> ডাহুক নদীর তীরে পর্ব ৪, ৫, ৬ | Bangla New Fiction | বাংলা উপন্যাস | নতুন বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাস
-->

ডাহুক নদীর তীরে পর্ব ৪, ৫, ৬ | Bangla New Fiction | বাংলা উপন্যাস | নতুন বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাস

মাহাদী ঘরে বসে আপনমনে পড়ছিল।ছেলেটার বয়স মাত্র এগারো বছর।অথচ,হাতে-পায়ে এই বয়সেই তথাকে ছাড়িয়ে গেছে সে। সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি একদম অপছন্দ মাহাদীর।দু-তিন লাইনের একটা উদ্দীপক দেয়। তারপর বইয়ের সাথে মিলিয়ে সেখান থেকে চারটে প্রশ্ন বের করে।মাত্র দশটা নাম্বারের জন্য রাজ্যের লেখা লেখতে হয়।আর শিক্ষকদের কথা তো না বললেই নয়।এতো এতো লেখার পরেও প্রতি সৃজনশীলে মাত্র ছয় নম্বর করে দেবে।এসব একদম বিরক্ত লাগে মাহাদীর। একটু বেশি নম্বর দিলে কি হয়? শিক্ষরা কি নম্বর দিয়ে বাড়ি বানাবে?

তথা এসে দাঁড়ালো মাহাদীর পাশে।তার মাথায়  ওড়না টেনে দেওয়া,মুখে মাস্ক,হাতে ব্যাগ।তথার এমন রূপ দেখে জোরে জোরে পড়া শুরু করলো মাহাদী।তথার বেশ-ভূষা বলছে,সে এখন বাইরে যাবে।আর বাইরে যাওয়ার সময় সে মাহাদীকেও বগলদাবা করে নিয়ে যায়।কিন্তু এখন মাহাদীর বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না।তার অনেক পড়া।কালকে পড়া না পারলে স্যার মারবে।

---" ভাই,পড়ছিস?"

---" হুম।"

---" অনেক পড়া?"

---" হুম। "

---" যাবি এক জায়গায়?মাত্র আধ- ঘন্টা লাগবে।"

---" উঁহু। আমার অনেক পড়া।"

---" আধ-ঘন্টারই তো ব্যাপার। চল না।"

---" উঁহু, তুমি অন্য কাউকে নিয়ে যাও।"

খাটের উপরেই বসে আছে রুবাইদা।সে বসে বসে ত্রিকোণমিতির সূত্রগুলো মুখস্থ করছে। এই সূত্রগুলো তার দু-চোখের বিষ।কিছুতেই মুখস্থ হয় না।এতো কঠিন সূত্র আবিষ্কার করার কোনো দরকার ছিল?এগুলো কি কাজে লাগে?পড়ায় মনোযোগী নেই রুবাইদার।মায়ের ভয়ে দম খিচে পড়ছিলো।তথার বাইরে যাওয়ার কথা শুনে সে লাফিয়ে উঠে।বই-খাতা ছুড়ে ফেলে দেয় পাশে।

---" তথাপু,আমি আসি?"

---" তোর না পরীক্ষা?"

---" কিছু হবে না।"

---" কোনো প্রয়োজন নেই।তুই পড়।চল না মাহাদী।তোকে কিছু খাওয়াব।"

খাবারের কথা শুনে নড়েচড়ে বসে মাহাদী।ছেলেটা ভীষণ ভোজনরসিক। খাবারের লোভ সামলে পড়ায় মনোযোগ দেওয়া পুরোপুরি অসম্ভব মাহাদীর পক্ষে।সে বই বন্ধ করে ট্রাউজারের পকেটে হাত গুজে দেয়।

---" কি খাওয়াবা?"

---" ডালপুরি।বাজারের সবেচেয়ে ভাল ডালপুরি তোকে খাওয়াব আজ। "

---" উঁহু, চলবে না।"

---" তাহলে কি খাবি তুই?"--- তথার নাক-মুখ কুঁচকে যায়।নেহাৎ প্রয়োজন বলে।নয়তো এই মুহূর্তে মাহাদীকে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারতো।

---"বিসমিল্লাহ হোটেলের  দু-প্লেট বিরিয়ানি খাওয়াতে হবে।"

---" এই সন্ধ্যাবেলা কে বিরিয়ানি খায়?"

---" আমি খাই।চলবে?"

তথা বড় এক দম নেয়।মাথা নেড়ে বলে---" হুম চলবে।চল।"

রুবাইদা এতোক্ষণ বসে বসে ওদের কান্ড দেখছিলো।ঘোড়ার পরীক্ষার জন্য আজ ঘরে বসে থাকতে হবে।নাহয় তথার সাথে যেতে পারতো।তথা দরজার দিকে পা বাড়াতেই পিছু ডাকে রুবাইদা।

---" আপু,কই যাবা ?"

---" একটু বাজারের দিকে যাব।কাঁচা হলুদ, মধু আর অ্যালোভেরা জেল লাগবে।ওগুলো আনতে হবে।"

---" চেহারার জন্য?"

---" হুম।"

তথা সামনে পা বাড়ায়।আবারো পিছু ডাকে রুবাইদা।রুবাইদার কান্ডে খুব বিরক্ত হয় মাহাদী।চোখ-মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করেঃ" কি সমস্যা রুবি আপু?"

---" তোকে ডেকেছি? তথাপু, বাজার থেকে ঝালমুড়ি আনবে কিন্তু।আর ডালপুরি সামনে পেলে  ডালপুরি আনবে।"

---" আমি কি বাংলাদেশ ব্যাংক? "

---" তোমার কাছে টাকা আছে তা আমি জানি।মনে করে আনবে কিন্তু।"

---" আচ্ছা, আনব।দরজা আটকে দে।কাকিমা বাড়িওয়ালা আন্টিদের ঘরে গেছে।কেউ নক করলে, নাম জিজ্ঞেস করে  তারপর দরজা খুলবি।মনে থাকে যেন।"

তথা - মাহাদী বাইরে বেড়িয়ে আসে।তথার কাছে ভাই-বোনের  আবদার করার বিষয়টা নতুন না।তথা যখন স্কুলে পড়তো, তখন বাড়ি ফিরার পথে পাঁচ টাকার বাদাম হলেও কিনে নিয়ে আসতো।তখন তো আর মাহাদী খেতে পারতো না।শুধু রুবাইদার জন্যই নিয়ে আসতো সে।আবার যখন টিউশনি শুরু করলো, তখন ভাই- বোনের আবদার আরো বেড়ে গেল।তথাপু এটা খাব,তথাপু ওটা খাব---এরকম হাজারটা আবদার।তথাও হাসিমুখে পূরণ করে এসব।কয়টা বোনের কপালে এমন মিষ্টি আবদার জুটে?তথা সত্যি ভাগ্যবতী। সৃষ্টিকর্তা কখনো কারো সাথে অন্যায় করেন না।তিনি জন্মের পর তথার বাবা-মাকে নিয়ে গেছেন ঠিকই,তবে বিনিময়ে একটা সাজানো- গোছানো পরিবার দিয়েছেন।

***

---" ওই মামা ওই,রাস্তায় আর জায়গা নাই? গায়ের উপরে রিকশা উঠায় দিবেন নাকি?"

