--- "আমার বয়স কত জানেন? ২৩! আপনার চেয়ে ৩বছরের বড় আমি। লজ্জা করলো না নিজের আপুর বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে?"
ছেলেটা নিজের দৃষ্টি আরো তুখোড় করলো। কণ্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বললো, "ভালোবাসি আপনাকে হৈমন্তীকা।"
ছেলেটার বেহায়াপনা দেখে খানিক বিরক্ত হলো হৈমন্তী। রেগে গেলে তার নাক কাঁপতে শুরু করে। এখনও কাঁপছে। ঝাঁঝালো গলায় সে আওড়ালো,
--- "আমার নাম হৈমন্তী। হৈমন্তীকা না! আপনাদের বিল্ডিংয়ে ভাড়া থাকি বলে ভাববেন না আপনাকে ভয় পাই আমি। আর একবার যদি আমাকে এইসব ফালতু প্রস্তাব দেন, তাহলে আপনার বাবা-মাকে বলতে দেড়ি করবো না আমি। মনে থাকে যেন!"
বলেই নিজের তীক্ষ্ণ চাউনি দ্বারা একবার দেখে নিলো ছেলেটাকে। যেন চোখ দ্বারাই ভস্ম করে দেবে তাকে। তারপর গটগট পায়ে চলে যেতে লাগল বিল্ডিংয়ের ভেতর। পেছন থেকে তুষার তখন আবেগী স্বরে বললো,
--- "আপনাকে আমি আপু মানি না হৈমন্তীকা। আপনাকে ভালোবেসেও কোনো অপরাধ করিনি। আমি আপনাকে ভালোবাসি, ভালোবসব। সেটা আপনি না চাইলেও।"
হৈমন্তী শুনেও শুনলো না যেন। ছেলেটার মাথা গেছে একদম। নিজের চেয়ে তিন বছরের বড় মেয়েকে বলে কি-না ভালোবাসি! হৈমন্তী প্রথমে ভেবেছিল তুষার মজা করে করছে এমন। তবে না! দিনে দিনে এর উদ্ভট সব কান্ড বেড়েই চলেছে। এই যেমন কালকের ঘটনাই ধরা যাক। হৈমন্তীকে একটা ছেলে প্রপোজ করেছে বলে ছেলেটাকে কি মারধরই না করেছে সে! হৈমন্তী এতদিন বাচ্চা ছেলে ভেবে কিছু বলেনি। কিন্তু এবার সে ভেবে নিয়েছে। আবারো এমন কিছু হলে সে সত্যি সত্যিই নালিশ দেবে তুষারের বাবার কাছে।
_________________
বৃষ্টি বাড়ছে। সাথে কোনো ছাতা আনে নি হৈমন্তী। দোকানের ছাউনির নিচে আরেকটু ঠেসে দাঁড়ালো সে। আর কতক্ষণ যে এই বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কে জানে! আশেপাশে কোনো রিকশারও দেখা মিলছে না। নতজানু হয়ে ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলল হৈমন্তী। হঠাৎ পাশ থেকে চিরচেনা এক কণ্ঠ কানে এলো তার,
--- "এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন হৈমন্তীকা? ছাতা আনেন নি?"
হৈমন্তী চমকে তাকালো। নিজের পাশে তুষারকে দেখে চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন ছুড়লো,
--- "আপনি এখানে? আবারো আমার পিছু নেওয়া শুরু করেছেন?"
তুষার মুচকি হেসে বললো,
--- "আপনার পিছু নেওয়ার প্রয়োজন পরে না হৈমন্তীকা। ভাগ্য নিজেই আমাকে আপনার কাছে টেনে আনে। এবার চলুন, আপনাকে পৌঁছে দেই।"
--- "আপনার কি ধারণা, আমি আপনার সঙ্গে যাবো? মরে গেলেও না!"
--- "আপনার ইচ্ছা। পরে কিছু হলে কিন্তু তার দায় আমি নেব না।"
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কথাটুকু বলে হাতের লাল ছাতাটা খুলে নিলো তুষার। এরপর ধীরস্থির ভঙ্গিতে হেঁটে চলে যেতে লাগল সামনের পথে। হৈমন্তী হাত ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত আটটা বেজে চল্লিশ মিনিট। আর কিছুক্ষণ পরই ন'টা বেজে যাবে। এ রাস্তা তেমন সুবিধার না। তারওপর রিকশাও নেই আশেপাশে। বৃষ্টিও কমছে না। হৈমন্তীর কি যাওয়া উচিত তুষারের সঙ্গে? সে একবার তুষারের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আবার উলটো পথে তাকালো। নির্জন রাস্তাটি দেখে মুহুর্তেই ভয় এঁটে বসলো হৈমন্তীর মস্তিষ্কে। কি ভেবে উঁচানো গলায় ডাকলো তুষারকে। দু'তিনবার ডাকলো।
তুষার থামলো। মুখে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে এলো হৈমন্তীর দিকে। খানিক ঝুঁকে ফিচেল হেসে বললো,
--- "ভয় পাচ্ছেন হৈমন্তীকা?"
হৈমন্তী হকচকালো। থতমত গলায় বললো,
--- "আ-আমি ভয় পাবো কেন? আমি তো ভেবেছি, আপনি ভয় পাবেন একা একা যেতে। তাই বড় আপু হিসেবে আমার কর্তব্য আপনার সঙ্গে যাওয়া। আমি তো শুধু আমার কর্তব্যই পালন করছি।"
'বড় আপু' কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল তুষারের। দৃষ্টি কঠিন হয়ে এলো। গম্ভীর স্বরে নিদারুণ অধিকার বোধ নিয়ে সে বললো,
--- "আপনি আমার আপু নন হৈমন্তীকা।"
হৈমন্তী রাগলো না এবার। বরং বোঝানোর সুরে বললো,
--- "আমি আপনার আপুই তুষার। সেটা আপনি মানুন বা না মানুন। আর হ্যাঁ, আমাকে হৈমন্তী বলে ডাকবেন। হৈমন্তীকা না।"
তুষার কথা বাড়ালো না। ছাতার একপাশে চেপে গিয়ে জায়গা করে দিলো হৈমন্তীকে। নিজ মনে বিড়বিড় করে উঠল,
--- "আপনি আমার কে হন, সেটা সময়ই বলে দেবে হৈমন্তীকা।"
নির্জন, নিস্তব্ধ রাস্তা। চারিদিকে শুধু বৃষ্টির ধুপধাপ শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু'একটা সিএনজি কিংবা রিকশা হর্ণ বাজিয়ে ব্যস্ত হয়ে ছুটে চলছে নিজ গন্তব্যে। সব'কটা যাত্রীতে ভরপুর। থামানোর জো নেই। হৈমন্তী জড়োসড়ো হয়ে হাঁটছে তুষারের সঙ্গে। ছাতা ছোট হওয়ায় বারংবার নিজের হাতে তুষারের হাতের স্পর্শ পাচ্ছে সে। অস্বস্থি হচ্ছে খুব। হৈমন্তী হাতটা বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
--- "জলদি হাঁটুন তুষার। পথটা শেষই হচ্ছে না!"
হৈমন্তীর কণ্ঠে বিরক্তি যেন চুইয়ে চুইয়ে পরছে। অপরদিকে কাঁধসহ পুরো একপাশ ভীষণ ভাবে ভিঁজে গেছে তুষারের। তবুও আনন্দপূর্ণ মেজাজে আছে সে। গলা ছেড়ে এবার গান গেয়ে উঠল তুষার,
--- "এ পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো?"
হৈমন্তী একবার আড়চোখে তুষারের দিকে তাকালো। রাশভারি গলায় বললো,
--- "খুবই বাজে হতো।"
--- "উহু! আপনার আর আমার প্রেম হতো।" নাকচ করে বললো তুষার।
হৈমন্তী রেগে গেল,
--- "আপনাকে কিন্তু থাক্কা দিয়ে ফেলে দেব তুষার!"
--- "দিন! আমিও আপনার হাত টেনে ফেলে দেব।"
বিরক্তিতে মুখ দিয়ে 'চ' শব্দ বেড়িয়ে এলো হৈমন্তীর। বাকি পথটুকুতে তুষার নানান কথা বললেও সে টু শব্দটিও করলো না। বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি আসতেই হৈমন্তী ছোট্ট করে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যেতে চাইল। তুষার হাত ধরে আটকালো। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো হৈমন্তী। ঝাঁঝালো দৃষ্টিতে তাকাতেই নির্নিমেষ চেয়ে তুষার শুধু বললো, "সরি।"
হৈমন্তী দাঁড়ালো না আর। ছুটে চলে গেল সেখান থেকে।
২.
দুপুর বেলা। ছাদে টানানো রশি থেকে কাপড় নিচ্ছে হৈমন্তী। রোদের তেজি আলো সরাসরি চোখে, মুখে পরছে তার। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে যাচ্ছে। কাপড় নিতে নিতে আনমনেই ছাদের দরজার দিকে তাকালো সে। থমকে গেল। ছাদের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুষার। প্রশস্ত বুকে দু'হাত আড়াআড়ি ভাবে রাখা। ঘর্মাক্ত মুখখানা লাল হয়ে আছে। নির্নিমেষ দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ। হৈমন্তী একপলক সেদিকে তাকিয়েই চোখ আবার ফিরিয়ে নেয়। নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে। তুষার এগিয়ে আসে। হৈমন্তীর সামনাসামনি রেলিংয়ে ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,
--- "সকালে আসেন নি কেন হৈমন্তীকা? আমি অপেক্ষা করছিলাম।"
হৈমন্তী ক্রুদ্ধ চোখে তাকালো মাত্র। জবাব দিলো না। তুষার আবার বললো,
--- "আপনাকে রাগলে ভীষণ সুন্দর লাগে হৈমন্তীকা। সেটা কি আপনি জানেন?"
--- "বেয়াদবির একটা সীমা থাকে। আপনি সেটা পার করে যাচ্ছেন তুষার। কোন দিন না আমি আপনাকে থাপ্পড় মেরে দেই!"
রেগে গিয়ে কাঠকাঠ গলায় বললো হৈমন্তী।
জবাবে তুষার ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। রশি থেকে একটা সাদা রঙের ওড়না নিয়ে হাতে পেঁচিয়ে নিলো। অতঃপর বিস্তর গগনে চেয়ে আফসোসের সুরে বললো,
--- "আপনি আরো পরে জন্ম নেন নি কেন হৈমন্তীকা? তাহলে আপনার এত এত বকা শুনতে হতো না আমার। আল্লাহ্ জানে, বিয়ের পর আপনি কি করেন আমার সাথে।"
হৈমন্তী চোখ রাঙিয়ে তাকালো। উঁচানো স্বরে বললো,
--- "ওড়না দিন!"
--- "এটা আপনার ওড়না?"
--- "হ্যাঁ।"
--- "আচ্ছা, নিন।"
বলেই হাতে থাকা ওড়না এগিয়ে দিলো তুষার। হৈমন্তী দ্রুত নিয়ে নিলো সেটা। দক্ষিণ দিক থেকে দমকা হাওয়া ভেসে আসছে। সেই হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে হৈমন্তীর কোমড় অব্দি কালো কেশ। হৈমন্তী বারবার মাথার ওড়না ঠিক করছে। অস্বস্থি নিয়ে ঠোঁট কামড়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তুষার মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে রইল হৈমন্তীর মুখপানে। বুকে এক ধরণের চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে সে। ইচ্ছে করছে, উম্মাদ প্রেমিকের মতো প্রেমিকার কপালে থাকা চুলগুলো কানে গুঁজে দিতে। তুষার নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না। হাত এগিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিলো হৈমন্তীর কপাল। কানে চুলগুলো গুঁজে দিতেই হঠাৎ নিজের গালে সূক্ষ্ণ ব্যথার আভাস পেল সে। হৈমন্তী চড় মেরেছে তাকে।
তুষার বিস্ময় নিয়ে তাকালো। গালে হাত বুলিয়ে মন খারাপ করে বললো,
--- "এত জোড়ে মারলেন হৈমন্তীকা? ব্যথা পেলাম তো!"
তুষারের নির্বিকার অভিব্যক্তি দেখে রেগে গেল হৈমন্তী। অবিশ্বাস্য গলায় বললো,
--- "আপনার কি একটুও লজ্জা করে না তুষার? এতটা নির্লজ্জ কেন আপনি?"
তুষার জবাব না দিয়ে হাসতে লাগল। হৈমন্তীর সারা শরীরে কেউ আগুন লাগিয়ে দিলো যেন। এ ছেলেটাকে কখনো বাচ্চা ছেলে ভেবেছিল সে? এ ছেলেটাকে? এ তো আস্ত অসভ্য! পাগল! যা তা!
হৈমন্তী আর দাঁড়ালো না। রোষপূর্ণ চাহনিতে একবার তুষারের দিকে চেয়ে কাপড়গুলো নিয়ে চলে গেল ছাদ থেকে। তার যাওয়ার পথে দৃষ্টি মেলে আরেক দফা গালে হাত বুলালো তুষার। বিড়বিড় করে বললো, "নরম হাতের কি জোড়! একদম ধানিলংকা।"
___________________
ঘরে এসেই ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় গা এলিয়ে দিলো হৈমন্তী। কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরক্ষণেই চোখ-মুখ কুঁচকে চেঁচিয়ে উঠল,
--- "আমাকে আর কাপড় নিতে ছাদে পাঠাবে না মা। এই পিচ্চি সারাদিন ঘরে বসে থাকে। একে কাপড় আনতে বলতে পারো না?"
শুনে তেঁতে উঠলো হেমন্ত। কণ্ঠে একরাশ প্রতিবাদী ভাব এঁটে বললো,
--- "মোটেও না! আমি অনেক কাজ করি।"
হৈমন্তী চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করলো,
--- "কি এমন কাজ করিস?"
হেমন্ত বেশ গর্ব করে বললো,
--- "কেন, আজকে সকালে নিজের বিছানা গুছিয়েছি না?"
--- "এতটুকুই?"
--- "এতটুকু বলছো কেন? বিছানা গুছানো তোমার কাছে কম লাগে?"
--- "তাহলে আমি কি করি? আমার মতো কাজ করলে তো তোকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না।"
একটু থেমে আবার বললো, "কালকে থেকে তুই-ই যাবি ছাদে কাপড় আনতে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে মাইর একটাও মাটিতে পরবে না। বলে দিলাম!"
হেমন্ত ভেঙচি কাটলো। আপন মনে কি যেন বিড়বিড় করতে করতে মোবাইল নিয়ে চলে গেল রুমে। হৈমন্তীর মা রাবেয়া আসলেন একটু পরেই। হাতে থাকা একটা টিভিন বক্স টেবিলে রেখে বললেন,
--- "বাড়িয়ালা কয়েকদিন আগে পায়েস দিয়েছিল বুঝলি? এখন খালি বক্স তো আর দেওয়া যায় না। আমি আজকে অল্প বিরিয়ানি বানিয়েছিলাম। ভাবলাম, এ ফাঁকে ওদের বক্সটাও দিয়ে দেওয়া যাবে। তুই একটু ওদেরকে বক্সটা দিয়ে আয় না মা।"
হৈমন্তী অসন্তুষ্ট হয়ে তাকালো। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,
--- "আমিই কেন? পিচ্চিকে বলো।"
রাবেয়া আদুরে গলায় বললেন,
--- "ওকে বলেছিলাম। ও যায় নি বলেই তো তোকে বলছি। যা না মা! তুই না আমার লক্ষীটা?"
হৈমন্তীর তখন ইচ্ছে করছিল, হেমন্তর চুল সব ছিঁড়ে ফেলতে। একটা কাজ বললে করে না ছেলেটা। তার মাও কম কিসের? হৈমন্তী ছাড়া যেন উনার চলেই না। সব কাজে হৈমন্তীকেই লাগবে। হৈমন্তী ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল। বক্স হাতে দাঁড়ালো বাড়িয়ালার বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
___________________
অনেকটা অলস পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল হৈমন্তী। কোত্থেকে তুষার এসে পথ রোধ করলো তার। কাছাকাছি এসে বললো, "কোথাও যাচ্ছিলেন হৈমন্তীকা?"
হৈমন্তী কোনোরূপ ভণিতা ছাড়াই বললো,
--- "আপনার বাসায়ই যাচ্ছিলাম। এই নিন বক্স। মা বিরিয়ানি পাঠিয়েছে আপনাদের জন্য।"
--- "বিরিয়ানি আপনি বানিয়েছেন হৈমন্তীকা?"
বলতে বলতে বক্স হাতে নিলো তুষার।
হৈমন্তী সেকথার উত্তর দিলো না। বরং খানিক কঠিন গলায় বললো,
--- "আপনাকে কতবার বলেছি আমাকে হৈমন্তীকা না ডাকতে? এখন থেকে হৈমন্তী, হৈমন্তীকা কিছুই ডাকবেন না আমাকে। আপু বলে ডাকবেন।"
তুষার শীতল চোখে তাকালো তখন। স্বাভাবিক স্বরেই আওড়ালো, "কখনো শুনেছেন নিজের হবু বউকে আপু ডাকতে? আমি তো আপনাকে হৈমন্তীকাই ডাকবো। একদিন দেখবেন, এই আমার থেকেই হৈমন্তীকা ডাকটা শোনোর জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠছেন আপনি। আমি কিন্তু তখন আপনার ব্যাকুলতা বাড়াবো না হৈমন্তীকা। ভয়ংকর ভাবে বুকে আগলে রাখবো।"
৩.
তুষারের চিন্তায় ঘুম আসছে না হৈমন্তীর। ছেলেটার পাগলামি দিন দিন বাড়ছেই। এমতাবস্থায় হৈমন্তীর কি করা উচিত? চড়, থাপ্পড়, অপমান, কিছুই তো বাকি রাখে নি সে। তবে হ্যাঁ, তুষারের বাবাকে নালিশ দিলে কিছু একটা হতে পারে হয়তো। কিন্তু হৈমন্তীর মন সায় দেয় না এতে। তুষারের জন্যে অদ্ভুদ মায়া হয়। মতিভ্রষ্ট হয়ে কিভাবে মরিচীকার পিছু ছুটতে ছেলেটা! তুষার যা চায় তা কি আদৌ সম্ভব? হৈমন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঘুম আর আসবে না তার। মাথা ভীষণ ব্যথা করছে। এখন একটু কড়া চা খেলে মন্দ হয় না। যেই ভাবা সেই কাজ! রান্নাঘরে গিয়ে চা বানিয়ে আনলো সে। মুক্ত বাতাসের মাঝে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
বিল্ডিংটা পাঁচ তলা। হৈমন্তীর পরিবার দু'তলায় থাকে। আর তুষাররা থাকে তিন তলা। হৈমন্তীর বারান্দার সঙ্গে তুষারের রুমের বারান্দা উপর-নিচ লাগানো। হৈমন্তী যখন চা খাচ্ছিল তখন হঠাৎ উপর থেকে তার চায়ের কাপে ছোট্ট একটা পাথর টুপ করে এসে পরলো। ফলসরুপ কাপে থাকা কিছু চা ছিটকে পরলো তার হাতে। সূক্ষ্ণ ব্যথায় অল্প চেঁচিয়ে উঠল হৈমন্তী। দ্রুত কাপটি টেবিলে রেখে ফু দিতে লাগলো হাতে। তখনি আবারও একটা ছোট্ট পাথর এসে পরলো তার বারান্দার মেঝেতে। তবে এবারের পাথরটা ভিন্ন। পাথরের গায়ে মোড়ানো রয়েছে একটি হলুদ রঙের কাগজ। হৈমন্তী এগিয়ে গেল সেদিকে। কাগজটা নিয়ে খুলতেই চমৎকার হাতের লেখা ভেসে উঠল তার সামনে,
‘দুঃখীত হৈমন্তীকা। আমি ইচ্ছে করে ফেলি নি পাথরটা। আপনি কি বেশি ব্যথা পেয়েছেন?’
লেখাটা পড়ে ভড়কে গেল হৈমন্তী। উপরে উঁকি দিতেই দেখতে পেল তুষারকে। তার মতো করে সেও বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ভড়াকানো গলায় ক্ষীণ স্বরে হৈমন্তী বলে উঠল,
--- "আপনি এখানে কি করছেন? আর এগুলো কি ধরণের বেয়াদবি? কাপে পাথর ফেলেছেন কেন?"
--- "আমি তো সরি বলেছি হৈমন্তীকা। চাইলে এন্টিসেপ্টিকও দিতে পারি। রুমে আছে, দিব?"
--- "লাগবে না আপনার এন্টিসেপ্টিক। কালকে না আপনার ক্লাস আছে? এত রাতে না ঘুমিয়ে এখানে কি করছেন?"
--- "একই প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি। আপনি এত রাতে না ঘুমিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন হৈমন্তীকা?"
হৈমন্তীর কপালে সূক্ষ্ণ ভাঁজ পরলো। কণ্ঠে তেজ এনে বললো,
--- "আমার যা ইচ্ছে আমি করবো। আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে কেন? যান, রুমে গিয়ে ঘুমান।"
ওপাশ থেকে একরোখা উত্তর, "যাবো না।"
রাগে হৈমন্তীর নাক কাঁপতে শুরু করলো। ছেলেটা এত ঘাড়ত্যাড়া! তুষারের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছেই মিইয়ে গেল তার। টেবিল থেকে কাপ উঠিয়ে ক্ষীপ্ত কণ্ঠস্বর ছুঁড়ে দিলো,
--- "আপনি থাকুন! আমিই চলে যাচ্ছি!"
তুষার রেলিং গলিয়ে খানিক ঝুকল। হৈমন্তীর যাওয়ার দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে ম্লান হাসলো মাত্র।
_____________
পরেরদিন ছিল রবিবার। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস হতে এখনো ১ঘন্টা বাকি। হৈমন্তী আজ একটু তাড়াতাড়িই চলে এসেছে ভার্সিটি। সাথে রয়েছে তার প্রিয় বান্ধবী পারু। তারা দুজনে মিলে ক্যান্টিনে বসে ছিল। স্যান্ডউইচ খেতে খেতে পারু বেশ আহ্লাদী স্বরে বললো,
--- "তোকে যে ছেলেটা পছন্দ করে... কি যেন নাম?"
হৈমন্তী আগ্রহহীন ভাবে জবাব দিলো, "তুষার।"
--- "ও হ্যাঁ তুষার। ছেলেটা কি এখনো তোর পেছনে ঘুড়ে?"
--- "হ্যাঁ।"
--- "কিছু বলিস নাই?"
--- "কালকে চড় মেরেছিলাম ডান গালে।"
শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো পারু। কণ্ঠে একরাশ বিস্ময় ঢেলে বললো,
--- "ডাইরেক চড় মেরে দিলি? এত সুন্দর একটা পোলারে চড় মারতে তোর বুক কাঁপলো না হৈমন্তী? তুই এত পাষাণ? আমি হইলে তো কবে হ্যাঁ বলে দিতাম। ছেলেটার কপালটাই আসলে খারাপ! তোর মতো দজ্জাল মহিলাকে পছন্দ করছে!"
হৈমন্তী চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো। বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে উঠল,
--- "তুই আমার বন্ধু নাকি ওর? ওর এত গুণগান গাইছিস কেন? এ বিষয়ে আর একটা কথাও বলবি না পারু। ওর নাম যেন তোর মুখে আর না শুনি!"
পারু স্যান্ডউইচে অল্প কামড় দিয়ে ঠোঁট উলটে বললো,
--- "এভাবে বলছিস কেন?"
--- "চুপ থাক!"
পারু সত্যি সত্যি চুপ হয়ে গেল এবার। আর একটা কথাও বললো না।
কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরই হৈমন্তী জিজ্ঞেস করল,
--- "কয়টা বাজে পারু?"
--- "৯ টা চল্লিশ। তোমাদের ক্লাস তো একটু পরেই তাই না?"
পারু কিছু বলবে, তার আগে আগেই পেছন থেকে পুরুষালী কণ্ঠে কেউ বলে উঠল কথাটা। হৈমন্তী ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো। অচেনা এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তাদের একটু দূরেই। সে এগিয়ে আসলো এবার। অনুমতি ছাড়াই হৈমন্তীর পাশের চেয়ারে বসে পরলো। এক হাত এগিয়ে হৈমন্তীর উদ্দেশ্যে বললো,
--- "আমি ইভান। তোমার এক বছরের সিনিয়ার। কেমন আছো?"
আকস্মিক এমন ঘটায় বিব্রতবোধ করল হৈমন্তী। হাত না মিলিয়েই ম্লান হেসে বললো,
--- "জি ভালো আছি। আমি আসলে আপনাকে ঠিক চিনলাম না। আপনি কি আমাকে চিনেন?"
হাত না মেলানোয় খানিক অপমান বোধ করলো ইভান। তবে মুখে তা প্রকাশ পেল না। হাত গুটিয়ে স্বাভাবিক হেসেই বললো,
--- "জুনিয়রদের সব খবরাখবর থাকে আমাদের কাছে। তুমি আমাকে চেনো না রাইট? সমস্যা নেই। কিছুদিন যাক। চিনে যাবে।"
কথাটা কেমন যেন লাগলো হৈমন্তীর। পছন্দ হলো না। তবুও ভদ্রতা রক্ষার্থে ক্ষীণ হাসলো সে। ইভানের একটা বন্ধু তাকে ডাকতেই সে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। হৈমন্তী হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন! সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলে পাশে তাকাতেই ভয়ে মাথা পিছিয়ে নিলো। তার পাশে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুষার। তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে! চোখের পলক ফেলেছে না একদমই। হৈমন্তী বুকে হাত রেখে বড় বড় নিশ্বাস নিলো। হুট করে তুষারকে দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। একটু শান্ত হতেই রাগী গলায় বললো,
--- "সমস্যা কি আপনার? এমন ভূতের মতো চলাফেরা করেন কেন?"
সেকথার জবাব দিলো না তুষার। উলটো গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, "ছেলেটা কে?"
--- "মানে?"
--- "একটু আগের ছেলেটা কে?"
--- "আপনাকে কেন বলবো?"
টেবিল থেকে পানির বোতল নিলো তুষার। আলতো চুমুক দিয়ে কাঠাকাঠ ভাবে বললো,
--- "আমার হবু বউয়ের ওপর লাইন মারছিল সে, হৈমন্তীকা! আর আমার জানা লাগবে না ছেলেটা কে?"
চলবে...
Writer:- ঈশানুর তাসমিয়া মীরা