২১
সকালটা সুন্দর। চারদিকে মেঘ মাখানো হালকা আলো। বিছানার পাশের জানালাটা খোলা, গোলাপী রঙের পর্দাটা অল্প অল্প কাঁপছে। ঘরের কোণের টেবিলটাতে বসে এসাইনমেন্টের পাতায় মুখ ডুবিয়ে আছে আপু। আমি সচেতন চোখে এদিক-ওদিক তাকালাম। দরজার কাছে আম্মুকে দেখতে পেয়ে আবারও আগের মতোই পড়ে রইলাম। কয়েকমাস যাবৎ খুব বাজে একটা অভ্যাস হয়েছে। নয়টা/সাড়ে নয়টার আগে বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। আজও করছে না। আমাদের রুমে কোনো ঘড়ি নেই। এখন সকাল কয়টা বাজে তার সঠিক খবরটাও আমার জানা নেই। তবে কেন জানি মনে হচ্ছে এখনও নয়টা বাজে নি। এ বাড়িতে ঘড়ির প্রয়োজন আমার বিশেষ একটা হয় না। তবে, সময় জানার একটা বিশেষ পদ্ধতি অবশ্য আমার আছে। 'বিশেষ' ট্যাগ লাগানো বিষয়গুলোর বিশেষ বিশেষ নাম থাকতে হয়। বিশেষ বিষয়ের বিশেষ নাম থাকবে এটাই নিয়ম। তবে, আমার পদ্ধতিটির বিশেষ কোনো নাম নেই। তার নামটা খুব সাধারণ ---- " দি ন্যাচারালিস্টিক এলার্ম"। এই এলার্ম, নিয়ম করে রোজ ৮ টা থেকে বাজতে শুরু করে। আমি ওঠে না বসা পর্যন্ত বাজতেই থাকে। এই এলার্ম সিস্টেমের একমাত্র অধিপতি হলেন, আমার মা। সে যায় হোক, কিছুক্ষণ ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকার পরও যখন আম্মুর এলার্ম সিস্টেমটা বেজে উঠলো না তখন বাধ্য হয়েই চোখ মেলে তাকালাম। আপুর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
---" এই আপু? কয়টা বাজে?"
আপু আমার দিকে একবার তাকিয়েই ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকালো। ব্যস্ত গলায় বললো,
---" ন'টা বত্রিশ।"
ন'টা বত্রিশ! এতো বেলা হয়ে গেছে? আম্মুর এলার্মটা কি আজ তবে ঘড়ি দেখতে ভুলে গেছে ? আশ্চর্য! আম্মুর এলার্ম তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে করতেই বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম। সারা বাড়ি ইলিশে শুঁটকির গন্ধে মউ মউ করছে। ইলিশ মাছের গন্ধ শুকতে শুকতেই হঠাৎ চাটনির কথা মনে পড়লো। ভুনা খিচুড়ির সাথে ঝাল ঝাল চাটনি....আহা! ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গুটি গুটি পায়ে রান্না ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আম্মুর মেজাজ বুঝার জন্য হালকা গলায় ডাকলাম,
---" আম্মু!"
আম্মু জবাব দিলেন না। আম্মুর নিশ্চুপতা মানেই ভয়ানক রাগ। তবুও সাহস করে বললাম,
---" আম্মু? চাটনি বানাও না প্লিজ। একদম ঝাল ঝাল চাটনি।"
এবারও জবাব এলো না। আমি একটু ঘাড় নুইয়ে আম্মুর মতিগতি বোঝার চেষ্টা করলাম। কিন্তু লাভ বিশেষ হলো না। আম্মু আগের মতোই থমথমে মুখে রান্নার কাজ সারতে লাগলেন। আমার পাশে থাকা নুনের বাটিটা হাত বাড়িয়ে নিলেন ঠিক তবুও আমাকে দেখলেন না। হয়তো দেখার চেষ্টাই করলেন না। এমন একটা ভাব করলেন যেন এই দুনিয়াতে 'রোদেলা' নামক কোনো বস্তুর কথা তিনি ভাবতেই পারেন না। আমি নিজের চেষ্টা জারি রাখতে আবারও বললাম,
---" আম্মু? ও আম্মু?"
আম্মু এবার ধমকে উঠলেন। হাজারো ক্ষোভ নিয়ে বললেন,
---" একদম আম্মু আম্মু করবি না। আমার একটা কথা শুনিস কোনোদিন? যা মন চায় তাই করিস। এখন আবার আম্মু কিসের? কোনো আম্মু নাই। খবরদার আমায় আম্মু ডাকবি না।"
আমি অসহায় চোখে তাকালাম। আম্মুকে ডিসট্রেক্ট করার সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা। আমার এই প্রচেষ্টাটাও মাঠে মারা গেলো, আম্মু পাত্তা দিলেন না। ব্যর্থ আমি, অসহায় মন নিয়ে বসে রইলাম সোফায়। কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে থেকে ওঠে দাঁড়াতেই টি-টেবিলে রাখা আম্মুর ফোনটা বেজে উঠলো। আম্মু তখন কড়াইয়ে খুন্তি নাড়তে ব্যস্ত। একবার উঁকি দিয়ে ফোন স্ক্রিনে নামটা দেখে নিয়েই ঝটপট তুলে নিলাম ফোন।
---" মামানি আচার খাবো।"
---" কে রোদু?"
---"হু।"
---" কিসের আচার খাবি?"
---" আমড়ার আচার।"
---" আচ্ছা, করে দিবো।"
---" করে দেবে কি? আমি আজই খাবো।"
---" আচ্ছা। তাহলে চলে আয় বাসায়। তোর মামুকে আমড়া আনতে পাঠাচ্ছি।"
মুহূর্তেই খুশি হয়ে উঠলাম আমি। ফিসফিস করে বললাম,
---" মামানি? আম্মু তো এখন যেতে দিবে না। তুমি বলো না প্লিজ।"
মামানি হাসলেন। আদুরে গলায় বললেন,
---" বেশ তো। তোর মাকে ফোনটা দে আর তুই ঝটপট রেডি হয়ে যা।"
___________________
মামানি চুলোয় আমড়া সিদ্ধ চড়িয়েছেন। আমি এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করছি। পর্দার ফাঁক দিয়ে বারান্দায় লাগানো গোলাপের গাছ চোখে পড়ছে। গাছে গাঢ় রঙের একটা ফুলও ফুটেছে। সেদিকে চোখ রেখেই বিরবির করে বলে উঠলাম আমি,
---" ভাল্লাগছে না কিছু। সবই কেমন একঘেয়ে লাগছে মামানি।"
আমার কথায় চোখ তোলে তাকালেন মামানি। একবার ঘড়ি দেখে নিয়ে বললেন,
---" টিভি দেখ ভালো লাগবে। নয়তো শুভ্রর রুম থেকে কোনো উপন্যাস টুপন্যাসের বই এনে পড়। তোর তো বইয়ের প্রতি খুব নেশা।"
মামানির প্রস্তাবটা খুব একটা খারাপ লাগলো না আমার। পা টিপে টিপে শুভ্র ভাইয়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। রুমের দরজাটা খোলায় ছিলো কিন্তু ভেতরটা আবছা অন্ধকার। রুমে ঢুকে আলো জ্বেলে দিতেই বিছানায় উপুর হয়ে ঘুমিয়ে থাকা শুভ্র ভাইকে চোখে পড়লো। আমি চুপচাপ বুকসেল্ফ ঘেটে বই দেখতে লাগলাম। পছন্দ মতো বই নিয়ে এদিক ওদিক পায়চারী করে এক-দু পাতা উল্টে-পাল্টে দেখছিলাম। এমন সময় ঘুম জড়ানো কন্ঠ ভেসে এলো,
---" এই? এখানে কি করিস তুই?"
হঠাৎ এমন ধমকে চমকে উঠে বিছানার দিকে ফিরে তাকালাম। উনি ঘুম মাখা আধো চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তাকাতেই বললেন,
---" যা। রুম থেকে যা। তোকে না বলেছি? যখন তখন রুমে আসবি না।"
আমি কপাল কুঁচকে বললাম,
---" আশ্চর্য! আমি কি আপনাকে চিমটি দিয়েছি নাকি? আমি এখানে বই নিতে এসেছি। আপনি আপনার মতো ঘুমোন না।"
উনি এবার সোজা হয়ে শুলেন। কাঁথাটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,
---" বই নেওয়া তো শেষ হয়েছে? এবার যা।"
আমি বই হাতেই হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালাম। ভ্রু উঁচিয়ে বললাম,
---" যাবো না। আমি এখানেই বই পড়বো। আপনার ঘুম আপনি ঘুমোন না। আমি কি আপনাকে ডিস্টার্ব করেছি? একটা কথাও তো বলছি না। তাহলে সমস্যা কোথায়?"
---" অনেক সমস্যা। প্রথম সমস্যা লাইট জ্বালিয়ে রেখেছিস। আর মুখ্য সমস্যাটা হলো, তোর পায়ের নুপুরের শব্দ আর গায়ের গন্ধে আমার ঘুম আসবে না। তুই যা এখান থেকে। রাতে ঘুম হয় নি...ঘুমোতে দে।"
হাতের বইটা সেল্ফের উপরে রেখে ভ্রু কুঁচকালাম আমি। বিরক্তি নিয়ে বললাম,
---" আজিব! রাতে আপনার ঘুম হয়েছে কি হয় নি সেটা নিতান্তই আপনার সমস্যা? আপনার রাতে ঘুম হয় নি বলে সারা দুনিয়া অন্ধকার করে রাত বানিয়ে ফেলবেন? দিনে ঘুমোতে হলে আলোতেই ঘুমোতে হবে। আর তারসাথে আমার নুপুরের শব্দও শুনতে হবে।"
শুভ্র ভাই বিরক্ত চোখে তাকালেন,
---" এই তুই বের হ তো। আমার রুম আমি অন্ধকার করি নাকি আলোকিত করি সেটা নিতান্তই আমার ব্যাপার। দরকার হলে আমার রুমকে আমি পাতালপুর বানিয়ে ফেলবো, তাতে তোর কি? তুই বের হ।"
---" বললাম তো যাবো না। আমি এখানেই বই পড়বো। ব্যস!"
শুভ্র ভাই কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে থেকে কাঁথা দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লেন। আমি আগের মতোই রুমময় ঘুরে ঘুরে বই পড়তে লাগলাম। আধাঘন্টা পর আমাকে ডাকতে ডাকতে রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালেন মামানি। আমি তাকাতেই বললেন,
---" আচার হয়ে গেছে আয়।"
আমি দাঁত বের করে হেসে বললাম,
---" মামানি? আচারের বাটি কি এখানে আনা যায় না? এখানে বেশ হাওয়া আসে। চলো না এখানে বসে খাই আর গল্প করি। প্লিজ..."
মামানি কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন,
---" আচ্ছা। ঠিক আছে।"
কিছুক্ষণের মাঝেই মামানি আচার নিয়ে রুমে এলেন। মামানি বিছানার এক কোণায় আর আমি চেয়ার টেনে পাশে বসে গল্পে মন দিলাম। মামানি আর আমার গল্পের মাঝপথেই বিরক্তি নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
---" আম্মু? যাবা রুম থেকে? কি সব আজাইরা গল্প শুরু করে দিয়েছো। এই বাসায় কি গল্প করার জন্য আর কোনো রুম নাই? ঘুমোতে দাও তো...যাও।"
মামানি ভ্রু কুঁচকালেন। আচারের প্লেটটা পাশে রেখে ফুঁসে ওঠে বললেন,
---" এতোক্ষণ তো তোর কোনো সমস্যা হচ্ছিলো না। আমি এসে বসতেই তোর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে গেলো?"
---" আশ্চর্য! আমি কি বলেছি যে ওকে রেখে তুমি একা চলে যাও? আমি দু'জনকে মিন করেই বলেছি। দরকার হলে পুচকিকে বাইরে বসিয়ে রেখে তুমি একা এখানে আমার পাশে বসে থাকো। কিন্তু দু'জন একসাথে বসে কান খেয়ো না প্লিজ।"
---" আমি এখন তোর কান খাওয়ার মানুষ হয়ে গেলাম? এই ছেলেকে পেটে ধরছি আমি? আজ আমার একটা মেয়ে থাকলে এই দিন দেখতে হতো না।"
মামানির কথায় শুভ্র ভাই চরম বিরক্ত। চোখ মুখ কুঁচকে ছোট্ট একটা শ্বাস টেনে নিয়ে পাশের বালিশটা মাথায় চেপে রাগী গলায় বললেন,
---" করো গল্প। মহিলা মানুষ মানেই আপদ। 'ক' বললে কোলকাতা বুঝাটা এদের জন্মগত স্বভাব। রিডিকিউলাস।"
মামানি কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। আমার দিকে তাকিয়ে উৎসাহ নিয়ে বললেন,
---" ওকে ছাড়। রুহিকে যে দেখতে এসেছিলো ওই ছেলেকে দেখেছিস তুই? দেখতে কেমন রে?"
আমি আচারের টুকরো মুখে দিতে দিতে বললাম,
---" আমি কি করে দেখবো? বাসার কেউই তো দেখে নি। ঘটক বললো ছেলে নাকি লম্বা। দুধের মতো ফর্সা হেনতেন। আমার তো ভাল্লাগে নাই। ছেলে জিরাফের মতো লম্বা আর ফর্সা হলেই হয় নাকি? ফর্সা ছেলেদের বলদ বলদ লাগে। তার থেকে শ্যামা ছেলেদেরই মিষ্টি লাগে। তাই না মামানি?"
---" হ্যাঁ। নুরজাহানের ছেলে নাহিদ কিন্তু শ্যামা। তবু নাঈমের থেকে নাহিদকে সুন্দর লাগে। কি মিষ্টি চেহারা। ফর্সা হলেই...."
এটুকুই বলেই থেমে গেলেন মামানি। আমিও নিশ্বাস বন্ধ করে আচার চিবুতে লাগলাম। ততক্ষনে শুভ্র ভাই বিছানায় ওঠে বসেছেন। শুভ্র ভাইকে উঠতে দেখেই মামানি 'অনেক কাজ আছে' এই বাহানা দিয়ে ওঠে গেলেন। শুভ্র ভাই চেঁচিয়ে ওঠে বললেন,
---" কোথায় যাও? দাঁড়াও... নিজের ছেলের নামে বসে বসে নিন্দা করছো আম্মু? আনবিলিভেবল। ফর্সাতে এতো সমস্যা হলে ফর্সা ছেলে বিয়েটা কেন করেছিলে। আম্মু? আরে..."
আমি এবার ওঠে দাঁড়ালাম। আচারের বাটিটা হাতে নিয়ে কোনো রকম দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। সাথে সাথে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন উনি,
---" আরেকদিন যদি মুখে নাহিদের গুণগান শুনেছি তো দুটোকেই নাহিদের বাসায় দিয়ে আসবো। অসহ্য!"
আমি বিরবির করে বললাম,
---" নাহিদ ভাইয়াদের বাসাটা যথেষ্ট সুন্দর। আমার বা মামানির কারো কোনো সমস্যা নেই।"
---" এই? কি বললি তুই?"
উনার কথাটা শেষ হওয়ারার আগেই দৌঁড়ে রুমের সীমানা পাড় করলাম আমি। রান্না ঘরে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম। মামানি আমার দিকে ফিরে তাকাতেই দু'জনে দমফাঁটা হাসিতে ফেঁটে পড়লাম। হাসিটা কোনোরকম থামিয়ে বলে উঠলেন মামানি,
---" অনেকদিন পর এভাবে হাসলাম রোদু। আজ থেকে যা না মা। গিয়ে গোসল করে নে।"
---" কি যে বলো না মামানি। আমি কি জামা-কাপড় এনেছি যে গোসল করবো? তাছাড়া, আজ যেতে হবে নয়তো আম্মু বকবে খুব।"
---" তোকে এতো পাক্নামো কে করতে বলেছে? আমি তোর আম্মুকে ফোন দিয়ে বলে দিচ্ছি। আর গোসল করে আমার শাড়ি পড় আজ। আমার আগের ব্লাউজগুলো ঠিক হয়ে যাবে তোর। আমি আজ তোকে আমার ইচ্ছে মতো সাজাবো। তুই আমার মেয়ে হলে রোজ সাজিয়ে দিতাম। যা..."
---" কিন্তু মামানি...."
---"কোনো কিন্তু নয়, চল।"
অগত্যা মামানির কথাতেই রাজি হতে হলো আমায়। একটা গোলাপী-সাদা সিল্ক শাড়ি পড়িয়ে ইচ্ছে মতো সাজালেন। মামানির মুখে প্রশান্তির হাসি। সাজানো শেষ হলে দু'জনেই খেতে বসলাম। মামানি জোর করেই প্লেট তুলে নিয়ে বললেন,
---" চল তোকে খাইয়ে দিবো।"
আমি ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললাম,
---" কি দরকার? দাও আমি খাচ্ছি। আমাকে খাইয়ে দিলে তুমি কখন খাবে? আর শুভ্র ভাই আর মামু কোথায়?"
---" ওদের আর খাওয়া! একেক জন একেক সময় খাবে। তুই হা কর তো।"
---" তাহলে চলো সোফায় বসে খাই। টিভি দেখবো।"
---" আচ্ছা চল।"
আমরা সোফায় গিয়ে বসার কিছুক্ষণের মাথায় ডোরবেল বাজলো। মামানি গলা উঁচিয়ে শুভ্র ভাইকে ডাকলেন,
---" এই শুভ্র? বাবা দরজাটা খোল একটু।"
শুভ্র ভাই সাথে সাথেই উত্তর দিলেন,
---" ইচ্ছে করছে না।"
মামানি ফুঁসে ওঠে বললেন,
---" শুনো ছেলের কথা। দরজা খুলবি এতে ইচ্ছে করা না করার প্রশ্ন কোথা থেকে আসছে? বাপ ছেলে দু'জনেই জ্বালিয়ে খেলো আমায়।"
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
---" আমি খুলছি মামানি।"
ধীর পায়ে গিয়ে দরজাটা খুলতেই ভেতরে এলেন দু'জন মহিলা আর একটি আমার বয়সী মেয়ে। এদের মধ্যে একটা মহিলাকে হয়তো এক আধবার দেখেছিলাম আমি। মহিলাগুলো আমাকে উপর-নিচ ভালো ভাবে পর্যবেক্ষন করে মামনির দিকে তাকালেন। মামানি ভাতের প্লেটটা হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়ালেন। স্মিত হাস্যে বললেন,
---" আরে ভাবি? কেমন আছেন? এখান থেকে চলে যাওয়ার পর তো আর খোঁজ-খবরই নেন না। এটা আপনার বোন সেলিনা আপা না?"
উনাদের মধ্যে একজন মহিলা বললেন,
---" হ্যাঁ ভাবি। আসলে, আসবো আসবো করেই সময় করে উঠতে পারি না।"
মামানি হেসে বললেন,
---" সময় কি আর হয়? করে নিতে হয়। বসুন ভাবি।"
উনারা বসলেন। আমিও দরজাটা বন্ধ করে মামানির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সাথে সাথে পাশে বসা মহিলাটি বলে উঠলেন,
---" আপনার ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন নাকি ভাবি? ছেলের বউ এটা? ভালোই তো দেখতে। কিন্তু আপনার ছেলে না সাদা ফর্সা? বউ আরেকটু ফর্সা হলে ভালো হতো। হাইটও একটু কম মনে হচ্ছে। প্রেমের বিয়ে নাকি এরেঞ্জ ম্যারেজ? আজকাল তো ছেলেমেয়েরা প্রেম করেই বেশি বিয়ে করছে।"
মামানি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকালেন। আমার মেজাজটা তখন চড়কগাছ। মামানি আমার হাত টেনে পাশে বসিয়ে বললেন,
---" তাড়াতাড়ি 'হা' কর জলদি শেষ কর এটুকু।"
আমি মৃদু গলায় বললাম,
---"আর খাবো না মামানি। প্লিজ।"
---" ছেলের বউকে বেশ আদরে রেখেছেন ভাবি। এখন বুড়ো বয়সে দেখলেই হলো।"
আমার ইচ্ছে হচ্ছিল মহিলাটার চুলগুলো টেনে বলি, আমি যে মামানি ডাকছি শুনছিস না? শাশুড়িকে কেউ মামানি ডাকে? আমার ভাবনার মাঝেই হেসে উত্তর দিলেন মামানি,
---" এটা আমার ননদের মেয়ে ভাবি।"
মহিলাটি বিস্মিত হয়ে বললেন,
---" এটা আপনার ছেলের বউ না?"
মামানি মৃদু হাসলেন। ঠিক তখনই রুম থেকে বেরিয়ে এলেন শুভ্র ভাই। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে এদিকে তাকালেন। কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
---" আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?"
আগের মহিলাটিই হাসি হাসি মুখ নিয়ে সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
---" সেই চার-পাঁচ বছর আগে দেখেছিলাম। আগের থেকে স্বাথ্যবান হয়ে গেছো দেখছি।"
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
---" ভার্সিটি বন্ধ তো... বাসায় থাকি। টিউশনি করানোর ঝামেলা নেই। তাই আরকি..."
মহিলাটি বেশ আয়েশ করে বসলেন। হাসিমুখে বললেন,
---" আপনার ছেলে কিন্তু মাশাআল্লাহ অনেক ভদ্র ভাবি। আমার মেয়েটাও এমন। আমার মেয়েটার কথা মনে আছে তো? দুটো পয়েন্টের জন্য ভার্সিটিতে চান্স হলো না। একটার পর একটা বিয়ের ঘর আসছে। সুন্দরী মেয়ে থাকলে যা ঝামেলা হয় আরকি৷ তারওপর ভদ্র। আমাদের পিংকিও তো অনেক ভদ্র। আমার মেয়েটাও খুব ভদ্র। বাসা থেকেই বের হয় না। কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে গেলেই ভয়ে কাঁপে দু'জনেই।"
মামানি কিছু বলবেন তার আগেই ইনোসেন্ট মুখ নিয়ে পাশের মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুঁড়লেন শুভ্র ভাই,
---" কেমন আছো পিংকি?"
মেয়েটা লাজুক হাসি দিয়ে বললো,
---" ভালো আছি ভাইয়া।"
---" কাল তো তোমাকে পার্কের একটু এইপাশে গলির মোড়ে দেখলাম। শাহিন ভাইয়ের সাথে দাঁড়িয়েছিলে।"
সাথে সাথেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এলো মেয়েটির। মহিলা দুটো গোল গোল চোখে পিংকির দিকে তাকালেন। তাদের দৃষ্টি দেখেই বুঝা যাচ্ছে, শাহিন নামে কাউকে চেনে না তারা। শুভ্র ভাই আগের মতোই ইনোসেন্ট চেহারা নিয়ে বললেন,
---" করোণাকালীন সময়ে ওভাবে ঘুরাফেরা করা উচিত নয়। আর বাইকে তো একেবারেই না। রিস্ক থাকে তো খুব। এখন তো বড় হয়েছো....সচেতন হতে হবে তো নাকি?"
শুভ্র ভাইয়ের কথায় দমফাটা হাসিতে ফেঁটে পড়তে ইচ্ছে করলেও চুপচাপ মুখ চেপে বসে রইলাম। মানুষকে কিভাবে, কতভাবে অপমান এবং বাঁশ দেওয়া যায় তা হয়তো উনার থেকে শেখা উচিত। পিংকি মেয়েটা পাংগু মুখে বসে রইলো। শুভ্র ভাই মৃদু হেসে বললো,
---" রোদ? আম্মু আন্টিদের সাথে গল্প করছে তুই একটু খেতে দে আমায়।"
আমি চুপচাপ ওঠে গেলাম। মহিলাটি মৃদু স্বরে বললেন,
---" আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে হলে এমনই হয়। বউকে 'তুই' করে ডাকাটা কেমন শুনায়?"
উনার কথাটা কানে যেতেই আমার একটি কথায় মনে হলো। আর তা হলো, "মহিলাটি পাবনা ফেরত পাগল।" মামানি বললোই আমি তার ননদের মেয়ে তবু শুভ্রর বউ নামক কীড়া তার মাথা থেকে যায় নি। অদ্ভুত! মহিলার কথায় আমি বিরক্ত হলেও শুভ্র ভাই চরম রকম অবাক হলেন। খাবার টেবিলে বসে প্রথমেই বললেন,
---" এই? ওই মহিলা ওই কথাটা কেন বললো? তোকে আর আমাকে ইন্ডিকেট করেই তো বললো, না?"
আমি জবাব না দিয়ে চুপচাপ খাবার সার্ভ করতে লাগলাম। উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,
---" মা কি তোকে বউ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে নাকি রে? কি সাংঘাতিক ব্যাপার!"
আমি এবারও কিছু বললাম না। উনি প্লেটটা টেনে নিয়ে কপাল কুঁচকে তাকালেন। মৃদু হেসে বললেন,
---" শাড়ি পড়লে তোকে অনেকটাই তাই মনে হয়। ব্যাপারটা খারাপ না। শাড়িই পড়ে থাক। খুলিস না..."
আমি এবার বিরক্তি নিয়ে তাকালাম। উনি খেতে নিয়েও থেমে গিয়ে বললেন,
---" আম্মু খেয়েছে?"
আমি চেয়ারে হাত রেখে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
---" না খায় নি। "
---" আর তুই? খেয়েছিস? ও সরি...তুমি খেয়েছো?"
এটুকু বলে নিজেই হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে উঠলেন উনি। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
---" আশ্চর্য! এতো ঢং করছেন কেন?"
উনি হাসতে হাসতেই বললেন,
---" ঢং কই করলাম? ওই আন্টির কথামতো ট্রাই করছিলাম। আর দু-একবার ট্রাই করলে হাসতে হাসতেই মরে যাবো আমি।"
আমি রাগ নিয়ে বললাম,
---" আপনাকে কেউ ট্রাই করতে বলেছে? আজাইরা কাজে সবসময় হাজির। আর এভাবে হাসছেন কেন? একদম হাসবেন না। চুপচাপ খাবার খান নয়তো খাওয়া বন্ধ।"
উনি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। মুখে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বললেন,
---" আচ্ছা যা। হাসবো না আর। এবার সিরিয়াসলি জিগ্যেস করছি, তুমি খেয়েছো?"
এটুকু বলে আবারও উনি হাসিতে মেতে উঠলেন। উনার থেমে থেমে ঝংকার তোলা হাসির দিকে তাকিয়ে থেকে কটমট গলায় বললাম,
---" আপনি জাস্ট অসহ্য। আরেকবার হাসলে ডিরেক্ট খুন করে ফেলবো। হাসি থামান।"
উনি হাসি থামালেন না। উনার হাসির মাঝেই ফোন বাজলো। সেই ফোনের বাহানায় হলেও হাসিটা কমিয়ে ফোন রিসিভ করলেন। চাপা গলায় বললেন,
---" দোস্ত আজ নয় প্লিজ। আজ আমি বিজি। বের হতে পারবো না।"
ওপাশে কে বা কি বললো শুনা গেলো না। উনি আবারও জোর দিয়ে বললেন,
---" আরে শালা, বুঝিস না কেন। সিরিয়াসলি ব্যস্ত আছি নয়তো যেতাম। মেজাজ খারাপ করিস না। আরে তুই... আচ্ছা ঠিক আছে। আসছি বাট মাত্র একঘন্টা,ওকে? আচ্ছা রাখছি।"
উনি এবার কোনোরকম কথা না বলে খাবারে মনোযোগ দিলেন। আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি হুট করেই আমার হাত টেনে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললেন,
---" হা কর।"
প্রথম দফায় খানিকটা চমকে গেলেও পরবর্তীতে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। উনার হাতটা ছাড়িয়ে ওঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই আরো শক্ত করে চেপে ধরলেন উনি। প্লেটের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললেন,
---" 'হা' না করলে ছাড়বো না। আগে হা কর তারপর ছাড়বো।"
আমি বিরক্তি নিয়ে উনার দিকে তাকালাম। তারপর হুট করেই মামুর রুমের দিকে তাকিয়ে বললাম,
---" মামু! মামু তুমি খাবে না?"
'মামু' শব্দটা শুনেই হাতটা ছেড়ে খানিকটা সরে বসার চেষ্টা করলেন উনি। আমিও ঝটপট ওঠে দাঁড়িয়ে খানিকটা তফাৎ এ গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি আড়চোখে মামুর রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে আমার চালাকিটা বুঝতে পেরেই হেসে ফেললেন। আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
---" খুব পেকে গেছো রোদপাখি।"
আমার ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক চিলতে গর্বমাখা হাসি। উনি আবারও খাবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে বললেন,
---" বাইরে এসেছিলাম তোকে ডাকতে। খেতে নয়। আমার রুমে যা। বেডসাইড টেবিলে একটা বক্স আছে।"
---" তো?"
---" তো তোর মাথা। বেশি কথা না বলে যা তো।"
আমি অলস ভঙ্গিতে উনার রুমের দিকে এগুলাম। ড্রয়িংরুমের সোফা থেকে এক পলকের জন্য আমার দিকে তাকালেন সেই মহিলা। আমি সেসব পাত্তা না দিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো সেই কাঙ্ক্ষিত বাক্স। একটি কাঁচের বাক্স। আমি আলতো হাতে বাক্সটা তুলে নিতেই বুঝতে পারলাম,
এটা একটা চুড়ির বাক্স। লাল, নীল, হলুদ আর কালো....চার রঙের কাঁচের চুড়িতে ভরে আছে বাক্সটা। আমি বাক্সটা উল্টেপাল্টে দেখলাম। কিছু একটা নেই নেই মনে হচ্ছে। কিছুতে নেই। হঠাৎ ফ্লোরের ওপর পড়ে থাকা সবুজ কাগজের টুকরোর ওপর চোখ আটকে গেলো আমার। কাগজটা দেখেই হালকা হাসি ফুটে উঠলো আমার ঠোঁটে। আনমনে এই চিরকুটটাকেই হয়তো খুঁজছিলাম আমি। উনার দেওয়া সব উপহারেই এমন একটা চিরকুট থাকা চাইই চাই। আমি নিচু হয়ে চিরকুটটা হাতে তুলে নিলাম। তাতে লেখা,
" এর আগের বারের সবকটা চুড়িই তুমি ভেঙে ফেলেছিলে, মনে আছে? চাইলে এবারও ভাঙতে পারো। তোমার তো আবার ভাঙাভাঙির অভ্যাসটা জন্মগত। তবে, ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগে না। একবার না ভাঙলে তো আর দ্বিতীয়বার কেনা যায় না। জানো? আমি প্রতিদিন উইশ করি তোমার ওই বাম পায়ের নুপুরটা যেন হারিয়ে যায়। কিন্তু আমার উইশটা পূরণ হচ্ছে না। নুপুরটা কিছুতেই হারাচ্ছে না। তিন তিনটা বছর ধরে এই একটা নুপুরই এভাবে আগলে রেখেছো কেন বলো তো? ইচ্ছে করেও তো হারিয়ে ফেলতে পারো। তাহলেই নতুন একটা পাওয়া যায়। তুমি বড্ড বোকা, সেই কাজটা তুমি কিছুতেই করবে না। লাস্ট টাইম তোমার ঘুমের মধ্যে রাফিয়া নুপুরটা খুলে নিজের পায়ে পড়েছিলো বলে তোমার সেকি কান্না। আমি সেদিন হতবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। একটা নুপুরের জন্য একটা মানুষ এতোটা কাঁদতে পারে বুঝি? এখন আমার নিজের দেওয়া ওই নুপুরটার প্রতিও আমার মারাত্মক হিংসে হয়। মানুষটার চেয়ে নুপুরটাকে বেশি ভালোবাসাটা কিন্তু অন্যায় রোদপাখি। আর এই অন্যায় আমি মানতে নারাজ।"
চিরকুটটা পড়ে হেসে ফেললাম আমি। মন জুড়ে বয়ে গেলো অদ্ভুত এক পরিপূর্ণতাময় শিহরণ!
২২
শরৎ-এর মাঝামাঝি। আকাশে পেঁজা তুলোর মতো শুভ্র মেঘের উড়ো উড়ি চোখে পড়ছে না। আকাশটা ছেয়ে আছে ছাই রঙা মেঘে। ব্যালকনির ডানপাশের দেয়ালটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। গায়ের গোলাপী-সাদা শাড়ির আঁচলটা অল্প অল্প উড়ছে। খোলা চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিতেই হাতের চুড়িগুলো রিনিঝিনি বাজছে। আজকাল বেশ উদাসীন হয়ে পড়েছি আমি। হুটহাট মন খারাপ হয়। আবার হুটহাটই অন্যায় হাসিতে মত্ত হই। 'অন্যায় হাসি' শব্দটা মনের মাঝে ছোট্ট বলের মতো ঢপ খেতে খেতে ঘুরে বেড়ায়। আচ্ছা? হাসির মাঝেও কি ন্যায়- অন্যায় হয়? হয়তো হয়! নয়তো নয়। আমার এসব অদ্ভুত চিন্তাগুলোর মাঝেই ধমকা হাওয়ার মতো পেছন থেকে ডেকে উঠলেন মামানি,
---" রোদু মা?"
আমি ছাই রঙা আকাশে দৃষ্টি রেখেই উত্তর দিলাম,
---" হু।"
মামানি আগ্রহ নিয়ে বললেন,
---" দারোয়ানকে দিয়ে লুডু কিনে আনিয়েছি। চল লুডু খেলি। অনেকদিন যাবৎ খেলি না।"
মামানির কন্ঠে হঠাৎই যেন কিশোরী মেয়ের চঞ্চলতা খুঁজে পেলাম আমি। ঘাড় ঘুরিয়ে মামানির দিকে তাকাতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মামানি। সোফায় বসে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন,
---" শুভ্র জন্মাবার আগে তোর মামু আর আমি রোজ লুডু খেলতাম। তোর মামু অফিস থেকে আসার পর কত রাত জেগে জেগে কাটাতাম আমরা।"
কথাগুলো বলতে গিয়ে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো মামানির ঠোঁটে। মনে হলো, উনি হয়তো সেই দিনগুলোকে দেখছেন। প্রথম যৌবনের শিহরণময় রাতগুলো যেন চোখের সামনে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। আমি হাসিমুখে মামানির পাশে গিয়ে বসলাম। কৌতূহল নিয়ে বললাম,
---" তারপর?"
আমার কথায় অন্যমনস্কতা কেটে গেলো মামানির। আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। হেসে বললেন,
---" তারপর একটা মাইর। খুব দুষ্টু হচ্ছিস দিন দিন। চল লুডু খেলবো। লুডুতে সবসময় জিতি আমি।"
আমি হেসে বললাম,
---" আর আমি সবসময়ই হারি!"
ড্রয়িংরুমের ফ্লোরে পা গুটিয়ে বসে লুডুর ওপর ঝুঁকে আছি। বিরবির করে বলছি, "একটা ছয়! আল্লাহ.. একটা ছয়।" এমন সময় পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন শুভ্র ভাই। উরুতে দু'হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। আমার হাত থেকে লুডুর কৌটোটা একরকম ছিনিয়ে নিয়ে বললেন,
---" ধুর! তুই পারিস নাকি কিছু? সর...আমিও খেলবো।"
আমি বিরক্ত চোখে তাকালাম। কৌটোটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
---" উফ্ ওটা দেন বলছি। বিরক্ত করবেন না একদম, এখন আমার চাল।"
উনি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললেন,
---" আমি বিরক্ত করছি? ঠাডায় লাগাবো একটা চড়, বেয়াদব। বড়দের রেসপেক্ট করতে শিখ। আমি গুণে গুণে তোর থেকে ছয় বছরের বড়।"
---" আশ্চর্য! আমি আপনাকে ডিসরেসপেক্ট কখন করলাম? মামানি? তোমার ছেলেকে এখান থেকে যেতে বলো নয়তো আমি উনার মাথা ফাটিয়ে দেবো।"
শুভ্র ভাই বিস্ময় নিয়ে বললেন,
---" কি সাংঘাতিক মেয়ে তুই! মুখের উপর মাথা ফাটিয়ে দিতে চাইছিস তবু বলছিস অসম্মান করছিস না? একদম বাপের মতো হয়েছে...."
আমি ঠোঁট উল্টিয়ে ধারালো দৃষ্টিতে তাকালাম। অনুযোগের সুরে বললাম,
---" আপনি আবার বাবাকে নিয়ে বাজে কথা বলছেন। খেলবো না আমি। এক্ষুনি বাসায় চলে যাবো।"
মামানি শুভ্র ভাইয়ের পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন,
---" একটা চড় দিবো। দিন দিন ফাজিল হচ্ছিস। ওর বাবা তোর কি হয়,হ্যাঁ? খবরদার এসব কথা যেন আর না শুনি। এবার এখান থেকে ভাগ।"
মামানির কথায় শুভ্র ভাইয়ের মধ্যে তেমন কোনো ভাবাবেগ হলো না। ফ্লোরে বেশ আয়েশ করে বসলেন। নাছোড়বান্দা গলায় বললেন,
---" আমিও খেলবো।"
আমি রাগ নিয়ে বললাম,
---" আপনাকে নেওয়া হবে না। আপনি না তুষার ভাইয়াদের সাথে বের হচ্ছিলেন? তাহলে সেখানে যান না....এখানে কি?"
উনি আমার মাথায় চাটি মেরে বললেন,
---" তুই বললেই আমায় যেতে হবে? আমার এখন যেতে ইচ্ছে করছে না, যাবো না। খেলতে ইচ্ছে করছে ... খেলবো, ব্যস।"
আমি কিছুক্ষণ মুখ ফুলিয়ে বসে রইলাম। মামানি আর আমি দু'জনেই জানি, এই মানুষটার মতো নাছোড়বান্দা ব্যক্তি পৃথিবীতে আর দুটো নেই। একবার যখন বলেছেন 'খেলবো' তারমানে পৃথিবী উল্টেপাল্টে গেলেও উনি খেলবেন। মামানি ছেলের যন্ত্রণায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আবারও নতুন করে গুটি সাজানো হলো। খেলা শুরু করার আধাঘন্টার মাঝেই লুডুর ছক উল্টে দিলেন শুভ্র ভাই। আমি আর মামানি দু'জনেই চোখ গরম করে তাকালাম। আমাদের তপ্ত দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে বলে উঠলেন উনি,
---" এটা কোনো খেলা হলো? ফালতু। লুডুর ছকও মেয়েদের সাইড নিচ্ছে। এই অসম অধিকার তো মানা যায় না। তোমাদের দু'জনেরই ছয় উঠছে আমার উঠছে না...... এটা তো রীতিমতো দুর্নীতি।"
উনার কথা শুনে রাগে শরীরটা জ্বলে উঠলো আমার। ইচ্ছে হচ্ছিলো উনার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো টেনেটুনে ছিড়ে ফেলি। একটা মানুষ এতোটা বিরক্তিকর কি করে হতে পারে? কি করে? মামানি রাগ নিয়ে বললেন,
---" বাপ ছেলে একরকম হইছে। চাপা দিয়েই পৃথিবী উদ্ধার করে ফেলে। খেলাটা এতো ভালোভাবে এগুচ্ছিলো নষ্ট করলি কেন?"
---" ভালো কই এগুচ্ছিলো? একদম বিশ্রীভাবে এগুচ্ছিলো। আমি হলাম যুবসমাজ...চোখের সামনে তো আর দুর্নীতি সহ্য করতে পারি না।"
---" এগুলো কথা তোর বাপের থেকে শিখছিস না? তোর বাপ যুবসমাজ থেকে বুড়োসমাজে পৌঁছেছে এখন ছেলে যুবসমাজ বলে হল্লা করছে। তোরা ময়মনসিংহের ছেলেরাই এমন....চাপাবাজ।"
শুভ্র ভাই যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,
---" ময়মনসিংহের ছেলেরা চাপাবাজ? ওকে ফাইন...বাবাকে ডাক। গার্লস Vs বয়েজ খেলা হবে। দেখি কে জিতে। শেরপুরের মেয়েরা নাকি ময়মনসিংহের ছেলেরা। ডাক... ডাক..."
মামানি কনফিডেন্স নিয়ে বললেন,
---" তোরা হারবি। তোর বাপও সারাজীবন হেরেছে, তুইও হারবি।"
---" দেখা যাবে। দেখা যাবে। হু..."
শুভ্র ভাইয়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করেই মামুকে ডাকলেন মামানি। চারবারের মাথায় বই হাতে বেরিয়ে এলেন মামু। নাকে পড়ে থাকা মোটা চশমার উপর দিয়ে মামানির দিকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
---" কি সমস্যা? এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন?"
মামানি এমনিতেই রেগে ছিলেন। মামুর কথায় রাগটা তার দ্বিগুণ হলো। ফুঁসে ওঠে বললেন,
---" একবার ডাকার পর চলে এলেই তো চেঁচাতে হতো না।"
মামু একবার আমার দিকে তাকালেন। ভাগ্নীর সামনে বউয়ের তেজ সহ্য করতে একদমই রাজি নয় সে। আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলেন মামু,
---" ডাকছিলে কেন?"
মামানি ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি ঝুলিয়ে নিয়ে বললেন,
---" লুডু খেলবো, আসো।"
মামানির কথায় কিছুক্ষণ বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মামু। ডানহাত দিয়ে চশমাটা ঠেলে দিয়ে বললেন,
---" তোমরা খেলো।"
আমি আদুরে গলায় বললাম,
---" মামু? চলো না খেলি। মজা হবে অনেক।"
মামু মৃদু হেসে বললেন,
---" তোরা খেল মা। আমি বই পড়ছি।"
---" প্লিজ মামু। প্লিজ...প্লিজ...।"
মামু কিছু বলার আগেই পাশ থেকে বলে উঠলেন শুভ্র ভাই,
---" আব্বু? আম্মু কিন্তু তোমায় ব্যাপক পঁচাচ্ছে। বলছে, তুমি নাকি সারাজীবন হেরে হেরে বুড়ো হয়েছো। আমি বলি নি, আম্মু বলেছে। আমিও নাকি তোমার মতো হেরে হেরেই বুড়ো হবো। আব্বু? এর প্রতিবাদ না করলে কিন্তু হচ্ছে না। গার্লস Vs বয়েজ খেলা হবে, মানসম্মানের ব্যাপার। চলে আসো...."
মামু খানিক ভাবলেন। মামানির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। হাতের বইটা টি-টেবিলে রেখে মামানির পাশে ফ্লোরে এসে বসলেন। আবারও নতুন উদ্দ্যমে খেলা শুরু হলো। কিছুক্ষণের মাথায় শুভ্র ভাই আমার পর পর দুটো গুটি খেয়ে দিলেন। রাগে-দুঃখে লোকটাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করলো আমার। আমাকে রাগী চোখে তাকাতে দেখেই হেসে ফেললেন উনি। ঠোঁট কামড়ে হেসে ডান চোখটা টিপে দিয়ে আবারও খেলায় মনোযোগী হলেন। সাথে সাথেই মামানির একটা গুটি গিয়ে পড়লো মামুর হাতে। মামনী রাগে ফুঁসে ওঠে বললেন,
---" এটা চিটিং ছিলো। তুমি ভুল চাল দিয়েছো।"
মামু গম্ভীর গলায় বললেন,
---" একদম না।"
লেগে গেলো দু'জনের মাঝে যুদ্ধ। এই বয়সে এসেও মামু-মামানিকে বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করতে দেখে রাগ ভুলে হেসে ফেললাম আমি। শুভ্র ভাই আমার দিকে একটু চেপে এসে ফিসফিস করে বললেন,
---" আল্লাহ বাঁচিয়েছে....এদিক থেকে আব্বুর চেয়ে আমি লাকি।"
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। উনি আবারও হাসলেন। শেষমেশ মামানিই জয়ী হলেন, গুটিটা আগের জায়গায় রেখে আবারও চাল দিতে হলো মামুকে। কিন্তু শেষ রক্ষাটা আর হলো না। ঘুরেফিরে একটা 'কানা' কে পুঁজি করেই জিতে গেলেন শুভ্র ভাই আর মামু। মামানি রাগে কটমট করে মামুর দিকে তাকালেন। মামু ব্যাপারটাকে এড়িয়ে চলার জন্য বই নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলেন। শুভ্র ভাই হাসি চেপে বললেন,
---" ইট'স ওকে আম্মু। এরপরের বার তোমরা জিতবে, সিউর।"
মামানি ফুঁসে ওঠে বললেন,
---" একদম আম্মু ডাকবি না। বাপের চামচা কোথাকার।"
শুভ্র ভাই অবাক হয়ে বললেন,
---" আরে, আমি কি করলাম?"
---" কি করলি মানে? তুই আমার দুটো গুটি খাইছিস।"
আমি ঠোঁট উল্টিয়ে বললাম,
---" আমারটা ছয়বার খেয়েছে।"
শুভ্র ভাই হেসে ফেললেন। ঠোঁট চেপে হাসি কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে বললেন,
---" আম্মু? তুমি বাচ্চাদের মতো করছো কেন? খেলায় এক-দুটো গুটি খাওয়া কোনো ব্যাপার না।"
পাশ থেকে মামু বলে উঠলেন,
---" তোর মা এমনই করে। আগে হারলে রাতের রান্না বন্ধ করে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতো।"
মামানি চেতে উঠে বললেন,
---" একদম চুপ। বাপ-ছেলে মিলে আমায় হেনস্তা করছো। আল্লাহ কেন আমাকে একটা মেয়ে দিলো না। তাহলে নিশ্চয় সে আমার সাইড হয়ে কথা বলতো। তুমিই সব নষ্টের গোড়া।"
মামু অবাক হয়ে বললো,
---" আরে... আমি কি করলাম?"
আমি একহাতে মামানিকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
---" ওদের ছাড়ো তো মামানি। ওরা সব চিট করেছে। নয়তো তোমার সাথে পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। এইযে মামুর ছেলে? নিজের দোষটা স্বীকার করতে শিখুন। বুঝেছেন?"
মামানি আমার কথায় খুশি হয়ে বললেন,
---" একদম। নিজেদের দোষ স্বীকার করা শিখ নয়তো বিয়ে টিয়ের নাম ভুলে যা। ঘুরে-ফিরে তো আমার কাছেই আসবি। তখন বুঝাবো মজা, আমি নিজে ভাঞ্জি দিয়ে বিয়ে ভেঙে দিবো। হুহ... "
শুভ্র ভাই হেসে ফেললেন। মামুর ঠোঁটেও মৃদু হাসি। শুভ্র ভাই হাত জোড় করে বললেন,
---" আদেশ শিরধার্য মাতা। সব দোষ আপনার স্বামীর...আমি স্বীকার করলাম।"
শুভ্র ভাইয়ের কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলাম আমি। মামু অবাক চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালেন। মামানি হেসে ফেলে বললেন,
---" দিন দিন ফাজিল হচ্ছিস তুই।"
শুভ্র ভাই তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
---" চলো একটা ফ্যামিলি পিক তুলি আম্মু। অনেকদিন যাবৎ একসাথে বসা হয় না আমাদের। এটা একটা মেমোরি.... এই দিনে শেরপুরের মাইয়াদের হারিয়ে দিয়েছি আমরা। আহা! স্বর্ণালী ইতিহাস। এই জিতটাকে বাঁধায় করে রাখতেই হবে।"
কথাটা বলে নিজেই হেসে ফেললেন উনি। মামানি, মামু হাসিমুখে সোফায় গিয়ে বসলেন। শুভ্র ভাইয়ের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম,
---" আপনি থ্রী কোয়াটার প্যান্ট পড়ে ফ্যামিলি ফটো তুলবেন?"
---" তো?"
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
---" কিছু না। আপনিও গিয়ে বসুন, আমি ছবি তুলে দিচ্ছি।"
উনি ফোনটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বললেন,
---"তুই কেনো তুলে দিবি?সর!"
উনার এমন কথায় বেশ অবাক হলাম আমি। মুখ ভার করে খানিকটা সরে দাঁড়ালাম। উনি ফোনে টাইমার সেট করে আমাকে টেনে নিয়ে মামানিদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠেলো। শুভ্র ভাই ফোনের কাছে গিয়ে বললেন,
---" পার্ফেক্ট ফ্যামিলি ফটো আম্মু। ওয়ান মোর..."
উনি আবারও টাইম সেট করে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। পাশে দাঁড়িয়েই আমার খোলে রাখা লম্বা চুলগুলো হালকা হাতে টানলেন। আমি চুলে হাত দিয়ে বিস্মিত চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। আমি তাকাতেই চমৎকার একটা হাসি দিলেন। সাথে সাথেই জ্বলে উঠলো ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। আমি চুলগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
---" শুধু শুধু ছবিটা নষ্ট করলেন। বিরক্তিকর।"
---" নষ্ট হয় নি বরং দারুন এসেছে। দেখিস... "
আমি মুখ বাঁকিয়ে মামানির পাশে গিয়ে বসলাম। শুভ্র ভাই আবারও ছুটলেন টাইমার সেট করতে।
___________________
হঠাৎ করেই ঘুম ছুটে গেলো আমার। চোখ পিটপিট করে চারপাশে তাকালাম। ঘরটা ঝাপসা অন্ধকার। শান্ত, শীতল পরিবেশ। বিছানা থেকে একটু দূরে ছোট্ট আলো জ্বলছে। সেই আলোতেই ফুটে উঠেছে অস্ফুট এক অবয়ব। ঘুম ভেঙেই এমন একটা দৃশ্য দেখে চমকে উঠলাম আমি। চোখ দুটো বোজে নিয়ে আবারও চোখ মেলে তাকালাম। ওই আলোমাখা অবয়বটা যে শুভ্র ভাই সেটাও বেশ বুঝতে পারলাম। আমি আর কিছু ভাবার আগেই মামনির কন্ঠ কানে এলো। তারস্বরে আমার নাম ধরে ডাকছেন উনি। দরজার কাছাকাছি এসে লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে আবারও ডেকে উঠলেন উনি। আমি কি ভেবে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম। শুভ্র ভাই তাড়াহুড়ো করে বললেন,
---" আস্তে আম্মু। ঘুমের মাঝে কেউ এতো জোরে ডাকে? চমকে উঠবে তো।"
---" ওহ্ খেয়াল ছিলো না। রোদু? এই রোদু?"
---" থাক না আম্মু। ঘুমোচ্ছে ঘুমোক। ডেকো না। আমি দাদুর রুমে চলে যাচ্ছি।"
---" ডাকবো না মানে? খায় নি তো রাতে। সেই সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পড়েছে। খেতে হবে না?"
---" খায় নি তো ঘুমুতে দিয়েছো কেন?"
---" আমি কি ঘুমুতে দিয়েছি নাকি? তোর ল্যাপটপে নাটক দেখছিলাম। ও বিছানায় শুয়ে ছিলো। কখন ঘুমিয়ে গিয়েছি বুঝতেই পারি নি। তখন ডাকি নি ভাবলাম খাওয়ার সময় ডাকবো।"
---" ঘুমিয়ে যখন পড়েছেই তখন থাক। একরাত না খেলে কিছু হবে না। এখন ডাকলে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে। সকালে এক প্লেটের জায়গায় দু'প্লেট খাইয়ে দিও। তাতেই হবে।"
মামানি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। উনার নিঃশ্বাসের শব্দ নিস্তব্ধ রুমের বাতাসে আঘাত হেনে খনিকের মাঝেই মিলিয়ে গেলো। ছোট্ট করে বললেন,
---" ঠিক আছে। তুই তাহলে তোর দাদুর রুমেই শুয়ে পড়িস...এবার খেতে আয়।"
---" হুম। যাচ্ছি। আব..শুনো আম্মু? মশারীটা কোথায়?"
মামানি বিস্মিত কন্ঠে বললেন,
---" মশারী দিয়ে কি হবে? তোকে তো মেরে কেটেও মাশারী টানাতে রাজি করানো যায় না, আজ হঠাৎ।"
---" আমাকে মশা কামড়ায় না কিন্তু...."
---" কিন্তু?"
---" না.. আসলে...এতো প্রশ্ন কেনো করছো মা? উত্তরটা দিয়ে দিলেই তো হয়। মশারি কোথায়?"
---" আলমারির কোন চিপাই আছে কে জানে? অনেক খুঁজতে হবে। কয়েল জ্বালিয়ে দে......তাহলে যাকে নিয়ে চিন্তা করছিস তাকেও মশা কামড়াবে না।"
শুভ্র ভাই কেশে উঠলেন। মামানি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
---" খেতে আয় জলদি।"
মামানী হয়তো রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। পায়ের শব্দগুলো ধীরে ধীরে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এলো। শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বিছানার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি কোনোরকম দম আটকে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। বারবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি ধরা পড়ে যাচ্ছি আমি। এই বুঝি কাপড় সরে গেলো শরীর থেকে। এই বুঝি ধরে ফেললেন সব চুরি। এতোসব চিন্তা নিয়ে ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকা ধীরে ধীরে দুষ্কর হয়ে উঠলো আমার জন্য। উনি জোড়ে একটা শ্বাস টেনে নিয়ে আমার মাথার পাশে বসলেন। ঠিক সেই সময়েই আমার খোলা চুলগুলো নাকে-মুখে সুড়সুড়ি দিতে লাগলো আমায়। ইশ! কি একটা ঝামেলা। আচ্ছা? ঘুমের ভান ধরে চুল ঠিক করলে কি উনি বুঝে যাবেন? অনেক চিন্তা ভাবনা শেষে, চুলের সুড়সুড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে ডানহাতে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুলাম আমি। আমি পাশ ফিরে শুয়ার দুই মিনিটের মাথায় চুলে টান অনুভব করলাম। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! শুভ্র ভাই কি আমার চুল ধরে টানছেন? কিন্তু কেনো? উনি কি বুঝে গেছেন আমি জেগে আছি? নাকি অন্য ব্যাপার? আমার ছোট্ট মাথায় এতো এতো টেনশন নিয়ে ছটফট করতে লাগলাম আমি। যতটুকু পারি চোখ খিঁচে পড়ে রইলাম। পাঁচ মিনিটের মাথায় চুলের টান কমে এলো। একটা গরম নিঃশ্বাস ক্রমান্বয়ে গাঢ় থেকে গাঢ় হয়ে পড়তে লাগলো আমার ঘাড়ে,গলায়। আরো একদফা চমকে উঠলাম আমি। এটা কি সত্যিই শুভ্র ভাই? নাকি কোনো ভূত,টূত কিছু একটা। নয়তো, শুভ্র ভাই এমন অদ্ভুত বিহেভ কেন করবেন? আমার চিন্তার মাঝেই দূরে সরে গেলো সেই নিঃশ্বাস। গায়ে চাদরের মতো কিছু একটা অনুভব করলাম। অল্প একটু চোখ খুলে গায়ে জড়ানো বস্তুটির দিকে তাকালাম --- কাঁথা। এই কাঁথাটা নেওয়ার জন্যই কি এতোটা কাছাকাছি এসেছিলো মানুষটা? মুহূর্তেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস খেলে গেলো মনে। মাথায় আর কপালে কারো ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে আবারও নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো আমার। চোখ মেলে খুব করে দেখতে ইচ্ছে করলো শুভ্র ভাইয়ের মুখ। কিন্তু সে সুযোগ হলো না। প্রায় সাথে সাথেই রুমের আলো নিভিয়ে বেরিয়ে গেলেন উনি। 'উনি চলে গেছেন!' ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি। কাঁধে পড়ে থাকা লম্বা বিনুনিটা দেখেই অবাক হলাম। বিনুনির শেষ প্রান্তে ছেলেদের হাতে পড়ার ব্যান্ডগুলো বাঁধা দেখে প্রচন্ড হাসিও পেলো। বুকে একরাশ প্রশান্তি নিয়ে আবারও গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। শরীর-মন চঞ্চল হয়ে উঠছে হঠাৎ। অসম্ভব ভালো লাগায় ছেয়ে যাচ্ছে চারপাশের আকাশ, বাতাস, গুমোট অন্ধকার....
২৩
শরৎ কালের মাঝামাঝিতেও বর্ষার মতো ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে আমার মুখটাও ঘন মেঘে ঢেকে আছে। আমার ঠিক সামনে ভ্রু কুঁচকে বসে আছেন শুভ্র ভাই। তার চোখে-মুখে বিরক্তি স্পষ্ট। কিছুক্ষণ বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে দেখে, বিরক্ত চোখজোড়া তুলে আমার দিকে তাকালেন। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
----" A good student is never indifferent to his studies. এখানে ইনডিফারেন্টের পর 'টু' কেন বসলো, বল তো?"
আমি চোখ পিটপিট করে তাকালাম। উনার কুঞ্চিত ভ্রু জোড়া আরো খানিকটা কুঁচকে এলো। দু'ভ্রুয়ের মাঝে হাজার টন বিরক্ত এঁটে নিয়ে বললেন,
----" কি হলো? বল!"
আমি ঘাড় চুলকিয়ে বললাম,
----" ক্ষুধা লেগেছে। প্রচুর!"
শুভ্র ভাই শান্ত চোখে তাকালেন। বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন,
----" 'টু' কেন বসলো বল।"
আমি অসহায় চোখে তাকালাম। কোথায় কিসের 'টু' না 'ফু' বসেছে তা নিয়ে মোটেও ভাবতে ইচ্ছে করছে না। মূলত পড়তেই ইচ্ছে করছে না। আমি গালে হাত দিয়ে বসে...উনার দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বললাম,
----" বিয়ে করবো।"
উনি আবারও চোখ তুলে তাকালেন। উনার গভীর শান্ত চাহনী দেখেই মনের মাঝে প্রেমময় হাওয়া বয়ে গেলো। উনাকে চুপ থাকতে দেখে ঠোঁট উল্টে বলে উঠলাম আমি,
----" পড়াশোনা ভাল্লাগে না। তার থেকে বরং বিয়ে করে ফেলি। ব্যাপারটা দারুন হবে। আপনি একটু ছেলে টেলে দেখুন তো। যে ছেলে জীবনেও পড়তে বসতে বলবে না তাকেই বিয়ে করবো।"
শুভ্র ভাই এবারও কিছু বললেন না। বইটা বন্ধ করে গম্ভীর চোখে তাকালেন। উনার এই শান্ত ভঙ্গিমা আমার ঠিক হজম হলো না। ঢোক গিলে নিয়ে বললাম,
----" মনের কথা শুনতে হয়। মন যা চায় তাই করতে হয়। আমার বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে তাই বলছিলাম যে...."
আমার কথাটা শেষ না হতেই গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন শুভ্র ভাই,
----" আমারও এখন তোকে ঠাডিয়ে চড় লাগাতে ইচ্ছে করছে। আমার কি আমার মনের কথা শুনা উচিত?"
আমি খানিক চুপসে গেলাম। কলম আর খাতাটা তুলে নিয়ে পড়াশোনায় অতিরিক্ত ব্যস্ততা দেখাতে লাগলাম। উনি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
----" ইংলিশে তোর বেসিকটা ঠিক কোন লেভেলে আছে তাই বু....."
উনি এটুকু বলতেই হুট করে বলে উঠলাম আমি,
----" ব্ল্যাক টি-শার্টে আপনাকে একদম অস্থির লাগছে শুভ্র ভাই। অনেকটা সাউথ ইন্ডিয়ান ফিল্মের হিরোদের মতো।"
উনি এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। রাগ নিয়ে বললেন,
----" সমস্যাটা কি তোর?"
আমি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
----" আমার আবার কিসের সমস্যা? আমি তো জাস্ট সত্যটা বললাম। লুকিং ড্যাশিং!"
----" তুই কি আজ মার খাওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়েই পড়তে বসেছিস রোদু?"
আমি মুখ ভার করে বললাম,
----" আমি আপনার প্রসংশা করলাম আর আপনি আমায় বকছেন? মারতে চাইছেন? অন্যকেউ হলে কখনোই এমন করতো না। নিরামিষ!"
শুভ্র ভাই চাপা গলায় বললেন,
----" আমি অন্যকেউ নই বলেই তোর এই ট্রিকটা কাজে লাগবে না। এতোগুলো বছরে একবারও আমাকে ড্যাশিন, কিউট মনে হলো না তোর। আজ পড়তে বসেই আমি ড্যাশিন? এতো সহজ আমাকে ডিসট্রেক্ট করা? চুপচাপ পড় নয়তো মাইর।"
আমি অসহায় বাচ্চার মতো তাকিয়ে থেকে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম। আহ্লাদী গলায় বললাম,
----" আমি এখন পড়বো না। ঘুম পাচ্ছে আমার। প্লিজ প্লিজ!"
শুভ্র ভাই অধৈর্য্য গলায় বললেন,
----" এখন কিসের ঘুম? বাচ্চামো না করে পড়তে বস। এক ঘন্টা ধরে কিচ্ছু পড়িস নি তুই। এখন সত্যিই চড় লাগাবো আমি।"
----" আমার সত্যিই ঘুম পাচ্ছে। লুক এট মাই আইস্। তাছাড়া, আপনার কাছে পড়া টড়া হবে না আমার। ক্রাশ টাইপ ছেলেদের সামনে পড়তে বসলে বইয়ের থেকে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় বেশি। এভাবে পড়া সম্ভব?"
আমার কথায় মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লেন শুভ্র ভাই। আমি হাসি হাসি মুখ নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনাকে বিরক্ত করতে ভীষণ আনন্দ লাগছে আমার। কিন্তু সেই আনন্দটা খুব বেশিক্ষণ টিকলো না। ডান পা'টা চেয়ারে আটকিয়ে আমিসহ চেয়ারটাকে নিজের দিকে টেনে নিলেন উনি। টেবিলের সাথে এই আকস্মিক ঘর্ষনে চমকে উঠলাম আমি। উনি দরজায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিচু গলায় বললেন,
----" রোদপাখি? আমি আমার ফুল ফর্মে চলে এলে শুধু পড়া কেন? তোমার এখানে বসে থাকাটাও হয়ে উঠবে না। তুমি কি তাই চাইছো?"
উনার কথায় বিস্ফারিত চোখে তাকালাম আমি। শুভ্র ভাই মৃদু হাসলেন। পা দিয়ে ঠেলে, চেয়ারটা আবারও ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললেন,
----" কাল থেকে আমার বাসায় গিয়ে পড়ে আসবি তুই। নিজের ঘরে বসে পড়িস কারণেই ঘুম, ক্ষুধা, বিয়ে, ড্যাশিন এতোকিছু.... আমার ঘরে বসে পড়লে এসব কিছুই হবে না। আমি ফুপ্পিকে বলে রাখবো। কাল থেকে ওই বাসায় গিয়ে পড়বি তুই। তারপর দেখবো ঘুমটা কিভাবে আসে তোর।"
আমি উদাস চোখে জানালা ভেদ করে আকাশের দিকে তাকালাম। মেঘে ঢাকা আকাশ থেকে ফোঁটা ফোঁট বৃষ্টি পড়ছে। যেকোনো সময় শুরু হবে মুষলধারার বর্ষন। চারপাশে থমথমে ভাব। প্রকৃতিও যেন আমার মতোই দুঃখী মন নিয়ে অস্থির, অলসভাবে বসে আছে সর্বক্ষন। আমার ভাবনার মাঝেই স্কেলের দানবীয় আঘাতে টেবিলেটাকে কাঁপিয়ে দিলেন শুভ্র ভাই। আমি চমকে উঠে সচেতন চোখে তাকালাম। উনি শক্ত গলায় বললেন,
----" পড়। নয়তো নেক্সট মাইরটা তোর গায়ে পড়বে।"
আমি অসহায় চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই পড়ায় মনোযোগ দিলাম। টানা দু-ঘন্টা পড়ার পর আবারও চেয়ার গা এলিয়ে দিলাম আমি। ঝুঁটি করে রাখা লম্বা চুলগুলো একটানে খুলে নিয়ে বললাম,
----" মাথাটা ধপধপ করছে। আর একটা হরফও পড়বো না আমি।"
শুভ্র ভাই জবাব দিলেন না। চেয়ারের গায়ে ঠেস দিয়ে গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি আবারও জানালা ভেদ করে বাইরে তাকালাম। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ করেই মনে পড়লো 'আমি-তুমি' তো বারান্দায়! চেয়ার ছেড়ে দৌঁড় গেলাম বারান্দায়। বারান্দার এক কোণায় মোটা রডে আটকে রাখা আমি-তুমির ছোট্ট খাঁচাটা। বৃষ্টির ছাঁটে খাঁচার একটা কোণ ভিজে একাকার। বারান্দার মেঝেও পানিতে পিচ্ছিল। আমি পা টিপে টিপে বারান্দার দক্ষিণের কোণের দিকে এগিয়ে গেলাম। বৃষ্টির ছাঁটে জামা আর ওড়নার একপাশটা ভিজে এসেছে প্রায়। এক হাতে কপাল চুইয়ে পড়া পানিটুকু মুছে নিয়ে অন্যহাতে খাঁচার দিকে হাত বাড়ালাম। খাঁচার রিংটা রডের কোণায় আটকে যাওয়ায় বেশ বেগ পেতে হলো আমায়। টেনে হিঁচড়েও খাঁচাটা নিজের হাতের মুঠোয় না আনতে পেড়ে মেজাজটাই বিগড়ে গেলো। এমন সময়, আমার হাতের ওপর দিয়ে একটা লম্বা, শক্ত হাত এসে থামলো খাঁচাটার ওপর। চোখের পলকেই রিংটা খুলে নিয়ে আমাকে সহ খানিকটা দূরে এসে দাঁড়ালেন। বৃষ্টির ছাঁট থেকে নিরাপদ দূরত্বে এসে দাঁড়ানোর পর পেছন ফিরে তাকালাম। শুভ্র ভাই মিষ্টি হেসে বললেন,
----" 'তুমিটা' একদম ভিজে গিয়েছে।"
উনার কথার ভিত্তিতে চোখ ফিরিয়ে খাঁচার দিকে তাকালাম। হলুদ রঙা পাখিটা সত্যিই ভিজে গিয়েছে খুব। বার বার গা ঝাড়া দিয়ে পানি ঝাড়ছে। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো নীল পাখিটা বারবার হলুদ পাখিটার গা ঘেঁষে দাঁড়াচ্ছে.... মাঝে মাঝে একবার দু'বার ঠুকরে দিচ্ছে। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে 'তুমির' ভিজে যাওয়া ঠান্ডা শরীরটাকে নিজের উত্তাপটুকুও বিলিয়ে দিতে চাইছে। ওদের এমন কাজে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলাম আমি। শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
----" কি মারাত্মক প্রেমিক 'আমি'। 'তুমিকে' কতো ভালোবাসে দেখেছিস? কিন্তু আফসোস, তুমিরা সবসময় বোকা হয়।"
আমি স্নিগ্ধ চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি আমার থেকে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ালেন। নিজের চুল আর কাঁধের দিকটা ঝাঁড়তে ঝাঁড়তে বললেন,
----" গর্দভের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গিয়ে ড্রেস চেইঞ্জ কর! ভিজে গেছিস তুই।"
আমি একবার উনার দিকে তাকালাম। ভেজা চুল আর ভেজা শার্টে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে উনাকে। কয়েক সেকেন্ড উনার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে ফ্লোরের কাছে নামিয়ে রাখলাম আমি-তুমির ছোট্ট সংসার। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললাম,
----" আজ বৃষ্টিবিলাসের দিন। বৃষ্টির ছোঁয়ায় পাগল হওয়াটা আজ চাইই চাই।"
এটুকু বলে, পায়ের নুপুরে তুমুল রুনুঝুনু শব্দ তুলে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে। ড্রয়িংরুমে বসে পালংশাক বাছছিলেন আম্মু আর ফুপ্পি। আদিবা-জারিফ এদিক ওদিক ছুটাছুটি করে চলেছে অনবরত। ওদেরকে দেখেই উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠলাম আমি,
----" এই বাচ্চাপার্টি? বৃষ্টিতে ভিজবি?"
ওরা কিছু বলার আগেই চেঁচিয়ে বলে উঠলেন ফুপ্পি,
----" খবরদার বৃষ্টিতে ভিজবি না। মাত্রই জ্বর থেকে ওঠলি। একদম কুটে ফেলবো দুটোকে।"
ফুপ্পির কথার তোয়াক্কা না করে আম্মুর দিকে তাকালাম,
----" আম্মু ভিজি? প্লিজ প্লিজ।"
আম্মু গম্ভীর গলায় বললেন,
----" একদম না।"
----" প্লিজ!!"
----" না মানে না।"
ততক্ষণে বসার ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন শুভ্র ভাই। ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেই অনেকক্ষণ। আমি মুখ ভার করে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই মৃদু হেসে ঘাড় কাত করলেন। চোখের ইশারায় বুঝালেন, 'পারমিশন গ্রেন্টেড'। দৌঁড়ে ছাদে উঠে যাওয়ার দায়িত্ব আমার আর আম্মুকে সামলানোর সব দায় নিতান্তই উনার। আমার চোখে-মুখে মুহূর্তেই খুশির ঝিলিক খেলে গেলো। সিঁড়ি ঘরের দিকে দৌঁড় লাগিয়ে বললাম,
----" আম্মু আমি ভিজতে গেলাম।"
আম্মু চেঁচিয়ে বললেন,
---" রোদ... রোদ..."
ততক্ষণে সিঁড়িঘর পেরিয়ে গিয়েছি আমি। মোটা মোটা বৃষ্টির ফোঁটায় শরীর রাঙিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছি ছাদের এ কোণ থেকে ও কোণ। বৃষ্টির ঠান্ডা স্পর্শে শরীরটা কেঁপে কেঁপে ওঠছে। দুই বাহু ফেলে আকাশের দিকে মুখ করে তাকাতেই ঢলে পড়া আকাশটাকে মনে হচ্ছে অন্য এক ভুবন। আমার ছাদে আসার কিছুক্ষণ পরই আদিবা-জারিফও দৌড়ে এলো ভিজতে। তার কিছুক্ষণ পর আপুও এলো। এক ফাঁকে শুভ্র ভাইও এলেন। তবে না ভিজে, ছাঁদের দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ। আপু আর বাচ্চাদের সাথে হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে উনার দিকে চোখ পড়তেই মিষ্টি হাসলাম আমি। আমার হাসির পরিবর্তে একগুচ্ছ নেশাগ্রস্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলেন উনি। গভীর চোখে তাকিয়ে রইলেন শুরু থেকে শেষ অব্দি।
২৪
বৃষ্টি আর ঘুমের মাঝে অদৃশ্য এক বন্ধন আছে। বৃষ্টি হলেই ঘুম ভালো হবে, এ যেন চিরন্তন সত্য। বৃষ্টি আর ঘুমের মাঝের এই নিগূঢ় প্রেমের লজিক্যাল কারণটা সঠিক জানা নেই আমার। তাই বলে আমি তাদের প্রেমবিরোধী নই বরং পক্ষপাতী। আশ্বিন মাসের নয় তারিখ। এ সময় প্রকৃতির ঢালা বর্ষন খুব একটা চোখে পড়ে না। তবে এবার পড়ছে। রাত-দিন অন্ধকার করে বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টিময় সকালে সারা শরীর কাঁথায় মুড়িয়ে শুয়ে আছি আমি। ঘুমটা তখন মাখোমাখো হয়ে এসেছে। এমন সময় কাঁথা টেনে ধরে বিকট শব্দে ডেকে উঠল কেউ। আমি বিরক্তি নিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকালাম। সাথে সাথেই চাওড়া হাসল রাফিয়া। লাফিয়ে বিছানায় ওঠে তুমুল ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
----" এই রোদু? ওঠ! আমি শেরপুর থেকে চলে এলাম আর তুই ঘুম থেকেই উঠতে পারলি না? এগারোটা বাজল বলে। জেঠীমণি এখনই ঝাড়ু নিয়ে আসবেন তোকে মারতে।"
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। হঠাৎ ঘুম ভাঙায় রাফিয়ার অনবরত বলা কথাগুলো বুঝতে খানিক বেগ পেতে হল আমায়। চোখ-মুখ কুঁচকে বললাম,
----" সকাল সকাল কই থেকে টপকাইলি রে তুই? আর কোনো কাম কাজ নাই? সুযোগ পেলেই দৌঁড়ায় দৌঁড়ায় চলে আসিস। মেজো কাকি এত সহজে আসতে দিল তোকে?"
রাফিয়া দাঁত কেলিয়ে বলল,
----" আসতে দিবে না মানে? আম্মা তো নিজেই চলে আসছে।"
আমি বিস্ফারিত চোখে তাকালাম। সটান ওঠে বসে বললাম,
----" মেজো কাকিও এসেছে নাকি?"
রাফিয়া বালিশে ঠেস দিয়ে বসল। ফোনে ব্যস্ত হয়ে বলল,
----" শুধু আম্মা কেন? ভাইয়া আর বাবাও এসেছে।"
রাফিয়ার কথায় বেশ অবাক হলাম। কোলের ওপর বালিশ টেনে নিয়ে বললাম,
----" বলিস কি? হঠাৎ সপরিবারে আগমনের কারণটা কি বল তো? তাও আবার এমন বৃষ্টির দিনে?"
রাফিয়া আড়চোখে আমার দিকে তাকাল। ফোনটা পাশে রেখে বলল,
----" আজকে যে রুহি আপুকে দেখতে আসছে জানিস না তুই? এবার বোধহয় বিয়েটা হয়েই যাবে। ছেলেটা দেখতে ভালোই। আব্বুর অফিসের কলিগের ছেলে। সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার।"
আমি হঠাৎ করেই চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
----"কি?"
রাফিয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
----" হুম। আপুও হয়ত জানে না। আরাফ ভাইয়ার সাথে আপুর প্রেমটা সাকসেসফুল হওয়ার চান্স এখন ১% হয়ে গেল রে। বিষয়টা কষ্টের!"
আমি বিরক্ত চোখে তাকালাম। হঠাৎ করেই উপলব্ধি করলাম রাফিয়ার কথায় ভয়ানক বিরক্ত হচ্ছি আমি। বিরক্তিটা মাথার নিউরনে নিউরনে রিনরিন করে বাজছে। আমার বিরক্তির মাঝেই দরজা থেকে দমফাটা গলায় ডেকে উঠলেন আম্মু,
----" রোদু? উঠলি না এখনও? প্রতিদিন দুপুর অব্দি ঘুমানোটা কেমন স্বভাব? যেমন ভাই তার তেমন বোন। বাপের আস্কারা পেতে পেতে লাটে উঠছে। কিছু বলতে গেলেই বলবে, আহা! ডেকো না। রাত জেগেছে মেয়েটা। বলি, রাত জেগে কোন দুনিয়া উদ্ধার করেছে সে? মানুষের ছেলেমেয়েরা সারারাত পড়াশোনা করেও কাকভোরে ঘুম থেকে উঠছে। নামায পড়ছে। আর আমার ছেলেমেয়েদের দেখো? এসব আর সহ্য হয় না আমার। বিরক্ত হয়ে গিয়েছি এই সংসারে। মাঝে মাঝে নিজের মাথায় কুপ মেরে মাথাটা দু'ভাগ করে ফেলতে ইচ্ছে করে।"
এটুকু বলে দম নিলেন আম্মু। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে সুর বদলে বললেন,
----" বাবু ওঠ। ঘরটা একটু গুছা মা। বাবু? এই রোদু? উঠলি না?"
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
----" উফ মা! উঠেছি তো।"
----" বিছানায় বসে থাকলে তাকে উঠা বলে? বিছানা থেকে নেমে হাঁটাচলা করলে না ঘুম ভাঙবে। তাড়াতাড়ি ওঠ।"
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাফিয়াকে পাশ কাটিয়ে বিছানা ছাড়লাম। ফ্রেশ হয়ে চুলগুলোকে হাতখোঁপা করতে করতে বসার ঘরে আসতেই চোখ পড়ল মামানির ওপর। হাতে একটা খাতা নিয়ে বসে আছেন উনি। আম্মুর সাথে মিলে কিছু একটার লিস্ট বানাচ্ছেন। আমাকে দেখেই মুচকি হাসলেন মামানি। হাসিমুখে বললেন,
----" একটু আমাদের বাসায় যা তো রোদু। ফ্রিজে মশলা বাটা আছে। ওখান থেকে লাল আর নীল রঙের বাটিটা আনবি। নরমালে কিছু কাঁচা মরিচ আছে ওগুলোও আনিস।"
আম্মু বাঁধা দিয়ে বললেন,
----" কাঁচা মরিচ কিনে আনলেই হবে ভাবি।"
----" অতগুলো মরিচ থাকতে কিনবে কেন? এমনিতেও দু-একদিন পর নষ্ট হয়ে যাবে সব।"
এটুকু বলে আমার দিকে তাকালেন মামানি। তাড়া দিয়ে বললেন,
----" কি রে? দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? জলদি যা। আর শোন? শুভ্রকে বলবি তোর মা ডেকে পাঠিয়েছে। রাহাত ওর জন্য অপেক্ষা করছে। একসাথে বাজারে পাঠাব দু'জনকে। জলদি যা।"
আমি বিরস মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নড়েচড়ে উঠলাম। দরজার পাশে রাখা ছাতাটা নিয়ে রাফিয়াকে ডাকলাম। শুভ্র ভাইদের বাসায় যাব শুনেই লাফিয়ে রাজি হয়ে গেল রাফিয়া। মনে মনে চরম বিরক্ত হয়ে প্যাচেপ্যাচে কাঁদায় পা রাখলাম। বৃষ্টির দিনে এই একটা সমস্যা, কিছুক্ষণের জন্য বেরুলেও জামা কাপড়ের অবস্থা থাকে না । মামানিদের বাসায় গিয়েই সোজা রান্না ঘরে চলে এলাম আমরা। ফ্রিজ খুলতে খুলতে বললাম,
----" তুই গিয়ে শুভ্র ভাইকে ডেকে আয় রাফিয়া। আমি কাঁচা মরিচ আর মশলা বের করছি।"
রাফিয়া খুশি হয়ে শুভ্র ভাইয়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মাঝে ফিরেও এল। আমি ফ্রিজের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললাম,
----" বলেছিস?"
রাফিয়া মুখ কাঁচুমাচু করে বলল,
----" শুভ্র ভাইয়া ঘুমোচ্ছে। তুই গিয়ে ডেকে তোল। আমি পারব না। পরে যদি রেগে গিয়ে ধমক দেয়?"
----" ধমক দিলে তুইও ধমক দিবি। ধমকে ধমকে কাটাকাটি।"
----" শুভ্র ভাইয়াকে ধমক দিবো আমি? পাগল হয়েছিস? উনি আমার দিকে তাকালেই তো ভয় লাগে আমার। তুই যা বোন। আমি এগুলো ব্যাগে ভরছি.....তুই বরং উনাকে ভর থুক্কু উনাকে তোল।"
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাফিয়ার দিকে তাকালাম। রাফিয়া অসহায় মুখ করে বলল,
----" প্লিজ!"
আমি কিছু না বলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। শুভ্র ভাই কম্বল পেঁচিয়ে ঘুমোচ্ছেন। ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে। আলো নেভানো। চারপাশে কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। এই ঠান্ডা দিনে ফ্যানের কি প্রয়োজন, কে জানে? আমি কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকেই সুইচ টিপে আলো জ্বালালাম। ফ্যানটা অফ করে বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। মৃদু গলায় ডাকলাম,
----" শুভ্র ভাই? শুভ্র ভাই?"
আমার ডাকে উনার মধ্যে কোনো হেলেদুল দেখা গেল না। খানিকটা ঝুঁকে এসে আবারও ডাকলাম,
----" শুভ্র ভাই?"
উনি এবার কম্বলের ভেতর থেকে উঁকি দিলেন। আমাকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে বললেন,
----" কি সমস্যা ছকিনার মা?"
আমি তেতে উঠে বললাম,
----" ছকিনার মা মানে?"
উনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন,
----" তা নয়ত কি? সত্যি করে বল তো, তোর কি আর কোন কাজ নেই? আমি ঘুমালেই দৌঁড়ায় দৌঁড়ায় ডিস্টার্ব করতে চলে আসিস। আমি তো আর সাধে বলি না যে, তুই তোর বাপের মত হয়েছিস। দু'জনেই সেইম। একজন শান্তি নষ্ট করে তো অন্যজন ঘুম।"
আমি নাক ফুলিয়ে বললাম,
----" খবরদার বাবাকে নিয়ে কিছু বলেছেন তো। খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরে দেব একদম।"
শুভ্র ভাই বিস্ফারিত চোখে তাকালেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,
----" কি ভয়ানক মেয়ে রে তুই। মুখের ওপর মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছিস। তাও আবার বাড়ি বয়ে এসে? ফাজিল মেয়ে।"
----" আপনার সাথে ফাও ঝগড়া করার কোন ইচ্ছে আমার নেই। আম্মু আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছে। আর আমি হলাম তার পেয়াদা।"
শুভ্র ভাই কপাল কুঁচকে তাকালেন,
----" কেন? ডেকে পাঠাল কেন?"
আমি দাঁত কেলিয়ে বললাম,
----" জামাই আদর করতে।"
উনি আগ্রহী গলায় বললেন,
----" সত্যি?"
----" আপনার মাথা! ভাইয়াকে আর আপনাকে বাজারে পাঠাবে বলে লিস্ট হাতে বসে আছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে কামলাগিরি করেন গিয়ে যান।"
আমার কথা শেষ না হতেই মুখ-চোখ ডেকে আবারও শুয়ে পড়লেন শুভ্র ভাই। আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম,
----" আরেহ্ শুয়ে পড়লেন কেন আবার?"
উনি কম্বলের ভেতর থেকেই উত্তর দিলেন,
----" প্রথম কথাটা পছন্দ হয়েছে। দ্বিতীয় কথাটা পছন্দ হয় নি। এই ছ্যাতছ্যাতে দিনে বাজারে যেতে পারব না আমি।"
----" উফ! ঢং করবেন না তো। আজ আপুকে দেখতে আসবে। মামানি আপনাকে আর্জেন্ট যেতে বলেছে।"
শুভ্র ভাই এবার কম্বল সরিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। খুশি খুশি গলায় বললেন,
----" সত্যি? কিন্তু, তার জন্য আমাকে বাজারে যেতে হবে কেন? সত্যি করে বল তো? তোর বাপ কি আমাকে বৃষ্টির পানিতে ডুবিয়ে, নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে খুন করতে চায়ছে? মেয়ে বিষ খাওয়াবে আর বাপ নিউমোনিয়ার রোগী বানাবে। কি সাংঘাতিক বুদ্ধি রে বাবা! যেমন মেয়ে তার তেমন বাপ।"
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
----" আপনি জাস্ট অসহ্য একটা লোক।"
এমন সময় দরজার কাছে এসে দাঁড়াল রাফিয়া। ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল,
----" ওগুলো ব্যাগে ভরে নিয়েছি। শুভ্র ভাইয়া উঠেছে?"
শুভ্র ভাই দরজার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। উঠে বসতে বসতে বললেন,
----" বাহ্ আমাকে নিতে এতগুলো পেয়াদা? নিজেকে খুব স্পেশাল স্পেশাল লাগছে আজ। তো, কেমন আছ রাফিয়া?"
রাফিয়া খুশি খুশি গলায় বলল,
----" ভালো আছি ভাইয়া।"
আধাঘন্টাময় নানা ঢং সং করে আমাদের বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন উনি । কিন্তু গেইটের কাছে এসেই বাঁধল আরেক বিপত্তি। ফ্ল্যাট থেকে নেমে আসার সময় ছাতা আনতে ভুলে গিয়েছেন শুভ্র ভাই। অথচ, বাইরে রাত-দিন অন্ধকার করা বৃষ্টি। উনি চাইলেই উপরে গিয়ে ছাতা আনতে পারেন। চারতলা উঠা আহামরি কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু উনি যাবেন না। আমাদের দুটো ছাতার মধ্যে থেকেই একটি উনার চায়। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
----" আপনি একা একটা ছাতা নিয়ে নিলে আমরা ভিজে যাব না?"
উনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন,
----" ভিজলে ভিজলি। তাতে আমার কি? তবে চাইলে আমার ছাতায় আশ্রয় নিতেই পারিস। আমি মাইন্ড করব না।"
উনার কথাটা শুনেই মেজাজ চটে গেল আমার। গেইটের পাশে পড়ে থাকা ইট নিয়ে মাথা ফুটো করে দেওয়ার তুমুল ইচ্ছে জাগল। নিজেকে কোনরকম শান্ত করে রাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
----" রাফিয়া? তুই শুভ্র ভাইয়ের সাথে যা। আমি একাই যাব।"
রাফিয়া খুশি মনে রাজি হলেও শুভ্র ভাই রাজি হলেন না। চোখে-মুখে অসন্তোষ ফুটিয়ে তুলে বললেন,
----" তোরা লেডিস লেডিস এক ছাতায় যা। আমি কারো সাথে ছাতা শেয়ার করব না।"
কথাটা বলে এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না উনি। আমাদের রেখেই গটগট করে গেইট পেরিয়ে গেলেন। আমি রাগে দুঃখে কুঁকড়ে গেলাম। বিরবির করে বললাম,
----" শালা ফাজিল কোথাকার। আস্ত একটা গন্ডার।"
আমার কথাটা কানে যেতেই অনুযোগের সুরে বলে উঠল রাফিয়া,
----" ধুর! শুধু শুধু বকছিস কেন? গায়ে গা লাগবে ভেবেই হয়ত সাথে নিলেন না। কতটা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ভাবতে পারছিস?"