রিকশাওয়ালার উদ্দেশ্যে চেচিয়ে কথাগুলো বলল বলে মাহাদী। তারপর বোনের কাঁধে হাত দিয়ে নিজের দিকে টেনে নেয়।তথার চাইতে সে কয়েক ইঞ্চি বেশি লম্বা।তথা বড়করে দম নেয়।শর্টকার্টে বাজারে যাওয়ার জন্য  এই রাস্তাটা ব্যবহার করা হয় রাস্তাটা বেশ চওড়া। তবুও একটা রিকশা তার গা ঘেষে চলে গেছে।কাজটা যে ইচ্ছাকৃত তা দেখলেই বুঝা যায়। এই রাস্তা সবসময় নিরিবিলি থাকে।তথার পাশের ল্যাম্পপোস্টটা নষ্ট। তাই এদিকটায় একটু অন্ধকার। তথা আর মাহাদী দাঁড়িয়ে আছে।একটু আগে দ্রুত সরে যাওয়ার সময় তথার বাম পায়ের গোড়ালিতে একটু চোট লেগেছে। গোড়ালিটা ব্যাথা করছে এখন।মাহাদী তথার ফোনের আলোর সাহায্যে বোনের পা দেখে।

---" আপু বেশি ব্যাথা পেয়েছো নাকি?"

---" না।একটা রিকশা ডাকতো ভাই।হাঁটতে পারব না।"

মাহাদী এদিক- ওদিক তাকায়।নিরিবিলি হওয়াতে এদিকে রিকশা পাওয়া দুষ্কর। খানিকবাদে একটা বাইক এসে থামে তাদের পাশে।বাইকটা তথা না চিনলেও মাহাদী চিনতে পেরেছে। মাহাদীর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে।যাক, বাঁচা গেল অবশেষে। 

---" কি সমস্যা ছোট ভাই,এইখানে দাঁড়ায় আছো যে?" --- হেলমেট খুলে কপালের একপাশে পড়ে থাকা চুলগুলো ঠেলে পিছনে সরিয়ে দেয় ইরফান। 

---"আর বইলেন না ভাই। বাজারে যাব ।এক বদমায়েশ রিকশাওয়ালা আপুর গা ঘেষে রিকশা চালাইছে। সাইডে সরার সময় আপু পায়ে ব্যাথা পাইছে।তাই, রিকশার জন্য দাঁড়ায় আছি।"

---" রিকশাওয়ালা আমাদের এলাকার নাকি? তুমি চিনো?"--- বাইক থেমে নেমে দাঁড়ায় ইরফান।তার কন্ঠে খানিক রাগের আভাস।

---" না, ভাইয়া। কখনো দেখি নাই এদিকে।নতুন মনে হয় "

এতোক্ষনে ইরফানকে চিনতে পারে তথা।ইরফান খুব পরিচিত নয় আবার একদম অপরিচিতও নয়।বিরক্তির সাথে সাথে অস্বস্তিতেও গুটিয়ে আসে শরীর।এই তবে ইরফান?এই মানুষটার  জন্যই এলাকার ছোট ছোট ছেলেদের মুখে ভাবি ডাক শুনতে শুনতে কান পঁচে যায়।তথা অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।বাড়াবাড়ি খুব অপছন্দ তার।

---" ও বেশি ব্যাথা পেয়েছে?"

---" পা বোধহয় একটু মচকে গেছে।"

---" তুমি দাঁড়াও এদিকে।আমি রিকশা ডেকে দেই।"

দু- পা সামনে এগোয় ইরফান।তথার সামনে গেলে তার নিজেরও অস্বস্তি হয়।অকারণেই দুই হাঁটু কেঁপে উঠে।জ্বিভ জড়িয়ে আসে।কতবার সাহস করে তথার সাথে কথা বলার পরিকল্পনা করেছে।কিন্তু, কখনোই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হয়নি।মেয়েটা  কিভাবে যেন তাকায়।চোখগুলো ছোট ছোট করে, কপালের চামড়াগুলো দুই ভ্রুর মাঝে জড়ো করে, বিরক্তিভাব নিয়ে ছেলেদের দিকে তাকায়।এই চাহনী সহ্য হয় না ইরফানের।তাই কখনো মুখোমুখি দাঁড়ায়নি ইরফান।কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও ধমক দিয়ে মনকে শাসন করেছে।মনে ইচ্ছে জাগবেই। তাই বলে সব পূরণ করতে হবে নাকি?সময় হোক।বিশেষ ইচ্ছেগুলো তোলা থাক।আজ নাহয় কাল তা পূরণ হবেই।সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

তথার সামনে একটা অটো এসে থামলো।ইরফান রিকশা পায়নি।পথে একটা অটো পেয়েছে,তাই ধরে এনেছে।অটোতে পাঁচজন যাত্রী আছে।আর একটা সিট খালি। ইরফান মাহাদীকে বলেঃ" তোমার বোনকে তুলে দাও।আর তুমি আমার সাথে চলে এসো।"

কথা বাড়ায় না মাহাদী।সযত্নে বোনকে তুলে দেয়।আরেকবার তথার পায়ের দিকে তাকায়।

---" ফার্মেসীতে যাওয়া লাগবে নাকি আপু?"

---" আরে নাহ পাগল।একটু তেল মালিশ করলেই হয়ে যাবে।তুই বিসমিল্লাহ হোটেলে যেয়ে খেতে বস।আমি কেনাকাটা করে আসছি।"

---" তোমার সাথে যাওয়া লাগবে না?"

---" না।তুই আমার সাথে গেলে আরো দেরি হবে। তুই চলে যাবি কিন্তু।আমি দশ মিনিটের মাঝেই আসছি।"

--- " আচ্ছা।"

অটো ছেড়ে দিলে পিছন থেকে ইরফানের সাবধানী গলা ভেসে আসে।

---" মামা,সাবধানে নিয়েন।"

তথা বসে থেকে মুখ বাকায়।বেশি বেশি ঢং একেবারে।অসহ্য!

---" এই সন্ধ্যাবেলায়  বাজারে কি মাহাদী?"

---" আপুর কি কি যেন লাগবে।আপু নাটকে চান্স পেয়ছে তো।তাই স্কিনের যত্ন নিচ্ছে খুব।"

---" তাই নাকি?"--- খুব অবাক হয় ইরফান।খবরটা তার কান অবধি এখনো আসেনি।
ইরফানের বিস্ময়ে দ্বিগুণ উৎসাহ পায় মাহাদী।মাথা ঝাঁকিয়ে বলেঃ" হ্যাঁ। আপু সব টিউশনি ছেড়ে দিয়েছে। এই মাসের শেষেই পঞ্চগড় যাবে শুটিংয়ের জন্য। সেখানে নাকি একটা পুরোনো জমিদার বাড়ি আছে।সেখানে শুটিং হবে।নাটকের নাম ডাহুক নদীর তীরে।"

---" এতো দূর যাবে? তোমার বাবা- মা কিছু বলবে না?"

---" মা তো আপুর উপর খুব রাগ করেছে।কথাই বলে না।বাবা কিছু বলেনি।বাবা আরো খুশি।"

---" কতদিনের জন্য যাবে তথা?"

---" আপাতত একমাস।এরপর কাজ শেষ না হলে আরো সময় লাগবে।"

---" আচ্ছা, বাইকে উঠো।"

ইতফানের ভিতরটা তেতো হয়ে গেছে মুহূর্তেই।পঞ্চগড় যাবে?অনেক দূর হয়ে যায় না? তাছাড়া একমাস! সময়টা তো কম নয়।আরেকটা ভাবনা মনে দাগ কাটে ইরফানের।তাদের রক্ষণশীল পরিবার।বেশিরভাগ বাঙালি পরিবারে নাটক-সিনেমার জগৎ নিয়ে নেতিবাচক ধারণা প্রচলিত।ইরফানের পরিবারও তার ব্যতিক্রম নয়।যদি তথার এই পেশাটাই বিয়েতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়? যদি বাবা- মা তথাকে অপছন্দ করে? তখন কি হবে?ইরফানের ভয় হয় খুব।পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠে।হোক না একতরফা ভালোবাসা। ইরফানের অনুভূতি তো মিথ্যা নয়।বরং তথাকে ঘিরে তার অনুভূতিগুলো বড্ড ভয়ংকর।ভবিষ্যৎ ভেবেই মাথা চক্কর দেয় ইরফানের।একতরফা অনুভূতিগুলো অভিশাপ হয়।এর উল্টোপিঠে কেবল ভয় আর দুশ্চিন্তার বসবাস।

***

জমিদার বাড়ির দো-তলায় হালকা আলোর  একটা লাইট জ্বলছে।অন্ধকার দূর করছে না এই আলোটুকু। বরং অন্ধকারকেই আরো তীব্রভাবে প্রকাশ করছে যেন।দোতলার সবচেয়ে কোনার দিকের রুমটা বেশ বড়।এটা ইউসুফের ঘর।এই বাড়িতে এলে সে এই ঘরেই থাকে।ঘরটা বাড়ির পিছন দিকে।তাই রাস্তা থেকে খুব একটা চোখে পড়ে না।ইউসুফ গ্রামে এসেছে সন্ধ্যা নামার একটু পরে।সামান্য খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নিচ্ছে সে।খাটের উপর আধশোয়া হয়ে আছে ইউসুফ।তার বামপাশেই দাঁড়িয়ে আছে মামুন।ইউসুফ একবার চোখ মেলে তাকায় মামুনের দিকে।

---" মামুন দুপুরে যে প্রোডাক্টগুলো সাপ্লাই দেওয়ার কথা ছিল,তা দিয়েছো?"

---" জ্বি,স্যার।"

---" ঘরগুলো সব পরিষ্কার করা হয়েছে?"

---" জ্বি, স্যার।"

---" আমার পাশের ঘরটা তোমার ম্যাডামের হবে।ঘরটা সুন্দরভাবে সাজাবে।"
 
মামুন সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।

---" তুমি এখন যাও, মামুন।আমি আরেকটু ঘুমাব।"

মামুন যায় না।মাথা নিচু করে বলেঃ" একটা কথা বলব স্যার?"

---" বলো।"

---" " আপনি বোধহয় বিদেশে চলে গেলে পারতেন।আপনি যে দেশে আছেন,সেই খবর পুলিশ জানে।"

---" চলেই যেতাম বুঝলে। তবে,একটা কামিনী ফুলে আটকে গেলাম।দেশ ছাড়তে হলে ফুলটাকে নিয়েই দেশ ছাড়ব।"

---" স্যার,আবোধা ডিরেক্টরটার সাথে কাজ না করলেই ভালো হতো।ব্যাটা পাক্কা হারামী।দুই বছর আগে কি কাহিনীটাই না করলো! এইবারও যদি এরকম করে?ম্যাডামকে ওর ভরসায় রেখে আসা কি ঠিক হলো স্যার?যদি খারাপ কিছু হয়!"

---" ডিরেক্টর তোমার স্যারকে খুব ভালো করে চিনে।দু-বছর আগের ঘটনার যদি পুনরাবৃত্তি হয় তবে ওর চৌদ্দপুরুষের নাম ভুলিয়ে দেব।আর বাই এনি চান্স তথার যদি কিছু হয়,তবে গুনে গুনে ছয়টা গুলি ওর মুখে ভরে দেব।এরপর যা থাকে কপালে।"

ইউসুফ চোখ বন্ধ করে।চোখের উপর ভেসে উঠে একটা মেয়ের প্রতিচ্ছবি।না,না মেয়ে নয়।ইউসুফের চোখে সে সাক্ষাৎ একটা কামিনী ফুল। বৃষ্টিভেজা শুভ্র কামিনী ফুল।।




একগাদা জিনিসপত্র নিয়ে খুব ঝামেলায় পড়ে গেল তথা।কাঁচা হলুদ,অ্যালোভেরা জেল,ব্যাগ, মধু,ডালপুরি,ঝালমুড়ি ---জিনিসপত্র কম নয়।তার উপর পা' টা ব্যাথা।গোড়ালিতে ভালোই ব্যথা পেয়েছে তথা, কিন্তু মাহাদীকে বলেনি।ছোট মানুষ অকারণেই ব্যস্ত হয়ে পড়বে।তথা পা টেনে টেনে আস্তে আস্তে হাঁটছে।কেনাকাটা করতে মাত্র বিশ মিনিট সময় লেগেছে।মাহাদী এখনো ভোজনে ব্যস্ত।ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা গেল না।বিসমিল্লাহ হোটেল খুব বেশি দূরে নয়।এই গলিটা পেরোলেই স্বনামধন্য হোটেলটা চোখে পড়ে।এই হোটেলের বিরিয়ানির ভক্ত অনেকেই।হোটেলের সামনে যাওয়া যায় না। খাবারের গন্ধে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে।

---" তথা,তথা..."

পিছনে কারো কন্ঠের আভাস পেয়ে থমকে দাঁড়ায় তথা।গলার স্বর অপরিচিত নয়।একটু আগেই এই কন্ঠের মানুষটাকে দেখেছে সে।এখন আবার কি?একটু আগেই না প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল?
বেশ খানিকটা অবাক হয়েই পিছু ফিরে তথা।ইরফানকে চোখে পড়ে।তার চাইতে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে সে।ইরফানের দিকে দু-পা এগিয়ে যায় তথা।ইতস্তত গলায় প্রশ্ন করেঃ " আপনি কি আমায় ডেকেছেন, ভাইয়া?"

ভাইয়া ডাক শুনে মুহূর্তেই মেজাজ খারাপ হয় ইরফানের।মাথার তালু পর্যন্ত রাগে ঝিমঝিম করে উঠে।কোন কালের ভাইয়া সে?ছেলেটা আবার অল্প সময়ের মধ্যেই রাগ গিলে ফেলতে পারে।রাগটুকু হজম করে নেয় ইরফান।অনেক সাহস করে কথা বলতে এসেছে আজ।হাঁটু মৃদুভাবে কাঁপছে।গলা শুকিয়ে আসছে।নিজের মনেই নিজেকে ধিক্কার জানায় ইরফান?এতো ভয় পাওয়ার কি আছে?তথা বাঘ নাকি ভাল্লুক?ইরফানকে খেয়ে ফেলবে নাকি? খেয়ে ফেললে খেয়ে ফেলুক।প্রেয়সীর হাতে মৃত্যুবরণ করাও ভাগ্যের বিষয়।

---" আপনি কিছু বলবেন, ভাইয়া?"

ঘন ঘন উপর-নিচে মাথা দোলায় ইরফান।

---" কি বলবেন?"

---" তুমি ভালো আছো?"

---" জ্বি"--- তথা অবাক না হয়ে পারে না।মাঝ রাস্তায় ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করার জন্য দাঁড় করিয়েছে!

---" তুমি নাকি পঞ্চগড় যাবে?"

---" জ্বি।এই মাসের শেষেই যাব।"

---" বিষয়টা কি ঠিক হচ্ছে,তথা?না মানে এই পেশাটাকে তো সবাই ভালো চোখে দেখে না,তাই বলছিলাম আরকি। "

---" সবাই কি চোখে দেখে সেটা দেখে তো আমার লাভ নেই, ভাইয়া।আমার চোখে এটা অনেককিছু।আমি নিশ্চয়ই আমার পছন্দ অপছন্দ রেখে আরেক জনের রুচির দিকে নজর দেব না"

---" হ্যাঁ, তোমার কথাও ঠিক।তবে, এতোদূর যাওয়া কি ঠিক? যাদের সাথে যাচ্ছ তারা কি বিশ্বাসযোগ্য? "

---" শতদল মাল্টিমিডিয়া, নামটা শুনেছেন? খুব পরিচিত না,তবে দু- একটা নাটক বেরিয়েছে।ডিরেক্টরকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ দেখিনি।শুধু আমি না, বিশাল একটা টিম যাচ্ছে পঞ্চগড়ে।"

---" কি জানি,নাম শুনিনি।সব বাদ দেও।তোমার অকাট্য যুক্তি-তর্ক সব।একটা কথা বলব,তথা?"--- 
ইরফানের গলায় খুব অনুনয়ের সুর।

---" কি বলবেন,ইরফান ভাই?"

---" এতোদূরে যেয়ো না, প্লিজ।পঞ্চগড় এখানের রাস্তা না।ঢাকা থেকে অনেক দূর।তাছাড়া, একটা মাস কম সময় না।প্লিজ,না যাও।এখানেই কাজের অফার আসলে করো।"

---" আপনি এগুলো কার কাছে শুনেছেন?মাহাদীর কাছে?"

---" হুম।"

---" আমি এতোদূরে গেলে আপনার কি?আমি কি আপনার কাছের কেউ?"

---" ভালোবাসি,তথা।অনেক বছর আগ থেকে অনেকটা ভালোবাসি।"

তথার মুখে কোনো বিস্ময় বা অস্বাভাবিক অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় না।সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।যেন এই উত্তরের অপেক্ষাতেই  ছিল।ইরফানের কথা তো সে আগেই জানতো।এসব প্রণয় বাক্যে আজকাল উত্তেজিত হয় না তথা।এগুলো তার জন্য ডাল-ভাত।সৃষ্টিকর্তা অসামান্য রূপ দিয়েছেন।মানুষ তো মুগ্ধ হবেই।

---" কিছু বলবে না,তথা?"

---" ইরফান ভাই, আমি সেই ক্লাস ফাইভ থেকে প্রপোজাল পাই।কাজিন,প্রতিবেশী ,ক্লাসমেট,শিক্ষক---কেউ বাদ যায়নি।এতো জনের চোখে পড়ার কারণ কি বলতে পারেন? কারণ হলো এই সৌন্দর্য । আমার সৌন্দর্য না থাকলে এতো মানুষ মুগ্ধ হতো কি না সন্দেহ।এখন এতো মানুষের মাঝে আমি কাকে বিশ্বাস করব বলুন তো?আপনি যেভাবে অনুভূতির কথা বললেন,এভাবে এর আগেও আমাকে অনেকেই বলেছে।আমি এখন আর এসবে উত্তেজিত হই না।ভালোও লাগে না এসব।কত আর শুনতে ইচ্ছে করে বলুন?আপনার অনুভূতিও আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি।সবার মতো আপনিও রূপ দেখেই মুগ্ধ।তাই আপনার কথার বিপরীতে ইতিবাচক উত্তর নেই আমার কাছে।"

ইরফান হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকে।তার চোখ দুটোতে দেখা যায় তীব্র অবসাদ।মেয়েটা ভীষণ কাঠখোট্টা। মুখের উপর কি সুন্দর প্রত্যাখ্যান করে দিল! সে শুধু সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েছে ---কথাটা ইরফানের  নিজের কাছেই খুব বিশ্রি শোনায়। তবে,এটা ঠিক তথার সৌন্দর্যের কারণেই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল ইরফান।তারপর আস্তে আস্তে মেয়েটার সম্পর্কে খবর নিলো,মেয়েটার আচরণ দেখলো,চরিত্র দেখলো,তারপর প্রেমে পড়লো।অনেকগুলো পর্যায়।অথচ,তথা মুখের উপর বলে দিল সবাই তার সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে।সে কি জানে, ইরফানের ক্ষেত্রে কথাটা প্রযোজ্য নয়?দেশে তো আরো সুন্দরী মেয়ে আছে।এমনকি ইরফানের ক্লাসমেট আছে কতগুলো।একটার চেয়ে একটা সুন্দরী।কই কেউ তো কখনো নজর কাড়তে পারেনি।একটা কিশোরী ফুলে আটকে গিয়েছিল ইরফান।মুগ্ধ হয়েছিল,হাঁটু ভেঙে প্রেমে পড়েছিল।ফুলটা এখন পরিনত।অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, তবুও মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি ইরফান।তথাতেই পড়ে আছে। ইরফান শুধু তথার সৌন্দর্য নয়,গোটা তথাকেই ভালোবাসে।তথা কেবল সাময়িক উত্তেজনা বা মোহ নয়,তথা একগুচ্ছ শীতল অনুভূতির নাম।ইরফানের কল্পরাজ্যের সবটুকু তথার নামেই লেখা।সেখানে একচ্ছত্র আধিপত্য কেবল এই হৃদয়হীনা মানবীর।

---" আপনি আর কিছু বলবেন, ভাইয়া?"

---" তুমি ইচ্ছে করে কথায় কথায় ভাইয়া ডাকছো, তাই না?"

---" জ্বি।বর্তমান ছেলেদের দুর্বল দিক হলো এই ভাইয়া ডাক।এই অস্ত্রে তাদেরকে সহজেই কাবু করা যায়।ভাইয়া ডাক শুনলে মেয়েদের প্রতি তাদের বোন বোন অনুভূতি আসে।"

---" কয়টা ছেলেকে বিশ্লেষণ করেছো? প্রথমে তোমার মুখে ভাইয়া ডাক শুনে আমারো রাগ হয়েছিল।কিন্তু এখন আর হচ্ছে না।ধার করা ভাই থেকে জামাই হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, বুঝেছ?তাই তুমি যতই ভাইয়া ডাকো না কেন,আমার দৃষ্টিভঙ্গি এই জীবনে আর বদলাবে না।"

নাক-মুখ কুঁচকে ফেলে তথা।এই ছেলে তো ভালোই ত্যাদড়।কি থেকে কি বানিয়ে ফেললো! তথা হোটেলের পথে পা বাড়ায়।দু-পা এগিয়ে যেয়েও কিছু একটা ভেবে আবারো পিছু ফিরে তথা।ইরফান একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।হাতদুটো বুকের উপর ভাঁজ করা।তথা বেশ খানিকটা দূরেই দাঁড়ায়।বেশ শক্ত গলায় বলেঃ" শুনুন,আপনার বাড়াবাড়িগুলো আমার সহ্য হয় না।আমি রাস্তায় বেরোলেই আপনার ছেলেপেলে আমাকে ভাবি বলে ডাকে।বাড়ির নিচের দোকানগুলো থেকে কিছু কিনার পর দোকানদাররা টাকা নেয় না।বাড়ির সামনে রিকশা দাঁড়িয়ে থাকে।এসব যে আপনার কাজ তা আমি খুব ভালো করেই জানি।প্লিজ, এসব বন্ধ করুন। আমাকে আমার মতো থাকতে দিন।আমাকে নিয়ে আপনার এসব বাড়াবাড়ি খুব বিরক্ত করে আমায়।আপনি আমাকে ভালোবাসেন,ভালো কথা।আপনার অনুভূতিগুলো ঢাক- ঢোল পিটিয়ে সবার কাছে জাহির করার দরকার কি? আমি এসবে বিন্দুমাত্র আকৃষ্ট হই না।একতরফা অনুভূতিগুলো গোপনেই সুন্দর।আপনি বোধহয় বুঝতে পারছেন,আমি কি বলছি।আশা করি আমার কথায় গুরুত্ব দিবেন।"

তথা আর পিছু ফিরে তাকায় না।পা টেনে টেনে হোটেলের কাছে যায়। এতোক্ষণ একটানা দাঁড়িয়ে থাকা উচিত হয়নি।পা'টা ব্যাথা করছে খুব।বাসায় যেয়ে ভালোভাবে তেল মালিশ করতে হবে।নাহয়,ভুগতে হবে খুব।
মাহাদীর খাওয়া শেষ হয়েছে একটু আগে।হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে বোনের জন্য অপেক্ষা করছে সে।মাহাদী তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে।এলাকার এমন কোনো মানুষ নেই যে এই হোটেলের বিরিয়ানী খায়নি।কিভাবে যেন খাবার বানায় এরা। মুখে দিলেই মন ভালো হয়ে যায়।

---" মাহাদী,ধর। বিল দিয়ে আয়।"---মাহাদীর দিকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দেয় তথা।

---" এতোক্ষণ সময় লাগলো তোমার! আমার খাওয়া শেষ, বিল দেওয়াও শেষ।"

---" কিভাবে দিলি?"

---" ইরফান ভাই দিয়ে দিয়েছে।"

প্রচন্ড বিরক্ত হয় তথা।এরকম শুরু করেছে কেন সে?তথা গলায় বিরক্তি ফুটিয়ে বলেঃ" তুই নিষেধ করলি না কেন?উনি দিতে চাইলো আর তুইও দিতে দিলি! তুই কি পাগল মাহাদী?"

---" আমি বারবার নিষেধ করেছি কিন্তু শুনলোই না।আমি কি আর তার সাথে মারামারি করব?"

চোখ বন্ধ করে বিরক্তি আর রাগটুকু গিলে নেয় তথা।বাড়ি যেতে হবে।রাত বাড়ছে।

---" মাহাদী,রিকশা ডাক... 

আদেশ করতে দেরি তথার সামনে রিকশা হাজির হতে দেরি নেই।রিকশাওয়ালা ছেলেটা বিনয়ের হাসি হাসে।মুখে হাসি ধরে বলেঃ" আপা,উঠেন।সুবর্ণ মঞ্জিলে যাইবেন না?আমিও ওইদিকে যামু।উঠেন।"

তথা অবাক হলো না।রিকশাওয়ালাকে ঠিকানা বলে কে পাঠিয়েছে তা বেশ বুঝতে পারছে।লোকটা পুরো আঠার মতো লেগে আছে। আর কোনো রিকশা চোখে পড়লো না তথার।অগত্যা এটাতেই বসতে হলো। মিনিট কয়েক পরে, তথার ফোনে টুং করে একটা শব্দ হয়।কারো কাছ থেকে হয়তো মেসেজ এসেছে।ফোনটা হাতেই ছিল তার।তাই ক্ষুদে বার্তা দেখতে সময় লাগে না।মোবাইলের লক খুলতেই চোখে সামনে ভেসে উঠে প্রচন্ড অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষের কাছ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত এক বার্তা।তথা হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে মোবাইলের স্ক্রিনে। 

" অনেক লেকচার দিয়েছ আজ।কথার ছলে উপদেশ দিয়েছ,তাচ্ছিল্য করেছ সেগুলোও কানে এসেছে।তবে তোমার কথাগুলো মাথায় ঢুকেনি, মনেও রাখিনি।তুমি বোধহয় ভুলে গেছ আমার পরিচয়। আমি এক লৌহমানবীর অনুগত,ব্যক্তিগত প্রেমিক পুরুষ।প্রেমিকরা প্রেমের কথা ছাড়া অন্যকিছুতে কান দেয় না।তাদেরকে বুঝানো আর বালু মাটিতে পানি ঢালা একই কথা।দুটোতেই কোনো ফল পাওয়া যায় না।আমার আচরণ তোমার কাছে বাড়াবাড়ি তবে আমার কাছে তা কর্তব্য।তোমার আগে -পিছে আমি থাকবই।হাজার নিষেধ করলেও থাকব।যেখানেই যাও না কেন,তোমার পিছু আমি নেবই।"

খানিক রাস্তা অতিক্রম করার পরেই ইরফানকে চোখে পড়ে।বাইকের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।চোখদুটো তথার উপরে নিবদ্ধ।ঘর্মাক্ত শ্যামবর্ণ মুখের উপর দীর্ঘ বিষাদের ছাপ।ইরফানের মুখটা কালো হয়ে আছে।সেখানে ঘোর অমাবস্যা চলছে যেন।একটা সুন্দর মুখ-মন্ডলের উপর খানিকটা কালি লেপে দেওয়া হয়েছে যেন।আর পর্যবেক্ষণ করতে পারে না তথা।ইরফানকে ছাড়িয়ে রিকশা চলে যায় সামনে।তথাও মনোযোগ সরিয়ে নেয়। ভাবলেশহীনভাবে চেয়ে থাকে অন্ধকার রাতের পথে।

***

---" তথা মা,ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবা। বেশি কাজের চাপ নিবা না।শরীরের যত্ন নিবা। কাজ কঠিন মনে হইলে করার দরকার নাই।চইলা আসবা বাসায়।মন খারাপ লাগলে বাসায় ফোন কইরা কথা কইবা।ঠিক আছে?"

তথা মাথা দুলায়।ইকবাল মিয়া পরম যত্নে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।ভাইয়ের অংশকে সবসময় নিজের অংশই ভেবেছেন।কাছ ছাড়া করেননি কখনোই।এই প্রথম।ইকবাল মিয়ার চোখের কোনে পানি জমে।কে বলেছে তথা তার মেয়ে না?তথা তারই মেয়ে।জন্ম দিলেই খালি বাবা-মা হওয়া যায়?রক্তের সম্পর্কের বাইরেও একটা সম্পর্ক থাকে। একে আত্মার সম্পর্ক বলে।এর জোর অনেক।

---" কাকা,আমি ঠিকমতোই থাকব।তোমরাও ভালো থেকো।কাকিকে কান্নাকাটি করতে নিষেধ করবে।আমি সময় পেলেই ফোন করব।মাহাদী-রুবি ওদেরকে ভালোভাবে পড়াশোনা করতে বলবে।আলমারির এককোনে একটা ব্যাগ আছে।ওখানে ওদের হাতখরচের টাকা রাখা আছে।আর.... "

ইকবাল মিয়ার ফোনে কল আসায় কথা থামিয়ে দেয় তথা।ইকবাল মিয়া ইশারা করে পাঁচ মিনিটের সময় চায় তথার কাছে। কলটা গুরুত্বপূর্ণ। নাহয় তিনি এখন ফোন ধরতেন না।ইকবাল মিয়া খানিকটা দূরে সরে যান কথা বলার জন্য।তথা চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে।দেখতে দেখতে মাস শেষ হয়ে গেছে।আজকেই পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে তারা।তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে বাসটা।এতে চেপেই তারা পঞ্চগড় যাবে।মোট পঁচিশ  জনের একটা টিম যাচ্ছে পঞ্চগড়। বিশ মিনিট পরে বাস ছাড়বে।তথা আগেই চলে এসেছে।অন্যান্যদের মধ্যে দু-একটা মেয়ে এসেছে শুধু।ওদেরকে চিনে না তথা।তারা বাসে বসে আছে।হঠাৎ করেই তথার সামনে একটা বাইক থামে।ধুলো উড়িয়ে বাইকের চাকা থামতেই দু-পা পিছিয়ে যায় তথা।আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে যায় তথা।বাইকের উপর ইরফানকে দেখে বেশ খানিকটা বিরক্ত হয় সে।কপাল কুঁচকে  বিরবির করে বলে---" ছোট্ট খাটো জানোয়ার একটা।"

---" তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে,তথা।মাখন রঙের জামায় একদম মাখনের মতো দেখাচ্ছে।"

না চাইতেও জোর করে ভদ্রতার হাসি হাসে তথা।দিনদিন ইরফানের সাহস বাড়ছে।আগে তো কথা বলতো না।এখন বলে।মাঝে মাঝে ফোনে মেসেজও পাঠায়। 

---" তুমি একাই এসেছো?"

---" জ্বি,না।কাকা এসেছে সাথে।"

---" কোথায় যেন যাবে তোমরা?"

---" ডাহুক নদীর তীরে একটা জমিদার বাড়ি আছে,সেখানে।"

---" ভালো থেকো,তথা।আবার কতদিন পর দেখা হবে আল্লাহ মালুম।"

---" আপনিও ভালো থাকবেন।"

ইরফান হাসে।তার হাসি ফেটেও যেন দুঃখ ঝরে।বাইক থেকে নেমে তথার দিকে দু-পা এগিয়ে যায় সে।ফিসফিসিয়ে বলেঃ"ভয়াবহ দুঃসাহস দেখাতে ইচ্ছে করছে।আমাদের মাঝে বৈধতা থাকলে এই মুহূর্তে তোমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতাম।কিন্তু যেখানে বৈধতা নেই,সেখানে এসব কল্পনা করাও পাপ।তাই নিজেকে সামলে নিচ্ছি।।আমার স্বস্তিটুকু নিয়ে এক আকাশ দুশ্চিন্তা দিয়ে যাচ্ছ।আবার নিজেই বলছো, আমি যেন ভালো থাকি!আমার ভালো থাকার দিন ফুরিয়ে গেছে।তুমি কি বুঝতে পারছো, তথা?"




হানিফ পরিবহনের বাসটা দাঁড়িয়ে আছে শ্যামলী বাস স্টেশনে।সাদা রঙের বাসের নরম সিটে মাথা এলিয়ে দিয়েছে তথা।চোখের পাতা দুটো বন্ধ।ডান হাতে তিনটে কদম ফুল।ফুল তিনটে এখনো সতেজ।তথা চোখ খুলে একবার তাকায় ফুলগুলোর দিকে।হলদে- সাদা ফুলে সবুজ পাতার সংমিশ্রণ। দেখতে মন্দ নয়। কদম ফুল অনেকের বাড়াবাড়ি রকমের পছন্দ হলেও তথার খুব বেশি একটা ভালো লাগে না।তথার পছন্দ কলমি লতার ফুল।আদুরে ফুলগুলো দেখতে বেশ সুন্দর হলেও ঘ্রাণ নেই।তথা জানালার পাল্লা খুলে দেয়।জানালার পাশের সিটে বসেছে সে।বাস ছাড়বে সাড়ে নয়টায়।অল্প কিছুক্ষণ সময় আছে আর।কেউ কেউ এসেছে।আবার কিছু কিছু সিট এখনো খালি।ডিরেক্টর, খোকন,শাফিন,পুনম ---এরা কেউ আসেনি এখনো।যারা এসেছে তারা বেশিরভাগই জুনিয়র আর্টিস্ট। সবাই নতুন।একগাদা অচেনা মুখের মাঝে বসেও অস্বস্তি হচ্ছে না তথার।বাসের বেশিরভাগ যাত্রী মেয়ে।কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না,একে অন্যের সাথে পরিচিত হচ্ছে না।মাথা ঝুকিয়ে মোবাইলের দিকে চেয়ে আছে।তথার পাশের মেয়েটার নাম সোনালী।মেয়েটা তথার চাইতে ছোট হবে।সেও বসে বসে মোবাইল দেখছে।তথা জানালার বাইরে মাথা বের করে।রাস্তার কোল ঘেষে স্বল্প পরিচিত বাইকটা এখনো দাঁড়ানো।মানুষটা নেই কেবল।তথা মাথা ভিতরে নিয়ে আসে আবার।ইরফানের আচরণগুলো কেমন যেন পাগলাটে।সরাসরি প্রত্যাখানের পরেও কেউ এমন করে?এরকম নির্লজ্জ মানুষ আর কোথাও দেখেনি তথা। একটু আগে কি কান্ডটাই না করলো! ইরফান যখন এক আকাশ আবেগ নিয়ে ফিসফিস করে প্রণয়কথা বলছিল,তথা তখন বিস্মিত চোখে চেয়ে ছিল মানুষটার দিকে।যেভাবে কথা বলেছিলো মনে হচ্ছিল যেন ইরফান এখন কেঁদেই দিবে।ইরফানের আক্ষেপের শেষেই তথা ব্যস্ত পায়ে দু'পা পিছিয়ে যায়।কাজটা আরো আগেই করা উচিত ছিল। কিন্তু অবাকের রেশ কাটিয়ে, কর্তব্য পালনে মনোযোগ দেওয়ার মতো মন-মানসিকতা ছিল না তথার।তথা রাস্তার আশে-পাশে দ্রুতগতিতে চোরের মতো নজর বুলায়।কোনোভাবে কাকা আবার দেখে ফেললো না তো?

---" তথা,সারাদিন তোমাকে মনে পড়বে আমার।তোমার অজান্তেই তোমাকে অনুসরণ করতাম।অভ্যাসগুলো পোড়াবে খুব।সাবধানে থেকো,ভালো থেকো।কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার সাথে আর দেখা হবে না।এতোদূরে না গেলে হয় না?"

---" আপনি কি পাগল,ইরফান ভাই?আর এসবের মানে কি হ্যাঁ? কাজ নেই আপনার?আপনাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।আত্মসম্মানে লাগেনি একটুও?আপনার মতো ভয়াবহ নির্লজ্জ আর কোথাও দেখিনি। "----- তথার কন্ঠে ঝরে পড়ে তীব্র আক্রোশ ।
ইরফান মুচকি হাসে।এক ভ্রু উঁচু করে বলেঃ " আত্মসম্মান থাকলে আবার প্রেম যুদ্ধে নামতে পারতাম?তুমি জানো না,প্রেম আর আত্মসম্মান পরস্পর বিপরীতমুখী? এরা কখনো সমানতালে  এক পথে চলে না।"

---" ছিঃ! কতটা আত্মসম্মানহীন আপনি।একবার চিন্তা করে দেখেছেন?আত্মসম্মান যার না থাকে সে আবার মানুষ হয় নাকি?"

---" তোমার চিন্তা- ভাবনা আমার সাথে মিলে না।আমার কথা তুমি বুঝতে চাও না,তোমার কথাও আমি বুঝতে পারি না।তাই সব বাদ দাও।তোমার জন্য একটা গিফট এনেছি।নিতেই হবে।না নিলে যাব না এখান থেকে।"

---" আপনি এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাবেন।আমি প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছি। বুঝতে পারছেন না কেন,বলুন তো।"

---" আমিও এতোবার বলছি ভালোবাসি,তুমি কেন বুঝতে চাইছো না বলো তো?"

---" এই একঘেয়ে প্যানপ্যানানি বন্ধ করুন।বিরক্ত  লাগছে এখন।অসহ্য!"

---" দয়া-মায়াহীন পাষাণ নারী একটা।অসহ্য!"

তথা কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকে। প্রেমের প্রস্তাব তার জন্য পুরোনো হলেও এরকম পাগলামি তার জন্য একদম নতুন। এসব পাগলামি আকর্ষণ নয় বিরক্ত করছে তাকে। রাস্তার পাশ থেকে আস্ত ইটটা নিয়ে ইরফানের মাথায় ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে করছে তথার। এ মানুষ নয়, এ যেন জীবন্ত ফেবিকল আঠা।পিছু লেগেছে তো লেগেই আছে,ছাড়াছাড়ির নাম নেই।

---" তোমার জন্য তিনটে কদম এনেছি।আমার সবচেয়ে পছন্দের ফুল।এখন কদম ফুল পাওয়া 
খুব কঠিন ব্যাপার, বুঝলে।বহু কষ্টে খুঁজে খুঁজে বের করেছি।"

ইরফানের হাতের আকর্ষণীয় ফুলগুলো তথার মনোযোগ কাড়তে পারে না।তার মনোযোগ এখন কেবল ইরফানের দিকে।এতোদিন ইরফানের অনুভূতিগুলো  যেন শক্ত কোনো চাদরে মুড়ে ছিল।আজকাল বন্যার পানির মত হুড়মুড় করে বাড়ছে।আগেই তো ভালো ছিল।কথা-বার্তা বলতো না,সামনে দাঁড়াতো না।কিন্তু এখন? তথার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে একদম।

---"এই নেও। এই  ফুলগুলো তোমার।দারুন না দেখতে?"

---' আপনি বললেই আমি নিয়ে নেব?অযথা চেষ্টা করছেন,ইরফান ভাই।আপনি খুব ভালো একজন মানুষ। আপনার মূল্যবান সময়গুলো আমার পিছনে নষ্ট করবেন না প্লিজ।অন্যকারো পিছনে সময় দিন।যে আপনাকে গুরুত্ব দিবে,ইচ্ছাকে সম্মান করবে,আপনার অনুভূতিকে বুঝতে পারবে, কদর করবে।আমার দ্বারা এসব হবে না।আশা করছি আপনি আমার কথা বুঝতে পারছেন।দোয়া করি আপনি যাতে সঠিক মানুষকে চিনতে পারেন।পাগলামিগুলো তার জন্য তুলে রাখুন।আমার মতো ভুল মানুষের জন্য পাগলামি করবেন না,প্লিজ।ভালো থাকবেন,আসছি।"

যে  ধিক্কার অথবা তাচ্ছিল্যে  পরিবর্তন হয় না,তাকে ঠান্ডা মাথায় বুঝাতে হয়।ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে পুরোটা পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিতে হয়।ঠিক সেই পথটাই ধরলো তথা।আশা করা যায়, এখন ইরফান বুঝতে পারবে।অকারণে তাকে আর বিরক্ত করবে না।
ইকবাল মিয়া পাঁচ মিনিটের কথা বলে, দশ মিনিট পরে ফিরলেন।তার হাতে কিছু শুকনো খাবার।তিন প্যাকেট চিপস,এক প্যাকেট চানাচুর আর দুই প্যাকেট নোনতা বিস্কিট। বাইরের এই খাবারগুলো খুব পছন্দ করে তথা।যাত্রাপথে কিছু শুকনো খাবার না হলে তার চলেই না।ইরফান ও তথাকে একসাথে দেখে খুব অবাক হলেন ইকবাল মিয়া।ইরফান খুব পরিচিত তার। কাউন্সিলরের ছেলে হিসেবে ছোট -বড় সবাই তাকে চিনে।এই ছেলেটা এখানে কি করছে? তথার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কেন?মনে  একগাদা প্রশ্ন নিয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যান ভাতিজির দিকে। মেয়ের দিকে হাতের খাবারগুলো  বাড়িয়ে দেন।অনুতাপের সুরে বলেনঃ" অনেকক্ষণ দাঁড় করায়া রাখছি এই রোইদের মাঝে।কাজের সাইড থেকা ফোন আসছিলো,তাই কথা শেষ করতে দেরি হইছে।"

---" সমস্যা নেই, কাকা।এতো খাবার কিনতে গেছ কেন?আমি একা এতোগুলো খাব নাকি?"

---" রাইখা রাইখা খায়ো।তা ইরফান বাবা, তুমি এই জায়গায় যে?"

---" এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম,এখানে এসে তথার সাথে দেখা।রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে তাই ভাবলাম কোনো সমস্যা হলো নাকি।তাই দাঁড়ালাম, আরকি।"

---" ওহ।তা শ্যামলীতে কোনো কাজ আছে নাকি তোমার?"

---" আমার বড় আপুর শ্বশুরবাড়ি শ্যামলীতে।ওর বাসাতেই যাচ্ছি।"

---" বুঝলাম।তথা মা, তাইলে আমি যাই এখন।ভাবসিলাম গাড়ি ছাড়লে তারপর যামু।কিন্তু, কাজের সাইডে এহন না গেলে চলব না।তুমি ভাল থাইকো।নিজের যত্ন নিয়ো আর কোন সমস্যা হইলে ফোন কইরা  জানায়ো।ঠিক আছে?"

---" আচ্ছা, কাকা।তোমরাও ভালো থেকো।কাজের ফাঁকে কল দেব।একমাসেরই তো ব্যাপার।চিন্তা করো না।আমি শীঘ্রই ফিরে আসব।"

 পরম স্নেহে মেয়ের মাথায় বার দুয়েক হাত বুলিয়ে দেন ইকবাল মিয়া।মেয়েকে রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না তার।মেয়েটাকে কষ্ট করে বড় করেছেন।এতোদিনের জন্য অচেনা জায়গায় একলা ছাড়তে কষ্ট তো হবেই।

---" আপনি এখনো যাননি! "

---" উঁহু,ইচ্ছে করছে না।"

ইরফানের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তথা।একে আর বুঝিয়ে লাভ নেই।তারচেয়ে গাড়িতে যেয়ে বসে থাকাই ভালো।তথা গাড়ির দিকে দু-পা এগোতেই এক অভাবনীয় কান্ড ঘটায় ইরফান। দ্রুত গতিতে তথার পাশে যেয়ে তথার হাতে ফুল গুজে দেয়।তথা বাঘিনীর মতো গর্জে উঠার আগেই চাপা ধমক দেয় ইরফান। 

---" খবরদার,বাড়াবাড়ি করবে না।আমার সাহস দেখার দুঃসাহস করো না।তোমার জন্য কষ্ট করে ফুলগুলো এনেছি।অন্তত আমার কষ্টের মূল্যটুকু দাও।"

তথা আর কথা বাড়ায় না।মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাড়াবাড়ি না করাই ভালো।সামান্য ফুলই তো।তথা গাড়িতে উঠে যায়।একবারের জন্যও পিছু ফিরে দেখে না ইরফানের মুখ।

***

---" আপু, আপনার কাছে পানি হবে?আমি আসলে পানি আনিনি।"

সোনালীর বিনয়ী প্রশ্নে কল্পনার সুতো কাটে তথার।মুচকি হেসে বলেঃ" হ্যাঁ, হবে।দাঁড়াও দিচ্ছি।"

সোনালীকে পানি দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও দিতে পারে না তথা।সেও ভুলে পানি আনেনি।ইকবাল মিয়া অনেক খাবার কিনে দিলেও পানি দেননি।হয়তো তিনিও ভেবেছিলেন,তথার কাছে পানি আছে।তথা অপারগতা প্রকাশ করে সোনালীর কাছে।

---" সোনালী,আমিও পানি আনিনি।পানির আনার  কথা বেমালুম ভুলে গেছি।"

মিষ্টি হাসে সোনালী। 

----" সমস্যা নেই আপু।আমি ম্যানেজ করছি।"

---" এই তথা,তথা...."---- জানালার কাচে ঠকঠক আওয়াজ তুলে ইরফান।সে এখনো যায়নি।তথা আড়চোখে একবার সোনালীর দিকে তাকায়।সে বেশ আগ্রহ সহকারে উঁকি দিচ্ছে এদিকে।না চাইতেও ইরফানের ডাকে সাড়া দেয় তথা।যে তাচ্ছিল্য বোঝে না,অপমান বোঝে না,নিষেধাজ্ঞা মানে না,উপদেশ কানে নেয় না---তার সাথে  আর কি করা যায়? ঢাকায় থাকা অবধি ইরফানের কবল থেকে বাঁচা যাবে না, তা বেশ বুঝে গেছে তথা।তথা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কোন কুক্ষণে যে ইরফানের নজরে পড়েছিল।তথা জানালার পাল্লা দিয়ে সামান্য মুখ বাড়ায়। চোখে পড়ে ইরফানের চিন্তিত,বিষাদগ্রস্ত চেহারা।যেন এখুনি ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দেবে।ইশ! ছেলেদের মন এতো নরম হয়?

---" আবার কি হলো,ইরফান ভাই?"

---" এই নেও।"
 
খোলা জানালা দিয়ে একটা পলিথিন এগিয়ে দেয় ইরফান।স্বচ্ছ পলিথিনের ভিতরে এক বোতল পানি আর তেঁতুলের আচার চোখে পড়ে তথার।নির্লিপ্ত গলায় প্রশ্ন করে সেঃ" এখনি চলে যাবেন নাকি আরো বিরক্ত করবেন?"

---" এমন করো কেন?গাড়ি ছাড়লেই চলে যাব।"

---" আপনি খুব আবেগী।একটা কথা মনে রাখবেন,হাজী সাহেব কখনো নিজের ছেলের বউ হিসেবে একজন অভিনেত্রীকে মেনে নিবেন না।"

---" ভয়টা তো এখানেই।এই জন্যই তোমাকে যেতে নিষেধ করছি।তোমার পছন্দের পেশা আমি মেনে নিলেও আমার পরিবার কখনো মানবে না।"

---" নিজের বাবার পছন্দকে সম্মান করতে শিখুন।ভবিষ্যতে যা হবে না তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করা বন্ধ করুন।"

ইরফান খুব বিরক্ত হয় তথার কথায়।মেয়েটার কোনো কান্ডজ্ঞান নেই।ইরফানের খুব খারাপ লাগছে ---এটা যেন সে বিশ্বাসই করতে চাইছে না।আজব! জানালার কাছ থেকে সরে যায় ইরফান।নিজেকেই নিজে ধিক্কার দেয়।এতোটা পাগল হওয়া কি উচিত? আত্মসম্মান ইরফানেরও আছে।কিন্তু কেন যেন তথার কথাগুলো আত্মসম্মানে বাধে না।হয়তো তথার প্রতি ইরফানের অত্যধিক দুর্বলতাই এক্ষেত্রে দায়ী।এজন্যই মেয়েটা এতো কথা শোনাতে পারছে। নাহয় কার সাধ্য ইরফানকে এতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলে!

---" উনি কি আপনার হাজবেন্ড?"

---"উঁহু, প্রণয় ভিক্ষুক।"

---" সত্যি! ভাইয়া কিন্তু খুব কেয়ারিং।আপনি চাইলেই তার সাথে রিলেশন করতে পারেন।"

সোনালীর কথায় খুব বিরক্ত হয় তথা।মেয়েটা খুব ইঁচড়েপাকা। সবকিছু বেশি বুঝে।তথা সোনালীর দিকে পানির বোতল এগিয়ে দেয়।সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে।উত্তেজনায় কাল রাতে ঘুম হয়নি ঠিকভাবে।ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে।তথার বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠে একটি বিষাদগ্রস্ত পুরুষের মুখ।মনে মনে খুব অবাক হয় তথা।ইরফানের পাগলামিগুলো মনের কোথাও দাগ কাটলো নাকি?অজান্তেই ইরফান নামক প্রেমিক পুরুষটা মনের এককোনে হাত-পা ছড়িয়ে আসন গাড়লো নাকি?

***

ইউসুফ এখন পঞ্চগড়ে।তার স্থায়ী কোনো আবাস নেই,পরিবার নেই, বন্ধন নেই।বংশের অংশ হিসেবে  শরীরে রক্ত ও জমিদার বাড়িটাই আছে।এই বাড়িটা খুব ভালো লাগে ইউসুফের।কতো কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে।ইউসুফের জন্মের আগে তাদের পরিবারটা এখানেই ছিল।ছোট-খাটো পরিবার নয়।একান্নবর্তী পরিবার। ব্রিটিশ আমল থেকে তাদের আধিপত্য এখানে।আধিপত্য ধ্বংস হল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।ধ্বংসের শুরু ইউসুফের জন্মের আগেই।ইউসুফের জন্ম হয়েছে পাকিস্তানের করাচীতে।তার মা ছিল পাকিস্তানি। বাবা বাংলাদেশী।এই দম্পতির তৃতীয় সন্তান সে।তবে ইউসুফের কোনো ভাই-বোন জীবিত নেই।প্রথম দুজন পৃথিবীতে আসার আগেই মারা গেছে।আহমেদ সফিউর ও বিবি জুলেখার বিয়ে হয়েছিলো একাত্তরের শুরুর দিকে।প্রেমের বিয়ে। জুলেখার বাবার বাড়ি শুরুতে মেনে নেয়নি তাদের বিয়ে।তবে একটা মেয়ে হওয়ায় পরে ঠিকই মেনে নিয়েছে।যুদ্ধের শেষে, জুলেখার বাবার বাড়িতেই আশ্রয় নেয় এই দম্পতি।যুদ্ধের পরে বহু কষ্টে দেশ থেকে পালিয়েছে তারা। এসব বাবার মুখে শুনেছে ইউসুফ।নিজের দেশে প্রথম পা রেখেছে দশ বছর বয়সে।তার আগে সে  পাকিস্তানেই ছিল।

---" গাড়ী চলে এসেছে, স্যার।গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।আপনি কি নিচে যাবেন?"

মামুনের প্রশ্নে উঠে দাঁড়ায় ইউসুফ।ঘাড় নেড়ে বলেঃ
" হ্যাঁ, যাব।চলো।"

ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে একবার আয়নায় চোখ বুলায় ইউসুফ।স্টাডি রুমের পশ্চিম দিকের দেয়ালে বিশাল বড় এক আয়না আছে।আপাদমস্তক দেখা যায় তাতে।দুই দেশের রক্তের সংমিশ্রন ইউসুফ।চেহারার আদল বেশিরভাগ মায়ের মতো। বাঙালি নয়,অনেকটাই পাকিস্তানীদের সৌন্দর্যের ছাপ পড়ে তার চেহারায়।ইউসুফ অগোছালো চুলগুলো হাত দিয়ে পিছনে ঠেলে দেয়।তার কামিনী ফুলটা দোরগোড়ায়। শুভ্র ফুলের সামনে যাওয়ার আগে একবার পরিপাটি হওয়ার দরকার ছিল।

তথা গাড়ি থেকে নেমে হাত-পা ঝারা দেয়।সেই কখন গাড়িতে উঠেছিল! হাত-পা লেগে গেছে একদম।তার পাশে সোনালী এসে দাঁড়িয়েছে।আসতে আসতে বেশ ভাব হয়েছে দুজনের মাঝে।সোনালীর বয়স সবে আঠারো।বয়সের আগেই পেকে গেছে মেয়েটা।পাকা পাকা কথা বলে।তথা লোহার গেটের দিকে তাকায়।বিশাল গেটের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে ভিতরের অভিজাত প্রাসাদটা দেখা যাচ্ছে।আখতার সাহেবের মুখে শুনেছে, এটা নাকি সেই ব্রিটিশ আমলের প্রাসাদ।ব্রিটিশ আমল।মানে সেই দুইশ বছর আগের কাহিনী। দুইশ বছর আগের এক প্রতাপশালী বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে,ভাবতেই শরীরে শিহরণ জাগে তথার। বাড়ির পথে দুজন ব্যক্তির অবয়ব দেখা যায়।লোহার গ্রিলগুলো ফাঁকা ফাঁকা। তাই ভিতরের দৃশ্য স্পষ্ট দেখা যায়। কিছুক্ষণের মাঝেই খুলে যায় ভারী গেটটা।দুইজন পুরুষের মাঝে একজনের দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে যায় তথার। কয়েক সেকেন্ড অপলক তাকিয়ে থাকে সে।বাড়ির সামনে মৃদু আলোর বাতি জ্বলছে। সেই আলোতে মানুষটার চেহারা স্পষ্ট চোখে পড়ে।এরকম বলিষ্ঠ সুপুরুষ আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি তার।চেহারার আগে চোখদুটো নজর কাড়ে।চোখের মনিদুটো কটকটে সবুজ রঙের ।মনি নয় যেন শ্যাওলা মিশ্রিত পানি ভরে রেখেছে চোখের ভিতর।পাশ থেকে সোনালী ফিসফিস করে তথার কানের কাছে।

---" তথা আপু,এটা বাড়ির মালিক নাকি?পুরাই হটপেটিস।আহ! ব্যাটা কি বিদেশি? এতো সুন্দর ক্যান?চোখ দুইটা খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।পুরাই রসগোল্লা, তাই না?"






চলবে...






Writer:- হালিমা রহমান


NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner