১
"ভাইয়া কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?আমাকে ছাড়ুন ভাইয়া প্লীজ ছাড়ুন! প্লীজ ছেড়ে দিন! দয়া করুন আমার উপর!"
বলতেই উনি সাদা রুমাল মুখের সামনে চেপে ধরলো। ধস্তাধস্তির এক পর্যায় মেয়েটি জ্ঞান হারালো । জ্ঞান ফিরলো যখন নিজেকে আবিষ্কার করলো হাত পা বাধা অবস্থায় চেয়ারে বসে। আর তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে কিছু পরিচিত মুখ।এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো৷সারা শরীরে বয়ে গেলো ভয়ের স্রোত। কাঁপন ধরলো গায়ে।
"আপনারা? প্লীজ আমাকে ছেঁড়ে দিন। দয়া করুন!আমি কাউকে কিছু বলবো না। "
কান্না জড়িত করুন কন্ঠে বলে উঠলো মেয়েটি। বিশেষ লাভ হলো না এতে। উল্টো পলক ফেলার আগেই, লোকটি তার কাছে এসে পড়লো। মেয়েটি ভয়ে চোখ বুঝে ফেললো। কানে ভেসে আসলো লোকটির বিকৃতি কথা। আতঙ্ক মেয়েটির মুখ সাদা হয়ে গেলো।
---"আমার দাদু মানুষের কলিজা ভুনা খুব পছন্দ করতেন!"
লোকটির কথায় সিটিয়ে গেলো মেয়েটি।কিছুটা পিছনে হেলে ভয় ভয় চোখে তাকালো লোকটির দিক। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
---"কি স...ব বলছেন? "
লোকটি মৃদু হাসলো। চাপানো শক্ত চোয়াল তবুও স্টাইল করা দাঁড়ি আড়ালে মুখখানায় রয়ে গেল গম্ভীর, রাশ ভরা। লোকটি মেয়েটির কঁপাল থেকে গাল পর্যন্ত স্পর্শ করলো। লোকটি শ্বাস নিশ্বাস আছড়ে পড়লো মেয়েটির চোখে, মুখে, গালে।শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা মেয়েটির। মেয়েটির কঁপালের ছোট চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিলো লোকটি। ফিসফিস করে বলল,
----"কিন্তু আমার মানুষের মাংস খেতে পছন্দ। লবন, ঝাল দিয়ে খেতে দারুন স্বাদ। জানো পৃথিবীতে মানুষের মাংসের স্বাদ সবচেয়ে বেশি!"
চোখ বড় বড় করে তাকালো মেয়েটি। তীব্র সুদর্শন এই যুবকটির বিকৃতি কথা বার্তা হজম হলো না। গা গুলিয়ে এলো মেয়েটির। মুখ ভর্তি করে বমি চলে আসচ্ছে। বহু কষ্টে ঠেলে দিচ্ছে ভিতরে। ভয়ে আধমরা মেয়েটি লোকটিকে অস্পষ্ট ভাঙ্গা স্বরে বলল,
"এ..স..ব কি.. ব...লছেন স্যার!"
লোকটি হো হো করে হেসে উঠলো। হাসির গুঞ্জনে কেঁপে উঠলো ঘরের ইট। কেঁপে উঠলো মেয়েটি। এই মুহুর্তে তার পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু লোকটি তাকে বেঁধে রেখেছে। কি করবে সে? লোকটির কুৎসিত কথা বার্তায় নেতিয়ে পরেছে ।
" তোমার মতো সুন্দরী, নরম তুলতুলে মসৃন শরীর আর নাদুসনুদুস শরীরের মাংস আরো সুস্বাদু হবে নিশ্চয়ই? আম সো এক্সাইটেড তোমার শরীরের মাংস খেতে!"
শেষের কথাটি ধীরে ধীরে হিসহিস করে বলল লোকটি। ফ্যাকাসে হয়ে গেলো মেয়েটির মুখ। কঁপালে দেখা গেলো বিন্দু ঘাম।মুখ ভর্তি আতঙ্ক নিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো মেয়েটি,,
"না...! প্লীজ আমাকে ছেঁড়ে দিন স্যার। আমাকে যেতে দিন। আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না। দয়া করুন স্যার!"
লোকটি মৃদু হাসলো। মেয়েটির মুখে উপর ঝুকে এক হাতে মেয়েটির গাল টিপে অন্য হাতে নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলল,
"যাবে তো সুন্দরী ...খুব শীগ্রই তুমি.. তবে,কিন্তু আমার পেটে!"
পিলে চমকে উঠলো মেয়েটির। ডর ভয় হুরহুর করে বাড়লো। হুহু করে কেঁদে উঠলো।
"আমি আপনার পায়ে পড়ি। আমাকে মারবেন না। ছেঁড়ে দিন। আমি..আমি কথা দিচ্ছি আমি চলে যাবো, দূরে..দূরে কোথাও চলে যাবো। আমাকে ছেড়ে দিন।আমি মরতে চাই না। আমাকে বাঁচতে দিন।"
মেয়েটির কথার মাঝেই লোকটি ইঞ্জেকশন পুশ করলো।মেয়েটি ঢলে পড়লো আবার।আর লোকটি শক্ত চোয়ালে ভেসে উঠলো রহস্যময় হাসি।
"ডক্টর? এখন রুফাইদাকে কি করবেন?"
অস্বস্তি নিয়ে কয়েকহাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা গোল গাল চেহারার রোগাসোগা মেয়েটির দিকে তাকালো লোকটি। পরনে ফিনফিনে ক্রীম রঙ্গা জামা।মুখ ভর্তি প্রশ্নের রেশ। লোকটি এগিয়ে এলো। ঠোঁটে কোনে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে রুফাইদার দিকে তাকালো। মেয়েটিকে দেখে যেন মনে হচ্ছে ছোট বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে। লোকটি হাসি বহাল রেখে সামনের মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল,,
"বাকি সবার সাথে যা করি?"
যুবতী নিঃশব্দে ঢুক গিললো। চোখ টিপে দুষ্ট হাসি হেসে বলল,
"বিছানার সঙ্গী বানাবেন? ইউ রেপড হার?"
লোকটি রহস্যময় হাসি বহাল রেখে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। মেয়েটিও স্থীর চেয়ে রইলো। মনের কোনে কোথাও তার খুব খারাপ লাগছে। নিজের বান্ধবীকে নরপিশাচের হাতে তুলে দিয়েছে সে। মনে মনে অনুতপ্ত হলেও। ঠোঁটে হাসি ফুটলো। পথের কাঁটা তো দূর হচ্ছে? বাকি সব চুলায় যাক।মরে যাক। অথবা... ধর্ষিত হোক..।
-----------
নিস্তরঙ্গ নৈঃশ্বদে চাদর গায়ে মুড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে নগরী। ঘুম নেই শুধু এই জননীর। আজ তিন দিন যাবত সেই মায়ের হৃদয়ের টুকরো হারিয়ে গেছে। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেডিকেল কলেজ পড়াশোনো করতো তার মেয়ে রুফাইদা। রূপে গুনে ছিলো পঞ্চম মুখী। ছুটিতে বাসায় আসবে বলে কন্ঠে আমেদ নিয়ে ফোন দিয়ে ছিলো নাজমা তালুকদারকে। আর আজ তিন দিন চললো, মেয়ের ফোন বন্ধ, হোস্টেলে খবর নিয়ে জানতে পাড়লো, হোস্টেলেও নেই। এবার যেন বুক কেঁপে উঠছিলো নাজমার। ২৪ ঘন্টা পার হতেই মেয়ে নিখোঁজ রিপোর্ট করে এসেছেন তারা। আচ্ছা তার ছোট রুফাইদা ঠিক আছে তো? মেয়েটি খাওয়াদাওয়া করেছে তো? মুখে আঁচলের আড়ালে ঢুকরে উঠলেন তিনি।সেই মুহূর্তে নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়ালো এক মাঝ বয়সি লোক। গায়ে ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি । শরীরে বার্ধকের লক্ষ্মণ। চশমার আড়ালে চোখের জল লুকিয়ে হাত রাখলেন নাজমার কাঁধে। এক পলক তাকিয়ে নাজমা হাউমাউ করে কেঁদে মুখ লুকালেন তার বুকে।
" সাইফ! আমার মেয়ে কই বলো? ওকে এনে দাও। আমি সইতে পাড়ছি না আর। আমার মন বলছে আমার মেয়ে কষ্টে আছে। ওকে খুঁজে আনো...খুঁজে আনো ওকে...!"
সাইফ তালুকদার স্ত্রীকে বাহু ডোরে বন্ধ করে নিলেন। কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন,,
"কেঁদে না নাজমা। আল্লাহ উপর ভরসা করো। ঠিক দেখবে আমাদের মেয়ে চলে আসবে।"
নাজমা অবুঝের মতো কান্না করতেই লাগলেন। আজ সাইফ তালুকদার কাছে কোনো শান্তনা বানী নেই। অসহায় সে।
দরজার আড়াল থেকে মা-বাবার এই কান্না বুকে গিয়ে লাগচ্ছে জয়নবের। ছোট কিশোরী মন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। বোনকে হারিয়ে আজ দুঃখে বুক ভাসিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। কই তার বোন। কই তার খেলার সাথী???কই তার পড়ার সাথী?? কই তার ঝগড়ার সাথী। কাঁজলা দিদি কবিতার মতো সেও-কি আড়ালে চলে গেলো! কিন্তু কেন?
--------
কিছু, কিছু রাত কারো কারো জন্য অত্যন্ত অভিজাত। আবার কিছু কিছু রাত কারো জন্য বন্য প্রকৃতির। সেখানে অালো আধাঁরি খেলা হয়ে থাকে। কিছু গোপন খেলা, বিপদজনক খেলা।কিছুটা প্রকাশ্য, কিছুটা অপ্রকাশ্য।সেখানে প্রমিকের অাদরের মতো রোমান্টিসিজম নেই। আছে শুধু আদিম রিংরিসার মতো অন্তর্দহন প্রণয় দগ্ধ হওয়া দাউ দাউ অগ্নি শিখা। সেখানে শব্দ আছে কারো বাঁচা জন্য আর্তনাদ আছে।এই রাত, এই অগ্নিশিখায় চুড়ান্ত দহনে পুড়িয়ে মারে।
ঠিক তেমনি কিছু আর্তনাদ,, "আমাকে বাঁচাও, আমি বাঁচতে চাই, ছেড়ে দাও আমায়!" বিশাল ব্যয়বহুল এই কামড়া থেকে ভেসে আসচ্ছে। নরম বিছানার উপর শুঁয়ে আছে শুভ্র এক পরি। হাত-পা দুটি খাটের হাতলে বাঁধা। প্রাণপণ চেষ্টা করছে বাঁচার। ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো কেউ। তার দিকে তাকাতেই চোখ দুটি বড় বড় হয়ে গেলো রুফাইদার। সামনের এই দুর্দান্ত সুদর্শন যুবকটি দৈত, নর পিশাচের ন্যায়। পড়নে কালো প্যান্ট , উদম বুক। ডান পাশের একটি ট্যাটু। বাম হাতে চাবুক। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসচ্ছে সে রুফাইদার দিকে। রুফাইদা লোকটি এ রূপ দেখে শিরা-উপশিরায় নিস্তেজ হতে লাগলো। ঘরের মোলায়েম আলোয় মানুষ রূপী দানবটির পিশে ফেলতে চাইছে তাকে। প্রতিটি স্পর্শ ঘা বসাচ্ছে গায়ে। রুফাইদার আর্তনাদ কেঁপে উঠছে জগৎ।
"আমাকে ছেঁড়ে দিন। আমার এত বড় সর্বনাশ করবেন না। আমাকে ছেঁড়ে দিন!"
কিন্তু শেষ রক্ষে আর হলো না।নিশ্চুপ হলো চারিদিক, হরণ হলো সতীত্ব,মরন হলো মনের, নিথর হলো দেহোখানী। দেহের মাঝে লেগে গেলো ধর্ষিতার দাগ।
--------
রাতের বৃষ্টির পর সকালের রোদের রূপ উড়নচণ্ডী যেন। খা খা মাঠ ঘাট রাগে তপ্ত করছে । রোদের তেজে ঘরের মাঝে ভ্যাপসা গরম আর গুমাটে ভাবে হাপিয়ে উঠে ছিলো জয়নব। তিন রাত ঠিক ঠাক না ঘুমিয়ে, না খেয়ে বেহাল বাবা-মার জন্য চট করে ছোট কিশোরী সকালের নাস্তা করে ফেললো। টেবিল সাজিয়ে বাবা-মাকে জোর জবরদস্তি খাবারে নলা মুখে তুলে দিতেই খটখট শব্দ করে উঠলো দরজায়। বিরক্ত হয়ে জয়নব দরজা খুলতেই মুখখানা সাদা হয়ে গেলো। মুখ গগনবিদারী এক আর্তনাদের বেড়িয়ে এলো,
