> রোদ শুভ্রর প্রেমকথন স্পেশাল পর্ব ১৬, ২০ - Love Story Bangla - রোমান্টিক লাভ স্টোরি - Bangla Love Story - ভালোবাসার গল্প
-->

রোদ শুভ্রর প্রেমকথন স্পেশাল পর্ব ১৬, ২০ - Love Story Bangla - রোমান্টিক লাভ স্টোরি - Bangla Love Story - ভালোবাসার গল্প

১৬

চারদিকে বন্যার হাঁকডাক পড়তেই বন্যা দেখতে ছুঁটে গেলাম আম্মুর নানু বাড়ি। সেই হিসেবে আমার আর শুভ্র ভাইয়ের দু'জনেরই নানু বাড়ি। আম্মুর নানু বাড়ি ময়মনসিংহ থেকে বেশ খানিকটা দূরে  ব্রহ্মপুত্র নদের ধারের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। নদীর বদৌলতে সেই গ্রামে বন্যার পানি যেন ফুলে ফেঁপে ওঠে ডুবিয়ে দিতে চাইছে ঘর-বাড়িসহ সব। শহরবাসী মানুষ হিসেবে নৌকার প্রতি সহজাত এক টান আছে আমার। সেই টানে মত্ত হয়েই লাফালাফি করে চলেছিলাম পুরোটা পথ। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গাড়ি থেকে নেমে নৌকা পথে পাড়ি জমালাম আমরা। প্রায় একঘন্টা পথ নৌকা যুগে যেতে হয়েছিলো আমাদের। নৌকা দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেও বসতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হলো আমার। নৌকার ভেজা পাটাতনে পা ছড়িয়ে বসা মানেই জামা নষ্ট, এখন উপায়? আম্মু পাশে থাকলে আম্মুর আঁচল ধরে কিছুক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করে এই অযাচিত সমস্যার কিছু একটা সমাধান পাওয়া যেত কিন্তু সেই উপায়টাও নেই। মামু,মামানি, ছোট ফুপি, ফুপা,জারিফ,আদিবা, আব্বু, আম্মু, ভাইয়া, আপুসহ সবাই এসেছি ঘুরতে। মানুষের ঘনত্ব অনুযায়ী ভাড়া করা হয়েছে দুই নৌকা। তার মধ্যে থেকে অপেক্ষাকৃত বড় নৌকাটাই ওঠেছে মা-বাবাসহ বড়রা। আর ছোট নৌকায় ভাই-বোন মিলে আমরা ক'জন। আমার এই দূরাবস্তা দেখেই হয়তো মাঝিকে  উদ্দেশ্য করে হাঁক ছাঁড়লেন শুভ্র ভাই,

---" চাচা? নৌকার ডালিতে বসলে কি সমস্যা হবে?নয়তো বসার উপায় নেই।" 

মাঝবয়স্ক মাঝি শুভ্র ভাইয়ের "ডালি" শব্দের অর্থটা বুঝতে না পারলেও তার ইশারা করা হাতের দিকে তাকিয়ে আঁচ করে নিলেন। বাঁশের লম্বা লগি ঠেলে দিয়ে বললেন, 

---" না, চাচা। নৌকার নালে বসলে নৌকা ঠিক থাকবো না। ছোডু নৌকা তো...তারমধ্যে মানুষ বেশি। আপনারা তাড়াতাড়ি বইয়া পড়েন। তাড়াতাড়ি যাওয়ন লাগবো।" 

বলতে বলতেই নৌকা ঠেলে নামিয়ে দিলেন স্রোতে। হঠাৎ  ধাক্কাটা সামলে উঠতে না পেরে পড়ে যেতে নিলেই একহাতে ধরে ফেললেন শুভ্র ভাই। পায়ের জুতো জুড়ো খুলে মৃদু গলায় বললেন,

---"জুতোর ওপর বসে পড়।" 

সাথে সাথেই পাশ থেকে একরকম হুংকার দিয়ে বলে উঠলো ভাইয়া,

---" আরে চাচা? বসার আগেই নৌকা ছুটাচ্ছেন কেন? এখনই তো পড়ে যেত। এতো কিসের তাড়াহুড়ো? আমরা কি ভাড়া দিবো না আপনাকে?"

মাঝি ক্ষিপ্র হাতে লগি ঠেলতে ঠেলতে বললো,

---" ভাড়ার কথা না চাচামিয়া। আন্নেরা ভাড়া না দিলেও নিয়া যাইতাম। এই আপদের দিনে ভাড়ার কথা ভাবলে চলবো? যে জায়গাটা এহন পাড় হইতাছি এইডা হইলো মাটির রাস্তা। অটো, ভ্যান সবই চলতো কিন্তু এই বন্যার লাগি নৌকা ছাড়া কিছু চলে না। এই পুরা গেরামে আমরা মাত্র তিনজন নৌকা চালাই। এই তিনডা নৌকা দিয়াই আপদ-বিপদে এনে ওনে যায় সবাই। আপনা গো দিয়া আইতে আইতেই দেখুম কতো মানুষ নৌকার লাইগা খাড়ায় আছে। হের লাইগাই এতো তাড়াহুড়া।"

ভাইয়া আর কিছু বললো না। আমিও আড়চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে পড়লাম উনার খুলে রাখা জুতোর উপর। আমার পাশে বসেছে আপু আর আমাদের মুখোমুখি বসেছে আর শুভ্রভাই আর ভাইয়া। মাঝ বরাবর জারিফ আর আদিবা। দু'জনেই ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে সিটিয়ে আছে আমার গায়ে। ওদের এই ছোট্ট জীবনে এটাই প্রথম নৌকাভ্রমণ। আদিবা আর জারিফ থেকে কিছুটা দূরে মাঝির কাছাকাছি পাটাতনে পা গুটিয়ে বসে আছেন একজন বোরকা পরহিতা মহিলা আর একজন বৃদ্ধগোছের লোক। লোকটির টাকপড়া মাথার বাঁধবাকি চুলগুলো ধবধবে সাদা। কালো কুচকুচে শরীরের চামড়াগুলো কুঁচকে গিয়েছে প্রায়। আধ ময়লা লুঙ্গিটাও উঠে আছে হাঁটু অব্দি। দাঁতগুলো জর্দা আর পান খেয়ে কালচিটে রূপ নিয়েছে সেই অনেক বছর। লোকটির পাশে বড়সড় বেতের খাঁচা। চোখদুটোতে উদাসভাব নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন উনি। কিছুটা পথ যেতেই চোখে পড়লো আধ ডোবা পুঁইশাকের ক্ষেত । পানির নিচ থেকে প্রাণপণে মাথা উঁচু করে রেখেছে কিছু সবুজ লতা। সেই ক্ষেতকে উদ্দেশ্য করেই বলে উঠলেন সেই বৃদ্ধ, 

---" বুঝলা মোফাজ্জল? এই পুঁইশাকের টালে না হইলেও পঞ্চাশটার নাহাল সাপ পাওন যাইবো।" 

বৃদ্ধর কথার জবাবে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালেন মাঝি। হাতের পেশী ফুলিয়ে লগি ঠেলতে ঠেলতে বললেন,

---" হ, মজিবর চাচা। সাপ গুলান তো এহন খালি প্রাণ বাঁচাইতাছে। কয়দিন পর যখন পানি ঘাটবো তখন দেখবান সাপ কারে কয়। এইবারের মাইচ্চা সাপগুলানেরও বিষ আছে চাচা। মতিনের পোলা ফজল আছে না? ওইটাও তো সাপের কামড়ে মইরা গেলো। সবাই কইতাছে মাইচ্চা সাপই নাহি কামড়াইছে।" 

মাঝির কথা শুনে কৌতূহলী গলায় বলে উঠলো আদিবা,

---" রোদাপি? মইরা গিয়ে কি মারা যায়?" 

শুভ্র ভাই পা গুটিয়ে বসে ছিলেন। আদিবার কথা কানে যেতেই আদিবার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলেন। সন্দিহান চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন। আদিবার মাথায় চাটি মেরে মজার ছলে বললেন,

---" না। মারা গিয়ে মইরা যায়।" 

আদিবা ব্যাপারটা না বুঝে চোখ পিটপিট করে তাকালো। জারিফ পাশ থেকে চেঁচিয়ে ওঠে বললো,

---" তুই কি গাধী আদিবুড়ি। মারা আর মইরা একই কথা। ওরা "মারা" উচ্চারণ করতে পারে না বলে "মইরা" বলে।"

ওদের দু'জনের কথা শুনে মুচকি হেসে পানির দিকে চোখ রাখলাম আমি। চারপাশে অথৈ পানি তার মাঝে দু'একটা বাড়ি আর গাছ যেন দ্বীপের মতো মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের গর্ব প্রকাশ করতে ব্যস্ত। পানির ঢেউগুলোও যেন অদ্ভুত এক নিয়মে বন্ধী। সেই নিয়মের তালে তালেই মাতালের মতো হেলেদুলে খেলে উঠছে তারা। তাদের কোনো তাড়া নেই না আছে কোনো ব্যস্ততা। এই সুন্দর, স্নিগ্ধ  ঢেউগুলো ছুঁয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে বামহাতটা নৌকার বাইরে হেলিয়ে দিতেই বাঁধ সাধলেন শুভ্র ভাই। বললেন,

---" ছি! এই পানি ছুবি তুই?গ্রামের বেশিরভাগ  টয়লেটগুলোই ডুবে গেছে রোদ। আর তা মিক্সড হয়েছে এই বন্যার পানিতে। আমার তো ভাবতেই ঘৃণায় বমি আসছে। আর তুই কিনা এই পানিতে হাবুডুবু খাওয়ার চিন্তা করছিস?ছিঃ" 

উনার কথার যুক্তিসংগততা বুঝতে পেরে নিজের মনকে সংযত করে নিলাম আমি। হাত গুটিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলাম হাজারো ঢেউয়ের মেলা। প্রায় একঘন্টার মাথায় নৌকা এসে থামলো নানুবাড়ির উঠোনের কিনারায়। উঠোনের পাশের বাঁশঝাড়গুলো নুইয়ে এসে ছায়াময় করে তুলেছে চারপাশ। গোলা পানিতে বাঁশ পাতার ছায়া আর লগি টানার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে মুগ্ধ হয়েই নৌকা থেকে নামলাম আমরা।

________________

নানু বাড়িতে পৌঁছানোর পর পরই শুরু হলো দুনিয়া অন্ধকার করা বৃষ্টি। শহরে থাকতে থাকতে সবার মধ্যে যে আলসেমি ভাব তৈরি হয়েছিলো তা যেন মুহূর্তেই দৌঁড়ে পালালো। নানু বাড়িতে থাকা কাজিনরাসহ আমরাও নেমে এলাম উঠোনে। উঠোনের শেষ ভাগে একটা মস্ত কদম গাছ। কদম গাছটা যেন হলুদ-সাদা চাঁদরে ছেয়ে আছে। বৃষ্টির পানিগুলো সেই হলুদে গা ভাসিয়ে বেয়ে পড়ছে আমাদের চোখে-মুখে, শরীরের প্রতিটি অঙ্গে। কদম গাছের গোড়ায় বাঁধা ছোট্ট ডিঙি। সেই ডিঙিতেই হৈ-হুল্লুড় করে ওঠে বসলো সবাই। উদ্দেশ্য পরিষ্কার বন্যার পানিতে গোসল করা। কয়েকজন ওঠার পর আমি উঠতে গেলেই বাঁধ সাধলেন শুভ্র ভাই। গম্ভীর গলায় বললেন, 

---" তোকে নেওয়া হবে না। ঘরে গিয়ে গোসল কর। যা.. "

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, 

---" কেন? আমাকে নেওয়া হবে না কেন?"

---" সেটা তোকে বলতে হবে? নিবো না মানে নিবো না। সর..ভাগ। " 

আমি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম,

---" বললেই হলো? আমি যাবো মানে যাবো।ব্যস!" 

নৌকার গলুইয়ের কাছে লগি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলো রনি। আমি ওকে ধমকে উঠতেই আমাকে উঠার জন্য জায়গা ছেড়ে দিলো রনি। সাথে সাথেই পেছন থেকে গম্ভীর কন্ঠে হাঁক ছাড়লেন শুভ্র ভাই,

---" রনি!" 

রনির নামটা উচ্চারিত হতেই অসহায় মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকালো রনি। শুভ্র ভাই আমাকে পাশ কাটিয়ে লাফিয়ে নৌকায় উঠতেই নৌকা ঠেলে দিয়ে বলে উঠলো রনি,

---" তোমাকে পড়ে ঘুরতে নিয়ে যাবো রোদাপু। তুমি মন খারাপ করো না। এখন নিলে শুভ্র ভাই মারবে তো মারবে নৌকাই উল্টিয়ে দিবে।" 

শুভ্র ভাই রনির হাত থেকে লগিটা ছিনিয়ে নিয়ে নৌকা চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিছুটা দূরে গিয়েই চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

---" চার ইঞ্চি মানুষদের পানিতে ডুবে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। আগে বড় হ তারপর পানিতে নামিস।" 

উনাদের নৌকাটা বাঁশঝাড়ের আবছায়ায় হারিয়ে যেতেই চোখদুটো ঘোলা হয়ে এলো আমার। উনার বলা প্রতিটি কথা তীক্ষ্ণ অপমানের মতো বিঁধলো আমার মনে। রাগ, অভিমান,লজ্জা, অপমান সবকিছুই যেন আত্মপ্রকাশ করলো গাল বেয়ে পড়া সাদা জলে। সেই নুনতা জলগুলোও গালে নেমেই হারিয়ে যাচ্ছিলো একঝাঁক আষাঢ়ে বৃষ্টির অন্তরালে। লাল চোখ আর কম্পনরত শরীর নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম আমি। ড্রেসটা কোনরকম চেঞ্জ করেই নিরিবিলি জায়গা দেখে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে রইলাম অনেকক্ষন। ভেজাচুলগুলো বিছানায় ছড়িয়ে থাকায়  ভিজে চুপচুপে হলো বিছানা । সেই সাথে চুপচুপে হলো আমার দুই গাল। রাগ,অভিমান আর এক শ্রাবণ চোখের জল নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। দুপুরে খাওয়া হলো না। খাওয়া হলো না রাতেও। পুরাতন জায়গায় পুরাতন মানুষগুলোকে আবারও নতুন করে পেয়ে আমার কথা হয়তো মাথাতেই এলো না আম্মুর। রাত নয়টার দিকে খুঁজে খুঁজে আমার পর্যন্ত পৌঁছোলেন আম্মু। আম্মুকে উল্টো বকুনী দিয়ে কাঁথায় মুখ ঢেকে পড়ে রইলাম আমি। আম্মুও আর জোড়াজুড়ি করলেন না। তাতে যেন অভিমানটা আরো বহুগুণ বেড়ে গেলো আমার। সবসময় জোড়াজুড়ি করে তাহলে আজ কেন করলো না? নিশ্চয় আর ভালোবাসে না আমায়। কেউ ভালোবাসে না। কেউ না। এসব ভেবে নিজের উপরই বিরক্ত হচ্ছিলাম আমি। নেটওয়ার্ক প্রবলেমের জন্য বিরক্তিটা বেড়ে যাচ্ছিলো আরো বহুগুণ। এভাবেই বিরক্তিতে খিটমিট করতে করতে ঘড়ির কাটা বারোর ঘরে পৌঁছালো। সাথে সাথেই দরজা থেকে ডেকে উঠলো স্নিগ্ধা আপু। আম্মুকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললো,

---" ফুপি? রোদ আজ আমার সাথে থাকুক? এই গরমে চারজন এক বিছানায় থাকবেন কিভাবে? আমি আজ একা শুয়েছি ও বরং আমার সাথেই ঘুমুক।" 

আমার মন তখন কালবৈশাখীর কালো মেঘে ঢাকা। চোখে-মুখও অভিমানের ঝড়ে ক্লান্ত। তাই কোনো বনিতা না করেই বললাম, 

---" আমি এখানেই ঠিক আছি স্নিগ্ধা আপু। তুমি শুয়ে পড়ো। আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।" 

স্নিগ্ধা আপু নাছোড়বান্দা গলায় বললেন,

---" সমস্যা না হলেও আমার সাথে চল। আমি একা। কেমন যেন ভয় লাগছে আমার। চল না প্লিজ...কাল তো চলেই যাবি।" 

আম্মুও দ্বিধান্বিত চোখে তাকালেন। রাতের বেলা মেয়েকে নিজের থেকে দূরে রাখতে একদমই রাজি নয় সে তবুও স্নিগ্ধা আপুর জোড়াজুড়িতে রাজি হলেন তিনি। মৃদু গলায় বললেন,

---" আচ্ছা যা। স্নিগ্ধার সাথেই শুয়ে পড় না হয়।"  

আমিও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসলাম। স্নিগ্ধা আপুর সাথে ঘর থেকে বেরুতেই উনি জানালেন উনি ওয়াশরুমে যাবেন। উনাদের ওয়াশরুমটা ঘরের বাইরে বিশাল একটা আমড়া গাছের তলায়। উনি আমাকে সেই আমড়া গাছের তলায় দাঁড় করিয়ে ওয়াশরুমে গেলেন। আমি মনোযোগ দিয়ে নিউজফিড স্ক্রল করছি। মূলত, ভয় থেকে বাঁচতেই নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি। এমন সময় নারিকেল গাছের ছায়া থেকে ঢেকে উঠলো কেউ। মুহূর্তেই চমকে উঠে সেদিকে তাকালাম আমি। লম্বা করে কোনো পুরুষদেহি ছায়া দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাতেই আবারও ডেকে উঠলো ছায়াটি,

---" রোদাপু? আমি রনি।" 

"রনি" নামটা শুনে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। কিন্তু সন্দেহটা গুচলো না পুরোপুরি। নারিকেল গাছের ছায়া থেকে সরে আমার দিকে এগিয়ে আসতেই আমি সন্দেহী চোখে তাকালাম। মাথাটা খানিক পিছিয়ে নিয়ে বললাম, 

---" তুই সত্যিই রনি না ভূত?" 

আমার কথায় হেসে ফেললো রনি। মাথার একঝাঁক লালটে চুল হেলিয়ে দুলিয়ে বললো,

---" তুমি ভয় পাচ্ছো রোদাপু? আমি সত্যিই রনি।" 

আমি সন্দেহী গলায় বললাম, 

---" কালিমা বল তো। নয়তো "আল্লাহ" বল।" 

রনি এবার মুখ চেপে হাসতে লাগলো। ওর হাসির মাঝে ফোন বেজে উঠতেই বললো,

---" এই দেখো আমার ফোন। ভূতের কি ফোন থাকে?"

আমি কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বললাম, 

---" তো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিলি কেন? যা ফুট...তোর সাথে আমার কথা নেই। শুভ্র ভাইয়ের চামচা কোথাকার।" 

রনি এবার অপরাধী গলায় বললো,

---" রাগ করো কেন? শুভ্র ভাইয়ের কথা না শুনলে শুভ্র ভাই মারতো।" 

আমি ওর দিকে তেড়ে গিয়ে ওর বাহুতে একটা চড় দিয়ে বললাম, 

---" আমিও মারতে পারি। ডাফার কোথাকার...যা তোর শুভ্র ভাইয়ের কাছে। খবরদার আমার আশেপাশে আসবি না। বেদ্দপ।" 

রনি মাথা চুলকে বললো। 

---" উঠনোর ওই কোণায় ,ঘাটে চলো।" 

আমি অবাক হয়ে বললাম, 

---" কেন? এতো রাতে ওখানে যাবো কেন আমি?" 

---" একটা জিনিস দেখাবো।" 

আমি আবারও সন্দেহী চোখে তাকালাম,

---" ওই হারামি? তুই সত্যিই মানুষ নাকি ভূত? সত্যি করে বল। আমাকে পানির কাছে নিয়ে মেরে ফেলতে চাস? স্নিগ্ধা আপু? স্নিগ্ধা আপু তাড়াতাড়ি বের হও.... " 

রনি তাড়াহুড়ো করে বললো,

---" আল্লাহ্। চিৎকার করো না রোদাপু। শুভ্র ভাই তোমাকে ডাকছে। কসম।" 

আমি সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললাম, 

---" একদম মিথ্যা বলবি না। উনি এতো রাতে আমায় কেন ডাকবে? আর ডাকলেও যাবো না। যা ভাগ..."

রনি ব্যর্থ হয়ে কাউকে ফোন লাগালো। ফোনটা রিসিভ হতেই বললো,

---" রোদাপু যেতে চাচ্ছে না শুভ্র ভাই। কি করবো?  আচ্ছা....আচ্ছা ঠিক আছে।" 

এটুকু বলে থামলো রনি। আমার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

---" ভাই কথা বলবে।" 

আমি মুখ ভেঙিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। রনি উনাকে জানালো আমি কথা বলতে চাইছি না। শুভ্র ভাই কি বললেন না বুঝলেও ফোনটা লাউডে করে আমার সাথে ধরলো রনি। শুভ্র ভাই শান্ত গলায় বলে উঠলেন,

---" তোর কান ধরে উঠবস করার ভিডিওটা এখনও আছে আমার কাছে। ইচ্ছে না করলে আসিস না। আমি ওই ভিডিও কাল সবাইকে দেখাবো। ফেসবুকেও আপলোড করবো। আর যদি আসিস তো তাড়াতাড়ি আয়...তোর জন্য স্নিগ্ধা ওয়াশরুম থেকে বের হতে পারছে না। তুই এলেই ও বের হবে নয়তো ভেতরেই বসে থাকবে।" 

আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললাম,

---" এটা সম্পূর্ণটাই আপনার প্ল্যান ছিলো? মীরজাফর একটা।" 

শুভ্র ভাই রাগী গলায় বললেন,

---" কি বললি? আচ্ছা, যা বলেছিস বলেছিস মাফ করে দিলাম। বাচ্চা মানুষ বলে কথা। এবার জলদি আয়।" 

আমি মুখ ফুলিয়ে রনির পেছন পেছন উঠোনের কোণে বিরাট কদম গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওখানে নৌকার গলুইয়ের ওপর বসে ছিলেন শুভ্র ভাই। চাঁদের আলোতে পানিগুলো চিকচিক করছে সেই সাথে আবছামৃদু সৌন্দর্যে ঢেকে গেছে পুরো বাঁশ ঝাড়। উনি আমাকে দেখে হালকা হাসলেন। উনার ইশারা অনুযায়ী নৌকায় উঠতেই রনিও ঝটপট ওঠে এলো নৌকায়। লগি ঠেলে নৌকা ভাসিয়ে দিয়েই সামনের গলুইয়ের উপর বসে পড়লো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হকচকিয়ে গেলাম। শুভ্র ভাই আমার হাত টেনে পাশে বসিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন,

---" রোদপাখি কি রেগে আছে? মাঝরাতে নৌকায় জ্যোস্না স্নানের সাথে সাথে মন খারাপভাবটাকেও কি ভাসিয়ে দেওয়া যায় না? শুভ্র অনেকগুলো সরি।" 

উনার কথায় মন খারাপভাবটা ধরে রাখার হাজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। হঠাৎ করেই প্রচন্ড লজ্জা করতে লাগলো আমার। উনার থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দুই হাঁটুতে মাথা রেখে মুখ আড়াল করে বসে রইলাম। চারপাশের ঝিঝি পোকা আর নৌকার ঢেউের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাপিয়ে নৌকার ওপাশ থেকে কথা বলে উঠলো রনি,

---"কোন দিকে যাবো শুভ্র ভাই?" 

---" তোদের গ্রাম। আমি চিনি নাকি? বিল আছে আশেপাশে? থাকলে সেদিকে যা।"

---" আচ্ছা।" 

এবার আমি মাথা তুলে তাকালাম। উপরে বিরাট আকাশটাই আধখানা চাঁদের সাথে ছোট ছোট হাজার তারার মেলা। আর চারদিকে জ্যোস্না মাখা অসংখ্য ঢেউ। আকাশের দিকে তাকালেই মনে হচ্ছে...এ যেন এক তারার রাজ্য। হাজারও মায়াবী ঢেউ পাড়ি দিয়ে সেই রাজ্যেই যেন ডুবতে যাচ্ছি আমি। আমার মুগ্ধ চাহনীর মাঝেই গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলেন শুভ্র ভাই,

---" তোর পাশে হলুদ রঙের একটা শপিং ব্যাগ আছে। দেখ.."

আমি উনার দিকে জিগ্যেসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পাশে তাকালাম। হলুদ রঙের শপিং ব্যাগটা তুলে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। ভেতরে দুটো কেকের প্যাকেট, দুটো সুমোচা, দুটো পাকা আম আর একটা পানির বোতল। আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম,

---" এগুলো কেন?" 

---" ফেলে দেওয়ার জন্য।" 

---" মানে?" 

শুভ্র ভাই বিরক্তি নিয়ে বললেন, 

---" জীবনেও মূর্খ থেকে শিক্ষিত হবি না তুই। এগুলো কি ফেলে দেওয়ার জিনিস? তোর জন্য এগুলো বসে বসে খা।" 

আমি রাগ নিয়ে শপিং ব্যাগটা পাশে রেখে শক্ত গলায় বললাম, 

---" খাবো না। আপনার জিনিস আপনি খান।" 

উনি হেসে বললেন,

---" আমার জিনিস হলেও কি আর সবকিছু সবসময় খাওয়া যায়?" 

আমি ভ্রু বাকিয়ে তাকাতেই ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন উনি,

---" দুপুরে বা রাতে একবেলাও তো খেতে দেখলাম না। আসলেই খেয়েছিস নাকি ডায়েটিং করছিস?আদর করে বলছি, চুপচাপ সামনে বসে খা। নয়তো বন্যার পানিতে ফেলে দিবো। সাঁতার তো পারিস না। দুই তিনবার হাবুডুবু খেয়ে এই পঁচা পানিতে পেট ভরাবি তারপর তুলে আনবো। কি হলো, খা!" 

আমি মুখ কালো করে বসে রইলাম। উনি আবারও খেতে বলায় তেজ নিয়ে বলে উঠলাম,

---"আপনি আসলেই অনেক খারাপ। সবসময় এতো ধমকা ধমকি কেন করেন? ভালো লাগে না আমার। এই রনি? নৌকা ঘুরা যাব না আমি কোথাও। লাগবে না নৌকাভ্রমণ। ঘুরা বলছি।" 

আমার কথায় রনির তেমন ভাবাবেগ হলো না। শুভ্র ভাই আমার পাশে নৌকার পাটাতনে পা গুটিয়ে বসে বললেন, 

---"আচ্ছা বাবা, সরি! শুভ্র খুব খারাপ। এবার তো খা..প্লিজ।" 

আমি উনার দিকে আড়চোখে তাকালাম। উনাকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু নড়েচড়ে বসলাম। পেটের মাঝে ক্ষুধা নামক কীটটাও একটু নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো। তুমুল উৎসাহ নিয়ে কেকের প্যাকেটটা ছিঁড়ে একটা কামড় বসিয়ে উনার দিকে তাকালাম,

---" কেউ কি খাবে?" 

উনি হেসে বললেন,

---" জ্বি না, ম্যাডাম। রোদপাখি যার কথা বলছে সে খাবে না। এই রনি? কেক খাবি?" 

কথাটা বলেই একটা কেকের প্যাকেট ছুঁড়ে মারলেন উনি। রনি ডানহাতে প্যাকেটটা ক্যাচ করতেই মাথা ঘুরিয়ে কেকে কামড় বসালাম আমি। সাথে সাথেই একহাতে আমার চোখ চেপে ধরলেন। আমি বিস্মিত কন্ঠে বললাম,

---" কি হচ্ছে? "

---" অপেক্ষা। জাস্ট কয়েক মিনিট।" 

আমি অধৈর্য গলায় বললাম, 

---" কিন্তু কেনো?" 

---" চুপ করো না রে বাবা। আছে একটা কিছু। এই রনি? এদিকে একটু কম কম তাকা...বড়দের দিকে তাকাতে নেই।" 

রনির হাসির শব্দ কানে এলো। তারপর আবারও নীরবতা। আচ্ছা?  এটা কি ঝিঁঝি পোকার শব্দ? নাকি পানিতে থাকা কোনো জলজ কীট? কয়েক মিনিট পর যথারীতি আমার চোখদুটো ছেড়ে দিলেন উনি। আমি চোখ পিটপিট করে সামনে তাকাতেই নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বসা অবস্থায় লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে উঠলাম। সাথে সাথেই কাত হয়ে গেলো নৌকা। শুভ্র ভাই তাড়াহুড়ো করে আমাকে সামলে নিয়ে বললেন,

---" পাগলী। এখুনি ডুবতো নৌকাটা।" 

আমি উত্তেজনায় মুখ চেপে ধরে বললাম,

---" এতো শাপলা?" 

রনি হেসে বললো, 

---" এর থেকেও বেশি থাকতো। বিকেলেই সালামরা তুলে নিয়ে গেলো। শাপলার ডাটা তো রান্না করে খায়।" 

রনির কথাটা আমার মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছালো না। শুভ্রতামাখা জ্যোস্নায়  সাদা শাপলাগুলো যেন রূপের বন্যায় ভাসতে ভাসতে ক্লান্ত, অবিশ্রান্ত। চাঁদের আলোয় চকচকে পানিতে সাদা শাপলাগুলো যেন এক একটা রূপের তারা। আমি বিস্মিত হয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলাম,

---" এতো সুন্দর কেন ফুলগুলো?" 

ডান কানে হালকা "ফু" দিয়ে আমায় কাপিয়ে তুলে, পাশ থেকে  ফিসফিস করে বলে উঠলেন শুভ্র ভাই,

---" আমার রোদপাখি দেখছে যে তাই।" 

আমার মুগ্ধতা ভরা আবেগে উনার কথাটা যেন ভেসে গেলো ওই বহু দূরে। শুভ্র ভাই বেশ কিছু শপলা তুলে নিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবারও ঝুঁকে পড়লেন শাপলা তুলতে। আমি মুগ্ধতা ভরা দৃষ্টিতে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চারপাশটা আজ কেমন শুভ্রতায় ঘেরা। চারপাশে শুভ্র জল, শুভ্র শাপলা, আকাশে শুভ্র চাঁদ-তারা আর আমার পাশে শুভ্র নামক জীবন্ত এক অসুখ। ভয়ানক অসুখ। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন উনি। দুটো শাপলা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

---" এই? তুই কি এভাবে তাকিয়ে থেকে আমাকে প্রেমের জালে ফেলতে চাচ্ছিস? খবরদার...একদম তাকাবি না। আমি অলরেডি এনগেজড, বুঝলি? ওয়ানপিস শুভ্রর জন্য ওয়ানপিস রোদপাখি আছে। সেখানে তোদের মতো বাচ্চা মেয়েদের খাওয়া নেই। এখনো তাকিয়ে আছিস? মাই গড! কাল থেকে নজর ফোঁটা দিতে হবে। নয়তো,  তার আমানতগুলো তোরা তাকিয়ে তাকিয়েই নষ্ট করে দিবি।" 

উনার কথায় ঝংকার তুলে হেসে উঠলাম আমি। উনি বুকে হাত দিয়ে বললেন, 

---"এটাও তোর ষড়যন্ত্র। বুঝি তো আমি।" 

আমি আবারও হেসে উঠলাম। আমার হাসির সাথে তাল মিলিয়ে উনিও মুচকি হাসলেন। তার সেই হাসিতেই একঝাঁক শুভ্রতামাখা মুগ্ধতা। সেই মুগ্ধতা শুধুই তার রোদপাখির জন্য....শুধু এবং শুধুই তার রোদপাখির জন্য।

১৭

কাল ইদ। ইদুল আযহা। সেই উদ্দেশ্যই আম্মুর নানু বাড়ি থেকে সরাসরি গেলাম দাদুবাড়ি। এই করোনা পরিস্থিতির জন্য ডিসিশন নেওয়া হলো আব্বু আর মামু একসাথে কুরবানি দেবে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো অন্য জায়গায়, কোরবানিটা আসলে দেবে কোথায়? নানু বাড়ি ময়মনসিংহ? নাকি দাদুবাড়ি শেরপুরে? আমার নানা-নানি বেঁচে নেই সেই অনেক বছর। নানু বাড়িতে মামু ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই। অন্যদিকে আমার দাদু-দিদাও মারা গেছে অনেক বছর হলো। কিন্তু দাদু বাড়িতে আমরা ছাড়াও তিন কাকু আর ফুপিরা আসছেন ইদে। তাদের রেখে ময়মনসিংহে ইদ করাটা আব্বুর কাছে আকাশসম পাপ.... মহাপাপ! বাবা-মার অবর্তমানে ছোট ভাই-বোনদের রেখে ইদ করবেন? এটা আদৌ সম্ভব?  কখনো নয়। একদমই নয়।  তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো মামুর কুরবানিটাও এবার আমাদের সাথে আমাদের দাদুবাড়িতেই দেওয়া হবে। সেই হিসেবে মামুরাও এলো গ্রামের বাড়ি। আমাদের গ্রামের বাড়ির পেছন উঠোনের নিচ থেকেই বন্যার পানির বহর। নিচু রাস্তাটা তখন বন্যায় প্লাবিত হয়ে খেয়া ঘাটের রূপ নিয়েছে পুরোদমে। বাড়ির মহলও বেশ ভরাটে। কাকাতো-ফুফাতো ভাইবোন আর আমরা মিলে হৈ-হুল্লোড় কান্ড। তারওপর বন্যায় প্লাবিত কিছু লোকজনও এসে উঠেছে আমাদের পুরোনো চৌচালাটাই। সব মিলিয়ে বাড়িতে যেন মানুষ জনের অভাব নেই। বড় বড় সসপেন ভর্তি রান্না হচ্ছে। কাকিমনি,আম্মু, ফুপিরা মিলে পিঠে বানাচ্ছেন। আর আমরা? পাশের বাজারের দোকানগুলো চষে খাচ্ছি। আর এই সবকিছুর খরচ উঠাচ্ছেন ছোট চাচ্চু। প্রতিবার এমনই হয়। সব কাজিনরা মিলে যখন ইচ্ছে যা ইচ্ছে কিনে আনি আর শেষ দিনে সে সবের দম চুকিয়ে দেন ছোট চাচ্চু। এতো দিনে এটা যেন আমাদের জন্য একটা অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে ।  সে যায় হোক, শুভ্র ভাইয়ের জন্য এ বাড়িতে কুরবানির ইদ এটাই প্রথম। সবাই তাকে পেয়ে খুশিও ব্যাপক। শুভ্র ভাই বরাবরই আড্ডা জমাতে মহা ওস্তাদ। এবারও তাই হলো। মেহেদী দেওয়ার পাট চুকিয়ে রাত বারোটা নাগাদ ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় আড্ডা দিতে বসলাম সবাই। উদ্দেশ্য ঘুমানোর সমস্যা নিয়ে জর্জরিত এই রাতটা না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেওয়া। রাফিয়া ছুটে গিয়ে একটা পেপসির বোতল এনে বললো "ট্রুথ এন্ড ডেয়ার" খেলবে। সবার সম্মতিতে খেলাটা শুরুও হলো। এক পর্যায়ে বোতলের মুখটা শুভ্র ভাইয়ের দিকে পড়তেই চেঁচিয়ে উঠলো সবাই। ভেতরের ঘর থেকে আব্বুর এক দফা ধমকও খেলো। কয়েক সেকেন্ড নিরবতা পালন করে আবারও উত্তেজনায় ফেটে পড়লো সবাই। শুভ্র ভাই ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে খানিকটা হাসলেন। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে বললেন,

---" কাহিনী কি বুঝলাম না। আমার সময় সবাই এমন নাচতেছিস কেন?" 

আলিফ ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে বললো,

---" সেটা একটু পরে বুঝবে। তো ট্রুথ অর ডেয়ার?" 

শুভ্র ভাই হেসে বললো,

---" ট্রুথ।" 

সবাই আশাক্ষুন্ন হয়ে উনার দিকে তাকালো। আপু বললো,

---" এটা কি হলো? আপনার তো ডেয়ার নেওয়ার কথা ছিলো শুভ্র ভাই। খুব তো বলেন আমি বীর পুরুষ, বীর পুরুষ। এখন কই গেলো বীরত্ব? ভিতু একটা।" 

---" কানের নিচে চড় না খেতে চাইলে চুপ যা। তুই বললেই তো আর ভিতু হয়ে গেলাম না আমি। তোদের পাল্লায় পড়ে নিজের ইমেজ নষ্ট করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। বড়দের চোখে "শুভ্র অলওয়েজ আ গুড বয়।" সো ট্রুথ!" 

সবাই কিছুক্ষণ মন খারাপ করে বসে রইলো। ফিসফাস শেষ করে বেশ মুড নিয়ে বলে উঠলো রাফিয়া,

---"ভাইয়া? আপনি তো টোটালি ঢেকে রাখার মতো মানুষ। আপনার জিএফ আদৌ আছে কি নাই তা বহুত অনুসন্ধান করেও ধরতে পারি নি আমি। তো...আপনার ট্রুথটা হলো, আপনার যদি এমন কেউ থেকে থাকে তাহলে তাকে দেখামাত্রই আপনার মনে কোন কথাটা প্রথম জাগে। আই মিন, ফাস্ট ফিলিংসটা কেমন হয় সেটা..."

রাফিয়া কথাটা শেষ করার আগেই চট করেই উত্তর দিলেন শুভ্র ভাই,

---" চলো না বিয়ে করি।" 

রাফিয়া থতমত খেয়ে বললো, 

---" জি?" 

শুভ্র ভাই ইনোসেন্ট লুক নিয়ে বললেন, 

---" তাকে দেখলে আমার বারবরই এই একই ফিলিংস হয়। "চলো না বিয়ে করি" টাইপ ফিলিংস।" 

আলিফ ভাইয়া হেসে বললেন, 

---" ভাই? তোমার হবু শশুড়কে বলতাম বিয়ের কথা?" 

শুভ্র ভাই হেসে বললেন,

---" বলে ধন্য কর ভাই। সাথে আমার হবু বউয়ের হবু শশুড়কেও বলিস যে তার হবু বউমার হবু বর বিয়ে করতে চায়। " 

আলিফ ভাইয়াসহ সব ভাইয়ারাই হেসে উঠলেন। রাফিয়া দ্বিধান্বিত চোখে তাকালো। কিছুক্ষণ ভেবে বললো,

---" আলিফ ভাইয়া তুমি শুভ্র ভাইয়ার হবু শশুড়কে চেনো?" 

পাশ থেকে মাহিন ভাইয়া আমোদিত গলায় বললো,

---" না চিনলে শুভ্র ভাইয়ের থেকে ঠিকানা নিয়ে চিনে নেবো। সাথে ভাবির হাতের রান্নাও খেয়ে আসবো। শুভ্র ভাইয়ের বউ বলে কথা রান্না তো অবশ্যই পারবে। বেশি না আমাদের রোদুর মতো রান্না পারলেই চলবে। কি বলো শুভ্র ভাই, চলবে না?" 

শুভ্র ভাই হাসলেন। রাফিয়া ঠোঁট উল্টে বললো,

---" ধুর! আমি আরো ভাবলাম শুভ্র ভাই রোমান্টিক টাইপ কিছু বলবে। কিন্তু আমি আশাহত। উনি তো সরাসরি বিয়েতে গিয়ে ওখানেই স্টপ হয়ে গেলেন।" 

শুভ্র ভাই সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,

---" বাচ্চা মেয়েদের এতো ভাবা ভালো না।  আমি খুবই ভদ্র ছেলে তাই আমি সবসময় ভদ্র ভদ্র জিনিসগুলোই ভাবি। আমার মতো ভদ্র ছেলেকে নিয়ে এমন অভদ্র চিন্তা এলো কি করে তোমার? ছি!" 

রাফিয়া অসহায় মুখ করে তাকালো। আমি প্রথম থেকেই অনুভূতিশূন্য ভাব নিয়ে বসে ছিলাম। এখনও তেমন ভাব নিয়েই দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসলাম। দেয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ দুটো খানিকটা বুজতেই ফোনে ম্যাসেজ টুন বেজে উঠলো। অলস হাতে ফোনটা হাতে নিতেই শুভ্র ভাইয়ার ম্যাসেজ চোখে পড়লো,

---" পা ব্যাথা?" 

আমি ম্যাসেজের উত্তর না দিয়ে ফোনটা পাশে রাখতে নিতেই আবারও ম্যাসেজ এলো,

---" বেশি ব্যাথা করছে?" 

ম্যাসেজটা এক পলক দেখে ফোনটা উল্টে রেখে চোখ বন্ধ করলাম। এটা আমার মুড সুয়িং গত সমস্যা। হুটহাট কারো সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেওয়া, ম্যাসেজ- কল ইত্যাদিতে রেসপন্স না করা সবকিছুই আমার বয়সগত অভ্যাস। চোখ দুটো বুজে নিতেই রাজ্যের ঘুম ভর করলো আমার চোখে। আজ পা'টা সত্যিই খুব বেশি ভুগচ্ছে আমায়। এই ভুগান্তিটা আমি ছাড়া দ্বিতীয় কারো বুঝার উপায় নেই। তবুও উনি কিভাবে বুঝে গেলেন, কে জানে? আমি দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসার পাঁচ মিনিটের মাথায়  বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন মামানি। ঘুমুঘুমু কন্ঠে বলে উঠলেন, 

---" রোদু কই? রোদু?"

আমি চোখ মেলে তাকালাম। মৃদু গলায় বললাম, 

---" এই যে আমি। কিছু বলবে?" 

মামানি তাড়া দিয়ে বললেন,

---" তোর নাকি পা ব্যাথা করছে? রাতে ওষুধ খেয়েছিলি? ভেতরে আয়। আমার পাশে জায়গা আছে ওতো তোর হয়ে যাবে। আয় শীগগির।" 

আমি আর কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ উঠে চলে গেলাম রুমে। রুমে যাওয়ার আগে একবার আড়চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। মাহিন ভাইয়াদের সাথে গল্পে মত্ত এই শুভ্রকে যতবার দেখি ততই অবাক হই আমি। লোকটা ভীষণ অদ্ভুত।আশেপাশে না থেকেও যেন খুব অদ্ভুতভাবে আমার আশেপাশেই থাকেন উনি। কিছু না করেও যেন অনেক কিছু করেন। অনেক কিছু! 

বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি। পা ব্যাথায় শরীর মন সবই যেন বিষিয়ে উঠছে। বারান্দার পাশের রুমটাতে শোয়ায় বারান্দার চিল্লাপাল্লাগুলো কানে অনেকটাই স্পষ্ট। আমি ছোট্ট করে শ্বাস টেনে নিয়ে ডান দিকে ফিরে শুতেই থেমে গেলো সব গোলযোগ। থমথমে এই নীরবতা কাটিয়ে ভরাট একটা কন্ঠ বেজে উঠলো কানে,

"হয়তো তোমারই জন্য 
হয়েছি প্রেমে যে বন্য
জানি তুমি অনন্য, আশায় হাত বাড়াই। 
যদি কখনো একান্তে 
চেয়েছি তোমাকে জানতে
শুরু থেকে শেষ প্রান্তে 
ছুটে ছুটে গেছি তাই। 

এটুকু গেয়েই থেমে গেলেন উনি। একটু চুপ থেকে আবারও গাইলেন। তবে অন্য গান,

"Let's fall in love for the night
And forget in the mornin'
Play me a song that you like
You can bet I'll know every line
I'm the boy that your boy hoped that you would avoid....."

মুহূর্তেই মৃদু হাসি ফুটলো আমার ঠোঁটে। চোখ দুটো বুজে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। উনাকে বলতে ইচ্ছে হলো, " আমি মিথ্যে বলেছিলাম শুভ্র ভাই। আপনার কন্ঠে ইংলিশ গানটা খুব একটা বাজে শুনাই না। অনেকটা মাদকের মতো শোনায়। ঘুম পাড়ানো মাদক!" কিন্তু বলা হলো না। তার আগেই ঘুম নামক ক্লান্ত মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম আমি। 

১৮

সকালে প্রায় আটটার দিকে ঘুম ভাঙলো আমার। এই হল্লাময় বাড়িতে আমি আটটা পর্যন্ত বিছানায়  শুয়ে আছি তা ভেবেই আমি বিস্মিত। তারওপর আজকে ইদের দিন। কেউ কি একবারও ডাকতে আসে নি আমায়? ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। জানালার হালকা সবুজ পর্দা ভেদ করে তীর্যক রোদ এসে পড়ছে বিছানায়। সেই রোদের দিকে চোখ পড়তেই যেন ফাপরে পড়লো শরীর। কাঁথায় মোড়ানো শরীরটা টেনে বিছানায় পা ছড়িয়ে বসলাম। কাল রাতে তো এই "কাঁথা" নামক ঝামেলা নিয়ে ঘুমাই নি। এই গরমের মধ্যে শরীরে এটা পেঁচিয়ে দিলো কে, কে জানে? পিঠময় পড়ে থাকে এলোমেলো চুলগুলোর কিছুটা কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে ডানদিকে তাকালাম। রুমের দরজাটা খোলা হওয়ায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শুভ্র ভাইয়ের উপরই চোখ পড়লো প্রথম। কালো রঙের উপর সোনালী সুতোয় কাজ করা একটি পাঞ্জাবি পড়েছেন উনি। চুলগুলো সবসময়ের মতোই কপালে ছড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে বিরক্ত ভাব। ডার্ক রেড ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে মামানির সাথে কথা বলছেন উনি। কথা নয়... উনাকে দেখে মনে হচ্ছে নিচুস্বরে মামানির সাথে রাগারাগি করছেন উনি। এই ছেলেটার কি সারাদিনই রাগ উঠে থাকে নাকি? ইদের দিনেও কিসের এতো রাগারাগি? উনাদের কথাবার্তার মাঝেই বাবার ভড়াট গলার ডাক কানে এলো। শুভ্র ভাই ডানহাতটা সামনে এনে ভ্রু কুঁচকালেন। ডানহাতে পড়ে থাকা কালো রঙের ঘড়িটিতে মনোযোগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মামানির হাত থেকে জায়নামাজটা নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমার দিকে তাকালেন। আমি বেশ অপ্রতিভ বোধ করলাম। উনার এই খনিকের চাহনিতে যেন গাঢ় কোনো মায়া ছিলো। যে মায়াটা আমায় সূক্ষ্ম কম্পনে কম্পিত করে গেলো চোখের পলকে। কাঁথা সরিয়ে আলুথালু শরীর নিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসতেই মামনি রুমে ঢুকলেন। প্রথমেই ডান পা'টা চেইক করে বললেন,  

---" আগের থেকেও তো ফুলে গেছে রোদু। ব্লিডিংও হচ্ছে। এই ডাক্তারে কি ঔষধ দিচ্ছে বল তো? ব্যাটা কি সত্যিই ডাক্তারির কিছু পারে নাকি এমনি? নির্ঘাত নকল করে পাস করেছে।" 

মামানির কথায় হেসে ফেললাম আমি। এলোমেলো চুলগুলো খোঁপা করতে নিতেই পাশে এসে বসলেন মামানি। আমার চুলগুলো দু'হাতে খোঁপা করে দিতে দিতে বললেন,

---" তোরা কি আমার একটা কথাও শুনবি না রোদ? তোদের দু'জনকে না বলেছি একে অপরের সাথে কথা বলবি না। দূরে দূরে থাকবি। কিন্তু কে শুনে কার কথা!" 

আমি মন খারাপ বললাম,

---" আমি তোমার ছেলের সাথে কথা বলি না। উনি ইচ্ছে ইচ্ছে করে কথা বাড়ান।" 

মামানি হেসে ফেললেন। বিছানার কাঁথাটা গোছাতে গোছাতে বললেন, 

---" ও তো বলবেই। ও যে আমার কথা মেনে নিয়ে কিছুদিন চুপচাপ ছিলো তা দেখেই তো আমি অবাক। ওকে ধরে রাখা আমার কর্ম নয়। শুভ্র যখন ভেবে নেয়, কোনো কিছু তার চায় বা এটা তার প্রয়োজন তখন তার সেই ভাবনা চেঞ্জ করার ক্ষমতা স্বয়ং আল্লাহ ছাড়া কারো নেই। আবার যদি তার মনে হয়, এই জিনিসটা তার পছন্দ নয়।  তারমানে সেটা তার পছন্দ নয়। সেই জিনিসের ওকালতি করে করে তুই মরে গেলেও সেটা তার পছন্দ নয়। ওর মতের বাইরে ওকে দিয়ে একটা কাজ করানো জাস্ট অসম্ভব। ওকে যদি কখনো বলি, "শুভ্র? বাবা এই কাজটা একটু করে দে তো।" ওর যদি কাজটা মনে ধরে তো ভালো কথা। আর ভালো না লাগলে সুন্দর করে বলবে, "এই কাজ আমার ভালো লাগে না।" ভালো লাগে না মানেই সে করবে না। তুই যদি বলিস এটা না করলে আমি মরে যাবো তবুও সে করবে না। এটা একাধারে তার ভালো এবং খারাপ অভ্যাস। এক নাম্বারে পিছলা আমার ছেলে। তোর থেকে দূরে থাকতে বলেছি সে কথা তার পছন্দ হয় নি। তাই সে আমার কথা মানবে না...এটাই তার সুন্দর এবং সহজ যুক্তি।" 

আমি নিরীহ চোখে তাকালাম। চোখ পিটপিট করে বললাম,

---" তাহলে তো উনি খুব ডেঞ্জারাস মামানি।" 

মামানি বালিশগুলো একপাশে সাজিয়ে রেখে হাসিমুখে বললেন,

---" সেটা তো আমি তোকে আগেই বলেছি। ওর এই বিহেভগুলোতে ছোটবেলায় বেশ বিরক্ত হতাম। যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে তখন স্কুলে একটা ছেলের সাথে তুমুল ঝামেলা করলো। ঝগড়ার শুরুটা খেলায় ব্যাটিং করা নিয়ে। শুভ্রর রাগ তো জানিস? রাগে ছেলেটাকে বেদরাম পেটালো। ছেলের বাবা ছিলো তৃষাল থানার ওসি। কি একটা অবস্থা ভাব? হেড স্যার আমাদের ডেকে পাঠালেন। আমি আর তোর মামু সরি টরি বলে সব ঠিকঠাক করে ওকে বলেছি "বাবা, সরি বলো।" তাহলেই মিটে যায় সব। কিন্তু সে কি বললো জানিস? সে সোজা বলে দিলো," সরি বলবো না। মা বাসায় চলো নয়তো আমি ওকে আবার মারবো।" 
এই কথা শুনে তো হেডস্যারসহ ওসি সাহেবও অবাক। আমি রাগ করে ওর গালে একটা চড় বসালাম। তোর মামু ইচ্ছেমতো বকাবকি করলো কিন্তু ছেলের এক কথা সে সরি বলবে না। তার ধারনা এখানে তার দোষ নেই। বিনাদোষে সরি বলা তার পছন্দ নয়। তাই সে সরি বলবে না। হ্যাডস্যার আদর করে বললেন, "দেখো আবরার, তুমি ওকে মেরেছো তাই তোমাকে সরি বলা উচিত। নয়তো ওর বাবা কিন্তু পুলিশ তোমায় লকাপে বন্ধী করে দেবেন।" এ কথা শুনে শুভ্র বললো, " ওর বাবা যেহেতু পুলিশ তাহলে ওর উচিত উল্টো আমায় সরি বলা। ও আমাকে বাজে গালি দিয়েছে। বইয়ে পড়েছি যারা খারাপ কাজ করে পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে শাস্তি দেয়। আর ও আমার মাকে নিয়ে বাজে কথা বলে খারাপ কাজ করেছে। পুলিশের ছেলে হয়ে বাজে  কাজ করতে পারলে  আমি ওকে মারলে সেটা দোষ কেন হবে? আমি তো একা মারি নি। ও নিজেও আমাকে মেরেছে। ও গাধা বলে আমার শরীরে লাগাতে পারে নি। এটা কি আমার দোষ? আমি সরি বলবো না। পুলিশে নিয়ে গেলেও না।" চিন্তা করতে পারছিস রোদু?দশবছরের এক বাচ্চার মুখে এতো চটাং চটাং কথা মানায়? এতো সাহস যে ওই কোথায় পায় আল্লাহ জানে।" 

মামানির কথা বলার ভঙ্গিতে খিলখিল করে হেসে ফেললাম আমি। মামানি নিজেও হালকা হেসে বললেন,

---" হাসিস না রে মা। ছেলের টেনশনে অস্থির অস্থির লাগে আমার। ওকে বিয়ে করানোর পর বউয়ের কোনো একটা কিছু পছন্দ না হলে  মারপিট শুরু করে দেবে কি না কে জানে? এটা নিয়েও চিন্তার শেষ নেই আমার।" 

আমি হাসিমুখেই বললাম, 

---" মামানি? তুমি এক কাজ করো। একটা দর্জালি মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও। দু'জনে মিলে মারামারি করবে। আহা! কি সিন!" 

মামনি চোখ ছোট ছোট করে বললেন,

---" ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওকে শোয়া থেকে ওঠে বসানো যায় না আর তুই বলছিস বিয়ের কথা? ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলবে একদম। আর যদি শুনে এই বুদ্ধি তুই দিয়েছিস তাহলে যে কি করবে.... আল্লাহ! রক্ষা করো।" 

এটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মামানি। রান্নাঘর থেকে আম্মুর চেঁচামেচি শুনে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন। আমিও মাথা চুলকে ব্যাগ থেকে ব্রাশটা বের করে পেছনের উঠোনের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বাচ্চারা উঠোন জুড়ে ছোটাছুটি করছে। সবার গায়েই নতুন জামা, চকচকে লিপস্টিক, কাজল। বড়রাও গোসল সেরেছে সেই অনেকক্ষণ আগে। একমাত্র আমিই হতভাগা ব্রাশ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বন্যা আর করোনা দুটোর জন্যই ইদের নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে মসজিদে। আমাদের বাড়ির বারান্দা থেকেই চকচকে পাকা রাস্তাটা চোখে পড়ে। সেই রাস্তা পেরিয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে মসজিদ। আমি দাঁত ব্রাশ করতে করতেই রহিজ চাচা গাছের গুঁড়ি আর দাঁ, চাকু নিয়ে উঠোনে রাখলেন। রহিজ চাচা আমাদের এখানে বছর বাঁধা কাজ করেন। শরীরের রং একদম মিশমিশে কালো। দাদু বলতেন এটা নাকি জাম কালো। ছোট ছোট পিচ্চিরাও হাত ভর্তি দশ,বিশ টাকার কচকচে নোট আর গায়ে নতুন পাঞ্জাবি আর টুপি পড়ে উঠোনে এসে দাঁড়ালো। তাদের প্রধান আকর্ষণ কোরবানি দেওয়ার জন্য এনে রাখা লালটে চামড়ার গরুটা। বন্যায় কোরবানির মাঠ ডুবে যাওয়ায় বাড়ির পেছন উঠোনেই গরু কোরবানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাড়ির পেছনে একসময় মস্ত এক কামরাঙা গাছ ছিলো। সেই ছায়াতেই ছায়াময় হয়ে থাকতো পুরোটা উঠোন। কিন্তু একবছর আগে গাছটা কেটে ফেলায় উঠোনটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা বিরহী হয়ে উঠেছে। সেই সাথে বাড়িয়ে দিয়েছে রোদের উত্তাপ। ছোট্ট বেলা আমার ঘরের জানালার পাশেই ছিলো এই গাছ। ঘুম ভেঙেই  হাজারও সবুজ কামরাঙা আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লাল- সাদা ফুল চোখে পড়তো আমার। আম্মু স্কুলে চলে গেলে সেই কামরাঙা গাছই ছিলো আমার একমাত্র খেলার সাথি। ওই গাছটাতে উঠেই গাছে উঠতে পারার প্রথম গৌরব অর্জন করেছিলাম আমি। সেগুলো আজ যত্নময় অবহেলায় মোড়া কিছু স্মৃতি মাত্র। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই আব্বু-ভাইয়াদের নামায পড়ে ফিরতে দেখা গেলো। ওদের দেখেই ঝটপট ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম শাওয়ার নিবো বলে। ইদের দিন দেরি করে গোসল করাটা আমার বাবার খুব একটা পছন্দ নয়। গোসল সেরে ইদের জামা না পরে হুট করেই সিদ্ধান্ত নিলাম শাড়ি পরবো। আম্মুর গরম চোখে ঝলসিত হয়েও মামানির সাপোর্টে লাল রঙা এক শাড়ি পরলাম আমি। ভেজা চুলগুলো খোলা রেখে পেছনের বারান্দায় গিয়ে দেখলাম রাফিয়ারা সবাই হাসাহাসি করছে। বারান্দার বাইরে উঁকি দিয়ে ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করে বললাম,

---" কি রে? হাসছিস কেন তোরা?" 

রাফিয়া আমোদিত গলায় বললো,

---" দেখ, জেঠো সব কটাকে মাংস কাটতে বসিয়ে দিয়েছে। এমনকি শুভ্র ভাইকেও।" 

আমি রাফিয়ার পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে বাইরে তাকালাম। বাইরে উজ্জ্বল রোদ তারসাথে প্রচন্ড গরমও। ছাউনির নিচেই আমাদের যা অবস্থা তো বাইরের মানুষগুলোর কি হাল কে জানে? শুভ্র ভাই পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে কোমরে গামছা বেঁধে মাংস কাটছেন। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো তার গরম যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণ। কখনো কনুই দিয়ে তো কখনো ফু দিয়ে চুলগুলো সরানোর চেষ্টা করছেন উনি। ফর্সা মুখটা রোদে আর গরমে লাল টকটকে টমেটোর মতো হয়ে গেছে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলোতে বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো যেন রোদের ঝিলিকে চিকচিক করে উঠছে। উনার এই শোচনীয় অবস্থা দেখে হালকা খারাপ লাগলেও হাসি পেলো ব্যাপক। মুচকি হেসে নিজের মনে আওড়ালাম, বাহ্! কাটাকাটিও তাহলে করতে পারে মহাশয়। 

কিছুক্ষণ মাংস কাটাকাটি করে ঘেমে নেয়ে সব কটা এক এক করে উঠে এলো। একে একে সবার থেকে কেড়ে, মেরে, খাঁমচিয়ে হলেও সালামি নেওয়া হলো। আলিফ ভাইয়াকে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে সালামি নেওয়া হলো। কিন্তু শুভ্র ভাইয়ের কাছে আটকে গেলো সবাই। শুভ্র ভাইকে মারার কলিজা তো নাই-ই কারো। তারসাথে ব্ল্যাকমেইল করার মতোও কিছু খুঁজে পেলো না কেউ। শুভ্র ভাইয়ের থেকে সালামি নিতে পারা নিয়ে রীতিমতো বাজি লেগে গেলো। সেই বাজি রক্ষা করতে গিয়েই শুভ্র ভাইয়ার কাছে সালামি চাইলাম আমি। উনি আড়চোখে আমার দিকে তাকালেন। সটান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

---" সালাম কর। তোর সালাম যদি আমার পছন্দ হয় তাহলে সালামি পাবি নয়তো না।" 

আমি অবাক হয়ে বললাম,

---" সালাম কেন করবো? এখন আর সালামি পেতে সালাম করতে হয় না। দিন বলছি..." 

---" এমনভাবে দিন দিন বলছিস যেন আমার পকেটে তোর টাকা রেখেছিস। চাওয়া মাত্র দিয়ে দিতে আমি বাধ্য।" 

আমি কপাল কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললাম, 

---" এতো কিপ্টা কেন আপনি? ছোট ছোট বোনদের এক্টু সালামি দিতে পারেন না? কিপ্টুস!" 

---" আমি তো বলি নি দিবো না। অবশ্যই দিবো। তার  আগে সালাম কর। সালাম না করে সালামি নিয়ে যাবি তা তো হতে পারে না। আমি খুব স্বচ্ছ মানুষ স্বচ্ছভাবে বলছি। সালাম কর সালামি নে। ব্যস!" 

আমি রাগী চোখে তাকিয়ে বললাম, 

---" করবো না সালাম।" 

---" তাহলে টাকাও পাবি না।" 

কথাটা বলেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন উনি। আমি তেঁতে উঠে বললাম, 

---" জীবনেও বউ পাবেন না আপনি। আপনার মতো মানুষ তো বউকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিবে। আল্লাহ! রহম করো সেই রমনীকে। আমিন!" 

শুভ্র ভাই হেসে ফেললেন।  মাথাটা একটু উঁচু করে মাথার নিচে হাতদুটো রেখে বললেন, 

---" শুভ্রর কাছাকাছি আসবে অথচ জ্বলবে না তা তো হয় না। তবে তুই একটু ভুল বললি। শুধু জ্বালাবো এটা ভুল। বউকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই ছাই করে দেওয়ার প্ল্যান আমার। আর শকুনের দোয়ায় গরু মরে না, জানিস তো? তেমনি তোর দোয়াতেও আমার বউ পাওয়া আটকাবে না। বউতে আমি পাবোই... সেটা তুই দোয়া করলেও আর না করলেও। এখন বেশি কথা না বলে সালাম কর নয়তো ফুট।" 

আমি অধৈর্য গলায় বললাম, 

---" দেখুন! সালামি দেন বলছি নয়তো ব্যাপারটা ভালো হবে না।" 

উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, 

---" দিন দিন গুন্ডি হয়ে যাচ্ছিস তুই। সালাম না করে চাঁদাবাজি করার চেষ্টা করছিস। এই তোর বাপ না হাজী মানুষ? তুই যে এভাবে চাঁদাবাজী করিস সেটা শুনলে তো তোর বাপ ডিরেক্ট উপরে চলে যাবে।" 

আমি কোমরে হাত রেখে বললাম,

---" খবরদার বাবাকে নিয়ে কিছু বলবেন না।" 

---" আশ্চর্য! কথায় কথায় এমন ধমকি দিচ্ছিস কেন তুই? যাহ্ তোর বাপকে নিয়ে কিছু বললাম না। তো তোর শশুড়কে নিয়ে কিছু বলবো?" 

---" আপনি আসলেই একটা অসহ্য। মেয়েদের মতো এতো লেগে লেগে ঝগড়া করেন কেন শুনি?" 

উনি এবার ওঠে বসলেন,

---"আমি কই লেগে লেগে ঝগড়া করছি? আমি কি তোর বাপের মতো বহুদা ঝগড়া করি?" 

---" আবার বাবাকে টানছেন!" 

---" ওপস্ সরি। যা বাপ ক্যান্সেল। আমি কি তোর শশুড়ের মতো বেহুদা ঝগড়া করি?" 

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, 

---" আমার শশুড়কে নিয়েই বা আপনার এতো জ্বালা কেন শুনি? একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না।" 

উনি বাঁকা হেসে বললেন,

---" বাহ্!  আমার থেকে আমার বাপের প্রতি তোর দরদই বেশি দেখি।" 

আমি কনফিউজড হয়ে চোখ কুঁচকালাম,

---" মানে? কি বললেন আপনি?" 

---" বললাম, লাল শাড়ি পরে বউ বউ ভাব নিয়ে আমার চোখের সামনে ঘুরঘুর করছিস কেন? পরে ভুলে বউ মনে করে নিলে তো ঝামেলা। বাপের মতোই ধাপ্পাবাজ হয়েছিস। আমাকে ডিস্ট্রেক্ট করার চেষ্টা চালাস অলওয়েজ।" 

আমি এবার আর রাগ ধরে রাখতে পারলাম না। চেঁচিয়ে ওঠে বললাম, 

---" আপনি আবার বাবাকে বাজে কথা বলছেন। আমার কিন্তু এখন প্রচন্ড রাগ লাগছে। মামামি? মামানি? মামানি তুমি কই?" 

---" আরে! কথায় কথায় ম্যা ম্যা করিস কেন? একবার আম্মু তো আবার অন্যের আম্মু। তো..." 

উনার কথার মাঝেই মামানি এসে বললেন,

---" ঘরটাকে বাজার বানায় ফেলছিস। চেঁচাচ্ছিস কেন?" 

---" মামানি দেখো তোমার ছেলে আমায় সালামি দিচ্ছে না। তারওপর উল্টাপাল্টা কথা বলছে।" 

মামানি সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,

---" শুভ্র? ওকে সালামি দিচ্ছিস না কেন?"

শুভ্র ভাই বিছানায় বসে পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে বললেন,

---" ও যদি আমার কাছে টাকা চাইতো তো দিয়ে দিতাম। কিন্তু ও তো টাকা নয় সালামি চেয়েছে তারজন্য আগে সালাম করতে হবে না? আগে সালাম করুক তারপর টাকা। আম্মু তুমি যাও তো...ওর সাইড নিয়ে কথা বলবা না একদম। সালাম ওকে করতেই হবে।" 

মামানি বিরক্ত হয়ে বললেন,

---" তোরা পারিসও বটে। বিরক্ত করে ফেলিস একদম।" 

এরমধ্যেই মামানির ডাক পড়লো। ভেতরের বারান্দায় সবাই খেতে বসেছে। মামানি আমাদের রেখে তাড়াহুড়ো করে বারান্দায় চলে গেলেন। শুভ্র ভাই আয়েশ করে বসে আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালেন,

---" করবি না সালাম? শাড়ি যেহেতু পরেছিস সালাম তো তোকে করতেই হবে। আমি সালামি না দিলেও এখন তোকে সালাম করতে হবে। সালাম না করে রুম থেকে এক পা বের হলে খবর আছে।" 

আমি মুখ ফুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে নিতেই আঁচলের কোণা ধরে আটকালেন উনি। শাড়ির আঁচলের কোণাটা নিজের অনামিকা আঙ্গুলে শক্ত করে বেঁধে ফোন নিয়ে বসে  পড়লেন। আমি শাড়ির আঁচল টেনে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। মাঝে মাঝে আঁচল রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছি। উনি ফোন স্ক্রল করতে করতে বললেন,

---" অযথা লেইট না করে সালাম কর। তাহলেই ছেড়ে দিবো তোকে। নয়তো এখানেই বসে থাক। কেউ এসে দেখলে বলবো সব দোষ তোর।" 

আমি রাগে অভিমানে সালাম করার জন্য এগিয়ে গেলাম। উনি আমার মতিগতি বুঝতে পেরেই সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। আমি অস্বস্তি নিয়ে নিচু হয়ে উনার পা ছুঁতেই আমার মাথায় হাত রাখলেন উনি। হেসে ফেলে বললেন,

---" স্বামী সোহাগী হও রোদপাখি। তোমার বর তোমাকে জ্বালাময় ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলুক।" 

উনার কথায় রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ওঠে দাঁড়ালাম। উনি চোখ টিপে বললেন, 

---" আমার দোয়া তোর দোয়ার মতো ঠুনকো নয়। অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবে দেখিস।" 

আমি কিছু না বলে রাগ নিয়ে আঁচলটা ছাড়াতে নিতেই উনি নিজেই খুলে দিলেন আঁচলের বাঁধন। রাগে তখন চোখ দুটো টলমল করছে আমার। সেই টলমলে চোখ নিয়ে রুম থেকে বেরুতে নিলেই হাতটা টেনে ধরলেন উনি। আমি হাত মুচড়ামুচড়ি করতেই হেসে উঠলেন উনি। ভরাট গলায় বললেন, 

---" তোমার দুপুর সকালটা কে
করো সঠিক ভাগ
আমার জন্য কখন কখন
করবে তুমি রাগ ।

তোমার রাগের সময়টুকু
খুব ই ভালো লাগে
নরম কোমল স্বর্ণ ঘাম
নাকের অগ্রভাগে ।

রাগের সময় মুখটা তোমার
আমার দিকে ফিরে
কি যেন সব বলতে থাকে
খুব ই ধিরে ধিরে ।

রাগের সময় কাঁচের চুড়ি
ভাঙে তোমার হাত
তখন আমার সপ্নে আসে
শুধুই বাসর রাত ।

রাগলে যাদের মন্দ লাগে
তুমি তেমন নয়
তোমার আমার জীবনটা তাই
হোক না রাগময় ।" 
                     ----  collected 

উনার কথায় রাগ ভুলে লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম আমি। উনি শক্ত হাতে আমার হাত ধরে রাখায় রুম থেকে বেরুতেও পারছিলাম না আর না পারছিলাম উনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। উনি পেছন থেকেই ডানহাতে কিছু একটা গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন,

---" এবার যেতে পারেন ম্যাডাম।" 

কথাটা বলে আমাকে ছেড়ে বিছানায় বসে পড়লেন উনি। আমি ধীর পায়ে দু'পা এগিয়ে গিয়েই এক দৌঁড়ে পাশের রুমে গিয়ে দরজা দিলাম। বুকটা কেমন ধরফর করছে আমার। হাত-পা অল্পবিস্তর কাঁপছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখের ঘামটা মুছে নিয়ে ফ্যানের সুইচটা অন করেই বিছানায় গিয়ে বসলাম আমি। মুঠো করে রাখা ডানহাতটা চোখের সামনে আনতেই চোখে পড়লো চকচকে এক হাজার টাকার নোট। এতো টাকা দেখে আমি চোখ বড়বড় করে তাকালাম। টাকাটা উল্টাতেই চোখে পড়লো সাদা কাগজ। কাগজটা টাকার সাথে স্ট্রেপ্লার দিয়ে লাগানো। তাতে ছোট ছোট করে লেখা, 

"শুভ্রর বাবার বউমাটা একটু বেশিই লাজুক......টাকাটা যে তার জন্যই বরাদ্দ ছিলো। সালাম না করলেও যে টাকাটা সেই পেতো তা না শুনেই দৌঁড়ে পালালো। এভাবে শাড়ি পরে চোখের সামনে ঘুরঘুর করে মাথা নষ্ট করার অপরাধে এইটুকু শাস্তি কি তার প্রাপ্য নয়?"

১৯

ইদের আমেজ শেষ। এবার গ্রাম থেকে বাড়ি ফেরার পালা। কিন্তু বাড়ি ফেরার আগে আমার মহান বাবার মহান কাজ হলো মেজো বোনের বাড়িতে কোরবানির মাংস পৌঁছে দেওয়া। আমার বাবারা ছয় ভাইবোন। তিনবোন আর তিনভাই। ছোট ফুপি আর মেজো ফুপি ইদটা আমাদের সাথে গ্রামে কাটালেও বড় ফুপি রয়ে গেছেন সেই জামালপুরেই। মিথি আপুর বিয়ের পর এটাই তাদের প্রথম ইদ। মেয়ে জামাইকে রেখে বাপের বাড়িতে ইদ করা কি সাজে ফুপির? তাই বাধ্য হয়ে আমাদেরই ছুটতে হলো জামালপুরে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, আজকের রাতটা সেখানে থেকে পরেরদিন ট্রেন ধরে চলে যাবো ময়মনসিংহ। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। টোপলা-টোপলি বেঁধে আমরাও ছুটলাম জামালপুরে। কাকিমণির পেছনে ঘ্যানঘ্যান করে রাফিয়া আর রাতুল ভাইয়াও এসে পৌঁছালেন আমাদের সাথে। জামালপুরে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া শেষে ছেলেরা গিয়ে বসলো বাড়ির উঠোনে। প্লাস্টিকের চেয়ারগুলো সারি বেঁধে সাজিয়ে গোল হয়ে বসলো তারা। আর আমরা বসলাম বারান্দায়। রাত তখন আটটা কি নয়টা বাজে। বারান্দা আর বাইরের লাইটগুলো অফ করে ঝাপসা অন্ধকারে চন্দ্রবিলাসে ব্যস্ত আমরা। দু'পক্ষেই হাসি-ঠাট্টা চলছে তাদের নিজস্ব গতিতে। হঠাৎই ছেলেদের মাঝে একটা চাপা গুঞ্জন শোনা গেলো। সেই গুঞ্জনকে থামিয়ে দিয়ে বিরহী গলায় গেয়ে উঠলেন আলিফ ভাইয়া,

---" খুব জানতে ইচ্ছে করে
খুব জানতে ইচ্ছে করে
তুমি কি সেই আগের মতই আছো
নাকি অনেকখানি বদলে গেছ।।

এখনো কি প্রথম সকাল হলে
স্নানটি সেরে পূজার ফুল তুলে
পূজার ছলে আমারই কথা ভাবো
বসে ঠাকুর ঘরে।।"

আলিফ ভাইয়ার গানের মাঝেই সন্দেহী গলায় বলে উঠলেন শুভ্র ভাই। 

---" কাহিনি কি রে? এতো বৈরাগী হচ্ছিস কেন? ছ্যাকা ফ্যাক্ট নাকি?"

আলিফ ভাইয়া জবাব দিলেন না। আলিফ ভাইয়াকে চুপ থাকতে দেখে আবারও প্রশ্ন করলেন শুভ্র ভাই,

---" টু মাচ পার্সোনাল? তাহলে স্কিপ করে যা।" 

শুভ্র ভাই "স্কিপ" করার কথা বললেও কারো মাঝে কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। সবাই ঝিম ধরে বসে আছে। চাঁদের আলোর সাথে সাদা বেদনায়  মাখামাখি হচ্ছে সবার বুক। কিছুক্ষণ নিরব থেকে মৃদু গলায় বলে উঠলেন আলিফ ভাইয়া, 

---" আমার কিছু ভালো লাগছে না শুভ্র ভাই। অনিমা যে ছোট্ট একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে আমাকে ছেড়ে দিবে চিন্তায় করতে পারি নি আমি। ওকে আমি অনেক বুঝিয়েছি, অনেক রিকুয়েষ্ট করেছি কিন্তু ও শুনলোই না। তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে রাগারাগি করে আমাকেই ছেড়ে দিলো। আমি ওকে প্রচন্ড ভালোবাসি শুভ্র ভাই। প্রচন্ড।" 

শুভ্র ভাই কিছু বললেন না। পাশ থেকে অদুদ ভাইয়া বললেন,

---" তুইই যা কষ্ট পাচ্ছিস আলিফ। অনিমা তো ঠিকই নতুন বয়ফ্রেন্ড নিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। ফেসবুকে নিয়মিত নিব্বা-নিব্বিমার্কা পোস্ট মারছে। ওই মেয়ের মধ্যে কি এমন পাইছিস বল তো? এই মেয়েকে দেখলেই তো আমার থার্ডক্লাস গালি দিতে মন চায়।" 

---" প্লিজ ভাইয়া। এভাবে বলবে না। ওকে আমি ভালোবাসি তো বাসি। ভালোবাসতে কোনো কারণ লাগে না। ওকে আমি এমনিই ভালোবাসি।" 

শুভ্র ভাই এবার নড়েচড়ে বসলেন। চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে বসে বললেন,

---" এসব কাব্যিক কথা বন্ধ কর আলিফ। এসব শুধু উপন্যাসের পাতাতেই সত্য। রিয়েলিটি কি জানিস? বাবা-মা ছাড়া এই পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ বিনা কারণে কাউকে ভালোবাসে না। অনেকে তাদের প্রেমিকা বা অর্ধাঙ্গিনীকে প্রচন্ড ভালোবাসে কিন্তু এর পেছনে কারণ থাকে। কারণহীন ভালোবাসা শুধু দুর্লবই নয় অনেকটা অসম্ভব। আমরা প্রতিদিন অসংখ্য মেয়ের সংস্পর্শে আসি। রাস্তা-ঘাটে অনেককেই চোখে পড়ে কিন্তু এতো এতো মেয়ের মাঝে একজনের প্রেমেই পড়ি এবং একজনকেই চাই। এর কারণ কি? আমরা যদি বিনা কারণেই ভালোবাসি তাহলে সবার প্রেমে পড়ি না কেন? একটা মানুষের রূপ, গুন, কথাবার্তা বা এটিটিউট কোনো একটা কিছুতে মুগ্ধ হয়েই ভালোলাগার সৃষ্টি হয়। সেই ভালোলাগা থেকে তার প্রতি আকর্ষনের সৃষ্টি হয়। তার কাছাকাছি থাকার একটা সুপ্ত তাড়না বুকে ধাক্কা দেয়। তারসাথে মিশতে মিশতে। তার সাথে সময় কাটাতে কাটাতে ধীরে ধীরে তার সবকিছুই আমাদের ভালো লাগতে থাকে। তখন এমন একটা অবস্থা হয় যে, তুই যে কারণটার ওপর ভিত্তি করে প্রেমে পড়েছিলি সেটা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলেও তুই মানুষটাকে ভালোবাসছিস কেননা ভালোবাসাটা তখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু হুট করে প্রথম দেখেই নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে জীবন উজাড় করে দেওয়াটা সত্য নয়। মানুষের ভালোবাসা যদি এতোটাই নিঃস্বার্থ হতো তাহলে "ভাঙন" নামক শব্দটা পৃথিবীতে থাকতো না। মানুষ নিজের প্রয়োজন মেটাতেই অপরজনকে ভালোবাসে।"

আলিফ ভাইয়া দ্বিধান্বিত চোখে তাকালেন। মুখ কাঁচুমাচু করে প্রশ্ন করলেন,

---" তাহলে তুমি? তুমিও কি ভালোবাসো না? শুধুমাত্র প্রয়োজনের জন্য?"

শুভ্র ভাই বিরক্ত গলায় বললেন,

---" আরে,ছাগল। ভালোবাসি না কখন বললাম? আমি তাকে ভালোবাসি বলেই তাকে আমার প্রয়োজন। যা বুঝাতে চাইছি তা বুঝ। তুই যে বললি, ভালোবাসতে কারণ লাগে না এটা ভুল। অনেকেই বলে, ভালোবাসা অনুভূতির বিষয়। ভালোবাসতে কারণের প্রয়োজন হয় না বিষয়টা সত্য নয়। আমরা যেকোনো একটা কারণের উপর ভিত্তি করেই অন্যকে ভালোবাসি। সেটা যেকোনো কিছু হতে পারে। রূপ, এটিটিউট, গলার টুন ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর ধীরে ধীরে সংকীর্ণ ভালোলাগাটার বিস্তার হয় এবং মানুষটির সাথে যুক্ত সবকিছুই ভালোলাগতে থাকে। কিন্তু কারণ একটা থাকেই। কিছু কিছু মানুষ নিজের ভালোলাগার বিষয়গুলো নিয়ে নিজেরাই ক্লিয়ার নয় বলে নিজের অজ্ঞতা ঢাকতে বিষয়টাকে অসম্ভবের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।" 

আলিফ ভাইয়া কৌতূহলী গলায় বললেন,

---" তাহলে তোমার ভালোবাসার পেছনের কারণটা কি শুভ্র ভাই।" 

শুভ্র ভাই হাসলেন,

---" এখন তো ওর সবকিছুই ভালো লাগে। তবে ভালোলাগার একটা মৌলিক কারণ অবশ্যই আছে। তবে, সেই কারণটা তোদের বলা যাবে না।" 

আলিফ ভাইয়া আর কথা বাড়ালেন না। তবে, রাফিয়া এক লাফে আমাকে ডিঙিয়ে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালো। উৎফুুল্ল হয়ে বলে উঠলো, 

---" 'এখন তো ওর সবকিছুই ভালো লাগে।' এখানে এই 'ও' টা কে? জাতি জানতে চায়। বলুন...বলুন।"

শুভ্র ভাইয়ের মুখে ভাবান্তর দেখা গেলো না। উনি ভ্রু 
বাঁকিয়ে একবার রাফিয়ার দিকে তাকালেন। পাশ থেকে রাতুল ভাইয়া ধমকে উঠে বললেন, 

---" জাতি কিছু জানতে চায় না। থাপড়া না খেতে চাইলে চুপচাপ বস।" 

রাফিয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বললো, 

---" তুই সবসময় আমাকে ধমকাস কেন ভাইয়া? বাড়িতে একবার পৌঁছোতে দে শুধু, আব্বাকে যদি তোর গার্লফ্রেন্ডের কথা না বলছি। তুই যে সিগারেট খাস ওইটাও বলবো।" 

রাতুল ভাইয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন,

---" বল গা যা। তোর এফবি পাস এখনো আমার কাছে আছে। পাস চেঞ্জ করে দিলেই কি? স্ক্রিনশটগুলো একদম সিকিউর করে রেখে দিয়েছি। আমিও আম্মাকে দেখাবো যে তার মেয়ে কোন ধরনের পোলাপানের সাথে কোন ধরনের চ্যাটিং করে।" 

রাফিয়া এবার ধমে গেলো। চুপচাপ আমার পাশে এসে বসে পড়লো। তার প্রচন্ড দুঃখ দুঃখ অনুভূতি হচ্ছে। প্রথমত, শুভ্র ভাইয়ের "ও" নামক রহস্য সমাধান করতে পারলো না। দ্বিতীয়ত, এতোগুলো মানুষের সামনে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর, মিলাদ ভাইয়া আগের  কথার রেশ টেনে নিয়ে বললেন,

---" ওসব বাদ দে। আগে আমাদের আলিফের ডিপ্রেশন কিভাবে কমানো যায় তাই ভাব। কি রে আলিফ? নতুন গার্লফ্রেন্ড লাগবে? আমাদের জামালপুরে কিন্তু মেয়ের অভাব নেই।" 

মিলাদ ভাইয়ার কথায় সবাই হাসলেও আলিফ ভাইয়া চুপ করে বসে রইলেন। শুভ্র ভাই ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সামনের দিকে ঝুঁকে বসলেন। গম্ভীর গলায় বললেন,

---" দেখ আলিফ? এতো ডিপ্রেশড হওয়ার কিছু নেই। একটা সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার জন্য দুটো মানুষকে সমান শ্রম দিতে হয়। তুই একা একা আর কতো টানতি, বল? অনিমা কেমন মেয়ে ছিলো সেটা আমি যাচাই করতে যাচ্ছি না। আমার মতে, সব মেয়েই ভালো কিন্তু সবার জন্য সবাই সঠিক চয়েজ নয়। অনিমা হয়তো তোর জন্য পার্ফেক্ট চয়েজ ছিলো না। তাই এই পরিণতিটা যত তাড়াতাড়ি এসেছে সেটা তোর জন্য ততটাই ভালো হয়েছে। অনিমার পেছনে সময়, টাকা সবই প্রচুর পরিমাণে উড়িয়েছিস তুই। ওকে কিভাবে খুশি করা যায়, ওর প্রয়োজন কিভাবে মেটানো যায়, ওর থেকে নিজের দুর্বলতাগুলো কিভাবে লুকানো যায় এসব নিয়েই পড়ে থেকেছিস সবসময়। কিন্তু সত্যিই কি এটাকে ভালোবাসা বলে? একটা মানুষকে কনটিনিউয়াসলি 
সুখী করার চেষ্টাকে ভালোবাসা বলে না। দু'জন মিলে সুখী হওয়ার চেষ্টাকে ভালোবাসা বলে। যাকে ভালোবাসা যায় তার কাছে এতো সংকোচ, এতো ভয় থাকে না আলিফ। মানুষ ভালো থাকতে চায় বলেই ভালোবাসে। ভালোবাসাটা যখন মাথায় বোঝ হয়ে যায় তখন সেটা আর ভালোবাসা থাকে না। যার সামনে যাওয়ার আগে তাকে খুশি করার বা ইমপ্রেস করার জন্য হাজার ভাবনা ভাবতে হবে না, নিজেকে বেস্ট প্রমাণ করার জন্য হাজারো প্ল্যান সাজাতে হবে না তাকেই তুই সত্যিকারে ভালোবাসিস। যার কাছে তোর দুর্বলতাগুলো, তোর কষ্টগুলো লুকাতে হবে না সেই-ই হবে তোর ভালোবাসা। যে মেয়ে তোকে ভালোবাসবে তাকে কখনো গিফ্ট দিয়ে খুশি করতে হবে না। তোকে এক ঝলক দেখতে পেলেই অটোমেটিক খুশি হয়ে যাবে সে। যার চোখের দিকে তাকিয়ে নির্ভয়ে চিন্তা করতে পারবি, "হ্যাঁ। এই মেয়েটা শেষ পর্যন্ত তোর।" ভালোবাসা একটা প্রশান্তির নাম, আতঙ্কের নাম নয় রে। তাকে এটা/ওটা গিফ্ট না করলে আমায় ছেড়ে চলে যাবে এই উদ্ভট চিন্তাটা ভালোবাসায় আসবে কেন? শোন, মেয়েরা প্রচন্ড ভালোবাসতে জানে। শুধুমাত্র নিজের মনের মতো কাউকে খুঁজে নিতে হয়। হাজারের মধ্যে বেস্ট কাউকে নয়। শুধুমাত্র তোর জন্য বেস্ট কাউকে খোঁজ। সারাদিন বাবু,বেবি, ভালোবাসি বলে চেঁচালেই তা সত্যিকারের ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসাটা অনুভূতির বিষয়। যে অনুভূতি মুখে না বললেও অপরজনকে বুঝিয়ে দিবে তাকে তুই চাইছিস। তাকে ছাড়া তোর চলছে না। অনিমার সাথে ছয়মাসের রিলেশনে কখনো মনের শান্তিটা পেয়েছিলি? সারারাত ফোনে কথা বললেই কি শান্তি পাওয়া যায়? যায় না। তোর অসুস্থতায়  বাবু, বেবি বলে চেঁচিয়ে করা নাটকীয় চিন্তার চেয়ে অপর পাশের মানুষটির মুখ কালো করে চুপ করে থাকাটা যে কতোটা প্রশান্তির তোরা সেটা এখনও অনুভবই করতে পারিস নি। এতোকিছুর পরও যদি মনে হয়, অনিমার দুঃখে তোর সিলিং এ ঝুলে পড়া উচিত। তাহলে ঝুলে পড়তেই পারিস। কিন্তু, ঝুলে পড়ার পর তোর সবচেয়ে বড় আক্ষেপ কি থাকবে জানিস? এই ক্ষুদ্র জীবনে শুধুমাত্র তোর জন্য বরাদ্দকৃত চমৎকার মানুষটিকে তোর পাওয়া হলো না।" 

এটুকু বলে উনি থামলেন। এতোক্ষন সবাই মহোন্নত হয়ে উনার কথাগুলোই শুনছিলেন। উনার কথায় এমন কিছু ছিলো যা ঘুরে ঘুরে বারবারই কানে এসে লাগছিলো। প্রতিটি শব্দ যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিলো,"সত্যিই তাই"  সবার এই নীরবতা ভেঙে ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন মিথিলা আপুর হাজবেন্ড চয়ন ভাইয়া। শুভ্র ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

---" ডোন্ট মাইন্ড শুভ্র। বাট এখন রাফিয়ার মতো আমারও জানতে ইচ্ছে করছে যে তোমার রমনীটা কে?মাস্ট বি,  শী ইজ আ লাকি গার্ল।" 

শুভ্র ভাই হাসলেন,

---" কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আমি আর সে দু'জনেই বিশ্বাস করি, 'মাস্ট বি, শী ইজ এন আনলাকি গার্ল।'

চয়ন ভাইয়া ভ্রু কুঁচকালেন। অবাক হয়ে বললেন, 

---" কেন?" 

---" কারণ? আমি আমার ফ্রেন্ডদের সাথে একরকম, কাজিনদের সাথে একরকম, ফ্যামিলির সাথে একরকম এবং ওর সামনে টোটালি ভিন্ন রকম।" 

চয়ন ভাইয়া কপাল কুঁচকে বললেন,

---" ধুর মিয়া। বার বার 'ও' 'ও' না বলে নামটা বলে দিলেও তো পারো। আলিফ,অদুদ, রাতুল এদের কথা শুনে মনে হয় ওরা সবই জানে তাহলে বোন এবং বোন জামাইদের কেন বঞ্চিত করছো?" 

অদুদ ভাই ফোঁড়ন কেটে বললেন,

---" বোনদের পেট পাতলা আর বোনের জামাইদের পকেট পাতলা। এসব পাতলা-পুতলা মানুষদের সিকরেট কিছু বলা চলে না চয়ন ভাই। তবে, পাতলাগিরি কমিয়ে শালাদের পেট ভরানোর ব্যবস্থা করলে আমার গার্লফ্রেন্ডের নামটা বলেও দিতে পারি।" 

চয়ন ভাইয়া হেসে বললেন, 

---" তোমার গার্লফ্রেন্ডের নাম ট্রিট দিয়ে জানতে হবে?  মিথিকে যেদিন দেখতে গিয়েছিলাম সেদিনই তো জেনে গিয়েছি।" 

অদুদ ভাই অবাক চোখে তাকালেন। বিস্মিত কন্ঠে বললেন,

---" আমার প্রেম কাহিনি যে গলিতে গলিতে প্রচারিত হয় এটা তো জানা ছিলো না। শালার কপাল, মহল্লায় ভাই ভাই বললে কি হবে? ভাই-বোনদের কাছেই তো ইজ্জত পাইলাম না।" 

অদুদ ভাইয়ার কথায় আবারও হেসে উঠলো সবাই। চয়ন ভাইয়া আবারও আগের কথার রেশ ধরে বললেন, 

---" শুভ্র? শালামশাই? বোন আর বোনজামাইদের এভাবে অধিকার বঞ্চিত করতে পারো না তুমি। এটলিস্ট নাম তো বলো।"

শুভ্র ভাই এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকালেন। আমিও নিচের ঠোঁট কামড়ে নিঃশ্বাস আটকে বসে রইলাম। উনি আমার নাম বললেই কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। টেপ রেকর্ডার রাফিয়া দুই মিনিটে সারা দুনিয়ায় ঢোল পিটিয়ে নিজ দায়িত্বে খবর পৌঁছে দেবে। শুভ্র ভাই গম্ভীর মুখেই বললেন, 

---" বোনেরা আমার জন্য খুব স্পেশাল চয়ন ভাই। বোনের জামাইরা তো স্পেশাল স্কয়ার। এই এতো এতো স্পেশাল মানুষদের কি যেনতেন সময়ে কিছু বলা যায়? তাদের জন্য স্পেশাল সময়ের অপেক্ষায় থাকতে হয়। আমিও তাই আছি। আমার লাইফের সবচেয়ে স্পেশাল দিন হবে, প্রথমত বিয়ের দিন। দ্বিতীয়ত, বাবা হওয়ার দিন। তাই ভাবছি একটু কষ্ট হলেও বিয়ে অব্দি ওয়েট করি। কি আর করা? বোনদের তো একটা রেসপেক্ট আছে নাকি? আর বোন জামাইদের জন্য আরো ভালো পরিকল্পনা আছে। বিয়েটা করি। বাচ্চাকাচ্চা হোক। বাচ্চার জন্মদিনে সব দুলাভাইকে বাচ্চার মার নামটা জানিয়ে দিবো ইনশাআল্লাহ।" 

শুভ্র ভাইয়ের কথায় হোহো করে হেসে উঠলো আলিফ- রাতুল ভাইয়ারা। তাদের হাসির মাঝেই, ভাইয়ার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠলেন অদুদ ভাইয়া,

---" রাহাত ভাই? তুমিও একটু প্রাণ খুলে হাসো। " 

ভাইয়া অদুদ ভাইয়ার পেটে গুঁতো দিয়ে দাঁত বের করে বললেন,

---" এই নে হাসলাম।" 

কথাটা বলেই ঝাপসা অন্ধকারে একবার আমার দিকে তাকালো ভাইয়া। সাথে সাথেই ওঠে দাঁড়ালাম আমি। এই সম্পর্কে ভাইয়া কিছু জানে কি না তার বিন্দুমাত্র ধারনা আমার নেই। তবুও সারা শরীরে যেন বিশ্রী অস্বস্তি ভর করলো আমার। শরীর খারাপের বাহানা দিয়ে দ্রুত তার চোখের আড়াল হলাম। আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে বিছানায় গা এলিয়ে  মুখে বালিশ চেপে পড়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর ঝড়ের গতিতে রুমে ঢুকলো রাফিয়া। একটানে মুখের ওপর থেকে বালিশটা সরিয়ে নিয়ে বললো,

---" ওই? ঘুমিয়েছিস? চয়ন ভাইয়া সবাইকে খাওয়াবে। চল জলদি..." 

আমি হালকা গলায় বললাম,

---" তোরা খা। আমি খাবো না।" 

রাফিয়া আমার ডানহাত টেনে ধরে বললো,

---" কেনো খাবি না? চল জলদি।"

এবার বেশ বিরক্ত হলাম আমি। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বললাম,

---" উফ! বললাম তো খাবো না। সর না প্লিজ....আমি ঘুমুবো। তোরা গিয়ে খা।" 

কথাটা বলে আবারও বালিশ দিয়ে মুখ ঢাকলাম  আমি। রাফিয়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকেই একরকম ছুঁটে বেরিয়ে গেলো।  আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে করতে ঘুমটা যখন চোখে ধরা দিবে দিবে এমন সময় দরজায় তুমুল শব্দ তুলে ভেতরে ঢুকলো কেউ। মুখ থেকে বালিশটা সরিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকাতেই ছোট ছোট পায়ে দৌড়ে বিছানায় ওঠে এলো আদিবা। আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,

---" এখনও ঘুমুও নি তুমি? আর হাতে এগুলো কি? কে দিলো?" 

আদিবা হাতে রাখা পলিথিন ব্যাগটা আমার পাশে রাখলো। তাতে দুটো আইসক্রিম আর একটা চানাচুরের প্যাকেট। পলিথিনটা পাশে রেখেই আবারও ঝটপট বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো  আদিবা। 

---" কি ব্যাপার? কোথায় যাচ্ছো? এগুলো রেখে যাচ্ছো কেন?"

আদিবা যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। যেতে যেতে বললো,

---"ওটা দাদাভাই দিয়েছে। বলেছে, রোদাপু খাবে।"

আমি অসহায় মুখ নিয়ে আদিবার যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলাম। আদিবা দরজার আড়াল হতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে পলিথিনটির দিকে তাকালাম। আমার কাঁচা ঘুম ভেঙে আইসক্রিম, চানাচুর খাওয়ানোর মতো মহান কাজ সম্পন্ন করার জন্য লোকটিকে কি করা উচিত? অবশ্যই ব্রহ্মপুত্র নদে চুবানো উচিত। 

একঘন্টার মাথায় রাফিয়া আর আপু এসে শুয়ে পড়লো বিছানায়। আমি বিছানায় কিছুক্ষণ  এপাশ-ওপাশ করে ওঠে বসলাম। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম নেটওয়ার্কের অবস্থা খুবই বাজে। বিছানা থেকে নেমে রুমের পেছনের দরজাটা হালকা খুলে দরজার কোণায় গিয়ে বসলাম। আমার থেকে একটু দূরেই লাইটের আলোর নিচে বসে আছেন শুভ্র ভাই, চয়ন ভাইয়া, আলিফ ভাইয়া, অদুদ ভাইয়া আর রাতুল ভাইয়া। ওদেরকে দেখতে পেয়ে ফোনের আলোটা নিভিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। এরই মধ্যে বলে উঠলেন চয়ন ভাইয়া,

---" এটলিস্ট তোমার লাভ স্টোরিটা  তো আমাদের শোনাও শুভ্র।" 

শুভ্র ভাই হেসে বললেন,

---" আমার কোনো লাভ স্টোরি নেই চয়ন ভাই।" 

চয়ন ভাইয়া বাঁকা চোখে তাকালেন। অবিশ্বাস্য সুরে বললেন,

---" প্রেম করো অথচ লাভ স্টোরি নাই? এটা কেমন কথা হলো শালামশাই?"

শুভ্র ভাই হেসে ফেললেন। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললেন,

---" আমি প্রেমও করি না। এদের সবকটাকে জিগ্যেস করুন। আমাদের কাজিনদের জীবন্ত নিউজবোর্ড রাফিয়াকেও জিগ্যেস করতে পারেন। তাছাড়া, আপনিই বলুন... কখনো আমাকে ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে কথা বলতে দেখেছেন? ঘন্টার পর ঘন্টা ম্যাসিজিং করতে দেখেছেন? প্রেমে করার মতো কোনো লক্ষ্মণ কি চোখে পড়েছে আপনার?" 

চয়ন ভাইয়া কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, 

---" ব্যাপারটা নিরাশাজনক হলেও এমন কিছু চোখে পড়ে নি আমার। ভাবছি, একটা হ্যাকারের সাথে কন্ট্রাক করবো। তোমার এফবি আইডি হ্যাক করে ইনফরমেশন পাওয়া যেতে পারে।"

শুভ্র ভাই শব্দ করে হাসলেন। কপালের চুলগুলো পেছন দিকে ঠেলে দিতে দিতে বললেন,

---" প্রায় আট/নয় মাস হতে চললো এফবি আইডি ডিয়েক্টিভ আমার। হোয়াটসঅ্যাপে একটু আধটু ঢুকা হয় যা...." 

পাশ থেকে হালকা কাশলেন অদুদ ভাইয়া। দাঁত কেলিয়ে বললেন,

---" চয়ন ভাই? আমাকে ঘুষ দিলে আমি একটা ইনফরমেশন দিতে পারি।" 

চয়ন ভাইয়া ভ্রু নাচিয়ে বললেন,

---" কি ইনফরমেশন?" 

---" আগে ঘুষ তো দিন। আগে বললে কেমনে চলবে?" 

---" আগে বলো। তারপর ঘুষ। ইনফরমেশন আমার কাজের না এলে তো ঝামেলা।" 

পাশ থেকে খুকখুক করে কেশে উঠলেন আলিফ ভাইয়া। অদুদ ভাইয়া থেকে খানিক তফাৎ এ বসে বললেন,

---" চয়ন ভাই? এর কথা বিশ্বাস করবেন মানে ঠকবেন। তার থেকে ইনফরমেশনটা আমিই দিয়ে দিচ্ছি, শুভ্র ভাইয়ের আরেকটা আইডি আছে। যে আইডিতে বছরে একবারও ঢুকে না শুভ্র ভাই । পোষ্ট, টোষ্ট বহুত দূরের কথা। ওই আকামের আইডির খোঁজ দিয়ে টাকা মারার ধান্দা করছে ভাইয়া।" 

অদুদ ভাইয়া জুতো খুলে, আলিফ ভাইয়ার দিকে ছুঁড়ে মেরে বললেন,

---" এই তুই আমার ভাই কেমনে হইলি রে? শালার বড় ভাইরে কখনো ইজ্জত দিতে পারলি না। যা ফুট।" 

উনাদের কান্ডে সবাই পেট ফাটা হাসিতে ফেঁটে পড়লো। চয়ন ভাইয়া আফসোসের শিষ তুলে বলে উঠলেন,

---" শুভ্র? তোমার এই প্রেম সংক্রান্ত বিষয়গুলো জানাটা এখন আমার জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। না জানলে রাতে ঘুম হবে না ভাই। সত্যি করে বলো তো, কেমনে করো এসব?" 

শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে বললেন,

---" কিসব?" 

চয়ন ভাইয়া বাঁকা হেসে বললেন,

---" ওসব।" 

শুভ্র ভাই সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন। হালকা কেশে বললেন,

---" ভাই? আপনি তো দেখি খুবই কড়া জিনিস। আমি ভদ্র একটা ছেলে। আমাকে উদ্দেশ্য করে এসব ভয়ানক সব কথা বলা কি ঠিক?" 

চয়ন ভাইয়া শুভ্র ভাইয়ের পিঠ চাপড়ে হাসলেন। ফোঁড়ন কেটে বললেন,

---" তুমিও তো কম না। একটা বললে অন্যটা বুঝো। আমি তো জিগ্যেস করছিলাম যে, তোমাদের যোগাযোগটা কিভাবে হয়? এই যুগের মেয়েরা একদিন দু'মিনিট কম কথা বললেই তো রেগে ফায়ার। তুমি সামলাও কেমনে?" 

শুভ্র ভাই এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

---" আমি কিছুই সামলাই না চয়ন ভাই। যা সামলানোর তা নিজে নিজেই সামলে যায়। আমাকে নিয়ে এতো ইনভেস্টিগেশন করার মতোও কিছু নেই ভাই। না আছে কাউকে বলার মতো কিছু। এ পর্যন্ত সরাসরি কখনো ভালোবাসিটাও বলি নি ওকে। কখনো "কেমন আছো?" জিগ্যেস করি নি। কখনো ভিডিও কলে কথা বলি নি। ফোন কলে আবেগময় কথা বলাও আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে নি। বছরের বেশিরভাগ সময়ই ওর থেকে অনেক দূরে থাকি আমি। তবুও কখনো কল করে জানতে চাই নি, কি হচ্ছে তার সাথে? কেন হচ্ছে? ব্লা ব্লা। নিতান্তই যখন মনে হয়েছে শরীরটা আর চলছে না। তখন সব কাজ ফেলে ক্লান্ত শরীরে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। সাধারণ পরিচিত মানুষের মতোই একটু আধটু কথা হয়েছে। আমি আবারও ফিরে গিয়েছি।"

এটুকু বলে থামলেন শুভ্র ভাই। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, 

---" সবাই বলে আমার নাকি প্রচুর রাগ। কিন্তু একটা ভয়ানক সত্য হলো, আমার মতো রাগী বান্দাও তার রাগের কাছে অসহায়। অনেক সময় দেখা গিয়েছে দু-তিন মাস অন্তর আমাদের দেখা হয়েছে কিন্তু দেখা হওয়া মাত্রই ম্যাডাম রাগে বোম। কেন বোম? সেটা তিনি আমায় বলবেন না। তার রাগের কারণ আমাকে খুঁজে খুঁজে বের করতে হবে। নয়তো কথা বন্ধ। এমনকি সামনে আসাও বন্ধ। আমাদের কোনো গল্প নেই, চয়ন ভাই। এতো কাঠখড় পুড়ানোরও কোনো প্রয়োজন নেই।" 

চয়ন ভাইয়া উত্তেজিত হয়ে বললেন, 

---" অদ্ভুত! ভালোবাসি বলো নি তো সে বুঝে কেমনে তুমি তাকে ভালোবাসো? সে প্রোপোজ করেছে নাকি আগে?" 

---" আমিই প্রোপোজ করি নি আর সে করবে? মরে গেলেও স্বীকার করবে না।" 

---" তাহলে?" 

শুভ্র ভাই হাসলেন। ডানচোখ টা টিপে দিয়ে বললেন,

---" চোখে চোখে কথা বল
হৃদয়ে রাখ হৃদয় ।
মনে মনে ভাসি চল
হয়ে যাক না প্রণয় ।
বুকের ভেতর তোমার জন্য
মাতাল হাওয়া বয় ।
অনুভবে না বলা কথা
বুঝে নিতে হয় ।" 

স্ট্রং কানেকশন চয়ন ভাই। অটোমেটিক বুঝে যাই....হার্ট টু হার্ট।"

চয়ন ভাইয়া আমোদিত গলায় বললেন,

---" তোমরাই হলে নেক্সট জেনারেশনের লায়লা-মজনু শালামশাই।  চালিয়ে যাও....চালিয়ে যাও।" 

উনাদের মধ্যে একের পর এক ভিন্ন ভিন্ন টপিক নিয়ে আড্ডা চলতে থাকলো। আর আমি অন্ধকারে বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম উনার মুখে। মাতাল করা হাসিতে মেতে আছে উনার ঠোঁট । সেই হাসির সাথেই মিশে আছে আমার একগুচ্ছ আবেগ। একগুচ্ছ ভালোলাগা আর একগুচ্ছ বিশ্বাস। সত্যিই তো...কি করে মনের সুপ্ত অনুভূতিগুলো মিলে গেলো দুজনের? সত্যিই কি উনাকে কখনো ভালোবেসেছিলাম আমি? কখনো যেচে খবর নিয়েছিলাম উনার? শখ করে হাসিমুখে দুটো কথা কি আদৌ বলেছিলাম? কি জানি? মনেই পড়ছে না। এভাবে ভুলে ভুলেই কিভাবে কেটে গেলো তিনবছর ছয়মাস দুই দিন!

২০

চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে আছি। পা আর চেয়ারের ঘর্ষনের ফলে ক্ষনে ক্ষনেই বেজে উঠছে নুপুর। আমার ডানদিকের একটি চেয়ারে গম্ভীর মুখে বসে আছেন শুভ্র ভাই। দৃষ্টি আমার বইয়ের পাতায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ পাতা উল্টে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন উনি। গমগমে গলায় প্রশ্ন করলেন,

---" ক'মাস ধরে পড়তে বসিস না রোদু?" 

আমি জবাব দিলাম না। কাল থেকেই শরীরটা খুব জ্বালা করছে আমার। হুটহাট ভীষণ জ্বরে কাবু হচ্ছি তো আবার ঘামে অস্থির হচ্ছি। শুভ্র ভাই কয়েক সেকেন্ড উত্তরের অপেক্ষায় থেকে সন্দেহী গলায় প্রশ্ন করলেন,

---" ইংলিশ সেকেন্ড পেপারে তোদের কয়টা আইটেমের ওপর পরিক্ষা হয় বল তো।" 

আমি একবার চোখ তুলে উনার দিকে তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে নিলাম। সব কটা আইটেম আমার মনে আছে কি না তাই মনে মনে আওড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। চার/ পাঁচটা আইটেমের বাইরে আর কিছুই মনে পড়লো না আমার। শুভ্র ভাই চোখ-মুখ লাল করে তাকালেন। 

---" এই পাঁচ মাসে একটাবার বই স্পর্শ করেছিলি তুই? পরীক্ষা নিলে তো নির্ঘাত ফেইল করবি। কি ভেবেছিস? ফেইল করবি, বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে আর জামাইয়ের ঘাড়ে বসে শান্তিতে খাবার চিবোবি? বর তো থাকবেই, পড়ালেখা করে আর কি লাভ, তাই না? থাপড়াইয়া কান লাল করে ফেলবো বেয়াদব।" 

আমি প্রত্যিত্তরে কিছুই বললাম না। উনি ইংলিশ টেস্ট পেপারটা আমার সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন,

---" সবগুলো বোর্ড শেষ করে তারপর উঠবি। লাই পেতে পেতে মাথায় উঠে নাচছিস। এভাবে পড়াশোনা করলে রিক্সাওয়ালা ছাড়া আর বর জুটবে না। ফুপা তো বলেই দিয়েছে পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ করলেই কোনো আর্মি-পুলিশ দেখে বিয়ে দিয়ে দেবে। তোর জন্য ওটাই বেস্ট হবে।" 

এমনিতেই মেজাজ চটে ছিলো। শরীর খারাপের দোহাই নিয়ে দু'দিন ধরেই অল্পতে রেগে যাচ্ছিলাম। উনার এসব কথায় বিরক্ত হয়ে মেজাজ দেখিয়ে বললাম,

---" সেটাই, আমিও তাই বলি। আমিও এবার ডিসিশন নিয়েছি যে আমি ফেইল করবো। শুধু এবার না বারবার ফেইল করে আদু ভাইয়ের ফিমেল ভার্সন হবো। খবরের কাগজে আমার নাম উঠবে। তাছাড়া, আপনিও কিন্তু মন্দ বলেন নি। বিয়ে করা যেতেই পারে। আর্মি-পুলিশ তো খারাপ কিছু নয়। সারাদিন বাইরে বাইরে থাকবে আর আমি শান্তিতে ঘুমোনোর এক মহাসুযোগ পাবো। এক-দুই বছরে একটা দুইটা বাচ্চার মা হয়ে বিন্দাস সংসার করবো। সমস্যা তো নাই। আমার বিয়েতে আপনি বিশেষ অতিথি হবেন শুভ্র ভাই। আপনাকে বিশেষভাবে দাওয়াত দেওয়া হবে। ইন-শা- আল্লাহ।"

শুভ্র ভাই রাগে কটমট করে আমার দিকে তাকালেন। ডান চোখের ভ্রু হালকা উঁচু করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন উনি। আমি উনার দৃষ্টিটাকে আরো একটু তীক্ষ্ণ হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে বললাম,

---" বুঝলেন শুভ্র ভাই? ভাবছি বাবাকে তীব্রর কথাটা বলবো। বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে আংকেল টাইপ কাউকে না করে ছোকরা টাইপ কাউকে করাটাই ভালো। এমনিতেও সবসময় আগেপিছে ঘুরতে..." 

আমার কথার মাঝেই শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন শুভ্র ভাই,

---" তীব্র কে?" 

আমি উনার দিকে এক পলক তাকিয়ে বললাম,

---" আপনাকে বলা যাবে না।" 

শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকালেন। অবাক হয়ে বললেন,

---" কেন?" 

আমি ভাবলেশহীন ভাবে বললাম,

---" আপনাকে বললে, আপনি ওকে মারবেন।" 

---" আমি কেন মারতে যাবো?" 

---" সিফাত নামের ছেলেটার সাথে আপনি যা করেছেন তা এখনও মনে আছে আমার। বেচারা ভয়ে পুরো দু'মাস কলেজে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলো। শুধু তাই নয় আমি যে যে স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তাম ভয়ে ওইসব স্যারের কাছেও পড়া বন্ধ করে দিয়েছিলো বেচারা। কি বিশ্রী অবস্থা।" 

শুভ্র ভাই আরেক দফা অবাক হয়ে বললেন, 

---" আমি কি ওকে মেরেছি নাকি?" 

---" মারেন নি তবে ভয় তো দেখিয়েছেন। আপনাকে দেখলে তো ভয় পায়-ই আপনার বন্ধুদের দেখলেও বেচারার কাঁদ কাঁদ অবস্থা হয়ে যায়।" 

শুভ্র ভাই হালকা কেশে নড়েচড়ে বসলেন। ইতস্তত করে বললেন,

---" ও ভয় পেলে ওটা ওর সমস্যা। আমার তাতে কি? তবে ওকে মারা উচিত ছিলো। মেয়েদের পেছন পেছন বাসার গেইট পর্যন্ত চলে আসার অপরাধে ওর পা দুটো ভেঙে ফেলা উচিত ছিলো। বেয়াদব একটা! এবার চুপচাপ পড়া কমপ্লিট কর.... " 

আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। দরজার পাশ থেকে আম্মুর কড়া চাহনী দেখে কথা বাড়ানোর সাহসই পেলাম না। গ্রামারটিক্যাল করতে গিয়ে প্রথম দফায় খাতা ভর্তি ভুল করলাম। শুভ্র ভাই বিরক্ত হলেন। কিছুক্ষণ রাগ দেখিয়ে শান্ত গলায় বুঝাতে লাগলেন। উনার বুঝানোর পদ্ধতিটা অন্যরকম। উনি সারাদিন বুঝানোর খাতিরে বকবক করে গেলেও আমার মতো অধৈর্য ছাত্রীরও এক তিল পরিমান অমনোযোগী হতে মন চাইবে না। কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে উনার কথা শুনার পর মনোযোগটা আরো গাঢ় হয়ে এলো আমার। তবে এবারের মনোযোগটা পড়ায় নয় উনার চোখে-মুখে স্থির। কথা বলার সাথে সাথে উনার মুখের সংকোচন প্রসারণ খুব মন দিয়ে খেয়াল করছিলাম আমি। হঠাৎই উনি কথা থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,

---" ওই? তুই কি আদৌ কিছু শুনছিস? কি দেখছিস এভাবে?" 

আমি ফট করেই বলে ফেললাম,

---" কথা বলার সময় আপনাকে অনেক কিউট লাগে।" 

উনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। বইটা ঠেলে দিয়ে বললেন,

---" যতটুকু বুঝেছিস তার ওপর ভিত্তি করেই কর। দেখি কয়টা হয়। তাড়াতাড়ি।" 

আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে অলস ভঙ্গিতে বই-খাতা টেনে নিয়ে লিখতে বসলাম। কয়েক মিনিট পরেই লেখা থামিয়ে উনার দিকে তাকালাম। উনি ফোন স্ক্রল করছিলেন। আমাকে উনার দিকে তাকাতে দেখে চোখ না তুলেই বললেন,

---" আবার কি হলো?" 

আমার কপাল কুঁচকে এলো। বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললাম,

---" আপনি টিউশনি করান...." 

---"তো?" 

আমি কলমটা খাতার উপর রেখে বললাম,

---" কিছু না। আমি এখন পড়বো না। ঘুম পাচ্ছে ঘুমাবো। এইটুকুই!" 

কথাটা বলে উনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বিছানায় সটান শুয়ে পড়লাম। উনি ফোন থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। বিরক্ত কন্ঠে  বললেন,

---"ফ্রেন্ডদের আড্ডা ছেড়ে আমি এখানে বসে আছি শুধুমাত্র তোকে পড়াবো বলে। আর তুই হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছিস? ওঠে পড়তে বস বলছি।" 

উনার কথায় আমার মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন। ডানহাতে নিজের কপাল চেপে ধরে বললেন,

---" আমি মেয়েদের পড়াই না। সো, হা করে তাকিয়ে থেকে আমার কথা গেলার সুযোগ তাদের নেই। প্রেমে পড়ার সুযোগও নেই। এবার দয়া করে এসে পড়তে বস। ফুপি তোকে শুয়ে থাকতে দেখলে একটা মারও মাটিতে পড়বে না। আসবি নাকি থাপ্পড় লাগাবো?" 

আমি মাথাটা একটু উঁচু করে উনার দিকে তাকালাম। উনাকে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভয়ে ভয়ে ওঠে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলাম। উনার চোখ-মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভয়ানক রেগে আছেন উনি। কিন্তু এতো রাগের কারণটা  কি? আমি তো এতোটা রেগে যাওয়ার মতো কিছু করি নি। এসব কথা ভাবতে ভাবতে উনি কিছু বলার আগেই আবারও পড়ায় মনোযোগ দিলাম আমি। দশ পনেরো মিনিট পর, চুপচাপ আমার খাতার উপর নিজের ফোনটা রাখলেন উনি। আমি  লিখছিলাম। লেখার মাঝে হঠাৎ এভাবে ফোন রাখায় ভীষণ অবাক হলাম আমি। একবার উনার দিকে তাকিয়ে আবারও ফোনের দিকে তাকালাম। উনি শান্ত গলায় বললেন,

---" চয়ন ভাইয়ের বোনকে আমার নাম্বারটা কি তুই দিয়েছিস?" 

আমি বোবার মতো একবার উনার দিকে তাকিয়ে আবারও ফোনে মনোযোগ দিলাম। সুস্মিতা আপুর দেওয়া একের পর এক লম্বা লম্বা ম্যাসেজ দেখে বিস্মিত হলাম। আমাকে চুপ থাকতে দেখে আবারও কথা বললেন শুভ্র ভাই,

---" ফোনে ম্যাসেজ, কল তো আছেই। হোয়াটস্অ্যাপেও মিনিটে মিনিটে ম্যাসেজ দিয়ে চলেছে । এফবি আইডি ডিয়েক্টিভ থাকায় আইডিটা বেঁচে গেছে মনে হয়। আমি সিউর, আমার আনইউজড আইডিটাকেও ম্যাসেজের বন্যায় বসিয়েছে এই মেয়ে। উফ! কি বিরক্তিকর!" 

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বোকার মতো প্রশ্ন করলাম,

---" আপনাকে কেন ম্যাসেজ দেয়?" 

উনি উত্তর দিলেন না। আমি এবার লাস্ট ম্যাসেজটাতে চোখ বুলালাম,

---" এটা কেমন বিহেভিয়ার বলুন? আমি এতোদিন ধরে ম্যাসেজ দিচ্ছি এটলিস্ট একটা আন্সার তো আপনি দিতে পারেন। আমার দুটো নাম্বারই ব্লক লিস্টে রেখেছেন। এর কারণটা কি? আমি জানি আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে কিন্তু বিয়ে তো আর হয়ে যায় নি। আর সে কি আপনাকে কসম দিয়েছে যে অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে পারবেন না আপনি। আমি আপনাকে ব্রেকআপও করতে বলছি না। আমি শুধু আপনার সাথে ভালো ফ্রেন্ডশিপ করতে চাইছি। আপনি এটলিস্ট এক সপ্তাহ আমার সাথে কথা বলুন। তারপরও যদি আপনার মনে না হয় যে আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড থেকে বেটার না তাহলে আমি আর ডিসটার্ব করবো না। আমি সত্যিই অনেক পছন্দ করি আপনাকে। আমার এতো পাগলামো দেখেও কি বুঝতে পারছেন না? প্লিজ একটা রিপ্লাই দিন... প্লিজ!! " 

ম্যাসেজটা দেখে বিস্ফারিত চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি চোয়াল শক্ত করে বসে আছেন। উনার রাগ দেখে আমার রাগের সিস্টেমটা অটোমেটিক অফ হয়ে গেলো। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললাম,

---" পপপছন্দ করে আপনাকে।" 

শুভ্র ভাই ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

---" তোর কি ধারনা? আমি বাংলা পড়তে জানি না?" 

আমি কি বলবো বুঝতে না পেরে চুপচাপ বসে রইলাম। উনি ফোনটা নিয়ে একটা নাম্বার ডায়াল করে লাউড স্পিকারে দিয়ে আবারও আগের জায়গায় রেখে দিলেন। আমার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,

---" আজকের পর যদি এই মেয়ে আমায় ডিস্টার্ব করে তাহলে থাপড়াইয়া তোর দাঁত ফেলে দিবো।" 

উনার কথায় আমার বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁলো। ওই মেয়ের ফোন দেওয়ার সাথে আমার কি সম্পর্ক বুঝতে না পেরে বললাম,

---" আমার কি দোষ? আপ..." 

এটুকু বলতেই ফোনের ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো। শুভ্র ভাই চোখের ইশারায় কথা বলতে বলে নিজে চুপ করে বসে রইলেন। আমি ইতস্তত কন্ঠে বললাম, 

---" হ্যালো?"

---" আপনি কে? এটা শুভ্রর নাম্বার না?" 

---" জ্বি এটা উনারই নাম্বার।" 

---" এটা ওর নাম্বার হলে আপনি কে?" 

এবার আমি থতমত খেয়ে উনার দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই রাগী চোখে আমার দিকে তাকাতেই থেমে থেমে বলে উঠলাম,

---" আপনার কি মনে হয়? কে আমি?" 

---" শুভ্রর গার্লফ্রেন্ড? আপনি শুভ্রর গার্লফ্রেন্ড হলেও বা আমাকে ফোন কেন দিয়েছেন?" 

---" আপনি জানেন আমি কেন ফোন দিয়েছি। এতোকিছু জানার পরও আপনি কিভাবে একটা ছেলেকে দিনরাত ডিস্টার্ব করতে পারেন? আপনার কি আত্মসম্মান বোধ নেই? আমার তো মনে হয়, আপনি জন্মগতভাবেই এমন। আজ অবিবাহিত ছেলেকে ফোর্স করছেন তো কাল দুই-তিন বাচ্চার বাবাকেও ফোর্স করতে শুরু করবেন। আপনাদের ক্যাটাগরিটাই এরকম তাই না?" 

---" আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।"

---" থেংক গড বুঝতে পেরেছেন যে আমি আপনাকে অপমান করছি। আচ্ছা? আপনার মধ্যে কি সত্যিই অপমানবোধ নামক কিছু আছে?" 

---" আমার কি আছে আর কি নেই তা আপনার দেখার বিষয় নয়। এমন একটা ভাব করছেন যেন শুভ্রর বিয়ে করা বউ। আপনিও তো সেই রাস্তার মেয়েই। বিয়ের আগে প্রেম করে বেড়ানো মেয়েদেরকে কি বলে জানেন? না জানলে জেনে নিবেন। ব্লাডি বিচ।" 

সুস্মিতা আপুর কথায় রাগে সারা শরীর জ্বলে উঠলো আমার। দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। টলমলে চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,

---" কয়েকটা গালি শিখিয়ে দেন তো। এই মহিলাকে গালি দিতে ইচ্ছে করছে। অসভ্য মেয়ে! বেয়াদব... " 

শুভ্র ভাই দুই সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে হাসলেন। ফোনটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললেন,

---" হ্যালো?" 

ওপাশ থেকে তাড়াহুড়ো করে উত্তর এলো,

---" শুভ্র? দেখুন না, আপনার গার্লফ্রেন্ড কতোটা বাজে বিহেভ করছে আমার সাথে।" 

শুভ্র ভাই ছোট্ট করে শ্বাস টেনে নিয়ে বললেন,

---" সুস্মিতা? ওর সবচেয়ে বড় সমস্যাটা কি জানো? ওর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ও তোমার মতো থার্ডক্লাস বিহেভ করতে পারে না । আমাদের সমাজে মেয়েদের আলাদা একটা রেসপেক্ট থাকে। আর সেই রেসপেক্টটা মেয়েদের বজায় রেখেই চলতে হয়। আজ যে কথাটা তুমি ওকে বললে সেই কথাটা যদি আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে তাহলে হয়তো মেয়ে হিসেবে যে রেসপেক্টটা তোমার প্রাপ্য তা তোমায় দিতে পারতাম না। পুচকিকে কিছু বলার আগে দশবার চিন্তা করবে সুস্মিতা। নয়তো, আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। দেখো, তোমাকে আমি এর আগেও বলেছি আমি এনগেজড। তবু কেন এমন পাগলামো করছো? তুমি যে বারবার হাত কেটে ফেলবে বলে ধমকি দিয়ে চলেছো তাতে কি বিন্দুমাত্র চিন্তিত হচ্ছি আমি? একদমই না বরং বিরক্ত হচ্ছি। কারণ তোমার বেঁচে থাকা বা মারা যাওয়া কোনটাই আমার কাছে ম্যাটার করে না। তুমি বেঁচে থাকলেও আমি যেভাবে চলাচল করবো তুমি মারা গেলেও সেভাবেই চলাচল করবো। ও কাঁদলে আমার যে অস্থিরতাটা হয়, তুমি মারা গেলে তার চারভাগের একভাগও অস্থিরতা হবে না আমার। যা যাওয়ার সব তোমার ফ্যামিলিরই যাবে। যার কাছে তোমার গুরুত্বই নেই তাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা না করে যারা তোমাকে ভালোবাসে তাদের আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করো। তুমি অনেক ভালো মেয়ে। আমার থেকেও অনেক ভালো ছেলে ডিজার্ভ করো তুমি। বুঝার চেষ্টা করো আর এসব পাগলামো বন্ধ করো।"

---" কিন্তু...." 

এবার আমি শক্ত কন্ঠে বলে উঠলাম,

---" কিন্তু মাই ফুট। আবার যদি এভাবে ডিস্টার্ব করেন তাহলে আপনার ম্যাসেজের স্ক্রিনশট, কল রেকর্ডিংস সব আপনার ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেবো। আপনার ভাইয়ের নাম তো চয়ন মাহমুদ। আর বাসা তো আনন্দমোহনের পাশে তাই না?" 

ওপাশ থেকে ইতস্তত কন্ঠে বললো, 

---" আপনি ভাইয়াকে চিনেন?" 

---" জ্বি চিনি। আর বেশি হাংকিপাংকি করলে আপনার আসল রূপটাও তাকে চেনাবো। মাইন্ড ইট!" 

কথাটা বলে ফোনটা কেটে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলাম। শুভ্র ভাই ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে মৃদু হেসে বললেন,

---" বাহ্ বাচ্চাটা বড় হয়ে যাচ্ছে।" 

আমি কিছু বললাম না। উনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বইটা টেনে নিয়ে বললেন,

---" কিছু বোর্ড মার্ক করে দিয়েছি। ওগুলো কমপ্লিট করে নিস। তুষার বার বার কল করছে আমায় একটু বেরুতে হবে। আর ফুপ্পিকে বলিস আমি বেরিয়ে গেছি অন্য একদিন খাবো।"

উনি তাড়াহুড়ো করে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েও থেমে গেলেন। পেছন ফিরে বললেন,

---" শোন? খাওয়ার পর মনে করে মেডিসিন নিস। রাত জেগে পড়ার দরকার নেই।" 

এটুকু বলে আবারও দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন উনি। আমি উদাস মনে বসে রইলাম। কিছুই ভালো লাগছে না। কিছুদিন যাবৎ হুটহাটই মন খারাপ হচ্ছে। মাঝে মাঝেই নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুঃখী মনে হচ্ছে। ভালো কথাতেও বিরক্তি আর রাগে শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে। তার সাথে প্রচন্ড কান্নাও পাচ্ছে। কেন পাচ্ছে?  কে জানে? 

___________________

রাত প্রায় দশটা। আকাশে চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা চলছে। চারপাশে হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস। আমি ছাঁদের এক কোণে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছি। সময়ের সাথে সাথে মন খারাপ ভাবটা যেন চক্রবৃদ্ধি আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারসাথে বাড়ছে দীর্ঘশ্বাস। আমার এই দীর্ঘশ্বাসের মাঝেই ব্যস্ত পায়ে ছাঁদে এলেন শুভ্র ভাই। উনার হাতে পাখির খাঁচা। আমাকে দক্ষিণ দিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তেজ নিয়ে বললেন,

---" রাত দুপুরে একা ছাঁদে দাঁড়িয়ে থাকা কেমন স্বভাব?" 

আমি উনার হাতের খাঁচার দিকে তাকিয়ে উৎসাহী গলায় বললাম,

---" এটা কি?" 

উনি মৃদু হেসে বললেন,,

---" আমি তুমি" 

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

---" মানে কি? দেখুন, একদম মজা করবেন না।" 

শুভ্র ভাই হেসে ফেললেন,

---" আরে বাবা, মজা করবো কেন? ওদের নাম আমি এবং তুমি। এই নীল পাখিটা হলো আমি আর হলুদটা হলো তুমি।" 

উনার কথায় বেশ মজা পেলাম আমি। নিজের অজান্তেই হেসে ফেলে বললাম,

---" সত্যিই ওদের নাম আমি তুমি? নামগুলো ভীষণ অদ্ভুত শুভ্র ভাই।" 

শুভ্র ভাই খাঁচাটা রেলিঙের ওপর রেখে হাসিমুখে বললেন,

---" কিছু কিছু বিষয় অদ্ভুত হতে হয় রোদপাখি। কারণ, কিছু কিছু বিষয় অদ্ভুত বলেই আমরা ভালোবাসি।" 

এটুকু বলে উনি খাঁচার ভেতর পাখিদের দিকে তাকালেন। আদুরে গলায় বললেন,

---" এইযে আমি-তুমি? তোরাও পাখি আর এইযে এই মেয়েটাকে দেখছিস এটাও পাখি। ওর নাম রোদপাখি। তবে, এই পাখিটা শুধু শুভ্রর বুঝলি? রোদপাখির সবসময় মন খারাপ থাকে। রোদপাখির মন ভালো রাখার মহান দায়িত্ব কিন্তু এবার তোদের মাথায়। যদি শুনি তোরা থাকতেও রোদপাখি মন খারাপ করে বসে আছে, তাহলে 'আমি' কে কেড়ে নিয়ে 'তুমি' কে একদম একা করে দিবো। ঝিম মেরে বসে থাকলে চলবে না বুঝলি? কাজ করতে হবে। মন খারাপ তাড়ানোর কাজ।"

নীল পাখিটা উদাস চোখে উনার দিকে তাকালেন। ছাঁদের মৃদু আলোয় পাখিটার কালো ছোট্ট চোখটা কেমন চিকচিক করছে। মনে হচ্ছে, চোখদুটো যেন উপচে আছে জলে। আমি একরাশ হাসি নিয়ে খাঁচায় হাত রাখলাম। শুভ ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

---" সারাদিন মন খারাপ করে থেকে তোর বাপের বিপিটা না বাড়িয়ে একটু হাসতে শিখ। ছোট্ট একটা মেয়ে তার আবার কি গম্ভীর মেজাজ। এই আমি-তুমি? এর গাম্ভীর্যকে একদম পাত্তা দিবি না বুঝলি? বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমায় জানাবি। আমি কতো শতো কাজে ব্যস্ত থাকি। তাই তোদের এই মহান দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি। মহারানীর মন খারাপ হলে কিন্তু তোদের রক্ষে নেই।" 

উনি একের পর এক উপদেশ দিয়ে চলেছে "আমি" "তুমি" কে। পাখিরাও পিটপিট করে তাকিয়ে তাদের মনোযোগীতার স্বাক্ষর দিচ্ছে।  আমি ঠোঁটে নিঃশব্দ হাসি ঝুলিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। মাঝে মাঝে নিঃশব্দতা ছাপিয়ে আওয়াজ করে হেসে উঠছি। ছাঁদের লালটে আলো আর চাঁদের আলো মিলে অদ্ভুত এক সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে উনার মুখে। সত্যিই, কিছু কিছু সৌন্দর্য অদ্ভুত বলেই আমরা ভালোবাসি। 



চলবে...


Writer:- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner