২৬
আমাদের জীবনটা অনেকটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো। আদর করে হাতে তুলে নিতেই যেন মিলিয়ে যেতে চায়। মুখে দেওয়ার সাথে সাথেই মনে হয়, কোথায় গেল? কিছু বুঝে উঠার আগেই শেষ হয়ে গেল, কি আশ্চর্য! একটা জীবন মানেই আস্ত একটা সারপ্রাইজ বাক্স। খারাপ, ভালো মিলিয়ে কতশত সারপ্রাইজ তার ভাঁজে ভাঁজে। এইতো, মামানি যখন ফোন দিয়ে বলল মামু হসপিটালে আমরাও সারপ্রাইজড হয়েছিলাম। বিস্ময়ে 'থ' মেরে বসেছিলাম অনেকক্ষণ। আম্মুর কান্নার আওয়াজে আমাদের চমক কেটেছিল। এই অপ্রত্যাশিত সারপ্রাইজটার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করি নি। আসলে, জীবন আমাদের স্বপ্ন এবং কল্পনার বাইরে গিয়েও অনেক কিছু দেয়। ভয়ঙ্কর কিছু সারপ্রাইজে বিস্মিত, স্তব্ধ হতে বাধ্য করে।
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছি। সবার চোখে-মুখেই দুঃখ আর হতাশার ছাপ। মামু স্টোক করেছেন। হঠাৎ করেই এমন কিছু কখনোই আশা করি নি আমরা। স্টোকটা ছোট-খাটো আর প্রথমবার বলেই হয়ত তেমন একটা ক্ষতি হয় নি মামুর। হয়ত হয়েছে যা আমার অজানা। মামানি আমার ডান হাত আঁকড়ে ঝিম ধরে বসে আছেন। আমরা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর পরই শুভ্র ভাই এলেন। শুভ্র ভাই একটা বিশেষ প্রয়োজনে আজ সকালের গাড়িতেই চট্টগ্রাম রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু মামুর খবর শুনে মাঝ রাস্তা থেকেই ফিরতে হয়েছে তাকে। শুভ্র ভাই করিডোরে পা রাখতেই উঠে দাঁড়ালেন মামানি। শুভ্র ভাই কাছাকাছি আসতেই মুখ চেপে ডুকরে উঠলেন মামানি। শুভ্র ভাইয়া দ্রুত পায়ে মামানির সামনে এসে দাঁড়ালেন। মামানিকে দু'হাতে আগলে নিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললেন,
----" ইশ! বাচ্চাদের মতো কাঁদছ কেন আম্মু? বাবা ঠিক আছে তো। আমি ডাক্তারদের সাথে কথা বলছি। কালই বাবাকে বাসায় নিয়ে যাব দেখো।"
মামানি ফুঁপিয়ে উঠলেন। ছেলেকে কাছে পেয়ে এতক্ষন যাবৎ চেপে রাখা কান্না, অসহায়ত্বগুলো মুক্ত করে দিলেন। শুভ্র ভাই মামানিকে জড়িয়ে ধরেই দাঁড়িয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। শুভ্র ভাইয়ের চোখে-মুখে অদ্ভুত একটা ভয় আর অসহায়ত্ব চোখে পড়ছিল আমার। আমাদের মামু, চাচ্চু, ফুপি নামক অনেকগুলো ছায়া থাকলেও শুভ্র ভাইদের ছায়া হিসেবে শুধুই আমার আম্মু। তিন কোলে আর কেউ নেই। কেউ না। কিছুক্ষণ পর মামানিকে শান্ত করে ডাক্তারের কাছে ছুটলেন উনি। চোখে-মুখে নিদারুণ ক্লান্তি তার। উনার ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকাতেই হঠাৎ করেই ভীষণ কান্না পেয়ে গেল আমার। কারণ-অকারণের বিষয়গুলো না ভেবে ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করতে লাগল। বিকাল পাঁচটার দিকে ডাক্তার জানাল, মামু মোটামুটি ভালো আছেন। এতো চিন্তার কোনো কারণ নেই। হসপিটালে এডমিট থাকুক, তারা রুগীর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিবেন। সারাদিন না খাওয়া প্রতিটি প্রাণ যেন অল্প বিস্তর স্বস্তি পেল। সন্ধ্যার মধ্যে সবাই একে একে বাড়ি ফিরল। মামানি পুরোটা সময় আমার হাতটা এতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলেন যে সেই শক্ত মায়াজাল ছেড়ে আমার আর বাসায় ফেরা হলো না। আম্মুকে মিনমিনিয়ে বললাম,
----" আমি থাকি আম্মু। মামানি একা কিভাবে...."
হাসপাতাল নামক জায়গাটাকে ছোট থেকেই ভীষণ অপছন্দ করি আমি। কাছের কেউ অসুস্থ হলেও থাকতে পারি না, দমবন্ধ লাগে। কিন্তু আজ কিভাবে যে সাহসটা জুটে গেল, কে জানে? সারা সন্ধ্যা শুভ্র ভাই দৌঁড়াদৌঁড়ির মধ্যেই থাকলেন। নয়টার দিকে ভাইয়া খাবার দিয়ে এলে সাহস করে মামানির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। মামানির যে পরিস্থিতি তাতে খাবারের কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে বেশ ভাবনায় পড়লাম। অল্প কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মৃদু গলায় বললাম,
----" মামানি? সারাদিন খাও নি। অল্প একটু খেয়ে নাও প্লিজ।"
মামানি তখন মামুর পাশে ঝিম ধরে বসে আছেন। আমার কথায় চমকে তাকালেন। হালকা হেসে আমার হাতটা টেনে নিয়ে বললেন,
----" আমার ক্ষুধা নেই। আমায় নিয়ে চিন্তা করিস না। তুই একটু শুভ্রকে ডেকে খাওয়া। সেই ভোর পাঁচটায় দুটো রুটি খেয়েছিল। তারপর সারাদিন না খাওয়া ছেলেটা।"
আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলাম। কেবিনের সামনের করিডোরেই মাথা নিচু করে বসে আছেন শুভ্র ভাই। আমি কিছুক্ষণ দু'মনা করে উনার পাশে গিয়ে বসলাম। উনি আগের মতোই মাথা নিচু করে বসে রইলেন। আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল আমি কাউকে সান্ত্বনা দিতে জানি না। কাউকে দুঃখী হয়ে বসে থাকতে দেখলে কি বলা উচিত খুঁজেই পাই না। আমাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে শুভ্র ভাই নিজ থেকেই বললেন,
----" বাসায় যাস নি কেন?"
আমি কি বলব বুঝে উঠার আগেই সোজা হয়ে বসলেন উনি। কপাল কুঁচকে বললেন,
----" তুই এখানে থাকলেই কি বাবা সুস্থ হয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেবেন? আজাইরা ঝামেলা।"
আমি অবাক চোখে তাকালাম,
----" আমি ঝামেলা?"
----" অবশ্যই ঝামেলা। একদিকে বাবা অসুস্থ, অন্যদিকে আম্মুকে সামলাও, তারওপর এক্সট্রা ভাবে তুই। এদিক-ওদিক কোথায় গিয়ে হারিয়ে যাবি, কে জানে? তোকে চোখে চোখে রাখার জন্য হলেও আরেকজনকে নিযুক্ত করতে হবে এখন।"
----" আপনার ধারণা আমি হসপিটালের মধ্যে হারিয়ে যাব? হসপিটাল কোন হারানোর জায়গা হল? এমনভাবে বলছেন যেন মেডিক্যালে আজ আমি প্রথম আসছি।"
----" তুই তো নিজের রুমের মধ্যেই হারিয়ে যাস। সেখানে হসপিটালের মত জায়গা তো তোর হারানোর জন্য বেস্ট প্লেস।"
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
----" এমন একটা পরিস্থিতিতেও আমার সাথে ঝগড়া না করে চলছে না আপনার?"
উনি ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন,
----" আমি ঝগড়া কখন করলাম? ঝগড়া তো তুই করছিস। আমি তোকে স্বাভাবিক সত্যগুলো বুঝাতে চাচ্ছিলাম কিন্তু তোর জন্মগত সমস্যা হল তুই স্বাভাবিক বিষয়গুলোকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারিস না।"
উনার কথায় রাগ নামক বিশ্রী অনুভূতিটা ধপ করে জ্বলে উঠলেও চুপচাপ বসে রইলাম। লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে কন্ঠটা যথাসাধ্য নরম করে বললাম,
----"খাবেন না? আম্মু খাবার পাঠিয়েছে।"
উনি উত্তর দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
----" ক্ষুধা নেই।"
----" সারাদিন ধরেই তো কিছু খান নি। নয়টার বেশি বাজে। এখনও ক্ষুধা নেই?"
উনি ক্লান্ত শরীরটা চেয়ারের গায়ে মেলে দিয়ে চুপ করে রইলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর বললেন,
----" চল তোকে বাসায় দিয়ে আসি। এখানে থাকতে হবে না।"
উনার কথায় ভ্রু কুঁচকালাম আমি। জেদ ধরে বললাম,
----" আমি যাব না। আপনি খাবেন চলুন।"
----" খাব না। ক্ষিধে নেই। রাহাত ভাই নিচে আছে। উনাকে উপরে আসতে বলছি, উনার সাথে চলে যা...."
আমি গাঢ় গলায় বললাম,
----" বলছি তো যাব না।"
উনি কোন উত্তর দিলেন না। নিরুত্তর চোখে ছাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। উনার চোখে-মুখে একরাশ চিন্তা। কিছু একটা নিয়ে গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন উনি। আচ্ছা? মামুর কি ভয়ানক কোন সমস্যা হয়েছে? হঠাৎ করেই উনাকে ডাকার সাহস পেলাম না আমি। প্রায় ঘন্টাখানেক চুপচাপ বসে থাকার পর হসপিটালের ঘড়িতে দশটা বাজল। রাতের হসপিটালে মানুষের আনাগোনা কম। এদিকটায় কেউ নেই বললেই চলে। আমি সাহস নিয়ে একটু এগিয়ে শুভ্র ভাইয়ের পাশের চেয়ারটাতে গিয়ে বসলাম। উনার দিকে ঘুরে বসে নরম গলায় বললেন,
----" মামু ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না।"
উনি এক নজর আমার দিকে তাকালেন। মৃদু গলায় বললেন,
----" খেয়েছিস? এখানে ঘুমানোর জায়গা নেই। রাত জাগতে পারবি না তুই। চল বাসায় দিয়ে আসি। অযথা জেদ করে জ্বালাস না। এসব ঢং আর ভাল্লাগছে না।"
কিছু বলতে গিয়েও উনার গম্ভীর চাহনিতে বলা হয়ে উঠল না আমার। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আরেকটু পাশ ঘেঁষে বসলাম আমি। অস্বস্তি নিয়ে উনার ডানহাতটা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলাম। মনে মনে ধমক খাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকলেও উনি কিছু বললেন না। আমি সাহস নিয়ে বললাম,
----" আমি কি হসপিটালে ঘুমানোর জন্য এসেছি? আর ঘুম পেলে এভাবেই ঘুমাব আমি। সমস্যা হবে না।"
উনি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
----" সারাদিন দৌড়ঝাঁপ পেরেছি....গোসল সারা হয় নি। এই পরিস্থিতিতে যানবাহন আর হসপিটাল দুটোই রিস্কি জায়গা। আর সারাদিন এই দুটোর সংস্পর্শেই ছিলাম আমি। বাসায় ফিরে যা..."
----" উহু।"
তারপর সব নীরব। আমি চোখ তুলে উনার দিকে তাকালাম। উনার চোখ-মুখ ফ্যাকাশে লাগছে। সিল্ক চুলগুলোও উসকোখুসকো হয়ে পড়ে আছে কপালে। আমি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললাম,
----" মামু ভালো হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না।"
আমার কথায় কপাল কুঁচকালেন উনি। ধমকের মতো করে বললেন,
----" আপনাকে পাকামো করতে কে বলছে? ঘুম পাচ্ছে ঘুমা নয়তো সর।"
উনার কথায় মুখ ফুলিয়ে সরে গেলাম আমি। উনার থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে একহাতে কপাল চেপে চুপচাপ বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরই উঠে কেবিনের ভেতরের দিকে চলে গেলেন উনি। উনাকে চলে যেতে দেখে দু'হাতে মুখ চেপে চোখ বন্ধ করলাম। সারাদিন হসপিটালে কাটানোই মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ঘন্টাখানেক শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে বেশ হত। দশ পনের মিনিটের মাথায় ফিরে এসে আমার পাশের চেয়ারটাতে বসলেন শুভ্র ভাই। আমি হাত সরিয়ে এক নজর উনার দিকে তাকালাম। ব্রাউন শার্ট পাল্টে কালো রঙের টি-শার্ট পড়েছেন উনি। চোখ-মুখ স্নিগ্ধ লাগছে। চুলগুলোও ভেজা। আমার কপাল কুঁচকে এলো। উনি কি গোসল সেরে এলেন? কাপড়ের ব্যাগ উনার সাথে ছিল ঠিক কিন্তু গোসল কোথায় করলেন? মামুর কেবিনে? আমাকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নরম গলায় বললেন উনি,
----" ঘুম পাচ্ছে? চাইলে... "
----" আপনাকে এতো দয়া দেখাতে কি বলেছে? আমার ঘুম পেলে পাচ্ছে না পেলে নাই। আপনি নিজের কাজ করুন। আজাইরা ঢং দেখাতে আসবেন না।"
আমার ঝাঁঝাল উত্তরে খানিকটা নিভলেন উনি। কিছু বলবেন তার আগেই কাবিনের সামনে এসে দাঁড়াল একটি মেয়ে। গায়ে ডাক্তারদের এপ্রোন। এই মাঝ রাতেও ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটিকে। মেয়েটি কবিনের দরজায় হাত রেখে পেছন ফিরে মুচকি হাসল। তার হাসির উত্তরে মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালেন শুভ্র ভাই। মেয়েটির পেছন পেছন কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড দরজার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থেকে আগের মতোই বসে রইলাম আমি। সুন্দরী মেয়ে দেখে পাগল হয়ে যাওয়াটা ছেলে জাতির স্বভাব। কথায় আছে, মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও যদি সুযোগ পায় তবুও পুরুষেরা অন্য মেয়েদের দিকে তাকাবে। এটাই স্বাভাবিক। তার মধ্যে শুভ্র ভাই তো আলট্রা লিজেন্ড..... সুন্দরী ডাক্তার দেখে পটে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এদের সবকটাকে ধরে ব্রহ্মপুত্র নদে চুবানো উচিত, মেয়েবাজ কোথাকার। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। কিছুক্ষণ ঘুমোতে পারলে বেশ হত। আপাতত এদের বাংলা ঢংটা দেখতে হত না। আরও কিছুক্ষণ পর আমার পাশে গা ঘেঁষে বসল কেউ। গায়ের গন্ধেই বুঝতে পারছিলাম মানুষটির পরিচয়। শুভ্র ভাই কয়েক মিনিট চুপচাপ বসে থেকে আমার মাথাটা নিজের কাঁধে রাখলেন। ব্যাপারটাতে চরম রকম মেজাজ খারাপ হল আমার। উঠে দাঁড়িয়ে ধমাধম মাইর বসাতে ইচ্ছে করল উনার পিঠে। তবুও নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করে চুপচাপ বসে রইলাম। উনার সাথে ঝগড়া করার মত ন্যূনতম শক্তি আমার নেই। এখন একটা ঘুম প্রয়োজন। চমৎকার একটা ঘুম। আমাকে ডানহাতে আলতোভাবে জড়িয়ে নিয়ে, কপালে সাবধানে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফোনালাপে মনোযোগী হলেন শুভ্র ভাই,
----" হ্যাঁ তুষার,বল।"
তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ। তারপর আবারও ক্লান্ত গলায় বলে উঠলেন উনি,
----" ফুল ফ্যামিলিই তো হসপিটালে আছি। আর কত লাগে? তুই কাল সকালে আসিস। এখন আসার প্রয়োজন নেই। রো...."
তারপরের কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে এল আমার কানে। রাজ্যের ঘুমগুলোকে দু’চোখের পাতায় জায়গা দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে পড়ে রইলাম বিরক্তিকর মানুষটার কাঁধে। তারপর যখন চোখ খুললাম তখন তীক্ষ্ণ কোন আলো দৃষ্টি পথে বাঁধা দিচ্ছিল আমার। হাত বাড়িয়ে আলোটা ঢাকার চেষ্টা করতেই হাতটা সরিয়ে দিল কেউ। আবারও একই চেষ্টা করতেই গমগমে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়া হল,
----" কি সমস্যা?"
আমি চোখ কুঁচকে বললাম,
----" চোখে আলো লাগছে। বন্ধ করো আলো।"
গমগমে কন্ঠটা এবার ধমকে উঠে বলল,
----" বন্ধ করা যাবে না। অনেক ঘুমিয়েছিস এবার সর। ফজরের আজান পড়ে গিয়েছে। নামাযে যাব আমি। হসপিটালে রুগীর সেবা করতে এসে ঘুমিয়েই পাড় পাস না। থাকতে বলছে কে তোকে? সর জলদি।"
আমি ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলাম। ভারী মাথাটা চেয়ারের পাশের দেয়ালে এলিয়ে দিলাম। উনি হাত-পা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কোন কথা না বলে নিচে নেমে গেলেন। তারমানে সারারাত এভাবেই টানা বসে ছিলেন উনি? হাত-পা ব্যথা করে নি? এই ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর মিলল সকাল দশটায়। দশটার দিকে মামুকে দেখতে এলেন নুরজাহান আন্টি আর উনার দুই ছেলে। করিডোরে দাঁড়িয়ে গল্প করার সময় হঠাৎই প্রশ্ন করলেন নাঈম ভাইয়া,
----" বার বার হাত ঢলছ, কোন সমস্যা শুভ্র?"
শুভ্র ভাই হাসার চেষ্টা করে বললেন,
----" না। কোন সমস্যা নেই। সারারাত চেয়ারে বসেছিলাম তো হাত-পায়ের পেশিতে হালকা ব্যথা করছে। তেমন কিছু না।"
নাঈম ভাইয়া মাথা দুলিয়ে বললেন,
----" ওহ আচ্ছা। রোদেলা? তুমিও হসপিটালে ছিলে নাকি?"
----" জ্বি ভাইয়া।"
----" ওহ্। সেদিনের পর তো আর আমাদের বাসায় গেলে না রোদেলা। নাহিদ প্রায়ই বলে তোমার কথা।"
আমি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে নাহিদ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। নাহিদ ভাইয়া হেসে বললেন,
----" ছাঁদে বেশ কিছু গাছ লাগিয়েছি এবার। তুমি তো গাছ পছন্দ কর, ওটাই বলছিলাম নাঈমকে। গাছ দেখতে অবশ্যই যাবে আমাদের বাসায়। গাছ দেখার নিমন্ত্রণ রইল পিচ্চি।"
আমি হাসলাম। শুভ্র ভাই যে ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি ঝুলিয়ে রেখেছেন তাও বুঝলাম। নাহিদ ভাইয়াকে অযথাই সহ্য করতে পারেন না উনি। নাহিদ ভাইয়া যদি বলে 'ভাত খেয়েছ? ' সেটাও উনার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্রী কথা বলে মনে হবে ৷ আমার ধারণা ঠিক থাকলে এই মুহূর্তে নাহিদ ভাইয়ার প্রতি উনার মনোভাব হল, 'কেন ভাই? সারা ময়মনসিংহ শহরের মধ্যে কি শুধু তোর বাসার ছাঁদেই গাছ আছে? আর কোথাও গাছ নাই? তোর বাসাতেই গাছ দেখতে যেতে হবে কেন? শালা মতলববাজ।' কথাটা ভেবেই হুহা করে হাসতে ইচ্ছে করল আমার। আমাকে হাসতে দেখে প্রশ্ন ছুঁড়লেন নাহিদ ভাইয়া,
----" পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন পিচ্চি? পরীক্ষার ডেইট বোধহয় আজকালের মাঝে পড়ে যাবে।"
----" জ্বি, মোটামুটি।"
----" এডমিশন তো দিবে? আমিও হিউমিনিটিসের স্টুডেন্ট ছিলাম। ইংলিশে হেল্প লাগলে বলো। আর ইকোনমিক্সের জন্য নাঈম আছে। এডমিশনের জন্য ইংলিশ খুব ইম্পোর্টেন্ট।"
----" জ্বি ভাইয়া। বলবো।"
----" তোমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছি কাল। আই থিংক চেইক করো নি।"
আমি অস্বস্তি নিয়ে বললাম,
----" সরি ভাইয়া। আসলে, ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট চেইক করা হয় নি। বাসায় গিয়ে একসেপ্ট করে নিব। সমস্যা নেই।"
শুভ্র ভাইয়ের সহ্যের বাঁধ বোধহয় ভাঙল এবার। চাপা রাগ নিয়ে বললেন,
----" রোদ ভেতরে যা। আম্মু কি খাবে জিগ্যেস করে আয়। খাবার কিনতে যাব।"
আমি অবাক হয়ে বললাম,
----" কিন্তু আম্মু তো খাবা..."
----" যেতে বলছি তোকে। আর একটু পর রাহাত ভাই আসবে, উত্তর- দক্ষিণ না দেখে তার সাথে বাসায় যাবি। এখন যা...."
নাঈম ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,
----" বাই রোদেলা। বাসায় গিয়ে রেস্ট নেওয়া উচিত তোমার। সারারাত জেগেছ। "
আমি হাসার চেষ্টা করে দরজা ঠেলে কেবিনের ভেতরে ঢুকলাম। সত্যিই বাসায় ফেরা উচিত। হসপিটালের বাতাসটাও কেমন বিষাক্ত লাগছে এখন। মামানির কাছাকাছি গিয়ে বিরস মুখে প্রশ্ন করলাম,
----" কি খাবে মামানি? তাড়াতাড়ি বলো খাবার কিনতে যাবে।"
মামানি অবাক হয়ে বললেন,
----" খাবার কিনতে যাবে মানে? তোর মা তো খাবার পাঠিয়েছে আবার খাবার কেন?"
----" তোমার ছেলের আমার মায়ের হাতের খাবার পছন্দ না৷ তার টাকা আছে সে খাবার কিনে কিনে খাবারের গোডাউন বানাবে। তাড়াতাড়ি বল কি খাবে। আমি উনাকে জানিয়ে বাসায় ফিরব।"
মামানি কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন,
----" হুম যা। বাসায় গিয়ে রেস্ট নিয়ে কাপড় গুছিয়ে নে।"
----" কাপড় গুছাব মানে?"
----" তোর মামুকে বিকেলে ছুটি দিয়ে দিবে। তোর আম্মুর সম্মতিতে আগামী এক সপ্তাহ তুই আমাদের বাসায় থাকবি।"
আমি আৎকে উঠে বললাম,
----" কি?"
মামানি ভ্রু উঁচু করে বললেন,
----" কোন সমস্যা?"
মামানির প্রশ্নে বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে এলো আমার। উনাকে কি করে বলি, উনার এই অসহ্যকর ছেলেকে গোটা এক সপ্তাহ সহ্য করার মতো সহ্য শক্তি আমার নেই। কথায় কথায় উনার ত্যাড়ামো জাস্ট অসহ্য!
________________________
রাত দশটা। সোফায় বসে চ্যানেলের পর চ্যানেল পাল্টাচ্ছি আমি। মামানি নিজের বরকে নিয়ে ব্যস্ত। সেখানে তো ডিস্টার্ব করা চলে না। শুভ্র ভাইও ঘুমোচ্ছেন। দু'দিনের টানা পরিশ্রমে নেতিয়ে গেছে বেচারা। তবে, উনি ঘুমিয়েছেন বলেই রক্ষা নয়ত উনার ফালতু কাজকর্মে আমাকে এই পৃথিবী ছাড়তে হত। আমি বিরস মুখে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে আছি। কোন চ্যানেলেই ভালো কিছু দেখাচ্ছে না। আমাদের জীবনে এমন কিছু দিন থাকে যে দিনগুলোতে পৃথিবীর কোথাও ভালো কিছু হয় না। যেদিকে তাকাই সেদিকে বিরক্তিকর, অসহ্য ধরনের জিনিস চোখে পড়ে। আজকে নিশ্চয় সেই দিনগুলোর মধ্যে একদিন। সবকিছু খারাপ হওয়ার দিন। আমার খারাপ প্রহরের চিন্তার মাঝখানে রুমের পর্দা ঠেলে বেরিয়ে এলেন শুভ্র ভাই। উনাকে বেরুতে দেখেই টেলিভিশন অফ করে উঠে দাঁড়ালাম। টেবিলে খাবার দিতেই চেয়ার টেনে বসলেন উনি। নিজেকে পার্ফেক্ট কাজের বুয়ার মত ফিল হচ্ছে আজ। আম্মুর ষড়যন্ত্রে শেষ পর্যন্ত কাজের বুয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে সমর্থ্য হলাম আজ। শুভ্র ভাই মুখে খাবার তোলার আগে অভ্যাসবশত জিগ্যেস করলেন,
----" আম্মু খেয়েছে?"
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
----" হুম।"
উনি এবার আমার দিকে তাকালেন। উনার প্রশ্ন বুঝতে পেরে ঝটপট উত্তর দিলাম,
----" আমি পরে খাব। ক্ষুধা নেই। আপনি খান।"
উনি প্লেট থেকে হাত সরিয়ে হাত গুটিয়ে বসে রইলেন। উনাকে নিরুত্তর বসে থাকতে দেখে একঝাঁক বিরক্তি এসে হানা দিল আমার ভ্রু জোড়ার ফাঁকে। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে উনার প্লেটটা টেনে নিয়েই খেতে বসে গেলাম। উনি কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আরেকটা প্লেট নিয়ে খাবার নিলেন। আমার সামনের প্লেটটা টেনে নিয়ে নতুন প্লেটটা আমার সামনে বসিয়ে দিয়ে শান্ত হয়ে বসলেন। ধীরেসুস্থে আমার প্লেট থেকে খেতে শুরু করলেন। আমি বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম,
----" ওটাতে আমি খাচ্ছিলাম।"
উনি ছোট্ট করে জবাব দিলেন,
----" আমিও খাচ্ছিলাম।"
----" আপনি খান নি। শুধু ছুঁয়েছিলেন। আমি তো অনেকটাই খেয়ে ফেলেছি। জোডা হয়ে গেছে।"
উনি চোখ তুলে তাকালেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন,
----" আমি নিজের প্লেট ছাড়া খেতে পারি না।"
উনার কথায় সামনের চোয়ালটা ঝুলে পড়ল আমার। পাগল নাকি লোকটা? নির্দিষ্ট একটা প্লেট ছাড়া খেতে পারে না অথচ অন্যের খাওয়া জিনিসটা খেয়ে চলেছেন। অদ্ভুত.... সেই সাথে বিশ্রী! আমার সামনের প্লেটটাতে খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে এসব কথায় ভাবছিলাম। এমন সময় উনার ফোন বাজল। উনি কন্ঠে গাম্ভীর্য ঢেলে বললেন,
----" হুম। বল।"
অপর পাশের কথাগুলো কান পর্যন্ত পৌঁছাল না। উনি আবারও বললেন,
----" আমিও দেখেছি। ও যে ময়মনসিংহ মেডিক্যালেই ইনটার্ন করছে জানতাম না। হঠাৎ দেখে অস্বস্তিতে পড়েছিলাম।"
আমার দৃষ্টি অযথায় তীক্ষ্ম হয়ে এলো। কান খাঁড়া করে খাবার গিলতে লাগলাম,
----" আগে ছোট ছিল এখন বড় হয়েছে। পরিবর্তনটা তো স্বাভাবিক। আমি অবাক হই নি।"
----"......................................…........."
----" আমার কাছে আহামরি কিছু মনে হলো না। হ্যাঁ, দুর্বলতা কিছু থাকলে থাকতে পারে। বিয়ে করে নি এখনও?"
আমি খাওয়া রেখে উনার দিকে তাকালাম। উনি খেতে খেতেই হাসলেন। হাসিমুখেই বললেন,
----" আরে ধুর! সে কবে কার কথা। তুই আসলেই একটা থার্ডক্লাস। সে ডাক্তার দেখে আমার অনুভূতি চেঞ্জ হয়ে যাবে নাকি? ফাউল আলাপ বাদ দিয়ে রাখ তো। খাচ্ছি আমি।"
উনি ফোন রাখলেন। আমি কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বললাম,
----" ওই মেয়ে ডাক্তারটা আপনার গার্লফ্রেন্ড?"
উনি অবাক চোখে তাকালেন। হেসে ফেলে বললেন,
----" ঠাস করে গার্লফ্রেন্ড বলে ফেললি। তোর আত্মা কাঁপে না?"
আমি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
----" কাঁপবে কেন? আপনারা হলেন পাবলিকিয়ান থাকতেই পারে দু'একটা গার্লফ্রেন্ড। ওই ডাক্তারটাও আপনার গার্লফ্রেন্ড?"
উনি স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। উনার চোখ দেখে মনে হচ্ছে আমার কথা উনার পছন্দ হয় নি। আমি উনার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আবারও প্রশ্ন করলাম। উনি ছোট্ট একটা শ্বাস টেনে নিয়ে হালকা হাসলেন। খেতে খেতে বললেন,
----" একদা এক সময় সে আমার প্রেমিকা ছিল। ওর নাম তাসনিম।"
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
----" কি সুন্দর দেখতে! এতো সুন্দর মেয়ের সাথে ব্রেকআপ কেন হল?"
উনি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। তারপর হাসিমুখেই বললেন,
----" ওকে আমার ভাল্লাগে নাই আর।"
এবার গলায় খাবার আটকে গেল আমার। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। উনি নিজে থেকেই বললেন,
----" তখন ক্লাস টেনে পড়ি। এই বয়সটাতে ফ্যান্টাসি কাজ করে প্রচুর। তখন হয়ত ২০১১ সাল। আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিল তাসনিম। হঠাৎ একদিন চোখে পড়ল। বন্ধুদের বললাম মাইয়াটা চরম। সেদিন থেকেই বন্ধুরা ভাবি ভাবি বলে চিল্লাচিল্লি শুরু করল। আমার মধ্যেও ফ্যান্টাসি কাজ করতে লাগল। পড়তে বসে হঠাৎ তাসনিমের কথা মনে হতেই ভাবলাম নির্ঘাত প্রেমের লাস্ট লেভেলে এসে গিয়েছি, মেয়েটাকে না পটালে আর হচ্ছে না। আমাদের স্কুলেই তখন কোচিং ক্লাস হত। এক সপ্তাহ পর, সিদ্ধান্ত নিলাম প্রোপোজ করব। সারাদিন বেশ এক্সাইটমেন্টে কাটলো। রাত আটটায় কোচিং শেষ করে তাসনিম বের হতেই হাত চেপে ধরলাম। বললাম,' আই থিংক আই এম ইন লাভ উইথ ইউ।' তাসনিম কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে লাজুক হাসল। বললো, সেও নাকি সেইম ফিল করে। তার কথা শুনে আমি চরম অবাক। মেয়েটা আগে থেকেই পটে আছে। বন্ধুদের ট্রিট দিয়ে হুলস্থুল কান্ড বাঁধালাম। স্কুলের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে চুটকিতে পটিয়ে ফেলেছি, সাংঘাতিক ব্যাপার। দ্বিতীয় দিন তাসনিমের কথায় স্কুল বাম্প করে তাসনিমকে নিয়ে ফুসকা খেতে গেলাম। হাত ধরাধরি করে এখানে সেখানে ঘুরলাম। একটা সিনেমাও দেখেছিলাম সিনেমা হলে। কি যেন একটা সিনেমা চলছিল তখন। বেশ হিট সিনেমা। সিনেমা দেখে কোচিং ক্লাস কমপ্লিট করে বাসায় ফিরলাম। সেই দ্বিতীয় দিন থেকেই তাসনিমের প্রতি ইন্টারেস্ট কমে এলো আমার। ধীরে ধীরে ওর প্রতি বিরক্তি কাজ করতে লাগল। এসব জান, কলিজা ঢং আমার আজও ভালো লাগে না তখনও ভালো লাগত না। তাই সাতদিনের মাথায় বললাম ব্রেকআপ। কিন্তু তাসনিম কিছুতেই রাজি নয়। তার জীবন নাকি আমাকে ছাড়া অন্ধকার। আমি তাকে বুঝালাম, বুঝল না। শুরু হলো ওকে এবোয়েড করা। এক মাসের মাথায় তাসনিম সুইসাইড এট্যাম্প করল। আমি অবাক। আমি ওর সাথে এমন কিছুই করি নি যার জন্য ওর জীবন শেষ করে দিতে হবে। শুধু হাতটাই ধরেছিলাম তবু ও ধরতে বলেছিল বলে। ওর বাবা-মা জানল ব্যাপারটা। আমাকে এসে রিকুয়েষ্ট করল রিলেশন রাখার জন্য। ব্যাপারটা তখন চরম রকম মেজাজ খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়াল। তাসনিমের বাবা আমাকে হুমকি দিল উনি পুলিশ কেইস করবেন। আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। তাসনিমের বাসায় গিয়ে ওর গালে ঠাডিয়ে দুটো চড় বসিয়ে দিয়ে এলাম। ওর বাবা-মা হতবাক। পরের দিন জানতে পারলাম তাসনিম আবারও সুইসাইড এট্যাম্প করেছে। তখন আমার টেস্ট পরীক্ষা চলে। তাসনিমের বাবা আবারও আমায় শাসালেন। আমিও ঠান্ডা গলায় বললাম, ' যান। এখান থেকে পুলিশ স্টেশন যেতে দশ টাকা ভাড়া লাগে। দশ টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি। অ্যাফায়ার করে আমাকে একটা কল করবেন। আপনার বাসায় গিয়ে আপনার মেয়েকে আগে খুন করব তারপর দশ টাকা ভাড়া দিয়ে পুলিশ স্টেশন চলে যাব। সমস্যা নেই। এখন শুধু শুধু চিল্লাচিল্লি করবেন না। পরীক্ষার টেনশনে মেজাজ খারাপ। আম্মু বলেছে নাইন্টি প্লাস মার্কস আনতে। আপনার কারণে তা এইট্টিতে নেমে গেছে। যান প্লিজ।' লোকটা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। সেবার আর এসএসসি পরীক্ষা দেয় নি তাসনিম। ওর বাবা ওকে অন্য স্কুলে আবারও দশম শ্রেণিতে ভর্তি করেছিলেন। তারপর আর তাসনিমের খবর টবর নিই নি আমি। আজ এতো বছর পর হসপিটালে হুট করে দেখা হয়ে যাবে ভাবি নি। ওর এক্সপ্রেশন দেখে মনে হল আমাকে পেয়ে সে ভীষণ খুশি হয়েছে। তুষার বলল তাকেও নাকি জিগ্যেস করেছিল আমার কথা। ওর এতো ইন্টারেস্ট আর খুশি হওয়া দেখেও অবাক হয়েছি।"
এটুকু বলে থামলেন উনি। আমি চোখ-মুখ কুঁচকে বললাম,
----" আপনি কতটা হার্টলেস। মেয়েটা আপনাকে কত ভালোবাসত।"
উনি স্বাভাবিক গলায় বললেন,
----" তো?"
----" তো মানে? সে আপনাকে ভালোবাসতো তার কোনো গুরুত্ব নেই আপনার কাছে? এতো পাগলামোর পরও ওকে ভালোবাসতে পারলেন না?একটুও না?"
----" ওকে আমার ভালো লাগে না।"
উনার কথায় তেতে উঠলাম আমি। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
----" ভালো লাগে না মানে কি? আপনার কাছে ভালোবাসাটা ভালোলাগার মধ্যে সীমাবদ্ধ? কাল ভালো লাগবে না তাহলে পরশু ছুড়ে ফেলবেন?"
উনি শক্ত গলায় বললেন,
----" এতো হাইপার হওয়ার কিছু নেই। সেটা কিশোর বয়সের আবেগ ছিল। আর এমন তো নয় ওকে বছরব্যাপী ইউজ করেছি আমি। সাত দিনের মাথায় ব্রেকআপ করেছিলাম।"
আমি নরম গলায় বললাম,
----" মেয়েটা আপনাকে ভালোবাসতো। "
----" আই ডোন্ট কেয়ার।"
-----" ভালোবাসাটা আপনার কাছে কিছুই না? ইউজলেস তাই না?"
উনি হেসে বললেন,
----" আমার ভালোবাসা ছাড়া অন্যেরটা আমার কাছে ইম্পোর্টেন্ট নয়। আমি এমনই... আনফরচুনেটলি তোর ভাগ্যটা খারাপ।"
আমি বিরবির করে বললাম,
----" হার্টলেস। "
উনি হাসলেন। খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার চোখের দিকে তাকালেন। বললেন,
----" থেংক গড আমি হার্টলেস। আর তাই হয়তো আরেকজন হার্টলেসের পেছনে পড়ে আছি বছরের পর বছর।"
এটুকু বলে থামলেন উনি। আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন,
----" আই এম হ্যাপি ফর বিং হার্টলেস এন্ড আই এম হ্যাপি ফর হ্যাভিং দিস হার্টলেস বার্ড।"
উনার চোখদুটো গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার চোখে। সেই চোখে হাজার খানেক মায়া। হাজার আকুতি আর বুক ভরা প্রেম। আমার হঠাৎ করেই মনে হল উনার চোখ হাসছে। সেই সাথে হাসছে ভালোবাসায় ভরপুর মস্ত এক মন......ভালোবাসাময় অদ্ভুত এক হৃদয়।
২২
ঘড়িতে চারটা বাজে। সারা ঘরময় পায়চারি করছি আমি। ঘুম, উপন্যাসের বই, ফেসবুক কোনো কিছুতেই মন বসানো যাচ্ছে না। কখনও চাপা রাগ তো কখনও চাপা কান্নায় নিজেকে অসহায় অসহায় লাগছে। কিছুক্ষণ ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে থেকেই ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। নিজের রুম থেকে বেরিয়ে শুভ্র ভাইয়ের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ফিসফিস করে ডাকলাম,
-----" শুভ্র ভাই? শুভ্র ভাই?"
শুভ্র ভাই একটু নড়ে চড়ে চোখ মেলতেই আৎকে উঠলেন। মোবাইলের ফ্ল্যাশে চোখ-মুখ কুঁচকে নিয়ে নিজের অবস্থান বুঝার চেষ্টা করলেন। হাত বাড়িয়ে আলো জ্বালিয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। উনি ধমক দেওয়ার আগেই থমথমে গলায় বলে উঠলাম আমি,
-----" তাসনিম ছাড়া আর ক'জন গার্লফ্রেন্ড ছিল বা আছে বলুন তো।"
উনি বিস্মিত চোখে তাকালেন। হঠাৎ করেই কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। ডানহাতে নিজের চুলগুলো পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে টি-শার্টের কলার ঠিক করলেন। আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলেন। বললেন,
-----" ইশ! ভীষণ জ্বলে না?"
উনার ত্যাড়াব্যাকা কথা শুনেই মেজাজ বিগড়ে গেল আমার। রাগী চোখে তাকিয়ে বললাম,
-----" যা বলেছি তার উত্তর দিন।"
উনি ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
-----" তোর জেনে লাভ?"
আমি রাগী চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। কটমটে গলায় বললাম,
-----" নাহ্ এক্চুয়েলি আপনি তো প্রেমিক পুরুষ তাই অনেক মেয়েই চান্স টান্স খুঁজে। আমি আবার খুবই দয়ামহ নারী..... নাহিদ ভাইয়া ম্যাসেজে বলছিল যে... "
এটুকু বলতেই জ্বলে উঠলেন শুভ্র ভাই। বিছানা থেকে নেমে খপ করে আমার হাত চেপে ধরে বললেন,
-----" নাহিদ তোর নাম্বার কই পেল?"
আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,
-----" তা জেনে আপনার লাভ?"
উনি আমর দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
-----" অনেক লাভ। এখন বল।"
আমি শক্ত গলায় বললাম,
-----" আপনার লাভ আপনার কাছে। আমার তো কোনো লাভ নেই। সো বলব না। হাত ছাড়ুন..... মামানি জেগে আছেন এখনও।"
উনি হাতটা সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরে বললেন,
-----" বাড়াবাড়ি করলে খুন করে দেব বলে দিলাম। স্পষ্ট এবং সহজ ভাষায় বলছি নাহিদকে আমার ভালো লাগে না। আমার ভালো লাগে না মানেই তোর জন্য নিষিদ্ধ। এটাকে স্বাধীনতা হরণ ভাবলে তাই। আমার ঘুম, জীবন সবকিছুই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিলি তুই। কিন্তু অন্যকারো নিদ্রাভঙ্গের কারণ হয়েছিস তো খবর আছে....."
কথাটা বলে ধীরে সুস্থে আমাকে রুম থেকে বের করে দরজা লাগালেন উনি। রাগ আর অপমানে টলমলে চোখে রুমে ফিরে এলাম আমি। মনে মনে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। যায় হয়ে যাক না কেন, 'এই লোকের সাথে কথা বলা চলবে না। কিছুতেই না।'
_______________________
মামুর বাসায় কাজের মেয়ের রুল প্লে করার আজ দ্বিতীয় দিন চলছে। সেই সাথে শুভ্র ভাইয়ের প্রতি বিরক্তিটাও হুহু করে বাড়ছে। আজাইরা হুকুম কাকে বলে? কত প্রকার? এবং কি কি? তা খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন শুভ্র ভাই। শুভ্র ভাইয়ের শোবার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। বারান্দার পাশ ঘেঁষে কয়েকটি ক্যাকটাস গাছ লাগানো। তার মধ্যে 'রোজ ক্যাকটাস' গাছে রক্তলাল ফুল ফুটেছে। ফুলটাকে দেখতে ভীষণ আদর আদর লাগছে। আমি দু'পা এগিয়ে ফুলটাকে ছুঁতে যাব ঠিক তখনই রুম থেকে তীক্ষ্ণ রিংটোনের শব্দ কানে এলো। রিংটোনের শব্দকে অনুসরণ করে রুমের ভেতরে উঁকি দিতেই বিছানায় শুভ্র ভাইয়ের ফোনটা পড়ে থাকতে দেখা গেল। আমি ভ্রু কুঁচকে এদিক ওদিক তাকালাম। ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার আওয়াজ আসছে। আমি উঁকিঝুঁকি দিতে দিতেই ফোনটা কেটে গেল। প্রায় সাথে সাথেই নতুন উদ্যমে আবারও বাজতে লাগল মুঠোফোন। আমি কৌতূহল নিয়ে এক-দু পা এগিয়ে গেলাম। ভ্রু কুঁচকে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই আননোন একটা নাম্বার জ্বলজ্বল করে উঠল। ফোনটা আবার কেটে আবারও বাজতে লাগল। ডায়ালকারীর উদ্যম দেখে মনে হচ্ছে রিসিভ করার আগপর্যন্ত সে থামবে না। কিছুতেই না। আমি হাজারো দ্বিধা আর অস্বস্তি নিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিলাম। রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে রিনরিনে কন্ঠে সালাম দিল একটি মেয়ে। আমি নার্ভাস গলায় সালামের জবাব দিয়ে জিগ্যেস করলাম,
-----" কে বলছেন?"
-----" আমি তাসনিম সিদ্দিকী। এটা আবরার আহমেদ শুভ্রর নাম্বার না?"
আমার কপাল কুঁচকে এলো। শক্ত গলায় বললাম,
-----" জ্বি। এটা উনারই নাম্বার।"
-----" তাহলে আপনি কে? শুভ্র কোথায়?"
------" আমাকে আপনি চিনবেন না। উনি একটু ব্যস্ত আছেন। আপনার কিছু বলার থাকলে আমায় বলতে পারেন। আমি উনাকে বলে দিব।"
-----" না। ঠিক আছে। ওর সাথে আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত কথা ছিল। কিন্তু আপনি ওর কি হোন? বোন?"
মেয়েটা বেশ নম্রভাবে কথা বললেও রাগে মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল আমার। মেয়েটা ভুক্তভোগী, তার সাথে সহানুভূতির দৃষ্টিতে কথা বলা উচিত এসব মহান বাণী তখন নিতান্তই বিরক্তকর এবং অবান্তর বলে বোধ হতে লাগল। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললাম,
-----" আপনার তাই মনে হচ্ছে? "
-----" উহু। আমার অন্য কিছু মনে হচ্ছে। কিন্তু সেই মনে হওয়াটাকে পাত্তা দিতে চাইছি না। এই না চাওয়ার পেছনে কোনো কারণ নেই তবুও চাইছি না। আমার ধারণা আপনি বিশেষ কেউ।"
আমি হালকা হেসে বললাম,
-----" আপনার এমন কেন মনে হচ্ছে?"
-----" এইযে প্রথম থেকেই 'উনি' 'উনি' করে বলছেন। নিজের ভাইকে কেউ আপনি করে বলে না। আর আমি শুভ্রকে যতটুকু চিনি ওর পার্সোনাল জিনিসে হাত দেওয়ার সাহস সবার হয় না। কিন্তু আপনার মাঝে ভয় বা অস্বস্তির ছিটেফোঁটা নেই। তারমানে আপনি অবশ্যই এমন কেউ যাকে শুভ্র এসব বিষয়ে কোনো বাধা নিষেধ দেয় না।"
আমি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললাম,
-----" আপনি কিন্তু ভীষণ সুন্দরী। আপনি এতো সুন্দরী বলেই হয়ত আপনাকে আমার খুব একটা পছন্দ হয় না।"
মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসিমুখে বলল,
-----" কেন? সুন্দরী মেয়েরা বুঝি অপছন্দনীয় হয়?"
-----" না। তা হয় না। কিন্তু কিছু মানুষকে চাইলেও মন থেকে পছন্দ করা যায় না। আমার মনে হয় আপনি ওই ক্যাটাগরির মানুষ।"
তাসনিম জবাব না দিয়ে বলল,
-----" আপনিও ঠিক শুভ্রর মতোই মুখের ওপর বলে দেন সব। আচ্ছা? আমি যে সুন্দরী কিভাবে জানলেন? দেখেছেন কখন? শুভ্র দেখিয়েছে?"
-----" উহু। হসপিটালে দেখেছিলাম। উনি বলেছিলেন আপনি তার প্রাক্তন।"
তাসনিম কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বিস্ময় নিয়ে বলল,
-----" শুভ্রর পাশে বসে থাকা ওই পিচ্চিটা তুমি?"
আমি কিছু বললাম না। শুভ্র ভাই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। কপাল কুঁচকে বললেন,
-----" কার সাথে কথা বলিস?"
আমি ফোনটা এগিয়ে দিয়ে থমথমে গলায় বললাম,
-----" আপনার বাচ্চা কালের প্রেমিকা।"
আমার কথায় বেশ অবাক হলেন উনি। ফোনটা কানে নিয়ে ভরাট গলায় বললেন,
-----" হ্যালো? কে বলছেন?"
কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেসে উঠলেন উনি। ফোনটা সরিয়ে ঠোঁটের ইশারায় আমায় খাবার দিতে বলে আবারও ফোন কানে নিলেন। উনার এই গদগদে হাসি দেখেই রাগে উনার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলার অদম্য ইচ্ছে জাগতে লাগল আমার। পুরাতন প্রেমিকার সাথে এতো আনন্দে মত্ত হয়ে কে কথা বলে শুনি? সবক'টা একরকম। সুন্দরী মেয়ে দেখলে এরা দুনিয়া ভুলে যায়। নির্ঘাত এখন পুরনো প্রেম জেগে উঠবে তাদের। তারপর শুরু হবে আদিক্ষেতার দ্বিতীয় পর্যায়। কথাগুলো ভাবতেই নিজেকে ভীষণ অসহায় অনুভূতি হতে লাগল আমার। জীবনের কোনো একটা অংশ ধসে পড়ার সতর্কবার্তা যেন খিলখিল করে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে লাগল। আমি বিছানা থেকে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। ভঙ্গ মন নিয়ে শুনতে লাগলাম উনার প্রাণোচ্ছল কন্ঠস্বর,
-----" ওর অনেকগুলো নাম আছে। ওসবে কিছু মনে করো না। তোমাকে হয়ত তার ঠিক পছন্দ হয় নি। দেখা হলে ঠিক মিশবে...."
২৮
আকাশ মেঘলাটে। দু'ঘন্টার টানা বৃষ্টির পর রাস্তার পাশের গাছগুলো কাচের মত ঝকঝক করছে। ব্যালকণির পাশে থাকা মাঝারি আকারের হিজল গাছটির পাতা চুইয়ে এক দু'ফোটা বৃষ্টির জল গড়াচ্ছে। এক পাতা থেকে অন্য পাতায় জল গড়িয়ে পড়তেই অদ্ভুত সুরে বেজে উঠছে 'টপটপ, টপটপ'। বাসার সামনের পিচ ঢালা বিশাল রাস্তাটার এখানে সেখানে ঘোলাটে পানি জমে আছে। কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর চলন্ত রিকশা,অটোরিকশার চাকার চাপে ছিটকে ওঠে আরো একটু ঘোলাটে রঙে রাঙা হচ্ছে । সামনের বিল্ডিংয়ের কাঁটাতারে মোড়া প্রাচীরটিতে অলস ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছে একটি শুভ্র বিড়াল। বিড়ালটি দু- এক পা এগিয়েই ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। বার কয়েক অলস ভঙ্গিতে 'মেও' 'মেও' করে আবারও রাজকীয় চালে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি ব্যালকণির ভেজা গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। টবে লাগানো পাতা বাহারি গাছগুলো কিছুদিন হল কচি ডালপালা ছেড়েছে। বৃষ্টির সংস্পর্শে তাদেরকে দেখাচ্ছে উচ্ছল কিশোরীর মত। ডানহাতে গাছের কচি লতায় হাত বুলাতেই পাতা চুইয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল হাতে। সেই সাথে ভারী চোখ জোড়াতেও নামল জলের বহর। আমি মুখ ফুলিয়ে শ্বাস টেনে নিয়ে আবারও রাস্তার দিকে তাকালাম। মনটা ভীষণ খারাপ আজ। চোখদুটোও অভিমানে ফুলে ফেঁপে আছে। ঈর্ষান্বিত মনটা বার বারই বলে উঠছে, 'শুভ্র নামক ছেলেটা তাসনিম নামক অতি সুন্দরী মেয়েটার সাথে কথা বলবে কেন? যদিও বা বলে, কথার সাথে সাথে চমৎকার সেই হাসিটাই বা দেবে কেন? তবে কি শুভ্র তাকে ঝংকার তোলা সেই হাসি শোনার অধিকারটা দিয়ে দিল? সত্যিই দিয়ে দিল?' কথাগুলো ভাবতেই আবারও চোখের কোণা চিকচিক করে উঠল। নিজেকে পৃথিবীর সব চেয়ে দুঃখী আর অসহায় বলে বোধ হতে লাগল। সুপ্ত মনটা তাসনিম নামক প্রাণীটাকে কল্পনা করতে লাগল ভয়ানক ডাইনি রূপে। সেই সাথে আমি হয়ে উঠলাম দুর্সাহসী রাজকন্যা। যার কাছে আস্ত একটা জাদু ঝুলি থাকবে। রাজপুত্রকে...... আমার ভাবনার মাঝেই রাস্তা থেকে ছেলেদের কোলাহলের আওয়াজ কানে এলো। আমি ঘাড় এগিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই ১৪/১৫ বছরের পাঁচ-ছয়জন ছেলেকে দেখতে পেলাম। সবার প্যান্টের পকেটেই বই-খাতার অংশাবশেষ দেখা যাচ্ছে। টিউশনি ফেরত ছেলেগুলো গোল হয়ে দাঁড়িয়ে বেল পুড়ি খাচ্ছে আর হাসাহাসি করছে। তাদের বেল পুড়ি খেতে দেখে আমার কষ্টটা যেন আকাশ ছুঁলো। বেল পুড়ি খেতে না পাওয়ার দুঃখে চারতলা থেকে লাফিয়ে আত্মাহুতি দেওয়ার মত ভয়ানক চিন্তাও ঘুরপাক খেয়ে গেল পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে। কিছুক্ষণ মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর পাশের ব্যালকণিতে থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন কেউ,
-----" এই সাইম? খাওয়া শেষ হলে উপরে বেল পুড়ি দিয়ে যাস তো।"
সাইম উপরের দিকে তাকাল। ব্যালকণিতে শুভ্র ভাইকে দেখতে পেয়ে মুচকি হাসল। চেঁচিয়ে উঠে বলল,
----" কয় প্লেট ভাইয়া?"
শুভ্র ভাই আমার দিকে তাকালেন। আমি মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। শুভ্র ভাই হালকা কেশে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। কিন্তু লাভ বিশেষ হল না। আমি উল্টো দিক তাকিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। শুভ্র ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
----" ম্যাডাম? ছোট্ট পেটটাতে কতটুকু জায়গা হবে?"
আমি উত্তর দিলাম না। শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চেঁচিয়ে উঠে বললেন,
----" মামাকে সবগুলো দিয়ে দিতে বল। ঠেলাতে যতগুলো আছে সব।"
আমি চমকে উঠে উনার দিকে তাকালাম। বিস্ময় নিয়ে বললাম,
----" কিহ! পাগল? এতো খাবে কে?"
শুভ্র ভাই হাসলেন। ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
----" বাহ্ কথা ফুটল তাহলে? তো? কয় প্লেট চায়?"
আমি মুখ ভেঙিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। সাইমকে ইশারা করে বললাম,
----" দুই প্লেট।"
সাইম চেঁচিয়ে উঠে বলল,
----" দুই প্লেট শুভ্র ভাই?"
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
----" ম্যাডাম যা বলে তাই।"
শুভ্র ভাইয়ের কথাটা শেষ হতেই রাস্তার কিনারায় কাজিনদের দল চোখে পড়ল। তাদের পেছনেই ভারিক্কি চালে হেঁটে আসা বাবা, মা, ছোট ফুপ্পি, ফুপাসহ সবাই। সাইমকে বেল পুড়ির কথা বলতে দেখেই নিচ থেকে সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন আলিফ ভাই,
----" শুভ্র ভাই? সব বিল তোমার।"
----" জিন্দেগীতে না। তোরা আমাকে ফকির বানিয়ে ছাড়বি।"
পাশ থেকে অদুদ ভাইয়া বললেন,
----" ওমন করছ কেন? তুই বড়লোক্স মানুষ। আমাদের মতো মিসকিনদের ওপর দয়ামায়া দেখা ভাই।"
শুভ্র ভাইকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বেল পুড়ির ঠেলার ওপর হামলে পড়ল সবাই। শুভ্র ভাই অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
----" তোর ভাই সম্প্রদায় একদিন আমায় পাগল করে ছাড়বে। তোদের গোষ্ঠীতে কি সবাই পেটুক নাকি? শালার শালাময় ঝামেলা সব!"
উনার কথায় ফিক করে হেসে ফেললাম আমি। উনি ধমকী ধামকী দিয়ে আমাকে নিয়ে নিচে নেমে গেলেন। সারাদিনে জমিয়ে রাখা অভিমানগুলো যেন রঙিন প্রজাপতি হয়ে আকাশময় উড়ে বেড়াতে লাগল। ভালোবাসাময় বিশাল আকাশটাকে শুধু এবং শুধুই আমার নামে লিখে দিল!
___________________
এই পৃথিবীতে জন্মানোর পেছনে প্রত্যেকটা মানুষের আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য থাকে। শুভ্র ভাইয়েরও আছে। আমার ধারণা ঠিক হলে, তার জন্মানোর পেছনে প্রথম এবং একমাত্র উদ্দেশ্য হল আমাকে বিরক্ত করা। আর আমার উদ্দেশ্য হল উনার উদ্ভট কথাবার্তায় সাধ্যাতীত বিরক্ত হওয়া। আজও তাই হচ্ছি। চোখে-মুখে এক আকাশ বিরক্তি টেনে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। শুভ্র ভাই এদিক-ওদিক কিছু একটা খুঁজছেন। কিছুক্ষণ খুঁজাখুঁজির পর স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। ভ্রু কুঁচকে আমাকে নিচ থেকে উপর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলেন। কপাল কুঁচকে বললেন,
----" সোজা হয়ে দাঁড়া। এভাবে বেঁকে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?"
উনার কথায় চোখ-মুখ কুঁচকে তাকালাম আমি। নিরস গলায় বললাম,
----" আপনার প্রয়োজনটা কি সেটা বলুন। আমি বেঁকে দাঁড়িয়ে আছি নাকি স্ট্রেইট দাঁড়িয়ে আছি সেটা কোনো ইম্পোর্টেন্ট বিষয় নয়।"
শুভ্র ভাই অনামিকা আঙ্গুলে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন,
----" অবশ্যই ইম্পোর্টেন্ট। বেঁকে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো পোলিও রুগীকে তো আর কাজের হুকুম দেওয়া যায় না। তারা এমনিতেই রুগী। রুগীদের কাজ করার অনুমতি নেই।"
----" তাহলে আমিও রুগী। এবার দয়া করে নিজের কাজটা নিজে করুন।"
কথাটা বলে ঘুরে দাঁড়াতেই লম্বা বিনুনি টেনে ধরলেন উনি। আকস্মিক বাধায় ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলাম আমি। চুলে হাত দিয়ে উনার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাতেই নির্মল হাসি হাসলেন। বিনুনিটা আরো একদফা টেনে দিয়ে মিষ্টি করে গাইলেন,
----" You're light, you're the night
you're the color of my blood
you're the cure, you're the pain
you're the only thing I wanna
touch....."
উনার হঠাৎ গেয়ে উঠায় বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলাম আমি। উনি নিচের ঠোঁট কামড়ে চোখ টিপলেন। ফিচেল গলায় বললেন,
----" ইংরেজি টিংরেজি আদৌ বুঝিস? কি যন্ত্রণাদায়ক ফিলিংস হচ্ছে বুঝতে পারছিস?"
আমি সরু চোখে তাকালাম। উনার কথার আগামাথা বুঝতে না পেরে হঠাৎই ভীষণ বিরক্ত বোধ করলাম। উনি কয়েক পা এগিয়ে একদম আমার সামনাসামনি এসে দাঁড়ালেন। আমি সরে যেতে নিতেই চুলের বিনুনিতে টান পড়ল। উনি ফিচেল হেসে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে এলেন। উনার এমন ব্যবহারে হঠাৎই ভীষণ হকচকিয়ে গেলাম আমি। ভ্রু কুঁচকে বার কয়েক ঢোক গিললাম। উনি আরো খানিকটা ঝুঁকে এসে হাতের চাবিটা চোখের সামনে উঁচু করে ধরলেন। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,
----" 'চাবি' কোন ভাষার শব্দ?"
এতো ঢং করার পর উনার এমন প্রশ্নে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি কিছুটা সরে গিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
----" বল।"
আমি চোখ পিটপিট করে তাকালাম। সন্দেহী গলায় বললাম,
----" আপনি আমায় পড়াচ্ছেন?"
আমার কথায় হেসে ফেললেন উনি। হাসি চেপে বললেন,
----" কেন? তুই কি গভীর কিছু ভেবেছিলি নাকি?"
উনার মুখে পর পর এমন সব কথা শুনে চোয়াল ঝুলে পড়ার জোগাড় হল আমার। কপট রাগ নিয়ে বললাম,
----" আপনি....আপনি আসলেই একটা বদমাশ।"
উনি হাসলেন। আলমারি থেকে একগাদা কাপড় বের করে বললেন,
----" আচ্ছা? তাহলে 'বদমাশ' শব্দটা কোন ভাষা থেকে এসেছে, বল তো? আমার ওপর একটা শব্দ প্রয়োগ করবি আর সেই শব্দটা কোন ভাষার মেহমান তা জানবি না, তা তো মেনে নেওয়া যায় না। বল বল।"
আমি নাক ফুলিয়ে উনার দিকে তাকালাম। বিনুনিটা টেনে ছাড়িয়ে নিয়ে মুখ ভেঙিয়ে রুম থেকেই বেরিয়ে এলাম। উনি চেঁচিয়ে উঠে বললেন,
----" আরে! যাচ্ছিস কই? আমার জামা-কাপড় ধুয়ে দিয়ে যা। চার পাঁচ বছর পর তো বরের কাপড়-চোপড় ধুয়েই জীবন কাটবে। এখন থেকেই ট্রাই কর, বুঝলি?"
আমি দরজার বাইরে থেকে মাথা হেলিয়ে উনার দিকে তাকালাম। ডানপাশের চুলগুলো কানে গুঁজে দিয়ে বললাম,
----" জি নট। নিজের কাজ নিজে করতে শিখুন। চার-পাঁচ বছর পর তো বউয়ের কাপড়-চোপড় ধুয়ে ধুয়েই জীবন কাটবে। এখন থেকে শিখে রাখলে ভালো হয় না? তাছাড়া, আমার বর আমাকে ওয়াশিং ম্যাশিন কিনে দেবে। হুহ।"
শুভ্র ভাই হেসে ফেললেন। কাপড়গুলো বিছানায় রেখে হাত ভাজ করে দাঁড়ালেন। সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,
----" তাই নাকি? তোর বর এতো ভালো হবে বলে তো মনে হচ্ছে না। আমার সিক্স সেন্স বলছে....... "
----" আপনার ফালতু সিক্স সেন্সের গল্প আমি শুনব না।"
----" আরে, শোন তো। আমি তো তোকে রোমান্টিক উপন্যাস শুনাচ্ছি না। আমি তোকে কঠিন বাস্তবতার গল্প শুনাচ্ছি।"
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
----" আমি আপনার কঠিন বাস্তবতার গল্প শুনতে ইচ্ছুক নই।"
উনি ঠোঁট টিপে হাসলেন। এগিয়ে এসে আমার সামনাসামনি দাঁড়ালেন। ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
----" তাহলে কি রোমান্টিক উপখ্যান শুনতে চাস? তুই শুনতে চাইলে আমি....."
উনার কথার মাঝেই কলিংবেল বাজল। উনি সামনের দিকে উঁকি দিতেই কিছুটা সরে দাঁড়ালাম আমি। বসার ঘরের দিকে যেতে যেতে ঝাঁঝালো গলায় বললাম,
----" এসব রোমান্টিক উপখ্যান আপনার বাচ্চাকালের প্রেমিকাকে শুনান। আমাকে নয়.... মেয়েবাজ পুরুষ মানুষ!"
উনি হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরার চেষ্টা করে বললেন,
----" এই যে আম্মুর ছেলের বউ? আমার কাপড়গুলো তো ধুয়ে দাও!"
উনার কথা শুনেও না শোনার ভান করে বসার ঘরে এসে দাঁড়ালাম। সোফায় উবু হয়ে মোবাইলে গেইম খেলছেন আলিফ ভাইয়া,রাতুল ভাইয়া আর তুষার ভাইয়া। দরজার বিকট কলিংবেলের শব্দেও তাদের ধ্যান ভঙ্গ হচ্ছে না। আমি কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বাঁকা চোখে তাকালাম। শক্ত গলায় বললাম,
----" আশ্চর্য! এইখানে বসে থেকেও দরজা খুলছ না কেন?"
আলিফ ভাইয়া ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়েই জবাব দিলেন,
----" কভার দিচ্ছি। সামনে থেকে সর তো! গেইমে হারলে তোর খবর আছে।"
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। মনে মনে তৎক্ষনাৎ শক্ত একটা দোয়া করলাম। মুখে বললাম,
----" কভার দিচ্ছি! এমন একটা ভাব যেন পৃথিবী উদ্ধার করে ফেলছে। আজাইরা পাবলিকের আজাইরা কাজ।"
কথাগুলো বলে এক মুহূর্ত দাঁড়ালাম না আমি। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অস্থির মানুষটাকে মুক্ত করতে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। কপাল কুঁচকে বিরবির করতে করতে দরজা খুলতেই একজোড়া কৌতূহলী চোখের ওপর চোখ পড়ল। মহিলাটি আমাকে আগাগোড়া নিরক্ষণ করে বললেন,
----" বাড়ির বউয়ের এটা কেমন ব্যবহার? মুরুব্বিদের যে সালাম দিতে হয়, জানে না নাকি? মাথায় কাপড়টাও নাই।"
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। 'আমি শুভ্রর বউ' এই ধারণাটা এখনও উনি মনেপ্রাণে ধারণ করে রাখায় বেশ অবাক হলাম। এই মহিলার কি কমন সেন্স লেভেল জিরো? আমাকে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিক্ত মুখে তাকালেন উনি। আমার হাতটা সরিয়ে নিজে নিজেই ঘরে ঢুকে গেলেন। তার পেছন পেছন ঢুকল পিংকি নামের মেয়েটি। আমি দরজাটা লাগিয়ে সরু চোখে তাকিয়ে রইলাম। মহিলাটি বসার ঘরের সোফার দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। চোখ ছোট ছোট করে বললেন,
----" তোমরা কে? কে হও?"
আলিফ ভাই মুখ তুলে না তাকিয়েই বলল,
----" আপনি যা ভাবছেন তাই।"
----" মানে?"
রাতুল ভাই মুখ তুলে তাকালেন। আমাকে ইশারা করে থমথমে গলায় বললেন,
----" ওর ভাই।"
মহিলাটি একবার আমার দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবারও রাতুল ভাইয়ার দিকে তাকালেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,
----" তোমরা সবাই বউয়ের ভাই?"
আলিফ ভাইয়া বললেন,
----" কেন? কম মনে হচ্ছে? আরো দু'জন ছাদে আছে। একজন ভেতরের ঘরে ঘুমাচ্ছে। আর দু'জনকে বাসায় রেখে আসছি। আরও দুই একটা পৃথিবীতে ল্যান্ড করবে করবে ভাব। আই মিন, প্রক্রিয়া চলছে।"
মহিলাটি সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। আলিফ ভাইয়া উনার সাথে মজা করছেন কিনা বুঝার চেষ্টা করছেন। আমি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে আছি। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর কিছু বলার জন্য মুখ খু্ললেন উনি। ঠিক তখনই শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে এলেন শুভ্র ভাই। মহিলাটিকে দেখে মিষ্টি করে হাসলেন। কাছাকাছি দাঁড়িয়েই হাস্যোজ্জল কন্ঠে বললেন,
----" আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?"
এতোক্ষণ উল্টাপাল্টা উত্তর পেয়ে অনেকটাই বিরক্ত ছিলেন মহিলা। শুভ্র ভাইয়ের কথায় বিরক্তিটা কাটিয়ে প্রফুল্ল মনে হাসলেন। গদগদ কন্ঠে বললেন,
----" ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা। তুমি ভালো আছ তো? কি লক্ষ্মী একটা ছেলে। দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। তোমার মা কোথায়? শুনলাম তোমার বাবা স্টোক করেছেন? তাই দেখতে এলাম।"
শুভ্র ভাই হাসলেন। নম্র গলায় বললেন,
----" আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আম্মু রুমেই আছেন। এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে চলুন আন্টি। ডানদিকের রুমটাই আম্মুর।"
মহিলাটি খুশি হয়ে শুভ্র ভাইয়ের দেখিয়ে দেওয়া রুমের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে চিৎকার করে 'দুলাভাই' বলে ডেকে উঠলেন আলিফ ভাই। উনার চিৎকারে শুভ্র ভাই চমকে তাকালেন। আমি দু'হাতে মুখ চেপে অন্যদিকে তাকালাম। তুষার ভাইয়া আর রাতুল ভাই ফিক করে হেসে উঠলেন। শুভ্র ভাই অবাক হয়ে বললেন,
----" কি ব্যাপার?"
আলিফ ভাই দাঁত কেলিয়ে বললেন,
----" কিছু না ভাই। তোমার কাঁধের দিকে ধুলা লেগে আছে। এই জন্য বললাম ধুলা ভাই।"
শুভ্র ভাই সরু চোখে তাকালেন। কিছু বলবেন তার আগেই ফোন কানে বেরিয়ে এলো সেই মধ্যবয়স্কা মহিলা। সবাই তার দিকে তাকাতেই আবারও 'দুলাভাই' বলে চেঁচিয়ে উঠলেন আলিফ ভাই আর রাতুল ভাই। শুভ্র আবারও চমকে উঠলেন। বুকে থুতু ছিটিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন। হঠাৎ চিৎকারে খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন সেই মহিলা। হাত থেকে ফোনটা পড়ে যেতে যেতেও ধরে ফেললেন। কিছুক্ষণ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থেকে ব্যালকণির দিকে চলে গেলেন। আমি কোনোরকম হাসি চেপে কিছুটা সরে দাঁড়ালাম। শুভ্র ভাই কপাল কুঁচকে বললেন,
----" ওই? কি সমস্যা? একটা থাপ্পড় লাগাব। হঠাৎ দুলাভাই দুলাভাই করে চেঁচাচ্ছিস কেন? আমাকে কি বলদ মনে হয়?"
আলিফ ভাই ইনোসেন্ট মুখ নিয়ে বলল,
----" ধুর! ইন্ডাইরেক্টলি যে তোমাকে বোনের জামাই বলে স্বীকৃতি দিচ্ছি বুঝতে পারছ না?"
শুভ্র ভাই ঘাড় কাত করে ভ্রু বাঁকালেন। আলিফ ভাই দাঁত কেলিয়ে বললেন,
----" এই খুশিতে একটা ট্রিট দিয়ে দাও ভাই। আই মিন দুলাভাই।"
----" আমিও সেটাই ভাবছি, অনেকদিন ধরে কাউকে জুতোপেটা করা হয় না। আই মিন জুতো দিয়ে বাংলা মাইর দেওয়া হয় না। তোরে দিয়েই শুরু করব, আয়!"
_____________________
আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ছুটোছুটি। ভোর রাতের ঢালা বৃষ্টিটা সারাদিন ঝিমঝিমিয়ে বিকেলে এসে প্রগাঢ় রূপ ধারণ করেছে। সেই সাথে পরিবেশটাতে ছড়িয়ে দিয়েছে এক মুঠো শীতকাল। ব্যালকণির পর্দা ছাপিয়ে ভারী ফোঁটা এসে পড়ছে ব্যালকণির সাদা রঙা মেজেতে। চারতলার ওপরও নাম না জানা ফুলের তীক্ষ্ণ গন্ধ ভেসে আসছে। বৃষ্টির এই ঝুপঝাপ শব্দের সাথে চঞ্চল হয়ে উঠেছি প্রতিটি প্রাণ। ঠান্ডা ঠান্ডা আবহে কাজিনরা মিলে টেবিল সাজিয়ে বসেছি। মায়ের পাঠানো ভূনা খিচুড়ি আর গরুর মাংস সামনে নিয়ে পরম উৎসাহে গিলে চলেছি। বৃষ্টিভেজা দিনে ভোজন প্রিয় বাঙালির জন্য খিচুড়ি মানেই মহোৎসব। খিচুড়ির সাথে মাংস আর মাছ ভাজি হলে তা যেন পরম সুখ। আমরাও সেই সুখে সুখী হয়ে গরুর হাড় চিবুচ্ছি। এমন সময় খাওয়া থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন আলিফ ভাই। সন্দেহী গলায় বললেন,
----" টেবিলের নিচ দিয়ে প্রেমবিভ্রাট ঘটাচ্ছ কে ভাই?"
উনার কথায় সবাই চোখ তুলে তাকাল। একে অপরকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করার পরও যখন চোর ধরা গেল না। তখন শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালেন আলিফ ভাই। মুখ ফুলিয়ে কিছু বলবেন তার আগেই গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন শুভ্র ভাই,
-----" উল্টা পাল্টা কথা বলবি তো লাথ্থি দিয়ে চারতলা থেকে ফুটপাতে ফেলে দেব। আমার এমন থার্ডক্লাস প্রেম কোনদিনই পায় না। অযথা আমায় ঘাটতে আসবি না।"
আলিফ ভাই কিছু বললেন না। 'টেবিল তলার প্রেম' এর রহস্যোদ্ধার না করতে পেরে সবাই আবারও খাবারে মন দিল। কয়েক মিনিট পর আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন আলিফ ভাই। গোল গোল চোখে তাকালেন,
-----" আবার! আবার খোঁচা মারল! সত্যি করে বলো কে করছ এই কাজ? প্রেম করবা ভালা কথা আমার পায়ে লাথি মারো কেন ভাই?"
আবারও এক দফা পর্যবেক্ষণ চলল। আলিফ ভাই ব্যর্থ চিত্তে আমার দিকে তাকালেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
-----" তুই?"
আমি অবাক হয়ে বললাম,
----" আমি তোমাকে লাথি মারতে যাব কেন? আজব।"
----" না। স্টেশন ভুল করে চলে আসতেও পারে। পারে না?"
আমি নাক মুখ ফুলিয়ে বললাম,
----" জ্বি না। পারে না।"
আলিফ ভাই কিছু বললেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবার মুখের দিকে তাকালেন। অদুত ভাইকে ইশারা করে বললেন,
----" ভাইয়া!!"
অদুত ভাই জিভ কেটে বললেন,
----" নাউজুবিল্লাহ! ছোট ভাই-বোনের সামনে সরি ছোট ভাই-বোনদের চোখের নিচ দিয়ে এসব অশ্লীলতা আমি করি না। অশ্লীলতা হবে......."
শুভ্র হালকা কেশে বললেন,
----"ভাই তুই মুখে ব্রেক লাগা। যেকোনো সময় এক্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারে।"
শুভ্র ভাইয়ের কথায় হেসে উঠল সবাই। আলিফ ভাই এবার তন্নী আপুর দিকে তাকালেন। ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
----" কি গো বড় ভাইয়ের বান্ধুপি? তাহলে কি আপনি?"
তন্নী আপু বিষম খেলেন। চোখ বড় বড় করে বললেন,
----" ছি! একদমই না।"
আলিফ ভাই বিরক্ত চোখে তাকালেন। অধৈর্য্য গলায় বললেন,
-----" ছি! একদমই না। সবার উত্তর যদি 'ছি'ই হয় তাহলে লাথিটা মারল কে? আমি কি নিজের পায়েই নিজে লাথি মেরেছি নাকি?"
শুভ্র ভাই শান্ত চোখে তাকালেন। বললেন,
-----" মারতেও পারিস। তোর জন্য কিছুই অবিশ্বাস্য নয়।"
আলিফ ভাই অসহায় চোখে তাকালেন। কিছুক্ষণ পর যথারীতি আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন আলিফ ভাই। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
----" এই ষড়যন্ত্র আমি মানব না। এই তরুণ সিরাজ-উদ-দ্দৌলা হারবে না। কিছুতেই না। এই আদিবা? আদিবা?"
আদিবা ব্যালকণিতে বৃষ্টির পানি দিয়ে খেলছিল। আলিফ ভাইয়ার ডাকে আধভেজা জমা নিয়ে দৌঁড়ে এলো। কৌতূহলী গলায় বলল,
----" বয়ো।"
----" কোনো বলাবলি নেই। ডিরেক্ট ঢুকে যা।"
আলিফ ভাইয়ের কথার ভাবার্থ বুঝতে না পেরে বড় বড় চোখ মেলে তাকাল আদিবা। আলিফ ভাই খানিকটা ঝুঁকে বললেন,
----" এই মুহূর্তে তুই মানুষ না। তুই হলি ক্যামেরা। জীবন্ত ক্যামেরা। ডিরেক্ট টেবিলের তলায় ঢুকে যা। যার পা নড়বে তার পায়েই কামড় বসাবি। প্রতি কামড়ের জন্য একটা করে ডেইরি মিল্ক। কুইক!"
আদিবা মুখ ফুলিয়ে বলল,
----" পা পঁচা।"
-----" আরে পাগলা, পায়ের তলায় কামড় দিতে কে বলেছে তোকে? কামড় তো দিবি হাঁটুর নিচ বরাবার। ঢুক জলদি। প্রতি কামড়ের জন্য দুটো ডেইরি মিল্ক পাবি যা। অফার সীমিত।"
আদিবা রাজি হল। আদিবাকে টেবিলের নিচে একদম মাঝ বরাবর বসিয়ে দিয়ে খাবারে মনোযোগ দিলেন আলিফ ভাইয়া। আমরা সবাই খাবার রেখে চুপচাপ বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন আলিফ ভাই। চোখ বড় বড় করে টেবিলের নিচে তাকালেন। উনার সাথে সাথে আমরাও তাকালাম.....
২৯
সূর্যটা পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়ার পরই পরই তুমুল বর্ষণের সমাপ্তি হয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে ল্যাপটপে গেইম খেলছে ছেলেরা। তাদের পাশেই মুখ ফুলিয়ে বসে আছেন আলিফ ভাইয়া। 'টেবিল তলার রহস্য' উদ্ধার করতে না পেরে ভীষণভাবে হতাশ তিনি। তারওপর আদিবার কচি কিন্তু ধারালো দাঁতের কামড়ে চোখ-মুখে যথাসম্ভব অসহায়ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন তিনি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষটা উনি ব্যতীত অন্যকেউ হতে পারে না, সম্ভব না। আমি অপর পাশের সোফায় বসে কলি আপুর গল্পে তাল মিলাচ্ছি। কানে হেডফোন লাগিয়ে আমার গায়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে রাফিয়া। বয়ফ্রেন্ডের সাথে তুমুল ঝগড়াঝাটি করে আপাতত দেবদাসীর রূপ ধারণ করেছে সে। রাফিয়ার ধারণা, তার এবারের বয়ফ্রেন্ডটা বেশিদিন টিকবে না। দিন দুইয়ের মাঝেই ব্রেকআপ হবে নির্ঘাত। যদিও ব্রেকআপ নিয়ে তার তেমন মাথাব্যাথা নেই তবুও আগামী দু'দিন দুঃখী দুঃখী মুখ করে বসে থাকবে সে। টানা তিনদিন দুঃখী দুঃখী গান শুনবে। ব্রেকআপ হওয়ার পর নাকি এমনটাই করতে হয়, নিয়ম আছে। কলি আপু আমার দূরসম্পর্কের ফুপ্পির মেয়ে। বছরে এক অথবা দু'বার কালভাদ্রে দেখা হয় আমাদের। দাদুবাড়িতে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা না হলে তাদের দেখা পাওয়া মুশকিল। সামনের মাসে কলি আপুর বিয়ে বলেই এই অসময়ে আগমন তাদের। বাসায় আমাদের কাউকে না পেয়ে ভাইয়াকে সঙ্গে নিয়ে মামুর বাসায় হানা দিয়েছেন উনারা, উদ্দেশ্য বিয়ের কার্ড বিতরণ।শুভ্র ভাই এবং মামু কারো সাথেই তাদের পরিচয় নেই বললেই চলে। কলি আপু তার বিয়ের শপিং আর হবু বর নিয়ে কথার ঝুড়ি সাজাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই দৌঁড়ে এসে কলি আপুর পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল আদিবা। কলি আপু খুবই মিশুক ধরনের মেয়ে। আদিবাকে দুইহাতে কাছে টেনে নিতেই আধো আধো গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো আদিবা,
----" তুমিই বউ আপু? তোমার বিয়ে হবে?"
কলি আপু খুশিতে ঝুমঝুম করে বললেন,
----" হুম। আমিই বউ আপু।"
আদিবা বেশ উৎসাহ নিয়ে কলি আপুর কোলে চেপে বসলো। বড়দের মতো করে বলল,
----" আমি তোমার বিয়েতে শাড়ি পড়বো। আমার দুইটা শাড়ি আছে।"
আমি হাসলাম। কলি আপু আদিবার গাল টিপে দিয়ে বললেন,
----" বাপরে! তোমার দুই দুইটা শাড়ি আছে? আচ্ছা! বল তো, তোমার কোন আপুকে আগে বউ আপু বানানো যায়? রুহি, রাফিয়া, রোদ কাকে আগে বিয়ে দেওয়া যায়?"
আদিবা কিছু না ভেবেই ফট করে উত্তর দিলো,
----" রোদাপু।"
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। কলি আপু হাসলেন। কৌতূহল নিয়ে জিগ্যেস করলেন,
----" কেন? রোদাপু কেন?"
----" রোদাপুর দিকে তাকিয়ে থাকে মানুষ।"
কলি আপু ফিচেল গলায় বললেন,
----" কোন মানুষ? ছেলেরা?"
----"সব্বাই।"
কথাটা বলে চুপ করলো আদিবা।কলি আপু মজার ছলে বললেন,
----" ওরে বাবা। সব্বাই?"
আদিবা খানিক ভাবলো। তারপর মাথা দুলিয়ে বলল,
----" উহু। সব্বাই না, দাদাভাই। দাদাভাই তাকিয়ে থাকে।"
আদিবার কথার মর্মার্থ করতে না পেরে কপাল কুঁচকে তাকালেন কলি আপু। শুভ্র ভাইয়েরা পাশের সোফায় বসেই গেইম খেলছিলেন। আদিবার কথায় সবকটায় চোখ বড় বড় করে তাকালেন। শুভ্র ভাই হালকা কেশে নড়ে চড়ে বসলেন। ল্যাপটপের স্যাটারটা একটু নামিয়ে ভারী গলায় ডাকলেন,
----" এই আদিবুড়ি? তোর জন্য যে চকলেট রাখা হয়েছিলো নিয়েছিস ওগুলো? তোর ভাইয়া নির্ঘাত সব খেয়ে নেবে। তোর মামানির কাছে রাখা আছে, জলদি যা। এক দৌঁড়।"
আদিবা এক মুহূর্ত বসে না থেকে ছুটে গেল ভেতরের ঘরে। আর যায় হোক, দাদাভাইয়ের কথার খেলাপ করে না সে। বাচ্চাদের কাছে শুভ্র ভাইয়ের কথা মানেই বেদ বাক্য। পৃথিবী উল্টে গেলেও শুভ্র ভাইয়ের কথার নড়চড় হওয়া চলবে না। কিছুতেই না। আমি আড়চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনার ফর্সা মুখে একঝাঁক রক্তিম আলো চোখে পড়ছে। আচ্ছা, উনি কি লজ্জা পাচ্ছেন? শুভ্র ভাই আমার দিকে না তাকিয়ে মনোযোগ সহকারে শার্টের হাতা ফোল্ড করলেন। একহাতে কপালের চুলগুলো পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে আবারও ল্যাপটপের স্কিনে মুখ ডুবালেন। কলি আপু ভ্রু কুঁচকে ফিসফিস করে বললেন,
----" এই দাদাভাইটা কে রে রোদ?"
আমি আমতাআমতা করে বললাম,
----" কি জানি? ওই পুচকোর কথা ধরতে আছে? বাদ দাও তো।"
কলি আপু বাদ দিলেন না। কিন্তু তৎক্ষনাৎ ছোট ফুপ্পির আগমনে সে বারের মতো বেঁচে গেলাম আমি। ফুপ্পি কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েই গদগদকণ্ঠে বললেন,
----" খালামণিকে তো একদম ভুলে গিয়েছ কলি। এসেছো থেকে তো একবারও কথা বললে না।"
কলি আপু উঠে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত হাসলেন। বললেন,
----" আপনাকে দেখি নি খালামণি।আপু আমাকে রেখেই গটগট করে ভেতরে চলে গেল। কেমন আছেন?"
----" এইতো ভালো আছি, মা। রোদের মামির সাথে পরিচয় আছে তোমার? চলো ভেতরে চলো, পরিচয় করিয়ে দিই।"
কলি আপু হাতের পার্সটা তুলে নিয়ে ফুপ্পির পিছু পিছু ভেতরের দিকে হাঁটা দিলেন। যেতে যেতে হাতের ইশারায় বললেন, 'থাকো, আসছি।' আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ বসে রইলাম। কলি আপু বসার ঘরের দরজার আড়াল হতেই একরকম আর্তনাদ করে উঠলেন অদুদ ভাইয়া,
----" ওরে আল্লাহ! আমাদের এই গোল মরিচ তো দেখি ব্যাপক ঝাল। আমাদের চোখে যা পড়লো না, তা ওর চোখে পড়ে গেল? 'আদিবা কিছু বুঝে না' এই বিশ্বাসে অটুট থেকে ওর সামনে বসে তনিমাকে কতশত প্রেমের কবিতা শুনিয়েছি আমি। থেংক গড শুধু কবিতায়ই শুনিয়েছি। এর থেকে উপরের লেভেলে উঠি নাই৷ নয়তো এই গোল মরিচ, আমার বাপের সামনে মুখ খুলে আমাকে এক্কেবারে ওপরে উঠার ব্যবস্থা করে দিতো নির্ঘাত।"
অদুদ ভাইয়ার কথায় এক পল্টন হাসলো সবাই৷ আমি মুখ কাঁচুমাচু করে উঠে যেতে নিলেও রাফিয়ার জন্য পেরে উঠলাম না। সে আপাতত দেবদাসী রূপ থেকে বেরিয়ে এসে ঘুমের সাগরে হামাগুড়ি খাচ্ছে। আমি অসহায় চোখে রাফিয়ার ঘুমন্ত মুখটির দিকে তাকাতেই ফিচেল গলায় বলে উঠলেন আলিফ ভাইয়া,
----" সে যায় হোক, আমাদের মেইন পয়েন্ট হলো শুভ্র ভাই। তো, শুভ্র ভাই? আজকাল আমাদের বোনের দিকে তাকিয়ে টাকিয়ে থাকো শুনছি, কাহিনী কি?"
আমি চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে অন্যদিকে তাকালাম। আলিফ ভাইয়ার পাশেই বসে আছে ভাইয়া। এই মুহুর্তে লজ্জার থেকে ভাইয়ার উপস্থিতিটাই বেশি তাড়া করছে আমায়। ছি, ভাইয়া কি ভাবছে! আমি আড়চোখে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়া খুব মনোযোগ দিয়ে ফোন ঘাটছে। মুখ-চোখ দেখে মনে হচ্ছে আলিফ ভাইয়ার কথাটা কান পর্যন্ত পৌঁছায় নি তার। কিছুক্ষণ ফোন ঘাটাঘাটি করে বেশ স্মার্টলি উঠে দাঁড়ালো ভাইয়া। ফোনের দিকে নজর রেখেই ধীর পায়ে জায়গা ছাড়লো সে। ভাইয়া উঠে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। সেই সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন শুভ্র ভাইও। ডানহাতের আঙ্গুলগুলো চুলের মাঝে চালাতে চালাতে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন,
----" চোখ দুটো আল্লাহ দিয়েছেন কেন বল তো? অবশ্যই দেখার জন্য। সো, আমি দু'চোখ ভরে দেখবো এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহর দেওয়া চোখদুটোকে তো আর আনইউজড ভাবে ফেলে রাখতে পারি না। চোখের সৎ ব্যবহারটাকে যদি তোরা তাকিয়ে থাকা বলিস তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ, আই নো.. তোরা জন্মগত বলদ।"
আলিফ ভাইয়া প্রত্যুত্তরে কিছু বলবেন তার আগেই তারস্বরে কান্নার আওয়াজ কানে এলো। কলি আপুর বড় বোন কণা আপুর ছোট্ট ছেলেটা কাঁদছে। জারিফ তাকে কোলে নিয়ে এদিক ওদিক লাফালাফি করছে। শুভ্র ভাই জারিফকে ডাকতেই বাবু নিয়ে ছুটে এলো জারিফ। শুভ্র ভাই হাত বাড়িয়ে দিতেই পিচ্চিটা লাফিয়ে শুভ্র ভাইয়ার কোলে চেপে বসলো। শুভ্র ভাই কোলে নিয়ে খানিক নাড়াচাড়া করতেই খিলখিল করে হেসে উঠলো বাচ্চাটি। শুভ্র ভাই ভ্রু বাঁকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
----" এই যে আব্বু? নাম কি আপনার, হ্যাঁ?"
বাচ্চাটি তার বড় বড় কৌতূহলী চোখ মেলে শুভ্র ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ছোট্ট হাতটি বাড়িয়ে শুভ্র ভাইয়ের ছোট ছোট দাঁড়িগুলোতে হাত বুলিয়ে দন্তহীন হাসলো। উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে আধো আধো করে বলল,
----" বা বা বাবা।"
বাচ্চাটা বাবা বলার সাথে সাথেই দাঁত কেলিয়ে হাসলেন অদুদ ভাইয়া। মজার ছলে বললেন,
----" কিরে শুভ্র? তলে তলে চলতাছে টা কি? পোলা তোরে প্রথম দেখায় বাপ ডাকে কেন? তোর গায়ে বাপ বাপ গন্ধ পায় নাকি? আয় তো দেখি।"
কথাটা বলে শুভ্র ভাইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়তেই শুভ্র ভাই বাচ্চাটাকে বাম কোলে নিয়ে ডানহাতে ধুম করে একটা চড় বসালেন পিঠে। মুখে বললেন,
----" গায়ের ওপর পড়বি না, সর।"
অদুদ ভাইয়াকে দেওয়া শুভ্র ভাইয়ের চড়টায় বেশ খুশি হয়ে উঠলো বাচ্চাটি। তার উচ্ছ্বাসিত চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছে বড়দের এই অদ্ভুত খেলা দেখে ভীষণ রকম আনন্দিত সে। বাচ্চাটা কিছুক্ষণ বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে থেকে হাত-পা নাচিয়ে দন্তহীন খিলখিল হাসিতে মত্ত হলো। শুভ্র ভাই আবারও বাচ্চাটির দিকে তাকালেন। দু'হাতে এই ছোট্ট দেহটিকে উপরদিকে ছুঁড়ে মেরে আবারও লুফে নিতেই খিলখিল হাসিতে খেলে উঠলো পুরো ঘর। তার ছোট্ট হাতটি শুভ্র ভাইয়ের নাকের উপর রেখে চোখ পিটপিট করে বলল,
----" বাবা।"
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
----" এখনও বিয়ে করি নি বাপ। বারবার বাবা বলে আর দহন বাড়াস না।"
শুভ্র ভাইয়ের কথার জবাবে বাচ্চাটি গোল গোল চোখে তাকাল। শুভ্র ভাইয়ের ছোট্ট ছোট্ট দাড়িগুলো আঙ্গুল দিয়ে ধরার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে শুভ্র ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালো। শুভ্র ভাইয়ের গালে বার কয়েক আলতো চড় বসিয়ে ভারি আনন্দিত গলায় বলল,
----" বাবা।"
সাথে সাথেই চারপাশে হাসির ফোয়ারা বইলো। অদুদ ভাই হাসিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে বললেন,
----" দেখেছিস? বলেছিলাম সমস্যা আছে। নয়তো একাধারে বাপ বাপ করবে কেন এই পোলায়? কাহিনী ইজ ভেরি ভেরি আন্ধার।"
অদুদ ভাইয়ের কথায় শুভ্র ভাইয়াও হেসে ফেললেন। সবার হাসাহাসির শব্দে ততক্ষণে উঠে বসেছে রাফিয়া। রাফিয়া উঠে বসতেই সোফা ছেড়ে শুভ্র ভাইদের সোফার কাছে হাঁটু গেড়ে বসলাম আমি। দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
----" হ্যালো বেবি। আসো... আমার কাছে মজ্জা আছে।"
বাচ্চাটা আমার দিকে তাকালো। শুভ্র ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
----" যা...বা বা।"
আমি ভ্রু কুঁচকালাম। শুভ্র ভাই হেসে আমাকে ইশারা করে বললেন,
----" এটা মামনি। বলো মামনি।"
বাচ্চাটি শুভ্র ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
----" বা বা। বাবা।"
----" আরে বাপ, বুঝছি তো আমি তোর বাপ। আমি বাবা আর সে মামনি। ছে, মামনি।"
বাচ্চাটা এবারও তুমুল উৎসাহ নিয়ে বলল, বাবা, বাবা। শুভ্র ভাই বিরক্ত চোখে তাকালেন। উনার আশেপাশের সব কিছুকে উনার ইচ্ছে মতো চালিয়ে অভ্যস্ত তিনি। এই ছোট্ট বাচ্চাটা তার কথা শুনছে না তা যেন কিছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। অদুদ ভাইয়া বাচ্চার এক হাত টেনে ধরে বললেন,
----" এই যে আব্বু? আমার কোলে আসো। আমাকে ইচ্ছেমতো বাপ ডাকতে পারো, কোনো সমস্যা নাই। আসো.."
অদুদ ভাইয়ের প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে আবারও শুভ্র ভাইয়ের গলায় ঝাপটে ধরলো সে। অর্থাৎ সে বাবার কোলেই থাকতে চায়। অন্যকারো কোলে যাওয়া তার পছন্দ নয়। বাচ্চাটিকে নিয়ে টানাটানির একপর্যায়ে কণা আপু এলেন। পিচ্চিকে শুভ্র ভাইয়ের কোল থেকে জোরপূর্বক নিজের কোলে নিয়ে বললেন,
----" আসলে, ওর বাবারও সেইম কালার শার্ট আছে তো তাই বারবার বাবা বাবা করছে। কিছু মনে করবেন না।"
শুভ্র ভাই নম্র হেসে বললেন,
----" না না। ঠিক আছে। আপনার বাচ্চাটা খুব মিষ্টি আপু।"
কণা আপু হেসে বললেন,
----" মিষ্টির থেকে দুষ্ট বেশি। আচ্ছা, আজ আসি ভাইয়া। আপনার সাথে তো ঠিক মতো পরিচয়টাই হয়ে উঠলো না। আমাদের বাসা শম্ভুগঞ্জের দিকেই, ওদিকে গেলে আমাদের বাসায় যাবেন। আন্টিকে সাথে নিয়ে যাবেন আমাদের ভালো লাগবে।"
----" এখন তো ওইদিকটা তেমন যাওয়া হয় না। তবুও, চেষ্টা করবো। কিন্তু এখনই যাওয়া কেন? মাত্রই আসলেন আপাতত ডিনারটা করে যান।"
কণা আপু বিগলিত হেসে বললেন,
----" না ভাইয়া। অন্য একদিন। এমনিতেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে প্রায়। আসি তাহলে।"
সবার থেকে বিদায় নিয়ে দরজার কাছাকাছি যেতেই আমার ডানহাত খামচে ধরলেন কণা আপু। ফিসফিস করে বললেন,
----" ওই? এটা সত্যিই তোর মামাতো ভাই?"
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম,
----" হ্যাঁ। কিন্তু কেন?"
----" হারামি! দুই বছর আগে কই লুকিয়ে রাখছিলি এই ভাইকে? তাহলে আজকে আমি তোর ভাবি হইতাম। আমার ছেলে তোর ভাতিজা হতো। তোর কাজিনটাকে দেখে বিয়ে নিয়ে বিরাট আফসোস হচ্ছে আমার। ধুর!"
আমি হেসে বললাম,
----" তুমিও না আপু। তোমার থেকে এক দুই বছরের ছোট হবেন উনি। শুভ্র ভাই মাস্টার্স ফাইনাল। তোমার এক বছর জুনিয়র।"
----" তো? মানুষ সাত/আট বছরের ছোট বিয়ে করে ফেলছে আর আমি একবছরের ছোট বিয়ে করতে পারতাম না? এক বাচ্চার মা হয়ে ক্রাশ খাইলাম। হায়রে কপাল আমার!"
আমি হাসলাম। মনের কোথাও একটা ধারালো সূঁচও ফুটলো। শক্ত গলায় বলতে ইচ্ছে করতে লাগলো,
----" তোমাকে কেউ বলেছে ক্রাশ খাইতে? নেচে নেচে ক্রাশ খাইতে আসো কেন শুনি? যত্তসব আজাইরা পক পক।"
____________________
ঘন্টাখানেক আগেই মাগরিবের আযান পড়েছে। ছাঁদের চারপাশটাই জমাট বাঁধা অন্ধকার। বিকেলে বৃষ্টি থামার পর মামানি কিছু কাপড় মেলে দিয়েছিলেন ছাঁদে। সেগুলোর কথা বেমালুম ভুলে গিয়েই এই ভর সন্ধ্যায় ছাঁদে ছুটে আসা আমার। ছাঁদের কাপড়গুলো নিয়ে পেছন ফিরতেই ছাঁদের ওপাশ থেকে কারো কন্ঠ কানে এলো। কৌতূহল বশত ছাঁদের অন্য পাশটাই উঁকি দিতেই তুষার ভাইয়াকে চোখে পড়লো। কারো সাথে ফোনালাপ ব্যস্ত উনি। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে সিঁড়ি ঘরের দিকে রওনা দিতেই অনিচ্ছাকৃত ভাবেই তুষার ভাইয়ার একটি কথা কানে এলো,
----" আমিও বিশ্বাস করি তোমার আর শুভ্রর যতটুকু যায়, রোদের সাথে ততটুকু যায় না। আরে ও তো বাচ্চা একটা মেয়ে। শুভ্রও সেটা বুঝতে পারছে আজকাল। রোদ ওর আবেগ ছাড়া কিছুই না। আচ্ছা, তুমি..."
কথাটুকু বলতে বলতে ছাঁদের এদিকটায় আসতেই আমাকে চোখে পড়লো উনার। তুষার ভাইয়া ফোন কেটে হালকা হেসে বললেন,
----" কেমন আছো রোদ?"
আমি দুর্বল গলায় বললাম,
----" ভালো।"
----" একটু কথা ছিলো তোমার সাথে। সময় হবে?"
তুষার ভাইয়ার কথায় অজানা একটা ভয়ে কেঁপে উঠলো আমার বুক। আমি শুকনো ঢোক গিলে বললাম,
----" জ্বি বলুন।"
----" চলো ওদিকটায় দাঁড়াই। দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কথা বলতে অস্বস্তি লাগে।"
আমি ধীর পায়ে ছাঁদের এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালাম। তুষার ভাইয়া আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
----" আমার কথাগুলো তুমি কিভাবে নেবে বুঝতে পারছি না। আমি তোমাকে ছোট বোনের মতোই স্নেহ করি। কথাগুলো তোমার ভালোর জন্যই বলা।"
আমি শক্ত গলায় বললাম,
----" বলুন ভাইয়া।"
তুষার ভাইয়া জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললেন,
----" তুমি হয়তো জানো না যে, শুভ্র স্কুল লাইফে একটা মেয়েকে পছন্দ করতো। মেয়েটির নাম তাসনিম।"
----" আমি জানি উনার ব্যাপারে।"
তুষার ভাইয়া খানিক অবাক হলেন। তারপর বললেন,
----" জানলে তো প্লাস পয়েন্ট। আচ্ছা? তোমার কি কখনও মনে হয় না যে শুভ্র কোথাও না কোথাও এখনও তাসনিমকেই চায়? বা তাসনিমের মতোই কাউকে? তাসনিম সুন্দরী সেইসাথে ওয়েল স্যাটেলড। ওরা দু'জনই জুটি হিসেবে অসাধারণ। কিন্তু, তবুও শুভ্র ওর দিকে এগুচ্ছে না। কেন এগুচ্ছে না বল তো?"
আমি মৃদু গলায় বললাম,
----" কেন?"
----" তোমার জন্য। শুভ্র যে এখন প্রায় প্রায়ই কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত থাকে খেয়াল করেছো? তার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুটা হলে তুমি। তাসনিম ওর প্রথম ভালোবাসা। আর যায় হোক, কেউ কখনো তার প্রথম ভালোবাসাটা ভুলে যেতে পারে না। আর শুভ্রর মতো লয়েল ছেলেরা তো একদমই নয়। তাছাড়া, তাসনিমের কাছে ওই সবকিছুই আছে যা একজন ছেলে তার স্ত্রীর মাঝে চায়। তারওপর তাসনিম শুভ্রর জন্য পাগলপ্রায়। তাকে ছেড়ে শুভ্রর তোমাকে বেছে নেওয়াটা বোকামো। আর শুভ্র বোকা নয়। তবে, সে তোমাকে নিয়ে চিন্তিত। আবেগ হোক আর যায় হোক শুভ্র একসময় তোমাকে পজিটিভ সাইন দিয়েছিলো। তার ধারণা, হুট করে তোমার থেকে সরে গেলে তুমি হয়তো সামলে উঠতে পারবে না। উলোটপালোট কিছু করে ফেলবে। ওর এই চিন্তাটাই ওকে তোমার থেকে আলাদা হতে দিচ্ছে না। আর না, তাসনিমকে ফেলতে পারছে। আমার মনে হয়, এই সমস্যার সমাধান একমাত্র তুমি। তুমি যদি নিজ থেকে সরে যাও তাহলে শুভ্র খানিকটা রিলিফ পাবে। ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে ওর হয়ে এটুকু বলার রাইট নিশ্চয় আমার আছে, তাই না?"
আমি লম্বা একটা শ্বাস ফেললাম। তুষার ভাইয়ার প্রতিটি কথা অপমানের এক একটা সূঁচ হয়ে বিঁধতে লাগলো বুকে। উনি আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন আমি শুভ্র ভাইয়ের যোগ্য নই। আমি কোনো কিছুর বিনিময়েই উনাকে ডিজার্ভ করি না। অথচ, আমি কখনো উনাকে আমার জীবনে আসতে বলি নি। উনি নিজ ইচ্ছায় অনেকটা জবরদস্তির ওপর ঢুকে গিয়েছেন আমার জীবনে। নানা কাজকর্মে আমাকে বাধ্য করেছেন উনাকে নিয়ে ভাবতে। আর আজ...প্রাক্তোনকে পেয়ে সেই আমিই দুধে মাছি? এই আমিই এখন তৃতীয়পক্ষ? কথাগুলো ভেবেই ভেতরটা ভয়ানক ক্ষোভে হাসফাস করতে লাগল। কষ্ট আর অপমান মিলে বুকটা ভার হয়ে এলো। শক্ত গলায় বললাম,
----" শুভ্র ভাই আর আমার মাঝে কখনোই কোনো সম্পর্ক ছিলো না ভাইয়া। তাই আমাকে নিয়ে উনার এতো চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন দেখছি না। সমস্যার সমাধান আমি নই। আবেগ বা অন্যকিছু যা ছিলো সব উনার দিক থেকেই ছিলো, আমার দিক থেকে নয়। তাই সমাধানটা উনার আবেগ বৈ অন্য কিছু নয়। আপনার উচিত আপনার বন্ধুকে বুঝানো। তার আবেগটাকে নিজের আয়ত্তে আনতে শিখতে বলুন। হুটহাট আবেগ পরিবর্তন খুব একটা ভালো লক্ষ্মণ নয়।"
আমার শক্ত জবাবে বেশ খানিকটা থতমত খেয়ে গেলেন তুষার ভাইয়া। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
----" না মানে। তুমি যদি নিজ থেকে দূরে সরে যেতে তাহলে ওর সুবিধা হতো..."
----" কেন? আমি নিজ থেকে কোনোদিন কাছে এসেছি বলেই তো আমার মনে পড়ছে না। কাছে যেহেতু আসি নি সেহেতু দূরে যাওয়ারও প্রশ্ন আসছে না। উনার যখন আবেগ তৈরি হয়েছিলো তখনও নিতান্তই উনার সমস্যা ছিলো এখন আবেগ কেটে গিয়েছে এখনও নিতান্তই উনার সমস্যা। আমার নয়। তাই এডভাইসগুলো আপনার বন্ধুকে দিন। আমার সাথে যে তার যায় না সেটা বুঝিয়ে বলুন, কেমন?"
কথাটুকু বলে এক মুহূর্ত দাঁড়ালাম না আমি। অদ্ভুত এক তেজে নিচে নেমে এলাম। বুকের কোথাও একটা দৃঢ় বিশ্বাস কাজ করছিলো, শুভ্র ভাই এমনটা ভাবতেও পারেন না। কখনোই না। তবে, তুষার ভাইয়ার কথাও ঠিক। এই দুইদিনে বেশ কয়েকবারই শুভ্র ভাইকে অন্যমনস্কভাবে বসে থাকতে দেখা গিয়েছে। এমনকি বিকেলে খাবার টেবিলেও। তাহলে কি শুভ্র ভাই সত্যিই এমন কিছু ভাবছেন? তাসনিমকে নিয়েই জীবন গোছাতে চাইছেন? মনে নানা প্রশ্ন নিয়ে নিচে নামতেই শুভ্র ভাইয়ের সুরেলা কন্ঠ ভেসে এলো৷ আমি পর্দা সরিয়ে বসার ঘরে উঁকি দিলাম। শুভ্র ভাই গান গাইছেন। তার ঠিক সামনেই শাড়ি পরহিতা যুবতীটি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকে দেখছে,
"I was hanging with you
And then I realized
I didn't think it was true
I was surprised
When I found out I'd fallen for you
I didn't wanna believe
My feelings for you
I didn't wanna believe
That I could lose you
If I told you just how I felt
But I can't help it (ooh, ooh, ooh)
I'm falling for you
And I can't quit it (ooh, ooh, ooh)
'Cause I'm stuck on you....."
শুভ্র ভাইয়ের কন্ঠে ইংলিশ গান বরাবরই ভীষণ ভালো লাগে আমার। কিন্তু আজ ভালো লাগল না৷ শুভ্র ভাইয়ের পাশে বসা রমনীটিকে দেখে ভালো লাগাটা যেন উবে গেল। বারবার একই প্রশ্ন মাথায় ঠুকতে লাগলো, গানটা কি তাসনিমকে উদ্দেশ্য করেই গাইলেন শুভ্র ভাই? অতীতে না বুঝলেও এখন কি তিনি নতুন করে ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারছেন? আমি কি তবে সত্যিই উনার আবেগ? তিন বছর নয় মাসের দীর্ঘ আবেগ! আমি ধীর পায়ে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটির দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজায় ছিটকানি দিয়ে অযথাই কান্নায় ভেঙে পড়লাম। তুষার ভাইয়ার কথাগুলো মনে পড়তেই নিজেকে বড্ড ঠুনকো আর প্রয়োজনহীন মনে হতে লাগল। প্রায় ঘন্টাখানেক কেঁদে কেটে সিদ্ধান্ত নিলাম শুভ্র ভাইয়ের সাথে কথা বলব আমি। কিন্তু, কি জিগ্যেস করব উনাকে? উনি তো কখনও সরাসরি ভালোবাসার কথা বলেন নি আমায়। কোনও প্রতিশ্রুতিও দেয় নি কখনো। তাহলে কিসের জবাবদিহিতা চাইবো আমি? কথাটা ভেবেই মাথা চেপে ধরে বসে পড়লাম আমি। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকার পর হঠাৎই উঠে দাঁড়ালাম। দরজা খুলে সরাসরি বসার ঘরে গেলাম। বসার ঘরটা ফাঁকা পড়ে থাকতে দেখে শুভ্র ভাইয়ের রুমের ভেতর উঁকি দিলাম। শুভ্র ভাই ব্যালকণির দেয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছেন। উনার কপালে চিন্তার ভাঁজ। চোখ-মুখ রক্তশূণ্য। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে মৃদু গলায় ডাকলাম, উনি সাড়া দিলেন না। আরও দু'বার ডাকার পরও সাড়া না পেয়ে বেশ জোরেই ডাকলাম আমি। উনি চমকালেন। বিরক্তি নিয়ে তাকালেন।ঝাঁঝালো গলায় বললেন,
----" কি সমস্যা? আমাকে ডিস্টার্ব করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তোর? কারো রুমে ঢুকার আগে যে অনুমতি নিতে হয় জানিস না? এই সিম্পল কার্টিসিও কি তোর নেই? দিন দিন মূর্খ হচ্ছিস।"
শুভ্র ভাইয়ের কথার মাঝেই শুভ্র ভাইয়ের ওয়াশ রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো তাসনিম নামের মেয়েটি। আমি একবার তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েটির দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাইয়ের বলা বাকি কথাগুলো কানে ঢুকলো ঠিক কিন্তু মষ্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছালো না। অপরিচিতা এক মেয়ের সামনে শুভ্র ভাইয়ের করা অপমান মুহূর্তেই ক্ষতবিক্ষত করে দিলো আমায়। তীব্র আত্মসম্মানবোধে শুভ্র ভাইয়ের কথাগুলো চুম্বকের মতো কাজ করলো। অপমানে চোখ-মুখ মুহূর্তেই থমথমে হয়ে এলো। শুভ্র ভাই না জেনেই এমন একটা জায়গায় আঘাত করলেন যার কোনো ক্ষমা হয় না। কোনো কিছুর বিনিময়েই না। এই অসহ্যকর মেয়েটার সামনে আমাকে এতোগুলো অপমানকর কথা শুনানোর শাস্তি তাকে পেতে হবে৷ আমি দুর্বোধ্য হেসে কাঠ কাঠ গলায় বললাম,
----" সরি! এখানে যে প্রাইভেট টাইম চলছে বুঝতে পারি নি৷ আর দরজাটাও খোলা ছিলো তাই আর অনুমতি নেওয়া হয় নি। নেক্সট টাইম এই ঘরে যদি পা রাখি তাহলে অনুমতি নিয়েই ঢুকবো৷ ইউ গাইস,সরি এগেইন। "
কথাটা বলেই ঘুরে দাঁড়ালাম আমি৷ তাসনিম আপুর ঠোঁটের কোণে এক মুহূর্তের জন্য একটা দাম্ভিক হাসি চোখে পড়লো। উনি উচ্ছসিত গলায় বললেন,
----" তুমিই রোদ?"
----" না। আমি রোদেলা।"
তাসনিম আপু অবাক হয়ে বললেন,
----" রোদ আর রোদেলা একজন নয়?"
----" না। একজন নয়। তারা দু'জন আলাদা। রোদের মাঝে কার্টিসি জ্ঞান নেই। আত্মসম্মান তাকে তাড়া করে না। কিন্তু, রোদেলা ভিন্ন। তার আত্মসম্মানবোধ তীব্র। সেই আত্মসম্মানে হাত দিলে পুড়ে ছাই করে দেওয়ার মতো উত্তাপ সে রাখে।"
এটুকু বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম আমি৷ ঘর থেকে বেরুতেই প্রথম যে কথাটা মনে পড়লো তা হলো, তুষার ভাইয়ার কথাগুলো ঠিক ছিলো আর আমার মন ভুল। রোদ নামক মেয়েটা শুভ্র ভাইয়ের আবেগ বৈ অন্যকিছু নয়। যাকে আজকাল দূরে কোথাও ছুঁড়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তিনি৷ কথাগুলো ভাবতেই কান্নাগুলো গলার কাছে দলা পাকিয়ে এলো। কিন্তু কান্নার দলাগুলো চোখের পাতায় ঝড়লো না। কান্না মানেই দুর্বলতা। যে মানুষটি আমাকে ছুঁড়ে ফেলতে চাইছে তার জন্য চোখের জল ভাসানো বোকামো। আমি তো দুর্বল বা বোকা নই। এই অহেতুক চোখের জল আমায় মানায় না। দোষটা মনের ছিলো, মনেই জল নামুক। এই বিষাক্ত মনটা কেঁদে কেটে নিশ্চল হোক। কিন্তু তার ছাপ বাইরের দেহটাতে পড়া চলবে না। সেই লোকটাকে 'আমি ভালো নেই' 'আপনাকে ছাড়া ভালো থাকবো না' কথাটা বুঝতে দেওয়ায় চলবে না। তিল পরিমাণও না।
৩০
মাথার উপর বিশাল আকাশটা মিটিমিটি তারায় ছেঁয়ে আছে। তাদের মধ্য থেকেই ছোট্ট একটা তারা খসে পড়লো ওই একটু আগে। সত্যিই কি খসে পড়লো? নাকি আমার দৃষ্টির ভুল? আমি উদ্বেগ মাখা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বিশাল এই তারার ভূবনে সেই ছোট্ট তারাটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে পাশের বারান্দার দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই এখনও ফোনে কথা বলছেন। প্রায় অাধাঘন্টা যাবৎ চলছে উনার এই উচ্ছল ফোনালাপ। উনার এই দীর্ঘ ফোনালাপে আমার রাগ লাগার কথা কিন্তু অদ্ভুত এক কারণে রাগ লাগছে না। মাথার ভেতর ভোঁতা এক অনুভূতি হচ্ছে। পুরো পৃথিবীটাকে মিউট করে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। শুভ্র ভাইদের এই বাসায় মোট চারটা শোবার ঘর আছে। সেই চারটি শোবার ঘরের মাঝে একটি ঘর আমার জন্য বরাদ্দকৃত। এই ঘরটিতে অন্য কারো কতৃত্ব নেই। অলিখিত নীতির মতো এই ঘরটিতে আমার অলিখিত মালিকানা। শোবার ঘরের মতো খাবার টেবিলের একটি চেয়ারও আমার জন্য বরাদ্দ করা আছে। দীর্ঘদিনের অভ্যাসে সেই চেয়ারটা এখন শুধুই আমার। ঘন্টাখানেক আগে সেই চেয়ারটাতে বসেই রাতের খাবার খেয়েছেন তাসনিম আপু। মামানি আর আমার কাজিনদের সাথে হাসিমুখে গল্প করেছেন। আমি রাগ করি নি। শুধু খাবার রেখে উঠে এসেছিলাম, বাড়ি ফিরবো বলে। কিন্তু মামানির জন্য বাড়ি ফেরাটাও হয়ে উঠে নি। আমাদের জীবনে এমন কিছু মানুষ থাকে যারা আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ভালোবাসে। সেই অপ্রত্যাশিত ভালোবাসার মানুষগুলোকে হুট করে 'না' বলা যায় না। মামানিও ঠিক সেরকম একজন মানুষ। উনাকে আমি 'না' করতে পারি না। আমি অন্ধকার বারান্দা ছেড়ে নিজের ঘরে ফিরলাম। চারপাশের বাতাসটা বিষাক্ত লাগছে আজ। মন, মেজাজ সবই যেন তীব্র কোনো বিষে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। ঘন ঘন শ্বাস নেওয়ার পরও ভারী বুকটাতে অক্সিজেন পৌঁছাচ্ছে না। বুকের কাছে দলা বেঁধে ভারী থেকে ভীষণ রকম ভারী হয়ে উঠছে। চোখ দুটো জ্বলছে কিন্তু বৃষ্টি ঝরছে না। বিছানায় গা এলিয়ে, চার হাত-পা চারদিকে ছড়িয়ে দিয়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। আমার দীর্ঘশ্বাসের করুণ শব্দ নিস্তব্ধ দেয়ালে আঘাত হেনে আমার কানেই ফিরে এলো বরংবার। ভীষণ অভিমানে চোখ জোড়া বন্ধ করতেই ভেসে এলো ঘন্টাখানেক আগের সেই দৃশ্য, শুভ্র ভাই এবং তাসনিম আপুর একসাথে পথ চলার দৃশ্য। বন্ধ চোখের কোল ঘেঁষে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল বিছানায়। আমি হঠাৎ করেই অনুভব করলাম, এই গোপন অশ্রু বিসর্জনটুকু প্রয়োজন ছিলো। এই অশ্রু বিসর্জন ব্যতীত দীর্ঘ বিষাক্ত রাতটা কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব হতো না। কিছুতেই না।
পরের দিন সকালে, হেমন্তের নরম রোদ যখন আমার কপাল ছুঁলো তখন প্রায় আটটা বাজে। আমি ডানহাতটা বাড়িয়ে কপালের ওপর হাত রাখলাম। চোখ পিটপিট করে সামনের খোলা জানালাটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠে বসলাম। জানালার কাঁচে একটি লাল-কালো পাখি ঠুকরা- ঠুকরি করছে। কেন করছে, তা হয়তো তার নিজেরই অজানা। আমি হাতটা হালকা নাড়িয়ে দুর্বল গলায় বললাম, ' হুঁশ! যা।' পাখিটা আমার দিকে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড দ্বিধায় ভুগে নতুন উদ্যমে ঠুকরা-ঠুকরি শুরু করল। আমি বিরক্ত হলাম। চোখ-মুখ কুঁচকে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। মামানি কোমরে আঁচল জড়িয়ে রান্নার কাজ করছেন। আমাকে হেলেদুলে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মৃদু হেসে বললেন,
----" রোদু রাণির ঘুম ভাঙলো তবে?"
আমি হাসলাম। মামানি চুলোর আঁচ কমিয়ে দিয়ে আঁচলে হাত মুছলেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-----" চুলোর পাশে একটু দাঁড়া তো মা। ভাজি বসিয়েছি নাড়াচাড়া না করলেই পুড়া ধরে যাবে। তোর মামু ডাকছে, আমি যাব আর আসব।"
আমি চুলগুলোকে দু'হাতে মুঠো করে হাত খোঁপা করলাম। চুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম,
-----" তুমি যাও। আমি আছি এখানে।"
মামানি স্নিগ্ধ হাসলেন। মামানি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই ল্যাপটপ হাতে বেরিয়ে এলেন শুভ্র ভাই। ল্যাপটপটা টি-টেবিলে রেখে রান্না ঘরের দিকে উঁকি দিলেন। রান্নাঘরে শুধু আমার উপস্থিতি দেখে খানিকটা অপ্রস্তুত হলেন। শার্টের খোলে রাখা বাকি চারটা বোতাম লাগালেন দ্রুত হাতে। ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন,
-----" কফি বানাতে পারিস? একদম কড়া কফি?"
আমি কফি বানাতে পারি না। এই বস্তুটি কখনোই আমার পছন্দের তালিকায় পড়ে না। জীবনটা যেখানে এমনিতেই পুড়ে আঙ্গার সেখানে পোড়া গন্ধযুক্ত কোনো খাবার কেন থাকবে জীবন তালিকায়? থাকবে না। আমি রাখিও না। এই সহজ কথাটা উনাকে বলতে ইচ্ছে করছে না। আমার জবাবের জন্য অপেক্ষা করে জবাব না পেয়ে আরো খানিকটা অপ্রস্তুত হলেন উনি। স্বাভাবিক কোনো সময় হলে ধমক টমক দিয়ে পৃথিবী কাঁপিয়ে ফেলতেন কিন্তু আজ তেমন কিছুই করছেন না। আমার ষষ্ঠইন্দ্রিয় বলছে আমাদের দু'জনের মাঝের পরিবেশটা এই মুহুর্তে স্বাভাবিক না। উনি পকেটে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। অফ হোয়াইট থ্রী-কোয়াটার প্যান্টটা হাঁটুর খানিকটা ওপর পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। বাকি পা'টুকু দীর্ঘ পুরুষালী লোমে ঢেকে আছে। আমি উনার পা থেকে চোখ সরিয়ে খুন্তি নাড়ায় মনোযোগ দিলাম। উনি খানিক্ষন মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন,
-----" তুই ঠিক আছিস? না, মানে চোখ-মুখ কেমন যেন লাগছে।"
আমি শান্ত চোখজোড়া তুলে উনার দিকে তাকালাম। তারপর মামুর ঘরের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় ডাকলাম,
-----" মামানি? ভাজি হয়ে গিয়েছে। চুলো বন্ধ করে দেব?"
আমার প্রশ্নের জবাবে ঘর থেকে সশরীরে বেরিয়ে এলেন মামানি। তাড়াহুড়ো করে রান্না ঘরে এসে বললেন,
-----" এইতো এসে গিয়েছি। তুই গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে, বাকিটা আমি করছি।"
আমি চুলোর পাশ থেকে সরে দাঁড়ালাম। মামানির কথামতো ধীর পায়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দিলাম। পেছন থেকে মামানির কন্ঠ কানে এলো,
-----" কিরে? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কিছু চায়? কফি বানিয়ে দেব?"
শুভ্র ভাই তেজ নিয়ে বললেন,
-----" আমি যা চাই তা কখনোই পাই না আম্মু। লাগবে না আমার কফি। বিরক্তিকর।"
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম। ততক্ষণে ল্যাপটপ হাতে নিজের ঘরের দিকে চলে গিয়েছেন শুভ্র ভাই। মামানি কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে ডেকে উঠলেন,
----" শুভি? এই শুভি? হলোটা কি আবার? সকাল সকাল এতো রাগারাগি ভালো লাগে না আমার।"
আমার বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। শুভ্র ভাইয়ের সাথে আবারও দেখা হলো খাবার টেবিলে। সেটাকে বলা যায় দু'মিনিটের সাক্ষাৎ। উনি যখন টেবিলে খেতে বসেছেন তখন আমি নিজের ঘরে দোর আটকে বসে আছি। হঠাৎ করেই উনার সামনে যেতে ইচ্ছে করছিল না। মামানির অনেক ডাকাডাকির পর যখন বেরিয়েছি তখন শুভ্র ভাইয়ের খাওয়া শেষ প্রায়। আমি চেয়ার টেনে বসতেই উনি চোখ তুলে তাকালেন। ঠিক সেই সময়টিতেই উনার ফোন বাজলো। তুষার ভাইয়ার ফোন। উনি ছোট্ট করে বললেন,
----" নিচে আছিস? আচ্ছা, আসছি।"
কল কেটে খাবারের প্লেটটা ঠেলে দিয়ে মামানিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
----" আম্মু? সার্কিট হাউজের মাঠে ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছি। ফিরতে ফিরতে দুপুর হবে।"
মামানি ব্যস্ত হয়ে বললেন,
----" খাবার শেষ করে যা বলছি। কাল রাতেও তো খাস নি।"
শুভ্র ভাই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,
----" ইচ্ছে করছে না।"
মামানি আর কিছু বললেন না। জানেন, বলেই লাভ নেই। উনার ইচ্ছে করছে না মানে উনি খাবেন না। পৃথিবী উল্টে গেলেও সে 'না' 'হ্যাঁ' হবে না। আমি আর মামানি দু'জনেই গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। শুভ্র ভাই বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘন্টা দুই পর আমিও রওনা দিলাম বান্ধবীর বাসার উদ্দেশ্যে। স্পৃহার বাসা সার্কিট হাউসের অপজিটে সরু রাস্তাটির পাশেই। আমি স্পৃহার বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। স্পৃহার থেকে নোট নিয়ে, কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলাম পার্কে যাব। দুই বান্ধবী মিলে নদীর পাড়ে বসে চা খাবো। পরিকল্পনা অনুযায়ী পার্কের গেইট পেরোনোর পর পরই বিশাল এক ধাক্কা খেলাম আমি। আমার স্তব্ধ দৃষ্টিজোড়া মুহূর্তেই বিস্ময়ের চাদরে ঢাকা পড়লো। স্পৃহা ফিসফিস করে বলল,
-----" এই? এটা তোর কাজিন শুভ্র ভাইয়া না? সাথে ওইটা কে? গার্লফ্রেন্ড?"
আমি জবাব দিলাম না। স্পৃহা নিজের মনেই বিরবির করতে লাগলো,
-----" নতুন রিলেশন নাকি রে দোস্ত? এর আগে তো
কখনো কোনো মেয়ের সাথে চোখে পড়ে নি।"
আমি মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। এটাই কি তবে উনার ক্রিকেট ম্যাচ? এই ফুচকা গিলার জন্যই কি বাসার খাবার মুখে রুচে না? বাহ্ গুড চেঞ্জ। কাল পর্যন্ত যে ছেলে ফুসকার নামে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলতো সে আজ নব প্রেমিকার সাথে বসে ফুসকা গিলছে। নব? নাহ্ নতুন তো নয়। তাসনিম আপু তো পুরাতন, হয়তো একমাত্রও! আমার এবার কান্না পাচ্ছে। আকস্মিক এই আঘাতটা হজম করে নেওয়ার মতো মানসিক শক্তিটা মন বা মস্তিষ্ক কেউই সরবরাহ করতে চাইছে না। আমি নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
-----" আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আজ চা খাওয়া ক্যান্সেল। ফুচকা খাবো।"
-----" কিন্তু... "
-----" বাংলা সিরিয়ালের মতো কিন্তু কিন্তু করা বন্ধ কর। ফুসকা খাবো মানে ফুসকা খাবো, এখানে আবার কিন্তু আসছে কোথাকে?"
এটুকু বলে থামলাম আমি। কিছুক্ষণ উনাদের দিকে তাকিয়ে থেকে ব্যাগ থেকে ফোন বের করলাম। স্পৃহার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম,
-----" আমরা শুভ্র ভাইদের পাশের স্টলটাতে ফুসকা খাবো। তোর কাজ হলো পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওদের কাপল পিক তুলা। তবে, চুপিচুপি।"
কথাটা বলেই স্টলের দিকে হাঁটা দিলাম আমি। স্পৃহা আমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে অসহায় গলায় বলল,
-----" দোস্ত? ছবি তুললে শব্দ হবে।"
-----" তোর মাথা হবে। ছবি তোল তুই।"
-----" শব্দ হবে তো।"
ওর সাথে বাকবিতন্ডা করতে করতেই নির্দিষ্ট স্টলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা। পাশে রাখা ব্রেঞ্চটাতে বসে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম,
-----" তুই যে উচ্চ শ্রেণীর গাধা তা কি তুই জানিস? এতো বছর ধরে পার্কের অপজিটে থেকে আসছো অথচ একটা ছবি তুলতে পারো না? তোর তো এখানে থাকাটাই বৃথা। তোর আসলে ময়মনসিংহ থাকার যোগ্যতায় নাই। তুই যোগ্যতাহীন মানুষ।"
স্পৃহা কিছু বলবে তার আগেই উঠে গিয়ে শুভ্র ভাইদের কাছাকাছি ব্রেঞ্চটাতে গিয়ে বসলাম। শুভ্র ভাই বা তাসনিম আপু কেউই এখনও খেয়াল করে নি আমায়। ব্রেঞ্চে বসেই অবচেতন মনে ওদের দিকে কান খাঁড়া করলাম আমি। শুভ্র ভাই কথা বলছিলেন,
-----" আমার উচিত তোমার কথাগুলো নিয়ে ভাবা। এতে লাভ বৈ ক্ষতি হবে না। তাছাড়া আই মাস্ট ছে ইউ আর আ স্মার্ট এন্ড ইন্টেলিজেন্ট গার্ল। সো,...."
শুভ্র ভাইয়ের কথার মাঝে আমার পাশে এসে ধপ করে বসে পড়লো স্পৃহা। ফুসকার দোকানদারকে ভীষণ ঝাল দিয়ে দু'প্লেট ফুসকা দিতে বলল। আমাদের চিল্লাপাল্লায় শুভ্র ভাইদের কথার সুর কেটে গিয়েছে ততক্ষণে। দু'জনেই আমাদের দিকে চোখ ফিরিয়ে তাকিয়েছেন। আমি তাকাতেই তাসনিম আপু বললেন,
-----" আরে রোদেলা? এখানে?"
আমি জোরপূর্বক হেসে শুষ্ক গলায় বললাম,
-----" এইতো ফুসকা খেতে এলাম। আপনারাও ফুসকা খেতে এসেছেন বুঝি? নাকি ঘুরতে?"
তাসনিম আপু উত্তর দেওয়ার পূর্বেই ফুসকা এলো। তাসনিম আপু বললেন,
-----" অনেক দিন ফুসকা খাওয়া হয় না। তাই ভাবলাম ,আজ যেহেতু শুভ্র রাজি তো ট্রিট মিস করা চলে না।"
আমি দূর্বোধ্য হাসলাম। নিজের রাগ কমাতে একের পর এক ফুসকা মুখে পুরতে লাগলাম। অতিরিক্ত ঝালে চোখ-মুখ লাল হয়ে এলো মুহুর্তেই। পাঁচ মিনিটের মাথায় সবগুলো ফুসকা শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। স্পৃহার প্লেটে এখনও অধিকাংশ ফুসকায় পড়ে আছে। সে অবাক চোখে আমার কর্মকান্ড দেখছে। অতিরিক্ত ঝাঁঝে আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে তখন। সেই ঝাঁঝ মাখা অশ্রুটুকু মুছে নিয়ে স্পৃহার প্লেটটা ছিনিয়ে নিলাম। মামাকে ফুসকাগুলো প্যাক করে দিতে বলে স্পৃহার দিকে তাকালাম। স্পৃহা তখনও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি নরম গলায় বললাম,
-----" বাসায় গিয়ে খাস দোস্ত। আমাকে এই মুহুর্তে বাসায় ফিরতে হবে, আর্জেন্ট।"
স্পৃহার বিস্ময়মাখা দৃষ্টিটা খানিক নরম হলো। বলল,
-----" হঠাৎ..."
-----" প্লিজ!"
স্পৃহা আর কথা বাড়ালো না। ফুসকার বিল মিটিয়ে নিয়ে শুভ্র ভাই আর তাসনিম আপুর দিকে তাকালাম। কাঠ কাঠ গলায় বললাম,
-----" আপনারা থাকুন৷ আসি তাহলে।"
তাসনিম আপু মৃদু হাসলেন। শুভ্র ভাই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটা কথাও বললেন না। উনার চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে উনি কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। আমি স্পৃহাকে নিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এসেও থমকে দাঁড়ালাম। কি মনে করে, ভয়ানক একটি কাজ করে বসলাম। দীর্ঘ তিন বছর দশ মাস যাবৎ পরে থাকা নুপুরটা খুলে ফেললাম। উনার দীর্ঘ আবেগের স্মৃতিচিন্হটাকে উনার সামনে ধরে বললাম,
-----" এটা একটু মামানিকে দিয়ে দিবেন, শুভ্র ভাই? আসলে এখন আমি আমাদের বাসায় যাবো। আবার মামানিকে এটা ফিরিয়ে দেওয়াটাও জরুরি।"
শুভ্র ভাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, হাত বাড়ালেন না। একটা কথাও বললেন না। আমি বেশ কয়েকবার বলার পরও যখন হাত এগোলেন না তখন তাসনিম আপুর হাতের মুঠোয় নুপুরটা ধরিয়ে দিলাম আমি। মৃদু হেসে বললাম,
-----" যাবার সময় মনে করে নুপুরটা শুভ্র ভাইকে দিয়ে দিবেন আপু। চাইলে নিজের কাছেও রেখে দিতে পারেন। আমার একটু তাড়া আছে। আসছি!"
কথাটা বলেই ঘুরে দাঁড়ালাম। নুপুরহীন পা'টা হালকা লাগার কথা কিন্তু কেন জানি বড্ড ভারী লাগছে। পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। এই দীর্ঘ অভ্যাসটাকে অন্যের হাতে ফেলে এসে চাপা কান্নায় ঠোঁটজোড়া কেঁপে কেঁপে উঠছে। যে নুপুরটা কয়েক মিনিটের জন্য চোখের আড়াল হলেও কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়েছি একসময়। সেই নুপুরটা অন্য কারো হাতে দিয়ে কিভাবে এতো নিশ্চিন্তে হাঁটছি আজ? এতোটা শক্ত কবে হয়ে গেলাম আমি? কিন্তু, আমারই বা কি করার ছিল? উনাকে শাস্তি দেওয়াটাও তো প্রয়োজন ছিলো। উনাকে বুঝানো প্রয়োজন ছিলো, উনার আমাকে ছেড়ে দেওয়া মানেই আমার ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া নয়। তাছাড়া, এটা উনার শাস্তিরও অংশ। প্রাক্তনের সাথে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে পার্কে ঘুরে বেড়ানোর অপরাধে এই ভয়ঙ্কর শাস্তিটা উনার প্রাপ্য! আমি ক্লান্ত শ্বাস নিলাম। কাঁপা হাতে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে কাঁপা গলায় বললাম,
-----" আমায় একটা রিকশা ডেকে দিবি স্পৃহা? আমি হাঁটতে পারছি না।"
স্পৃহা আমার দিকে তাকিয়ে আৎকে উঠে বলল,
-----" রোদু? কি হয়েছে তোর? এমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেন তোকে? তোর কি কোনো অসুখ করেছে?"
আমি মৃদু গলায় বললাম,
-----" হ্যাঁ, করেছে অসুখ। প্লিজ একটা রিকশা ডেকে দে। মাথা ঘুরছে, বমি পাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আমি মারা যাচ্ছি স্পৃহা। জলদি বাসায় ফিরতে হবে আমায়। জলদি।"
স্পৃহার মুখটা মুহূর্তেই রক্তশূণ্য হয়ে গেলো। আমার ডান বাহুটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
-----" শুভ্র ভাইকে ডাকবো?"
-----" তুই রিকশা ডেকে দে। কাউকে ডাকতে হবে না। তুই না পারলে , আমি নিজেই খুঁজে নিচ্ছি।"
স্পৃহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিকশা ডাকলো। আমাকে রিকশায় তুলে দিয়ে নিজেও সাথে আসতে চাইলো। আমি ওকে সাথে না নিয়েই বাসায় ফিরলাম। এই মুহূর্তে একা থাকাটা খুব প্রয়োজন আমার। খুব প্রয়োজন।
চলবে...
Writer:- নৌশিন আহমেদ রোদেলা