বিশ্রী শব্দে কলিং বেল বেজে উঠতেই গা ঘিন ঘিন করে উঠলো আমার। দোকানদার বিক্রির সময় খুব ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছিল- “স্যার, নিয়া যান। বড়ই শ্রুতিমধুর আওয়াজ। শুনলে এতই ভালো লাগবো যে আপনে চাইবেন প্রতিদিন আপনার বাসায় মানুষ আসুক আর কলিং বেল চাপুক”।
প্রথমত, আমি চাইনা আমার বাসায় খুব বেশি মানুষ আসুক। দ্বিতীয়ত, কলিং বেলের আওয়াজ মোটেও শ্রুতি মধুর নয়। বেজে উঠলেই মনে হয় আশে পাশে কোথাও কর্কশ শব্দে কাক ডাকছে। আর সেই কাক যদি ডেকে ওঠে রাত ১১টায়, তাহলে?
এত রাতে আমার কাছে কেউ আসার প্রশ্নই ওঠেনা। বোধহয় পাশের বাসার কেউ ভুলে চেপেছে।
কিন্তু আমি দরজা খুলছি না দেখে আরো একবার কলিং বেল বাজালো আগন্তুক। এবার আমার ভ্রু খানিকটা কুঁচকালো। একই সাথে বিরক্তি এবং কৌতূহল জাগছে! কৌতূহল জাগার কারণ- এতো রাতে সাধারণত আমার কাছে কেউ আসে না। বিরক্তি জাগছে কারণ- সবে মাত্র খাবার টেবিলে সব কিছু সাজিয়ে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এ সময় মানুষজন সামনে থাকা আমার পছন্দ না।
এই ফ্ল্যাটটা আমার দাদার কেনা। বাবা ছিলেন দাদার একমাত্র সন্তান। দাদা মারা গেলেন, দাদি গেলেন, বাবা মাও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন- সবাই মরেছেন এই ফ্ল্যাটেই। এখন আছি আমি একা! অবশ্য সম্পূর্ণ একা কি বলা যায়?
আবার কলিং বেল বাজতেই ভাবনায় ছেঁদ পড়লো আমার। উঠে গেলাম কে এসেছে দেখতে। লুকিং গ্লাসে চোখ রেখে বাইরে দাঁড়ানো লোকটাকে তেমন চেনা যাচ্ছেনা। আমি হেঁড়ে গলায় জিজ্ঞেস করলাম, "কে? কে ওখানে?"
"আমি, আযহার ভাই!" লোকটা উত্তর দিলো। "আমি জামিল।"
জামিল হায়দার! আমার অফিসের কলিগ! হুজুগে টাইপের স্বভাব, অতিরিক্ত কথা বলে! লোকটা এতো রাতে আমার বাড়িতে কি মনে করে এসেছে? আমি দরজা খুলে দিলাম। মুখে সামাজিকতার হাসি ধরে রেখে বললাম, "আসুন জামিল ভাই, হঠাৎ কি মনে করে?"
জামিল হায়দার ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে উত্তর দিলো, "আমার এক আত্মীয়র বাড়ি আপনাদের গলির মুখেই। ওনার কাছে একটা দরকারে এসেছি, রাতে ওখানেই থাকবো। তাই ভাবলাম এক ফাঁকে আপনার কাছ থেকেও ঘুরে যাই"।
"ভাল করেছেন। আমি খেতে বসছিলাম, আপনিও আসুন"।
"আরে না না!"। জামিল হায়দার বেকুবের মত হাসলো। "আমি পরে খাবো ভাই, আপনি খেয়ে আসুন।"
"খামাখা কেন মিথ্যা বলছেন জামিল ভাই?" আমি মুখে অমায়িক হাসি ধরে রেখেছি। "আপনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে আপনার দারুণ খিদে পেয়েছে!"
এয়ার জামিল হায়দার লজ্জা ভেঙে এসে আমার সাথে খেতে বসলো।
খানিকক্ষণ নিরবে কাটলো। জামিল হায়দারই প্রথমে নিরবতা ভাঙলো। "একটা প্রশ্ন করি আযহার ভাই?"
"জি করেন"।
"আপনি এতো ভাল একজন মানুষ! ভাবী কিভাবে পারলো আপনাকে ছেড়ে যেতে?"
প্রশ্নটা শুনে আমার মুখের ভেতর টেস্টিং সল্ট দিয়ে কষিয়ে রান্না করা খাবার হঠাৎ তেঁতো লাগলো। আমি উত্তর দিলাম না, একটু হেসে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।
জামিল হায়দার তবুও নাছোড়বান্দা। বলে যাচ্ছে- "এই যে আপনি এখন উত্তরটা এড়িয়ে যেতে চাইছেন! পিওর ভদ্রলোক যাকে বলে! অন্য কেউ হলে বউয়ের নামে এক গাঁদা অভিযোগ ছুড়ে দিতো! কিন্তু আপনি ভালো মানুষ। আপনি তো কিছুই বলবেন না! বলুন না ভাই? জানতে খুব ইচ্ছে করে! কোনো কথা নেই, বার্তা নেই, হঠাৎ আপনার স্ত্রী আপনাকে ফেলে পালিয়ে গেলো। কিন্তু কেন?"
আমি প্রমাদ গুনলাম! এই লোকের হাত থেকে কতক্ষণে পরিত্রাণ পাবো কে জানে? আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে চেষ্টা করলাম, "এই যে মগজ ভুনাটা নিন জামিল সাহেব! আমার নিজ হাতে রান্না করা। ভালো মজা পাবেন। আর ডালটাও একটু চেখে দেখবেন, জলপাই দেওয়া ডাল, টক টক লাগে, অপূর্ব স্বাদ হয়েছে!"
এরপর আমি নানা প্রসঙ্গে কথা বলে জামিল হায়দারকে আমার স্ত্রী-র প্রসঙ্গ থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু লোকটা ঘুরে ফিরে বারবার ঐ প্রসঙ্গে খোঁচা মারছে। এরকম বিরক্তিকর মানুষ আমি আর দেখিনি। অফিসেও সারাদিন কানের কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যান করে! বসেরাও তাঁকে কিচ্ছু বলে না! আমার তো মাঝে মধ্যে মনে হয় এই লোক বুঝি সারাদিক ঘ্যান ঘ্যান করার বিনিময়েই মাস শেষে অফিস থেকে বেতন পায়! মনোযোগ দিয়ে অফিসের কাজ করছে- তাকে এমন অবস্থায় মনে হয়না কেউ কখনও দেখেছে!
অবশেষে বিরক্তির শেষ সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর আমি বললাম, "আপনি শুনতে চান কেন আমার বউ আমাকে ছেড়ে পালিয়েছে?"
জামিল হায়দার জিভে কামড় দিয়ে বলল, "ওমা! ছিঃ ছিঃ পালানোর কথা আসলো কোথথেকে? আমি এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম উনি কই আছে? কবে ফিরবে ইত্যাদি!"
আমি খুব শান্ত মেজাজে বললাম, "পুরোটা শুনবেন নাকি শেষটুকু?"
"শুনলে পুরোটাই শুনবো… একটু আধটু শুনে নাম করার দরকার আছে?" আনন্দে জামিল হায়দারের চোখ দুটো চক চক করছে! না জানি কতদিন অপেক্ষা করে আছে সে এই ঘটনা আমার মুখে শোনার জন্য! আমাকে উৎসাহ দেয়ার জন্য বললো, “বাই দা ওয়ে! গরুর মগজ ভুনাটা কিন্তু দারুণ হয়েছে খেতে! আর সেই সাথে ডাল! আহ কি অপূর্ব স্বাদ!”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলাম-
“তাহলে গোঁড়া থেকেই বলি শুনুন- এই যে ফ্ল্যাটটা দেখছেন, এটা আমার দাদা কেনা। কিন্তু কেনার কিছুদিন পরই দাদা মারা যান। বাবা ছিলো তার একমাত্র সন্তান। দাদার মৃত্যুর পর এই ফ্ল্যাটে দাদি আর বাবাই শুধু বসবাস করতেন। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে থাকলো। ঠিক রাত ১২টা বাজতেই ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে কেমন যেন খস খস আওয়াজ শোনা যায়। মনে হয় কেউ একজন পা টেনে টেনে হেঁটে যাচ্ছে!”
“তাই নাকি? এতো সাংঘাতিক ব্যাপার!”
জামিল হায়দারের গলায় টিটকারির সুর চিনতে আমার ভুল হলোনা। বুঝলাম ভদ্রলোক আমার কথা কিছুই বিশ্বাস করছেন না! তবুও আমি না থেমে বলে যাচ্ছি-
শব্দটা কেমন যেন অদ্ভুত ধরণের! এমনিতে আমরা যখন ভেতরের রুমে থাকি তখন শোনা যায়, কিন্তু বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে শব্দটা আর শোনা যায় না! অনেক কিছু করেছেন দাদি, কিন্তু কিছুতেই এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পান নি। কেউ-ই যখন এই ব্যাপারে কিছুই করতে পারলো না, তখন আমার দাদি একজন সাধুবাবার শরণাপন্ন হলেন।
সাধুবাবা আমাদের বাড়িতে এলেন। সব দেখে শুনে তিনি বললেন, “তোর পরিবারের ওপর বড় ধরণের অভিশাপ আছে। নিশ্চয়ই তোর স্বামীর পরিবারের পূর্ব পুরুষদের মধ্যে কেউ বিরাট কোনো অপরাধ করেছিল। হতে পারে কোনো অল্প বয়সী নারীকে অত্যাচার করে মেরে ফেলেছিলো। এই অপরাধের কোনো শাস্তি হয়নি। তাই তো ঐ নারীর অতৃপ্ত আত্না তোদের পিছু নিয়েছে। এই বাসা পাল্টেও কোন লাভ নেই! যেখানেই যাস, এই ছায়া তোদের পিছু নেবে!”
দাদি জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু এই অভিশাপ থেকে মুক্তির কি কোনো উপায় নেই?”
জ্যোতিষী উপায় বাতলে দিলেন, “নারী দিয়েই নারী আত্নাকে বশ করতে হবে। তোর ছেলের বিয়ে দিয়ে যখন বাড়িতে বউ আনতে পারবি, তখনই এই সমস্যা দূর হবে।”
দাদি এই কথা বিশ্বাস করেছিলেন কি না জানিনা, কিন্তু জ্যোতিষীর কথায় কাজ হলো। আমার মা যে রাতে এই ফ্ল্যাটে পা রাখলেন, সে রাত থেকেই বাড়ির বারান্দার ঐ খস খস শব্দ বন্ধ হয়ে গেলো। দাদি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন! অবশেষে বারান্দায় অশরীরী আত্মার হাঁটাহাঁটি বন্ধ করা গেছে। সেই স্বস্তি নিয়েই দাদি মারা গেলেন। কিন্তু বাবার কপালে শান্তি বেশিদিন টিকলো না। আমার জন্ম হওয়ার সময় মা মারা গেলেন। ব্যাস! আবার শুরু হয়ে গেল রাত ১২টা বাজতেই বারান্দায় হাঁটাহাঁটি...
আমাকে থামিয়ে দিয়ে জামিল হায়দার বললো, "কিন্তু আপনার এই পারিবারিক ভৌতিক কাহিনীর সাথে ভাবীর পলায়নের যোগসুত্র কোথায়?"
আমি দু সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললাম, “জামিল ভাই, আপনি একটা জিনিস জানেন যে আমি কথার মাঝখানে কথা বলা পছন্দ করিনা? আপনি যদি কথা বলতে চান, বলে যান আমি শুনছি। কিন্তু যদি আমার মুখে কিছু শুনতে চান, দয়া করে চুপ করে থাকবেন!”
জামিল হায়দার ভাতের লোকমা মুখে নিয়ে অদ্ভুত কণ্ঠে বললো, “ওকে ভাই! বলতে থাকেন! আমি আর বাধা দিচ্ছি না!”
আবার শুরু করলাম আমি-
“মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আবার সেই সাধুবার কাছে গেলেন। জ্যোতিষী তখন বুড়ো থুড়থুড়ে হয়ে গেছেন। ঠিক মত কথাও বলতে পারেন না। আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘তোর ছেলে বড় হয়ে বিয়ে করে যেদিন ঘরে বউ আনবে সেদিন থেকে আবার ঐ অশরীরী আত্মা বিদায় নেবে’। কি আর করা? আমি আর বাবা এই বাড়িতে থেকে ঐ শব্দের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতাম। তবে আমি কিন্তু ঐ শব্দে কোনো ভয় পেতাম না! ছোটবেলা থেকে ঐ হাঁটার শব্দ শুনে শুনেই বড় হয়েছি। আমার কাছে ভালোই লাগতো! ভুতের সাথেই যার বসবাস, সে ভুতকে কি করে ভয় পাবে বলুন?”
এই পর্যন্ত বলে আমি হো হো হো করে কিছুক্ষন হাসলাম। জামিল হায়দারও একটু অপ্রস্তুতভাবে হাসলো। এখন মনে হচ্ছে আমার কথা খানিকটা বিশ্বাস করছে লোকটা।
যেমন হঠাৎ হাসতে শুরু করেছিলাম, তেমনি হঠাৎ থামিয়ে দিলাম। কয়েক সেকেন্ড বিরতি। জামিল হায়দারের খাওয়া শেষ পর্যায়ে, ঘটনাটা তার আগেই বলে শেষ করা প্রয়োজন! আমি আবার বলা শুরু করলাম-
আমি বড় হলাম, পড়াশুনা শেষ করলাম। একটা ভালো চাকরী পাওয়ার সাথে সাথেই বাবা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য তড়িঘড়ি শুরু করলেন। বিষয়টা আমার ভালো লাগছিল না। আমি আরও সময় নিতে চাইছিলাম সব কিছু গুছিয়ে ওঠার জন্য। কিন্তু বাবা উঠে পড়ে লাগলেন ভুত তাড়ানোর জন্য। সাধুবাবার সেই বানী বাবা কখনও ভোলেন নি। আমার স্ত্রী বাড়িতে পা দিলেই বারান্দায় বসবাসকারী ঐ অশরীরী আত্মা নাকি পালাবে!
বাবা ডজনখানেক মেয়ে দেখে অবশেষে সোনিয়াকে পছন্দ করলেন আমার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য। সোনিয়া কে বুঝেছেন তো? আপনার ভাবী!
“জি বুঝেছি”। জামিল হায়দার প্রবলবেগে হ্যা-বোধক মাথা নাড়ল। গল্প ক্লাইমেক্সে পৌঁছেছে দেখে খাওয়া ভুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“সাধুবাবার ভবিষ্যৎবানী আবারও সঠিক প্রমানিত হল! সোনিয়া যে রাতে বাসায় এলো সে রাত থেকে ঐ অদ্ভুত খস খস শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। বাবা হাফ ছেলে বাঁচলেন।”
“স্ট্রেঞ্জ!” জামিল হায়দারের মুখ থেকে স্বগোক্তির মতো বেড়িয়ে এলো শব্দটা।
“সোনিয়া নিন্ম-মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধাসিধে মেয়ে। খুব বেশি চাহিদা নেই তার। আমার সংসারটাকে অল্প কদিনেই গুছিয়ে নিলো। পতিভক্তি, শ্বশুরভক্তি, সংসারসেবা- আদর্শ বাঙালী গৃহবধূ। সংসারে আছে সুখের সকল উপাদান। দারুণ কাটছিল দিনগুলি। সব কিছুই ঠিক ছিলো, শুধু একটা জিনিস বাদে!”
এই পর্যন্ত বলে আবার থামলাম আমি। প্রায় সাথে সাথেই জামিল হায়দার প্রশ্ন করলো, তার আর শেষটুকু শোনার তর সইছে না। “কি জিনিস আযহার ভাই? কি ঠিক ছিলোনা?”
“বলছি জামিল ভাই, একটু সবুর করেন।” বলে আমি এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। ইচ্ছে করেই জামিল হায়দারের উত্তেজনা বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। মৃদু হেসে বললাম, “সব ঠিক থাকলেও একটা জিনিসের অভাব ছিলো বাড়িতে।”
“কিসের অভাব?”
“ঐ পায়ের আওয়াজের অভাব বোধ হচ্ছিলো খুব!”
“কি বলছেন আপনি?” অবাক হলো জামিল হায়দার। “আপনারা সারাজীবন আশা করে এসেছেন যে এক সময় ঐ পায়ের আওয়াজ দূর হয়ে যাবে বাড়ি থেকে। যখন সেটা দূর হয়েছে, তার অভাব বোধ হবে কেন?”
"ভুল বললেন জামিল সাহেব"। আমি মুখের হাসিটা ধরে রেখেছি। "আমার দাদি চাইতো ঐ আওয়াজ চলে যাক, বাবাও চাইতেন, কিন্তু আমি চাইতাম না!"
"তার মানে?"
আমি বুঝানোর চেষ্টা করলাম- “একবার চিন্তা করে দেখেন জামিল ভাই। আপনি ছোটবেলা থেকে প্রতিনিয়ত পেয়ে অভ্যস্ত, এমন একটা জিনিস যদি হঠাৎ আপনার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে কি আপনার ভাল লাগবে? লাগবে না! আমারও লাগতো না!”
জামিল হায়দার নাছোড়বান্দার মত বলছে, “কিন্তু সেটা তো ঘটে প্রিয় কোনো বস্তুর ক্ষেত্রে! এটা একটা ভয়ের ব্যাপার! সবাই চাইবে এটা দূর হোক!”
“আবার ভুল করছেন আপনি। আমি কিন্তু একবারও বলিনি ঐ শব্দ শুনে আমার ভয় লাগতো! আমি প্রতিরাতে ঐ শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমাতাম। আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। অভ্যাস না বলে আসক্তি বলতে পারেন, অনেকটা নেশার মতো। যে রাতে ঐ আওয়াজ দূর হয়ে গেলো, সে রাত থেকে আমি আর ঘুমাতে পারতাম না!”
“তারপর?”
“তারপর আর কি?” আমি একটু হাসলাম। এক চামচ ডাল তুলে নিলাম পাতে। “যে কারণে আওয়াজ আসতো, সেই কারণ দূর করার চেষ্টা করলাম!”
“এবার বুঝেছি!” উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেলো জামিল হায়দার! “এবার বুঝেছি কেন সোনিয়া ভাবীর মতো এমন ভাল মানুষ ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন! কষ্টে! আপনি নিশ্চয়ই সোনিয়া ভাবীর ওপর অনেক অত্যাচার করেছেন যাতে উনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হন!”
“আবার ভুল করছেন মশাই!” আমি হাসি মুখে বললাম। “আপনি দয়া করে বসুন, আমি বুঝিয়ে বলছি!”
জামিল হায়দার নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসলো। রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। ভাবটা দেখে মনে হচ্ছে যেন সোনিয়া তার আপন বোন ছিলো!
আমি বললাম, “আমি কি একবারও বলেছি যে আপনার ভাবী পালিয়ে গেছে?”
“পালায় নি! আপনি তাড়িয়ে দিয়েছেন!”
“কোনটাই ঠিক নয়!”
“তাহলে কি ঠিক?”
আমি দার্শনিকের মতো বললাম, “হতে পারে সে হয়তো এ বাড়িতেই আছে। অথবা কোথাও নেই!”
“অসম্ভব” চেঁচিয়ে উঠলো জামিল! “আপনার বাড়ি থেকে ভাবীকে ব্যাগ ব্যাগেজ সহ দৌড়ে বেড়িয়ে যেতে দেখা গেছে! সবার ধারণা ভাবী পালিয়ে গেছেন!”
“তাই নাকি? সবাই ধারণা করলেই তা সত্যি হয়ে যাবে?”
“মিথ্যাই বা হবে কেন?”
আমি কৌতুক বলার মতো করে বললাম, “আপনি যে মগজভুনা দিয়ে মজা করে ভাত খাচ্ছেন, আমি তো একবারও বলিনি যে ওটা গরুর মগজ ভুনা! আপনি তো ঠিক তাই ধরে নিয়েছেন! তাই বলে কি আপনার ধারণাই সত্যি হয়ে যাবে?”
আমার দিকে এক মুহূর্ত নিশ্চুপ থাকিয়ে থাকলো জামিল হায়দার! তারপর মুখ খুললো, তোতলাচ্ছে- “তা... তারমানে? এ... এটা কীসের মগজ? আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিলো... গ... গরুর মগজ তো খেতে এতো মজা হয় না...”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “আপনার ভাবীর গুনের কোন শেষ নাই জামিল ভাই! তার আরও একটা গুণ আজ আবিষ্কার করলাম আমরা দুজনে মিলে! কি বলেন?”
জামিল সাহেব চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালো, মুখটা রক্তশুন্য ফ্যাঁকাসে দেখাচ্ছে। চোখ মুখ কুঁচকে চেহারায় অদ্ভুত এক বিকৃত ভাব করলো। ভেতর থেকে ঠেলে আসা বমি অনেক কষ্টে আটকানোর চেষ্টা করলে যেমন হয়! এরই ফাঁকে বলতে থাকলো, “আ... আপনি একটা স্যাডিস্ট! আ... আপনি একটা সাইকো! আ... আমি বলে দেব! স... সব বলে দেব! পুলিশকে সব কিছু বলে দেব!”
“তাই নাকি? সব বলে দেবেন?” আমার চোখে কৌতুক খেলা করছে।
“হ্যাঁ হ্যাঁ! বলে দেব!”
আমি টেবিলের ওপর রাখা ফল কাঁটার ছুড়িটা হাতে তুলে নিলাম। এক হাতে ছুরিটার ধার পরীক্ষা করছি। যদিও ফল কাঁটার ছুড়ি, কিন্তু চাইলে এটা দিয়ে অনেক কিছুই করা যায়! জামিল হায়দার আমার দিকে আতংকিত চোখে তাকিয়ে আছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “জামিল সাহেব? আপনি কি এখানে আসার আগে কাউকে বলে এসেছেন?”
জামিল হায়দারের মুখটা রক্তশূন্য ফ্যাঁকাসে আকার ধারণ করলো। চোখদুটো বলছে- সে এখানে আছে তা কেউ জানে না!
“আপনি এতো ভয় পাচ্ছেন কেন জামিল ভাই?” আমি ছুরিটা আবার টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলাম। মুখে সপ্রতিভ হাসি। বললাম, “আপনি পুলিশকে কি বলে দেবেন? বলার মত এখানে আছেটা কি?”
জামিল হায়দারের চোখ মুখ একটু উজ্জ্বল হলো এবার! “আপনি এতক্ষণ আমার সাথে মশকরা করেছেন তাই না আযহার ভাই?”
আমি কিছু না বলে ঠোঁট টিপে মুচকি মুচকি হাসছি।
জামিল হায়দার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। “ওহ! আযহার ভাই! আপনি পারেনও! ভয়ে জান উড়ে গিয়েছিল আমার।” জামিল হায়দার আবার পায়ে পায়ে হেঁটে এসে চেয়ার টেনে বসলো। “এটা ঠিক যে আমি আপনাকে সব সময় এটা ওটা প্রশ্ন করে জ্বালাই। তাই বলে এভাবে ভয় দেখাবেন আমাকে?”
আমি মুখে হাসিটা ধরে রেখেছি।
আরও কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল।
তারপর...
ঘড়িতে বাজে ঠিক রাত ১২টা!
বারান্দা থেকে ঐ খস খস শব্দটা আবার ভেসে এলো, কেউ যেন পা টেনে টেনে হাঁটছে। আহ! বড় শান্তি লাগে এই শব্দ শুনতে পেলে!
আমি আবার ফল কাঁটার ছুরিটা হাতে নিলাম। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি জামিল হায়দারের দিকে। জিজ্ঞেস করলাম, “আর একটু মগজ ভুনা খাবেন নাকি জামিল সাহেব?”
জামিল আমার দিকে তাকিয়ে আছে রক্তশূন্য ফ্যাকাসে দৃষ্টিতে!
সমাপ্ত...
Writer:- নাজিম উদ দৌলা