> একজন কিশোরীর মর্মান্তিক পোস্টমর্টেম | মর্মান্তিক মৃত্যু | হৃদয় কেঁপে উঠার মত সত্যিকার গল্প
-->

একজন কিশোরীর মর্মান্তিক পোস্টমর্টেম | মর্মান্তিক মৃত্যু | হৃদয় কেঁপে উঠার মত সত্যিকার গল্প

মৃত কিশোরীর সৌন্দর্য বর্ণনা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবুও বর্ণনা করা হল।

লম্বা এবং শুষ্ক চুল। মনে হচ্ছে কিছুক্ষন আগে শ্যাম্পু করে চুল শুকিয়েছে। মেয়েটা দাঁড়িয়ে থাকলে নিশ্চয় এই চুলে ঢেউ খেলত। টানটান মায়াবী চিবুক। চোখ বন্ধ থাকায় চোখের সৌন্দর্য কেমন বোঝা যাচ্ছেনা।

কিশোরীর মৃত শরীরটাকে টেবিলের উপরে শুয়ে দেওয়া হয়েছে। টানটান করে। মাথার নিচে আধাগজ চৌকাঠ। চৌকাঠটাকে বালিশ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আমি জানি না কতজন মৃত মানুষের বালিশ হবার ভয়ংকর অতীত আছে এই কাষ্ঠদন্ডের।

কিশোরীর সারা শরীর ফিনফিনে পাতলা সাদা ওড়নায় ঢাকা। বেঁচে থাকার সময় সম্ভবত এই সাদা ওড়নাটি কিশোরী পরত।

স্যার মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন-মৃত্যুর কি হতে পারে?

আমরা সারা শরীরে তাকালাম। কোন আঘাতের চিহ্ন নাই। ত্বক মসৃণ, উজ্জ্বল। লাবণ্য বলতে কি বোঝানো হয় জানি না। তবুও মনে হচ্ছিল, কিশোরীর ত্বক লাবণ্যময়। লাবণ্যময়ী মৃত কিশোরীর মৃত্যুর কারণ কি হতে পারে?

আমরা চল্লিশ জন মিলে টিউটোরিয়াল গ্রুপ। চল্লিশজন একসাথে বলল,
-স্যার, ব্রেইন ইনজুরি!
-কিভাবে?
-সম্ভবত রোড ট্র্যাফিক এক্সিডেন্ট। ব্রেইন দেখলেই বোঝা যাবে।

ডোমদের কাছে মরা গরুও যা, মরা মানুষও তা। একজন ডোম মোটামুটি হাসিমুখে ঝনঝন শব্দে অস্ত্র হাতে তুলে নিল। হাতুড়ি, বাটালি এবং ছুরি। ছুরি ধারালো। টাংস্টেন লাইটে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

প্রথমে কপালের উপর দিয়ে, এক কান থেকে আরেক কান বরাবর লম্বালম্বি ছুরি দিয়ে চামড়াটা কেটে ফেলল। কাটতে গিয়ে দেখা গেল ছুরিতে ধার নাই। দুইটা হিন্দি গালি দিয়ে কিশোরীর মাথার নিচের তক্তাটা টেনে বের করে ঘষঘষ করে ছুরিটা ধার দিল।

কপালের চামড়া কেটে চুলসহ মাথার স্কিনটা(স্কাল্প)) সামনে থেকে টেনে পেছনে আনল। নারকেলের ছোবড়া ছেলার মতো, টুপি খোলার মতো, গরুর চামড়া ছিলে ফেলার মত।

হাতুড়ি আর বাটালি দিয়ে কপালের কাছে 'ঠকঠক' করে খুলিটা ফাটিয়ে ফেলল। বয়ামের ঢাকনী খোলার মতো কপালের হাড্ডি দুইটা খুলে মাথার মগজ বের করল। ধারালো ব্লেড দিয়ে কেক কাটার মত করে মগজটা কয়েক খন্ডে কেটে দেখা হল। কোথাও জমে থাকা রক্তের চিহ্ন নাই। এর অর্থ- মাথায় আঘাত পেয়ে  কিশোরী মারা যায় নি। অন্য কোন কারণ আছে!

স্যার আবার জিজ্ঞাসা করল,
-মৃত্যুর কারণ কি হতে পারে?

এবার দশজন চুপ করে থাকল, ত্রিশজন বলল,
-স্যার, হ্যাংগিং। গলায় দড়ি!

ডোম গলা দেখাল...গলায় কালো দাগ...গলা কাটল। বুকের মাংস-স্কিন লম্বা টান দিয়ে দিয়ে চিরে ফেলল। মোটামুটি বোঝা গেল- হ্যাংগিং।

স্যার বললেন- গলায় রশি দিয়ে মরা। সুইসাইড। এবার বলো, সুইসাইডের প্রবাবল কজ (সম্ভাব্য কারণ) কি?

আমরা চুপ করে থাকলাম। কিছু বলতে পারলাম না। স্যার হাসলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-হিন্টস দিচ্ছি... ডেডবডি একটি মেয়ের... বয়স কম... সুইসাইড... কি কারণে হতে পারে?
আমরা সবাই বললাম,
-জানিনা স্যার।
-ব্রেইন খাটাও!
-ব্রেইন খাটছে না স্যার।
স্যার হাসলেন। ফিসফিস করে বললেন, 'মেয়ের বাবা-মা বলেছে, তাদের সাথে ঝগড়া হয়নি। মেয়ে বাবা-মায়ের উপর মন খারাপ করে সুইসাইড করেনি। বয়স দেখে তোমরা আন্দাজ করো...আর কি কারণে হতে পারে?'

ভিড়ের ভেতর হতে একজন ছাত্রী বলল,
-প্রেমঘটিত স্যার?
স্যার উচ্চস্বরে বললেন,
-একজ্যাক্টলি... উত্তর কাছাকাছি গেছে...আরো একজ্যাক্ট উত্তর দাও! একটু ভাবো...

আমরা ভেবে কিছুই পেলাম না।
আমাদের ব্যাচের প্রথম পোস্টমর্টেম। আমাদের এরকম বডি দেখার কোন অভিজ্ঞতা পর্যন্ত নেই। স্যার আমাদের লিড দিচ্ছেন প্রশ্নে। তিনি জানেন বলেই লিড দিতে পারছেন। তাকে নিশ্চয় এরকম অনেকগুলো কেইসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এরকম অনেকগুলো কিশোরীর ডেডবডি কাটাছেড়া করে দেখতে হয়েছে।

স্যার আমাদের বললেন,
-মেয়েটার বডির দিকে তাকাও। স্কিনটা কেমন গ্লেজ দিচ্ছেনা? দেখতে বেশ সুন্দরী...ঠিক?
-জ্বি স্যার...ঠিক।
-এবার বডির তলপেটের দিকে তাকাও। কিছু বোঝা যাচ্ছে?

অন্ধকে হাতি চেনানোর মত অবস্থা। আমরা বডির তলপেটে কিছুই দেখতে পেলাম না।  

স্যার ডোমকে নির্দেশ দিলেন।
ডোমসাহেব ছুরির ফলাটা গলায় ঢুকিয়ে দিয়ে  নাভি পর্যন্ত টান দিল।মনে হল...একটানে একটা বড় ট্র্যাভেল ব্যাগের চেইন খোলা হল। স্যার আমাদের বুকের-পেটের সব ভিসেরা দেখালেন। কিশোরীর স্টোমাক(পাকস্থলি) কেটে ফেলা হল। লিভার(কলিজা), ফুসফুস সব কাটাকাটি করা হল। কোন কিছু পাওয়া গেল না। স্যার জিজ্ঞাসা করল,
-কি কারনে সুইসাইড করতে পারে...এখনো বুঝতে পারছ না?

এবার দুই-একজন ছেলে আরেক জনের পিছনে মাথা লুকিয়ে, দুই-একজন মেয়ে লজ্জায় ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে বলল,
-সেক্সুয়াল এসল্ট?

স্যার যথেষ্ট পর্দা এবং গোপনীয়তার সাথে যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করলেন। সেক্সুয়াল এসল্টের সাইন-সিম্পটম নাই।

চল্লিশজন নিশ্চুপ। স্যার আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন,
-আমি তলপেট দেখতে বলেছি... এবার দেখ!

এবার তলপেট কাটা হল। জরায়ু(ইউটেরাস) কেটে একটা মাংসপিন্ড বের করা হল।

আমি নিশ্চত আমার মতো অনেকেই সেদিন কেঁপে উঠেছিল। মেয়ের জরায়ু কেটে একটা নবজাতক বের হল। এতো চমৎকার লাল টকটকে ছোট্ট শিশু আমরা কোনদিন দেখি নি। এত সুন্দর খাড়া নাক, গোলাপী ঠোঁট, লাললাল গাল, আঙ্গুরের দানার মত সুন্দর সুন্দর হাত পায়ের আঙ্গুল...কিশোরীর লাবণ্যময়তার কারণ বোঝা গেল। গর্ভবতী সকল নারীদের মত এই কিশোরীর শরীরেও লাবণ্যতা চলে এসেছে। স্নিগ্ধতা এসেছে।

বাচ্চাটাকে বের করে কাটাছেড়া করা লাবণ্যময়ী কিশোরী মায়ের পাশে আস্তে করে শুইয়ে রাখা হল।

মর্গের ভেন্টিলেটর দিয়ে বেলা তিনটার রোদ আসছে। সরাসরি শিশুটার উপর মুখের উপর রোদ পড়ছে। আমার মনে হচ্ছিল, শিশুটা জেগে যাবে। যেকোন মুহুর্তে জেগে যাবে। ট্যাওট্যাও করে কান্নাকাটি শুরু করবে। এখন হয়তো কাঁদছে না। সম্ভবত গলায় কিছু আটকে আছে। কেউ উল্টা করে পিঠে দুইটা থাবড়া দিলেই শিশুটা জেগে যাবে। কান্নাকাটি করবে।

আচ্ছা! জেগে উঠলে শিশুটা কি করবে?

তাকে মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। কিন্তু তার কিশোরী মাকে তো কাটাছেড়া করা। মৃত শরীর। বুকে দুধ নেই। শিশুটা যদি বুঝতে পারে তার মা মৃত, সে কি করত? শিশুটা যদি বুঝতে পারত যে সে কিশোরী মায়ের সন্তান...যে মা কোন বিচিত্র কারণে তাকে পেটে নিয়েই গলায় রশি ঝুলিয়েছে... পেটের সন্তানকে নিয়েই সহমরণে গেছে... এই তথ্যটা জানলে শিশুটা কি করত?

জানার খুব ইচ্ছা করছে।
ইচ্ছা করলেও উপায় নেই। শিশুটার পিঠে কেউ থাবড়া দিচ্ছে না। কেউ দিবেনা। কার ইচ্ছাও নেই। এটা যুক্তিহীন কাজ। যুক্তিহীন কাজ করার অর্থ নেই।

স্যার পোস্টমর্টেম শেষ করলেন।
মর্গের পাশে ছোট্ট ঘরটাতে গিয়ে আমাদের পার্সেন্টেজ দিলেন।

পার্সেন্টেজ দেওয়া শেষ। এখন ছুটি। স্যার আমাদের মর্গ ছারার আগমুহুর্তে জিজ্ঞাসা করলেন,
-বলতো মেয়েটা কেন সুইসাইড করেছে?
আমরা নিশ্চুপ।
স্যার মৃদ্যু হেসে বললেন,
-হিন্টস দিই?
আমরা নিশ্চুপ।
স্যার বললেন, 'মেয়েটা কিশোরী...সুইসাইড করেছে...কারণ তার পেটে বাচ্চা ছিল...পেটে বাচ্চা আসলে মানুষ সুইসাইড করেনা...কিন্তু এই মেয়েটা করেছে কারন তার এখনো বিয়ে হয়নি...এবার বলো মেয়েটাকে কেন সুইসাইড করতে হল?

আমাদের কেউ জবাব দিলাম না। সবাই ধাক্কা খেয়েছে। বড়সড় ধাক্কা। কেউ কারো দিকে তাকাতে পারছেনা।

ধীরেধীরে মর্গ থেকে সবাই বের হয়ে গেল।

শুধু পেছনে পড়ে রইল একটা লাশকাটা ঘর.. ঘরের মাঝখানে একটা ট্রলি...ট্রলিতে চৌকাঠে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকা এক লাবণ্যময়ী কিশোরীর নিষ্প্রাণ দেহ... একজন কিশোরী মায়ের নিষ্প্রাণ দেহ...কিশোরী মায়ের পাশে শুয়ে আছে একটি চমৎকার শিশু... ভেন্ট্রিলেটর দিয়ে ভুল করে ঢুকে পড়া সূর্যের আলো পড়েছে শিশুর মুখে...






Writer:- ডা. রাজীব হোসাইন সরকার
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner