> প্রিয়তম অসুখ সে উপন্যাস এর একটি অংশ | সাদাত হোসাইনের নতুন উপন্যাস | Bangla Fiction | Sadat Hossain Fiction
-->

প্রিয়তম অসুখ সে উপন্যাস এর একটি অংশ | সাদাত হোসাইনের নতুন উপন্যাস | Bangla Fiction | Sadat Hossain Fiction

অবন্তীর মন খারাপ। তার নামে চিঠি এসেছে। চিঠিতে ঝকঝকে মুক্তোর মতো হাতের অক্ষরে লেখা, ‘শোনো কাজল চোখের মেয়ে, আমার দিবস কাটে বিবশ হয়ে তোমার চোখে চেয়ে...।’

এই একটি মাত্র লাইন। আর কিছু লেখা নেই। এমন চিঠি পেয়ে যে কোনো মেয়েরই মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু অবন্তীর হয়নি। বরং মন খারাপ হয়েছে। এই মন খারাপের কারণ চিঠিটা বেনামী। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই নিয়মিত আসছে। অনেক চেষ্টা করেও সে প্রেরকের নাম আবিষ্কার করতে পারেনি। ফলে প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও এখন বিরক্ত লাগছে। মনে হচ্ছে, পরিচিত কেউ দুষ্টমি করছে। হয়তো তার ক্লাসেরই কেউ। যদি তা-ই হয়, তবে বিষয়টা খুবই খারাপ হবে।

রাতে রুমে ফিরে আরো একবার লকার থেকে চিঠিগুলো বের করল অবন্তী। সে নিশ্চিত যে এগুলো মঈন লেখেনি। কে লিখেছে তাহলে? লোকটার প্রতি একটা দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করে সে। কৌতূহলও। কী সুন্দর গোটা গোটা হাতের অক্ষরে লেখা-

‘তুমি তার কাছে যেয়ো রোদ, যে জানে আলো কতো দামি,
তুমি তার কাছে যেয়ো মন, যার কাছে শুধু দামি ‘আমি’!’

কিংবা 

‘অমন কাজল চোখে তুমি চেয়ো রোজ
ওই চোখে জীবনের হিসেব সহজ।’

সেই রাতে অবন্তী আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর যেন নিজের অজান্তেই চোখে কাজল পরার চেষ্টা করে। তার চোখ কি আসলেই অতো সুন্দর? কে সে, যে এমন করে রোজ তার চোখ দেখে কবিতা লেখে? মুগ্ধ হয়?

গত তিন সপ্তাহে সে সাতখানা চিঠি পেয়েছে। প্রতিবারই ভেবেছে এই চিঠি কুচিকুচি করে ছিঁড়ে চারতলা থেকে নিচে ফেলে দেবে। ফেলে দেয়ার সময় বাতাসে ভেসে টুকরো কাগজগুলো কী করে উড়ে উড়ে নিচে পড়ে তা দেখবে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো, একবারও তা করা হয়নি। প্রতিবারই রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে চিঠি ফেলতে গিয়েও ফেলতে পারেনি। 

কবিতার কথাগুলো কেমন যেন! প্রথম প্রথম যে তেমন ভালো লাগে, তা নয়।  কিন্তু তারপর সময় যত গড়াতে থাকে, ততই মাথায় ঘুরতে থাকে। বিঁধতে থাকে আলপিনের মতো। একটা প্রবল অস্বস্তির অনুভূতি দিতে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয়, কোনো একটা শব্দ হয়তো ভুলে গেছে। সেই শব্দ মনে করার জন্য মাঝরাতে লুকিয়ে একা সে তার গোপন ট্রাঙ্ক খুলে চিঠিগুলো বের করে। তারপর ভুলে যাওয়া শব্দের লাইনটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে। এই একটা শব্দ পড়তে গিয়ে আবারও তার সবগুলো চিঠি পড়া হয়ে যায়। আর তারপর রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে সে বিড়বিড় করে বলে, ‘কী আশ্চর্য! আমার না কাল পরীক্ষা? এগুলো আমি কী করছি?’

এই অবধি ঘটনা সরলই ছিল। খানিক বিরক্তিকর রহস্য, অস্বস্তিকর ভালো লাগা, আর একটু দ্বিধান্বিত রোমান্টিসিজম। কিন্তু ঘটনা গুরুতর আকার ধারণ করল পরের সপ্তাহে। 

এখন সাধারণত ছুটির দিনটাতে হৃদিদের বাড়িতে যায় অবন্তী। ওই বাড়িটা তার ভীষণ পছন্দের। ঢাকা শহরে যে এখনো এমন বাড়ি আছে এটা বিশ্বাস করা কঠিন। বাড়ির সামনে অতোটা খোলা জায়গা। সেখানে পাতাবাহার, দোলনচাঁপা, বাগানবিলাসের ঝোঁপ। ছাদে চেয়ার পেতে বসলে হাত বাড়িয়ে বিশাল আম গাছের ডাল-পাতা ছুঁয়ে দেয়া যায়। আমের মৌসুমে টুপটাপ আমও পেড়ে ফেলা যায়। চারপাশ জুড়ে অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য। একটা শান্তি শান্তি ভাব। মন খারাপ হলে এই বাড়ির উঠোনে হাঁটলে মন ভালো হয়ে যায়। শ্যাওলা ধরা সবুজাভ উঠানে বর্ষার সময় খুব সাবধানে পা ফেলে ফুল কুড়াতে হয়।

অবন্তী মফস্বলে বড় হলেও কখনো চালতা ফুল দেখেনি। অথচ ঢাকা শহরের এই বাড়িতে একটা বড় চালতা গাছও আছে। সেই গাছের ফুল যে এতো সুন্দর হতে পারে, তা তার জানা ছিল না। সে উঠোনে ছড়িয়ে থাকা চালতা ফুল কুড়ায়। কখনো সখনো কানের কাছে চুলের ভেতর গুঁজে দেয়। তখন তার নিজেকে পুস্পকুমারী মনে হয়। আচ্ছা, এই পুস্পকুমারী শব্দটা সে কোথায় শুনেছে? অবন্তী ঠিক মনে করতে পারে না। কোনো বইয়ে পড়েছে হয়তো। কিন্তু পুস্পকুমারী দেখতে কেমন? কে সে? অবন্তী তাও জানে না। তবে কল্পনায় একটা ছবি এঁকে নেয়। নিজেকে তখন তার সেই কল্পিত পুস্পকুমারী মনে হয়। 

এখন এ বাড়িতে সবচেয়ে বড় সুবিধা যেটি, সেটি হলো হৃদির ঘরটা ফাঁকা। ফলে অবন্তী এখানে এলে তার ঘরেই থাকে। রুমটা বড়। এটাচড বাথ। আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, এসি সবই আছে। তবে তার আগ্রহ ড্রেসিং টেবিলের ওপর থাকা বড় ঝকঝকে আয়নাটায়। সে ইচ্ছে হলেই ওই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে কাজল দিতে পারে। চোখ জ্বালা করলে কিংবা চোখে পানি চলে এলে আরাম করে মুছে ফেলতে পারে। কেউ দেখে ফেলবে বলে তটস্থ হয়ে থাকতে হয় না। 

রিয়ার মতো কেউ পেছন থেকে হঠাৎ ফিক করে হেসে দিয়ে বলে না, ‘কী রে নিশিকন্যা, রাতের অভিসারে যাচ্ছিস নাকি? তা রেট কতো তোর?’

কী বিচ্ছিরি কথা! এমন জঘন্য কথা কেউ কাউকে বলতে পারে? কিন্তু রিয়া পারে। সে এমনই। তার মুখে কিছু  আটকায় না।  আজ অবশ্য সেসবের বালাই নেই। এই ঘরের একচ্ছত্র অধিপতি আজ সে নিজে। কোনো দ্বিধা, ভয়, সঙ্কোচ ছাড়াই এখন গুনগুন করে গান গাইতে পারবে। 

আর কাজল আঁকতে পারবে চোখে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই কাজটা সে কেন করছে? এমনতো নয় যে সে পনেরো ষোল বছরের কিশোরী কোনো মেয়ে! ওই সামান্য কয়েকটি লাইন পড়েই তার মন এমন উচাটন হওয়ারও কথা নয়। তারপরও এই অতি বিরক্তিকর, হাস্যকর কাজটা সে করছে। 

আজ দুপুর থেকে বেশ কয়েকবার ওই চিঠি খুলে পড়েছে অবন্তী। সে জানে না কেন, লাইনগুলো সারাক্ষণ তার মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকে। অজস্র বিরক্তি, রহস্য, দ্বিধার প্রাচীর পেরিয়েও কীভাবে কীভাবে যেন একটা অবচেতন ভালো লাগা আলগোছে ছুঁয়ে যেতে থাকে তাকে। এই অনুভবটাকে কিছুতেই এড়াতে পারে না সে। বরং তার ভাবতে ভালো লাগে যে কেউ একজন তাকে আড়াল থেকে দেখে। ভালোবাসে। আর কে না জানে, প্রকাশ্যের চেয়ে গোপন প্রেমই বেশি সম্মোহনী। 

কিন্তু মানুষটা কে? পরিচিত কেউ নয় তো?

জানালার কাচে শব্দটা হলো ঠিক তখুনি। আনমনা অবন্তী শব্দটা প্রথমে শুনতে পায়নি। তবে দ্বিতীয়বার শুনল। কিন্তু যতক্ষণে শুনেছে, ততক্ষণে তার বাঁ দিকের জানালাটা খুলে গেছে। একটা বিদঘুটে মুখ কিংবা মুখোশ ঝুঁকে আছে জানালায়। সম্ভবত দেয়ালের গা ঘেঁসে দাঁড়ানো গাছ বেয়ে উঠেছে সে। তার এক হাত জানালার গ্রীলে। কিন্তু অন্য হাতে ওটা কী?

বিষয়টা বুঝতে একটু সময় লাগল অবন্তীর। লোকটার অন্য হাতে কুচকুচে কালো একটা পিস্তল। লোকটা কি তাকে গুলি করবে? কিন্তু কেন? চুরি করতে এলেতো গুলি করার কথা নয়। বড়জোর ভয় দেখানোর কথা। তা সে ভয় পেয়েছেও। 

ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেছে সে। তীব্র আতঙ্কে তার গলা থেকে কোনো চিৎকারও বের হলো না। তবে লোকটা তাকে ভুল প্রমাণ করে প্রথম গুলিটা করল তার বুক বরাবার। অবন্তী লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। দ্বিতীয় গুলিটা ছিটকে এসে পড়ল তার ঠিক পাশে। অবন্তীর অবশ্য ততক্ষণে আর কিছু মনে নেই। 

সে নিথর হয়ে পড়ে রইল মেঝেতে। 









Writer:- Sadat Hossain
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner