> বাস্টার্ড | Bustard | Bangla New Story
-->

বাস্টার্ড | Bustard | Bangla New Story

পুরোনো ঢাকার রাস্তাঘাটে দ্রুত গাড়ি চালানোর কথা ভাবাই যায় না। প্রত্যেক রাস্তায় ধারণ ক্ষমতার তুলনায় তিনগুণ গাড়ি চলছে। চলছে বললে আসলে ভুল হবে, থেমে আছে! ট্র্যাফিক জ্যামের সংজ্ঞাই বদলে গেছে এখানে। দিন-রাত কোনো ব্যাপার না, দশ মিনিটের রাস্তা পার হতে হয় এক ঘণ্টায়!

অতিকষ্টে মেইন রোড থেকে বের হয়ে এসে ঢুকলাম গলির ভেতর। এই গলি ঐ গলিতে খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর ইয়াতিমখানার জরাজীর্ণ লোহার ফটক চোখে পড়লো আমার। ড্রাইভারকে জিপ থামাতে বললাম। কড়া ব্রেক কষে থামলো জিপ। ফটকের উপরে বড় একটা সাইনবোর্ড। কোনো এক কালে হয়তো সাইনবোর্ডের লেখাগুলো পড়া যেত। এখন বেশ কসরত করলে রং ক্ষয়ে যাওয়া অক্ষরগুলো পড়া যায়- “লালবাগ আদর্শ এতিমখানা”। নামের নিচে ছোট অক্ষরে আরো কিছু লেখা আছে, যা হাজার কষ্ট করেও আর পড়া সম্ভব নয়! সম্ভবত “স্থাপিত: অমুক সাল” ধরনের কিছু লেখা আছে।

আমি নামলাম জিপ থেকে। জিপের পেছনের দিকে দুজন পুলিশ সদস্য বসে ছিলো, তারাও নামতে চাইলো। আমি ইশারায় তাদের নিষেধ করলাম। যে কাজে এসেছি তাতে এতো লোকের দরকার হবে না।

ইয়াতিমখানার গেটে ধাক্কা দিয়ে বুঝলাম- ভেতর থেকে গেট বন্ধ। আমি কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করার পর একজন খাকি পোশাক পরা দাড়োয়ান এগিয়ে এলো। এই দুপুরবেলা কোনো উটকো ভিজিটর এসেছে ভেবে খুব বিরক্ত। কিন্তু গেট খুলে আমাকে দেখে চমকে উঠলো সে। সঙ্গে সঙ্গে কপালে হাত ঠেকিয়ে সালাম দিলো। আমি মুচকি হাসলাম। আসলে আমাকে না, দাড়োয়ান সালাম দিচ্ছে আমার গায়ের পুলিশের ড্রেসকে। মাথা নেড়ে সালামের জবাব দিলাম আমি।

ইয়াতিমখানার ভেতরে পা রেখেই প্রথমে চোখে পড়লো একটা ছেলেকে ধরে কয়েকটা টুপি পড়া ছেলে বেদম পেটাচ্ছে। আর দূরে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছেলে মজা দেখছে। আমাকে দেখে ছেলেগুলো থেমে গেলো। পুলিশ দেখে ঘাবড়ে গেছে সবাই।

কেয়ারটেকার মতলব মিয়াকে দেখতে পেলাম একটা লাঠি হাতে দৌড়ে আসছে, “ওরে হারামজাদা, বদমাইশ, বেজন্মা! তোগোরে না কইলাম ফাইজলামি-শয়তানী করবি না...” 

ছেলেগুলো সব মতলব মিয়াকে দেখে যে যেদিকে পারে দৌড় পালালো।

কতক্ষণ তাদের ধাওয়া করার পর মতলবের চোখ পড়লো আমার উপর। দাঁত বের করে হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো। “আরে ভাইজান, চইলা আসছেন? স্যার আমাকে বলেছেন আপনি আসতেছেন।”

এই ইয়াতিমখানায় আমি মোটামুটি পরিচিত মুখ। আমার বড়খালু হাজী ইকবাল আহমেদ ইয়াতিমখানার মালিক। প্রতিবছর ঈদ ও অন্যান্য উৎসব উপলক্ষে আমার বাবা-মা এসে ইয়াতিমখানার বাচ্চাদের মাঝে খাবার আর কাপড় চোপড় বিলি করেন। তাদের সাথে আমারও আসতে হয়। 

“ভাইজান, আমার রুমে আইসা বসেন। চা-নাস্তা দেই।” মতলব মিয়া বললো।

আমি না-বোধক মাথা নেড়ে বললাম “সময় নেই মতলব ভাই। কই? সেই চোরটা কই?” 

