সেদিন নিজেকে ওই মানুষরূপী হায়েনাদের হাত থেকে বাঁচাতে পারি নি। ওরা দৌড়ে আমাকে ধরে ফেলে।একসাথে চারটা ছেলের শক্তির সাথে আমি পেরে উঠি নি।সারারাত আমাকে খুবলে খেয়েছিল ওরা। তারপর যখন ভোর হয় তখন আমাকে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে যায়।তারপর আর আমার মনে নেই। প্রচন্ড ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি আমি। বাড়ির লোকেদের কাছে শুনেছি রাস্তার পাশ থেকে
আমার ধর্ষিত দেহটা খুঁজে পেয়েছে।এরপর শুরু হয় আমার জীবনের অন্যরকমের গল্প। আমার নামের সাথে যোগ হয় ধর্ষিতার ট্যাগ। আমার শরীরে ওই পশুগুলো এতো পাশবিক নির্যাতন চালায় আমি প্রায় একমাসের মতো অসুস্থ ছিলাম। বড় মামা- ছোট মামা অনেক টাকা খরচ করে চিকিৎসা করে সুস্থ করে আনে। ধর্ষকের নামে মামলা করেও তেমন লাভ হয় না। আমাদের সমাজে ধর্ষকদের শাস্তি হয় না,কিন্তু
সমাজের মানুষদের কথার আঘাতে ধর্ষিতারা প্রতিদিন বারবার মৃত্যুর সমতুল্য যন্ত্রণা সহ্য করে।
আমার জীবনটা হয়ে গেছে সকলের জীবনের চেয়ে একবারে আলাদা। কোন মেয়ে আমার সাথে এখন আর মিশে না।সকলের ধারনা আমিই খারাপ মেয়ে।
এমনকি আমার জন্য ঝুমাআপুর বিয়েটাও ভেঙে যায়।পাত্রপক্ষ সরাসরি জানিয়ে দেয়, ধর্ষিতা পরিবারের সাথে তারা কোন আত্মীয়তা করতে চায় না।ঝুমা আপুর বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় মামি এবারে মুখ খোলেন।অবশ্য তার দোষ আমি দেই না কারন এতো ভালো সমন্ধটা হাতছাড়া হলে যে কেউ রাগ করবে।কিন্তু আমার যে কিছুই করার ছিল না।কেউ তো আর নিজের ইচ্ছায় ধর্ষিত হয় না।মামি আমাকে আর মাকে নিয়ে মুখ দিয়ে যা নয় তাই বলেছিল। এতো কুরুচিপূর্ণ কথা মানুষ বলতে পারে আমার জানা ছিল না। সেদিন মা মামির কথা শুনে আমাকে ভীষণ মেরেছিল।আমাকে মা মারতে মারতে বলেছিল, তুই কেন তোর পোড়ামুখ নিয়ে ফিরে এলি? মরে যেতে পারলি না।তুই মরলে তো আমিও বাঁচতাম।তোর ভাইকে গলা টিপে মেরে আমি নিজেও না হয় গলায় দড়ি দিতাম।কেন মরলি না? আর কতদিন অন্যের বোঝা হয়ে থাকব?
আশেপাশের সকলের কথা, মামির কথা,মায়ের কথা
সকলের কথা শুনে বুঝতে পারলাম আমি মরে গেলেই ভালো হতো। সকলের কথা শুনে আমার নিজেরও জীবনের প্রতি ঘৃণা চলে এলো। অভিমান হলো এই পৃথিবীর ওপর, এই সমাজের মানুষগুলোর ওপর,যারা ধর্ষিত অসহায় মেয়েগুলোকেই সকল দোষ আরোপ করে। অভিশপ্ত জীবনটাকে আর রাখতে চাই না।মরে গিয়ে সবাইকে শান্তি দিতে চাই। ছোট মামাদের ঘর থেকে চুরি করে ইঁদুরের বিষ নিলাম।ঘরে গিয়ে ছোট্ট একটা চিঠি লিখলাম।
ভয়ে ভয়ে হাতে থাকা বিষ মুখের সামনে নিলাম।চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়ছে, আত্মহত্যা করা মহাপাপ।যেখানে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনটাও অনিশ্চিত। ****
.....
এতোটুকু পড়ার পর পরের পৃষ্ঠা ভয়ে আর পড়লাম না। সুইসাইড করার চেষ্টার ঘটনাটুকু পড়ে আমার গায়ের লোম দাড়িয়ে গেছে। আমি ডায়েরিটা রেখে দিলাম। কেন জানি আমার প্রচন্ড ভয় করছে আমার! কেনো মেয়েটা সুইসাইড করার মতো এতবড় দুঃসাহস করলো?
চোখটা বন্ধ করে আমি যেন মেয়েটার পুরো জীবন কাহিনিটা আবার স্মরণ করলাম।আমার মনে হচ্ছে মেয়েটার জীবনের কাহিনিগুলো আমার সামনেই সব ঘটেছে আর আমি জীবন্ত সব দেখতে পাচ্ছি। এর মাঝেই মায়ের ডাক শুনতে পেলাম। মা আমাকে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকছে।খাওয়ার টেবিলে বসে খেতে পারছি না, বারবার ডায়েরির মেয়েটার কথা মনে পড়ছে। না আমি মেয়েটাকে চিনি, আর না আমি মেয়েটার নাম জানি।খাওয়ার টেবিলে আমাকে এমন চুপচাপ দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন,
--কিরে রিনি? কি হয়েছে তোর,শরীর অসুস্থ লাগছে?
--হ্যাঁ..মা
বলে আমি খাওয়া রেখেই আমি নিজের রুমে চলে এলাম। ডায়েরিটার
শেষ পর্যন্ত না পড়া অবধি আমার শান্তি নেই।তবে এবার ডায়েরিটা হাতে একটু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। ডায়েরিটা বেশ মোটা।শেষের পৃষ্ঠার কোণায় একটু বড় করে লিখা
"নীলা আহমেদ + তামিম হাসান " নিচে একটা লাভ একে লাভের ভিতরে N+T লিখা। আমি বুঝতে পারলাম যে ডায়েরির মালিকের নাম নীলা আহমেদ।
তামিম হাসান হয়ত তার বয়ফ্রেন্ড কিংবা স্বামী। যাইহোক, ডায়েরিটা খুলে আবার পড়া শুরু করলাম।
**** বিষ মুখে দিতে যাব এমন সময় মামা এসে আমাকে কষে একটা থাপ্পড় মারলেন। মামা এতো জোরে থাপ্পড় দিলেন যে আমার হাত থেকে বিষটুকু পড়ে গেল আর আমিও ফুপিয়ে কেঁদে ফেললাম। আমার খেয়াল হলো আত্মহত্যা করার আগে দরজাটা আটকাতেই ভুলে গেছি। মামার সাথে ঝুমা আপুও এসেছে। মামা আমাকে এবারে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,
-- নীলা, রাগের বশে তোমাকে থাপ্পড় মেরে ফেলেছি কিন্তু তোমার ভালো চাই বলেই। থাপ্পড় খেয়ে তোমার রাগ হতে পারে এটাই স্বাভাবিক। ঝুমার কাছে জানতে পারলাম আজকে তোমাদেরকে ঝুমার মা বেশ খারাপ কথা বলেছে।রেশমাও তোকে অনেক কিছু বলেছে।শোনো নীলা মা রেশমা তোমার মামির সাথে অভিমান করে তোমাকে কথাগুলো শুনিয়েছে তাই বলে তুমি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিবে। আজ যদি তোমার কিছু হয়ে যেত তাহলে তোমার মায়ের অবস্থা কি হবে?তুমি ভাবতে পারছো। তুমি তোমার মায়ের ভরসা,আশার আলো। সেই কালোরাতের ঘটনা ভুলে তোমাকে পড়ালেখা শিখে অনেক বড় মানুষ হতে হবে,তারপর ওদের মত সব নরপশুদের শাস্তি দিতে হবে। আর কখনো আত্মহত্যা করার চেষ্টা করবে না। ঝুমা যদি না দেখতো তুমি রোমানের ঘর থেকে ইদুরের বিষ চুরি করছো তাহলে এখন কি হতো ভাবতে পারছো?তুমি মন দিয়ে একটা কথা ভেবে দেখো,
আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে ওই নরপশুদের শাস্তি দেওয়ার জন্য। না হলে ওই পশুগুলো তোমাকে চাইলে মেরে ফেলতে পারতো।আমার বিশ্বাস আল্লাহ তোমাকে দিয়ে বড় কিছু করাবেন বলে তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এখন রেস্ট নাও, আমরা কিছুক্ষন পর আসছি।"
বলে ঝুমা আপু আর মামা চলে গেলেন।
মামার কথাটা শুনে আমার মনে হলো আসলেই তো,প্রায়ই পত্রিকায় পড়ি ধর্ষণের পর কিশোরী / তরুনীকে মেরে হয়।আল্লাহ নিশ্চয় আমাকে দিয়ে ভালো কিছু করাবেন তাই বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমি এখন থেকে বাঁচবো নিজের জন্য নয়,বাঁচবো আমার মত প্রতিটি অসহায় মেয়েদের হয়ে লড়াই করার জন্য।
আমরা এখন মামার বাড়ির কিছুদূরেই বাসা ভাড়া করে থাকি। মামা অবশ্য আমাদের বাসা ভাড়া নিতে নিষেধ করেছিল কিন্তু মা থাকতে রাজি নয়।আমি কিংবা মা কখনোই চাই নি আমাদের জন্য তাদের ফ্যামিলিতে ঝামেলা হোক। ঝুমা আপুর বিয়ে ভাঙার পর থেকে মামি সামান্য কারনেই মামার সাথে ঝগড়া করতো যার কারন হিসেবে থাকতাম আমি,মা আর না হয় আমার ছোট ভাই রাজু।
বাসা ভাড়া নেওয়ার পর থেকে আমি আবারও টিউশনি পড়ানো শুরু করি।আগে যাদের পড়াতাম,তাদের মধ্যে একজন স্টুডেন্ট আমার কাছে পড়ে।আমার জীবনে আমি সেই স্টুডেন্টের ফ্যামিলির কাছেও ঋনী কারন সেইদিনের ঘটনার পর থেকে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিলেও তারা আমাকে অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করেছে।আবার আমাকেও দ্বিগুণ সম্মানি দেয়। সবকিছুতে ওই ভাইয়া-ভাবী আমার পাশে থাকেন। হয়ে ওঠেন রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও আপনজন।
জীবন চলছে আপন গতিতে....
এখন আমার জীবনের মূল লক্ষ্য সমাজে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা যাতে রাস্তায় বেরোলে কেউ বলতে না পারে ধর্ষিতা নীলা আহমেদ যাচ্ছে।
সামনে এইচএসসি পরীক্ষা তারপর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা। আমি কোচিং সেন্টারের ক্লাসে এসেছি
আমার ফোনে অনেকগুলো কল আসছে,ফোন ভাইব্রেট মোডে থাকায় বেশ বুঝতে পারছি কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস থাকায় কলটা রিসিভ করলাম না।
কিন্তু এতো বার কল করছে যে শেষমেষ বিরক্ত হয়ে ফোনটা ধরলাম। ফোনটা ধরে যা শুনলাম তা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে.....
আমি কোচিং সেন্টারের ক্লাসে এসেছি
আমার ফোনে অনেকগুলো কল আসছে,ফোন ভাইব্রেট মোডে থাকায় বেশ বুঝতে পারছি কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস থাকায় কলটা রিসিভ করলাম না।
কিন্তু এতো বার কল করছে যে শেষমেষ বিরক্ত হয়ে ফোনটা ধরলাম। ফোনটা ধরে যা শুনলাম তা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে।
ফোনটা রিসিভ করার পর ওই প্রান্ত থেকে একটি পুরুষ কন্ঠে শুনতে পেলাম,
-- আপনার মা ট্রাক চাপায় গুরুতর আহত হয়েছে। অনেক ব্লিডিং হয়েছে যার কারনে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। স্হানীয় সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে আপনি দয়া করে তাড়াতাড়ি আসুন।
আমি একমুহূর্ত দেরী না করে হাসপাতালে ছুটে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম ছোট মামা, ঝুমা আপু কাঁদছে আর ছোট মামি তাদের সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে। তাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম আমার ছোট্ট প্রিয় ভাইটা আর দুনিয়ায় নেই। কথাটা শুনে আমার মনে হচ্ছে কেউ আমার বুকটা চিরে ভেতর থেকে কলিজাটা টেনে ছিড়ে ফেলছে।আমি যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাদঁতে পারছি না। কীভাবে কি হয়ে গেলো এতটুকু সময়ের মধ্যে?আমি বিশ্বাসই করতে পারছি যে আমার কলিজার ভাইটা আর নেই। আমি ঝুমা আপুর দুই বাহু ধরে জিজ্ঞেস করলাম,
--তুমি মিথ্যা বলছো তাই না ঝুমা আপু?আমার ভাইটা বেঁচে আছে। ওর শিক্ষা সফর শেষে ঠিকই বাড়ি ফিরবে। এতোকিছু কিভাবে হলো, কখন হলো?সকালেই তো রাজুকে টাকা দিলাম ঘুরতে গিয়ে কিছু কেনার জন্য.....
ঝুমা আপু আমার কোনো কথার উত্তর দিল না।আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল।ছোট মামি কান্না আটকে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,
--"তুমি শান্ত হও নীলা।আগে আমার কথা শোনো...
শিক্ষা সফরে যাওয়ার সময় রাজুদের বাস খাদে গিয়ে পড়ে সেখানেই স্পট ডেড।তারপর সেই খবর পেয়ে তোমার পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছিলেন রাস্তার গাড়ি খেয়াল না করেই। আর একটা ট্রাক এসে আপাকে চাপা দেয়।তোমার বড় মামা আর মামাতো ভাই মাহবুব রাজুর লাশ আনতে গেছে। "
আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বললাম,
--"মামি,,রাজুর মৃত্যুর জন্য, মায়ের এই অবস্থার জন্য দায়ী একমাত্র আমি। মা ওকে ঘুরতে যেতে নিষেধ করেছিল। ওর মন খারাপ হবে বলে আমি টাকা দিয়ে ঘুরতে যেতে দিয়ে ওকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি। আজ যদি না যেত তাহলে ও এখন বেঁচে থাকতো আর মায়েরও কিছু হতো না।"
--"এখন যা হওয়ার হয়েছে মা...
এখানে কারো হাত নেই,সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তোমার এখন শক্ত হতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না।"
.
.
.
মায়ের অবস্থার উন্নতি নেই।বড় মামা আর মাহবুব রাজু’র লাশ নিয়ে এলো।রাজুর বিকৃত লাশ দেখে আমি আতকে উঠলাম। সবকিছু সম্পন্ন করে দাফন করা হলো।কিন্তু আমি যেন ঘরের ভেতর ওর আওয়াজই শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে ও হাঁটছে,আবার আমার সাথে ঝগড়ার কারন খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি ওর জামাকাপড় নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না ওকে যে জীবনে আর কখনো দেখব না।
.....
দিন যতো যাচ্ছে ততই বুঝতে পারছি জীবনটা যে কতো কঠিন! আমাদের মতো ফ্যামিলির মেয়েদের জীবনে হয়ত সুখ নামক কথাটি লিখা নেই।রাজুুর মৃত্যুর ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে মায়ের মৃত্যু হলো। টানা পনেরো দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে করতে মা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল সেদিন তাদের সাথে আমারও মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। পরিবার হারিয়ে আমার মনের যে কি অবস্থা হয়েছিল বলে বোঝানো সম্ভব নয়। হারানোর বেদনা সেই বোঝে যার হারায়। প্রতিটা দিন আমার কাঁদতে কাঁদতে পার হতো। বাড়িটা ছেড়ে দিলাম।মামা তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল আমিই যাই নি।
স্টুডেন্টের বাবা-মা মানে আলভি ভাইয়া আর ভাবীর সহযোগিতায় আমি মেয়েদের হোস্টেলে গিয়ে উঠলাম। পরিবার হারিয়ে আমি হয়ে গেলাম একা..
সম্পূর্ণ একা.....
পরিবারের শোক কাটিয়ে পড়াশোনা করতে পারি নি। মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় আমি চান্স পেলাম না। আরো ভেঙে পড়লাম। এবার নিজেকে
শক্ত করলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলাম।একমাস কঠিন পরিশ্রম করলাম।
অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেলাম। আনন্দে মনটা ভরে গেল রেজাল্টটা দেখে।
কিন্তু আমার আনন্দ, আমার খুশি ভাগ করার মত কেউই নেই। মা থাকলে ভীষন খুশি হতেন।আমার রেজাল্টে মামা-মামি,আলভি ভাইয়া, ভাবী সবাই খুশি হলেন।
ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পর থেকেই ভালো করে পড়াশোনা শুরু করে দিলাম।আমাকে যে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হতেই হবে। যাতে কেউ আমাকে আর ধর্ষিতা মেয়ে বলতে না পারে।আমার দুচোখে হাজারো স্বপ্ন। আমার ইচ্ছে আমার নিজের একটা সংস্থা থাকবে যেখানে এতিম, অসহায় মেয়েগুলোকে লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের পায়ে দাড়া করানো।
.
.
.
ভার্সিটির লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করতে গিয়ে একটা ছেলেকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। ছেলেটা আমার সিনিয়র তবে কোন ইয়ারে পড়ে তা জানি না।ছেলেটার নামটাও জানি না। লাইব্রেরীতে প্রতিদিন এসে পড়াশোনা করে।আমি প্রায়ই তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
ছেলেটা উজ্জ্বল শ্যামবর্নের, হাসি দিলে একগালে টোল পড়ে যা দেখে আমি প্রথম দিনেই পুরো ফিদা হয়ে গেছি।
আজকেও বইয়ের ফাঁকে একটু তার দিকে তাকালাম। সেও আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল।চোখে চোখ পড়ায় আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। লজ্জায় আমি তাড়াতাড়ি সেখান থেকে উঠে চলে আসলাম। তারপর হোস্টেলের রুমে এসে ফেসবুকে ঢুকে দেখলাম ছেলেটা আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। আমি অবাক হলাম ছেলেটা আমার নাম জানলো কিভাবে? তবে আমি খুশি মনে হয়ে একসেপ্ট করে ফেললাম।ছেলেটার নাম তামিম হাসান। পদার্থবিজ্ঞানের চতুর্থ বর্ষে পড়ে।দেখে যথেষ্ট নম্র-ভদ্র মনে হয়। কিছুক্ষন পর তামিম নামের ছেলেটা আমাকে ম্যাসেজ দিল,
-- কেমন আছো?
আমি রিপ্লাই দেওয়ার আগেই সে আবার ম্যাসেজ দিল, " প্রতিদিন তুমি আমাকে বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে দেখো কেনো?"
তার ম্যাসেজটা পড়ে আমি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম। আমি তাকে লিখলাম, "কই না তো"
--" আর মিথ্যা বলতে হবে না,আমি খেয়াল করে দেখেছি। আজকেও তো আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে..
তার ম্যাসেজের ধরন দেখে মনে হচ্ছে তার সাথে আমার কতদিনের পরিচয়? আমি তাকে "সরি,আর আপনার দিকে তাকাবো না" লিখে সেন্ড করলাম।
--আর এই সামান্য ব্যাপারে সরি বলতে হবে না,আমি জাস্ট মজা করলাম।কালকে থেকে আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে হবে না।আমাকে সরাসরি দেখো।
ম্যাসেজটা দেখে আমি একটা হাসির ইমোজি পাঠালাম।এভাবেই আমাদের পরিচয় হলো। প্রথম দিকে টুকটাক কথাবার্তা হতো, ধীরে ধীরে আমাদের
সম্পর্কটা বন্ধুত্বের চাইতেও বেশি হয়ে উঠল। দুজন দুজনের চোখের ভাষা বুঝলেও কখনোই কারো ভালোবাসি কথাটি বলা হয়ে ওঠে নি। আমার পরিবারের কথা,আমার স্বপ্নের কথা জানতো তাই আমার স্বপ্ন পূরনের জন্য
আমাকে পড়াশোনার ব্যাপারে অনেক হেল্প করতো। তবে তামিমের সাথে আমার সম্পর্ক শুরু হওয়ার পর থেকে আমি পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী হতে পারতাম না।সারাক্ষণ আমার কল্পনায় তামিম থাকতো। কিন্তু তামিম আমায় সবসময় বলতো,
কল্পনায় কখনো জীবন চলে না আমাকে জীবনে সফল হতেে হলে অনেক পরিশ্রমী হতে হবে। নিজের যোগ্যতায় সমাজে মাথা উচু করে বাঁচতে হবে। ওর
আমি কথাগুলো শুনতাম ঠিকই মানার চেষ্টা করতাম না। চোখে তখন হাজারো রঙিন স্বপ্ন দেখতাম।
.
.
.
দিন যতোই যাচ্ছে আমাদের বন্ধুত্ব ততই গভীর হচ্ছে। আমার একদিন মনে হলো আমার কালো অতীত সম্পর্কে তামিমকে কিছু বলা উচিত। কারন কাউকে কখনো ঠকাতে চাই না।আমি ওর সাথে দেখা করে আমার জীবনের কালো অধ্যায় সব খুলে বললাম। তামিম মাথা নিচু করে সবকিছু শুনলো তারপর হাত দুটো ধরে বলল,
--আমি জানি নীলা একটা মেয়ের ধর্ষিতা হওয়ার পেছনে তার কোনো দোষ থাকেনা তোমারও নেই।কিন্তু আমরা,আমাদের সমাজের মানুষগুলো অসহায় মেয়েটাকেই সব দোষ দিয়ে থাকি।
যাইহোক, আমি তোমার অতীত নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না।আমি এখন যেমন তোমার পাশে আছি ভবিষ্যতেও তেমন তোমার পাশে থাকতে চাই।"
তামিমের কথাগুলো শুনে আমার খুব ভালো লেগেছিল। মনে হচ্ছিল আমি ভুল মানুষকে ভালোবাসি নি।
তবে আমার মনের কথা ধারণাটা ভুল প্রমানিত হয়েছিল তার দুইদিন পরে। সেদিন আমার ফাস্ট ইয়ারের ফাইনাল রেজাল্ট দিয়েছিল। রেজাল্ট দেখে আমি নিজেই প্রচন্ড শকড হয়েছিলাম।আমার দুই সাবজেক্টে ফেল আসে। আমার যেহেতু দুনিয়ায় আপনজন বলতে কেউ ছিল না,তাই তামিমের কাছেই আমি আপনজন ভেবে সব শেয়ার করতাম।
তামিমকে ফোনে আমার রেজাল্টের কথা বলতেই ও ক্ষেপে যায়।আর ফোনেই আমাকে বলতে থাকে,
--আমি জানতাম নীলা এমন কিছুই হবে...
আমি বেশ কিছুদিন ধরে তোমাকে খেয়াল করছি যে তুমি আমার প্রতি দিনকে দিন দূর্বল হয়ে পড়ছো।পড়াশোনা ঠিকমতো করো না। শোনো নীলা...
আমি কিন্তু তোমার প্রতি দূর্বল নই।আমি তোমাকে ভার্সিটির জুনিয়র বোন হিসেবে, বন্ধু হিসেবে এতোদিন ভেবেছি এছাড়া অন্য কিছু নয়।
আমি ওর কথা শুনে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছালাম। হয়ত ও আমাকে কখনো মুখে বলে নি আমাকে ভালোবাসে কিন্তু আমার প্রতি ওর কেয়ারিং দেখে বুঝতে পারতাম যে ও আমাকে ভালোবাসে।আমি তামিমকে সরাসরি বললাম,
--তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?
-- এখানে আমার ভালোবাসা না বাসার কথা বলছি না।আমি বলেছি তুমি আমার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছো, যা তোমার লেখাপড়ার ওপর খারাপ প্রভাব ফেলছে। ভালোমতো পড়াশোনা করো।
চলবে...
Writer:- নিঝুম