হুজুর গরু কোরবানি দিয়ে চলে গেছেন বেশ খানিকক্ষণ হলো। কিন্তু কসাই ব্যাটার এখনও আসার নাম নাই! কোরবানির পর মৃত গরুটা গ্যারেজে পড়ে আছে। মাছি ভন ভন করছে। রক্তের গন্ধ বাড়ছে। কি বিচ্ছিরি ব্যাপার!
ঘণ্টা খানেক আগেও কসাই-এর সাথে ফোনে কথা বলেছি- "এই তো বস! আমি আইসা পড়ছি। আর দশ মিনিট লাগবো। আপনেরা গরু কোরবানি দিয়া ফেলেন!"
হুজুরকে যদি পরে না পাওয়া যায়- এই ভেবে আমরা নিজেরাই কোনোমতে ধরে বেঁধে কোরবানি সম্পন্ন করেছি। কিন্তু মাংস কাটাকুটির কাজ তো আমরা পারবো না! কসাই ব্যাটাও এখন আর ফোন ধরছে না! ভারি মুছিবতে পড়া গেলো!
আব্বা আমার সাথে রাগারাগি শুরু করলেন, "এই নাজিম? কোন বাটপার কসাই ঠিক করছিলি? তোরে দিয়া একটা কাজও ঠিক মতো হয় না! কোরবানির পশু এইভাবে ফালায় রাখা কি ঠিক হইতাছে?”
আমি আমতা আমতা করলাম, "ইয়ে... আব্বা... লোকটাকে তো ভালো বলেই মনে হইলো। বললো সে তার সাথে দুইজন লোক নিয়ে আসবে। তিনজনে গরুটা বানায় দিবে। তাই ওর ভরসায় আর কাউকে বলা হয়নি..."
আব্বা আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললো, "কাজটা ভালো হচ্ছে না রে। চল আমরাই নিজেরা যা পারি, চেষ্টা করি। এভাবে ফালায় রাখলে গুনাহ হবে..."
আমি আপত্তি জানালাম, "আমরা আনাড়ি লোক, চামড়া ঠিক মতো ছাড়াতে পারবো না, হাড্ডি কোপাতে পারবো না। সারাদিন লেগে যাবে আব্বা। আর দশটা মিনিট অপেক্ষা করে দেখি?"
আব্বা মন মেজাজ খারাপ করে একটা সিগারেট ধরালো। আর আমি বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক উঁকি দিতে থাকলাম। কিন্তু কসাইয়ের আসার নাম নাই!
এই এলাকাটা আমার খুব একটা ভালো লাগেনা। বাড়ি বানানোর আগে কথাটা আব্বাকে বলেছিলাম। আব্বা কানে তোলেনি। মানুষ খুব কম, যাও বা ছিলো- ঈদের ছুটিতে বাড়ি গেছে সব। কারো খোঁজ কেউ রাখে না! দরকারের সময় কাজ করার মতো লোকও পাওয়া যায় না!
বিশেষ করে প্রতি কোরবানির ঈদের সময় ঝামেলায় পড়তে হয়। মাংস কাটাকাটির লোক পাওয়া খুব মুশকিল। প্রায় সব বাড়িতেই দুইটা-তিনটা গরু কোরবানি হয়। কসাই বুকিং দিতে হয় অন্তত এক সপ্তাহ আগে। তাছাড়া, এলাকার মানুষরাও খুব স্বার্থপর! সবাই যে যার মতো থাকে, কেউ কারো সাহায্যে এগিয়ে আসে না।
গত সপ্তাহে আমি বাজারে গিয়ে এই কসাইয়ের সাথে কনটাক্ট করেছিলাম। লোকটা একটা মাংসের দোকানে কাজ করে। বেশ দক্ষ। তার সাথে ৫ হাজার টাকার চুক্তি হয়েছে। বাসার ঠিকানা দিয়ে এসেছি। ঈদের দিন সকাল সকাল দুজন সহকারি নিয়ে চলে আসবে কথা দিয়েছে। কিন্তু এখনও তার আসার নাম নাই! আমার তো সন্দেহ হচ্ছে আরও বেশি টাকা অফার করে কেউ তাকে নিয়ে কাজে বসিয়ে দিয়েছে!