“অফিস ঘরে বাইন্ধা রাখছি ভাইজান। আসেন আমার সাথে...” 

মতলব মিয়ার পেছন পেছন ইয়াতিমখানার প্রশাসনিক ভবনের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। এখানে পাশাপাশি চার-পাঁচটা রুমে অফিশিয়াল কার্যক্রম চলে। মতলব আমাকে নিয়ে একটা রুমে ঢুকলো। দেখলাম একটা ১৪-১৫ বছর বয়সী ছেলেকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। আমি মতলব কে বললাম, “ওর বাঁধন খুলে দাও। আমি কথা বলবো।” 

মতলব ঠোঁট উল্টে বললো, “কথা বলার তো কিছু নাই ভাইজান! হারামজাদারে হ্যান্ডকাফ পরাইয়া হাজতে নিয়া যান। তারপর ইচ্ছামতো ডলা দেন।”

“আহ! যেটা করতে বলেছি করো তো!”

মতলব মিয়া নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছেলেটির বাঁধন খুলে দিলো। আমি পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে ছেলেটাকে দেখলাম, পরনে একটা সাদা গেঞ্জি আর কালো রঙের প্যান্ট। দুটোই বিভিন্ন অংশে ছেঁড়া, জোড়াতালি দেওয়া। মাথার চুল উস্কো-খুস্কো। নাকে, ঠোঁটে, গালে রক্তের দাগ। বোঝা যাচ্ছে ইতোমধ্যে ভালোই মার খেয়েছে।

“ওকে মেরেছে কে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। 

“পাবলিকে মারছে ভাইজান!” মতলব হেসে উত্তর দিলো, “দোকান থেইকা খাবার চুরি করতে গিয়া ধরা পরছে। পাবলিকে ধইরা প্রথমে পিটানি দিছে। তারপর ইয়াতিমখানায় দিয়া গেছে।”

ছেলেটি যেভাবে মতলবের দিকে তাকাচ্ছে তাতে আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে শুধু পাবলিকের মার নয়, ইয়াতিমখানায় আসার পর মতলব মিয়াও তাকে যথেষ্ট মেরেছে। আমি প্রশ্ন করলাম, “ও এতিমখানার ফান্ড থেকে কত টাকা চুরি করে পালিয়েছিলো?” 

“১২ হাজার টাকা!” বলার সময় ‘হাজার’ শব্দটার উপর বেশি জোর দিলো মতলব।

আমার মেজাজ খারাপ গেলো কথাটা শুনে। ১২ হাজার টাকা! আমার বড়খালু খুব একটা অবস্থাসম্পন্ন মানুষ নন। পেনশনের টাকায় চলেন। অতি কষ্টে বিভিন্ন জায়গা থেকে ডোনেশন এনে তিনি এই ইয়াতিমখানার খরচ চালান। যাদের জন্য তিনি এত কষ্ট করেন, তাদেরই একজন ইয়াতিমখানা থেকে টাকা চুরি করে কীভাবে? এটা নতুন না, আগেও ইয়াতিমখানার ফান্ড থেকে চুরি করে পালানোর ঘটনা ঘটেছে। তারপরও খালু এদেরকে এত ভালোবাসেন কেন? বিষয়টা নিয়ে খালুজানের সাথে আমার প্রায়ই তর্ক হয়। আমার বিশ্বাস এই সব বাপ-মায়ের পরিচয়হীন বেজন্মাগুলো কখনও মানুষ হবেনা। হাজার আদর করলেও এরা বড় হয়ে চোর-বাটপার হবেই! কিন্তু খালু আমার কথা কিছুতেই মানতে চান না!

আমি ছেলেটাকে প্রশ্ন করলাম। “এই বদমাইশ! দোকান থেকে চুরি করতে গেলি কেন? ১২ হাজার টাকা দুদিনেই খরচ করে ফেলেছিস? জুয়া খেলেছিস নাকি?”
 
ছেলেটি স্থির দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো উত্তর দিচ্ছে না।

চোর-ডাকাতের সাথে আমার নিয়মিত ওঠা-বসা। বেশিরভাগ সময় দেখেছি চুরি করে ধরা পড়ার পর চোরের চেহারায় একটা করুন ভাব চলে আসে। যাতে মার-ধোর একটু কম খেতে হয়। দুই একটা চড় থাপ্পড় খেলেই এরা ‘বাবাগো’ ‘মাগো’ বলে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করে। অপরদিকে, কিছু অপরাধী দেখা যায় যারা সচরাচর অপরাধ করে ধরা পড়তে অভ্যস্ত নয়। আর একবার ধরা পড়লেও এদের দেমাগ কমে না! চোখের দৃষ্টি দিয়ে সবাইকে ভস্ম করে দিতে চায়। হাজার মারলেও এরা কাবু হয় না। এদের দূর্বলতা অন্য জায়গায়। বাজে গালাগালি করলে এদের গায়ে খুব লাগে! আমার সামনে বসে থাকা ছেলেটি দ্বিতীয় প্রজাতির অপরাধী। তবে অপরাধী যেমনই হোক, তাকে বশে আনার পদ্ধতি আমার জানা আছে!

আমি শুরু করলাম, “এই শুয়োরের বাচ্চা, কথা বলছিস না কেন?”

ছেলেটা ঝট করে আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। 

মতলব বললো, “দেখছেন ভাইজান? কেমনে তাকায় আছে? লোহার শিক গরম কইরা ওর চোখ দুইটা গাইল্লা দেওয়া উচিত!”

আমি দাঁতে দাঁত পিষে আবার বললাম, “এই বাস্টার্ড! ১২ হাজার টাকা কি করেছিস?”

ছেলেটি এইবার মুখ খুললো। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, “বাস্টার্ড আমার নাম না। আমার একটা নাম আছে... কামাল।”

“কেমন মুখের উপরে কথা বলে বেআদব!” মতলব বললো। "অর মুখটা সিলায় দেওয়ার কাম!"

আমি এগিয়ে গিয়ে কামালের মুখের উপর সপাটে হাত চালালাম। কামাল চেয়ার থেকে দু’হাত দূরে ছিটকে পড়লো। পতনের ধরন দেখেই বুঝলাম ভালো ব্যথা পেয়েছে। কিন্তু তারপরও কোনো চিৎকার না, কান্না না, আবার সেই অগ্নিদৃষ্টি! মেজাজ ঠাণ্ডা রাখা মুশকিল হয়ে গেলো আমার জন্য। 

আমি এগিয়ে গেলাম তার দিকে, “শুয়োরের বাচ্চা! পাতে খেয়ে পাতে মুতিস?” গায়ের জোরে একটা লাথি মারলাম তার পিঠে। “বাস্টার্ড বললে তোর গায়ে লাগে? চুরি করার সময় গায়ে লাগে নাই?”

লাথিটা নীরবে হজম করে নিলো কামাল। 

আমি মতলবকে বললাম, “তোমার লাঠিটা দাও তো”।

মতলব যেন ঠিক এটাই চাচ্ছিলো। হাসিতে তার মুখে সবকটা দাঁত বেরিয়ে পড়লো। 

মতলবের কাছ থেকে লাঠি নিয়ে আমি বললাম, “এখনও সময় আছে! যা জিজ্ঞেস করি তার ঠিক ঠাক জবাব দে। একবার পিটানো শুরু করলে বাপ ডাকলেও আর থামবো না!” 

কামাল একগাদা থুতু ছিটালো মাটিতে। ভাবটা এমন যেন থুতু আমার গায়েই মেরেছে।

রাগে আমার মাথা গরম হয়ে গেলো। দমাদম পেটানো শুরু করলাম। আমি জানি কীভাবে এবং শরীরের কোথায় পেটাতে হয়। হাড় ভাঙবে না, রক্ত বেরোবে না, কিন্তু যতটা ব্যাথা দিতে চাই ঠিক ততটাই পাবে! অবশ্য মাঝেমধ্যে দু একটা বাড়ি খারাপভাবে লেগে যেতে পারে, তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। জন্ম-পরিচয়হীন একটা জারজ ছেলের প্রতি বিন্দু মাত্র মায়া নেই আমার। খালুজান কষ্টের টাকায় এদের ভরণ-পোষণ করেন। অথচ প্রতি বছর শুয়োরের বাচ্চাগুলো ইয়াতিমখানার ফান্ড থেকে টাকা চুরি করে পালায়!

ঠিক কতক্ষন পিটিয়েছি বলতে পারবো না। ঘেমে নেয়ে উঠেছি আমি। হঠাৎ পেছন থেকে খালুজানের কণ্ঠ শুনলাম, “কি করছো কায়সার? পাগল হয়ে গেলে নাকি?”

আমি থামলাম। খালুজান প্রায় দৌড়ে এসে কামালকে ধরলো। কামালের নাক-মুখ রক্তাক্ত। কপালের একপাশেও রক্তের ধারা বইছে। তারপরও সেই একই দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! 

আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “এইসব... এইসব মারে ওদের কিছু হয়না খালুজান। ওকে... আমার কাছে দেন। থানায় নিয়ে কথা আদায় করতেছি।” 

“তোমাকে আর কিছু করতে হবেনা। যা করার আমিই করবো”। খালুজানের কণ্ঠে রাগ। কামালের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। “কিরে বোকা? চুরি করলি কেন? আমার কাছে চাইলেই তো পারতি!”

আমার শত মারেও যা হয়নি, এইবার তা হলো। খালুজানের আদর পেয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলো কামাল। 

চোরদের এই পদ্ধতিও আমার জানা আছে। যার হৃদয় নরম, তার সামনে কান্না-কাটি করলে মাফ পাওয়া যায়, এটা ওরা ভালো করেই জানে। আমি বললাম, “খালু এদের আদর দেবেন না। এরা আপনার খেয়ে আপনার সাথেই বেঈমানি করে। এরা আদর পাওয়ার যোগ্য না”। 

“কে বলেছে এরা আদর পাওয়ার যোগ্য না?” খালুজান এখনও রেগে আছেন আমার উপর। 

আমি আর কথা বাড়ালাম না। বড়খালুকে বোঝানোর সাধ্য আমার নেই। “ঠিক আছে! আপনি আদর করতে থাকেন। আমি গেলাম। কিন্তু বলে যাচ্ছি- এই ব্যাটা আবার চুরি করে পালাবে। পালানোর সময় খুন খারাবিও করে যেতে পারে। যতই আদর করেন না কেন,  বাপ-মায়ের পরিচয়হীন একটা বাস্টার্ড কখনও চোর-ছ্যাঁচোর-সন্ত্রাসী ছাড়া অন্য কিছু হবেনা!”

আমি অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে আসছি। পেছন থেকে শুনছি খালুজান বলছেন, “কথাটা তুমি  ভুল বললে কায়সার। বাবা-মায়ের পরিচয় বড় কথা নয়! নিজের পরিচয়টুকুই আসল। আদর ভালবাসা আর সঠিক দিক-নির্দেশনা পেলে এদের পক্ষে সবই হওয়া সম্ভব। এদের কেউ হবে শিক্ষক, কেউ হবে ডাক্তার, কেউ হবে ইঞ্জিনিয়ার, এমনকি এদের পক্ষে তোমার মত পুলিশ অফিসারও হওয়া সম্ভব... ”
খালুজানের এই অন্ধবিশ্বাস কবে যে দূর হবে কে জানে! তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমি কোনো ভুল বলিনি।

***

সকাল বেলা ডিউটিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। ইউনিফর্ম পরা শেষ, কোমরে বেল্ট লাগাচ্ছি। সুরভী প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে বেডরুমে ঢুকলো। বললো, “এই তুমি নাকি গতকাল খালুজানের ইয়াতিমখানায় গিয়ে এক ইয়াতিম ছেলেকে অনেক মেরেছো?”

আমি কোমরে বেল্ট লাগানোর ফাঁকে বললাম, “খালুজানই আমাকে ফোন করে বলেছিল ব্যাপারটা দেখতে! ব্যাটা ফান্ড থেকে ১২,০০০ টাকা চুরি করে পালিয়েছিলো। আবার বাইরে গিয়ে চুরি করে ধরা পড়েছে।”

সুরভী বললো, “খালুজান তোমাকে বলেছিল ছেলেটাকে একটু ভয় দেখাতে, যাতে ভবিষ্যতে আর চুরি না করে। এমন নিষ্ঠুরের মতো মারতে বলেনি নিশ্চয়ই?” 
“চোর-ছ্যাচোর সহজে ভয় পায় না! মাইর হলো এদের জন্য উত্তম ঔষধ!” 

“তুমি ছেলেটাকে এমন মার মেরেছ যে হাসপাতালে নিতে হয়েছে”। 

আমার বেল্ট লাগানো হয়ে গেছে। হোলোস্টারে পিস্তল রাখছি। বিরক্ত কণ্ঠে বললাম, “এইসব খালুজানের বাড়াবাড়ি। আমি জানি কীভাবে মারতে হয়। হাসপাতালে নেয়ার মত কিছু হয়নি”। 

“তুমি ছাই জানো! এক্ষুনি ছেলেটাকে দেখতে যাও প্লিজ!” সুরভীর কথা শুনে মনে হল কেঁদে ফেলবে।  

আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম, "কক্ষনো না!"

"প্লিজ, একবার গিয়ে দেখে আসোনা কেমন আছে... আমার খুব ভয় হচ্ছে, একটা বাচ্চা ছেলে...” বলতে বলতে কেঁদে ফেললো সুরভী।

যা ভয় পেয়েছিলাম! এই ছিঁচকাঁদুনে মেয়েকে নিয়ে হয়েছে যতো জ্বালা! পুলিশের বৌ হয়েছে, কিন্তু কোনো ধরনের ভায়লেন্স তার সহ্য হয় না! 

আমি কঠিন কণ্ঠে বললাম, “কান্নাকাটি করে কোনো লাভ নেই সুরভী। একটা বাস্টার্ড ছেলের জন্য আমার কোনো মায়া নেই! আমি যাচ্ছি না...” 

সুরভী কাঁদতে কাঁদতে বেডরুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আমি জানি কোথায় যাবে। মায়ের কাছে গিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে পুরো ঘটনা বলবে। তারপর মাকে দিয়ে আমাকে বলাবে কামালকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার জন্য। সুরভী জানে মায়ের কথা আমি ফেলতে পারবো না।

আমার মায়ের স্বভাবও ঠিক সুরভীর মতো। তিনিও ভায়োলেন্স সহ্য করতে পারেন না! আমার এখনও মনে আছে- যেদিন সিদ্ধান্ত নিলাম পুলিশের চাকরীতে জয়েন করবো, সেদিন মা সারাদিন খায়নি। তার মাথায় নানান অমঙ্গল চিন্তা। যদি কোনোদিন সন্ত্রাসীদের সাথে লাগতে গিয়ে আমার কিছু হয়ে যায়? প্রায়ই তো সন্ত্রাসীদের সাথে সংঘর্ষে পুলিশের মৃত্যুর খবর শোনা যায়। “তুই আমার নাড়ি ছেড়া আদরের ধন, তোর কিছু হয়ে গেলে বাঁচবো কি নিয়ে...” ইত্যাদি বলে কেঁদেছিলেন সারাদিন। শেষে বাবা অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে মানিয়েছিলো।
 
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই হয়েছে। পায়ে বুট লাগাচ্ছিলাম এমন সময় সুরভী মাকে নিয়ে হাজির। মা কিছু বলার আগেই আমি মাথা নেড়ে বললাম “আম্মা! তুমি যতই অনুরোধ করো, কোনো লাভ নাই। আমি হাসপাতালে যাচ্ছি না!” 

মা অনুনয় করে বললো, “পাঁচ মিনিটের জন্য একটু দেখে আয় কায়সার! ছেলেটার অবস্থা বেশি ভালো না। ইয়াতিমের অভিশাপ আল্লাহ শোনেন। তোর অমঙ্গল হবে বাবা!” 

আমি হেসে বললাম, “ইয়াতিম যদি চোর-বাটপার হয়, তারপরও আল্লাহ তার অভিশাপ শোনেন?” 

“এভাবে বলিস না বাবা। অল্পবয়সী ছেলে, না বুঝে একটা কাজ করে ফেলেছে! ওকে শুধরানোর একটা সুযোগ তো দেয়া যায়।” 

“সুযোগ দিয়ে কোনো লাভ নেই মা। ঐ ছেলে বড় হয়ে সন্ত্রাসীই হবে...”

