“এই অসময়ে কই যাও?”
অদিতির প্রশ্নে পেছন ফিরে তাকালাম। কোমরে দুই হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। মারমুখো দৃষ্টি। আমি দাঁত বের করে হাসলাম, পরিস্থিতি সহজ করার চেষ্টা। কিন্তু হাসিতে আমার স্ত্রী'র মন গললো না। সে আবার জিজ্ঞেস করলো, “হাসছো কেন? আমি কি জোকস বলেছি?”
আমি আমতা আমতা করে বললাম, “না মানে… একটু চা খাব…”
“চা আমি ঘরে বানিয়ে দিচ্ছি, বাইরে যেতে হবে না!”
“আসলে… বন্ধুরা একসাথে…”
“রিমন!” রেগে গেলো অদিতি। “তুমি সারা বছর ব্যস্ত থাকো অফিসের কাজে। দুজনে একসাথে সময় কাটানোর সুযোগই পাই না। ঈদের বন্ধে কই একটু আমাকে সময় দেবে, আর তুমি যাচ্ছো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে?”
আমি এগিয়ে গিয়ে অদিতির দুই কাঁধে হাত রাখলাম। বোঝানোর চেষ্টা করলাম, “দেখো, সাইদ ফোন দিয়ে ডাকলো, আমি 'হ্যাঁ' বলে দিয়েছি। সবাই চলে এসেছে, এখন না গেলে কেমন দেখায়?”
অদিতি কাঁধ থেকে আমার হাত নামিয়ে দিলো। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলো।
“রাগ করো না, প্লিজ!” আমি একহাতে অদিতির গাল স্পর্শ করলাম। “একটু গিয়ে চেহারাটা দেখিয়ে আসি। জাস্ট এক কাপ চা খেয়েই চলে আসবো। বড়জোর ১০ মিনিট…”
অদিতি চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে একবার আমার দিকে তাকালো, আবার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
আমি গলায় দরদ ঢেলে দিয়ে বললাম, “কথা দিচ্ছি, এই বন্ধে আর কোথাও যাবো না। বাকি দিনগুলো শুধু তুমি আর আমি…”
“১০ মিনিট!” অদিতি আচমকা বলে উঠলো। “তার বেশি যেন না হয়!”
স্ত্রী-র অনুমতি পেয়ে হাসিতে আমার সব কটা দাঁত বেরিয়ে পড়লো।
***
যদিও অদিতিকে বলেছি ১০ মিনিট লাগবে। তবে আমার মাথায় ছিলো অন্তত আধা ঘণ্টা থাকবো। অদিতিও জানে বন্ধুদের আড্ডা ছেড়ে ১০ মিনিটে উঠবো না আমি।
আড্ডা-আলাপে কখন যে সময় পার হয়ে গেলো টেরই পাইনি! কর্মব্যস্ত জীবনে এমন সুযোগ তো খুব একটা পাওয়া যায় না। দিন-দুনিয়ার বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ চলতে থাকলো। সাথে চললো কাপের পর কাপ চা আর অনর্গল সিগারেটের ধোঁয়া ওড়ানো। হঠাৎ হাতঘড়িতে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম আমি। প্রায় দেড়ঘণ্টা কেটে গেছে!
পকেট থেকে মোবাইল বের করলাম। ১২টা মিসড কল! সবগুলো অদিতির নাম্বার থেকে এসেছে। শিট! সকালে মোবাইল সাইলেন্ট করেছিলাম, আর রিং অন করা হয়নি। আমি দ্রুত অদিতিকে কলব্যাক করতে যাবো, তার আগেই একটা কল চলে এলো। ডিসপ্লে-তে দেখছি আননোন নাম্বার।
কল রিসিভ করলাম, “হ্যালো?”
“রিমন সাহেব বলছেন?” একটা রাশভারী পুরুষ কণ্ঠ জিজ্ঞেস করলো।
“হ্যাঁ, বলছি।”
“আপনি যেখানেই থাকুন, এই মুহূর্তে বাসায় চলে আসুন।”
“বাসায়?” অবাক হলাম আমি। “কার বাসায়?”
“আপনার বাসায়।” বলেই ফোন কেটে দিলো লোকটা।
আমি হতবাক হয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
***
বাড়ির মেইন গেটের সামনে অনেক মানুষের জটলা। উৎসুক জনতা উঁকি দিয়ে ভেতরে কিছু দেখার চেষ্টা করছে। একটা পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। কি ব্যাপার? কি হয়েছে এখানে? আমি দ্রুত এগিয়ে গেলাম। লোকজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে গেট দিয়ে ঢুকলাম ভেতরে। অনেক পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে বিল্ডিং-এর নিচে। আমি ভয়ে ভয়ে কলাপ্সিবল গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম।
৫ তালা একটা বিল্ডিং-এর নিচতালার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকি আমরা। ঈদের বন্ধে দাড়োয়ান বাড়িতে গেছে। তাই কলাপ্সিবল গেটটা দিনের বেলা খোলাই থাকে। আমাদের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা দেখা যাচ্ছে। দরজার সামনে গড়িয়ে আসা রক্তের ছাপ দেখে আমার বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা ধড়াস করে উঠলো।
একজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। লোকটার পকেটের উপর নেমপ্লেটে লেখা- হামিদ। স্বাস্থ্যবান, মাঝবয়সী, নাকের নিচে গোঁফ। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “আপনিই রিমন?”
গলার আওয়াজ শুনে বুঝলাম উনিই ফোন করেছিলেন আমার নাম্বারে। আমি হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়লাম।
“খুন হয়েছে আপনার বাসায়।”
আরেকবার চমকে গেলাম পুলিশের কথায়। অদিতি ১২বার কল দিয়েছে আমাকে! স্ত্রী বিপদে পড়ে কল দিচ্ছিলো আর আমি বন্ধুদের আড্ডায় মেতেছিলাম!
আমি ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে গেলাম দরজার কাছে। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। হাঁটুতেও বল পাচ্ছি না। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি তাকালাম ঘরের ভেতরে এবং আরও একবার চমকে উঠলাম!
ঘরের মেঝেতে রক্তের বন্যা। তার মধ্যে একজন পুরুষ মানুষের লাশ পড়ে আছে!
তারমানে অদিতি খুন হয়নি, হয়েছে অন্য কেউ! আমার চোখদুটো ঘরের চারিদিকে ছোটাছুটি শুরু করলো। অদিতিকে খুঁজছে। কোথায় অদিতি?
পুলিশ সদস্য বললো, “খুনটা আপনার স্ত্রী করেছে। তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”
মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো চমকে উঠলাম আমি!
***
থানার ভেতরে পা রাখতেই দেখতে পেলাম অদিতি একটা চেয়ারে বসে আছে। দু-হাতে হ্যান্ডকাফ লাগানো। আমাকে দেখতে পেয়ে তার দু-চোখে যেন একশো ওয়াটের বাল্ব জ্বলে উঠলো। উঠে দাঁড়ালো, দৌড়ে এলো।
আমার বুকে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো অদিতি। হাতে হ্যান্ডকাফ থাকায় জড়িয়ে ধরতে পারছে না। মুখ ঘষছে আমার বুকে আর ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। আমি তাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরলাম।
থানার ভেতর পুলিশ ভরা। একজন নারী পুলিশ এসে অদিতিকে ছাড়িয়ে নিলো আমার কাছ থেকে। অদিতি কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললো, “রিমন, তুমি না ১০ মিনিটের মধ্যে আসবে বললে? তুমি না আমাকে কথা দিয়েছিলে?”
আমি কি উত্তর দেবো বুঝতে পারছি না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
নারী পুলিশ অদিতিতে টানতে টানতে নিয়ে আবার সেই চেয়ারে বসিয়ে দিলো। এতক্ষণে আমি চারিদিকে নজর দেওয়ার সুযোগ পেলাম। বেশ কয়েকটা ডেস্ক আশে পাশে। ডেস্কে পুলিশ অফিসাররা বসে আছে। কেউ সামনে ঝুঁকে ফাইল দেখছে, কেউ চোখ তুলে আমাকে দেখছে। সাধারণ পুলিশ সদস্যরা হাঁটাহাটি করছে। কারো মধ্যেই আমাদের ব্যাপারে বাড়তি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে, এই ধরনের দৃশ্য তারা নিয়মিত দেখে অভ্যস্ত।
“রিমন সাহেব, এদিকে আসুন”।
কথাটা বললো একজন কমবয়সী অফিসার। পরিষ্কার ইউনিফর্ম পরনে। মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা।
আমি তার ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেলাম।
অফিসার আমাকে ইশারায় একটা খালি চেয়ার দেখিয়ে বললো, “বসুন।”
আমি চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।
লোকটি নিজের পরিচয় দিলো, “আমি ইন্সপেকটর আমান।”
আমি হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়লাম। নার্ভাস ভঙ্গিতে একটু হাসার চেষ্টা করলাম।
ইন্সপেক্টর আমান অদিতির দিকে ইশারা করে বললো, “আপনার স্ত্রী একজনকে খুন করেছেন। তার ভাষ্যমতে- আপনি ১০ মিনিটের জন্য বাইরে গিয়েছিলেন। কলিং বেলের শব্দ শুনে উনি মনে করেন আপনিই এসেছেন। তাই লুকিং গ্লাসে না দেখেই দরজা খুলে ফেলেন। আচমকা ভেতরে একটা অচেনা লোক ঢুকে পড়ে। লোকটা আপনার স্ত্রী-র সাথে জোরাজুরি শুরু করে। আইমিন রেপ করার চেষ্টা করছিলো। আত্ম-রক্ষার্থে আপনার স্ত্রী একটা তরকারি কাটার ছুরি লোকটার বুকে ঢুকিয়ে দেয়। লোকটা সাথে সাথেই মারা যায়। এরপর আপনি ফোন ধরছেন না দেখে উনি নিজেই থানায় ফোন করেছেন।”
আবার সেই ১২টা মিসড কলের কথা মনে পড়লো আমার। অদিতি নিশ্চয়ই খুন করে ফেলার পর কি করবে বুঝতে পারছিলো না! দিশে হারিয়ে বারবার আমাকেই ফোন করছিলো! বেচারি!
“এই ব্যাপারে আপনার অভিমত কি?” ইন্সপেক্টর আমান জিজ্ঞেস করলো।
আমি বলতে শুরু করলাম, “আমি ১০ মিনিটের মধ্যে ফিরবো বলে বের হয়েছিলাম। কিন্তু বন্ধুদের আড্ডায় সময়ের দিকে খেয়াল ছিলো না। হঠাৎ খেয়াল হতেই মোবাইল বের করে দেখি অদিতির ১২টা মিসড কল…”
ইন্সপেক্টর আমাকে হাত তুলে থামালো, “আপনি কি করেছেন তা শুনতে চাইনি। আমি আপনার মতামত শুনতে চাইছি। আপনার কি মনে করেন আপনার স্ত্রী যেভাবে বলেছেন, খুনটা ঠিক সেভাবেই ঘটেছে?”
“অবশ্যই!” আমি দৃঢ়কণ্ঠে বললাম। “তা না হলে আমার স্ত্রী কেন খুন করবে কাউকে?”
“এমনও তো হতে পারে যে খুনটা আসলে আপনার স্ত্রী করেননি। হয়তো লোকটাকে বাড়িতে ডেকে এনে খুন করেছেন আপনি। বাঁচার জন্য ঐ ১০মিনিটের গল্পটা সাজিয়েছেন। তারপর স্ত্রী-কে রেখে বাইরে গেছেন?”
“আপনি কি পাগল হয়েছেন?” রেগে গেলাম আমি। “একটা অচেনা লোককে ঘরে ডেকে এনে খুন করেছি? তারপর স্ত্রী-কে ফাসিয়ে দেয়ার প্ল্যান করেছি? আরে, খুন আমি করলে তো লাশ লুকিয়ে ফেলতাম! আপনারা খবরও পেতেন না! এই বুদ্ধি নিয়ে পুলিশের চাকরি করেন?”
ইন্সপেক্টর আমাকে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। পেছনে কিছু একটা দেখে থেমে গেলো। আমিও ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম। হামিদ নামে ঐ মাঝবয়সী পুলিশ সদস্য ভেতরে ঢুকেছে। হাতে একটা স্বচ্ছ প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ। ভেতরে একটা পিস্তল, মোবাইল, মানিব্যাগসহ আরো কিছু খুঁটিনাটি জিনিস দেখা যাচ্ছে।
“কি অবস্থা হামিদ ভাই?” ইন্সপেক্টর আমান জিজ্ঞেস করলো।
হামিদ এগিয়ে এলো ডেস্কের কাছে। বললো, “স্যার, লাশটা পোস্ট মর্টেমে পাঠানো হয়েছে।” প্লাস্টিকের ব্যাগটা টেবিলে নামিয়ে রাখলো। “লাশের পকেটে এগুলো পাওয়া গেছে।”
“প্রাইমারি রিপোর্ট কি?”
হামিদ একমুহূর্ত চিন্তা করে বললো, “স্যার, আপাতত আত্ম-রক্ষার্থে খুন বলেই মনে হচ্ছে। মৃত লোকটার সাথে পিস্তল ছিলো, সম্ভবত ডাকাত। এই বাড়ির উপর হতো আগে থেকেই নজর রাখছিলো। ঈদের বন্ধ, দাড়োয়ান নেই, গেটও খোলা থাকে। রিমন সাহেব বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর ঢুকেছে, হয়তো সে জানতো ফ্ল্যাটে উনার স্ত্রী একা আছেন। কিন্তু মেয়েটিরও সাহস আছে বলতে হবে। ছুরিটা একদম হার্ট বরাবর গেঁথে দিয়েছে!”
ইন্সপেক্টর আমান প্লাস্টিকের ব্যাগটা হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। কি যেন চিন্তায় ডুবে গেছে মনে হচ্ছে।
আমি বললাম, “তাহলে এবার অদিতেকে ছেড়ে দিন। আমরা বাড়ি যাবো।”
ইন্সপেক্টর দাঁত বের করে বিশ্রী ভঙ্গিতে হাসলো, “আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনার স্ত্রী ঐ ডাকাতকে হালকা চড়-থাপ্পড় মেরেছে! আরে ভাই, মার্ডার কেইস। আপনার স্ত্রী মার্ডার করেছেন!”
“হ্যাঁ, কিন্তু সেটা তো করেছে নিজেকে বাঁচানোর জন্য।”
“হোয়াটএভার। মার্ডার ইজ মার্ডার। কেইস হবে। পুলিশ ইনভেস্টিগেশন হবে। রিপোর্ট জমা পড়বে। আদালতে শুনানি হবে। আদালত যদি মনে করে আপনার স্ত্রী নির্দোষ, তাহলে উনি মুক্তি পাবেন।”
“আপনি কি মানুষ?” আমি উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেলাম। “একটা মেয়ে নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়ে বাধ্য খুন করেছে! আজ আমার স্ত্রীর জায়গায় যদি আপনার স্ত্রী থাকতো? পারতেন এসব বলতে?”
ইন্সপেক্টর আমান এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। তারপর স্বভাবসুলভ হেসে বললো, “আমি বিয়ে করিনি, মিস্টার রিমন। তারপরও আপনার কষ্টটা বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছুই করার নেই। আমারও মনে হচ্ছে আপনার স্ত্রী নির্দোষ। কিন্তু মনে হলেই তো হবে না। পুলিশের ইউজুয়াল প্রসেডিউরের মধ্যে দিয়ে সেটা প্রমাণিত হতে হবে। তাতে একটু সময় লাগবেই।”
***
সময় অবশ্য খুব একটা লাগলো না।
ঘটনার তিনদিনের মধ্যে আমি অদিতিকে থানা থেকে জামিনে ছাড়িয়ে আনলাম। এখানে পুরো ক্রেডিট আমার উকিলের। এক বন্ধুর সহযোগিতায় একজন ভালো উকিল ধরেছি। ভদ্রলোক দুই-তিন জায়গায় কল দিতেই অদিতির জামিনের ব্যবস্থা হয়ে গেলো।
এদিকে কিছু সাংবাদিক বন্ধু-বান্ধবদের সব জানিয়েছি। তারা বিষয়টা নিয়ে নিউজ করেছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও আলোচনা চলছে। সব মিলিয়ে এক প্রকার চাপে পড়ে পুলিশ বিষয়টা নিয়ে দ্রুত তদন্ত চালাতে বাধ্য হয়েছে। আশা করছি, খুব তাড়াতাড়ি পুলিশের ফাইনাল রিপোর্ট পাওয়া যাবে।
***
অদিতির খুব জ্বর এসেছে। শরীরটাও দূর্বল। দুপুরে অল্প একটু খাবার খাইয়ে ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। এখন ঘুমুচ্ছে। ডাক্তাররা বলেছেন একটা সাইকোলজিক্যাল ট্রামার মধ্যে আছে মেয়েটি। কিছুদিন বিশ্রাম নিলে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
তবে আমার ধারণা পুরোপুরি রিকভার করতে অনেক সময় লাগবে অদিতির। একজন মানুষ খুন হয়ে গেছে তার হাতে, বিষয়টা মাথা থেকে সহজে দূর হবে না! একটা বিখ্যাত গান আছে- “মানুষ মানুষের জন্যে! জীবন জীবন জন্যে!” কিন্তু সব সময় জীবন জীবনের জন্যে হয় না। কখনো কখনো জীবনে এমন দূর্ভাগ্য নেমে আসে, যখন নিজে বাঁচার জন্য অন্যের জীবন কেড়ে নিতে হয়। অদিতি তেমনই এক দূর্ভাগ্যের শিকার।
কলিং বেলের আওয়াজ হলো। এই দুপুরবেলা কে এলো?
আমি লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে দেখলাম ইন্সপেক্টর আমান দাঁড়িয়ে আছে। ইউনিফর্ম পরা নেই, সাধারণ শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট। চোখে আবার সানগ্লাস লাগিয়েছে!
দরজা খুলে দিলাম। ইন্সপেক্টর আমাকে দেখে হাসলো। “হ্যালো, রিমন সাহেব। কেমন আছেন?”
“মোটামুটি। আপনি এই সময়ে?”
“তদন্তের কাজে আসিনি। আসলাম এমনিই আপনাদের সাথে একটু সৌজন্য সাক্ষাৎ করার জন্য।”
আমি দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালাম। ইন্সপেক্টর ভেতরে ঢুকলো।
ড্রয়িং রুমে এনে একটা সোফা দেখিয়ে বললাম, “বসেন।”
ইন্সপেক্টর বসার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার স্ত্রী কোথায়?”
“ঘুমুচ্ছে। ওর শরীরটা ভালো না। ডাকা লাগবে?”
“না না! সমস্যা নেই। আপনার সাথেই কথা বলতে এসেছি।”
“জি বলুন।”
ইন্সপেক্টর চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে বুক পকেটে রাখলো। রুমের ভেতর চারিদিকে তাকাচ্ছে। কিছু বলছে না।
আমি একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, “সরি, চা-কফি কিছুই দিতে পারছি না। আমি আবার এসব বানাতে পারি না। অদিতিই বানিয়ে খাওয়ায়।”
“লাগবে না।” মাথা নাড়লো ইন্সপেকটর আমান। “একটা সিগারেট ধরানো যাবে?”
“সিওর।” আমি অনুমতি দিলাম।
ইন্সপেক্টর আমান পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করলো। আমি একটা অ্যাশট্রে এনে তার সামনে সেন্টার টেবিলের উপর রাখলাম। সে আমাকে একটা সিগারেট অফার করলো। আমি না-বোধক মাথা নাড়লাম।
“স্মোক করেন না?” ইন্সপেক্টর জিজ্ঞেস করলো।
“করি, এখন ইচ্ছে করছে না।”
ইন্সপেক্টর বকবক করে এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে বললো, “শুনুন রিমন সাহেব। ভণিতা আমার পছন্দ না। যা বলার সরাসরিই বলি- আপনার স্ত্রী যে লোকটিকে খুন করেছে, সে ডাকাত নয়। একজন ভাড়াটে খুনী”।
আমি চমকে উঠলাম ভীষণভাবে। “কি বললেন?”
“যা বলেছি আপনি স্পষ্টই শুনেছেন।” সিগারেটে আরেকটা টান দিলো ইন্সপেক্টর আমান। আবার ধোঁয়া ছেড়ে বললো, "পিস্তলটা দেখেই আমার সন্দেহ হয়। সেমি-অটোমেটিক গ্লক নাইনটিন। এমন পিস্তল চোর-ডাকাত পাবে কই? তাদের কাছে থাকে মান্ধাতা আমলের জিনিস। অনেকক্ষেত্রে বুলেটও থাকে না ম্যাগজিনে, ভয়ভীতি দেখানোর জন্য সাথে রাখে। ঠিক মতো পিস্তল চালাতে পারে কি না সন্দেহ। কিন্তু খুন হওয়া লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে ঝানু মাল।”
“অদিতিতে খুন করার জন্য খুনী ভাড়া করবে কে? কেনই বা করবে?”
“কেন করেছে সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে বলি কে করেছে…” সিগারেটে আরেকটা সুখটান দিলো ইন্সপেক্টর। “লোকটার সাথে পাওয়া মোবাইলের ব্রাউজার হিস্টোরি ঘেঁটে একটা ডার্ক ওয়েবের ওয়েবসাইটের অ্যাড্রেস পাওয়া গেছে। আই-ওয়ান্ট-টু-কিল। ঐ ওয়েবসাইটে তার কাছে খুনের অর্ডার আসে। অর্ধেক পেমেন্ট পাওয়ার পর সে খুন করে। খুনের পর বাকি পেমেন্ট নেয়। পুরো বিষয়টা হয় অনলাইনে। রেকর্ড অনুযায়ী লোকটা এখন পর্যন্ত ৩১ টা খুন করেছে।”
ইন্সপেক্টর আমানের কথা শুনে আমার চোখ কপালে উঠলো।
“৩২ তম খুনের অর্ডার এসেছিলো- আপনার স্ত্রী অদিতিকে খুন করার জন্য। আইপি অ্যাড্রেস ট্রেস করে দেখা গেলো অর্ডারটা এসেছিলো অ্যামেরিকা থেকে। আসলে ওটা ছিলো ফেইক ফ্লোটিং অ্যাড্রেস, বুঝতে পারলাম বাংলাদেশে বসেই কেউ অর্ডার করেছে। ফ্রি ভিপিএন ইউজ করলে যা হয় আর কি! আমাদের টেক এক্সপার্টরা সহজেই লোকাল আইপি ট্র্যাক করে ফেললো। তারপর আইপির অ্যাগেইন্সটে ডিভাইসের ইএমইআই নাম্বার বের করা হলো। দেখা গেলো অর্ডারটা আপনার ফোন থেকেই এসেছে!”
স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম আমি।
“এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কে খুনী ভাড়া করেছিলো?” বিশ্রী ভঙ্গিতে মিটি মিটি হাসছে ইন্সপেক্টর আমান। “এবার আসি আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নে- কেন ভাড়া করেছিলো? ওয়েল, এটা বের করতেও খুব একটা অসুবিধা হয়নি। আপনার স্ত্রীর সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করতেই বের হয়ে গেলো সে আসলে পরকীয়ায় লিপ্ত ছিলো। সম্ভবত আপনি বিষয়টা ধরে ফেলেন। আর তাই…”
“হ্যাঁ, তাই!” আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। “জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছি ওকে। সারাদিন পরিশ্রম করি দুজনের ভবিষ্যতের জন্য। আর ও কি না প্রেম করে বেড়াচ্ছে পর-পুরুষের সাথে? আমি এটা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারি না!”
“আর সেজন্যই কিলার হায়ার করেছেন!” সিগারেট খাওয়া শেষ ইন্সপেক্টরের। অ্যাশট্রে-তে চেপে আগুন নিভিয়ে রেখে দিলো। “প্ল্যানটা খুব ভালো ছিলো বলতে হবে। আপনি বাইরে যাবেন, কিলার আসবে। সে অদিতিকে খুন করে, ঘর থেকে কিছু গহনা আর টাকা চুরি করে পালাবে। মনে হবে ঘরে ডাকাত ঢুকে অদিতিকে মেরে টাকা-পয়সা-গহনা নিয়ে পালিয়েছে। কেউ সন্দেহই করবে না যে এসবের পেছনে আপনার হাত আছে! কিন্তু দাবার ছক উলটে গেলো। শিকার শিকারিকে মেরে ফেললো!”
“এখন কি চান আপনি?” আমি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললাম। “আমাকে গ্রেফতার করতে চান?”
“সেটা করলে তো ইউনিফর্ম পরে পুলিশ ফোর্স নিয়েই আসতাম।" ইন্সপেক্টর হাসিটা ধরে রেখেছে। "অ্যাটেম্পট টু মার্ডার কেইসে আপনাকে গ্রেফতার করা উচিত। কিন্তু আপনার কারণে সমাজের উপকারই হয়েছে। ৩১টা খুন করা একটা লোক মরেছে। তাই আর ওসব ঝামেলায় যাচ্ছি না।”
“তাহলে কেন এসেছেন?”
“বলতে পারেন, সাবধান করতে।” সংক্ষেপে উত্তর দিলো ইন্সপেক্টর।
“আবার যেন স্ত্রী-কে খুন করার চেষ্টা না করি?”
ইন্সপেক্টরের ঠোঁটে আবার সেই অদ্ভুত হাসিটা ফিরে এলো। গা জ্বলে যাচ্ছে আমার।
“রিমন সাহেব। আপনি বড্ড বোকা। লাশটা কোথায় পড়েছিলো মনে আছে?”
আমি ভ্রু কুঁচকে রেখে বললাম, “দরজার সামনেই।”
“আপনি বলেছেন ১০ মিনিটের মধ্যে ফিরবেন। ১০ মিনিটের মধ্যেই কলিং বেল বাজলো। আপনার স্ত্রী ভাবলো আপনি এসেছেন। তাই লুকিং গ্লাসে না দেখেই দরজা খুলে দিলো। আমাকে একটা জিনিস বলেন তো? স্বামী বাড়ি ফিরলে স্ত্রী কখনো ছুরি হাতে দরজা খুলে দেয়?”
ভীষণভাবে চমকে উঠলাম আমি! আসলেই তো! খুনটা হয়েছে ঠিক দরজার সামনে। অদিতি কেন ছুরি হাতে দরজা খুলতে যাবে? তাহলে কি অদিতি আমাকে খুন করার জন্যই ছুরি হাতে দরজা খুলেছিলো? আমি এসেছি ভেবেই ঐ কিলারকে খুন করে ফেলেছে!
আমার মাথাটা ঘুরে উঠলো। ঠিকভাবে চিন্তাও করতে পারছি না! একটু আগে অদিতিকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছি। লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে আছে বিছানায়! কে বলবে তার মাথায় নিজের স্বামীকে খুন করার চিন্তা ঘুরছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। পায়ে পায়ে বেডরুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি বালিশ চাপা দিয়ে অদিতিকে মেরে ফেলি!
“কই যাচ্ছেন রিমন সাহেব?” ডাক দিলো ইন্সপেক্টর আমান। “একটা বিষয় তো এখনও আপনার জানা বাকি!”
আমি থামলাম। “কি বিষয়?”
“আপনার স্ত্রী কার সাথে পরকীয়া করছিলো জানতে চান না?”
আমি উল্টো ঘুরে তাকালাম।
ইন্সপেক্টর আমানের হাতে একটা পিস্তল। আমার বুকে নিশানা করে রেখেছে। ট্রিগারে আঙুল। ঠোঁটে খেলা করছে ঐ অদ্ভুত বিশ্রী হাসি!
Writer:- নাজিম উদ দৌলা