সন্দেহটা সত্যি প্রমানিত হলো। আরও আধাঘন্টা চলে গেলো, কসাই আসার খবর নেই। এই সময় বাড়ির একজন ভাড়াটিয়া এলো বাইরে থেকে। সে জানালো- “আপনেগো কসাই তো পাশের এলাকার মেম্বারবাড়িতে গরু সাইজ করতাছে!”
খুব হতাশ হয়ে গেলাম আমি। আব্বা রাগে গজরাতে থাকলো। বাধ্য হয়ে আমরা নিজেরাই হাত লাগাতে যাবো, ঠিক তখনই গেটের সামনে দিয়ে রাম-দা হাতে এক কসাইকে যেতে দেখলাম। তার শার্টে আর লুঙ্গিতে গরুর রক্তের ছাপ।
আব্বা ডাক দিলেন কসাইকে, "এই মিয়া? তোমার কাজ কি শেষ নাকি?"
লোকটা ঘুড়ে দাঁড়িয়ে হাসলো, "হ স্যার... পাশের বাড়ির গরুটা বানায় দিয়া আসলাম।"
"দেখো কী কান্ড!” আব্বা হতাশ কণ্ঠে বললো, “মানুষের মাংস কাটাকাটি শেষ। আর আমরা এখনও শুরুই করতে পারলাম না। আচ্ছা ভাই, তুমি কি আমাদের গরুটা একটু সাইজ করে দিবা?"
"না স্যার। সময় নাই হাতে।" লোকটা আপত্তি করলো। "আগে থেকে বললে হইতো। আমার আরেক বাড়িতে যাইতে হবে, অ্যাডভান্সড টাকা দিয়া রাখছে।”
"আরে মিয়া ঐখানে পরে যাও।” আব্বা লোকটাকে পটানোর চেষ্টা করলো, “তোমারে ৩ হাজার টাকা দিবো। আমাদের কাজটা করে দিয়ে যাও আগে। কতক্ষণ আর লাগবে বলো?”
দাম নিয়ে কিছুক্ষণ মুলামুলি করে শেষে ৫ হাজারে রাজি হলো লোকটা। বসে গেলো কাজে। খুবই দক্ষ কসাই। নিজে একাই চামড়া ছাড়িয়ে নিলো, অনায়াসেই হাড্ডি-মাংস আলাদা করে ফেললো, তারপর হাড্ডি কুপিয়ে সুন্দর সাইজ করে দিলো। আমি আর আব্বা একটু হেল্প করলাম কেবল। সব মিলিয়ে ১ ঘন্টায় কাজ শেষ!
গুনে গুনে নগদ ৫ হাজার টাকা নিয়ে আব্বাকে সালাম দিয়ে চলে গেলো লোকটা।
আমরা মাংস নিয়ে বাসায় ঢুকে ভাগাভাগি করছি… তিন ভাগ করা হচ্ছে মাংস। নিয়ম অনুযায়ী এক ভাগ নিজেরা রেখে দুই ভাগ মানুষকে দিতে হবে...
হঠাৎ বাইরে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনতে পেলাম। ঈদের দিন এলাকায় পুলিশ কেন?
আমি বাড়ির বাইরে এসে দেখলাম, পাশের বাড়ির সামনে লোকজনের ভিড়!
একজন বলছে, "এমন একটা কান্ড হইয়া গেলো আর কেউ দেখলো না?"
আরেকজন বলছে, "এমন চিপার মধ্যে আইসা বাড়ি বানাইলে এমনই তো হইবো!"
আমি তো তাজ্জব! এগিয়ে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, "ভাই, কি হয়েছে এখানে?"
লোকটা রাগী গলায় আমাকে বললো, "আপনেরা কই থাকেন ভাইজান? পাশের বাড়িতে এক লোক কসাই-এর বেশে ঢুইকা বাড়ির মানুষরে কোপাইয়া মাইরা গেলো! আর আপনেরা টের পাইলেন না?"
আমার মাথাটা ভীষণভাবে চক্কর দিয়ে উঠলো!
সমাপ্ত...
Writer:- নাজিম উদ দৌলা