“সন্ত্রাসী হয়ে যদি তোর ক্ষতি করে? বিরোধ রেখে লাভ কি বাবা?”

অগত্যা কি আর করা? আমি কাঁধ ঝাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কোন হাসপাতালে আছে?” 

“তুই চিনিস তো! লামইয়া আদর্শ হাসপাতাল। তোর ইউসুফ আংকেলের হাসপাতাল।”

আমি হাসলাম। ইউসুফ আংকেল হচ্ছেন আমার বড়খালুর ছোট ভাই। এনারা দুই ভাই “আদর্শ” শব্দটা খুব পছন্দ করেন। যাই বানান সেখানে “আদর্শ” শব্দটা জুড়ে দেন। সেটা আদর্শ হোক বা না হোক!

***

আমি গাড়ি থেকে নেমে হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকলাম। খালুজানের ছোটভাই ডাক্তার ইউসুফ আহমেদ তৈরি করেছেন এই হাসপাতাল। তার বড়মেয়ে লামইয়ার নামে নামকরণ করেছেন। অবশ্য খালুজানের ইয়াতিমখানার মত দৈন্যদশা নয় এই হাসপাতালের। অনেক নামী-দামি ডাক্তাররা এখানে চিকিৎসা দেন। আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জমও রয়েছে। 

আমি হাসপাতালের রিসিপশনে এসে কামালের খোঁজ বের করলাম। ৬৪৩ নম্বর কেবিন। কেবিনে রাখা হয়েছে একটা চোরকে! ছোটভাইয়ের হাসপাতাল বলে কথা! 
কেবিনে ঢুকে যা দেখবো ভেবেছিলাম, ঠিক তাই দেখলাম। কামাল একটা বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে চাদর গায়ে আধ-শোয়া হয়ে আছে। মাথায় একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা। আজ অবশ্য চোখে সেই অগ্নিদৃষ্টি নেই। আমাকে দেখে একটু হাসলো মনে হলো! কেবিনে ডাক্তার আংকেল ইউসুফ আহমেদও বসে আছেন। এত বড় একজন ডাক্তার এই চোরের চিকিৎসা করছে! নিশ্চয়ই ওনার বড় ভাই বলে দিয়েছেন- “কামালকে তুমি নিজ দায়িত্বে দেখবা!”

“আংকেল কেমন আছেন?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম। 

আমাকে দেখে হাসিতে উজ্জ্বল হলো ডাক্তার ইউসুফের চেহারা। “ভালো আছি, কায়সার। তুমি কেমন আছো বাবা?” 

“জি ভালো আছি।” আমিও হাসলাম। কামালের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, “কি অবস্থা ওর?” 

“মারাত্মক কিছু না। মাথার আঘাতটা একটু খারাপভাবে লেগেছে। তবে আশংকার কিছু নেই। ওষুধ দিয়েছি। আশা করি দুই একদিনের মধ্যেই সেরে উঠবে।”
আমি অজুহাত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, “আসলে মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিলো...” 

“সমস্যা নেই, ঠিক হয়ে যাবে। তুমি বসো, আমি একটু আসছি...” বলে আংকেল উঠে গেলেন। 

আমি এগিয়ে গিয়ে কামালের বেডের পাশে রাখা একটা চেয়ারে বসলাম।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটলো। কেউ কোনো কথা বলছি না। আমি কামালের দিকে তাকাচ্ছি না, কেবিনের ভেতর কি কি আছে দেখছি এক এক করে। কামালও সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থেকে কি যেন ভাবছে। শেষে আমিই নীরবতা ভেঙে বললাম, “চুরিটা কেন করেছিলি?” 

কামাল শান্ত স্বরে জবাব দিলো, “মোবাইল কিনার জন্য”। 

আমি হেসে বললাম, “তোর আবার মোবাইলের শখও হয়?” 

“কেন? এতিমদের শখ করা নিষেধ নাকি? পৃথিবীর যত শখ, সব কি আপনাদের জন্য?” কামালের কণ্ঠে ক্ষোভ প্রকাশ পেলো। 

আমি চুপ করে থাকলাম। আজ কিছুতেই মাথা গরম করবো না ঠিক করেছি।

কামাল বলে চলেছে, “আপনাদের মা-বাপ আছে, শখ হলে চাইলেই টাকা পাবেন শখ মেটানোর জন্য। কিন্তু আমার বাবা-মা নেই। শখ হলে পূরণ করবো কেমন করে…”

কামালের লেকচার চললো মিনিট দুয়েক। চুপচাপ শুনছি। সে থামতেই আমি বললাম, “হুম বুঝলাম। তো... মোবাইল কিনেছিলি নাকি?” 

“হ্যা।” 

“কোথায় এখন?” 

“ছিনতাই হয়েছে”। 

আমি উচ্চশব্দে হেসে উঠলাম। হাসতে হাসতেই বললাম, “তোর শখ হয়েছে তুই চুরি করেছিস, আর ওদের শখ হয়েছে ওরা ছিনতাই করছে। মামলা তো একই!” 

“ঠাট্টা করছেন?” কামালের গলার আওয়াজ কমে এলো। আস্তে করে বললো, “একটা কথা সত্যি করে বলবেন স্যার? আপনার কি মনে হয়? আমি এতিম, এটা কি আমার দোষ?” 

আমি হাসি থামালাম। আমি জানি এটা ওদের দোষ নয়। এটা ওদের বাবা মায়ের দোষ। এইসব ইয়াতিম ছেলেদের বেশিরভাগই জন্ম পরিচয়হীন। প্রনয়ঘটিত অবৈধ সম্পর্কের ফল। নিজেদের কুকীর্তি আড়াল করতে এরা সন্তানকে এতিমখানায় দিয়ে দেয়। সেখানে অনাহারে অর্ধাহারে এরা বড় হয়। এক সময় এতিম খানা থেকে বেরিয়ে আসে কিন্তু সমাজ তাদের সহজভাবে গ্রহণ করে না। তাদের গায়ে “বাস্টার্ড” তকমা লাগিয়ে দেয়া হয়। বেশিরভাগই জীবিকা সংগ্রহের জন্য সন্ত্রাসকে বেছে নেয়। না! এটা ওদের দোষ নয়!

এরপর কিছুক্ষণ সাধারণ কথা বার্তা বললাম কামালের সাথে। দুজনের সম্পর্ক অনেকটা সহজ হয়ে গেলো। কামাল সতঃস্ফুর্তভাবে কথা বলছে আমার সাথে।

“স্যার, আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?”

“আছে সবাই। বাবা-মা, স্ত্রী আছে- নতুন বিয়ে করেছি।”

“ভাই-বোন?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “নেই।”

“হয়নি নাকি মারা গেছে?” কামাল জিজ্ঞেস করলো।

“আমার যখন ২ বছর বয়স, তখন মায়ের একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিলো। অপারেশনের পর তার সন্তানধারণের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়...”

“আর অপারেশনটা হয়েছিলো আমার এই হাসপাতালে....” কথাটা বললেন ডাক্তার ইউসুফ আহমেদ। আমি তাকালাম ডাক্তার আংকেলের দিকে। আবার কেবিনে ফিরে এসেছেন সেটা খেয়ালই করিনি। আংকেলকে দেখে মনে হচ্ছে হারিয়ে গেছেন স্মৃতির পাতায়, “সেই দিনটির কথা আমি কখনও ভুলতে পারবো না! তোমার মা ছিলেন আমার হাসপাতালের প্রথম রোগী। হাসপাতাল উদ্বোধন সেরে আমি কেবল বাড়ি ফিরেছি, এমন সময় শুনলাম তোমার মায়ের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। হাসপাতালে আনা হয়েছে, অবস্থা খারাপ। আমি ঝড়ের বেগে ছুটে এলাম। নিজ হাতে অপারেশন করেছিলাম! খুব ক্রিটিক্যাল অপারেশন ছিলো...”

আমি অবাক কণ্ঠে বললাম, “বলেন কি আংকেল? আম্মা এই হাসপাতালের প্রথম পেশেন্ট ছিলো? এটা তো জানতাম না!”

ডাক্তার ইউসুফ হাসলেন। বললেন, “কোনো ডাক্তার চান না নিকট আত্মীয়ের মধ্যে কেউ তার হাসপাতালে রোগী হয়ে আসুক! যাই হোক, বাদ দাও ওসব। তুমি কি আরও কিছুক্ষণ থাকবে এখানে? কামালকে একটা ঘুমের ওষুধ দেওয়া হবে এখন।”

“না না! আমি যাচ্ছি।” বলে উঠে দাঁড়ালাম আমি।

কামালের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কামাল, তোকে আমি একটা মোবাইল কিনে দেবো। দামি মোবাইল। কিন্তু আমাকে কথা দিতে হবে তুই আর কক্ষনো চুরি করবি না!” 

কামাল মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। মুখে কিছু বললো না। আনমনে কি যেন ভাবছে।

ডাক্তার আংকেলের পিছু পিছু কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়েছি তখন পিছন থেকে কামাল ডাক দিল। “স্যার, একটু শুনুন...” 

আমি ঘুরে দাঁড়ালাম, “আবার কি বলবি?” 

“আপনার বয়স কত জানতে পারি?” 

“কেন?” আমি তো অবাক! 

কামাল একটু আমতা আমতা করে বললো, “আসলে... আমি মনে মনে একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। একদিন আপনার মতো পুলিশ অফিসার হবো। আর... আপনার সমান বয়স হওয়ার আগেই হবো! তাই জানতে চাইছি।”

আমার ঠোঁটে হাসি ফুটলো। “চ্যালেঞ্জ অ্যাক্সেপ্টেড! আমার বয়স ঊনত্রিশ। বিসিএস পাস করে পুলিশ হয়েছি এক বছর হলো।” 

কামালের ঠোঁটে হাসির রেখা দেখা গেলো। সে হাসিতে মনে হলো অন্যরকম কিছু একটা আছে। আমার কেন যেন ভয় লাগলো ওর হাসি দেখে। মাথায় কি মতলব পাকাচ্ছে কে জানে! জিজ্ঞেস করলাম, “আর কিছু জানতে চাস?”

কামাল হাসিটা ধরে রেখে না-বোধক মাথা নাড়লো। 

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি স্টার্ট করে হাসপাতালের গেট দিয়ে বেরিয়ে এলাম। শেষ একবার পেছন ফিরে তাকালাম। এই হাসপাতালের গেট খালুজানের এতিমখানার গেটের মত জরাজীর্ণ নয়। মনে হচ্ছে যেন গতকালই রং করা হয়েছে! সাইনবোর্ডের লেখাটাও সুন্দর করে বড় বড় অক্ষরে লেখা। অনেকদুর থেকেও পড়া যাবে। 

“লামইয়া আদর্শ হাসপাতাল”।
নিচে একটু ছোট করে লেখা- “স্থাপিত: ১৯৮৫” 

কিছুদূর এগিয়ে যেতেই আমার মনে একটা খটকা লাগলো! আমি ব্যাক ড্রাইভ করে আবার ফিরে এলাম হাসপাতালের সামনে। গাড়ি থেকে নামলাম। সাইনবোর্ডের লেখাটা লক্ষ্য করলাম, হ্যা তাইতো! “স্থাপিত: ১৯৮৫” লেখা!

এটা কি দেখছি আমি? আমার জন্ম ১৯৯০ সালে! এই হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছে ১৯৮৫ সালে! অর্থাৎ, আমার জন্মের ৫ বছর আগে! আর আমার মা ছিলেন এই হাসপাতালের প্রথম রোগী! তার মানে বাবা-মা আমাকে মিথ্যা বলেছে! তারা সব সময় বলে এসেছে- মায়ের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে আমার জন্মের ২ বছর পর। আসলে অপারেশনটা হয়েছিলো আমার জন্মেরও ৫ বছর আগে! আর সেই অপারেশনের পর মায়ের ‘মা’ হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো... তাহলে আমি কোথথেকে এলাম? আমার জন্ম হলো কি করে?

কামাল কি তবে এ কারণেই আমার বয়স জানতে চাইছিলো? আমার চোখের সামনে কামালের সেই অদ্ভুত হাসির দৃশ্য ভেসে উঠলো। কানে বেজে উঠলো খালুজানের কণ্ঠ- “এদের পক্ষে তোমার মত পুলিশ অফিসারও হওয়া সম্ভব…” 

আমার চোখের সামনের পৃথিবীটা ভীষণভাবে দুলে উঠলো... 
পায়ের নিচ থেকে মনে হচ্ছে মাটি সরে যাচ্ছে... 
আমি পড়ে যাচ্ছি হাঁটু ভেঙে...







সমাপ্ত...







Writer:- নাজিম উদ দৌলা
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner