না।
আমিঃ আচ্ছা ঠিক আছে।
ফারিয়াঃ চল এখন!
আমিঃ কোথায়?
ফারিয়াঃ ক্যান্টিনে, আমার বাকি ফ্রেন্ডসদের সাথে তোর পরিচয় করিয়ে দিবো।
আমিঃ হুম চল।
এরপর ক্যান্টিনে গেলাম। অনেক স্টুডেন্ট ওখানে বসে আছে, আমজ ফারিয়ার পিছু পিছু হাটতেছি, একটা টেবিলের পাশে গিয়ে ফারিয়া বললো...
ফারিয়াঃ গ্যায়েজ! ওর হচ্ছে জুয়েল। আমাদের নতুন ফ্রেন্ড।
তারপর সবাই পরিচয় দিতে লাগলো... হাই আমি সানি, আমি আয়মান, আমি সাদিয়া।
আমিও আমার পরিচয় দিলাম। সাদিয়া বললো...
সাদিয়াঃ আমাদের ফ্রেন্ডসদের মধ্যে আপনি বা তুমি চলে না। শুধু তুই চলে। আমরাও তোকে তুই বলবো তুইও আমাদের তুই বলবি।
আমিঃ আচ্ছা ঠিক আছে।
সানিঃ এবার বল কি খাবি?
আমিঃ আপনারা যেটা খাবেন।
আয়মানঃ ফারিয়া! ও মনে হয় আমাদের আপন করে নিতে পারেনি।
সাদিয়াঃ এই তুই করে বলার জন্য বলেছিনা?
আমিঃ আচ্ছা ঠিক আছে, তোরা যেটা খাবি সেটাই অর্ডার দে।
আসলে ছেলে মেয়ে গুলো যে এতো মিশুক, এতো ভালো ম্যান্টেলিটির ওদের সাথে না মিশলে হয়তো জানতাম না। একদিনেই এতো আপন করে নিলো আমাকে? ভাবতেই ভালো লাগছে।
হঠ্যাৎ করে দেখলাম সেই ফালতু মেয়েটা আমার দিকে আসছে। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে, আমার কাছে এসেই.....
চলবে....
Writer:- এম এইচ জুয়েল