১৭
লাস্যময়ী ভঙ্গিতে হাসলো। দেবাশীষ স্তম্বিত হলো। তার মনে হলো, কোনো দেবী তার সামনে একটি লাল ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়ে বসে আছে। জয়নব প্রথমে হাত বাড়ালো। দেবাশীষ সম্মোহিতর মতো ওর তালে তাল মিলাতে লাগলো। দেবাশীষ প্রতিরাতে এখানে আসে। তার জন্য একটি রুম বরাদ্দ থাকে সব সময়। সে রুমটির দিকে এগিয়ে গেলো জয়নবকে নিয়ে।রুমে ঢুকেই বসে পড়লো বিছানার উপর। বিশালতা ভরপুর এই কামরা। নিয়ন আলো জ্বলছে। রুমটির ঠিক মাঝ বরাবর গোল বিছানাটিতে বসে কামুকতা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে জয়নবকে।জয়নব এক অদ্ভুত হাসি হেসে ফেললো,
"আর ইউ আফ্রাইড অফ ডেড পিপল?"
দেবাশীষ চমকে গেলো। এমন এক পরিস্থিতিতে বেমান লাগলো কথাটুকু। কিন্তু তবুও মস্তিষ্ক কেমন অস্থির হয়ে গেলো । জয়নব আবার বলল,
"জানেন? এই পুরো বিল্ডিং গড়ে উঠেছে পুরোনো শ্মশানের উপর!"
দেবাশীষ এবার ঘামতে লাগলো। ছোট থেকেই ভয় পায় এইসবে। এমনকি, নিজের স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে দেখাতো দূর, মুখাগ্নি করেন-নি পর্যন্ত।এমনকি মেডিকেলে বরাবরই লাশ ঘটিত ব্যাপার থেকে দূরে থাকতে চায়। এই ভার থাকে সব সময় সাহিরের উপর। জয়নব এ কদিনে এদের উপর নজর রেখেছে। খুঁজে বের করেছে দূর্বলতা। আর তাইতো এই টোপ টাই ফেলেছে। তার জন্য সবচেয়ে বড় ভুমিকা রাখছে মৌ পোকার সংগ্রহীত করা ধুতরা ফুলের বিষ। ভয়ংকর সেই বিষ হল a very powerful haducinating drug যা মানুষের চিন্তায় কাজ করে। চেতনাকে পাল্টে দেয়। রিয়েলিটির ভুল ব্যাখ্যা করে।
জয়নব পড়েছিল একটি বই। বইটার নাম The crystad door, বইটার লেখক কিংস কলেজের একজন বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট-James Hauler, তিনি এই বইটিতে বললেন-মানুষের মনের কিছু দরজা আছে যা সহজে খোলে না। মানুষ যদি কোনো কারণে ভয়ঙ্কর কোনো চাপের মুখোমুখি হয় তখনি দরজা খুলে যায়। তিনি এই দরজার নাম দিয়েছেন crystal door.
জেমস হাউলার বলছেন–এই স্ফটিক দরজার সন্ধান বেশির ভাগ মানুষ সমগ্র জীবনে কখনো পায় না। কারণ বেশির ভাগ মানুষকে তীব্র ভয়াবহ মানসিক চাপের মুখোমুখি হতে হয় না। জেমস হাউলার মনে করেন মানুষের কাছে দুধরনের বাস্তব আছে। একটি দৃশ্যমান জগতের বাস্তবতা, আরেকটি অদৃশ্য জগতের বাস্তবতা। স্বপ্ন হচ্ছে সে রকম একটি অদৃশ্য জগত এবং সেই জগতও দৃশ্যমান জগতের মতোই বাস্তব। স্ফটিক দরজা বা crystal door হল অদৃশ্য বাস্তবতার জগতে যাবার একমাত্র দরজা। এই সাইকিয়াট্রিষ্ট মনে করেন যে কৃত্রিম উপায়ে মানুষের মনে চাপ সৃষ্টি করে অদৃশ্য দরজা খোলা যেতে পারে। তিনি একটি কৃত্রিম উপায় বেরও করেছেন। তার উপর গবেষণা করছেন।
মনের উপর কৃত্রিম চাপ সৃষ্টির জন্যে তিনি উৎসাহী ভলেন্টিয়ারকে একটি সাত ফুট বাই সাত ফুট এয়ার টাইট ধাতব বাক্সে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে দেন। বাক্সের ভেতরটা ভয়ংকর অন্ধকার। বাইরের কোনো শব্দও সেখানে যাবার কোনো উপায় নেই। পরীক্ষাটা কী, কেমন ভাবে হবে তার কিছুই ভলেন্টিয়ারকে জানানো হয় না। সে কোনো রকম মানসিক প্ৰস্তৃতি ছাড়াই বাক্সের ভেতর ঢোকে। তারপর হঠাৎ লক্ষ করে বাক্সের ভেতর পানি জমতে শুরু করছে। আস্তে আস্তে পানি বাড়তে থাকে। ভলেন্টিয়ার বাক্সের ভেতর দাঁড়ায়। ডাকাডাকি করতে শুরু করে। বাক্সের ডালায় ধাক্কা দিতে থাকে। কোনো উত্তর পায় না। এদিকে পানি বাড়তে বাড়তে তার গলা পর্যন্ত চলে আসে। সে প্ৰাণে বাঁচার জন্যে পায়ের আঙুলে ভর করে উঠে দাঁড়ায়। পানি বাড়তেই থাকে। পানি নাক পর্যন্ত যাবার পর পরীক্ষাটা বন্ধ হয়। তীব্র ভয়ে ভলেন্টিয়ার দিশাহারা হয়ে যায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে শতকরা ত্রিশভাগ। ভলেন্টিয়ার পরীক্ষার শেষ পর্যায়ে হঠাৎ নিজেকে বাক্সের বাইরে অ্যালো ঝলমল একটা জগতে দেখতে পায়। যে জগতের আলো পৃথিবীর আলোর মতো না। সেই আলোর বর্ণ সোনালি। সেই জগতের বৃক্ষরাজি বৃক্ষরাজির মতো না। সেই জগত অদ্ভূত অবাস্তব এক জগত। যেখানে অস্পষ্ট কিন্তু মধুর সঙ্গীত শোনা যায়। শতকরা দশভাগ। ভলেন্টিয়ার নিজেদের আবিষ্কার করেন। অন্ধকারে ধূম্রময় এক জগতে। সেই জগত আতঙ্ক এবং কোলাহলের জগত। বাকি ষাট ভাগ কিছুই দেখে না। তারা আতঙ্কময় এক অভিজ্ঞতা নিয়ে বাক্স থেকে বের হয়ে আসে।
জয়নব এবার ঠিক তেমনি টেকনিক প্রয়োগ করলো। দেবাশীষের মস্তিষ্কে ঘুর ঘুর করতে লাগলো প্রতিটি কথা। জয়নব এবার দেবাশীষের মাথা খুব সুক্ষ্ম ভাবে ঢুকিয়ে দিলো কিছু কথা,
"জানেন? এই বিলাশময়ী রুমিটতে একটি মেয়ে মারা গিয়েছে। রোজ রাতে নাকি মেয়েটি এই পরো বিল্ডিং-এ উল্টো হয়ে ঘুরে বেড়ায়?"
দেবাশীষের শ্বাসপ্রশ্বাস ঘন হয়ে এলো। খুব কষ্টে যেন দম ফালছে। হুট করেই কান দুটি যেন গরম হয়ে গেছে। দেবাশীষ যেন স্পষ্ট দেখতে পেলো বড় পর্দার পিছনে একটি নগ্ন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি মাথা ঘন কালো কুচকুচে চুল। সারা অঙ্গ চুলে ঢাকা। মাথা নত করে আছে যেন। জয়নব দেবাশীষের চোখে মুখ ভয় দেখতে পেল। জয়নব বাঁকা হাসলো। বুঝতে বাকি নেই, ধুতরাফুল মধু কাজ করছে। দেবাশীষের চিত্রবিভ্রম
, দৃষ্টিবিভ্রম,দিকবিভ্রম হচ্ছে। জয়নব আরো একটু তেল মশলা ঢাললো। দেবাশীষের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
"আরো কি হয় জানেন.... রাত যত গভীর হয়, শ্মশানে পরিণত হয় এই হোটেল। শিকার খুঁজে নেয় শ্মশানের অশুভ আত্মারা। "
চোখ ভর্তি ভয় নিয়ে তাকালো দেবাশীষ। মুখের কথা গুলো বন্ধ হয়ে গেলো অটোমেটিক। বিছনা থেকে উঠে এক ছুটে রুম থেকে পালিয়ে যেতে চাইলো সে। কিন্তু কে যেন আটকে দিয়েছে পা জোড়া। মনে হচ্ছে! মনে হচ্ছে যেন পা দু'টো আটকে গেছে ইট পাথরের ফ্লোরটিতে। দেবাশীষ চিৎকার করতে চাইলো। জয়নবের দিকে তাকিয়ে ধাপাধাপি করতে লাগলো উঠার জন্য কিন্তু নাহ্... পারলো না। মনে হলো কোনো অদৃশ্য অশরীরী তার পা জোড়া বেঁধে দিয়েছে। দেবাশীষ তাকালো পর্দার আড়ালে থাকা মেয়েটির দিকে। হুট করে মেয়েটি চোখ মেলে তাকালো। দেবাশীষের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। এই যে তার মেয়ে শোভা...। যাকে সেদিন পালানোর পরেও খুঁজে বের করেছে। এবং ধরে এনেছিলো। নির্মম ভাবে সপে দিয়ে ছিলো ড্রাগ দিয়া শিবপাঞ্জির কাছে। কিন্তু সেদিন তার মেয়ে বাঁচে নি। সাহির তাকে পুতে দিয়ে ছিলো কোনো এক শ্মশানে। শুকনো ঢুক গিললো দেবাশীষ। কাঁদো কাঁদো মুখে দাঁড়িয়ে রইলো শোভা। অসহায় কন্ঠে বলল,
"আমাকে কেন মারলে বাবা? আমি তো তোমার মেয়ে ছিলাম। তোমার শরীরের ছোট অংশ! জানো.. আমি সবাইকে বলে বেড়াতাম। 'মাই ফাদার ইজ দ্যা বেস্ট ফাদার ইন ওয়ার্ল্ড। কিন্তু তুমি... তুমি আমাকে এভাবে মেরে দিলে? জানো বাবা? কত কষ্ট হয়ে ছিলো আমার। খুব কষ্ট। জানো এই অন্ধকার জগতেও খুব কষ্ট। কেউ নেই আমার সাথে। কার সাথে খেলবো? কথা বলবো? কিন্তু তুমি আছো তো। তাই তোমাকে নিতে এসেছি বাবা। এসো...!"
হাত বাড়িয়ে দিলো শোভা। দেবাশীষ আর্তনাদ করে উঠলো,
"নাহ্ নাহ্, আমি যাবো না, কোথাও যাবো না দূর হউ!"
মেয়েটি হাসতে লাগলো। হাসলে আরো যেন বিশ্রী রকমের ভয়ংকর লাগে। দাঁত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে যেন।দেবাশীষের গা গুলিয়ে এলো। সে অন্য দিকে ফিরলো। সাথে সাথে ভয়ংকর চিৎকার করলো। তার ডান পাশেই শতশত লাশ দাঁড়িয়ে আছে নগ্ন ভাবে। কারো বুকের ভিতরে হৃদপিণ্ড নেই, কারো চোখ নেই, নেই কারো কিডনি। দেবাশীষ পালাতে চাইলো। কিন্তু জয়নব তার আগেই রুম থেকে বেড়িয়ে দরজা আটকে দিলো। বাহিরে পার্টি হচ্ছে। লোউড সং বাজাচ্ছে। কেউ শুনতে পেলো না দেবাশীষের আর্তনাদ। জয়নব বেড়িয়ে গেলো রেস্টুরেন্ট থেকে। কেউ জানলোও না, বুঝলোও না। একটি রুমের মাঝে নিজের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের চিত্রবিভ্রম ভস্ম করে দিলো দেবাশীষকে......
------------------------------
দেবাশীষ মারা গেছে আজ সাত দিন হলো। সবাই সেদিন দেখতে পেয়েছিলো সেই হোটেলের বদ্ধ ঘরটিতে ফাঁস লটকে ঝুলছিল দেবাশীষ। নিজের মস্তিষ্কের উত্তেজনা হয়তো সইতে পারেনি সে..! দেবাশীষের মৃত্যু সবচেয়ে ভাবায় সাহিরকে। কিছু তেই বুঝতে পারে না। এমন কেন করলো দেবাশীষ? সব তো ছিলো তার জীবনে। কিসের দুঃখ ছিলো তার? যা জানতো না সাহির? কিছুটা ভেঙ্গে পড়েছে কলেজ জীবনের এই বন্ধুটির জন্য।
-------------------------------
জয়নবের মন আজ বেশ ফুরফুরে। গুন গুন করতে করতে সে গোসল করছে। তখনি টোকা পড়ে বাহির থেকে। জয়নব একটু ফাক করে দেখে অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যুথি। জয়নব মনে মনে হাসে। এর জন্যেও একটি টোপ রেডি করেছে অবশ্য। জয়নব মিষ্টি করে হেসে বলে,
"আপু কিছু বলবেন?"
অগ্নিমূর্তি যুথি গর্জে উঠে বলল,
"তুমি আমার হেড ফোন ছিঁড়ে ফেলেছো! ভর্তি কে করবে শুনি?"
জয়নব তার হাসিটুকু বরাদ্দ রেখে, বিনয়ী কস্ঠে বলল,
"সরি আপু ঘর পরিস্কার করতে গিয়ে বিছানা ঝুরতে থাকতে দেখি, আমি উঠিয়ে রাখতে নেই তখনি টান লেগে ছিঁড়ে যায়। আমি অনেক সরি তার জন্য। ইচ্ছেকৃত ভাবে করিনি।"
যুথি নাছোড় বান্দা। পায়ে পা মারিয়ে ঝগড়া করতে চাইছে সে। বলল,
"সরি বললে আর হয়ে গেলো? জানো কত দাম এটির? লশ তো আমার হলো! ক্ষতি পূরণ টা দিবে টা কে শুনি?"
জয়নব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
"আমি বরং কিনে দেবো? আজ বিকেলে তো ছুটি আছে। আমরা বরং দোকান থেকে নতুন কিনে আনবো?"
যুথি খুশিই হলো। নতুন জিনিস আর টাকার প্রতি বড্ড লোভ তার। সে সম্মতি দিয়ে চলে গেলো। এবং জয়নব দরজা আটকে চোখ বুঝে ঝরনার দিকে মুখ করে হাসলো। ঝড়নার পানি স্নিগ্ধ মুখটাকে ধুয়ে আরো শীতল করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। জয়নব মুচকি হেসে বলল,
" পাখি তুমি হবে বন্দী খাঁচার ভিতরে খুব জলদি...! যেভাবে আমার বোনকে তুমি মরণযন্ত্রনা ভোগ করাচ্ছো? এখন তুমি করবে। খুব শখ না.. বিশ্বাস নিয়ে খেলার এবার কি হবে তোমার.......!"
১৮
আপনি যখন প্রতিশোধের যাত্রা শুরু করবেন তখন দুটি কবর খনন করে শুরু করুন: একটি আপনার শত্রুর জন্য এবং একটি নিজের জন্য” " - জোডি পিকল্ট এর এই উক্টুটি মাথায় গিথে গেছে ভালো করে জয়নবের। মন, মস্তিষ্ক দিয়ে নিজকে তৈরি করে নিয়েছে। মৃত্যুকে মাথায় করে আজ-ও বের হচ্ছে দ্বিতীয় খুনটি করতে। খুন! হে খুন। মস্তিষ্ক দিয়ে বুঝে শোনে খুন, ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে করা খুন। হাসলো জয়নব। এই খুনে তার কোনো অস্ত্রের প্রয়োজন নেই। নেই কোনো শক্তির প্রয়োগ। শুধু প্রয়োজন....বুদ্ধির। জয়নব তাদের হোস্টেল রুমের ছোট আয়নার সামনে বসে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে যাচ্ছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে । কি থেকে কি হয়ে গেছে সে? সেতো আর ৫টা কিশোরীর মতোই ছিলো, কখনো রাগ, কখনো অভিমান, অভিযোগ, খিলখিল করে হাসি, ঠাট্টা সব করার কথা? কিন্তু সে কি করছে? ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করছে।
পরমুহূর্ত আবার ভাবলো জয়নব, সত্যিই মানুষ এরা? এরাতো পশু! আর এই যুথি? ওকে বড়পু তার কত বিশ্বাস করতো? তার সাথে কম্পিটিশন করতো বলে আপু কখনো অবজ্ঞা করতো না। সব সময় বলত,
"কমপিটিশন কমপিটিশনের জায়গা! আর বন্ধুত্ব? বন্ধুত্বের জায়গায়... "
কিন্তু যুথি তা মানতো না। তাই তো রুফাইদা আজ ওদের হেফাজতে। ছোট শ্বাস ছেড়ে উঠে পরলো সে। এমন সময় পিছন থেকে যুথি বলে উঠলো,
"কি গো মেয়ে? রেডিতো? নাকি ভুলেই গেছো?"
জয়নব বাঁকা হাসলো। যার অর্থ," আমি ভুলে যাবো? নাহ্ হতেই পারে না.."
দুজনেই রওনা করলো গন্তব্য। কলেজ গেট ক্রস করবে তখনি ঘটলো বিপত্তি। ডা. আদর! এই বাঁদর লোকটির এখনি এখানে টপকানোর কি দরকার ছিলো? ভেবে পাচ্ছে না জয়নব। সে বিনয়ের সাথে বলল,
"কিছু বলবেন স্যার?"
ডা. আদর গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
"কথায় যাচ্ছ তোমরা?"
যুথিতো খুশিতে গদগদ। আজ কতদিন পর ডা. আদর সেধে এসে কথা বলছে! ভাবা যায়? সে বলল,
"আমরা, আমরা ওইতো সামনের শপিংমলে যাচ্ছি স্যার!"
ডা. আদর স্বভাবসুলভ ভ্রু কুঁচকে এক তার ঠান্ডা গম্ভীর দৃষ্টিতে দেখলো জয়নবকে। জয়নবের কি হলো? সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিলো। সামনে দাঁড়ানো ব্ল্যাক প্যান্ট, স্কাই ব্লু শার্ট পড়া হ্যান্ডসাম ছেলেটি দিকে তাকানোর সাহস তার হলো না। রিজেক্ট করার পর থেকেই লোকটিকে দেখলে বুকটা কেমন খা খা করে। মনে হয় জয়নবের বুকের উপর আছড়ে পড়ে হাউ মাউ করে কেঁদে বলতে,
"ভালবাসি আমাকে আদর। খুব ভালোবাসি। "
কিন্তু আফসোস সে পারে না। আর পারবেও না। তার জন্য এসব নয়! তার উপর তার বাবা জয়নবের শত্রু। অনেক বড়... শত্রু। জয়নব মাঝে মাঝে ভেবে যায়। এই ব্যক্তিটি যখন জানবে, ডা. সাহিরকে সে খুন করতে চায় তখন নিশ্চয় জয়নবকে ঘৃণা করবে ডা.আদর! এত..এত ভালোবাসা যে ফ্যাকাসে চোখ জোড়ায় জয়নব নিজের জন্য দেখে, তা নিশ্চয়ই ভয়ংকর, ধারোলো, উত্তপ্ত, লোহিত হবে বৈকি। জয়নব সপ্তপর্ণ একটি শ্বাস গিলে ফেললো। ডা. আদর তখন নিরবতা ভেঙ্গে বলল,
"চল, আমি তোমাদে ছেড়ে দেই। আমিও সেই দিকেই যাচ্ছি!"
চকিতে তাকালো জয়নব।একটা অচেনা ভয় কামড় দিলো বুকে। ডা. আদর যদি তাদের সাথে যায় তার কাজ সে কিভাবে করবে? তাহলে কি যুথি বেঁচে যাবে আজ? নাহ্, তা হতে দিবে না জয়নব। সে ঠোঁট ভাজ করে বলল,
"না, না স্যার। তার প্রয়োজন নেই, আমরা চলে যেতে পারবো।"
ডা. আদর শীতল দৃষ্টিতে আবার তাকালেন জয়নবের দিকে। মেয়েটি বরাবরই তার কথা বিন্দু পরিমাণ সম্মান করে না। কেন? আদর কি এতটাই ফেলনা নাকি? এটকা চাপা ক্রোধ ছেয়ে গেলো ডা. আদরের মুখখানায়। সে অবশ্যি চোখ এড়ায়নি জয়নবের। ভয় শুকনো ঢুক গিললো শুধু। তখন শোনা গেলো যুথির কথা। সে খুশি খুশি কন্ঠে বলল,
"আপনি আমাদের নিয়ে যাবেন এটা তো আমাদের সৌভাগ্য স্যার। যাবো আমরা যাবো!"
বলেই জয়নবের হাত ধরে টেনে ফিসফিস করে বলল,
"মানা করছো কেন মেয়ে? ডা. আদরের জন্য কত মেয়ে মরি মরি করে জানো? আর সে যখন আমাদের ছেঁড়ে দিবে বলেছে, তাহলে সমস্যা কথায়? চলো। বরং জলদি পৌঁছে যাবো আমরা। "
জয়নব কিছু বলল না৷ যাস্ট মনে মনে প্ল্যানটা গুছিয়ে নিলো আরেক দফা। ডা. আদর তার গাড়ির দিকে হেঁটে চলে গেলেন। পিছন পিছন গেলো তারাও। কিন্তু এখানেও আবার বিপদ। সামনের সীটে বসবে কে? তবে বেশি ভাবতে হলো না জয়নবের। যুথি তাকে অবাক করে দিয়ে ঠেলে সামনে বসিয়ে দিলো। জয়নব আকাশ থেকে পড়েছে যেন, এমন ভাব করে বলল,
"আপু তুমি বসো না...! আমি নাহ্ পিছনে বসি?"
"কেনো? এই সিটে কি কাঁটা লেগে আছে?"
ডা. আদরের কন্ঠে চাপা ক্রোধ টের পেলো জয়নব। এমনটি নয় যে সে চায় না বসতে এখানে! কিন্তু একটা অস্বস্তি কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগলো ভিতরটা। কেন এলো আদর তাদের সাথে? জয়নব যে দিকভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জয়নব গলার মাঝে শ্বাসটুকু আটকে বসে রইলো গাড়ির ভিতর। তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে বাহিরে। প্রচন্ড হাত-পা কাঁপছে তার। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সবটুকু দেখলো ডা. আদর। ঠোঁট ভাজ করে বলল,
"এমন করছো কেন? আমিকি রাক্ষস? খেয়ে ফেলবো তোমায়?"
জয়নব চমকে তাকালো। ডা. আদরের এমন ঝাঁঝালো কণ্ঠে ভিতরটা নাড়িয়ে দিচ্ছে জয়নবের। কেন? কেন সে চেয়েও স্বাভাবিক থাকতে পাড়ছে না এই লোকটির সামনে?
---------------
তারা পৌঁছে গেলো সামনের শপিংমলে। একটি বড় শপিংমল, যেখানে এসব আছে, সিনেপ্লেক্স, জিম, স্পা, জামা কাপড়ের দোকান। আবার উপরে উঠে গেছে আবাসিক কিছু পাঁচ তারকা হোটেল আর রেস্টুরেন্টে। আদর গাড়ি পার্ক করতেই, নেমে পড়লো গাড়ি থেকে চট করে জয়নব। আদর হতভম্ব। বলল,
"তোমার কি ট্রেন ছুটে যাচ্ছে নাকি?"
জয়নব থতমত খেয়ে গেলো। চাঁপা হেসে বলল,
"তেমন কিছু না ধন্যবাদ আমাদের পৌঁছে দেয়ার জন্য।আসি।"
বলেই যুথি আর জয়নব পা বাড়ালো। তখনি আদর বলল,
"জয়নব,আ.. আমার একজনকে গিফট করার আছে, কেন ইউ হেল্প মি?"
জয়নব কিছু বলবে, তার আগেই লাফাতে লাফাতে বলল যুথি,
"অবশ্যই স্যার কেন করবো না আমরা? বলেন কি নিতে চাইছেন? ঠিক করেছেন কি কিছু? বাই দ্যা ওয়ে কার জন্য নিবেন? ছেলে না মেয়ে?"
ডা. আদর গম্ভীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে চাইলো যুথির দিকে। যুথি চুপ করে গেলো। জয়নবের উদ্দেশ্যে আবার বলল,
"কেন ইউ?"
জয়নব মাথা নাড়লো। চলে এলো ভিতরে। ঘুর ঘুর করে সব দেখতে লাগলো। ডা. আদরের যেন কিছুই পছন্দ হচ্ছে না। কি করবেন? ভেবে না পেয়ে জয়নবের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। জয়নব বলল,
"স্যার শাড়ি নিতে পারেন!"
ডা. আদরের গম্ভীর মুখে এবার একটু হাসির দেখা মিললো। তারা শাড়ির স্টোরে এসে দাঁড়ালো। জয়নবের তখনি চোখ আটকে গেলো সাদা একটি
শাড়িতে। সোনালী সুতের সুন্দর কাজ করা। জয়নব একনজর দেখে নিয়ে বলল,
"ওই শাড়িটা দিতে পারেন।"
ডা. আদর হাসলো। দোকানদারকে বলল,
"প্যাক ইট!"
জয়নব হতবুদ্ধি। ডা. আদর শাড়িটি দেখেছে কি না সন্দেহ। তাহলে? শুধু কি জয়নবের পছন্দ হয়েছে বলেই? জয়নব চোরা চোখে তাকালো একবার। লোকটি তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।জয়রব লজ্জা পেলো। লজ্জা লাল দুটি টমেটো হয়ে গেলো যেন। আচ্ছা? এ হাসি রহস্য কি?
-----------------
শপিং শেষে তারা এসে বসলো একটি রেস্টুরেন্টে। আদর তখন-ও সাথে। জয়নবের কেন জানি ভালো লাগছে আজ অাদরের সাথে সময় টুকু কাটিয়ে। এর মাঝেই খাবার অর্ডার করা হলো। জয়নব যুথি বসে। তখনি যুথি বললো,
"আমি ওয়াশরুম থেকে আসচ্ছি!"
বলেই উঠে পড়লো। আর ডা. আদর তার গম্ভীর বরফ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো জয়নবের দিকে। রেস্টুরেন্টের এই জায়গায় টুকু আপাদতে ফাঁকা। ডা. আদরের ঘোর লাগা দৃষ্টিতে জয়নবে অস্বস্তি আবারো বেরে গেলো। এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। ডা. আদর হাসলো, জয়নবের অভিব্যক্তি দেখে। হালকা কেশে বলল,
"তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছো জান?"
জয়নব থমকালো। আবার জান? কেন ডাকেন এই নামে এই লোকটি? কেন? এই আদর মাথা শীতল কন্ঠে জয়নব দিশেহারা যে হয়ে যায়! তা তি জানে আদর?জয়নব মাথা নত করে নিলো। আদর পরমযত্নে বলল,
"কেনো নিজে কষ্ট পাচ্ছো? আর আমায় কষ্ট দিচ্ছো? "
জয়নব এক পলক তাকিয়ে বলল,
"আ.. মি। আ.. মি কাউকে কষ্ট দিচ্ছিনা।"
ডা. আদর হতাশ শ্বাস ছাড়লো। বললো,
"আমি সারাজীবনের জন্য দেশ ছাড়ছি। আজ রাতে আমার ফ্লাইট। "
জয়নব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ অনুভব করলো তার নিশ্বাস ভাড়ি হচ্ছে, চোখ দুটি বড্ড জ্বালা করছে, বুকের গভীরে চিন চিন এক ব্যথা যেন কাবু করে নিচ্ছে তার ভিতর টা। ডা. আদর এবার শপিং ব্যাগটি এগিয়ে দিলো। মিষ্টি হেসে বলল,
"একটি আবদার আছে তোমার কাছে!"
জয়নব বহু কষ্টে একটি শব্দ উচ্চারণ করলো,
"কি?"
"যাওয়ার আগে এই শাড়িটিতে একবার দেখতে চাই তোমাকে!"
জয়নব চুপ। চুপ চারপাশ। আদরের কথাটা যেন ঝংকার তোলার মতো বাজতে লাগলো জয়নবের কানে। জয়নব তাকিয়ে রইলো শুধু। একটা.. একটা কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো জয়নবের। ঠিক সেই মুহূর্তে তার অনুভূতি গুলো দমিয়ে দিয়ে ভেসে এলো যুথির আত্মা চিৎকার। দুজনেই চমকে গেলো। এতখন একে অপরের দিক মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো, তাউ হারিয়ে গেলো। দৌঁড়ে চললো ওয়াশরুমের দিকে। ওয়াশরুমের দরজা তখন বন্ধ। ভিতর থেকে ভেসে আসচ্ছে চিৎকার। যুথি বলছে,
"আ..মা..কে ছেড়ে দাও। যেতে দাও। নাহ্। হেল্প, সাম বডি হেল্প মি, প্লিজ। না ছুঁবে না আমাকে যেতে দাও, যেতে দাও..!"
বাহির থেকে কেউ কিছুই বুঝতে পাড়লো না যেন। কি হচ্ছে ভিতরে? যুথির কি হলো? কেন করছে এমন চিৎকার? রেস্টুরেন্টে তেমন মানুষ নেই। যারা ছিলো সবাই চলে এলো ওয়াশরুমের সামনে। আদর ক্ষণকাল সময় নষ্ট না করে, লাথি লাগালো ওয়াশরুম। দরজা খুলে গেলো। যুথি মাটিতে গুটিয়ে আছে। হাত দিয়ে আত্নরক্ষা করতে চাইছে, অথচ ভিতরে কেউ নেই। কার থেকে বাঁচতে চাইছে সে? সবার মুখের সামনে প্রশ্ন ঝুলে রইলো। ডা. আদর তার কাছে এগিয়ে গেলো। যুথিকে ধরতেই যুথি ধাক্কা দিয়ে পিছিয়ে গেলো,বার বার বলল,
" মেরে দেবে ও ও আ..মা..কে মেরে দিবে.. ওরা ওরা আমাকে মারতে চায়। ছুঁতে চায়। "
ডা. আদর সহ সকলের মুখেই চিন্তার ছাপ। একটি সুস্থ সবল মেয়ে যে কিনা ভিতরে ঢুকেই এমন অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো? এটা কি মানা যায়? কেউ কিছুই বুঝলো না যেন। এক মাত্র দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জয়নবের মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো। কাজ হয়েছে। এবার ধীরে ধীরে শেষ সময়টার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যুথি।
এদিকে যুথি কাউকে চিন্তে পাড়ছে না। ওর ভয় হচ্ছে বড্ড ভয়। দূরে দাঁড়িয়ে আছে আয়ান ওর মাথা নেই। হাতের মুঠুতে মাথা, অন্য হাতে দুটো চোখ। ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে পূঁজা, থেঁতলে দেয়া মুখ, এসিডে পোঁড়া, গলা শরীর গায়ে এক ফোঁটা কাপড় নেই যেন। তার হাতে ধোয়া ওঠা এসিডের বোতল। পাশেই রুফাইদা। তার হাতে একটি রাম দ্যা। বিকট এক হাসি হেসে এগিয়ে আসচ্ছে তার দিকে, চেঁচিয়ে বলছে,
" বিশ্বাসঘাতক। তুই ছাড় পাবি না। "
আয়ানের কাঁটা মাথার ঠোঁট দুটি বলছে,
"আমি তোর বন্ধু ছিলাম, তুই আমাকেও ছাঁড়লি না?"
পূঁজা বলল,
"তোর থেকে সুন্দর বেশি বলে নিজ হাতে এসিড নিক্ষেপ করেছিলি না। এবার তোর চেহারার কি হবে?"
যুথি হাত দিয়ে না না করলো। বলল,
" আমাকে মে... রো না। না না।"
যুথি কাকুতি মিনতি করতে লাগলো। তার মাথার সৃষ্টি করা চিত্রভ্রমে নিস্তেজ করে দিতে চাইছে যেন। যুথি আর পাড়লো না। তার বাঁচতে হবে এই ভয়ানক ঘটনাটি দুঃস্বপ্ন লাগছে। সে পালাতে চায়। যুথি উঠে দাঁড়ালো। আদর বলল,
"আর ইউ ওকে যুথি?"
যুথি পাত্তা দিলো না। এক ছুটে বেড়িয়ে গেলো সবাইকে ঠেলে। পিছন পিছন দৌঁড় লাগালো জয়নব আর আদরও। কিন্তু ততক্ষণে খুব দেঁড়ি হয়ে গেছে। যুথি দশতলা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েছে নিচে.....। এবার সব নিস্তব্ধ......।
জয়নবের শান্তি লাগলো যেন। চোখ বুঝে ভাবতে লাগলো, কিছু ঘন্টা আগের সময়টা।
দুপুরে লাঞ্চ টাইমে খাবার খেতে বসেছিলো দুজন। যুথির ভাত খাবার পর ফিরে এলো ঘরে। জয়নব একটি আচারে কৌটা বের করে বলল,
"আপু খাবে?"
যুথি হেসে বলল,
"এসব আবার কেউ না বলে নাকি? যে বলে সে মানুষই না..!"
মুখে পুরে নিলো। আঙ্গুল চেটে পুটে খেলো। জয়নব তখন গম্ভীর হয়ে বলল,
"জানো আপু? রুফাইদা আপুরও এই আচার টা খুব পছন্দের ছিলো। বাসায় যতবার যেত বলতো, আয়ান ভাইয়া, পূঁজাদির ও খুব পছন্দ। "
গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে আবার বললো জয়নব,
" দেখো? আজ আপুরা নেই অথচ তার জন্য মা ঠিকি বানায়!"
যুথি কেমন যেন থম মেরে গেলো কথাটুকু শুনে। একদম চুপ। জয়নব তার পরের চালটি এবার চেলে দিলো,
"এমন যদি হতো! যারা আপুদের আর ভাইয়কে খুন করেছে সবাইকে তাদের অতৃপ্ত আত্মা মেরে দেয়!"
যুথি ভয় পেয়ে গেলো। থতমত খেয়ে বলল,
"এই.. এই মেয়ে কি সব বলছো? হে! আচ্ছা বাদ দাও মনে আছে তো, আজ আমরা কোথায় যাবো?"
জয়নব হেসে মাথা নাড়ায়। মনে মনে বলে,
"হে জানি তো, জমের বাড়ি!"
--------------
আগের বারের মতো এবারো কোনো ক্লু পাওয়া গেলো না। সিসিটিভি ক্যামেরা দেখেও কিছু বুঝলো না। এদিকে জানতে পারলো সি আই ডি, কোনো এক ডিপ্রেশনের শিকার ছিলো সে। তা থেকেই হয়তো রেহাই পেতে যুথি এই পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু...! তবুও এই কিন্তু... একটি থেকে যায়। যা রূপক ধরতে পাচ্ছে না। এদিকে ডা. আদরের দেশ ছাড়ার প্ল্যান সাত দিন পিছিয়ে গেছিলো যুথির জন্য। কেসে তেমন দম নেই। প্রতিবারের মতো বন্ধ করে দিলো খাতা। এতে জয়নবের মুখে তাচ্ছিল্য ভরা হাসি ফুঁটে উঠে, যার অর্থ আইন নিশ্চয়ই এবারো পয়সা খেয়ে অন্ধ হয়েগেছে। নিশ্চয়ই যুথির কেইসটা আগালেই সব বের হয়ে যেতো বৈকি। কথায় বলে না? কান টানলে মাথা আসে। কিন্তু জয়নব জানে সে নিজের শাস্তি কিভাবে মাথা পেতে নিতে হয়। আর একটি খুন। ডা. সাহিরকে সে নিজ হাতে মারবে। তার রক্ত লাল করবে তার শরীর প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আহ্ কি শান্তি পাবে সে। সব শত্রু শেষ। কিন্তু আসলেই কি সব শত্রু শেষ হবে জয়নবের? নাকি ভাগ্য তার জন্য আরো কিছু লিখে রেখেছে?
---------------
আজ রাতের ফ্লাইট একেবরে ইউএস চলে যাচ্ছে আদর। মনটা ভিষণ খারাপ। একে একে হসপিটালের সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছে। জয়নবের বুকে কেমন খালি খালি একটা অনুভতি হচ্ছে। সে বসে আছে আদরের দেয়া শাড়িটি নিয়ে। লোকটির আবদার সে কি রাখতে পারবে? কিন্তু ভিতর থেকে কে যেন বার বার বলছে,
"আবদার তো রাখাই যায়। চলেই তো যাচ্ছে সে!"
অনেক ভেবে পড়ে নিলো শাড়ি। সাধারণ সাজে বেড়িয়ে এলো সে। ডা. আদর নিশ্চয়ই তার কেবিনেই আছে? একটু ভয়? একটু ভালবাসা, মিষ্টি অনুভূতি নিয়ে পা বাড়াল। ডা. আদরের কেবিনের সামনে থেমে গেলো। ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো। সে কি যাবে ভিতরে? এতে লজ্জা কেন লাগচ্ছে? মনে হচ্ছে পুরো দুনিয়া তাকে দেখছে। জয়নব ভয় ভয় দরজা খুললো। ঠিক সেই মুহূর্তে ভিতর থেকে ভেসে এলো,
"হে রুফাইদাকে ঠিকানা লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। অভিনব কখনো পাবে না তাকে!"
একটা ঠান্ডা গম্ভীর কন্ঠ ভেসে এলো। এ কন্ঠ বড্ড চেনা জয়নবের। ডা. আদরে কন্ঠ। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়তে লাগলো জয়নবের। ভালবাসার মানুষটির কাছে তার বোন? জয়নব এক ঝটকায় দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেলো। চোখ ভর্তি জল আর ভাঙা আয়নার মতো মন নিয়ে বলল,
" আমার বোনকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন স্যার?"
আদর স্থীর দৃষ্টিতে ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো জয়নবের দিকে। সাদা শাড়িটিতে কতই না সুন্দর লাগচ্ছে তার শ্যামলতাকে। জয়নব কাঁদছে ঝরঝর করে ঝরছে চোখে পানি। ডা. আদরকে কিছু বলতে না দেখে এগিয়ে এলো সে, টেবিলের বাড়ি দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
"বলবেন, আমার বোন কোথায়?"
ডা. আদর কিছুক্ষণ গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ঠোঁটের কোনে বাঁকা হেসে বলল,
" সাদা শাড়িটিতে একদম আমার বউ লাগছে তোমাকে!"
জয়নব সচকিতে তাকালো। গোল গোল করে বলল,
"আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি, আপনাকে! প্লিজ বলুন!"
ডুকরে উঠলো এবার। ফ্লোর ধুপ করে বসে পড়ে বলল,
" আমি আপনার কাছে ভিক্ষা চাইছি আমার বোনকে ফিরিয়ে দিন।প্লিজ, আমি আপনার পায়ে পড়ি!"
ডা. আদর উঠে এলো। তার আচরণ আজ ভাড়ি উদ্ভট। এক পা ভাজ করে নিচে বসে জয়নবের দিকে তার গম্ভীর, ধারালো কন্ঠে বলল,
" বোন চাই?"
জয়নব মাথা নাড়লো। ডা. আদর জয়নবের চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলল,
"মেরি মি?"
জয়নব হতবিহ্বল, হতবুদ্ধি। হা করে চেয়ে রইলো শুধু। কিছুই বুঝতে পাড়লো না যেন। ডা. আদর তখন জয়নবের এলো মেলো চুল গুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
"বোন চাই তো? তাহলে বিয়ে করতে হবে আমাকে! নয়তো রুফাইদা কেন? তার ছায়ার কাছেও তুমি কখনো পৌছুতে পারবেনা। লেট মি গিভ ইউ সাম ইনফরমেশন, রুফাইদার হাতে বেশি সময় নেই। সময় গুনছে সে পৃথিবীর বুক থেকে মুক্তি পেতে।"
জয়নব অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে রইলো। কি করবে সে? রুফাইদাকে বাঁচাতে নিজের জান দিবে? নাকি রুফাইদাকে বাঁচাবে? কি করবে সে?সব কিছু ফাঁকা লাগচ্ছে। মায়ের বলা কথা গুলো মনে পড়ছে৷ বাবার শেষ ইচ্ছেটা কি পূরণ করতে পারবে সে? তখনি আদর আবার বলল,
"সময় বেশি নেই তোমার কাছে জয়নব মাত্র ৩০ মিনিটি। এরপর আমি বাংলাদেশ ছাড়বো। তোমার বোন কই? তা আর কখনো জানতে পারবে না কখনো না। ইওর টাইম স্টার্ট নাও... টিক টক টিক টক টিক টক............"
-------
১ম খন্ড সমাপ্ত...
Writer:- সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি