নীরা আঠারো নম্বর চিঠিটা পেল আজ সকালে।সেই আগের মতোই, একটা সুন্দর সাদা কাগজে কয়েকটা লাইন। লেখাগুলো এতো জঘন্য! নীরা ভেবেই পায় না, এই সুন্দর কাগজটা নষ্ট করার মানেটা কি?যে ওকে এই চিঠিগুলো পাঠায়, সে নিশ্চয়ই বয়সে ছোট নয়।এতো বড় একটা মানুষের লেখা এরকম কীভাবে হয়! নীরা চিঠি নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়।যার ইচ্ছে হচ্ছে দেক।কিন্তু, খচখচানি বলতেও একটা শব্দ আছে পৃথিবীতে। না চাইতেও মাথায় চলেই আসে, কে দেয় এসব চিঠি?কে এতো পর্যবেক্ষণ করে নীরাকে?
কোথা থেকে রুমের ভিতর উড়ে এলো কুসুম।ছিনিয়ে নিলো নীরার হাত থেকে চিঠিটা।এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললো দুটো লাইন।
নীরা
তুমি ভয়াবহ বিধ্বংসী। তোমার অনুরোধ তোমার মতোই ভয়াবহ,কিছুতেই ফেলে দেয়া যায় না।
ইতি
তোমার নাম পুরুষ।
---"বাহ! লাইনগুলো তো বেশ।কিন্তু, লেখাগুলো এরকম কেন, নীরাপু?"
---" আমি কী করে জানব?"
---" সেটাও একটা কথা।"
কিছুক্ষণ চুপ করে দু- জনেই চিঠির দিকে চেয়ে রইলো। কয়েক সেকেন্ড পর কুসুম নিজেই মুখ খুললো।
---" আচ্ছা নীরাপু,আগের চিঠিটা পাওয়ার পর তুমি কার কাছে অনুরোধ করেছিলে? "
---"মানে?"
---" মানে বলছি যে, এখানে তো অনুরোধ করার কথা বলা আছে।এই চিঠির আগের চিঠিটা পেয়েছিলে কালকে।তার মানে তুমি নিশ্চয়ই কালকে কারো কাছে অনুরোধ করেছ।কার কাছে করেছিলে,তা যানতে পারলেই তো কেল্লা ফতে।আমরা দুজন যেয়ে ওই নাম পুরুষের গলা টিপে ধরব।ভালো না বুদ্ধিটা?"
কুসুম চওড়া হাসলেও, নীরার মুখে আষাঢ়ের মেঘ ছেয়ে গেল মূহুর্তে। এই কথাটা যে তার মাথায় আসেনি ব্যাপারটা তেমন নয়।নীরার স্পষ্ট মনে আছে সে সারাদিনে শুধুমাত্র ইশরাকের কাছে অনুরোধ করেছিল। নীরার মনে হলো কুসুমের সাথে এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা উচিৎ। মেয়েটা ছোট হলেও অবুঝ নয়।
---" কুসুম তোকে কিছু কথা বলি? কিছু কিন্তু মনে করতে পারবি না।"
---"কী বলবা নীরাপু? তোমারে এমন লাগতেসে কেন?"
---" আমার না কেন যেন মনে হয় চিঠিগুলো ইশরাক ভাই পাঠায়।"
অবাকের পরের শব্দটা বোধহয় মহাঅবাক।কুসুম ঠিক মহা অবাক হয়ছে।মুখটা হা হয়ে গেছে তার।ইশরাক!!! কিন্তু, তা কীভাবে সম্ভব?
কুসুম অবাক কন্ঠে বললঃ " তুমি কী নিশ্চিত? ভাইয়ার এমন কোনো আচরণ চোখে লেগেছে তোমার?"
নীরা গতকাল সকালের পুকুর পাড়ের কথা ও বিকালের শার্ট ধোয়ার অনুরোধের কথা সব খুলে বলল।সবকিছু শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো কুসুম। নীরার মনে হচ্ছে, ও কথা সাজিয়ে নিচ্ছে।
বেশ অনেক সময় পার হওয়ার পর কুসুম মুখ খুললো।
---" নীরাপু,তুমি যা বললে তার দুটো মানে হয়।তোমার কথা শুনলে মনে হয় ইশরাক ভাই করছে এগুলো। কিন্তু, ভালোভাবে ভেবে দেখলে বুঝা যায় ব্যাপারটা কাকতালীয় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।"
নীরা কিছুই বলল না কেবল শান্ত চোখে চেয়ে রইলো।
---" ইশরাক ভাইয়ার লেখা আমরা চিনি।এতো জঘন্য কখনোই নয় তার লেখা।দ্বিতীয়ত,চিঠিতে তোমাকে কেউ একজন পুকুর পাড়ে যেতে নিষেধ করেছে জোকের জন্য।তেমনি সকালবেলা,ইশরাক ভাইয়াও তোমাকে নিষেধ করেছে। কিন্তু তুমি চিন্তা করো, তোমার যায়গায় আমি থাকলেও ইশরাক ভাই একই কাজ করতো।শুধু আমি কেন বাড়ির যে কেউ যেতে চাইলেই ইশরাক ভাই নিষেধ করতো।এ থেকে বুঝাই যায় ইশরাক ভাই কখনোই নাম পুরুষ হতে পারে না।আচ্ছা, তুমিই বলো ভাইয়া কি কখনো আমাদের চার বোনকে আলাদা করে দেখেছে?"
নীরা মাথা নাড়লো। অসহায় কন্ঠে বলল,
---" কিন্তু, তুই ভেবে দেখ কুসুম জানালার কথা, খাটের কথা, অনুরোধের কথা সব কেন শুধু ইশরাক ভাইয়ার দিকেই ইঙ্গিত করে?চিঠিগুলো যেই দেক সে নিশ্চয়ই বাড়ির ভিতরের কেউ।আর কাল বিকেলে সেখানে ছেলেদের মধ্যে শুধু ইশরাক ভাই ও রেদু ভাইয়াই ছিল।রেদু ভাইয়া নিশ্চয়ই এগুলো করবে না।তার লেখাও আমরা জানি।তাহলে?"
---" তুমি শুধু শুধু এতো চিন্তা করছো, নীরাপু।ইশরাক ভাই এই বাড়িতেই থাকে।আমার সাথে বহুবার কথা বলার জন্য ভাইয়া এঘরে এসেছে।তাই খাট - জানালার কথা জানা এমন কঠিন কিছু নয়।আচ্ছা, সব বাদ দেও শুধু এতুটুকু চিন্তা কর ভাইয়া যদি তোমাকে অন্য চোখে দেখেই থাকে তবে তা মুখে বলবে।আমার ভাইকে তো আমি চিনি।তোমার মাথায় গিঁট লাগানোর মতো এতো বুদ্ধি তার নেই।যে ছেলে এখনো রাস্তা- ঘাটে আছাড় খেয়ে পরে, সে নাকি আবার পাঠাবে চিঠি।হাহ! পাগল আরকি।এমন তো হতেই পারে চিঠিগুলো বাইরে থেকে আসে।"
কুসুমের কথায় আশ্বস্ত হলো।ওর কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মতো না।নীরার মন থেকে মনে হয় একটা পাথর সরে গেল।সকাল থেকেই মনে হচ্ছিলো ইশরাক বদলে গেছে।আগের মতো নেই।এবাড়িতে ইশরাকের একচেটিয়া জনপ্রিয়তা। তওসিফ বখে গেছে বলেই হয়তো সব আদর - আবদারের ভাগ ইশরাকের ঝুলিতে জমা হয়েছে।ইশরাক মানেই বোনদের আবদারের স্থান,বড়দের ভরসা।সেই ইশরাকই যদি বদলে যেত তবে সবচেয়ে দুঃখ নীরার হতো।নীরার আপন বড় ভাই নেই।ছোট থেকেই ইশরাক ও তওসিফকে নিজের ভাই হিসেবে জেনেছে।বাড়ির বড় মেয়ে হিসেবে নীরা ছোট বেলা থেকেই প্রচুর আদুরে।ছোটবেলা থেকে ইশরাক কত কত আদর করেছে ওকে।সব স্মৃতিগুলো যেন চোখের উপর দিয়ে দৌড়ে চলে গেল।চওড়া হাসি হাসলো নীরা। নাহ,ইশরাকের কথায় আচরনে যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা হলো স্নেহ, অপত্য স্নেহ।এগুলো কিছুতেই কামনা হতে পারে না।
কুসুমের কথায় ঘোর কাটলো নীরার।
---" কালকে আমি যখন বিকালে কবরস্থানে ছিলাম,তখন চেয়ারম্যান কাকার ছেলেরে দেখসি আমাদের বাড়ির দিকে উঁকি দিতে। আমার চোখে চোখ পরতেই চলে গেছে সেখান থেকে।"
---" উনি না ঢাকায় থাকে?"
---" থাকতো। কবেই তো গ্রামে আসছে।"
***
রেদোয়ানের শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে।মাথাটার ওজন মনে হচ্ছে চল্লিশ কেজি।কাথা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে খাটে।রেদোয়ানের শরীরের চাইতে মনটা বেশি খারাপ।চাকরি কী হবে না? কতদিন আরেকজনের বাড়িতে পরগাছার মতো থাকতে হবে? রেদোয়ানের যে এখনো অনেক স্বপ্ন ছোঁয়া বাকি।সেগুলো কী আদোও পূরণ হবে নাকি স্বপ্নই থেকে যাবে? জানে না রেদোয়ান। ভাবতেও পারে না।মাথাটা চক্কর দিচ্ছে খুব।মনে হয় এখনি খুলে পরে যাবে।
***
কুসুমের বাবা আজ বাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যার দিকেই।শরীরটা ভালো যাচ্ছে না ইদানিং। ঘরে ঢুকেই বাতি জ্বালিয়ে বসলেন তিনি।রুমটা ঠিক আগের মতোই আছে।মমতা ঠিক যেরকম সাজিয়ে রেখেছিল সেভাবেই আছে।পার্থক্য শুধু আগে এই ঘরটাকে সাজিয়ে রাখত মমতা, এখন রাখে কুসুম।কুসুমের মা মমতা বেগম মারা গেছেন আজ থেকে দু- বছর আগে।এরকমই বর্ষা ছিল তখন।এক বর্ষার দুপুরে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়েছিল।বাতাসের ঝাপটায় উঠোনের সুপারি গাছগুলো মনে হচ্ছিলো মাটিটাকে ছুঁয়ে দেবে।কী বজ্রপাতটাই না হয়েছিল সেদিন! মনে হচ্ছিল আকাশ বুঝি দু- ভাগ হয়ে যাবে।এমন ভয়ংকর দুপুরে মমতা বেগম বেড়িয়েছিলেন মুরগি খুজঁতে।হতভাগা মুরগি ঝড়ের আভাস পেয়ে কোথায় লুকিয়েছিল কে যানে! সাধের মুরগি খুঁজতে সেই যে মমতা বেগম বেড়িয়েছিলেন আর ফিরেননি ঘরে।বজ্রপাতে মারা গিয়েছিলেন তিনি।কুসুম তখন ক্লাস এইটে পড়ে কেবল।মায়ের মৃত্যু যেন এক লহমায় মেয়েটাকে বড় করে ফেললো। কান্নাকাটি বাদ দিয়ে ভেঙে পরা বাবা ও ভাইকে সামলে নিলো।আজকাল মমতার কথা খুব মনে পড়ে কুসুমের বাবা,জনাব ইদ্রিসের।ছোট- খাটো মেয়েটা এ সংসারে এসেই যেন বড় হয়ে গেল।কুসুম একদম মায়ের চেহারা পেয়েছে।যখনই মমতার কথা খুব মনে পরে, তখন ইদ্রিস আলী মেয়েকে দু- চোখ ভরে দেখে।মেয়ের হাসি দেখলেই মনে হয় এইতো মমতাই হাসছে।
বাবার খাবার হাতে ঘরে ঢুকলো কুসুম।ইদ্রিস আলী তখন পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসেছিলেন। কুসুম ঘরে ঢুকে কিছু বলল না।খাবারের প্লেট টেবিলের উপর রেখে বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। এওটা তার নিত্যদিনের অভ্যাস।ইদ্রিস আলী মৃদু হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
---" আম্মাজানের কী খবর?"
---" ভালো।"
---" সন্ধ্যায় কিসু খাইসেন?"
---" না,তোমার সাথে খাব।"
---" আমি এখন কিছু খামু না আম্মাজান।ভালো লাগতাসে না।আপনে খায়া নেন।ঠিকাসে?"
---" আচ্ছা।তোমার আজকে মায়ের কথা খুব মনে পরছে, তাই না বাবা?"
চুপ করে রইলেন ইদ্রিস আলী। মেয়েটা কী করে বুঝে যায়! তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বললেনঃ" তুমি নাকি এই বিষ্টি - বাদলার দিনেও কবরস্থানে যাও? কথাডা কী সত্য?"
কুসুম হাসলো।নিশ্চয়ই নীরা নালিশ করেছে।
---" আম্মাকে আমার খুব মনে পরে, বাবা।বিকাল হলেই মনে হয় যেন কবরটা আমায় ডাকছে।জানো, মায়ের কবরের উপর একটা শিমুল তুলার গাছ হয়েছে।কী সুন্দর টকটকে লাল রঙের ফুল ফুটে সেখানে!"
---" আর যায়ো না আম্মা।বিষাক্ত পোকামাকড়ও থাকতে পারে।"
---" চেষ্টা করব।আচ্ছা, বাবা তোমার কখনো আমার জন্য নতুন মা আনতে ইচ্ছে হয়নি?"
হাসলেন ইদ্রিস আলী। মেয়ে এই প্রশ্ন প্রায়ই করে।
---" না, আম্মা।আমার ভয় হয় যদি আপনার নতুন মা আমার আম্মারে কষ্ট দেয়, তহন কী করুম আমি?"
কুসুম জানে এটা কেবল তাকে ভুলানোর জন্যই বলেছে বাবা।সত্যিটা হলো, বাবা এখনো মাকে ভুলতেই পারে নি।কুসুমের কাছে মনে হয় এই পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী অনুভূতির নাম মায়া।এই মায়াই তার বাবাকে এখনো দু- বছর পিছনেই ফেলে রেখেছে।কুসুম বুঝতে পারে, বাবার এখন একটা সঙ্গী প্রয়োজন। বৃদ্ধ বয়সে এই প্রয়োজন আরো প্রকট হবে। তখন কী করবে বাবা?হঠাৎ করেই কুসুমের রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর একটা বিখ্যাত কবিতার কথা মনে পরলো।সে ভরাট গলায় আবৃত্তি করলো রুদ্রবাবুর সেই কবিতার দুটো লাইন--
"চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন করা- আদ্র রজনী"....
সকাল সকাল খুব রেগে গেলেন জয়নব বেগম।রাগে তার ভারী শরীরটা কেঁপে উঠলো বার- দুয়েক।জয়নব বেগব রেগে গেলে, তার শরীর কাঁপে।
সকালের খাবার খেয়ে মাত্র বসেছিলেন জয়নব বেগম।সকাল থেকেই শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল তার।ভেবেছিলেন, দুপুরে আর রান্নাঘরের দিকে যাবেন না।সাহানা ও রুমাকে বলবেন রান্নাটা সামলে নিতে।কিন্তু,বিধি বাম! ঘর থেকে বের হয়ে দেখেন, তাদের ছুটা কাজের ছেলেটা মাথায় মাঝারি আকারের একটা ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখে বিগলিত হেসে ঝুড়ি নামায়।ঝুড়ি ভর্তি ছোট- বড় মাছ।কয় কেজি পাঠিয়েছে কে যানে!পুঁটি থেকে শুরু করে মলা,ঢেলা, নারকেলি,কৈ,টাকি -- কী নেই সেখানে।জয়নব বেগম হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলেন।এই মাছ কাটঁতে কয় বেলা পার হয় আল্লাহ মালুম।তার বিস্ময় বিরক্তিতে পরিনত হলো সাহানার কান্ড দেখে।এতো মাছ দেখে সাহানা বেগম মুহূর্তেই অসুস্থ হয়ে গেলেন।হুরহুর করে বেড়ে গেল তার বাতের ব্যাথা।তিনি এখন কিছুতেই বিছানা থেকে উঠতে পারবেন না।টুনিকে নিয়ে রুমাও পড়েছে বিপদে।মেয়েকে কোল থেকে নামাতেই পারছে না,মাছ কাটঁবে কী করে?জয়নব বেগম অসহায় চোখে তাকালেন ছোট দুই জা' য়ের দিকে।যৌথ পরিবারের এই এক জ্বালা।সবাই গা বাঁচিয়ে চলবে। এখানে যেন প্রতিযোগিতা চলে,কে কত কম কাজ করবে।
জয়নব বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বটি নিয়ে বসলেন।উঠোনের মাঝে পিড়ি পেতে অভ্যস্ত হাতে কেঁটে চললেন একের পর এক নিষ্প্রাণ মাছ।তার জীবনটাই শেষ হয়ে গেল এই ভালোবাসাহীন দুধভাতের সংসারে।কিছুক্ষণ পর, রুমাও এলো বটি নিয়ে।মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছে।
নীরা মাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলো।
নীরাদের মাছের ব্যবসা।চার ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে প্রায় চল্লিশজন জেলে মাছ ধরে।কমদামে মাছ কিনে বেশি দামে বেচা, এই হলো তাদের ব্যবসা।তাই, নীরাদের বাসায় মাছ আসার কোনো ঠিকঠাক সময় নেই।মাছ বিক্রি না হলেই ঝুড়ি ভরে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।
কিছুক্ষণ পর কুসুমও এলো।মাছ কাঁটতে বসার আগে নীরার ওড়না ঠিক করে দেয়ার অজুহাতে,নীরার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললঃ" সেজ কাকি কই?"
--" শুয়ে আছে।তার নাকি বাতের ব্যাথা, পা ফেলতে পারছে না মাটিতে।"
---" হুহ, বাতের ব্যাথা।আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তো দেখছি, বাড়িতে মাছের ঝুড়ি আসলেই তার বাতের ব্যাথা শুরু হয়।কই যখন চিবিয়ে চিবিয়ে মাছের মাথা খায় তখন তো দাঁতে ব্যাথা হয় না?"
---" আস্তে কথা বল, আম্মা শুনলে বেয়াদবির অপরাধে দাঁত ভেঙে দেবে।"
---" মেজমা এতো আহ্লাদ করে কেন? আমি তার যায়গায় থাকলে জীবনেও সেজ কাকির সাথে কথা বলতাম না, একসাথে থাকা তো দূরের কথা।"
--- "এই জন্যই তুই আম্মার জায়গায় নেই, আর আমরা এখনো একসাথে থাকি।যৌথ থাকতে হলে এরকম মেনে নেয়া লাগেই।"
জয়নব বেগম রামধমক দিলেন দু-টোকে।
---" কাজ করতে হইলে কর নইলে ঘরে যা।চোখের সামনে এতো গুজুরগুজুর কীসের?নাটক যতসব।বাড়িটা ভইরা গেল নাটকে।"
কুসুম নাক মুখ কুঁচকে কাজে হাত দিলো। হাহ! তার মেজমা শুধু তাদের সাথেই পারে।
***
রেদোয়ানের জ্বর নেই এখন।দুটো দিন খুব ভুগিয়েছে জ্বর।শরীর অনেক দুর্বল হয়ে গেছে।খেতেও ইচ্ছে করে না,শুয়ে থাকতেও ভালো লাগে না আবার বেশিক্ষণ বসে থাকলেও মাথা ঘুরায়।এ এক অসহ্যকর যন্ত্রণা। রেদোয়ানের অবস্থা দেখে জয়নব বেগম নীরা - কুসুমকে পড়তে আসতে দেননি।আজ একটু ভালো লাগছে রেদোয়ানের। তাই কুসুমকে ডেকে পাঠিয়েছে।পড়াগুলো দিয়ে দেবে।কিছু ই- মেইল জমে আছে।চেক করা হয় না তিনদিন যাবৎ।অবশ্য রেদোয়ান ইচ্ছে করেই করে না।প্রত্যেকবার অনেক আশা নিয়ে ই- মেইল দেখতে বসে।যদি কোনো চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক আসে।কিন্তু,প্রতিবারই হতাশ হয় রেদোয়ান। তার প্রত্যাশিত ই- মেইল আসেনি এখন পর্যন্ত। আচ্ছা,লকডাউন তো শিথিল হয়েছে অনেক।তবে রেদোয়ানের চাকরিটা কেন হচ্ছে না?
কুসুম দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিলো।অনুমতি চাইল ভিতরে আসার।
---" ভেতরে এসো কুসুম।"
কুসুমের এক হাতে বই অন্য হাতে কাঁচা আম ভর্তার বাটি।বইগুলো টেবিলে রেখে বাটি এগিয়ে দিলো রেদোয়ানের দিকে।
---" ভাইয়া,মেজমা পাঠিয়েছে আপনার জন্য।বলসে জ্বরের মুখে ভালো লাগবে।"
--- " আচ্ছা, রাখো ওখানে।"
রেদোয়ান বইগুলো থেকে পড়া দিচ্ছে কুসুমকে।কিছু কিছু জায়গা বুঝিয়েও দিচ্ছে।কিন্তু যাকে বুঝানো হচ্ছে সে কী আদোও মনোযোগ দিচ্ছে? ভাবনার বিষয়।
ইদানিং, রেদোয়ানকে খুব ভালো লাগে কুসুমের।আগে যে খারাপ লাগতো ব্যাপারটা তা নয়।শিক্ষক হিসেবে রেদোয়ান খুব ভালো।তাই তাকে ভালো লাগা খুব স্বাভাবিক বিষয়।কিন্তু কুসুমের চোখে কেবল শিক্ষক হিসেবে নয়, একজন বলিষ্ঠ পুরুষ হিসেবেও ভালো লাগে।কোথায় যেন পড়েছিল কুসুম,বাঙালি মেয়েদের অনুভূতির হাতে- খড়ি হয় গৃহ- শিক্ষককে ঘিরে।তার সাথেও কী এরকম কিছু হচ্ছে? জানে না কুসুম।শুধু জানে,রেদোয়ানকে তার ভালো লাগে।তার কিশোরী মনে অন্যরকম আনন্দ হয় রেদোয়ানকে দেখলে।রেদোয়ানের সবকিছু কুসুমের ভালো লাগে।যখন পড়া বুঝায়,মুখরা সেজ কাকির কথার জবাব দেয়,মেজমার স্নেহের বিপরীতে মুচকি হাসে,তর্জনী আঙুল দিয়ে নেমে আসা মোটা ফ্রেমের চশমাকে নাকের উপরে ঠেলে দেয়--- তখন খুব ভালো লাগে কুসুমের।এমনকি কুসুম ও নীরা যখন পড়া পারে না তখন রেদোয়ান তাদেরকে শাস্তি হিসেবে কান ধরে উঠ-বস করায়।কখনো পঞ্চাশ বার আবার কখনো একশ বার।এটাও খুব ভালো লাগে কুসুমের।কান ধরে উঠ-বস করতে করতে রেদোয়ানকে ফিসফিসিয়ে বলতে ইচ্ছে করেঃ" আরে রেদু ভাই,আপনার সবকিছু আমার এতো ভালো লাগে কেন? আপনার শাস্তিটাও কী সুন্দর! এতো সুন্দর শাস্তি দিতে আমি কাউকে দেখিনি।"
---" কুসুম তুমি কী শুনছো"?কুসুম,কুসুম?"
রেদোয়ানের কথায় ঘোর ভাঙলো কুসুমের।ভাবনার দেয়ালগুলো হঠাৎ করে ভেঙে যাওয়ায় খানিকটা অপ্রস্তুত হলো সে।তবে কুসুমের সামলে নেয়ার ক্ষমতা প্রবল।সে মাথা নেড়ে বললঃ" শুনছি তো রেদু ভাই।"
বিশ্বাস হলো না রেদোয়ানের।ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলোঃ" তুমি সত্যি শুনছো তো?"
---" হ্যাঁ, এইযে আপনি মূলধন ব্যয় বুঝাচ্ছিলেন।আমাকে জিজ্ঞেস করুন, আমি পারব।"
--- " আচ্ছা, ঠিকাছে।আজকের জন্য শুধু পড়া দিয়ে দিচ্ছি।কালকে থেকে পুরোপুরি পড়ানো শুরু করব।ঠিক আছে?"
---" জ্বি, আচ্ছা।"
---" ওহ, আরেকটা কথা।যাওয়ার সময় টেবিলের উপর থেকে অনিরুদ্ধ কাহালীর বাংলা ২য় পত্র বইটা নিয়ে যেয়ো নীরার জন্য।"
---" কিন্তু নীরা আপুর তো বই আছে।"
---" থাকুক। বই পড়লে কারো জ্ঞান কমে না।আর তাছাড়া নীরা বাংলা ২য় পত্রে অনেক কাচা।নিয়ে যেয়ো।"
---" ঠিকাছে ভাইয়া।"
বাইরে বেড়িয়ে বড় একটা দম নিলো। ভাগ্য ভালো তখন পড়া ধরেনি। ধরলে আজ খবর ছিল কুসুমের।
***
এই নিয়ে তিনবার গোসল করেছে নীরা।হাত দুটো ধুয়েছে বোধহয় পঞ্চাশ বারের বেশি।তবু মাছের আশঁটে গন্ধ যাচ্ছে না হাত থেকে।লেগেই আছে।আজকে নিশ্চিত নীরা ভাত খেতে পারবে না।আশঁটে গন্ধ একদম সহ্য হয় না নীরার।এই গন্ধ নাকে আসলেই মনে হয় যেন আশেপাশে অশরীরী মাছখেকো পেত্নীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।মাছের গন্ধের লোভে নীরাকে লাল লাল জ্বিভ দিয়ে চেটে দেবে তারা।শিউরে উঠে নীরা।নীরা খুব ভীতু মেয়ে।ভূত- পেত্নিতে তার ভীষণ ভয়,অগাধ বিশ্বাস।
আরো একবার গামছা কাঁধে গোসলঘরের দিকে এগোয় নীরা।আরেকবার গোসল করেই দেখা যাক গন্ধ যায় নাকি।
তবে যাওয়া হয় না তার।উঠোনের মাঝে আসতেই দেখা যায় নীরাদের সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকছে রিমা।বোরকায় মোড়ানো রিমাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে যায় নীরা।প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।রিমাও জড়িয়ে ধরে নীরাকে।
রিমা ও নীরা দুই বান্ধবী।ছোট বেলার বান্ধবী যাকে বলে আরকি।দুই জনের মাঝে তুমুল ভাব।তবে, লকডাউনে কলেজ বন্ধ হওয়ার পর একটু ভাটা পড়েছিল বন্ধুত্বে।আসা- যাওয়া,প্রত্যেকদিন কথা বলা কমে এসেছিল অনেকটাই।আজ অনেকদিন পর দেখা হওয়াতে মনে হয় যেন বন্ধুত্বের নদীতে জোয়ার এসেছে।কথা যেন ফুরাচ্ছেই না।
বিকেলের অর্ধেকটা প্রায় শেষ তবে কথা এখনো শেষ হয়নি।আড্ডার একপর্যায়ে রিমা জিজ্ঞাসা করলোঃ " নীরা,বাজারে যাবি? ইশরাক ভাইয়ের দোকানে?"
---" কেন? সেখানে কী?"
---" আরে,আমার কিছু জিনিস কিনার দরকার ছিল। চল না আমার সাথে।"
নীরা নাইনুকুর করলো কিছুক্ষণ। কারণ, তার আম্মা কিছুতেই এখন যেতে দেবে না।তবে রিমাও দমবার পাত্র নয়।সে নীরাকে অভয় দিয়ে বললঃ" আমি আন্টিকে রাজি করালে তুই যাবি তো? আমি এখনি যেয়ে রাজি করাচ্ছি।তুই রেডি হ।"
কথা রাখতে পারলো রিমা।বহু তেল মেখে,অনুরোধ করে জয়নব বেগমকে রাজি করালো।তবে শর্ত হলো,কুসুমকে নিয়ে যেতে হবে।সন্ধ্যার আগে আগে বাড়ি ফিরতে হবে।
মেনে নিলো রিমা।কুসুমকে নিতে কোনো সমস্যা নেই কুসুমের সাথে তার খুব ভাব।আর রইলো সন্ধ্যার আগে ফিরার কথা।তা তো পারবেই।কয়টা আর জিনিস কিনবে,কতক্ষণই বা সময় লাগবে।
রাস্তায় বেড়িয়ে ভীষণ ভালো লাগলো নীরার।কতোদিন পর বের হলো। রিমাকে জড়িয়ে ধরে দুটো চুমু দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।এমনিতে মা তো ওকে একা বের হতেই দেয় না।
বড় বাজারে ইশরাকের দোকান।বাজারে সবচেয়ে বড় দোকানটা ইশরাকের।সব পাওয়া যায় এখানে।
দোকানে যাওয়ার কিছুটা রাস্তা তখনো বাকি।এমন সময়,কুসুমের চোখে পড়লো মেহরাবকে।মেহরাব,এ গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলে।ঢাকায় থাকে।লকডাউনের জন্য গ্রামে এসেছে।কুসুম সেদিন মেহরাবকেই দেখেছিল, কবরস্থানে দাঁড়িয়ে। আজকেও কেমন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।বড্ড অদ্ভুত লাগলো কুসুমের।মেহরাবের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওদেরকে থামিয়ে দিলো মেহরাব। কুসুমকে বিগলিত হেসে জিজ্ঞাসা করলোঃ" ভালো আছো কুসুম?"
একটু অপ্রস্তুত হলো কুসুম।মেহরাব অনেক পরিচিত না আবার একদম অপরিচিত না।তাই হালকা হেসে বললোঃ" জ্বি, ভালো আছি।আপনি ভালো আছেন?"
---" হুম।ওরা কারা? "
--- " আমার বড় আপু হয়।নীরাপু এইটা মামা হয়।ওইযে আমার বান্ধবী নূরজাহান আছে না,ওর মামা। "
নীরা সালাম দিলো মেহরাবকে।মেহরাবও ভোতা মুখে সালামের উত্তর নিলো।শেষ পর্যন্ত মামা!
কুসুম হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলোঃ" মামা,নূর ভালো আছে?"
---" হ্যাঁ, ভালো আছে।আচ্ছা পরে কথা বলব। যাও তোমরা যেখানে যাচ্ছিলে।"
বিরসমুখে অন্যদিকে চলে গেল মেহরাব।কুসুমের সামনে থাকলে নিশ্চিত যেকোনো সময় ঠাটিয়ে দুটো চর মারতো।যাদের বাড়িতে উঁকি দেয়া মেহরাবের অভ্যাস হয়ে গেছে,সেই বাড়ির মেয়ে নাকের ডগা দিয়ে মামা ডেকে গেল।ছিঃ! কী গা ঘিনঘিনে ব্যাপার।
ইশরাকের দোকানে ঢুকে তিনজন আলাদা হয়ে গেল।নীরা - কুসুম চলে গেল আইসক্রিমের দিকে।একটা আইসক্রিম খেলে মন্দ হয় না।রিমা একা একা প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো দেখতে লাগলো।রিমাকে একা পেয়ে এগিয়ে এলো ইশরাক।সবার অগোচরে রিমার বাম হাত চেপে ফিসফিস করে বললঃ" আমার ফোন ধরো নাই কেন, ফাজিল মহিলা? আমাকে টেনশন দিতে খুব ভালো লাগে?আরেকদিন এরকম করলে মেরে ফ্রিজে ভরে রেখে দেব, বেয়াদব।
ইশরাকের হাতের মুঠো থেকে এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো রিমা।হতভম্ব হয়ে গেলো ইশরাক।অবাক কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলোঃ" সমস্যা কী তোমার রিমা?"
---" এইগুলা কেমন আচরণ ভাইয়া? "
---" ভাইয়া!"
---" আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।এখন আপনি যদি এরকমভাবে হাত ধরেন আর কেউ যদি তা দেখে, তাহলে বুঝতে পারছেন আমার কতবড় বদনাম হবে? আপনি ছেলে আপনার তো কিছুই হবে না।সব সমস্যা আমারই হবে।"
অবাকের রেশ কাটিয়ে উঠতে পারছে না ইশরাক।রিমার বিয়ে ঠিক! তা কীভাবে সম্ভব?
---" আমাকে জানাও নাই কেন? ছেলে কী করে? বিয়ের তারিখ কি পাকা হইসে?"
---" ছেলে প্রবাসী। দিনক্ষণ এখনো পাকা হয়নি।ছেলের পরিবার নাকি আমাকে দেখসে।পছন্দ হয়েছে তাদের।কালকে ছেলেসহ দেখতে আসবে।আম্মা - আব্বার খুব পছন্দ ছেলে।"
কথাগুলো বলার সময় গলা কেঁপে উঠলো রিমার।কাঁপবে না কেন? প্রথম প্রেমের মায়া ত্যাগের মতো এতোবড় বিসর্জন আর কিছু হয় নাকি?
ইশরাক রেগে যেয়ে পাশে থাকা টেবিলের গায়ে একটা লাথি দিলো।রিমার বাবার ঠিক করা প্রবাসীকে একটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে বললঃ" প্লেন না বন্ধ?ওই বেয়াদব দেশে আসলো কীভাবে? "
---" প্লেন যখন চালু ছিলো তখন আসছে।এখন বিয়ে করবে।"
---" তার মানে এখন বেকার?আর খোঁজখবর নেয়া ছাড়াই তোমার বাবা তোমারে বিয়ে দিয়ে দিবে! আশ্চর্য! "
রিমা ভোঁতা মুখে দাঁড়িয়ে রইলো ইশরাকের পাশে।মনে মনে ইশরাকের উদ্দেশ্যে বললঃ" না আমার বাবা আমারে বিয়ে কেন দিবে? সে তো আপনার জন্য বসে থাকবে।বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার সাহস নেই, আবার বড় বড় কথা।যত্তসব।"
ইশরাক রিমার পাশে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো।এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে নীরা ও কুসুম হাতে আইসক্রিম নিয়ে এটা - ওটা দেখছে।এই দোকানে তাদের অবাধ রাজত্ব।
ইশরাক কিছুক্ষণ ভেবে বললঃ" আচ্ছা,তুমি যাও বাসায়।আমি দেখি কী করা যায়।"
কিছুক্ষণের মাঝে কুসুম - নীরাও চলে এলো তাদের কাছে।কুসুম রিমাকে প্রশ্ন করলোঃ"যাবে না বাসায়?"
---" হুম চলো। "
ওরা বেড়িয়ে গেলে পিছন থেকে চিন্তিত চোখে চেয়ে রইলো ইশরাক।বিরাট ঝামেলায় পড়া গেল তো।
ইশরাক ও রিমার সম্পর্কের বয়স এক বছর।রিমা প্রায়ই আসা- যাওয়া করতো নীরাদের বাড়িতে।সবাই পছন্দ করে রিমাকে।তেমনি ইশরাকেরও ভালো লাগতো।শান্ত,সহজ,সরল একটা মেয়ে।তবে ভালোবাসার শুরু এক বছর আগে থেকে।সেদিন ছিল এক বর্ষা দুপুর। বৃষ্টি হচ্ছিল খুব।কোথায় যেন যাচ্ছিল রিমা। পথে শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি।বৃষ্টির তীব্রতায় হাঁটতে পারছিল না।পথের পাশে থাকা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল।পরনে থাকা বোরকাটাও ভিজে গেছে।ওই পথ দিয়েই বাড়ি ফিরছিল ইশরাক। সেদিন ইশরাকই দেখেছিল রিমাকে।হাতে থাকা ছাতাটা বাড়িয়ে দিয়েছিল রিমার দিকে।বলেছিল নীরার কাছে চলে যেতে।নাহয় ভিজা শরীরে ঠান্ডা লেগে যাবে।রিমাও ইশরাকের কথামতো গুঁটি গুঁটি পায়ে ইশরাকের পিছু পিছু চললো নীরাদের বাড়িতে।ভালো লাগার শুরু সেখান থেকেই।আস্তে আস্তে কীভাবে যেন প্রেমটাও হয়ে গেল।ওদের সম্পর্কের সমীকরণ খুব সুন্দর ছিল।সামনা-সামনি দেখা খুব কম হতো।দেখা হলেও দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে কেবল মুচকি হাসতো।আবার কখনো রিমা তার বাবার ফোন দিয়ে লুকিয়ে কথা বলতো ইশরাকের সাথে।কখনো দশ মিনিট, কখনো পনেরো মিনিট।কোনো অশ্লীলতা ছিলো না দুজনের মাঝে।ইশরাক জানতো কীভাবে রিমাকে সম্মান দিতে হয় আবার রিমাও জানতো তার আচরণের সীমাবদ্ধতা। ইশরাক চাইলেই রিমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে পারতো।তবে ইচ্ছে করেই পাঠায়নি।এই দোকানটা ইশরাকের একার নয়।দোকানের অংশীদার দুজন।ইশরাক ও তওসিফ।তওসিফ বসে না বলেই ইশরাক একাই বসে এখানে।ইশরাকের ইচ্ছে ও নিজে কিছু একটা করবে তারপর বিয়ে করবে।এখনো তো বউয়ের দেনমোহরের টাকাও জোগাড় করতে পারল না,তবে বিয়ে করবে কীভাবে?ততোদিনে রিমাও একটু বড় হোক।মেয়েটার বয়সতো সবে আঠারো। খুব বেশি বড় তো আর হয়ে যায়নি।এখনি যদি সংসারে জড়িয়ে যায় তবে নিজের জীবনটাকে দেখার তো আর সুযোগই পাবে না।কিন্তু এখনি যে রিমার বাবা এতোটা পাগল হয়ে যাবে,তা কে জানতো!
***
অনেকবার গোসল করার কারণে ঠান্ডা লেগে গেছে নীরার।মাথাটাও ধরেছে তার সাথে।বাড়ি এসে শরীর খারাপ লাগায় ঘুমিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। ঘুম থেকে উঠার পরেই বুঝতে পারল ঠান্ডা লেগেছে।জয়নব বেগম এসে দেখে গেছে কয়েকবার।ধমকি- হুমকিও দিয়েছে অবশ্য।মেয়ে মানুষের আবার এতো ঢং কীসের? কয়েক কেজি মাছ কেঁটেই একেবারে চৌদ্দবার গোসল করতে হবে কেন? গন্ধ কী সারাজীবন থেকে যাবে হাতে?
নীরা জবাবে কিছু বলেনি।কেবল মুখ বন্ধ করে মায়ের হাত থেকে ভাত গিলেছে।খেতেও ইচ্ছে করছিল না।গলায় মনে হচ্ছে যেন খরা দেখা দিয়েছে।খালি শুকিয়ে যায়।
জয়নব বেগম পানি খাইয়ে দু চামচ ঠান্ডার সিরাপ খাইয়ে দিলো।নীরার আবার সিরাপ খেতে পারে না।তবুও খেয়ে নিলো।এখন না খেলে মা নিশ্চিত দুটো চর মারবে গালে।
জয়নব বেগম ঘরের বাতি বন্ধ করার আগে নীরাকে আরো একবার হুশিয়ার করে দিলেন।
---" খবরদার তোরে যাতে আর কখনো মাছের কাছে যাইতে না দেখি।তুমি কয়েকটা মাছ কাঁটার পর এতো ঢং করবা, আবার অসুখ বাধাইবা।আর আমি সব ফালায়া তোমার কাছে বইসা তোমার সেবা করুম, তা চলব না।"
নীরা কিছু না বলে কাঁথা মুরি দিয়ে চুপ করে শুয়ে রইলো। তার মা এতো কঠিন কেন? মায়েরা না মমতাময়ী হয়?
***
ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে এখন বাজে রাত নয়টা।ল্যাপটপের সামনে বিস্মিত চোখে বসে আছে রেদোয়ান। অবশ্য শুধু বিস্মিত না অনেকটা প্রফুল্লও বটে।হঠাৎ করে আল্লাহ তাকে এতোবড় সৌভাগ্যের সম্মুখীন করবে তা যেন ভাবতেও পারছে না রেদোয়ান। রাতের বেলা অলস সময় কাটাতে ই- মেইলগুলো চেক করছিল রেদোয়ান।চার- পাঁচটা ই- মেইল জমে আছে।প্রথম দুটো ইতালি থেকে এসেছে।তার চাচা জানতে চেয়েছে বাংলাদেশে করোনার খবর।পরের দুটো ই- মেইল চেক করতেই হতভম্ব হয়ে গেল রেদোয়ান।
কিছুদিন আগে কয়েক জায়গায় সিভি জমা দিয়েছিল সে।সেখান থেকেই ডাক এসেছে তার।কেবল একটা নয় দুটো কোম্পানি থেকে।সহসা এতোবড় খবর হজম করতে বেগ পেতে হল রেদোয়ানকে।চোখ কচলে আবারো তাকালো কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে।না খবরটা তাহলে সত্যি! রেদোয়ান খুব খুশি হলো।যাক এতোদিনের দুশ্চিন্তা কমলো। কিন্তু, মনের সবটা দিয়েই কী রেদোয়ান খুশি হতে পারলো? কে জানে?
রেদোয়ান সবার আগে কাগজ- কলম নিয়ে বসলো।আজ একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারতে হবে।
রাত সাড়ে এগারোটা।
রেদোয়ান, ইশরাক,তওসিফ দাঁড়িয়ে আছে গ্রামের বাস স্টেশনে। রেদোয়ানের সাথে বিশাল ব্যাগ।জীর্ণ চাতালের নিচে ঢাকার বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে সে।বারোটায় একটা বাস ছাড়বে। রেদোয়ান চাকরির খবরটা সর্বপ্রথম জয়নব বেগমকে দিয়েছিল।তিনি খুব খুশি হলেও পরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।ছেলেটা চলে যাবে! জয়নব বেগম আরো অস্থির হয়ে গেলেন যখন শুনেছেন এই রাতেই বেড়িয়ে যাবে রেদোয়ান।কারণ, ই- মেইল এসেছে আরো তিনদিন আগে।হাতে সময় আছে আর মাত্র দু- দিন।অন্যদিকে, সারাবছর সিলেটে থাকা রেদোয়ান ঢাকার কিছুই চিনে না।রেদোয়ান তার চাচাতো ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করেছে।ঢাকায় তার শ্বশুরবাড়ি।আপাতত রেদোয়ান সেখানেই থাকবে।এরকম কথাই হয়েছে।তাই, রেদোয়ান ঠিক করলো রাতেই বেড়িয়ে যাবে।সময় খুব কম।
ইশরাক বাস স্টেশন আরো একবার ঘুরে এলো।
---" রেদু,এতো রাতেই যাবা তুমি? কালকে সকালে গেলে হয় না?"
--- " না, ভাইয়া।এখন গেলে সকালেই পৌঁছে যাব।কিন্তু,কালকে সকালে গেলে পৌঁছাতে বিকাল হবে।বিশ্রাম নিতে পারব না।"
---" ওহ,আচ্ছা।"
পৌনে বারোটায় বাস এলো।রেদোয়ান তার ব্যাগ রেখে এগিয়ে এলো ইশরাক ও তওসিফের দিকে।জড়িয়ে ধরলো ইশরাককে।এই কয়েকমাসে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল ওদের সাথে।
---" আসছি ভাই।দোয়া করবেন যাতে চাকরিটা হয়।আর ভালো থাকবেন।"
---" তুমিও ভালো থেক।যোগাযোগ রেখো।আর ঢাকায় কোনো সমস্যা হলে চলে এসো গ্রামে।সংকোচ করো না কোনো। "
ইশরাক বাস স্টেশনে থাকা দোকানগুলোর দিকে এগিয়ে গেল।এগুলো প্রায় সারারাত খোলা থাকে।রেদোয়ানকে কিছু শুকনো খাবার কিনে দিলে ছেলেটার খুব উপকার হবে।ইশরাক চলে গেলে, রেদোয়ান তওসিফকেও জড়িয়ে ধরলো।তওসিফ অবাক হয়ে গেল খুব।তার সাথে এরকম আচরণতো কেউ এখন আর করে না! তওসিফ নিজেও বিনিময়ে জড়িয়ে ধরলো রেদোয়ানকে।
---" ভালো থেকো তওসিফ।মানুষ অন্যায় করতে পারে কিন্তু অনুশোচনায় সবাই ভোগে না।"
---" আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন কেন ভাই? আমাকে এখন সবাই ঘৃণা করে,আপনি করেন না?"
---" মানুষ মানুষকে ঘৃণা করে না,করে তার আচরণকে।তোমার আচরণটা খারাপ ছিল।কিন্তু তুমি নও।তুমি যে অনুশোচনায় ভোগ তা তোমার চোখ দেখলেই বুঝা যায়।তুমি নিজেও চাও বাড়ির সবার সাথে আগের মতো হয়ে যেতে,কিন্তু মানুষগুলো তোমাকে আর বিশ্বাস করে না।বিশ্বাস ভেঙেছ তুমি আবার অর্জন তোমাকেই করতে হবে।এছাড়া আর পথ নেই।"
হঠাৎ করেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো তওসিফ।
---" নীরা, কুসুম কেউ আমার সাথে কথা বলে না।তাই আমি ইচ্ছে করেই ওদেরকে রাগিয়ে দেই।রাগিয়ে দিলে একটু কথা বলে নাহয় তো ফিরেও তাকায় না।"
---" সেটাই কী স্বাভাবিক নয়?ওদেরকে না রাগিয়ে ভাই হওয়ার চেষ্টা কর।ওরা তোমার সাথে কথা এমনিতেই বলবে।"
বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে।আরো একবার বিদায় জানিয়ে বাসে উঠলো রেদোয়ান।বাস ছেড়ে দিলে।সিটে গা এলিয়ে দিলো সে।রেদোয়ানের দু- চোখের কোল বেয়ে বর্ষা নামলো।কাঙ্ক্ষিত সুখময় স্মৃতি ফেলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়া যে কতটা কষ্টের, তা ও ছাড়া আর কে জানে?
নীরার ঘুম ভাঙলো খুব দেরিতে।ঘুম থেকে উঠে অবাক চোখে ঘড়ির দিকে তাকালো।দশটা বাজে! অথচ মা এখনো ডাকতে আসেনি।বিষয়টা ভাবনার।নীরা তাড়াতাড়ি গায়ের কাঁথা ফেলে উঠে দাড়ালো। নিচে পা ফেলতেই পায়ের নিচে কাগজের অস্তিত্ব খুঁজে পেল।দীর্ঘশ্বাস ফেললো নীরা।আবারো সেই নাম পুরুষ! নীরা কাগজ উঠিয়ে হাতে নিলো।খুলবে না খুলবে না করেও খুলেই ফেললো।খুলতেই হতভম্ব হয়ে গেল নীরা।চোখের সামনে ফুটে উঠলো গুটি গুটি অক্ষরে প্রকাশ পাওয়া কিছু মনের কথা।লেখাগুলো বড্ড পরিচিত নীরার।ধপ করে খাটের কোনে বসে পড়লো নীরা।এ কী আদোও সত্যি!
চলবে...
Writer:- হালিমা রহমান