সময়টা তখন মাঝরাত।হুট করেই খুলে গেল নীরার ঘরের জানলা।অবশ্য হুট করেই নয়।জানালার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি বহু কসরত করে ,বহু সময় ব্যয়ে জানালার একটা পাল্লা খুলতে পেরেছে।নীরা তখন বিছানায় ঘুমিয়ে কাদা।পাশে তার গায়ে হাত- পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে তার চাচাতো বোন কুসুম।আপাদমস্তক কালো চাদরে ঢাকা মানুষটি একবার হাত বাড়িয়ে, নীরার চুলগুলো ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। একদম শান্ত,কোমল একটা স্পর্শ। তবে দিলো না।অভাবনীয় ইচ্ছেগুলোকে জোরেসোরে ধমক দিয়ে গিলে নিলো।বলিষ্ঠ হাতগুলো চাদরের ভিতর ঢুকিয়ে, সেখান থেকে বের করলো চারভাজ করা ফকফকে সাদা রঙা একটা কাগজ।ঢিল মেরে ছুড়ে দিলো নীরার বিছানার উদ্দেশ্যে।বিছানায় পরলো না কাগজ।জায়গা করে নিলো নীরার পড়ার টেবিলে। ব্যক্তিটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজও লক্ষ্যভ্রষ্ট। জানালার পাল্লাটা আলতোহাতে টেনে দিয়ে আড়াল হয়ে গেল সারি সারি বাঁশগাছের আড়ালে।
***
বর্ষার একটি সুন্দর সকাল।আশেপাশে ভিজে মাটির গন্ধ।টুপটুপ করে ঝরছে পাতাছোয়া জল।শেষরাতে একচোট বৃষ্টি হয়েছে।তার দরুন মাটিভেজা,গাছভেজা এমনকি কাঠের দরজার সামনে বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে রাখা কুসুমের তোতাপাখির খাঁচাটা পর্যন্ত আধভেজা।বৃষ্টির দিনে আলসেমিরা ঘিরে ধরে।বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছেই করে না।নীরার এখন সেই দশা।ফজরের সময় একবার নামাজের জন্য ডেকে গেছে তার মা।কুসুম উঠে গেছে তখনি।শুধু নীরাই পরে আছে বিছানায়।ঘুমায়নি, ঘুমের ভান ধরে আছে।
নীরার মা, নামাজ শেষ করে হাতে বাঁশের চকচকে কঞ্চি নিয়ে দ্রুতপায়ে নীরার ঘরে ঢুকলো। নীরার ফর্সা পায়ের পাতায় ঠাসঠাস দু- ঘা লাগিয়ে দিলো।লাফিয়ে উঠলো নীরা।অগোছালো চুলগুলো পিঠের পেছনে ফেলে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো মায়ের দিকে।
---" উঠতেসি তো আম্মা।"
---" এতক্ষণ লাগে ক্যান? তুই মুসলমানের বাচ্চা না? নামাজের সময় কী তোর জন্য বইসা থাকে?"
দ্রুত পায়ে খাট থেকে নিচে নামে নীরা।এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যাওয়ার আগেই আবারো পেছন থেকে ডাক দেয় তার মা।
---" ওড়না নেস না যে? মাইয়া মানুষ ঘুমের মাঝেও ওড়না রাখে শরীরে।আর তুই?"
ওড়না মাথায় জড়িয়ে প্রায় দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় নীরা।এখানে থাকলে মা আরো ভুল ধরবে।
ফজরের নামাজের পর ঘুমানোর কোনো নিয়ম নেই নীরাদের বাড়িতে।বাবা- কাকারা সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। তাই, সকাল সাতটার মাঝেই এবাড়িতে সকালের নাস্তা তৈরি হতেই হবে।সুসময় - দুঃসময় যাই হোক না কেন।অবশ্য,নীরা নিজেই ঘুমায় না।ঘুমাবে কী করে?মা - চাচিরা কাজ করার সময় মুখটাকে একটু বন্ধ করে রাখতে পারে না।চিৎকার- চেঁচামেচি করতেই হবে।একটা বাড়িতে কতগুলো মানুষ থাকে।সবাই একটা করে শব্দ বললেই অনেকগুলো কথা হয়।নীরাদের যৌথ পরিবার। নীরার বাবারা চার ভাই।চার ভাই এখনো একসাথেই আছে।চারজনে একসাথে ব্যবসা করছে।বেশ মিল তাদের মাঝে।তাই ঘরের বৌদের মাঝে হিংসা থাকলেও ভাতের হাঁড়ি আজো আলাদা হয়নি।
নীরা নামাজ পরে ঘর থেকে বেরিয়ে পরলো।আশপাশটা ঘুরে দেখবে একটু।কুসুমকে পেল না হাতের কাছে।প্রতিদিন দুজন একসাথেই বের হয়।আজ কুসুমকে না পেয়ে সাবধানী পায়ে একাই বের হলো।স্যাতস্যাতে মাটি,জায়গায় জায়গায় কাদা।নীরা ঘর থেকে বেরিয়ে প্রথমেই বাঁশের সাথে ঝুলানো আধভেজা তোতাপাখির খাঁচা নামিয়ে রাখলো।বেচারা তোতাপাখি!চোখ বন্ধ করে কাপাকাপি করছে।নীরা খাঁচা নামিয়ে রাখতেই চোখ মেলে তাকালো তোতাপাখি।নীরা মৃদু হেসে বলল,
---" শুভ সকাল,পিটুশ।কুসুম তোমাকে নামিয়ে রাখে নি কেন? তুমি একদম ভিজে গেছ।কুসুম পচা,তাইনা? বলো, কুসুম পচা,কুউউসুম পওওচা।"
তোতাপাখি কি বুঝলো কে জানে! হুট করেই রিনরিনে গলায় বলে উঠলো,
---" নীরাপু অটোপাশ।"
চমকে উঠলো নীরা।কে শেখালো একে? নীরা কিছু বলার আগে আবারো পিটুশ বার দুয়েক " নীরাপু অটোপাশ,নীরাপু অটোপাশ " বলে জপ করলো।নীরা পিটুশকে একপ্রকার ছুড়ে ফেললো ঘরের ভেতর।
"বেয়াদব তোতাপাখি।পড়ালেখা বুঝিস তুই? আবার অটোপাশ অটোপাশ করছে।বেশি বেশি ফাজিল।"
নীরা ওড়নার আঁচল আঙুলে জড়িয়ে হাটা দিলো পশ্চিমের পুকুর পাড়ের দিকে।এতো সকালে ওইদিকে থাকে না কেউ।নীরা পুকুরের কাছে যেয়ে দেখলো পাড়ে বসে দাঁত মাজছে ইশরাক।সম্পর্কে সে তার চাচাতো ভাই।বংশের সবচেয়ে বড় ছেলে।কুসুম ও ইশরাক দুই ভাই- বোন।ইশরাক নীরাকে দেখে মৃদু হাসলো।মুখ ধুয়ে বললঃ" আজ তোর সাথী কই রে?"
---" কি যানি কই গেছে কুসুম।সকাল থেকে দেখিনি।"
---" এদিকে যাস না।জোক অনেক।"
---" আচ্ছা।"
নীরা ফিরে যাওয়ার আগে আবারো পিছু ডাকলো ইশরাক।
---"রাতে ঘুমানোর আগে ভালোভাবে দরজা, জানালা লাগিয়ে ঘুমাবি নীরা।আর মেজ কাকা'কে বলবি নতুন খাট বানিয়ে দিতে।খাট - জানালা দুটোই নিচু।জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়েই তোদের গলা টিপে ধরা যায়।বুঝলি কী বললাম?"
ইশরাক আর দাঁড়ালো না।নীরা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো ইশরাকের দিকে।জানালা তো নীরা আঁটকেই ঘুমায়।আর ইশরাক ভাই কী করে জানলো জানালা ও খাটের খবর।নীরার জানালার পিছনে অনেক বাঁশগাছ।সচরাচর সেখানে কেউ যায় না।ইশরাকের তো যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।সে সকালে দোকানে চলে যায়, আসে রাতে।তাছাড়া, নীরা ও কুসুম বড় হওয়ার পর থেকে ইশরাক অনুমতি ছাড়া কখনোই ওদের ঘরে ঢুকে না। তাহলে??
***
গোসল করে সবে বসেছে নীরা।দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে।চুল থেকে গামছা খুলে দড়ির সাথে মেলে দিলো।কোথা থেকে দৌঁড়ে এলো কুসুম।হাতে খাতা কলম।
---" নীরাপু ফিন্যান্সের একটা অংক মিলতেসে না।একটু মিলিয়ে দেও না।"
---" অন্যকারো কাছে যা। আমিতো অটোপাশ।তুই তো জানিস আমি কিছুই পারি না।"
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো কুসুম।পিটুশকে কথাটা শেখানো উচিত হয়নি।
---" আর হবে না নীরাপু।স্যরি। "
হুট করেই তেড়ে এলো নীরা।
--" সবাইকে শিখিয়ে এখন আমায় স্যরি বলো তাই না? পারবো না আমি। যা এখান থেকে?"
কুসুম অসহায় চোখে অনুনয়ের সুরে বললঃ দেও না নীরাপু,প্লিজ।অংকটা না করতে পারলে রেদু ভাইয়া আজ আমায় একশবার কান ধরাবে।চিন্তা করতে পারো তুমি? মান- ইজ্জত সবশেষ।"
শেষ কথাটায় গলে গেল নীরা।মনে পরলো,শেষবার নীরা যখন পড়া পারেনি, তখন তাকেও একই শাস্তি দিয়েছিল রেদোয়ান।কুসুম বাঁচিয়েছিল নীরাকে।
---"আর বলবি আমাকে অটোপাশ? সরকার এখনো আমাদের ব্যাচরে অটোপাশ দেয় নাই, গাধা।"
---"আর কখনো বলব না,কসম।"
---" যা টেবিলের থেকে ক্যালকুলেটর নিয়ে আয়।"
কুসুম খুশিমনে ক্যালকুলেটর খুঁজতে গেল।পেয়েও গেল এক সেকেন্ডে।আরো একটা জিনিস পেল সাথে একটা ফকফকে সাদা কাগজ।কুসুম কাগজটার ভাঁজ খুলে দেখলো কয়েকটা লাইন লেখা তাতে।চার - পাঁচটা হবে বোধহয়।
---" কীরে কুসুম এতোক্ষণ লাগে?"
কুসুম কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বললঃ " এটা পেলাম আমি তোমার টেবিলে।"
---" দেখি কি এটা।"
নীরা কাগজটা হাতে নিয়ে পড়া শুরু করলো।
নীরা,
যখন - তখন বাইরে যাও কেন?খুবই খারাপ অভ্যাস এটা।এখন বর্ষার দিন, পথঘাট পিচ্ছিল।আছার খেয়ে পরলে কেমন হবে তখন? আর যেন কখনো না দেখি।আর পশ্চিমের পুকুর পাড়ে যাবে না।অনেক জোক সেখানে।প্রয়োজনে গেলেও সাথে লবন নিয়ে যাবে।মনে থাকে যেন।
ইতি
তোমার নাম পুরুষ।
পুরো চিঠি জুরেই হুমকি- ধমকি।কুসুম হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো নীরার দিকে।নীরার দৃষ্টি জানালার ওপারে বাঁশগাছের দিকে।কেন যেন কেবল ইশরাকের কথা মনে পড়ছে।
কুসুম চিঠির কথা শুনে প্রথমেই যা বলল তা হলো,
---" নীরাপু তুমি প্রেম কর? আমারে বললে কী হইতো,আমি কী কারো কাছে বলতাম?খুবই দুঃখ দুঃখ লাগতেসে আমার।"
---" এটাকে তোর প্রেমপত্র মনে হয়?"
নীরার প্রশ্নে কুসুম চিঠিটা ছিনিয়ে নিয়ে বার দুয়েক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল।তিন - চারবারের মতো পড়লো। তারপর অনেক ভেবেচিন্তে বলল,
---" এখন আর প্রেমপত্র মনে হচ্ছে না।মনে হচ্ছে, তোমারে হুমকি দিচ্ছে।লেখাগুলোতে কেমন মারকুটে ভাব, খেয়াল করসো?"
---" হুম।তুই তো সবে আজকে দেখলি।আমি সেই গত দুমাস থেকে দেখছি।"
কুসুম অবাক হয়ে গেল।গত দুমাস!
---" মানে? তুমি গত দুমাস থেকে এমন চিঠি পাও?"
---" হুম।দাড়া, দেখাই তোরে।দরজাটা লাগায় দে।"
কুসুম দরজা লাগিয়ে খাটে যেয়ে বসলো।নীরা তার আলমারি খুলে জামা- কাপরের ভিতর থেকে আরো কতগুলো চিঠি বের করলো।দশ - বারোটা হবে বোধহয়। চিঠিগুলো নিয়ে কুসুমের সামনে বসতেই হাতাহাতি শুরু করলো কুসুম।
---" আহ,আস্তে কুসুম।"
---" কোন চিঠিটা আগে পাইসো?
নীরা কয়েকটা চিঠি খুলে সেখান থেকে একটা কুসুমের হাতে দিলো।চোখ দিয়ে ইশারা করলো পড়ার জন্য।
নীরা
তোমাকে আমি আজ অনেক সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলাম।ভালো লেগেছে তোমাকে।একটু না, অনেকখানি।তোমার সরলতাটুকু বেশি ভালো লেগেছে।
ইতি
তোমার নাম পুরুষ।
---" ব্যস এতোটুকুই?"
---" হুম।"
কুসুম চিঠিগুলো নড়াচড়া করে আরেকটা হাতে নিলো।বালিশে হেলান দিয়ে নীরাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়া শুরু করলো।
নীরা
তোমার পা অনেক বেড়ে গেছে, তাইনা? এতো বেড়ানোর শখ কেন? করোনার সময় লকডাউন দিয়েছে ঘরে থাকার জন্য।আর তুমি লেখাপড়া বাদ দিয়ে ঘুরতে চলে গেছ।ফাজিল মেয়ে।আমার মন চাচ্ছে, তোমার পা কেটে আলু দিয়ে রেঁধে খাই।অনেকদিন মানুষের মাংস খাই না।অবশ্য,তুমি তো মানুষ না। তুমি হলে গাধী,একদম জংলী গাধী।নাহয়, এইসময় কেউ খালার বাসায় ঘুরতে যায়?
ইতি
তোমার নাম পুরুষ।
চিঠি পড়ে হা করে রইলো কুসুম।কয়েক সেকেন্ড পর অবাক কন্ঠে বললঃ" নীরাপু,ব্যাটা দেখি ব্যপক ফাজিল।কতোবড় সাহস! তোমারে অপমান করে আবার হুমকিও দেয়।চিন্তা করতে পারো? "
নীরা চিঠিগুলো তুলে রেখে বললঃ " লেখাগুলো দেখেছিস কী বাজে।তোর লেখার চাইতেও খারাপ"।
সায় দিলো কুসুম।
---" হুম, অনেক বাজে লেখা।আমি তো ভাবতাম একা আমার লেখাই খারাপ।এখন দেখি না, আমি ভুল ছিলাম।আমার জাতভাই আরো আছে পৃথিবীতে। কিন্তু, তুমি এগুলা মেজমারে দেখাও না কেন? "
---" তুই পাগল কুসুম? আম্মারে দেখানো মানেই প্রশ্ন কামানের সামনে দাঁড়ানো।হাজারটা প্রশ্ন শুরু করে দিবে আম্মা।তোকে কেন দেয়,কারো সাথে সম্পর্ক আছে নাকি,সম্পর্ক না থাকলে টেবিলের উপর চিঠি আসলো কীভাবে,,ব্লা,ব্লা,ব্লা।"
---" তোমার কথায় যুক্তি আছে নীরাপু।কিন্তু তুমি এগুলো নিজের কাছে কেন রাইখা দিসো?"
---" ওই ব্যাটারে যদি কখনো সামনে পাই, এইগুলা ওর চেহারায় ছুঁড়ে মারব।তাই।"
---" ভালো বুদ্ধি।কিন্তু, ইতি নাম পুরুষ কেন লেখে? "
---" কী জানি?"
হুট করেই কুসুম হেসে ফেললো। নীরা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই ছন্দে ছন্দে বলল,
--" আমি,তুমি ছাড়া
ভবে আছে যারা
তাহারাই নাম পুরুষ।
এই পত্র প্রেরককে খঁজতে কী করবে তুমি এখন?"
***
দুপুরের দিকে আবারো শুরু হলো বৃষ্টি। একদম মুষলধারে বৃষ্টি যাকে বলে।নীরা ও কুসুম ঘর থেকে বেড়িয়েছে মাত্র।উদ্দেশ্য খাবারের ঘর।নীরাদের রান্নাঘরের পাশে খাবারের জন্য ছোট একটা ঘর আছে।সেখানেই মাদুর পেতে বাড়ির সবাই একসাথে খায়।অবশ্য,সবাই একসাথে না।বাড়ির পুরুষেরা খেয়ে যাওয়ার পর মেয়েরা একসাথে বসে।ঘরের সামনেই একফালি উঠোন।উঠোনের মাঝে একটা টিউবওয়েল। টিউবওয়েলের চারপাশে পাকা করা।তার থেকে দু- পা এগিয়ে গেলেই রান্নাঘর ও খাবার ঘর।তার পাশেই দুটো টয়লেট,গোসলখানা।উঠোনের উত্তরদিকে আলাদা পাকা করা একটা রুম।এই রুমে থাকে রেদোয়ান।
নীরা ও কুসুম বৃষ্টির জন্য ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পেল না।দাঁড়িয়ে রইলো দরজার কাছে।নীরার পাশ দিয়ে একছুটে বেড়িয়ে গেল ইরা ও তোহা।ইরা; নীরার আপন ছোট বোন ও তোহা তার সেজো কাকার মেয়ে।নীরা চিৎকার করে ডাকলো দুই বোনকে।
---" ইরা,তোহা; বৃষ্টি থামলে বের হওয়া যায় না? জ্বর যদি আসে,তাইলে খবর আছে তোদের।"
যাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা, তারা পাত্তাও দিলো না।একদৌড়ে খাবারের ঘরে পৌঁছে নীরাকে চিৎকার করে বললঃ" আমরা কি তোমাদের মতো ভীতু? জ্বরের ভয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকব?"
ইরা, তোহা ওদেরকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দু'বার "ভীতু,ভীতু "জপ করে ঢুকে গেল ঘরের ভেতর।
বৃষ্টির তোড় কমে এসেছে অনেকটাই।নীরা ও কুসুম পা টিপেটিপে ঘর থেকে বের হলো।এমন সময় ওদের সামনে দৌড়ে এলো তওসিফ।তওসিফের সারা শরীর বৃষ্টির পানিতে ভিজে জবজবে হয়ে আছে।তওসিফ হুট করেই সামনে চলে আসাতে, কুসুম তাল সামলাতে না পেরে পড়েই যাচ্ছিল প্রায়।পিছন থেকে তাকে আঁকড়ে ধরলো নীরা।কুসুম কপালের সীমান্ত পর্যন্ত ওড়না টেনে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।রাগে চোখদুটো লাল হয়ে আছে মেয়েটার।
---" এগুলো কেমন ধরনের আচরণ, তওসিফ ভাইয়া?"
অনুশোচনা দেখা গেল না তওসিফের চেহারায়।বরং, দাঁত কেলিয়ে বললঃ" ভয় পাইলি নাকি,কালী? এতো ভীতু কেন তুই?"
এমন এক বিশ্রী সম্বোধনে ফুঁসে উঠলো কুসুম।
---" আমার একটা নাম আছে তওসিফ ভাই।আমার নাম কি আপনার মনে নেই? মস্তিষ্ক কী রাস্তা ঘাটে ফেলে এসেছেন?"
---" আহা,রাগ করস কেন? মেয়েরা মোমের মতো নরম হয়।কালো মেয়েরা আরো বেশি নরম হয়।আশেপাশে খেয়াল কইরা দেখিস।"
কুসুম কিছু বলার আগেই তাকে থামিয়ে দিলো নীরা।তওসিফকে উদ্দেশ্য করে বললঃ" ওর গায়ের রঙ কালো তা আপনাকে কে বলল? শ্যামলা মেয়েদেরকে কখনো কালো বলে না।আর তাছাড়া কালো যদি হয়েই থাকে, তাতে আপনার সমস্যা কী তওসিফ ভাই? ওর দায়িত্ব তো আর আপনাকে নিতে হচ্ছে না।বড় ভাই, বড় ভাইয়ের মতো থাকেন।নিজের সম্মান নিজে ধরে রাখতে শিখেন।আর কুসুম, তুই কী পাগল? সবার কথায় গুরুত্ব দিয়ে রেগে যেতে হবে কেন? রাগটুকু তুলে রাখ।রাগ জায়গামতো দেখাতে হয়।ভবিষ্যতে কখনো যেন না দেখি সবার কথার গুরুত্ব দিতে।আমাদের চারপাশের সবাই সমান গুরুত্বপূর্ণ হয় না।কিছু আবর্জনাও হয়।বুঝেছিস?"
কুসুমের হাত ধরে টেনে সামনের দিকে নিয়ে গেল। পিছনে ফেলে গেল ক্রুদ্ধ তওসিফকে।
তওসিফ তোহার ভাই।নীরার থেকে চার বছরের বড় সে।এই বয়সেই স্বভাব এতোটা জঘন্য হয়েছে, যা বলার বাহিরে।তওসিফের জন্য নীরার সেজোকাকা মানুষের সামনে মাথা তুলে পর্যন্ত দাঁড়াতে পারে না।তওসিফ কয়েকমাস আগে, ইভটিজিং এর অপরাধে জেলেও গেছে।বহু কষ্টে তাকে ছাড়িয়ে এনেছে বাড়ির বড়রা।যতই খারাপ হোক, নিজেদেরই তো রক্ত।রক্তের টান খুবই ভয়াবহ।সহজে এড়ানো যায় না একে।তবে,সেই ঘটনার পর থেকে নীরা ও কুসুম এড়িয়ে চলে তওসিফকে।যেই ছেলে বাহিরের মেয়েদেরকে সম্মান করে না, সে কখনো ঘরের মেয়েদেরকেও সম্মান করতে পারে না।এটাই নীরা ও কুসুমের অকাট্য যুক্তি।
***
নীরা খাবার ঘরে যেয়ে দেখলো ইরা ও তোহা এখনো খাওয়া শেষ করেনি।আয়েশ করে ভাত চিবোচ্ছে দু- জনে।সাথে হাজার কথা।কার গরু চুরি হয়েছে,কার পুতুলের বিয়ে দেয়া এখনো বাকি,এইবার মেলা কেন হবে না,ভাইরাসে কীভাবে মানুষ মারা যায়... এসব কথা।নীরা দুটোকে রামধমক দিয়ে এগিয়ে গেল ছোট চাচির দিকে।ছোট চাচিকে নীরার খুব ভালো লাগে।সহজ - সরল একটা মানুষ।অল্পতেই অস্থির হয়ে যায় আবার অল্পতেই খুশি হয়।নীরার ছোট চাচির নাম রুমা।তিনি তার তিন বছরের মেয়েকে ভাত খাওয়াচ্ছেন।নীরা তার চাচির পিছনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল টেনে কোমড় ঢেকে দিলো।মুখে বললঃ" শাড়ি সামলাতে না পারলে পর কেন? অন্য কিছুই তো পরা যায়।"
---" তোমার কাকা রাগ করে শাড়ি না পরলে।"
---" হাহ!শরীর তোমার আর পোশাক ঠিক করে দেবে আরেকজন? আশ্চর্য! "
নীরার কথায় পিছন থেকে ফোড়ন কাটলো তার সেজো কাকি।
---" মাইয়া মানুষের নিজের বলতে কিছু থাকে না, এইটা জানো না নীরা?হেগোরে পানি হওয়া লাগে,যাতে সবকিছুর লগে মিশ্যা যাইতে পারে।এতো বড় বড় বই পড় অথচ এইটি জানো না?
নীরা জবাব দিলো না।চুপ করে রইলো।সেজো চাচি প্রচন্ড মুখরা।সাথে তর্কবাজ।নিজে যা ঠিক মনে করবে তাই করবে।হইচই করতেও ওস্তাদ তিনি।তাই বাড়ির কেউ খুব একটা পাত্তা দেয় না তাকে।এই যে এখনো যে তিনি অনর্গল বাজে বকছেন, তাও নীরা কিছুই বলবে না।
---" বুঝছো রুমা,কী যুগ যে আইলো! আঠারো বছর হওয়ার পরেও মাইয়াগো বিয়া দেয় না।আমাগো সময় পনেরো বছরে বিয়া না দিলেই হইছিলো। গেরামের মাইনশে জুতা মারতো বাপ- মার মুখে।আর কথাও কইতে পারতাম না আমরা।হাহ! এহনকার মাইয়ারা যেই বেদ্দপ।আমরা এতো বেদ্দপ আসিলাম না।আমগো সময়...
---" আপনাদের সময়ে তো মেয়েরা ফিসফিস করে কথা বলতো।অথচ, আপনার কথার আওয়াজে আমি ঘরেই থাকতে পারলাম না।ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না, কাকি?"
নীরা অবাক হয়ে তাকালো দরজার দিকে।এই মুখরা কাকির কথার জবাব দেয়ার কী দরকার ছিল? এখন তো কুরুক্ষেত্র বানিয়ে ফেলবেন তিনি!
রেদোয়ানের কথায় অবাক হয়ে গেলেন নীরার সেজো চাচি সাহানা। হাতে থাকা চামচটাকে ভাতের হাঁড়িতে সজোরে ছুড়ে ফেললেন।মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন,
---" কী কইলা তুমি?"
রেদোয়ান ঘরে ঢুকে ধপ করে ইরার পাশে বসে পরলো।মুখে বললঃ" মানে বললাম যে,আমি তো শুনেছি আপনাদের সময়ে মেয়েরা ফিসফিস করে কথা বলতো। আপনি তো সেদিন বললেন নীরাকে,এখনকার মেয়েরা নাকি চেচিয়ে কথা বলে।কিন্তু,আজ আপনার গলার আওয়াজে আমি ঘরেই টিকতে পারলাম না।দৌড়ে আসতে হলো।আপনিও কী ইদানিং এখনকার মেয়েদের মতো হয়ে যাচ্ছেন নাকি,কাকি?"
রেদোয়ানের কথার ধরনে কুসুম ও নীরা হেসে ফেললো। রুমাও মুখে শাড়ির আঁচল গুজে হাসলো।ইরা ও তোহা কথার মানে বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলো সবার দিকে।সাহানা বেগম যেন আর কথাই খুঁজে পেলেন না।কেবল মাথায় আঁচল দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পা বাড়ালেন।রেদোয়ানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রেদোয়ানকে শুনিয়ে শুনিয়েই বললেন---" হতভাগা, মুখপোড়া, শয়তান। "
রেদোয়ান সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।এমন সময় ঘরে ঢুকলেন নীরার মা জয়নব।বর্তমানে, এবাড়ির বড় বউ তিনি।বাড়ির কর্ত্রীও বটে।মাকে ঢুকতে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল নীরা।ইরাও শান্ত মেয়ের মতো ভাত গুছিয়ে খাওয়া শুরু করলো।রাশভারী এই মানুষটাকে সবাই যেমন ভয় পায়,তেমনি শ্রদ্ধাও করে।জয়নব বেগম, ধীরপায়ে যেয়ে ভাতের হাঁড়ির সামনে পিড়ি পেতে বসলেন।তিনটে প্লেট নিলেন ভাত বাড়ার জন্য।
---" নীরা, কুসুম ভাত খাইতে আসোছ
না কেন?"
---" আসতেসি মেজোমা।"
কুসুম মাদুরের এক অংশে বসলেও নীরা পিড়ি পেতে একটু দূরে বসলো।রেদোয়ানের সামনে বসলে কেমন যেন অস্বস্তি আসে শরীরে।তিনটি প্লেট তিনজনের দিকে এগিয়ে সরঞ্জামাদিও এগিয়ে দিলেন।রুমা তার মেয়েকে খাইয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।পিছন থেকে তাকে ডাক দিলেন জয়নব বেগম।
---" রুমা কই যাও? ভাত খাইবা না?"
---" আপনাগো সাথে খামু ভাবি।ওরা খায়া উঠুক, আমি ততোক্ষণে টুনিরে ঘুম পারায়া আসি।"
---" আচ্ছা, যাও।"
নিশ্চুপে ভাত খাচ্ছে তিনজন।ইরা, তোহা উঠে গেছে অনেক আগেই।রেদোয়ানের আজ খেতে একদম ইচ্ছা হচ্ছে না।জ্বিভ তিতে হয়ে আছে।একটু আগে মাথায় দু- তিন ফোটা বৃষ্টির পানি পরেছিল।রেদোয়ানের আবার বৃষ্টি সয় না।বৃষ্টির পানি শরীরে লাগলেই জ্বর আসে।রেদোয়ান বিরসমুখে দু- তিন লোকমা ভাত গিললো।নাহ, আর সহ্য হচ্ছে না।ভাতের প্লেট ঠেলে উঠে দাঁড়ালো রেদোয়ান।
---" কী হইলো রেদু বাবা? ভাত শেষ করলা না যে?"
---" ভালো লাগছে না খালামনি।মনে হয় জ্বর আসবে।"
ব্যস্ত হয়ে পরলেন জয়নব বেগম।
---" কী কও বাবা,এই সময়ে জ্বর কেন আইবো? শরীর কী বেশি খারাপ লাগতাসে?"
---" ব্যস্ত হবেন না খালামনি,আমি ঠিক আছি।আর জ্বর যদি আসেই, একটা নাপা খেয়ে নেব।
কুসুম, পিটুশকে কি দুপুরে খাবার দিয়েছ?"
কুসুম মাথা নাড়লো দু'দিকে। যার অর্থ, সে দেয়নি।
---" আচ্ছা, আমি দিয়ে দিচ্ছি।আর তোমরা আজকে একটু তাড়াতাড়ি পড়তে এসো।ঠিকাছে?"
কুসুম কিছু বলার আগেই জয়নব বেগম বললেনঃ" আজকে পড়ানো লাগবোনা। তুমি যায়া ঘুমায়া থাক।"
সন্তুষ্টির হাসি হাসলো রেদোয়ান। এই মানুষটা তাকে এতো ভালোবাসে কেন?
--- " তোমার ছেলে এতোটাও অসুস্থ হয়নি খালামনি।ওদেরকে আমি পড়াতে পারব।"
রেদোয়ান এবাড়ির আপন কেউ না।নীরার কেমন যেন লতায়- পাতায় ভাই হয় সে।খুব ছোট বেলায় রেদোয়ানের বাবা- মা মারা গেছে।তারপর থেকে সে চাচা- চাচির কাছে থাকতো সিলেটে।ভালোই ছিল সেখানে।বেশ কয়েকবছর পর তার চাচা-চাচি সিদ্ধান্ত নেয় তারা আর এই নোংরা দেশে থাকবে না।রেদোয়ানের চাচাতো ভাই ইতালিতে ও চাচাতো বোন আমেরিকায় থাকে।তার চাচা- চাচি মনস্থির করে ইতালিতেই সেটেল হবেন দু- জনে।যেই ভাবা সেই কাজ।রেদোয়ানের বয়স তখন বোধহয় সতেরো। তাকে হোস্টেলে রেখেই তার চাচা- চাচি পাড়ি জমায় ইতালিতে।মাসে মাসে রেদোয়ানের জন্য টাকা পাঠাতো তার চাচা।এইভাবেই চলে গেছে এতোগুলো বছর।রেদোয়ানের পড়ালেখা শেষ হয়েছে,চাকরির প্রস্তুতি নিয়েছে।যেই না চাকরি যুদ্ধে নামবে,তখনি দেশে আসলো করোনা।ঘরে ঘরে মৃত্যু, বাইরে লকডাউন।হাতে থাকা টিউশনিগুলো সব ছুটে গেল।বিশ্বে ইতালির অবস্থা তখন ভয়াবহ।প্রতিদিন মৃত্যু দেখতে দেখতে জমে গেছে তারা।ইতালি থেকে টাকা আসা বন্ধ হয়ে গেল।রেদোয়ানের তখন কঠিন অবস্থা।পকেটে টাকা নেই,হাতে কাজ নেই।সবশেষে উপায়ান্তর না পেয়ে গ্রামের জায়গাগুলো বেচার সিদ্ধান্ত নিলো।দলিলপত্র হাতে নিয়ে বহুকষ্টে চলে এলো গ্রামের বাড়ি।গ্রামে আপন বলতে নীরার পরিবার ছাড়া বিশেষ কেউ নেই।এখানেই এসে উঠে রেদোয়ান।বেশ যত্ন- আত্তি করে সবাই।একসময় জয়নব বেগম জানতে পারেন রেদোয়ানের গ্রামে আসার কারণ।তিনি নিষেধ করেন যাতে কিছুতেই জায়গাটুকু না বেচে রেদোয়ান।বাবা - মায়ের স্মৃতি বলতে রেদোয়ানের ঝুলিতে এতুটুকুই তো আছে।নীরার বাবাও নিষেধ করেন।রেদোয়ান নিজেও চিন্তা করে, সত্যিই তো এইটুকু ছাড়া তার আর কিইবা আছে।পরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত। রেদোয়ান চলে যেতে চাইলেও তাকে কিছুতেই ছাড়েন নি জয়নব বেগম।মা- বাপ ছাড়া কোথায় কি খাবে ছেলেটা, কে জানে! রেদোয়ান আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পরে এ সংসারে।এবাড়ির সব মেয়েদের ওই পড়ায়।কয়েক জায়গায় অনলাইনে সিভি জমা দিয়েছে।যদি একটা চাকরি হয়।একটু- আকটু ফ্রিল্যান্সিংও করছে।অন্যের বাসায় থাকা সম্ভব কিন্তু অন্যের টাকায় পকেট চালানো তো আর সম্ভব নয়।
***
নীরা ব্যাগ কাঁধে যখন রেদোয়ানের ঘরে ঢুকেছে তখন রেদোয়ান চশমা চোখে দিয়ে ল্যাপটপে কি যেন করছে।নীরা ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে নিলো।একটা বিছানা, একটা টেবিল,দুটো চেয়ার ও একটা সেগুন কাঠের আলনা।এই ঘরের আসবাব।ঘরের জিনিসগুলো এতো গোছানো, যা দেখে মাঝে মাঝে নীরা নিজেই অবাক হয়। পুরুষ মানুষ এতো গোছানো হয়! রেদোয়ান বাহাতি।খাওয়া বাদে বাকি সব কাজই সে বা হাত দিয়ে করে।
---" আজ কি ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?"
লজ্জা পেলো নীরা।তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকে সালাম দিলো রেদোয়ানকে।
সালামের উত্তর নিয়ে রেদোয়ান জিজ্ঞেস করলো কুসুমের কথা।
--- " ও দশ মিনিট পরে আসবে ভাইয়া।"
---" ঠিকাছে।তাহলে বসো তুমি। এই দশ মিনিট আমরা বইয়ের বাইরে কথা বলি।লাস্ট যেই বইটা দিয়েছিলাম,সেটা পড়েছ?
---" দেনা- পাওনা বইয়ের কথা বলছেন তো? পড়েছি।"
---" কেমন লাগলো?"
---" খুব ভালো একটা বই।দারুন লেগেছে।"
--- "কোন চরিত্রটা বেশি ভালো লেগেছে?"
---" ষোড়শী। উফ! কী সুন্দর জীবানান্দের সব কথায় ঠাস ঠাস উত্তর দেয়।"
---" জীবানান্দকে ভালো লাগেনি?"
---" একটু একটু ভালো লেগেছে।ব্যাটা কী বজ্জাতিটাই না করলো প্রথমে।তবে ওর একটা কথা খুব ভালো লেগেছে।"
---" কোনটা?"
---" ওই যে, মাঝরাতে ষোরশীর ঘরে বসে যে বলে,
যত্ন জিনিসটায় মিষ্টি আছে সত্যি
কিন্তু তার ভান করায় না আছে মধু না আছে স্বাদ।"
***
সন্ধ্যা নামবে বোধহয় কিছুক্ষণের মাঝেই।আকাশ আবার কালো হয়ে এসেছে।বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা আছে।নীরা, ইরাকে বগলদাবা করে ছুঁটছে পুকুরের দিকে।সেদিকে একটা জাম গাছ আছে।হঠাৎ করেই জাম খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। ইরাতো কিছুতেই যাবে না। সে হাঁড়ি- পাতিল খেলতে বসেছিল।নীরা অনেক্ষণ তেল মেখে নিয়ে এসেছে তাকে।অবশ্য,সাথে করে লবন নিয়েছে সেই নাম পুরুষের কথামতো।বলাতো যায় না,বর্ষার দিন।যদি জোকে ধরে।নীরা বাইরে বেড়িয়ে দেখলো রেদোয়ান পিটুশকে কথা শিখাচ্ছে।বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ঢুকছে ইশরাক।তার সারা শার্ট- প্যান্টে কাদার ছড়াছড়ি। ইশরাককে সবার প্রথমে ইরাই দেখলো।সে দৌড়ে গেল বড় ভাইয়ের দিকে।
---" কী হইসে ভাইয়া তোমার?"
---" আর বলিস না বোন, আসার সময় পিচ্ছিল কাদায় পরে এই অবস্থা।"
ইশরাকের কথা শুনে এগিয়ে এলো রেদোয়ান ও নীরা।রেদোয়ান উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলোঃ" বেশি ব্যাথা পেয়েছেন নাকি ভাইয়া?"
---" নারে ভাই।আল্লাহ বাঁচাইসে।মনে হয় হাঁটুর দিকটা একটু ছিলে গেছে।"
ইশরাক নীরার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলোঃ" কোথাও যাচ্ছিস তুই?"
---" হ্যাঁ, ভাইয়া।পুকুর পাড়ে যাব একটু।তোমার শার্টটা দেও,ধুয়ে দেই।"
--- "পারবি তুই?"
---" হুম,পারব।"
ইশরাক শার্ট খুলতে খুলতে বললো ---" কুসুম কই?"
---" কোথায় থাকে এইসময়?"
---" আশ্চর্য! এই বৃষ্টির দিনে কী করতে গেছে সেখানে? তুই নিষেধ করিসনি?"
---" আমার নিষেধ ও শোনে নাকি? তুমি একটু ধমক দিয়ো ওরে।"
ইশরাক নীরার হাতে শার্ট ধরিয়ে দিয়ে বললঃ" সাবধানে পা ফেলিস।আর ধুতে না পারলে ধোয়ার দরকার নেই।"
নীরাদের পুকুর পাড়ের শেষ প্রান্তে অনেক সুপারি গাছ।সুপারি গাছের ওইপাশেই বড় রাস্তা।পুকুর পাড়ের উত্তরদিকে নীরাদের পারিবারিক কবরস্থান।পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়েই বড় রাস্তার পথচারী দেখা যায়।নীরা ঘাটের শেষ সিঁড়িতে বসে শার্ট ধোয়ার কাজে লেগে গেল।কিছুক্ষণ পরেই, কেমন অস্বস্তি লাগা শুরু করলো নীরার।তার মনে হচ্ছে কেউ তাকে দেখছে।নীরা কাজ থামিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখলো আশেপাশে।নাহ,কেউ নেই।মনের ভুল ভেবে আবারো কাজে হাত দিলো নীরা।
নীরা যদি ভালোভাবে খেয়াল করতো তবে দেখতে পেত, কেউ একজন দু- চোখ ভরে দেখছে তাকে।শেষ বিকেলের নরম আলোয় সেই চোখজোড়ায় জড়িয়ে আছে,অসাধারণ মুগ্ধতা।।
চলবে...
Writer:- হালিমা রহমান