আমি বিরক্ত চোখে তাকালাম। ছাতা খুলতে খুলতে বললাম,
----" ব্যক্তিত্বসম্পন্ন না ছাতা। কয় দিন চিনিস তুই উনাকে? দেখতে ভদ্র মনে হলেও পেট ভরা শয়তানী। আরেকবার যদি 'শুভ্র ভাইয়া' ' শুভ্র ভাইয়া' করতে শুনেছি তো ইট তুলে মারব। শুভ্রর চামচা কোথাকার।"
রাফিয়া হেসে বলল,
----" আচ্ছা যা। এখন থেকে শুধু শুভ্র বলব। তাহলেই আর শুভ্র ভাইয়া ডাকটা শুনতে হবে না তোকে। হ্যাপি?"
রাফিয়ার কথায় রাগী চোখে তাকালাম। আমার রাগ দেখেই হাসতে লাগল রাফিয়া। তার খিলখিল হাসির শব্দেই যেন মুখরিত হল চারপাশ।
______________________
রান্না ঘরের দরজা আর আমাদের শোবার ঘরের দরজার মধ্যবর্তী জায়গাটুকুতে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আপুকে দেখতে আসা আর রাফিয়াদের আগমনে ধীরে ধীরে সব কাজিনগুলোই জুটে গিয়েছে বাসায়। আলিম ভাইয়া থেকে শুরু করে তনিমা আপু পর্যন্ত দুপুর নাগাদ হাজির। আমরা সবাই এখানে দাঁড়িয়েই ফিসফাস করছি। মাঝেমাঝে বড়দের চোখ রাঙানোর শিকারও হচ্ছি। বসার ঘরে মেহমানরা বসে আছেন। তাদের বলা কথাগুলোও মাঝেমাঝে উঁকিঝুঁকি দিয়ে শোনার চেষ্টা চালাচ্ছি। হঠাৎ করেই তনিমা আপুর মাথায় চাটি মেরে বলে উঠলেন শুভ্র ভাই,
----" ওই? খালি হাতে এসেছিস কেন? ক'দিন পর তো এটা তোর মামা শশুড়ের বাড়ি হয়ে যাবে। দেবর, ননদদের জন্য কিছু আনাটা তোর নৈতিক দায়িত্ব।"
তনিমা আপু কিছু বলবেন তার আগেই দ্রুত পায়ে এদিকে এলেন মামানি। নিচু গলায় বললেন,
----" রুহিকে তৈরি থাকতে বল। একটু পরেই ডাকবে ওকে।"
এটুকু বলেই আবারও দ্রুত পায়ে বসার ঘরের দিকে চলে গেলেন মামানি। আপু ততক্ষণে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়েছে, ফর্সা নাকটাও টুকটুকে লাল হয়ে আছে। আমরা সবাই আপুর মলিন মুখের দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই আপুর মাথায় হাত রেখে বললেন,
----" কি রে? চোখ ফুলিয়েছিস কেন? তোর সাথে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে আমার। মনোযোগ দিয়ে শুনবি, ওকে?"
আপু চোখ তুলে তাকাল। শুভ্র ভাই গম্ভীর ভাব নিয়ে বললেন,
----" আমরা এখানে যে কয়টা দাঁড়িয়ে আছি সবকটায় কিন্তু তোর ভাই-বোন। আমাদের সবারই তোর ওপর একটা হক আছে। আমাদের প্রতি তোরও কিছু দায়িত্ব আছে। আর আজকে সেই মহৎ দায়িত্ব পালন করার পালা। আর সেই দায়িত্বটা হল টাকা আদায়। মেয়ে দেখার পর টাকা দেওয়ার রেওয়াজ আছে জানিস তো? সেই টাকার ভাগীদার আমরা। আজকে ওদের দেওয়া টাকায় সন্ধ্যাপার্টি করব আমরা। দেখাদেখি শেষ হলে সরাসরি বলবি, ওই? টাকা দিবি কিনা বল। ২/৩ হাজার টাকার নিচে দিলে ডিরেক্ট অনশন করবি, বুঝলি? দরকার পড়লে আমরা তোকে সাপোর্ট দিব। কোন সমস্যা নাই।"
শুভ্র ভাইয়ের কথায় হেসে ফেলল সবাই। আপুও মৃদু হাসল। শুভ্র ভাই কপাল কুঁচকে বললেন,
----" হাসলে চলবে না। অধিকার আদায় করতে হবে। এবারের সংগ্রাম টাকা আদায়ের সংগ্রাম। তোরা কি বলিস পোলাপানস্?"
সবাই হেসে বলল,
----" ইয়েসসসস্।"
বিকাল ৩ টা। কিছুক্ষণ আগেই মেহমান বিদায় হয়েছে। মেহমানদের যাওয়ার পর পরই সব কাজিনরা মিলে খাবার টেবিল অধিকার করে বসেছি। খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি তুমুল আড্ডা চলছে। আড্ডার বিষয়বস্তু হল ' ছেলেপক্ষের এক হাজার টাকা' শুভ্র ভাইয়ার অসহযোগ আন্দোলন খুব একটা সুবিধা করতে পারে নি। আপুর হাতে এক হাজার টাকা গুঁজে দেওয়ার পর আপু আর প্রত্যুত্তর করে নি। ফলে, সেই এক হাজার টাকাকে পুঁজি করেই জমবে আড্ডার আসর। আড্ডার একপর্যায়ে 'এক হাজার টাকা' থেকে 'সেই মেয়েটা' বিষয়বস্তু হল। আলিফ ভাইয়া আফসোসের গলায় বললেন,
----" তোদের পাশের বাসার ওই স্টাইলিশ মাইয়াটাকে পটানোর চেষ্টা করলাম রে রোদু। কিন্তু লাভ হল না। ভাইয়াও ট্রাই মারছে কিন্তু পুরাই ফ্লপ।"
তনিমা আপু ভ্রু কুঁচকে বললেন,
----" ভাইয়াও ট্রাই মারছে মানে?"
আলিফ ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হাসল। আলিফ ভাইয়ার পিঠে ধুম করে একটা কিল বসিয়ে বলে উঠলেন অদুত ভাইয়া,
----" বিভীষণ কোথাকার। নিজের ভাইয়ের সংসারে আগুণ লাগাস। ওর কথা বিশ্বাস কর তুমি তনিমা? হি ইজ আ বিগ লায়ার।"
রাফিয়া জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে বলল,
----" আমার মনে হয় তোমাদের দু'জনের মধ্যে কিছু চলছে আলিফ ভাই। ওই মাইয়া তোমাকে কিছু ইঙ্গিত করছে।"
আলিফ ভাইয়া অবাক হয়ে বললেন,
----" তাই নাকি?"
----" হু। ওই মাইয়া তোমার পোস্টে লাভ রিয়েক্ট দেয়। কিন্তু সব পোস্টে দেয় না। প্রথম বার এক পোস্ট অন্তর রিয়েক্ট দেয়। তারপর চারটা পোস্ট অন্তর রিয়েক্ট দেয়। তারপরের বার তিনটা পোস্ট অন্তর রিয়েক্ট দেয়। বুদ্ধি আছে। বুঝলা কিছু?"
আলিফ ভাইয়া গোল গোল চোখে তাকিয়ে বললেন,
----" তো?"
রাফিয়া অত্যন্ত বিরক্ত গলায় বলল,
----" আরে? একটা রিয়েক্ট চারটা রিয়েক্ট তিনটা রিয়েক্ট.... বুঝলা না? ইট'স মিন আই লাভ ইউ।"
আলিফ ভাইয়া বিস্ফারিত চোখে তাকালেন। খুশি খুশি গলায় বললেন,
----" বলিস কি? কি সাংঘাতিক!"
আমি হেসে বললাম,
----" একটা রিয়েক্ট চারটা রিয়েক্ট তিনটা রিয়েক্ট দিয়ে কিন্তু আই হেইট ইউ ও হয়। ধোঁকা খেও না আলিফ ভাই।"
আলিফ ভাই বিমর্ষ চোখে তাকালেন,
----" নব প্রেমিক হৃদয়টাকে ভেঙে চুরমার করে দিলি রে বইন। আহ্ গ্যাস্টিক গ্যাস্টিক ফিলিংস হচ্ছে। "
আলিফ ভাইয়ার কথায় হেসে উঠল সবাই। রাফিয়া প্রতিবাদ করে বলল,
----" হেইট ইউ বুঝাতে লাভ রিয়েক্ট কেন দিবে? অবশ্যই এ্যাংরি দিবে।"
আপু হাসল। রাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
----" তোর ভাষ্যমতো মেয়েটার বুদ্ধি আছে। সুতরাং, একটা স্পেশাল কোডে নিশ্চয় এতো ইজি সলিউশন দেবে না সে। লাভ এর উল্টো এংরি এমনও হতে পারে।"
অদুত ভাই কপাল কুঁচকে বললেন,
----" আহারে! কত ট্যালেন্ট তগো। মাইয়ার রিয়েক্ট নিয়ে এমন আলোচনা লাগাইছিস মনে হচ্ছে "মিশন ইম্পসিবল" এর সক্রিয় কর্মী তোরা। রাফিয়া, বইন? তোর কি আর কোনো কাম কাজ নাই? কে, কখন, কয় সেকেন্ড পর কার পোস্টে রিয়েক্ট দিল, উল্টা রিয়েক্ট দিল নাকি তক্তা রিয়েক্ট দিল এগ্লাও খেয়াল রাখিস তুই? তোরে একটা ১০ টাকা দামের দিস্তা খাতা গিফ্ট করব আমি। ওটা তোর পুরস্কার। ওখানে সাজিয়ে গুছিয়ে লিখে রাখবি সব। হেল্প হবে। রাতুল? তোর বোনের কি ট্যালেন্ট দেখছিস? এই ট্যালেন্টকে তো ভেস্তে দেওয়া যায় না।"
অদুত ভাইয়ের কথায় ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল সবাই। রাতুল ভাইয়া হারে কামড় বসাতে বসাতে বলল,
----" হু। খুব ট্যালেন্ট। একদম গাধার মত ট্যালেন্ট।"
রাতুল ভাইয়ার কথায় হুহা করে হেসে উঠল সবাই। রাফিয়া নাক-মুখ ফুলিয়ে বলল,
----" ভাইয়া? তুই অলওয়েজ আমায় অপমান করিস কেন বল তো?"
রাতুল ভাইয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
----" অপমান কাহাকে বলে না জানি আমি।"
----" আমি বাবাকে বিচার দেব।"
----" আমিও আম্মাকে বিচার দেব।"
রাফিয়া নাক ফুলিয়ে বলল,
----" কুত্তা, হারামি, ফাজিল।"
----" হ। ওইটাই বলতাছি। সব তুই।"
আলিফ ভাইয়া বিরস মুখে বললেন,
----" ঝগড়া থামিয়ে আমাকে সান্ত্বনা দে। ফিলিং বহুত কষ্ট।"
রাফিয়া খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
----" আমি তোমাকে সান্ত্বনা দেব। শুধু সান্ত্বনা নয় সান্ত্বনার সাথে এক ডাম ইংরেজি স্যামপেথিও দিব। তার আগে বল, শুভ্র ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ডের নাম কি?"
আলিফ ভাইয়া ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
----" সুবিধাবাদী মহিলা।"
----" প্লিজ আলিফ ভাই বল না। প্লিজ...প্লিজ।"
অদুত ভাই হেসে বললেন,
----" তোর না বহুত বুদ্ধি? বুদ্ধি খাটা।"
----" অনেক খাটিয়েছি ধরতে পারছি না। একেক সময় একেক জনের প্রতি সন্দেহ লাগে। আলিফ ভাইয়া? ও আলিফ ভাইয়া? বল না প্লিজ।"
আলিফ ভাই দাঁত কেলিয়ে বললেন,
----" বড় ভাইয়ের বউয়ের নাম মুখে নিতে নেয়। পাপ লাগে, তাই না রোদ?"
আলিফ ভাইয়ার কথায় থতমত খেয়ে গেলাম আমি। রাফিয়া অবাক হয়ে বলল,
----" এটা আবার কবে কার হাদিস?"
রাতুল ভাইয়া ধমকে উঠে বললেন,
----" তোরে এখন বই বের করে দেখান লাগবে? বেশি কথা কস কেন?"
রাফিয়া মুখ ফুলিয়ে বলল,
----" তাহলে ছবি দেখাও।"
----" বড় ভাইয়ের হবু বউয়ের ছবি রাখাটা পাপের ওপর পাপ, মহাপাপ। তবে, আমি তোকে ক্লু দিতে পারি।"
রাফিয়া উৎসাহ নিয়ে বলল,
----" বেশ বল তাহলে।"
আলিফ ভাইয়া সোজা হয়ে বসলেন। মুখে গাম্ভীর্যতা এনে বললেন,
----" মনোযোগ দিয়ে শুনবি ওকে? খুবই ক্লোজ একটা ক্লু দিব।"
রাফিয়া আগ্রহ নিয়ে মাথা নাড়ল। আলিফ ভাইয়া গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
----" শুভ্র ভাই যেদিকে তাকাবে তুইও ঠিক সে দিকেই তাকাবি। শুভ্র ভাই বায়ে তাকাতে পারে, তারপর ডানে, আবার বায়ে... সামনে, পিছে বিভিন্ন জায়গায় তাকাতে পারে। তোর কাজ হল ভাইয়ের সাথে তাকান। বায়ে, ডানে যেদিকেই তাকাক না কেন তুইও তাকাবি। তারপর যখন ভাই স্থির চোখে কোন রমণীর দিকে তাকাবে তখনই বুঝে যাবি সেই রমনীই তাহার হৃদয় হরণকারিণী। বুঝেছিস?"
রাফিয়া কনফিউজড হয়ে মাথা নাড়ল। সাথে সাথেই হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন আলিফ ভাই,
----" তাহলে দশটা টাকা দে।"
অদুত ভাই হেসে বললেন,
----" যদি এই ব্যাপার হয় তাহলে আমি আরেকটু ক্লিয়ার করে বলি। শুভ্র যার দিকে একটু তেমন তেমন নজরে তাকাবে সেই হল সেই নারী। পানির মত সহজ বুঝলি। একবার নামটা জানলেই ছাদ থেকে লাফিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করবে তোর। এত ক্লোজ মানুষটাকে না চেনার অপরাধে তোর নিজেকে আংশিক মৃত্যুদন্ড দিতে ইচ্ছে করবে। তবে, শুভ্র না চাইলে তোর বুঝাটা একটু মুশকিল। আমরাও বুঝি নাই। কিন্তু জানার পর মনে হয়েছে কত ক্লু ছিল। এত বলদ কেন আমরা? তোরও সেইম ফিল হবে... অপেক্ষা। এখন বিশটা টাকা দে।"
রাফিয়া মুখ ঝামটি দিয়ে বলল,
----" তোমরা সব কয়টা ছেঁচড়া।"
অদুত ভাই কিছু বলবে তার আগেই শুভ্র ভাইয়ের আগমন ঘটল। ভাইয়ার সাথে কোথাও পাঠান হয়েছিল উনাকে। শুভ্র ভাই ক্লান্ত ভঙ্গিতে আমার পাশের চেয়ারে বসলেন। পাশে বসেই প্লেটের সবচেয়ে বড় মাংসটা নিয়ে মুখে পুড়ে নিলেন। আমি রাগী গলায় বললাম,
----" এটা কি হল?"
উনি আমার কথার পাত্তা না দিয়ে বললেন,
----" কি নিয়ে আলাপ হচ্ছিল তোদের?"
আলিফ ভাই বাঁকা হেসে বললেন,
----" তোমার 'তাকে' নিয়ে। রাফিয়া তাকে চিনতে চায়। এজন্য সবাইকে ঘুষ দিচ্ছে।"
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
----" এত কষ্ট করার কি ছিল? আমাকে জিগ্যেস করলেই বলে দিতাম।"
আমি আর রাফিয়া দু'জনেই চোখ বড় বড় করে তাকালাম। শুভ্র ভাই টেবিলের দিকে ঝুঁকে এসে বললেন,
----" আমি তোমাকে একবার বলব। এই একবারে বুঝে যাওয়ার দায়িত্ব তোমার। সেকেন্ড টাইমের কোন অপশন নেই, ওকে?"
রাফিয়া মাথা নাড়ল। আপু আর তনিমা আপুও উৎসাহ নিয়ে তাকাল। শুভ্র ভাই মুচকি হেসে বললেন,
----" তোমার ভাইয়ের বাবার ভাবির ভাতিজার ফুপির ছোট বাচ্চা।"
চোখের পলকে কথাটা বলে শেষ করলেন শুভ্র ভাই। আলিফ ভাইয়ারা হাসিতে ফেঁটে পড়লেন। রাফিয়া 'হা' করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
----" এটা কি হল?"
শুভ্র ভাই চোখ টিপে বললেন,
----" এটাই সায়েন্স।"
আবারও হাসল সবাই। নতুন উদ্যমে শুরু হল গল্পের আসর। উনাকে ঘিরেই কত গল্প, কত ঠাট্টা, কত মায়া!
২৫
"রাঁধব মোরা রাঁধব আজি রাঁধব ছড়া ছন্দেতে,
তিনটি ভুবন ভরিয়ে দেব সুখাদ্যেরই গন্ধেতে।।"
মসজিদে মসজিদে শেষ বিকেলের সম্মোহনী সুর বাজতেই রান্না ঘরে ঢুকে গিয়েছি আমরা। রাতের আড্ডার বিশদ তালিকা নিয়ে রাঁধতে বসেছি। ফুসকা,,চটপটি, পিঁয়াজু, সমুচা ভাজাপোড়া জাতীয় খাবারের কোনটাই যেন বাদ পড়ে নি এই তালিকায়।
আপু আর রাফিয়া ব্যস্ত ভঙ্গিতে ডিমের খোসা ছাড়াচ্ছে। তনিমা আপু ময়দা মাখছে আর আমি ছোলা-আলু সিদ্ধ করছি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে দুষ্টু মিষ্টি হাসির গল্পও চলছে পুরোদমে। এমন একটা হাস্যোজ্জল পরিবেশের ইতি ঘটিয়ে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন শয়তানদের কর্ণধার শুভ্র ভাই। তার পিছু পিছু এসে দাঁড়াল সব কটা। আমরা কপাল কুঁচকে তাকালাম। ভ্রু কুঁচকে বললাম,
----" কি সমস্যা?"
শুভ্র ভাই বাঁকা হেসে বললেন,
----" সমস্যা হল তোরা।"
----" মানে?"
----" মানেটা সিম্পল! একটু আগে কি বলে এলি? মেয়েরা রাঁধবে মেয়েরাই খাবে। মেয়েদের খাওয়ার পর কিছু থাকলে ছেলেদের উপর দয়া করা হবে নয়ত নয়। এত বড় দুঃসাহস তোদের?"
তনিমা আপু মুখ কাঁচুমাচু করে তাকালেন। কথাটা উনি অদুত ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করেই বলেছিলেন। তার এই সামান্য কথাটা যে প্রমিকপুরুষকে টপকে পুরো ভাইজাতির গায়ে লেগে যাবে বুঝতে পারেন নি । তারওপর শুভ্র ভাই! আমি আড়চোখে তনিমা আপুর দিকে তাকালাম। আপু অসহায় চোখে তাকিয়ে আছেন। শুভ্র ভাইকে বেশ সমীহ করেই চলেন তনিমা আপু। শুধু তনিমা আপু নয়, খুব অদ্ভুত কিছু কারণে ছোট থেকে বড় সবাই-ই একটু আধটু ভয় পান উনাকে। কারণটা হয়ত উনার নাছোড়বান্দা স্বভাব। আমি ভ্রু নাচিয়ে বললাম,
----" যা সত্য তাই বলা হয়েছে। প্রবলেমটা কই? মেয়েরা কষ্ট করে রান্না করবে তো খাবারে মেয়েদের অগ্রাধিকার থাকবে এটাই স্বাভাবিক।"
শুভ্র ভাই দরজায় হাত রেখে দাঁড়ালেন। বামহাতে চুল ঠিক করতে করতে বললেন,
----" সেটাই! এই অতি সুন্দর স্বাভাবিক যুক্তিটা দেওয়ার জন্য তোদের সব ক'টাকে রান্নাঘর থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে। আজ ছেলেরা মানে আমরা, ভাইয়েরা রান্না করব। এবং সেই খাবারের অবশিষ্ট অংশও তোরা পাবি না। যা ভাগ...."
আমি কোমরে হাত রেখে চোখা দৃষ্টিতে তাকালাম,
----" বললেই হল? মামার বাড়ির আবদার?"
----" মামার বাড়ির আবদার নয় ফুপ্পির বাড়ির আবদার। যা বের হ সব।"
----" সেই স্বপ্ন দেখা বন্ধ করুন। এখানে শুধু এবং শুধুই আমাদের রাজত্ব। ভাগেন যান।"
শুভ্রভাই ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। রাগী গলায় বললেন,
----" একটা থাপ্পড় লাগাব বেয়াদব। বড়দের মুখে মুখে কথা। আমার ফুপ্পির বাড়ি তো আমার অধিকার.... এই মুহুর্তে বের হবি সবক'টা। নয়ত মেরে তক্তা বানিয়ে দেব।"
আলিফ ভাই দাঁত কেলিয়ে বললেন,
----" একটা পয়েন্ট মিস গিয়েছে শুভ্র ভাই। শশুরবাড়িও...."
শুভ্রভাই চোখ রাঙিয়ে তাকাতে গিয়েও হেসে ফেললেন। কথাটা কাটিয়ে যাওয়ার আগেই ফটাফট প্রশ্ন ছুঁড়ল রাফিয়া,
----" শশুরবাড়ি মানে?"
পাশ থেকে ধমকে বলে উঠলেন রাতুল ভাইয়া,
----" কথায় কথায় এত মানে মানে করিস কেন? গিলুহীন মহিলা। আলিফ বোঝাতে চাইছে এখানে তোদের কোন অধিকার নেই। এত পচপচ শশুরবাড়ি গিয়ে দেখাস যা।"
রাফিয়া গলা উঁচু করে বলল,
----" বাঁদর কোথাকার। কথায় কথায় ধমকাস কেন আমায়?"
রাতুল ভাইয়া কিছু বলার আগেই শীতল কন্ঠে বলে উঠলেন শুভ্র ভাই,
----" রাফিয়া বাইরে যাও।"
রাফিয়া অসহায় দৃষ্টি নিয়ে বলল,
----" জ্বি ভাইয়া?"
----" রান্নাঘর থেকে বেরুতে বলছি। তনিমা আর রুহিও বের হ।"
আমি জ্বলে ওঠে বললাম,
----" একদম বের হবি না রাফিয়া। এই যে আদিবার সো কল্ড দাদাভাই? ফুপ্পির বাড়ি বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি?"
----" অবশ্যই নিয়েছি। আমি তো শুধু নিয়েছি তুই তো কিনে নিয়ে আবার বিক্রিও করে দিয়েছিস। মামুর বাসায় গিয়ে যে ধাপট দেখাস.....নিজেকে তখন অসহায় মোরগ মনে হয়। সেখানে তোর দাপট মেনে নেওয়া হয় বলে এখানেও মেনে নেওয়া হবে তা কিন্তু নয়। এখন চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে চোখদুটোকে শান্তি দে, ছকিনার মা।"
আমি জেদ নিয়ে বললাম,
----" যাব না মানে যাব না। আমরা আগে আসছি তো আমরাই রান্না করব। বেশি বাড়াবাড়ি করলে মামানিকে ডাকব বলে দিলাম।"
শুভ্র ভাই ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন,
----" আমিও ফুপ্পিকে ডাকব। এন্ড এজ ইউজাল, ফুপ্পি আমার কথায় বিশ্বাস করবেন।"
আমি কটমটে দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম। রাফিয়া আমার হাত খামচে ধরে বলল,
----" চল চলে যাই। শুধু শুধু শুভ্র ভাইয়ার সাথে ঝামেলা করে কি লাভ?"
এমনিতেই রাগ আর জেদে শরীর কাঁপছিল আমার। রাফিয়ার বলা শুভ্র বাণীতে সেই রাগ-জেদ যেন আকাশ ছুঁলো। যেখানে নিজের মা জননীই শত্রুপক্ষের ভারী অস্ত্র সেখানে কি জেতার আশা করা চলে? আমার ধারণা, কোন একদিন যদি শুভ্র ভাই গিয়ে বলে, 'ফুপি? তোমার ছোট মেয়ে আমাকে খুন করে মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছে।' সেটাও বিনাবাক্যে বিশ্বাস করে নিবেন আম্মু। আম্মুর বদ্ধমূল ধারণা হচ্ছে, আমরা তার বাপের বাড়ির লোকদের পছন্দ করি না। যদিও উনার বাপের বাড়ি বলতে এই এক মামু, মামানি আর শুভ্র ভাই। তবুও তার ধারণা ফুফাতো বা কাকাতো ভাই-বোনদের যতটা পছন্দ করি তার ভাতিজাকে ততটা পছন্দ করি না। আর আমাদের এই অপছন্দের পেছনে আছেন আব্বু। আব্বুকে অনুসরণ করেই নাকি এতোটা অসামাজিক হয়ে উঠেছি আমরা। আমি মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। এই 'শুভ্র' নামক মানুষটিকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারলে মাথাটা বোধ হয় কিছুটা শান্ত হত আমার। নিজের রাগটা কমাতে টিভি অন করে থম মেরে বসে রইলাম সোফায়। পাশেই সাংসারিক আলোচনায় মত্ত দু'জন রমণী। আপু আর তনিমা আপু শোয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কিছু একটা নিয়ে গল্প করছে। রাফিয়া হয়ত বয়ফ্রেন্ডের ফোনালাপে ব্যস্ত। টিভি দেখতে দেখতে রাগটা কিছুটা নুইয়ে এলো। ঘন্টাখানেক যাবৎ দেখা মুভিটাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সীনটা যখন এলো ঠিক তখনই আমার পাশে ধপ করে বসে পড়লেন শুভ্র ভাই। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই রিমোটটা হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বললেন,
----" আজাইরা মুভি দেখিস অলওয়েজ। বাচ্চা মানুষ হয়ে এতো রোমান্টিক মুভি কেন দেখবি? তোর জন্য টম এন্ড জেরি পার্ফেক্ট। ভাবছি, তোকে টম এন্ড জেরির কিছু এপিসোড ডাউনলোড করে দেব। ভালো হবে না?"
আমি তেতে উঠে বললাম,
----" রিমোট দিন।"
আমার কথাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চ্যানেলটা পাল্টে দিলেন উনি। রাগে দুঃখে চোখদুটো টলমল করে উঠল আমার। চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
----" মামানি? আমি কিন্তু তোমার ছেলেকে খুন করে ফেলব বলে দিলাম। ভাল্লাগে না অসহ্য... রিমোট দিন।"
শুভ্র ভাই সোফায় গা এলিয়ে আরাম করে বসলেন। মামানি বিরক্ত চোখে তাকালেন। শক্ত কন্ঠে বললেন,
----" শুভ্র? সারাদিন মেয়েটার পেছনে কেন লেগে থাকো তুমি? রিমোট দাও ওকে।"
শুভ্র ভাই গম্ভীর গলায় বললেন,
----" ওর পেছনে কেন লাগতে যাব আমি? বাচ্চা পোলাপানদের রোমান্টিক মুভি দেখার মানেটা কি? এগুলো দেখেই তো নষ্ট হচ্ছে দিন দিন। চূড়ান্ত বেয়াদবও হচ্ছে। দিন-রাত থাপড়ানো উচিত এদের।"
----" আপনি দিবেন রিমোট? উফফ... আস্ত একটা অসহ্যকর মানুষ আপনি। আমি নষ্ট হলে হচ্ছি.... দরকার হলে আরও নষ্ট হব, তাতে আপনার কি? আমার রিমোট আমাকে ফেরত দিন ব্যস!"
আম্মু গলা চড়িয়ে বললেন,
----" একটা চড় লাগাব। বড়দের সাথে এটা কেমন ব্যবহার? এতোক্ষণ দেখেছিস মন ভরে নাই? শুভ্র যা দেখবে তাই দেখ নয়ত দেখার দরকার নেই। আস্ত বেয়াদব একটা।"
আম্মুর কথা শেষ হতেই চোখ থেকে টপাটপ দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল গালে। রাগ নিয়ে উঠে যেতে নিতেই হাত চেপে ধরলেন শুভ্র ভাই। আমি লাল চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি মনোযোগ দিয়ে টিভি স্ক্রিনে তাকিয়ে আছেন। উনার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, আমার হাত যে উনার হাতে আটকে আছে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণাও উনার নেই। এই পৃথিবীতে টিভি এবং তার দুটো চোখ ছাড়া অন্যকিছুর অস্তিত্ব থাকতেই পারে না, অসম্ভব! আমি চাপা গলায় বললাম,
----" হাত ছাড়ুন।"
শুভ্র ভাই জবাব না দিয়ে টিভির সাউন্ড বাড়িয়ে দিলেন। সাথে সাথেই গল্প ভুলে টিভির দিকে তাকালেন আম্মু-মামানি। টিভিতে তখন খবর চলছে। ব্রেকিং নিউজে বড় বড় করে লেখা বেরুচ্ছে, ' মারধোরের এক পর্যায়ে স্বামীর হাতে স্ত্রীর মৃত্যু' ব্রেকিং নিউজটা শুনেই সরু চোখে তাকালাম আমি। মামানি আফসোসের সুরে বললেন,
----" আহারে! কোন মায়ের বুকটা খালি হল কে জানে? এসব ছেলেদেরকে পিটাইয়া মারা উচিত। কাকে কি বলি? আমার নিজের ছেলের যে রাগ কয়েক বছর পর শুভ্রর নাম ব্রেকিং নিউজে এলেও আমি অবাক হব না। রাগের মাথাতেই বউ মেরে ফেলবে আমার ছেলে।"
শুভ্র ভাই একবার আমার দিকে তাকিয়েই মামানির দিকে তাকালেন। অনুযোগের সুরে বললেন,
----" আম্মু? সত্যিই কি তুমি আমার আম্মু? সুনামের চেয়ে আমার বদনামই তুমি বেশি কর। এমন চলতে থাকলে চিরকুমার হয়েই মরতে হবে আমায়। ফু্প্পি? তোমার মনে হয় আমি আমার বউকে এতো অত্যাচার করব?"
আমি ফোঁড়ন কেটে বললাম,
----" মনে হওয়ার কিছু নেই। আপনি এর থেকেও বেশি অত্যাচার করবেন। তবে, আমার ধারণা আপনার কপালে বউই জুটবে না। এমন প্যারাময় বিরক্তকর পুরুষকে কেউ দুই সেকেন্ডের জন্যও বিয়ে করতে চাইবে না।"
আম্মু ধমক দিয়ে বললেন,
----" তুই বললেই হল? আমার ভাতিজা লাখে একটা। শুভ্র তার বউকে মাথায় করে রাখবে।"
শুভ্র ভাই খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
----" এই না হলে আমার ফুপি! রক্ত কথা বলে। আর এগুলো তো পরের বাড়ির মেয়ে। সব কয়টা আমার শত্রু!"
শুভ্র ভাইয়ের কথায় আম্মু আর মামানি দু'জনেই হেসে উঠলেন। শুভ্র ভাই আবারও গভীর মনোযোগে চ্যানেল পাল্টাতে লাগলেন। আমি সোফায় গা এলিয়ে অসহায়ের মত বসে রইলাম চুপচাপ। উনি ঘুরেঘুরে আবারও সেই মুভিটাই দিলেন। আমি খুশি হয়ে উনার দিকে তাকালাম। উনি টিভির দিকে তাকিয়েই মৃদু হাসলেন। মুহুর্তেই মনে হল, নাহ! লোকটা খুব একটা অসহ্যকর পুরুষ নয় বরং টক,ঝাল, মিষ্টি!
___________________
চাঁদের আলোতে নয় ঝকঝকে বিদ্যুতের আলোতে গোল হয়ে বসে আছি আমরা। আমাদের ঠিক মাঝখানে প্লেটে সাজানো কেক, পেঁয়াজু জাতীয় খাবার। কাজিনরা সবাই একসাথে হয়েছি শুনে গাঙিনাপাড়া থেকে মিথি আপু আর চয়ন ভাইয়াও এসেছেন। ছেলেদের বানানো খাবার আর চয়ন ভাইয়ার কিনে আনা খাবারে আড্ডাটা বেশ মেতে উঠেছে তখন। রাফিয়ার বানানো চিরকুট খেলাটাতেও বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে সবাই। একমাত্র আমিই একটু পর পর উশখুশ করছি। অস্থির চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে এই আড্ডামহল থেকে বেরুবার সুযোগ খুঁজছি।
----" শুভ্র ভাইকে কিন্তু আজকাল ঘন ঘন পাঞ্জাবীতে দেখা যাচ্ছে। এর কারণ কি ভাই?"
আলিফ ভাইয়ার প্রশ্নে সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকাল। শুভ্র ভাই নির্মল হেসে বললেন,
----" কোনো কারণ নাই আবার আছেও। প্রথমত, সামনে যা পাচ্ছি তাই পরছি। দ্বিতীয়ত, সে বলেছে পাঞ্জাবিতে নাকি আমায় চরম লাগে।"
কথাটা বলে চোখ টিপলেন শুভ্র ভাই। শুভ্র ভাইয়ের শেষ কথাটাতে সবাই হৈ হৈ করে উঠল। আমি সরু চোখে তাকালাম। ডাহা মিথ্যা! এমন কিছু কাশ্মিনকালেও বলেছি বলে মনে পড়ছে না আমার।
----" কিন্তু সেই 'সে' টা কে? বলে দিলেই হয়। আমরা কি তুলে নিয়ে যাব নাকি আপনার তাকে?"
রাফিয়ার কথার খেই ধরেই চয়ন ভাইয়া বললেন,
----" রাফিয়ার সাথে সহমত আমি। বলে দাও শুভ্র। আমাদের মাঝে এতো ঢাকাঢাকির কি আছে?"
শুভ্র ভাই অলস ভঙ্গিতে বললেন,
----" এই এক কথা শুনতে শুনতে আমি বিরক্ত। আমি ঢাকলামটা কই? সবই চাঁদের আলোর মতো পরিষ্কার। আরও পরিষ্কারভাবে জানতে চাইলে ওয়েট করতে থাকুন। বাসররাতের পরের দিন দেখাব....এর আগে দেখালে নজর লাগানোর ভয় থাকে।"
মিথিলা আপু ফোঁড়ন কেটে বললেন,
----" কেন রে শুভ্র? আমরা দেখে ফেলার ভয়ে বিয়ের দিন তোর বউকে কি ড্রামের ভেতর ঢুকিয়ে রাখবি নাকি? নয়ত আমাদের না দেখিয়ে বাসর ঘর পর্যন্ত নিবি কিভাবে তাকে?"
---- " আমি কি তোর মতো সং সেজে বিয়ে করব নাকি? আমার বিয়ের খোঁজটাও তোদের জুটবে না। হঠাৎ কোনো বিকেলে.... "
শুভ্র ভাইয়ের কথার মাঝেই উঠে দাঁড়ালাম আমি। মৃদু গলায় বললাম,
----" তোমরা গল্প কর। আমার শরীর খারাপ লাগছে। আমি ঘুমোব।"
আলিফ ভাই ভ্রু কুঁচকে বললেন,
----" মাত্র নয়টা বাজে। এখনই কিসের ঘুম? আজ আমাদের আড্ডা বারোটা পেরুবে। আর তুই না থাকলে চলবে নাকি? এই মুহুর্তে তো তোকেই প্রয়োজন।"
কথাটা বলে দাঁত বের করে হাসলেন আলিফ ভাইয়া। আমি কপাল কুঁচকে মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
----" আমার শরীর ভালো নেই। তোমরা গল্প কর।"
কথাটা বলেই ঘুরে দাঁড়ালাম আমি। শুভ্র ভাই কিছু সন্দেহ করার আগেই দ্রুত পায়ে নিচে নেমে এলাম। মামানি ড্রয়িং রুমেই ছিলেন। আমাকে দেখেই ইশারা করলেন। আমি আম্মুর পাশে গিয়ে দুঃখী দুঃখী মুখ নিয়ে বললাম,
----" আম্মু? আমার শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে। একটু ঘুমুতে পারলে ভালো লাগত। বাসায় এতো মানুষ আর এতো চিল্লাচিল্লি এর মাঝে কি করে ঘুমাব?"
মামানি ঝটপট বললেন,
----" রোদকে আমার সাথে নিয়ে যাই অরি। তোমার ভাইও বাসায় নেই। আমার সাথেই থাকবে না'হয়। চোখ-মুখ কেমন শুকিয়ে গিয়েছে মেয়েটার।"
মামানির কথায় আমার দিকে তাকালেন আম্মু। আমি চোখে-মুখে দুঃখ দুঃখভাব আনার যথাসম্ভব চেষ্টা চালালাম। আম্মু রাজিও হলেন। মামানি আর আমি দু'জনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলাম। যার অর্থ প্ল্যান সাকসেসফুল!
_________________
ওভেন থেকে কেকটা বের করে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মামানির কাজ দেখছি। দ্রুত হাতে এটা সেটা বানাচ্ছেন তিনি। ঘড়িতে প্রায় দশটা বাজে। সারা বাসা নিস্তব্ধ। ব্যালকণির পর্দাটা বাতাসের ধাক্কায় অল্প সল্প উড়ছে। আমি অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে ঘড়ির দিকে তাকালাম। আরও এক ঘন্টা এভাবেই আহাম্মকের মত দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আমাকে। চোখের কার্ণিশে ঘুমেরাও যেন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে আসছে। শুভ্র ভাই জন্মদিনে অযথা কাঁচাল পছন্দ করেন না। উনার ধারণা, জন্মদিন নেচে গেয়ে মরে যাওয়ার মত কোন ঘটনা নয়। খুবই স্বাভাবিক একটি সত্য। সুতরাং, স্বাভাবিক বিষয়গুলো নিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করাটা বোকামি। কিন্তু আমি আর মামানি সেই বোকামোটাই করছি। শুভ্র ভাই সহজে চমকান না। দুনিয়ার সবকিছুই উনার কাছে অতি সাধারণ এবং স্বাভাবিক বলে বোধ হয়। সারপ্রাইজগুলোও কোনো না কোনোভাবে বুঝে ফেলেন উনি। আমার ভাবনার মাঝেই কথা বললেন মামানি,
----" সব কমপ্লিট। খাবারগুলো প্যাক করে সরিয়ে রাখতে হবে বুঝলি? শুভ্র আসার আগে সারা ঘরে রুমস্প্রে লাগাতে হবে। নয়ত আমার ধুরন্ধর ছেলে সব ধরে ফেলবে। কি খেয়ে যে এই পোলাকে জন্ম দিয়েছিলাম কে জানে?"
মামানির কথায় হেসে ফেললাম আমি। কেক ডেকোরেশনে মামানির সাথে হাত লাগালাম। কেকটা নজরে না পড়ে এমন জায়গায় রেখে পুরো রান্নাঘরে স্প্রে করলেন মামানি। সচেতন গলায় বললেন,
----" তোর নুপুরটা খুলে রাখ।"
----" কেন?"
----" শুভ্র যদি এখনই চলে আসে তাহলে তোর নুপুরের শব্দেই তোর উপস্থিতি বুঝে যাবে ও। পুরো প্ল্যানই শেষ। তারচেয়ে বরং খুলে রাখ।"
আমি অসহায় চোখে তাকালাম। মিনমিনে বললাম,
----" আমি সাবধানে হাঁটব মামানি। খুলে রাখলে পরতে ভুলে যাব নয়ত হারিয়ে যাবে।"
মামানি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসলেন। আমার ডান গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বললেন,
----" শাড়িতে সুন্দর লাগছে। এরপর থেকে সব শাড়ি দুটো করে কিনব। দু'জন একই শাড়ি পরলে একদম মা- মেয়ে লাগবে।"
মামানির এই ছোট খাটো পাগলামোতে মাঝে মাঝেই প্রচন্ড হাসি পায় আমার। মানুষ ছেলের জন্য হা-হুতাশ করে আর মামানি করেন মেয়ের জন্য। উনার শুকনো মুখ দেখে মনে হয় একটা মেয়ে হলেই বোধহয় পৃথিবীর সব সুখ ডানা ঝাপ্টে পড়ত তার ঝুলিতে। শুধুমাত্র একটা মেয়ের অভাবেই সেই সুখগুলো ধরা দিচ্ছে না তাকে। আমি কিছু বলার আগেই কলিংবেল বাজল। মামানি তাড়াহুড়ো করে বললেন,
----" ছেলেটা ঠিক বাপের মত হয়েছে। সবসময় অসময়ে ঘরে ফেরা। আর একঘন্টা পর ফিরলে কি হত? তুই জলদি লুকিয়ে পড় রোদু। আমি এই একঘন্টা কোনভাবে আটকে রাখব ওকে। সেই সময়টাতে খুব সাবধানে ঘর সাজিয়ে নিবি তুই....পারবি না?"
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
----" পারব।"
আমাকে কিচেনে রেখেই দ্রুত পায়ে দরজা খুললেন মামানি। আমি ফ্রিজের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজা খোলার কয়েক সেকেন্ড পরই শুভ্র ভাইয়ের কন্ঠ ভেসে এলো,
----" বাবা ফিরছে নাকি আজ?"
----" না তো। কেন?"
----" নতুন শাড়ি পরেছ যে তাই বললাম।"
মামানি হঠাৎ করে কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন,
----" আস্ত ফাজিল তুই। মায়ের সাথেও ফাজলামো। নতুন শাড়ি পড়ার জন্য তোর বাপের পারমিশন লাগবে আমার?"
----" কি যন্ত্রণা? আমি সাদা মনে একটা প্রশ্ন করলাম আর তুমি কই থেকে কই নিয়ে গেলে।"
মামানি জবাব না দিয়ে বললেন,
----"খাবি এখন? খাবার দেব?"
----" হু খাব।"
----" হাত-মুখ ধুয়ে আয়।"
ফ্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা আমার জমে যাওয়ার পালা। পায়ে নুপুর থাকায় কিচেনের ভেতরে হাঁটাচলা করাও সম্ভব হচ্ছে না। মামানি আর শুভ্র ভাই ডাইনিং এ বসে আছেন। আধা ঘন্টা যাবৎ উনি খাচ্ছেনই। পেটে এত জায়গা কোথায় থাকে আল্লাহ মালুম।
----" প্রচন্ড মাথাব্যথা করছে রে শুভি। মাইগ্রেনের ব্যথা মনে হচ্ছে।"
----" পুত্রবধূকে সাথে আনলেই পারতে। শাশুড়ি মায়ের সেবা করত রাতভর।"
মামানি ধারালো গলায় বললেন,
----" তোর কি ন্যূনতম লজ্জা-শরম নাই? মায়ের সামনে যা ইচ্ছে বলিস। আর পুত্র থাকতে পুত্রবধূর কি দরকার? খাওয়া শেষ করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবি। যতক্ষণ না ঘুমিয়ে পড়ি ততক্ষণ পাশে বসে থাকবি।"
----" লজ্জা পাওয়ার মত কিছু বলেছি বলে তো মনে হচ্ছে না। শুরু থেকে শেষ অব্দি সবই তুমি জানো তো লজ্জা পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং পৃথিবীর ইতিহাসে তুমিই প্রথম মা যে নিজের ছেলেকে ইচ্ছে করে এভাবে ডুবিয়ে দিয়েছ....এখন আর উঠতেই পারছি না। ভবিষ্যতে পারব বলেও মনে হয় না।"
----" একটা চড় খাবি ফাজিল। তোর চক্ষুলজ্জা ছোট বেলাতেও ছিল না, এখন তো নাই-ই এমনকি বুড়ো বয়সেও থাকবে বলে মনে হয় না। এখন চুপচাপ খাওয়া শেষ কর। খাওয়া শেষ করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবি। আমি ঘুমাব।"
----" আমি টায়ার্ড আম্মু।"
----" মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। ক'দিন পর বউয়ের মাথাব্যথা হলে তো ঠিকই রাত জেগে বসে থাকবি। মায়ের সময়ই টায়ার্ড? আজ একটা মেয়ে নাই বলে!"
----" আল্লাহ! আম্মু? তুমি কি জানো? তোমাকে ঠিক সময়ে ফিল্মে দিলে অভিনয় করেই কোটিপতি হয়ে যেতে তুমি। আর আমি হতাম কোটিপতির একমাত্র ছেলে।"
----" ফাজলামো করিস আমার সাথে?"
----" একদমই না।"
মা-ছেলের খুনশুটি দেখে ঠোঁট চেপে হেসে ফেললাম আমি। মামানিটা সত্যিই অদ্ভুত একজন মহিলা। কখনও কখনও ছেলে আর স্বামীর প্রতি উনার অভিমান দেখলে মনে হয় শরীরটা বাড়লেও মনটা এখনও সেই বাচ্চায় রয়ে গিয়েছে। শুভ্র ভাইয়ের অভিমানী ছোট্ট একটা বাচ্চা!
____________________
আধাঘন্টা যাবৎ কন্টিনিউয়াসলি দৌড়ঝাঁপ পেরে রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। শাড়ি পড়ে ঘর সাজানোটা দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজ বলে বোধ হচ্ছে আমার। কেক, মোম আর বাকিসব খাবারগুলো ঠিক জায়গায় রেখে চারপাশটাই একবার চোখ বুলালাম আমি। রুমটাকে খুব বেশি সাজানো হয় নি। এদিক ওদিক বেশ কিছু বেলুন, শুভ্র ভাইয়ের ছোট থেকে বড় হওয়ার ক্রমান্বয়ে কিছু ছবি, কিছু তাজা গোলাপ। কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে যখন চারদিকটা পর্যবেক্ষণ করছি ঠিক তখনই ফোনের ম্যাসেজ টুন বাজল। মামানির ম্যাসেজ, ' শুভ্র রুমে যাচ্ছে। লুকা তুই..." হঠাৎ এমন পরিস্থিতিতে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম আমি। কোমরে গুঁজা আঁচলটা খুলে তাড়াহুড়ো করে রুমের আলো নিভিয়ে করে দিলাম। আলো নিভিয়ে কানা মামার মতো কিছুদূর এগুতেই দরজা খুলে আলো জ্বালালেন শুভ্র ভাই। আমি কি বলব বুঝতে না পেরে দাঁত বের করে হাসলাম। বোকা বোকা গলায় বললাম,
----" হ্যালো!"
শুভ্র ভাই জবাব দিলেন না। আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। চোখে-মুখে চরম বিস্ময়। আমি দৌঁড়ে বেরিয়ে যাব নাকি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকব বুঝে উঠার আগেই আবারও আলো নেভালেন শুভ্র ভাই। মুহুর্তেই ঘরটা অন্ধকারে তলিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পর আবারও আলো জ্বালালেন। আগের মতোই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। চোখ পিটপিট করে বললেন,
----" সত্যিই তুই?"
আমি বোকার মতো হাসলাম। উনি হতভম্ব গলায় বললেন,
----" সত্যিই তুই? আমরা কি বিয়ে টিয়ে করে ফেলছি নাকি?"
আমি কপাল কুঁচকে বললাম,
----" জ্বি?"
আমার কথায় শুভ্র ভাইয়ের চমক কাটল। হাতে পরা ঘড়িটা দেখে নিয়ে বললেন,
----" এই এতো রাতে তুই এখানে কেন? তাও আবার আমার রুমে? আশ্চর্য তো! তোকে তো ধরে দেওয়া দরকার কয়েকটা চড়। তু...."
----" হ্যাপি বার্থডে বাবু।"
মামানির কথায় ফিরে তাকালেন শুভ্র ভাই। মামানি শুভ্র ভাইয়ার ডান গালে হাত রেখে বললেন,
----" পঁচিশ বছরের হয়ে গেলি! এতো তাড়াতাড়ি? মনে হচ্ছে সেইদিন হসপিটাল থেকে আনলাম তোকে। একদম এইটুকু একটা বাবু....আমার বাবু।"
মামানির কথায় হেসে ফেললেন শুভ্র ভাই। মামানিকে একহাতে জড়িয়ে ধরলেন। মামানি হেসে বললেন,
----" চেয়ারে বসলে টেবিল নাগাল না পাওয়া আমার ছেলেটার কি বিশাল শরীর এখন, বিশাল হাত, চওড়া বুক। মাঝে মাঝে ভাবি আর অবাক হই...এই এতোবড় জোয়ান ছেলেটা আমার? সত্যিই আমার? আরও হাজার বছর বেঁচে থাক শুভি। আমি এভাবেই মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকি তোকে।"
কথাটা বলে চুমু খেলেন শুভ্র ভাইয়ের বুকে। শুভ্র ভাইয়া হেসে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন মাকে। এই অসম্ভব সুন্দর মুহূর্তটুকুকে ক্যামেরাবন্দী করে তৃপ্তির হাসি হাসলাম আমি। মামানিকে ছেড়ে দিয়ে কপাল কুঁচকে বললেন উনি,
----" এসব তাহলে এই দুই রমণীর প্ল্যান?"
মামানি হেসে বললেন,
----" চমকেছিস? "
শুভ্র ভাই চোখের ইশারায় আমাকে দেখিয়ে বললেন,
----" সামনের জনকে দেখে চমকিয়েছি।"
----" তবু তো চমকিয়েছিস....এবার চল কেক কাটবি।"
----" আমার এইসব ভাল্লাগে না।"
----" শুভ্র!!"
----" আচ্ছা চল। সাময়িক কেক কাটা চলুক আজ। আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি আর তোমরা আনন্দ করছ। আমার তো দুঃখে ঘুমিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।"
শুভ্র ভাইয়ের কথায় হেসে ফেললাম দু'জনেই। মামানি মোমবাতি জ্বালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শুভ্র ভাই আমার পাশে দাঁড়াতেই মৃদু গলায় বললাম আমি,
----" জন্মদিনের শুভেচ্ছা মামুর ছেলে।"
শুভ্র ভাই হাসলেন। আমার দিকে খানিকটা চেপে এসে আমার থেকেও মৃদু গলায় বললেন,
----" জন্মদিনের শুভেচ্ছা রোদপাখির শুভ্রকেও।"
হঠাৎ করেই ভীষণ লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলাম আমি। অস্থির চোখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। শুভ্র ভাই অলস ভঙ্গিতে কেক কাটলেন। মাত্র রাতের খাবার খাওয়ায় একটা খাবারও মুখে তুললেন না। আমার খাবার-দাবার নিয়ে বেরিয়ে এলাম। সবকিছু কোনরকম ফ্রিজে রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসলাম। মামানি ওয়াশরুমে যেতেই ফোনে ম্যাসেজ টুন বাজল। শুভ্র ভাইয়ের ম্যাসেজ,
----" ঘড়িটা আমার জন্য? তুই কিনেছিস? অত টাকা কোথায় পেলি? আজকের এই সময়টুকু যে এতোটা স্পেশাল হবে ভাবতেই পারি নি আমি। জীবনের প্রথম চমক আর প্রথম চিরকুটটা আজই পেলাম আমি। নিজের জন্মদিনটাকে গুটিয়ে বুক পকেটে রেখে দিতে ইচ্ছে করছে। বার বার বলতে ইচ্ছে করছে, আমার জীবনের মোস্ট ইম্পোর্টেন্ট রমণী দু'জনকে ভীষণ ভালোবাসি আমি। ভীষণ! "
আমি মৃদু হাসলাম। সোফায় গা এলিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই দেখলাম দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন শুভ্র ভাই। তার গভীর দৃষ্টিজোড়া আমিতেই নিবদ্ধ। আমি বামহাতে শাড়ির আঁচলটা মুখের উপর মেলে দিলাম। মামানি না ফেরা পর্যন্ত এই আঁচল সরবে না। কিছুতেই না.....
Writer:- নৌশিন আহমেদ রোদেলা