"ব..ড়..পু"
২
"মিস রুফাইদাকে গন ধর্ষন করা হয়েছে! সারা শরীর জুড়ে টর্চারের আঘাত। স্পর্শকাতর জায়গা আর মুখ থেঁতলে দিয়েছে। এসিড মেরে মুখ ঝলসে গেছে, যার ফলে চেহারা বুঝা যাচ্ছে না । আর শরীরের জায়গা জায়গা থেকে মাংস তুলে নেয়া হয়েছে।"
বাড়ি ভর্তি করে উত্তেজনার ভাব। চারিদিকে পুলিশ আর মিডিয়ার লোক। শুধু থমথমে পরিবেশে সাইফ, নাজমা, জয়নব স্তব্ধ। আকাশে ঘন মেঘ গুড় গুড় করছে। সূর্যের দাম্ভিকতা দংশন করে দাপিয়ে আসছে অন্ধকার ।একঝলক বিদ্যুৎ নীলাভো আলো এসে পড়লো ঘর জুড়ে। নিঃশব্দ কিশোরী জয়নবের কর্ণপাত হচ্ছে পুলিশের কথাটি বাজ পড়ার মতো। ঘরের প্রতিটি মানুষের আদরের রুফাইদার মর্মান্তিক মৃত্যু কথা শুনে জ্ঞান হারিয়েছে নাজমা। সাইফ ভেঙ্গে পড়েছে। হু হু করে বাড়ছে বিপদ৷ বাহিরের বৃষ্টির বেগ আরো বাড়লো। গগনবিদারী চিৎকার করে বাজ পড়লো আবার। অন্ধকার ঘরটিতে দেখা মিলছে ক্ষনিকের নিয়ন আলো। সেই সামান্য আলোতে দেখা গেলো বিছানার উপর পা গুটিয়ে বসে থাকা কৃষ্ণাভ অথচ পেলব মসৃণ মুখ। ঘন কালো চুল এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে পিঠ জুড়ে। সামান্য উঁচু কঁপালের ঠিক নিচে ঘন ভ্রু যুগল আর এক জোড়া ঝকঝকে চোখ দিয়ে পড়ছে নেত্রনীর। সুচালো ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। বিছনার উপর পরে থাকা এলো মেলো কিছু রক্তাক্ত কাপড়, ভাঙ্গা ঘড়ি, গলার লকেট আর একটি কানের দুল, এগুলে দেখেই ফুপিয়ে উঠছে জয়নব। বোনের মরার খবর কিশোরী জয়নবের ছোট মনটা কাতর। তার উপর ধর্ষণের খবর বাতাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে আত্মীয় স্বজন আর পাড়াপড়শিদের মাঝে। কেউ সান্ত্বনার বানী শোনাচ্ছে তো কেউ টিটকারি দিয়ে বলছে,
"মেয়ে হোস্টেল থাকতো একা। হয়তো কোথাও ফষ্টিনষ্টি করেছে ছেলেদের সাথে। তাই ছেলেরা খেয়ে দিয়েছে একদম। এদের সাথে এমন হওয়াই সাজে বৈকি। "
কথা গুলো শক্তভাবে হজম করলেও দু চারটে কথার প্রতিবাদ করেও লাভ হয়নি বিশেষ। উল্টো নাজমার অবস্থা নাজুক। মেয়ের শোকে শরীর ছেড়ে দিয়েছে বিছানায়। দিন যেতে লাগলো পরিস্থিতি অনুকূল নেই। ভেঙ্গে চুড়ে যাচ্ছে সব। এভাবেই কেঁটে গেলো ১৫ টা দিন। এখনো বোনের থেঁতলে আর এসিড পোড়া মুখটি মনে পড়লেই কামড় দেয় বুকে। এদিকে পুলিশ থেকেও কোনো তথ্য পাচ্ছে না তারা। সাইফ পুলিশ স্টেশন ঘুরে ঘুরে ব্যর্থ কোনো তথ্য নেই! কারা করলো? কি দোষ ছিলো তার ছোট পরির? কেন তারা সাথেই এমন হলো?? সাইফ স্পষ্ট দেখতে পেলো তার ছোট পরি খিল খিল করে হেসে দৌড়ে আসচ্ছে কাছে। মুখে বাবার তার খোট বুলিতে বলছে, "আমার বাবা, আমার বাবা!"। সাইফ তার বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন।
বরাবরের মতো আজও হতাশ হয়ে ফিরলেন সাইফ। বুকের ভিতর আর জোড় নেই। ঘামন্ত, ক্লান্ত, শ্রান্ত শরীর হেলিয়ে দিলো সোফায়। রান্না ঘর থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে দৌড়ে এলো জয়নব। বাবার বেহাল দেখে আতঙ্ক ভাবে বলে উঠলো,
" কি হয়েছে বাবা? এমন করছো কেন? "
সাইফ হাঁপাচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সাদা পাঞ্জাবিতে সুদর্শন এই বাধ্যর্কের মুখ শুকিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে হাসফাস করছেন। এ কদিনে যেনো বয়স টা দিগুন বেড়েছে। ভয় হচ্ছে, তার কিছু হয়ে গেলে ছোট মেয়েটির কি হবে? সাইফ ছলছল নয়নে তাকালেন। বার কয়েক অস্থির কন্ঠে প্রশ্নে করতে থাকে জয়নব। অথচ সাইফ কি বলবেন? তার উত্তর খুঁজে পেলেন না। ছোট থেকে তার ছোট পরি বাবাকে বলতো,"আমার সুপারম্যান "অথচ আজ এই সুপারম্যান ব্যর্থ। নিজের মেয়েকে ন্যায় দিতে পারলো না? কেমন পিতা সে? ঢুকরে উঠলেন তিনি। জয়নবের মুখ অজানা এক ভয় সাদা হয়ে গেছে। ঠোঁট দুটি এক অব্যক্ত ভয়ে অল্প অল্প কাঁপছে।
"বাবা বলো না? কি হয়েছে?তুমি এমন করছো কেন??
কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে সাইফের সুন্দর মুখখানা টকটকে লাল হয়ে গেছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বুলিতে কথা পড়লেন তিনি,
"আমি ব্যর্থ বাপ!.. মা। আমার মেয়ের জন্য কিছুই করতে পাড়লাম না। সব শেষ!"
বাবার চোখের পানিতে জয়নবের চোখের নেত্রধারা পড়তে লাগলো। বাবা বুকে মাথা রেখে বলল,
"না বাবা,, তুমি সুপার বাবা। তুমি আমাদের গর্ব বাবা!"
সাইফের বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। মেয়েকে বুকে টেনে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
"আমি আমার ছোট পরিকে ন্যায় দিতে পাড়লাম না মা, পাড়লাম না।"
ছোট জয়নব কিছুই বুঝলো না। ছল ছল চোখে বারা দিকে তাকিয়ে রইলো। বিচলিত হয়ে বলল,
"কি বলছো বাবা?"
সাইফ মাথা নাড়লেন,
"তোর বোনের কেইস ক্লোজড করে দিয়েছে থানায়!"
মুহূর্তেই গর্জে উঠলো জয়নব,,
"কিন্তু, তারা তো খুনি পায়নি এখনো? কে আপুকে এ কাজ করেছে? কেন করছে, কিছু না জানিয়ে কিভাবে ক্লোজড করে দেয়!"
সাইফ নিশ্চুপ রইলেন। তার মনে হচ্ছে তার ছোট পরি কাঁদচ্ছেন আর বলছে,
"বাবা! তারা আমাকে অনেক অত্যচার করেছে বাবা।তাদের তুমি শাস্তি দাও নিজ হাতে দাও!"
-------
দুপরের কড়া রোদ। বাতাসের লেশ মাত্র নেই। গরমে চিটচিটে হচ্ছে শরীর। মাথার উপর ফ্যানটি গটগট শব্দে করেও গরম যেন দূর করতে পারছে না।এদিকে মেজাজ তুঙ্গে জয়নবের। তার উপর ভ্যাপসা গরমের মাঝে কনস্টেবলের ঘেন ঘেন। জয়নব এবার ধমকে উঠলো,
"আপনারা কেন আমার বোনে কেইস বন্ধ করলেন?বলেন? খুনি তো ধরা পড়ে নি তাহলে?"
কনস্টেবল ভাবলেশহীন। টেবিলের ড্রয়ার থেকে পানের বক্স বের করে পান মুখে দিতে দিতে বললেন,
"এই কেইসের কোনো ভিত্তি নাই। তাই বন্ধ করা হইছে। এর বেশি কিছু কবার পামু না। বাহিরে বসেন গিয়ে বড় স্যার আইলে তাহরে জিগাইবেন। যান যান উঠেন বাহিরে যান!"
আগত বাহিরে বেড়িয়ে আসতে হলো জয়নবের। বাহিরে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে ডাক পড়লো তার। ভিতরে গিয়ে অতি বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করতেই বড় স্যার বললেন,
" আমাদের হাতে কিছু নেই। উপর থেকে পেশার এসেছে বিধায় বন্ধ করতে হয়েছে। তবে তুমি চাইলে আমি কেইসটা রিওপেন করতে পারি। কিন্তু..!
মুহূর্তেই সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে ঠোঁটে ফুটেলো হাসি। আরেকটু ঝুকে এসে কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল,
"কিন্তু কি স্যার!"
"আমার কিছু চাই!"
জয়নব খুশি খুশি কন্ঠে বলল,
"টাকা চিন্তা করবেন না স্যার। যত টাকা লাগে আমি দিবো। তবু একবার ওই নির্লজ্জ, বেহায়াকে শাস্তি দিন!"
স্যার হালকা কেশে উঠলেন। জয়নবের হাতের উপর হাত রেখে হালকা চাপ দিলেন। কামুকতা নজরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
"আজ রাতটা তোমার আমাকে দাও অাদরে-সোহাগে ভরিয়ে দিবো। আই প্রোমিস রাতে খুশি করতে পারলেই কেইস রিওপেন করে দিবো!"
ঘৃনায় গা গুলিয়ে এলো জয়নবের এক ঝাটকায় হাত সরিয়ে ডান গাল বরাবর চর লাগালো জয়নব। বড় স্যার হতভম্ব। কি থেকে কি হলো বুঝতে পারছে না। জয়নব এবার গলা ছাড়লো। রাগে গা কাঁপছে। চেঁচিয়ে বলল,
"জনগণ তোদের বিশ্বাস করে তোদের কাছে আসে। আর তোরা এসব বলিস ছিঃ। মানবতা বলতে কিছু নেই তোদের? তোদের উপর থুতু দেই। "
বড় স্যারের নামটি এবার দেখে নিলো জয়নব। াবার বলল,
"মিঃ রাসেল আপনার নাম রাস্কেল হওয়া উচিত ছিলো। যতসব! আমি আমার কেশ রিওপেন করাবো, দরকার পড়রে কোটে যাবো।"
অফিসার রাসেল ভরকে গেলেন। কিশোরী মেয়ের এত তেজ হজম হলো না। এক ঝটকা মেরে ফেলে দিলো টেবিলে। স্পর্শকাতর জায়গায় চেপে ধরতেই চেঁচিয়ে উঠলো জয়নব। রাসেল এবার দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস করে বলল,
" নে ডাক কোন বাপেরে ডাকবি।"
বলেই এগিয়ে নিলো ঠোঁট জোড়া। জয়নব যথাসাধ্য চেষ্টা করে এক লাথী লাগালো রাসেলের গোপনাঙ্গে কুকিয়ে উঠে ছিটকে পড়লো রাসেল। জয়নব সেই সুযোগে পালিয়ে বের হলো। থানা থেকে এক প্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো। ছোট কিশোরী নেত্রধারা বইতে লাগলো। এতটুকু বয়সের এই বিচ্ছিরি অনুভূতি দাগ কেটে গেলো মনে ভয়ানক। সমাজের এই তুচ্ছতাচ্ছিল্য ধংস করতে দিতে ইচ্ছে হলো। পৃথিবীতে কি দেহটাই সব?
বসায় এসে সোজা ওয়াশরুমে ঠুকে গেলো জয়নব। রাসেলের বিচ্ছিরি স্পর্শ করা জায়গা গুলো সাবান দিয়ে ঢলতে লাগলো জয়নব। পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো হাউ মাউ করে। শরীরে এই অদৃশ্য দাগ গুলো কেন যাচ্ছে না? কেনো? সে মুছে দিতে চায়। আয়নায় নিজের প্রতিছবি দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখলো বিধ্বস্ত অবস্থায়। পরক্ষণেই মনে পড়ে গেলো বোনের সুন্দর মুখটি, আচ্ছা তার বোনের ও তো এমনি লেগেছিলো এমন পরিস্থিতিতে? সেতো পালাতে চেয়েছে? গলাকাটা মুরগির ধাপ্রি ছিলো। বাচার জন্য কতই না চেষ্টা করেছিলো? কত কষ্টই না পেয়েছে কুলাঙ্গারদের কাছ থেকে? জয়নব এবার স্থীর হয়ে গেলো। মনে মনে ঠিক করলো,তার বোনের খুনিকে সে শাস্তি দিয়েই ছাড়বে।
চলবে...
Writer:- সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি