১১.
বিকেল ৪ টা। সবাই মিলে দাঁড়িয়ে আছি মিথি আপুদের উঠোনে। ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরঘেষে মিথি আপুদের বাড়ি।যৌবন কালে বেশ শৌখিন লোক ছিলেন বড় ফুপা। সেই সুবাদেই হাফ বিল্ডিং বাড়ির চারপাশটা ছেয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের ফুল আর দেশী-বিদেশী গাছে। সকালে এখানে পৌঁছানোর পর পরই শুরু হয়েছিলো বৃষ্টি। সারা দিনের সেই মুশলধারার বৃষ্টি এসে থেমেছে এই বিকেলে। প্রকৃতিকে বৃষ্টিস্নান থেকে খানিক জিরুতে দিতেই যেন হঠাৎ এই নীরবতা। আগামীকাল শনিবার, আগামীকালই আবারও ময়মনসিংহের পথে পাড়ি জমাবো আমরা। তাই সবাই মিলে বেরিয়ে এসেছি খানিক ঘুরাঘুরির উদ্দেশ্যে। গন্তব্য ---- মিথি আপুর ছোট ফুপ্পির বাসা। মিথি আপুর ছোটফুপ্পি থাকেন জামালপুরের ঘোষপাড়ায়। ব্রহ্মপুত্রের তীর থেকে গাড়ি করে ১৫/২০ মিনিটের পথ। বাড়ির সামনে দু- দুটো অটোরিকশা দাঁড়িয়ে আছে। দুটো অটোরিকশাই গ্রুপের বড়দের জন্য বরাদ্দ অর্থাৎ, বাবা-মা,মামু-মামানি,বড় ফুপ্পি-ফুপা, ছোট ফুপ্পি-ফুপা, আদিবা-জারিফ,মিথি আপু আর মিলাদ ভাইয়া। আর আমাদের জন্য বরাদ্দ তিনটি বাইক। বড়রা অটোরিকশায় উঠে যেতেই শুভ্র ভাইয়ার বাইকের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। কিন্তু মাঝপথেই বাঁধ সাধলো মামানি। অটোরিকশা থেকে ডেকে উঠে বললেন,
---" রোদু? রাহাত দাঁড়িয়ে আছে তোর জন্য। তুই আর রুহি রাহাতের বাইকে যা। তাড়াতাড়ি কর।"
মামানির কথায় মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো আমার সাথে কিছুটা অপমানিতও বোধ করলাম। রাগ আর অভিমান মাখা দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করে পিছিয়ে এসে ভাইয়ার বাইকে চেপে বসলাম। সাথে সাথেই মামনির কন্ঠ কানে এলো। রাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলছেন,
---"রাফিয়া? দাঁড়িয়ে কেন? তুমি বরং শুভ্রর সাথে যাও। ওর বাইকটাতো খালি। যাও যাও..."
কথাটা কানে যেতেই কানদুটো গরম হয়ে এলো আমার। মুখ দিয়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলে ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে ঝাঁঝাঁলো কন্ঠে বললাম,
---" ভাইয়া? বাইক স্টার্ট না দিয়ে বলদের মতো বসে আছিস কেন? স্টার্ট দিবি নাকি নেমে যাবো?"
ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,
---" চড়াইয়া কানপট্টি গরম করে দিবো। আমি কি চিনি মিথির ফুপুর বাসা? বললেই কি চলে যাওয়া যায় নাকি? চুপ করে বস ধৈর্যহারা রমনী!"
আমি মুখ ফুলিয়ে বসে রইলাম। ভাইয়া ফুপাকে ডেকে কোনদিকে কোনদিকে যেতে হবে তার ডিরেকশন জেনে নিয়েই বাইক ছুটালো। প্রায় দশ/পনের মিনিটের মাথায় একটা ভারি লোহার গেইটের সামনে বাইক থামলো। গেইটের ওপাশে পাঁচতলা এপার্টমেন্ট। মিথি আপুর ফুপিরা পাঁচ তলার ঠিক কোন ফ্লোরের কোন ফ্ল্যাটে থাকে জানা নেই আমাদের। তাই গেইটের সামনেই অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। তার কয়েক মিনিট পরই রাফিয়াদের বাইক এলো। কিন্তু বাইক চালকের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হলাম আমি। আলিফ ভাইয়া!! কিন্তু রাফিয়া তো শুভ্রর বাইকে উঠেছিলো, তাহলে? আমার প্রশ্নের জবাবে প্রায় সাথে সাথেই এলো অদুদ ভাইয়ার বাইক। তার পেছনেই বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন শুভ্র ভাই। সবাই বাইক পার্ক করে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। রাফিয়া এসেই আমার আর আপুর গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। আমি অনুসন্ধানী গলায় বললাম,
---" তুই না শুভ্র ভাইয়ের বাইকে উঠেছিলি? তাহলে আলিফ ভাইয়ার পেছনে কিভাবে চলে এলি?"
রাফিয়া আক্ষেপের সুরে বললো,
---" আর বলিস না, বাইক স্টার্ট দেওয়ার আগমুহূর্তে শুভ্র ভাইয়া বললেন উনার চোখ ব্যাথা করছে বাইক চালাতে পারবেন না। চালালে এক্সিডেন্টও হয়ে যেতে পারে। উনার চোখদুটোও লাল লাল লাগছিলো তাই আলিফ ভাইয়াকে এই বাইকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে অদুদ ভাইয়ার পেছনে গিয়ে বসলেন।"
আমি ছোট্ট করে বললাম,
---"ওহ।"
রাফিয়া মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাতেই আড়চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম আমি। উনি আমার থেকে বেশখানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আলিফ ভাইয়া, অদুদ ভাইয়া আর ভাইয়ার সাথে খোশগল্পে মেতে আছেন। গায়ে ব্ল্যাক টি-শার্টের উপর হোয়াট-ব্লু চেইক শার্ট। শার্টের সবগুলো বাটন খোলা। শার্টের হাতাদুটো কনুই পর্যন্ত মোড়ানো। বামহাতে কালো ঘড়ি, পরনে জিন্স আর ক্যাটস্। কপাল জুড়ে ছড়িয়ে আছে একরাশ সিল্কি বাদামী চুল। হঠাৎ করেই চোখে চোখ পড়ে গেলো দুজনের। সাথে সাথেই কেঁপে উঠলো বুক। সারা শরীরে বয়ে গেলো লজ্জারাঙা স্রোত। চোখের পলক ঝাপিয়ে দ্রুত চোখ সরিয়ে সামনে তাকালাম। কানে চুল গুঁজতে গুঁজতে আবারও আড়চোখে তাকাতেই উনার গভীর চাহনীতে চোখ আটকালো আমার। সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিজের কাজে মন দিলেন উনি। কয়েক মিনিট পর প্রত্যাশিত অটোরিকশা দুটো এসে থামতেই শুভ্র ভাই আরো দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। রাস্তার পাশে সামান্য কাদা থাকায় হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে খুব সাবধানে মামানিকে নামালেন উনি। মামানিও তৃপ্তির হাসি হাসলেন। কিন্তু আমার মুখে হাসি ফুটলো না৷ কেমন একটা অজানা ভয়ের শিহরণ বয়ে গেলো গায়ে৷ তবে কি, মায়ের খুশিকেই প্রাধান্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শুভ্র ভাই? তাহলে, তাহলে.... আমি?
১২.
"ভালো আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ....."
মাঝে মাঝে ভালো থাকাকে ঠিক ভালো থাকা বলা যায় না। হয়তো,ভালো থাকা কাকে বলে তা উপলব্ধিই করা হয়ে উঠে না। আমিও আছি। বেশ ভালোই আছি। কিন্তু চিঠিটা লেখা হয় নি। শুভ্র ভাইয়ের মস্ত আকাশটাতে ভয়ঙ্কর সব প্রেমের চিঠিগুলো উড়িয়ে দেওয়া হয়ে উঠে নি। বড় বড় কালো চোখে আগ্রহ নিয়ে উনার মুখের 'পরে তাকানোটা হয়ে উঠে নি। অনেক কিছু না হওয়ার মাঝেও কিছু একটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে ----- "অবহেলা আর এড়িয়ে চলার বাহানা।" আজকাল এড়িয়ে চলাটা বেশ শিখে ফেলেছি আমি। আমি একা নই উনিও শিখেছেন, এড়িয়ে চলার বিদ্যা! একসময় কথায় কথায় হাজার কথা বলা মানুষদুটো এখন চুরের মতো হাঁটি। হঠাৎ দেখা হওয়ার ভয়ে দু'জনেই তটস্থ থাকি। কেন এতো ভয়? কেন এতো বাহানা? জানি না। হয়তো আমার অভিমান আর তার প্রতীজ্ঞা!
রাফিয়াকে নিয়ে মার্কেটে ছুটেছি প্রয়োজনীয় কিছু কিনবো বলে। কিন্তু হায় নিয়তি! গন্তব্য পর্যন্ত পৌছানোর আগেই আকাশ কালো হয়ে এলো বর্ষনে। ছুটে গিয়ে মোবাইল সার্ভিসিং দোকানের ছোট্ট বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট বাড়তেই দু-পা পিছিয়ে গেলাম দুজনে। অসহায় ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকাতেই চোখে পড়লো অনাকাঙ্ক্ষিত সেই মুখ। শুভ্র ভাই! এতোক্ষণ হয়তো আমাদের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। চোখে চোখ পড়তেই চোখটা সরিয়ে নিলেন খুব কৌশলে। নিজের মনে হাসলাম। মনে পড়ে গেলো আগের কথাগুলো। বেশিদিন তো নয় মাত্র একমাস আগের কথা। তখনও আমার দিকে তাকাতেন উনি। চোখে চোখ পড়লেও চোখ সরাতেন না কখনো। আমি অস্বস্তি আর লজ্জায় মিশে যেতাম তবুও উনি থাকতেন নির্বিকার। একসময় এই তাকানো নিয়েও সাজতো কথার পসরা,ঝগড়া কতো কিছু। একমাসের ব্যবধানে পরিবর্তন হয় অনেক কিছু। সেই সাথে মানুষগুলোও। আমিও চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আজ একটা মাস পর দেখা হলো দুজনের। একটি মাস কি খুব বেশি সময়? বেশি বৈকি! ত্রিশ ত্রিশটা দিন, সাতশো বিশ ঘন্টা! রাফিয়ার কন্ঠে ভাবনার প্রহর কাটিয়ে কান খাঁড়া করলাম। রাফিয়া খুশি খুশি গলায় বললো,
---"আরে শুভ্র ভাইয়া? কেমন আছেন ভাইয়া?"
ওপাশ থেকে অপ্রস্তুত গলায় উত্তর এলো,
---" আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?"
রাফিয়া উত্তর দেওয়ার আগেই আবারও বললেন উনি,
---" খাও না নাকি? শুকিয়ে গেছো অনেক।"
রাফিয়া বিস্মিত কন্ঠে বললো,
---" বলেন কি ভাইয়া? সবাই বলছে ময়মনসিংহ এসে নাকি ফুলে ফেঁপে গেছি আমি। আর আপনার কাছে শুকনো মনে হচ্ছে আমায়? আমাকেই শুকনো মনে হলে রোদকে কি মনে হবে বলুন তো? ও যা শুকিয়েছে না। দেখুন..."
কথাটা বলেই বামহাতটা হেঁচকা টানে জোর করে উনার দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো আমায়। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম আর উনার দৃষ্টি স্থির। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় রাফিয়ার হাত থেকে হাতটা ছাড়িয়ে আবারও পেছন ফিরে দাঁড়ালাম। রাফিয়া হেসে গল্প জুড়লো,
---" ভাইয়া? এখন বাসায় আসেন না কেন বলুন তো? আসলেও কখন আসেন কখন যান খুঁজেও পাওয়া যায় না। মিথি আপুর বিয়েটা যে ঠিক হয়ে গেছে জানেন?"
---" হ্যাঁ জানি। আম্মু কাল বলছিলো বিয়ের কথা।"
---"বিয়েটা কিন্তু রোদের বাসাতেই হচ্ছে। যদিও শুধু কাবিন হবে তবু বিয়ে তো। মিহি আপু,মিথি আপু,মিথুন ভাইয়া সবাই এসেছেন। আপনি না থাকলে আড্ডা জমে? আজ সন্ধ্যায় আপনাকে অবশ্যই ডেকে পাঠাবেন জেঠু। আসবেন না?"
ওপাশ থেকে নরম গলায় জবাব এলো,
---" আজকাল ব্যস্ত থাকি। তাই ও বাড়িতে সময় করে যাওয়া হয় না। সময় পেলে যাবো।"
একটু থেমে আবারও বললেন,
---" ভেতরের দিকে এসে দাঁড়াও। ভিজে যাচ্ছো।"
রাফিয়া খানিকটা সরে দাঁড়ালো। আমি জেদের বসে আরো একপা এগিয়ে দাঁড়ালাম। মনে হচ্ছে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরাটাও বেশি সুখের হতো। এটলিস্ট বৃষ্টির সাথে চোখের জলের মেলবন্ধনটা তো হতো।
---" এই রোদ? কিনারায় দাঁড়িয়েছিস কেন? ভিজে যাচ্ছিস তো।"
রাফিয়ার কথায় বিরক্ত হয়ে বললাম,
---" আমি ঠিক আছি।"
---"কিন্তু...."
রাফিয়াকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বলে উঠলেন শুভ্র ভাই,
---" তোমরা দাঁড়াও আমি বরং একটা অটো দেখি। এখানে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? ভিজে যাচ্ছো ঠান্ডা-জ্বর হলে আবার সমস্যা। এমনিতেই তো শরীরে কিছু নেই। বাতাসে উড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।"
রাফিয়া কনফিউজড হয়ে বললো,
---" ভাইয়া? আপনি কি আমাকে বলছেন? নাকি..."
শুভ্র ভাইয়া দ্রুত বললেন,
---"তোমাকেই বলছি রাফিয়া। আর কাকে বলবো? দাঁড়াও এখানে আমি অটো দেখছি..."
পাঁচ/দশমিনিট পর একটি অটোরিক্সা নিয়ে আমাদের সামনে দাঁড়ালেন উনি। রাফিয়া আনন্দে গদগদ গলায় বললো,
---" জলদি চল রোদ।"
আমি শক্ত গলায় বললাম,
---" তুই যা। আমি যাবো না।"
রাফিয়া অবাক হয়ে বললো,
---" যাবি না মানে? কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি এখানে?এতো বৃষ্টির মাঝে কেনাকাটা করা লাগবে না বোন। অন্য একসময় আসবো। এবার বরং চল।"
আমি কাটকাট গলায় বললাম,
---" বললাম তো যাবো না। তুই যা না।"
---" আশ্চর্য! তুই এতো জেদ করছিস কেন রোদ? দু'জন একসাথে এসে আমি একা চলে যাবো? এই বৃষ্টির মধ্যে কেনাকাটা না করলে চলছে না তোর?"
---" না। চলছে না। তোর ইচ্ছে হলে তুই যেতে পারিস।"
---" এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস তুই।"
---" করলে করছি। আমি তো বললাম তুই চলে যা৷ বৃষ্টি কমলে আমি চলে আসবো। তুুই-ই বা জেদ করছিস কেন?"
---" আমি জেদ করছি?"
আমাদের কথার মাঝেই অটো থেকে নেমে এলেন শুভ্র ভাই। গায়ের এ্যাশ রঙের টি-শার্টটার বেশি অর্ধেকই ভিজে গেছে তার। মাথার চুলগুলোও ভিজে নেতিয়ে পড়েছে কপালে। দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে চুল আর টি-শার্টটা হালকা ঝাড়লেন উনি। পকেট থেকে ফোন বের করে মৃদু গলায় বললেন,
---" হ্যালো আম্মু?"
ওপাশের কথাগুলো কানে এলো না আমাদের। খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবারও কথা বললেন উনি,
---" একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বৃষ্টিটা একটু কমলেই চলে আসবো। তুমি শুধু শুধু টেনশন করো না তো। জ্বর তো এখন আর নেই রে বাবা।"
আমি আড়চোখে তাকালাম।উনি আবারও বলে উঠলেন,
---" আর জ্বর হবে না। বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর হয় কে বললো? তোমার ছেলের স্ট্রং বডি আম্মু..."
উনার কথার মাঝেই বৃষ্টি মাথায় রাস্তায় নেমে গেলাম আমি। পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো রাফিয়া,
---" এই রোদ? কই যাস? জেঠীমনি ভিজতে বারণ করেছিলো। রোদ? এই রোদ?...."
ধীরে ধীরে রাফিয়ার গলাটা মিলিয়ে গেলো বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের আড়ালে। আমি দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে চলেছি। হঠাৎই একটা অটোরিক্সা গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। প্রথমে চমকে উঠলেও পরবর্তীতে রাফিয়ার গলা শুনে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালাম,
---"রোদ পাগলামো করিস না ওঠে আয়। দেখ, এভাবে বাড়ি ফিরলে জেঠীমনি তোকে সহ আমাকেও পেদাবে। প্লিজ বইন...প্লিজ।"
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটার প্রস্তুতি নিতেই শুভ্র ভাই নেমে এলেন। অন্যদিকে তাকিয়েই হাতটা ধরে অটোরিকশায় নিয়ে বসালেন। একবার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়েও কি মনে করে থেমে গেলাম। আবারও মনে পড়লো সেই কথাটায়...." একমাস পর!"
দু'জনেই পাশাপাশি বসে আছি। অটোর দুপাশে কালো মোটা পর্দা টানা। ভেতরটা আধো অন্ধকারে ছায়া। দু'জনের গা ভেজা বলেই আলাদা একটা সিটে বসেছে রাফিয়া। রাফিয়া বেশ মনোযোগ দিয়ে ফোন ঘাটছে। আর আমরা দু'জনেই দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে হাসফাস করছি। পর্দার আড়ালে রাস্তাটাও দেখা যাচ্ছে না বলে বাধ্য হয়েই খুব মনোযোগে একে অপরের হৃদস্পন্দন শোনার চেষ্টা করছি। কিছুটা এগিয়েই খানিকটা হেলে পড়লো অটো। আমরা উল্টো সিটটাতে বসায় তাড়াতাড়িই একহাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরলেন উনি। ঠান্ডা শরীরে গরম হাতের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলাম আমি। অস্বস্তি আর কৌতূহল দুটোর তুমুল লড়াইয়ের পর কৌতূহলই জয়ী হলো। এতোগুলো দিন পর মুখ ফুটে কথা বেরিয়ে এলো আমার,
----" আপনার গায়ে জ্বর।"
আমার কন্ঠে যেন চমকে উঠলেন উনি। জিগ্যাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি আবারও বললাম,
---" আপনার গায়ে প্রচুর জ্বর।"
উনি ছোট্ট করে উত্তর দিলেন,
---" জানি।"
---" তাহলে ভিজলেন কেন? মামানি বকবে।"
উনি হয়তো হালকা হাসলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
---" মামানিদের ভাগ্নীরা যদি এতো জেদি হয় তাহলে আমার মতো নিস্পাপদের তো মামানিদের হাতের মার খেতেই হবে।"
আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম। উনি কি ফাজলামো করছেন? এতোদিন ভং ধরে থেকে এখন ফাজলামো?
১৩.
"বিয়ে" ----- বিয়ে শব্দটাই আমার কাছে এক্সাইটিং সাউন্ড করে। আমাকে ঘিরে সবাই ছুটাছুটি করছে , সাজুগুজু করছে ভাবতেই অসম্ভব রকম আনন্দ লাগে। আগামীকাল মিথি আপুর বিয়ে। অনুষ্ঠান নয়। শুধুই কাবিন। বাড়িতে মিথি আপুর দাদুর বাড়ির লোকেরাও এসেছে প্রচুর। যার ফলে তৈরি হয়েছে থাকা সংক্রান্ত সমস্যা। আমার আম্মু মেয়েদের নিয়ে খুবই সেনসিটিভ। এদিক-ওদিক ছেলেরা দৌড়াদৌড়ি করবে আর মেয়েরা ফ্লোরে বেসামাল শুয়ে থাকবে? না, কক্ষনো না। তাই আম্মুর কড়া আদেশ যুবতী মেয়েদের থাকতে হবে মামানিদের বাসায়। সেই সুবাদে, আমি, রাফিয়া, আপু আর মিহি আপুর থাকার ব্যবস্থা হলো মামানির বাসায়। সকালেই বৃষ্টিতে ভিজেছি তাই শরীরটা হালকা গরম। চোখ-মুখ দিয়ে যেন অসুস্থতা ভরা গন্ধ বেরুচ্ছে। মেহমানদের আপ্যায়ন করার মাঝ পথেই চোখ গরম করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আম্মু। জোর করে খাবার গিলিয়ে টেবলেট খাইয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,
---" রাফিয়াকে নিয়ে তোর মামানিদের বাসায় যা। গিয়েই ঘুমিয়ে পড়বি। টেবলেট খাওয়ার পর ঘুমটা জরুরি। ঘুম থেকে উঠে দেখবি জ্বর নেই। আর একবারও যেন এদিক ওদিক দৌড়াতে না দেখি। যা...জলদি যা...।"
আমি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা দুলিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম ---- ৭ঃ৪০। এই সন্ধ্যায় ঘুমানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। তবে মামানির বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে শতভাগ। কে জানে শুভ্র ভাইয়ের জ্বর কমলো কি না? চুলগুলো দু'হাতে মুঠো করে হাতখোপা করতেই একরকম লাফিয়ে রুমে ঢুকলো রাফিয়া। আমার থেকে শুভ্র ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার আগ্রহটা ওরই দ্বিগুণ। আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা হাতে নিয়ে বললাম,
---"চল।"
মামানিদের বাসায় এসে কলিংবেল চাপার আগেই দরজা খুললেন মামু। আমাদের দেখে হেসে বললেন,
---" রোদুমনি কেমন আছে?"
আমি হালকা হেসে বললাম,
---" রোদুমনি ভালো আছে।"
মামু হেসে রাফিয়ার দিকে তাকালেন,
---" ভালো আছো রাফিয়া?"
---" জ্বি আংকেল। ভালো আছি।"
মামুকে পাশ কাটিয়ে ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বললাম,
---" কোথাও যাচ্ছো মামু?"
---" তোদের বাসাতেই যাচ্ছিলাম। তোর বাবার সাথে একটু কাজ ছিলো। তুই কি অসুস্থ নাকি রে রোদমা?চোখ-মুখ কেমন শুকনো লাগছে। "
---" না মামু। অসুস্থ নই তবে তোমার বোনের বকা শুনতে শুনতে আরেকটু হলেই অসুস্থ হয়ে যেতাম। তোমার বোনটা কি মারাত্মক মহিলা মামু। এনিওয়ে, মামানি কই?"
মামু হাসলেন। হাতে একটা কাগজের ফাইল তোলে নিয়ে বললেন,
---" শুভ্রর রুমে আছে হয়তো। ছেলের ক্লাস নিচ্ছে। দু'দুটো সপ্তাহ ধরে জ্বরে পুড়ছে তবু শিক্ষা হয় না। কাল রাতেও ১০৪° জ্বর ছিলো। সকালে একটু কমেছিলো কিন্তু মহাশয় ঘন্টাময় বৃষ্টিতে ভিজে আবারও কাহিনী বাঁধিয়েছেন। তোরা বাচ্চারা যে কেন বুঝিস না আমাদের! আচ্ছা, আমি যাচ্ছি। দরজাটা লাগিয়ে দে মা।"
মামু বেরিয়ে যেতেই দরজা লক করে শুভ্র ভাইয়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম দু'জনে। মনের মাঝে বিন্দু বিন্দু খারাপ লাগাগুলো যেন প্রতিটি পদক্ষেপেই পাহাড় রূপ ধারন করছে। দু'জনেই নিঃশব্দে শুভ্র ভাইয়ের রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দু'জনের মুখেই দুঃখী দুঃখী ভাব। আর যায় হোক, শুভ্র ভাই তো আমাদের জন্যই বৃষ্টিতে ভিজেছিলেন। ইশ! বেচারা। শুভ্র ভাই মামনির কোমর জড়িয়ে পেটে মুখ লুকিয়ে বসে আছেন চুপচাপ। থেকে থেকেই কেঁপে উঠছে উনার শরীর। মামানি দাঁড়িয়ে থেকেই থমথমে মুখে ছেলের মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। আমি আর রাফিয়া একে অপরের দিকে তাকালাম। সাথে সাথেই শুভ্র ভাইয়ের মৃদু কন্ঠ ভেসে এলো,
---" আমি আর পারছি না আম্মু। সহ্যের সীমাটা ভেঙে যাচ্ছে। তুমি হয় আমার মনটা পিষে ফেলো নয় আমায় ছেড়ে দাও...."
শুভ্র ভাই আরো কিছু বলতেন তার আগেই রাফিয়া জোরে-সোরে বলে উঠলো,
---" এমা! শুভ্র ভাইয়া কি কাঁদছেন?"
রাফিয়ার কন্ঠ কানে যেতেই থেমে গেলেন শুভ্র ভাই। আমাদের দিকে না তাকিয়েই ওঠে চলে গেলেন বারান্দায়। আমি রাফিয়ার দিকে রাগী চোখে তাকাতেই অপরাধী গলায় বলে উঠলো রাফিয়া,
---" বিশ্বাস কর! আস্তে বলতে গিয়ে ভুল করে জোরে বলে ফেলছি। আল্লাহ কসম।"
আমি কিছু বললাম না। চোখ ফিরিয়ে মামানির দিকে তাকালাম। মামানি আমাকে দেখে খানিক চমকালেন। ঠোঁটে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে বললেন,
---"রোদুমনি? কখন এলি?"
আমি হেসে বললাম,
---" এই মাত্র।"
রাফিয়া অনুযোগের সুরে বললো,
---" ওর জন্য আমাকেও আসতে হলো। জেঠীমনি জোর করে পাঠালেন। ও বাড়ি সবাই কতো মজা করছিলো। কিন্তু কি আর করা? রোদের জ্বর হয়েছে আর আমি বসে বসে মজা করবো তা তো হয় না। তাই এলাম... ওকে জেঠিমনি এখানে এসেই ঘুমোতে বলেছেন।"
মামানি অবাক হয়ে বললেন,
---" তোরও জ্বর?শুভ্ররও তো জ্বর।"
আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম,
---" আমার জ্বর নেই মামানি। শরীরটা হালকা গরম এই যা।"
মামানি গালে হালকা চাপড় দিয়ে বললেন,
---" বেশ। তোরা দাঁড়া আমি বিছানা রেডি করে দিচ্ছি।"
মামানি চলে যেতেই ঘরময় ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো রাফিয়া। ঠোঁট উল্টে বললো,
---" শুভ্র ভাইয়ের রুমটা কি গোছানো রে রোদ। উনার বউয়ের তো কোনো কাজই করা লাগবে না শুধু রোমান্স ছাড়া। তাছাড়া বান্দা যে হট বউয়ের অন্যদিকে মন থাকবে বলেও মনে হয় না।"
আমি কপাল কুঁচকে বললাম,
---" ছিহ!তোর মুখে সবসময়ই অশ্লীল কথাবার্তা। নিজের মুখ সামলা। উনি তোর বড়।"
রাফিয়া ভেংচি কেটে বললো,
---"এখানে অশ্লীল কথার কি দেখলি বল? আমি খাঁটি সত্য বলেছি। উনি যদি কাঁদায় মাখামাখি হয়ে থাকে তাহলেও কি মনে হবে জানিস? মনে হবে, ইশশ! কাঁদাগুলো আগে কেনা মাখান নি উনি? এটিটিউট ইজ আ বিগ ম্যাটার...."
আমি অসহায় গলায় বললাম,
---" প্লিজ বইন ৷ চুপ যা, উনি বারান্দায়।"
রাফিয়া ভ্রু উঁচিয়ে বারান্দার দিকে উঁকি দিলো। দাঁত বের করে হেসে বললো,
---" পোলা তো নয় সে তো আগুনের ঘোলা রে! রোদ রে? বিশ্বাস কর, এই পোলায় যদি কয় রাফিয়া তুমি দুনিয়া ছেড়ে দাও তাহলেও আমি এক পায়ে রাজি। ইশশ! এত্তো কিউট কেন? যা করে সব কিউট কিউট লাগে। এখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে তাতেও যেন কিউট কিউট ভাব। উফফ!"
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
---" তোর দুনিয়ার সব ছেলেকে দেখলেই এমন ফিলিংস হয়। এটা নতুন কিছু নয়। ট্রাই সামথিং নিউ।"
রাফিয়া টেবিলের উপর থেকে একটা ডায়েরি তুলে নিয়ে পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললো,
---" তোর মামাতো ভাইই তো নিউ প্যাকেজ রে। নিউ ব্র্যান্ড, নিউ.... "
এটুকু বলেই থেমে গেলো রাফিয়া। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে হাতের ইশারায় ডাকলো আমায়। আমি ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে যেতেই ফিসফিস করে বললো,
---" রোদ রে, আমাদের হিরো তো দেখি প্রথম থেকেই কারো প্রেমে হাবুডুবু,সাঁতার,ডুব সবই দিচ্ছে রে।"
এটুকু বলেই থামলো রাফিয়া। ভীষণ উৎসাহ নিয়ে ফিসফিস করে পড়তে লাগলো ডায়েরীর সেই কালো লেখা ---
" এই শ্যামলতা,
এখনো কি রেগে আছো আমার ওপর? নাকি অভিমান করেছো? আমার অনেকগুলো অভিযোগ জমা হয়ে আছে শ্যামলতা, অনেক! তোমার উপর, মায়ের উপর, সবার উপর। আমার যে কতো কষ্ট হয় তা কি তুমি জানো? জানো না। কখনো জানতে চাও-ও না। কিন্তু কেন চাও না? একটা বার আমার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে পারো না কেন? আমি তোমার কাছে আসছি না, কথা বলছি না, ভালোবাসছি না তবুও তুমি নির্বিকার। আমার কাছে না আসাটা কেন তোমাকে ভাবাবে না? কেন চোখের আড়ালে থেকেও তোমাকে একটিবার শুধু একটিবারও দেখতে পাবো না?আমি এড়িয়ে গেলেও তুমি কেন এড়িয়ে যাবে আমায়? কেন? " মাকে চাই নাকি তোমাকে?" এই প্রশ্নটা খুব জঘন্য শ্যামলতা। কিন্তু সেই জঘন্য প্রশ্নটা একবারও বুঝতে চাও না তুমি। বুঝতে চাও না আমাকেও। আমার যে তোমার হাসিটা সহ্য হচ্ছে না। কেন এতোটা শক্ত থাকবে তুমি? আমি নেই জেনেও কেন হাসবে তুমি? কেন আগের মতোই চলবে? একটুও অগোছালো হয়ে পড়বে না কেন? আজ বিশ বিশটা দিন হতে চললো দেখি না তোমায়। গায়ে প্রচন্ড জ্বর অথচ একটা বার শুধু একটা বার আমার কাছে এলে না তুমি। ছেলের চিন্তায় দু'দিন যাবৎ ঘুমোচ্ছে না মা। অথচ, কি আশ্চর্য! উনি আমার জ্বরের কারণটাই ধরতে পারছেন না। এই জ্বর তো জ্বর নয় তোমারই উত্তাপ তা কি করে বুঝাবো তাকে? কিভাবে?..... "
এটুকু পড়তেই হালকা শব্দে চোখ তুলে তাকালাম দু'জন। শুভ্র ভাই পকেটে হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। সিল্কি চুলে ঢেকে থাকা কপালের নিচটাতে একজোড়া রক্ত লাল চোখ তাকিয়ে আছে নির্বিকার। আমি আর রাফিয়া একে অপরের দিকে তাকালাম। রাফিয়া ঢোক গিলে নিয়ে খুব সাবধানে ডায়েরিটা টেবিলে রাখলো। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে আমার ডানহাতটা শক্ত করে চেপে ধরে ভয়মাখা গলায় বললো,
---" সসসরি ভাইয়া।"
শুভ্র ভাই কিছু বললেন না। আগের মতোই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। কি করবো বুঝতে না পেরে দু'জনেই একদৌড়ে বেরিয়ে এলাম। নিজেদের রুমে গিয়ে বসতেই দুঃখী দুঃখী গলায় বলে উঠলো রাফিয়া,
---" কষ্টে প্রাণটা ফেঁটে যাচ্ছে রে। আমার ক্রাশটা অলরেডি বাঁকা হয়ে আছে। কোন হারামজাদির প্রেমে পড়ছে আল্লাহ জানে। হে খোদা! "
আমি রাগী গলায় বললাম,
---" এতো ঢং কেন করছিস রাফিয়া? তোর না বয়ফ্রেন্ড আছে? বয়ফ্রেন্ড থাকা অবস্থায় অন্যের দিকে নজর দেস। শেইমলেস।"
---" এই? বয়ফ্রেন্ড থাকলেই যে অন্যের দিকে তাকানো যাবে না কে বললো তোকে? আর অন্যকেউ আর শুভ্র ভাইয়া কি এক হলো নাকি? শুভ্র ভাইয়ের জন্য তো হাজারটা বয়ফ্রেন্ড কোরবান। বুঝিস না কেন? ক্রাশ ইজ ক্রাশ। আহা!"
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
---" উহুম রাফিয়া বেপ্পি। ক্রাশ ইজ নট ক্রাশ, ক্রাশ ইকুয়ালটু বাঁশ। যা এখন তোকে খাওয়াবো আমি। বেয়াদপ।"
________________
রাত একটার দিকে হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেলো আমার। ফোনটা হাতে নিয়ে ডাইনিং রুমে গেলাম পানি খাবো বলে। পানি খেয়ে ভেসিনের উপর ফোন আর মাথার কাটাঁটা রেখে চুলগুলো হাতখোপা করলাম। চোখে-মুখে পানি দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মনে হলো পেছনে কেউ আছে। ভয়ে শ্বাস আটকে চরম সাহস নিয়ে পেছনে ফিরে তাকালাম। ভেবেছিলাম ভয়ানক মুখশ্রীর কিছু একটা দেখে জ্ঞান হারাবো। কিন্তু আমাকে মানসিক স্বস্তি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শুভ্র ভাই। আমার চোখে-মুখেই ঘুরে বেড়াচ্ছে তার নীরব দৃষ্টি। উনার এই দৃষ্টি বেশিক্ষন সহ্য হলো না আমার। উনাকে পাশ কাটিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। উনি পেছন থেকে মৃদু গলায় বললেন,
---" চুলের কাঁটাটা?"
আমি একপা পিছিয়ে উনার দিকে না তাকিয়েই পেছন দিকে হাত বাড়ালাম। উনি খুব ভদ্রভাবে কাঁটাটা তুলে দিলেন আমার হাতে। আবারও পা বাড়ানোর আগেই বলে উঠলেন উনি,
---" ফোনটা?"
এবারও যথারীতি হাত বাড়ালাম আমি। ফোন নিয়ে তাড়াহুড়ো করে সামনে পা বাড়াতেই আবারও বলে উঠলেন উনি,
---" আমার উত্তাপটা?"
আমি প্রথমে বুঝতে না পেরে আগের মতোই হাত বাড়ালাম। খানিকবাদেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অবাক হয়ে উনার দিকে তাকালাম। উনি মৃদু হেসে আমার দিকে এগিয়ে আসতেই মামু আর মামানির কন্ঠ শুনা গেল। মামু বলছেন,
---" গেলো কই? এখানেই তো ছিলো!"
আমি গলা বাড়িয়ে বললাম,
---" কি খুঁজছো মামু?"
ততক্ষণে মামু-মামানি দু'জনেই ডাইনিং রুমে এসে দাঁড়িয়েছেন। মামানি চেয়ারে হাত রেখে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,
---" ইঁদুর।"
মামু-মামানির চিৎকারে রাফিয়াও এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। হয়তো না ঘুমিয়ে বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিলো এতোক্ষণ। আমি অবাক হয়ে কয়েকপা এগিয়ে গিয়ে বললাম,
---" কি? চারতলায় ইঁদুর?"
এটুকু বলে নিচের দিকে তাকাতেই দেখি আমার পা থেকে দু আঙ্গুল দূরেই মাঝারি আকারের এক ইঁদুর। হঠাৎ চোখে পড়ায় চমকে গিয়ে লাফিয়ে উঠলাম। চিৎকারের সাথে সাথে দু- তিনটা লাফ দিতেই শুভ্র ভাইয়ের পায়ের উপর গিয়ে পড়লাম। উনার পায়ে পা লাগতেই ছোট্ট করে "উহ্" শব্দ করলেন উনি। মামু-মামানি ইঁদুর মারতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেই ডানহাতে কোমর চেপে ধরলেন উনি। আমি অবাক চোখে তাকাতেই মৃদু গলায় বললেন,
---" এভাবে লাফালে পড়ে গিয়ে নির্ঘাত কোমর ভেঙবে রোদপাখি।"
কথাটা শেষ করে আমাকে আরো একদফা অবাক করে দিয়ে বামগালে হালকা ঠোঁটে চুমু এঁকে দিলেন উনি। চুমু দিয়েই চোখের পলকে দু-তিনহাত দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। মামু-মামানি ইঁদুরের পিছু নিয়ে রান্না ঘরের দিকে ছুটতেই রাফিয়া চোখ বড় বড় করে আমার দিকে দৌঁড়ে এসে বললো,
---" আমি কিছু দেখলাম।"
আমি তখনও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বার কয়েক চোখ পিটপিট করে ঘোর ধরা গলায় বললাম,
---" কি দেখলি?"
রাফিয়া একবার শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালো। উনি গম্ভীর মুখে মামানিদের কাজ-কর্ম দেখছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে এই দুনিয়াতে "ইঁদুর" নামক প্রাণীটা ব্যতিত অন্যকিছুর অস্তিত্ব নেই। উনার ভাবসাব দেখে রাফিয়া কনফিউজড হয়ে বললো,
---" শুভ্র ভাইয়া তোকে..."
আমি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
---" কি?"
শুভ্র ভাই অতিভদ্র ছেলের মতো বললেন,
---" কোনো সমস্যা রাফিয়া? আমায় ডাকলে মনে হলো।"
আমি আর রাফিয়া দুজনেই একসাথে মাথা নাড়লাম। ইঁদুর মারতে ব্যর্থ হয়ে মামু-মামানি ব্যর্থতার শিষ তুলে নিজেদের রুমে ঢুকে গেলেন। তাদের পিছু পিছু শুভ্র ভাইও গেলেন। আর আমরা দু'জন হ্যাবলাকান্তর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম দু'জনের চোখে-মুখেই চরম হতাশা। সেই হতাশা নিয়েই বলে উঠলো রাফিয়া,
---" আমি হয়তো ভুল দেখিছি রে রোদু।"
আমিও হতাশ গলায় বললাম,
---"ওহ!"
১৪.
সন্ধ্যা সাতটা কি আটটা। বিছানায় গোল হয়ে বসে আছি। মিথিলা আপু লাজুক লাজুক চাহনী নিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন। চারপাশ থেকে লজ্জাদায়ক কথার ফুলঝুরিতে অনেকটাই ক্লান্ত সে। বেশ কিছুক্ষণ হলো ছেলেপক্ষ এসে পৌঁছেছে। ড্রয়িংরুমে বসে দেনমোহরের টাকা নিয়ে আলাপচারিতা চলছে। কিছুক্ষণ পরই শুরু হবে কাবিন পর্ব। আম্মুসহ অন্যান্য রমনীরা রান্নায় মেতেছেন। ভাইয়ারা ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে।এরই মধ্যে হুট করে মেয়েদের রুমে ঢুকলেন শুভ্র ভাই। গায়ে খয়েরী রঙের পাঞ্জাবি আর কালো জিন্স। পায়ে সাধারণ স্লিপার। সিল্কি চুলগুলো সমান্তরাল ভঙ্গিতে পড়ে আছে কপালে। হাতে আধ কাঁচা পেয়ারা। তাতে কামড় বসাতে বসাতেই খাটের পাশে এসে দাঁড়ালেন উনি। মিথি আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
---" পাশের রুমে দুটো সুন্দরী ললনাকে দেখলাম। তোর ননদ নাকি রে?"
মিথি আপু মাথাটা আরেকটু নুইয়ে নিয়ে বললো,
---" হ্যাঁ।"
শুভ্র ভাই আবারও কামড় বসালেন পেয়ারায়। মুখ ভেঙিয়ে বললেন,
---" বাহ্! বিয়ের আগেই ননদ বলে বলে অস্থির করে ফেলছিস। একা একা অস্থির না হয়ে আমাদের দিকেও তাকা। ভাইদের একটা হক আছে না? সেই হকটা আদায় না করেই এভাবে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়ে করতে পারবি তুই?"
মেথি আপু এবার মাথা তুলে তাকালো। বিস্ময় নিয়ে বললো,
---" মানে?"
শুভ্র ভাই তার ফর্সা গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
---" মানে, সিম্পল। তোর ননদ হলো আমাদের বেয়াইন। তো বেয়াইনদের আপ্যায়ন করা লাগবে না? আর আপ্যায়ন করার জন্য ফোন নাম্বার দরকার। ফোন নাম্বার দে সাথে ফেসবুক,হোয়াটসঅ্যাপ হেনতেন যা আছে সব দে। আই মিন দিতে পারিস। আমি মাইন্ড করবো না।"
মিথি আপু যেন এবার আকাশ থেকে পড়লো। চোখ বড় বড় করে বললো,
---" তোর ফোন নাম্বার চাই শুভ্র? সত্যিই?"
শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে বললো,
---" এমন রিয়েক্ট মারছিস কেন? নাম্বার দিতে বলছি নাম্বার দে। ব্যস!"
রাফিয়া দুঃখী দুঃখী গলায় বলে উঠলো,
---" শুভ্র ভাই? ওই মেয়ে দুটো কি আমার চেয়ে সুন্দর?"
শুভ্র ভাই অমায়িক হেসে বললেন,
---" বোন, আমি এখানে লাক্স সুন্দরী নির্বাচন করছি না। তাছাড়া, শুভ্রর বোন বলতেই পরী। সেই হিসেবে তুমিও পরীই হলে, তাই না? শুভ্রর ছোট বোন বলে কথা। এই মিথি? নাম্বার দিবি নাকি তোর জামাইরে ধরে বাঁধবো।"
আমি আড়চোখে তাকালাম। উনি আবারও তাড়া দিতেই মুখ খুললো রাফিয়া। মৃদু গলায় বললো,
---" দুইটার নাম্বার দিয়ে কি করবেন শুভ্র ভাই? বিয়ে করলে তো একটাকেই করবেন। তো একটাই সিলেক্ট করুন। আমরাও ভাবি ডাকার অভ্যাস করে ফেলি। দুইটার সাথে ট্রাই মারলে আমরা কনফিউজড হয়ে যাবো না?"
শুভ্র ভাই বিরক্ত গলায় বললেন,
---" তুমি না বড্ড বেশি কথা বলো রাফিয়া। তোমার ভাবিকে নিয়ে এতো চিন্তা করতে হবে না তোমায়। তাকে নিয়ে কনফিউজড হওয়ার চান্স নাই। এখন আপাতত চুপ থাকো। মিথি নাম্বার দে তো... জলদি দে।"
মেয়েদুটোর একটি বরের ছোটবোন আর অন্যটি বরের কাকাতো বোন। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর ওদের সাথে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছিলো মিথি আপুর। বেশ সুন্দরীও বটে। শুভ্রর চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত নাম্বারটা দিয়েই দিলেন মিথি আপু। শুভ্র ভাই নাম্বার নিয়ে রুম থেকে বেরুতেই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের মধ্যে চাপা হুল্লোড় পড়ে গেলো। রাফিয়া মন খারাপ করে একবার দরজার দিকে তাকিয়েই চাপা আর্তনাদ করে বললো,
---" রোদু রে?আমার ক্রাশ প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে পাগল হয়ে গেছে। এতো সুন্দরী আমি বসে থাকতে ওই দুই কালনাগিনীর নাম্বার নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে? হে খোদা!"
আমি রাফিয়ার দিকে মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকালাম। রাফিয়ার কষ্টের চাপে নিজের কষ্টটাই ভুলে গেলাম। সত্যিই তো, বেচারীর ক্রাশের সে কি দুর্দশা!
আটটা/ সাড়ে আটটার দিকে কাবিন শেষ হলো। কাবিন শেষে সবাই যখন খাওয়া দাওয়াত নিয়ে ব্যস্ত তখন দেখা দিলো আরেক ঝামেলা। লেবু শেষ! সকাল বেলা বাজারের লিস্ট থেকে যে কিভাবে লেবুর নামটা কেটে গেছে কে জানে? তাই মা আমায় পাঠালেন ছাঁদে। ছাঁদের কোণে ছোট্ট একটা লেবু গাছে ৫/৬ টা লেবু ধরেছে। আপাতত সেগুলো দিয়ে কাজ চালালেই রক্ষে। রাফিয়াকে সাথে যেতে বলতেই সে বিমর্ষ দৃষ্টিতে তাকালো। তাই বাধ্য হয়ে একাই চললাম ছাঁদে। ছাঁদের মেজেতে পাটি বিছিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো ভাইয়াসহ কাজিন ভাইয়ারা সবাই। আমি ছাঁদে পা রাখতেই একপলক তাকালো সবাই। আমি কিছু না বলে ডানদিকের কোণের দিকে এগিয়ে যেতেই কথা ছুড়লো ভাইয়া,
---" রোদ? এখানে কি?"
আমি সামনে এগুতে এগুতেই বললাম,
---" লেবু নিতে এসেছি ভাইয়া।"
তারপর সব চুপ। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবার শুরু হলো ফিসফিস। ফিসফিসানি শেষ হলে শুরু হলো ধাক্কাধাক্কি। এই ধাক্কাধাক্কির এক পর্যায়ে শুভ্র ভাইয়ার হাসির শব্দ কানে এলো। উনি হাসতে হাসতেই বললেন,
---" মাইর খাওয়াতে চাস? ডিরেক্ট খুন করে ফেলবে আমায় । ভাইকে বল।"
তারপর আবারও ফিসফিস শব্দ। আমি দুটো লেবু তুলে নিয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। এদের মধ্যে কি চলছে বুঝতে না পারলেও গভীর কিছু যে চলছে তা স্পষ্ট। কয়েক সেকেন্ড ভ্রু কুঁচকে ওদেরকে দেখে নিয়ে আবারও লেবু তোলায় মনোযোগ দিলাম। লেবু তুলে শেষ করে ফেরার জন্য পা বাড়াতেই সবাই মিলে ঠেলেঠুলে দাঁড় করিয়ে দিলো শুভ্রকে। আমি সচেতন চোখে তাকালাম। আশেপাশে কোথায় ভাইয়াকে দেখা যাচ্ছে না। এই হাঁদারামটা দরকারী সময়গুলোতেই হাওয়া হয়ে যায় কেনো কে জানে? আমি দ্রুত সিঁড়ি ঘরের দিকে এগুতেই সটান সামনে দাঁড়ালেন শুভ্র। চোখ তুলে উনার দিকে তাকাতেই মৃদু হাসলেন উনি। উনার হাসিকে পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটাতেই ডানহাতটা চেপে ধরলেন উনি। পেছন থেকে বললেন,
---" হেল্প দরকার ছিলো। একটু...প্লিজ।"
আমি বা উনি আরো কিছু বলবো তার আগেই দরজায় আম্মু এসে দাঁড়ালেন। আলিফ ভাইয়াদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
---" রোদ কি চলে গেছে রে?"
আলিফ ভাইয়া মাথা নেড়ে বললেন,
---" না মামি, ওই তো। শুভ্রর সাথে লেবু তুলছে।"
আম্মুর কন্ঠ কানে যেতেই দু'হাত দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন শুভ্র ভাই। এতো দেরি হওয়ার জন্য এক গাদা বকে দিয়ে আমাকে নিয়ে নিচে চললেন আম্মু। আম্মু পেছন ফিরতেই আমার ডান হাতে দু'খানা কাগজ গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলেন শুভ্র ভাই,
---" ওই মেয়েদুটোর জন্য। দিয়ে দিস প্লিজ...."
উনার কথাটা শুনেই মেজাজ চটে গেলো আমার। কত বড় সাহস! আমাকে দিয়ে প্রেম পত্র বিলি করা? আমাকে দিয়ে? রাগে ভেতরে ভেতরে গর্জাতে গর্জাতে আরো দু'পা এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে বলে উঠলেন তুষার ভাইয়া,
---"কাজটা কিন্তু করে দিয়েন রোদ ভাবি।"
তুষার ভাইয়ার কথাটা কানে যেতেই আমার সাথে সাথে আম্মুও থেমে গেলেন। আমি চোখ বড়বড় করে তাকালেও আম্মু ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,
---" রোদ তোমার ভাবি কিভাবে হয় তুষার?"
তুষার ভাইয়াও থতমত খেয়ে গেলেন এবার। এই ছোট্ট কথাটাও যে আম্মুর কানে চলে যাবে ভাবতেও পারে নি বেচারা। তাছাড়া আমি নিজেও অবাক। তুষার ভাই আমাকে ভাবি ডাকছে কোন দুঃখে? তুষার ভাইয়াকে চুপ থাকতে দেখে আম্মু অধৈর্য ভঙ্গিতে আবারও প্রশ্ন করলেন। আম্মুকে এভাবে ভুলানো যাবে না দেখে এগিয়ে এলেন শুভ্র ভাই। বেআক্কল হাসি দিয়ে বললেন,
---" ফুপ্পি? রোদ তো ওর বোনের মতোই তাই না? আর...বোনের বর তো এজ ইউজাল ওর দুলাভাইই লাগবে তাই না?"
আম্মু মাথা নাড়লেন। শুভ্র ভাই মৃদু হেসে বললেন,
---" এখন কি দুলাভাইকে কেউ দুলাভাই ডাকে? সবাই তো ভাইই ডাকে। তো সেই হিসেবে রোদ ওর ভাইয়ের বউ হলো না? আর ভাইয়ের বউ তো ভাবিই হলো ফুপ্পি।"
আমি আর আম্মু দু'জনেই হ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর কপাল কুঁচকে বলে উঠলেন আম্মু,
---" ওই? আমাকে তোর পাগল মনে হয়? দিবো এক চড়।"
শুভ্র ভাই ইনোসেন্ট গলায় বললেন,
---" এইতো বিশ্বাস করলে না। আরে বাবা...এটা নিউ জেনারেশন। এই জেনারেশনে সব চলে। এইযে তুমিই ভাবো... বন্ধুদের যে আমরা অহরহ মামা মামা বলে ডাকতেছি তাই বলে কি আমাদের বন্ধুরা আমাদের মায়ের ভাই হয়ে যাচ্ছে?"
আম্মু কনফিউজড হয়ে বললেন,
---" এই? তুইও কি রোদকে ভাবি ডাকিস নাকি?"
পেছন থেকে আলিফ ভাইয়া ফিক করে হেসে দিয়ে আবারও চুপ হয়ে গেলেন। শুভ্র ভাইয়া ভঙ্গ হৃদয় নিয়ে বললেন,
---" ও কি আমার ভাবি হয় যে আমি ওকে ভাবি ডাকবো।"
আম্মু যুক্তি দিয়ে বললেন,
---" তুষারের ভাবি হলে তোর কেন হবে না? তোর তো আরও বেশি করে হবে।"
শুভ্র ভাই বিরক্ত গলায় বললেন,
---" তুমি আমার বাপের বোন বলে কি রোদের বাপেরও বোন?"
আম্মু বুঝতে না পেরে বললেন,
---" মানে?"
আলিফ ভাইয়া পেছন থেকে বললেন,
---" মানেটা হলো লেবু, মামি। আপনার না লেবু নিয়ে যাওয়ার কথা?"
আলিফ ভাইয়ার কথায় যেন টনক নড়লো আম্মুর । আমার হাত থেকে লেবুগুলো একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়েই নিচে নেমে গেলেন। শুভ্র ভাই যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলেন। জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে তুষার ভাইয়ার দিকে তেড়ে গেলেন। ধুমধাম করে চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন,
---" ভাবি না?তোর তো দেখি ভাবি ডাকার বহুত শখ। শালা...ভাবি ডাকবি ভালো কথা কিন্তু নাম ধরে ডাকলি কেন? এখনই কেইস খাইতাম। বলদ একটা।"
আমি কয়েক সেকেন্ড তাদের ধাক্কাধাক্কি, মারামারি দেখে মুচকি হেসে নিচে নেমে এলাম। সিঁড়ির কয়েক ধাপ পেরিয়েই হাতে থাকা চিঠি দুটোর কথা মনে পড়লো। মুহূর্তেই রাগটা বেড়ে গিয়ে অসীমে গিয়ে ঠেকলো। প্রেমপত্র! এই প্রেমপত্রই গুলে খাওয়াবো তাকে। বেয়াদপ!
১৫
রাত নয়টায় বিয়ে নামক ঝঞ্জাল শেষ করে বাড়ির ফেরার জন্য তাগিদ দিয়ে উঠলেন ছেলেপক্ষ। সবাই যখন একে অপরের থেকে বিদায় নিতে ব্যস্ত সেই ফাঁকে কেউ একজন হেঁচকা টানে সিঁড়ির নিচের ঝাপসা অন্ধকারে দাঁড় করালো আমায়। প্রথম ধফায় চমকে উঠলেও শুভ্র ভাইকে দেখে ভ্রু কুঁচকালাম। উনি এদিক ওদিক তাকিয়ে চারপাশটা দেখে নিয়ে বললেন,
---" চিঠিগুলো কই? দিয়েছিস?"
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে উনার পেছন দিকে তাকিয়ে জোর গলায় ডেকে উঠলাম,
---" রিদি আপু? শুশ্মিতা আপু? এদিকে আসুন না প্লিজ!"
আমার এমন কাজে খানিকটা ভরকে গেলেন শুভ্র ভাই। কিছু বলে উঠার আগেই সামনে এসে দাঁড়ালেন রিদি আর শুশ্মিতা আপু। ওরা দু'জনেই আনন্দমোহনে কেমিস্ট্রি নিয়ে অনার্স করছে। আমার থেকে একবছরের সিনিয়র। উনারা আমাদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেসে বললেন,
---" কিছু বলবে রোদ?"
আমি গদগদবচনে বললাম,
---" হ্যাঁ,বলবো। তার আগে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি হচ্ছেন আমার একমাত্র মামাতো ভাই। ভীষণ ব্রিলিয়ান্ট এবং ভদ্র ছেলে। চুয়েটে পড়ছেন। মাস্টার্স ফাইনাল টার্ম। ব্রাইট ফিউচার। জাপানে স্কলারশিপের জন্য এপ্লাই করেছিলেন এবং রিসেন্টলি সিলেক্টও হয়ে গেছেন।"
রিদি আর শুশ্মিতা আপু একসাথে বললেন,
---"ওহ! কনগ্রাচুলেশন ভাইয়া।"
শুভ্র ভাই আমার মতিগতি উপলব্ধি করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। শুশ্মিতা আপুদের কথায় তিনি জোরপূর্বক হেসে আবারও আমার দিকে তাকালেন। আমি দাঁত বের করে হেসে বললাম,
---" এক্চুয়েলি শুশ্মিতা আপু, শুভ্র ভাইয়া আপনাকে খুবই পছন্দ করেন। লাভ এট ফার্স্ট সাইট ইউ নো। আমাকে একটা চিঠিও দিয়েছিলেন আপনাকে দেওয়ার জন্য কিন্তু আমার বোকামির জন্য আর দেওয়া হয়ে উঠলো না। তাই ভাবলাম সরাসরিই বলি। প্লিজ আপু....একসেপ্ট করে নিন। আপনাকে দেখার পর থেকে উনার মুখে আপনার নাম ছাড়া আর কিছু আসছেই না। আমাদের মুখ থেকেও বারবার ভাবি ভাবি চলে আসছে। আমি কিন্তু ননদ হিসেবে খারাপ হবো না। এনিওয়ে আপনারা গল্প করুন আমি আর আপনাদের প্রেমে হাড্ডি হচ্ছি না।"
এক নিশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে উনার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সেখান থেকে সরে আসতে নিতেই ডানহাতটা চেপে ধরলেন শুভ্র ভাই। আমি রাগী মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে নিয়ে বললাম,
---" হাত ছাড়ুন। শুভ্র ভাই হাতটা ছাড়ুন। শুশ্মিতা ভাবি আপনার সাথে কথা বলার জন্য ওয়েট করছে। আপনার ভাষায় আপনার "সুইটহার্ট" অপেক্ষা করছে। হাতটা ছাড়ুন! "
আমার কথায় কপাল কুঁচকে তাকালেন উনি। কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
---" মাইর না খেতে চাইলে একদম চুপ। এখন কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, রোদ।"
উনার কথার তোয়াক্কা না করে আবেগ আপ্লূত গলায় বললাম,
---" দেখেছেন হবু ভাবি?আপনাকে কত্তোটা পছন্দ করেন উনি। আমাকে বলতে বলছেন যে, আপনি যদি রাজি থাকেন তো আপনাকে খুব শীঘ্রই বিয়ে করতে চান উনি। আচ্ছা? সিকিম পছন্দ তো আপনার?এক্চুয়েলি শুভ্রভাই হানিমুনে সিকিম যাবে তো তাই। আপনাকে দেখে এক্সাইটমেন্টে কথা বলতে পারছে না বেচারা। তাই আমিই বলে দিলাম। এবার ডিসিশন নিন।"
আমার কথায় লজ্জায় রাঙা হয়ে আড়চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালেন শুশ্মিতা আপু। আর আমি এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সামনের দিকে হাঁটা দিলাম। পেছন থেকে ডেকে উঠলেন শুভ্র ভাই,
---" রোদ? আরে বাবা, আমার কথাটা তো শুনো।"
উনার ডাকে সাড়া না দিয়ে অলস ভঙ্গিতে এগিয়ে গেলাম মামানিদের দিকে। পেছন থেকে মৃদু কন্ঠ কানে এলো,
---" সরি আপুরা। বাচ্চা মেয়ে তো তাই বাচ্চামো আর রাগ দুটোই একটু বেশি। ও জাস্ট মজা করছিলো। আমি অলরেডি এনগেজড। আপনারা কিছু মনে করবেন না প্লিজ। আসলে আমার ফ্রেন্ডরা..."
এরপরের কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে এলো কানে। আমি ধীর পায়ে মামানির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটা লোক এতোটা মিথ্যুক কি করে হতে পারে কে জানে?"আমি অলরেডি এনগেজড!" কিসের এনগেজড? কার সাথে এনগেজড?লাফিয়ে লাফিয়ে প্রেমপত্র দিতে গেলে খুশিতে মরে যায় আর বিয়ের কথা বললেই এনগেজড, তাই না? ফাজিল একটা। শুভ্র ভাইকে এদিকে আসতে দেখেই জোর গলায় বলে উঠলাম আমি,
---" মামানি? ওই ব্লু ড্রেস পড়া মেয়েটাকে কেমন লাগছে?"
মামানি আর আম্মু কোনো একটা বিষয়ে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। আমার কথা কানে যেতেই সচেতন চোখে তাকালেন। মেয়েটিকে দু'মিনিট পর্যবেক্ষন করে নিয়ে বললেন,
---" ভালোই তো। খারাপ কি?"
আমি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
---" শুধু ভালোই তো? আরে মামানি, তোমার ছেলের এতো সুন্দর পছন্দকে তুমি শুধু "ভালোই তো" বলে জাজ করছো? দু'দিন পর তোমার পুত্রবধূ হবে আর তুমি তাকে "ভালোই তো" এর তালিকায় ফেলে দিচ্ছো? ভেরি ব্যাড মামানি।"
আমার কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালেন মামানি। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে পরম আয়েশে আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম আমি,
---" আম্মু? তোমার পছন্দ হয়েছে আমাদের ভাবিকে? তোমার ভাতিজার পছন্দ বলে কথা। গোলাপের পাঁপড়ির মতো ঠোঁট, বাঁশির মতো নাক, মোলায়েম রেশমের মতো চুল, মুক্তোর মতো হাসি আর কি কি জানি শুভ্র ভাই?"
শুভ্র ভাই আমার কথা শুনে অনেক আগেই দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন পাশে। রাগী চোখে ঝলসানোর চেষ্টাও করছিলেন সেই শুরু থেকে কিন্তু এবার যেন রাগের ষোল কলা পূর্ণ হলো তার। নাক ফুলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন উনি। আমি নিঃসংকোচ ভঙ্গিতে আম্মুর দিকে তাকালাম। বোকা বোকা চাহনি দিয়ে বললাম,
---" আম্মু? শুশ্মিতা ভাবিকে তোমার পছন্দ হয় নি?
কিছু বলছো না কেন বল তো? শুভ্র ভাই তো বলছিলো তুমি রাজি হলেই বিয়ে করে নিবে ভাবিকে। তোমার রাজি হওয়াটা নাকি বিগ ম্যাটার।"
আম্মু খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন,
---" আমি রাজি হবো না কেন? দরকার হলে মেয়ের বাড়িতে নিজে গিয়ে কথা বলবো। শুভ্র? তুই শুধু একবার মুখ ফুটে বলবি, ব্যস।"
আমি দাঁত বের করে হেসে শুভ্রর দিকে তাকালাম। চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,
---" দেখেছেন ভাইয়া? বলেছিলাম না? আম্মু একদম রাজি হয়ে যাবে।"
শুভ্র ভাই উত্তর দিলেন না। আম্মুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন,
---" বিয়ে করার হলে তোমাকে এমনিতেও আগে বলতে হবে ফুপ্পি। সে নিয়ে টেনশন করো না তো। আচ্ছা শুনো? রোদকে মিথি ডাকছিলো। ওর পাশে কেউ নেই। রাফিয়াকে দেখলাম ফোনে কথা বলছে। ওকে একটু পাঠিয়ে দিও, আমি তুষারদের সাথে মোড়ে যাচ্ছি। আমার কথা তো শুনবে না, তুমি একটু মনে করে পাঠিয়ে দিও কেমন?"
আম্মু মাথা নাড়লেন। সাথে সাথেই কপাল কুঁচকে এলো আমার। উহুম! হাওয়া সুবিধার নয়। কিছু একটা ঝামেলা তো নিশ্চয় আছে। আমার ভাবনার মাঝেই ধমকে উঠলেন আম্মু,
---" ওই? শুভ্র কি বললো শুনিস নি? মিথি ডাকছে যা জলদি। দিন দিন কানে কালা হয়ে যাচ্ছিস মনে হয়।"
আমি মুখ কালো করে মিথি আপুর রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু রুম পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই সামনে দাঁড়ালেন শুভ্র ভাই। হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে ডান ভ্রুটা খানিক উঁচু করে বললেন,
---" ছাঁদে। একটা কথা বলবা তো এক চড়। ছাঁদে যেতে বলছি মানে ডিরেক্ট ছাঁদে... গো!"
উনার মুখ-চোখের ভাব দেখে আরকিছু বলার সাহস জুগাতে পারলাম না আমি। চুপচাপ মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইলাম। সাথেসাথেই ধমকে উঠলেন উনি। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সিঁড়ির ধাপ ভেঙে ছাঁদে গিয়ে দাঁড়ালাম। তুষার ভাইয়ারা ছাঁদে বসে গল্প করছিলেন। আমাকে দেখে খানিক থমকালেন। আলিফ ভাইয়া বললেন,
---" কি রে রোদ? এখানে কি? কিছু বলবি?"
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। আলিফ ভাইয়া আরো কিছু জিগ্যেস করতেন তার আগেই ছাঁদে এলেন শুভ্র ভাই। আলিফ ভাইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
---" আলিফ-তুষার? সবকটা নিচে যা।"
আলিফ ভাইয়া উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,
---" কোনো সমস্যা শুভ্র ভাই?"
শুভ্রর স্পষ্ট জবাব,
---" কোনো সমস্যা নেই। তোরা নিচে যা।"
সবাই চুপচাপ নিচে নেমে গেলো। যাওয়ার সময় তাদের মধ্যে থেকে জারিফ বলে উঠলো,
---"রোদাপু নিচে যাবে না?রোদাপু চলো। দাদাভাই সবাইকে নিচে যেতে বলেছে তো।"
শুভ্র বিরক্তি নিয়ে বললো,
---" তোর রোদাপু নিচে যাবে না। তোকে যেতে বলেছি তুই যা। আর একটা প্রশ্ন করবি তো চড় দিয়ে ছাঁদ থেকে ফেলে দিবো। যা.."
জারিফ কিছু বলতে গিয়েও বললো না। হয়তো শুভ্র ভাইয়ের মুখটা খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছিলো না। সবাই নেমে যাওয়ার পর ছাঁদের দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন উনি। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলে উঠলাম,
---" কি সমস্যা?"
শুভ্র ভাই মৃদু গলায় বললেন,
---" কোনো সমস্যা নেই।"
---" তাহলে এখানে আনলেন কেন আমায়?"
উনি হেসে বললেন,
---" আমি কি কোলে করে এনেছি?"
আমি তেতে উঠে বললাম,
---" ফাজলামো করছেন আমার সাথে? সরুন সামনে থেকে। সরুন বলছি...আমি এক্ষুনি নিচে যাবো।"
উনি হেসে ফেলে বললেন,
---" একদম পার্ফেক্ট ম্যাচ। আমার বাচ্চারা খুবই নিরিহ টাইপ হবে। বাপ-মা দু'জনেই হাইপার তো তাদের নিরিহ না হয়ে উপায় আছে?
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
---" আপনার বাচ্চাদের গল্প আপনার সুইটহার্ট শুশ্মিতার সাথে করুন গিয়ে। আমার সাথে নয়। সরুন তো... আজাইরা।"
আমার ঝাঁঝালো কথায় কোনোরূপ হেলদোল হলো না উনার। মুচকি মুচকি হেসে আরো দু'পা এগিয়ে এলেন উনি। আমি মাথাটা পিছিয়ে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। উনি বামহাতে কোমরের পাশ ধরে কাছে টেনে নিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একজোড়া ঝুমকো বের করলেন। কালো আর সাদা পাথরের ঝুমকো। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো "ফু" দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে ঝুমকো জোড়া পড়িয়ে দিলেন আমার কানে। দুল পড়ানো শেষ করে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন উনি। থুতনী ধরে মুখটা এদিক ওদিক ফিরিয়ে দেখলেন। ডান কানের ঝুমকোতে টোকা দিয়ে চোখ টিপে গাইলেন,
---" পরান যায় জ্বলিয়া রে,
পরান যায় জ্বলিয়া....
কি রে? জ্বলে নাকি?... মন!"
এক ধাক্কায় উনাকে সরিয়ে দিয়ে কানে হাত দিলাম। কান থেকে দুলগুলো খুলতে নিতেই গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন উনি,
---" খবরদার দুল খুলবি না। তোরা মেয়েরা মানেই এক্সট্রা ঝামেলা বুঝলি? তোদের সব কিছুতেই দেমাক। শরীরের প্রতি পার্টে পার্টে দেমাক। ওসব পার্টে লাগানোর জিনিসগুলোরও ওমনই দেমাক। ফ্রেন্ডদের সাথে টি-শার্ট কিনতে গিয়ে পাশের দোকানে চোখ পড়লো। দুলগুলো দেখে কিনতে গিয়ে শুনি ১১৫০ টাকা। ভাবতে পারছিস? একজোড়া দুলের দাম ১১৫০ টাকা! এই দুল কিনতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি দেশের নিরীহ ছেলেগুলো বিয়ে করতে ভয়টা পায় কেন। দুল কিনতেই যদি এগারোশো চলে যায় তাহলে বাকিসব কিনবে কিভাবে?তোরা একেকটা মেয়েই একেকটা আতঙ্ক,বুঝলি?"
আমি রাগ নিয়ে বললাম,
---" আমি বলেছি আপনাকে কিনতে? নিবো না আপনার দুল।"
আমার কথা শেষ হতেই আবারও কাছে এসে দাঁড়ালেন উনি। আমার দুটো হাত শক্ত করে ধরে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
---" বেশি পাকনামো করলে খবর আছে। ঢং কমিয়ে কর বুঝলি? এখন চুপচাপ ছাঁদের ঘরে যা তো। ওখানে কিছু একটা ফেলে এসেছি নিয়ে আয়। যা..."
উনার কথায় মুখ ফুলিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। আমার হেলদোল না দেখে ভ্রু কুঁচকালেন উনি। কড়া গলায় বললেন,
---"তোর সাহস দেখে আমি হতবাক। এই? ক'দিন যাবৎ আদর করে কথা বলছি বলে কথা কানে যাচ্ছে না, তাই না? একটা চড় মেরে সবগুলো দাঁত ফেলে দেবো বেয়াদব। যা বলছি...."
উনার ধমকে প্রথমে কাঁদো কাঁদো হয়ে উনার দিকে তাকালাম। উনার চেহারায় ভাবাবেগ না দেখে ঠোঁট উল্টিয়ে কান্না কান্না ভাব নিয়ে ছাঁদ ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। ছাঁদের ঘরটা খুবই ছোট। একপাশে ছোট্ট একটা জানালা। সেই জানালার পাশ ঘেঁষে ছোট্ট চৌকি। তারপাশে ভাঙা আলনা আর টেবিল। মন খারাপ ভাব নিয়ে রুমের ঝং ধরা দরজাটা ঠেলে দিতেই বিছানার কিছু অংশে চোখে পড়লো। চৌকির উপর একরঙা ময়লা চাদর বিছানো। তারওপর একগুচ্ছ তাজা কদম। সবুজ পাতার মাঝে দশ,পনেরটা কদম ফুলে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা। ফুলগুলো দেখেই ঠোঁটদুটোর আকার পরিবর্তন হলো আমার। কান্না কান্না ভাবটা মুহূর্তেই হাসি হাসিভাবে রূপ নিলো। ফুলগুলো হাতে তুলে নিতেই হলুদ রঙের টুকরো কাগজ গিয়ে পড়লো মেঝেতে। কাগজটা তুলে মেলে ধরতেই ভেসে উঠলো লাল কালিতে লেখা,
"স্নিগ্ধ শ্রাবণ রাতের শুভেচ্ছা, মহারাণী!
বর্ষায় আপ্লুত কদমের মতো আমাকেও একটু মুগ্ধতায় ছুঁয়ে দাও না প্লিজ! তোমার চুলের ঘ্রানে মাতাল করে তোমাকেই....হ্যাঁ, শুধু তোমাকেই চুপিচুপি "ভালোবাসি" বলার সুযোগটা দাও না প্লিজ! তোমাতে সিক্ত এই আমিকে আরেকটু সিক্ত করে ভালোবাসা নামক নীল ব্যাথায় ভরিয়ে দাও না-
প্লিজ!! "
ছাঁদের ঘরের হলদে আলোয় দুই-তিন লাইনের ছোট্ট চিরকুটটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম আমি। চিরকুটটা পড়তেই অদ্ভুত এক লজ্জায় কেঁপে উঠলো সারা শরীর। সেই লজ্জায় রাঙা হয়ে পেছনে ফিরতেই চোখে পড়লো গভীর দুটো চোখ। ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে, হাত ভাজ করে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সে! আমার সে!
চলবে...
Writer:- নৌশিন আহমেদ রোদেলা