ত্রিশ-চল্লিশজন উগ্র ছেলে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমি হলে কী করতাম? সুন্দর করে যেভাবে এসেছি, সেভাবে চলে যেতাম সেখান থেকে। যেন পরিবেশটা একদম সুন্দর। কোনো হইচই নেই।
আর আমার বোন কী করেছে?
— যারা হিংস্রভাবে তার দিকে এগিয়ে এসেছিলো, তাদের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। যেন দৃষ্টি দিয়েই ভস্মীভূত করে ফেলবে ওদের।
— পিছু তো হটেই নি, উল্টো তাদের স্লোগানের প্রতিবাদে নিজের দ্বীনের স্লোগান দিয়েছে।
— অবস্থা এমন হয়েছিলো যে কলেজ কর্তৃপক্ষ এসে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দিয়েছিলো, সে নিজ থেকে সরে যায় নি।
একটু আগে এনডিটিভিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সে বলেছে, ভয় পাওয়া তো দূরের কথা— তার মনে একটু দুঃশ্চিন্তাও আসে নি যে তার সাথে খারাপ কিছু হতে পারে।
যারা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না—
ভারতের কর্ণাটকে রিসেন্টলি হিজাব পরে ক্লাসে আসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রথম দিকে যেসব মেয়েরা হিজাব পরতো, তাদের ক্লাসে আসতে না দিলেও ক্যাম্পাসে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়েছিলো। যার কারণে সেসব বোনেরা ক্লাসে ঢুকতে না পারলেও অন্তত ক্লাসের বাইরে বসে ক্লাস করতে পারতো।
পরবর্তীতে তাদের ক্যাম্পাসে প্রবেশেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এটি ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ভারতের সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বিধায় ভারতের মিডিয়ায় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মিডিয়ায় এ ঘটনাটি অনেক আলোচিত হয়। কেবল বাংলাদেশের মিডিয়াতেই এ ঘটনাটি তেমন গুরুত্বই পায় নি। সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রতিবেশি দেশের নারীশিক্ষার ব্যাপারে যে মিডিয়া ঘুমে থাকে, তাদের হিসেব থাকে না— তাদেরকেই আবার মুসলিমপ্রধান এক দেশের নারীশিক্ষার ব্যাপারে খুব সরব দেখা যায়।
ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, ভারতের প্রত্যেক নাগরিক তাদের ধর্মের আবশ্যক পোশাকগুলো পরিধানের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে সর্বক্ষেত্রে। এ কারণে শিখরা পাগড়ি পরার ক্ষেত্রে, খ্রিস্টানরা ক্রস পরার ক্ষেত্রে, মুসলিম মেয়েরা হিজাব পরার ক্ষেত্রে, হিন্দু বিবাহিত মেয়েরা মঙ্গলসূত্র পরার ক্ষেত্রে— পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে। কারণ, এগুলো তাদের ধর্মের আবশ্যিক পোশাক। কাগজে-কলমে কারো অধিকার নেই, তাদের বাধা দেয়ার।
যাই হোক, যা বলছিলাম— মিডিয়ার কভারেজের কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষ বেশ চাপের মুখে পড়ে। তাদের চাপ থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে হিন্দুত্ববাদী সাপোর্টাররা। তারা দাবি তুলে, যদি মুসলিম মেয়েরা হিজাব পরে ক্লাসে আসে— তাহলে হিন্দু ছেলেমেয়েদেরকেও গেরুয়া স্কার্ফ পরে ক্লাসে আসতে দিতে হবে।
যদিও হিন্দুধর্ম অনুযায়ী, সবসময় গেরুয়া স্কার্ফ পরা বাধ্যতামূলক নয়। তাই তাদেরকে এ পোশাক পরার অনুমতি দেয়ারও সুযোগ নেই কলেজ কর্তৃপক্ষের। তবুও হিন্দুত্ববাদী ছেলেমেয়েরা গেরুয়া স্কার্ফ পরে কলেজ ক্যাম্পাসে শোডাউন দেয়। মুসলিম মেয়েরাও হিজাব পরে এই বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ জানায়।
মুসলিম মেয়েদের পূর্ণ সমর্থন জানায় মুসলিম ও দলিত ছেলেরা। যখন মেয়েরা প্রতিবাদ করছিলো, তখন মুসলিম ছেলেরা ক্যামেরার সামনে না এলেও পেছনে থেকে মুসলিম মেয়েদের গেরুয়া সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলো।
একসময় মিডিয়ার চাপের মুখে কর্ণাটক সরকার কলেজ কর্তৃপক্ষকে মুসলিম মেয়েদের ক্যাম্পাসে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার আদেশ দেয়। তবে শর্ত হচ্ছে, তাদের আলাদা ক্লাসরুমে বসতে হবে। অর্থাৎ, তারা এতোই "নিকৃষ্ট" যে সবার সাথে ক্লাস করার উপযুক্ত না— মেসেজটা অনেকটা এরকমই।
মেয়েরা আলাদা ক্লাসে প্রবেশের সুযোগ পেলেও তাদের প্রতিনিয়ত গেরুয়া সন্ত্রাসীদের দ্বারা হ্যারাসমেন্টের শিকার হতে হচ্ছিলো। তাদের দেখলেই এরা স্লোগান দিচ্ছিলো। আক্রমণাত্মক মন্তব্য করছিলো। অত্যন্ত দুঃখজনক হচ্ছে, এই কাজগুলো যারা করছিলো, তারা ওদেরই সহপাঠী। এদের মধ্যে শুধু ছেলেরা না, মেয়েরাও শামিল ছিলো।
আজকে যে ভিডিওটা ভাইরাল হয়েছে, সেটা এমনই এক দৃশ্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। মেয়েটা হিজাব পরে কলেজ ক্যাম্পাসে ঢোকার সময়ে হিন্দুত্ববাদীদের স্লোগানের মুখে পড়ে। কিন্তু অন্য সবার মতো সে ভয় পায় নি, চুপচাপ চলেও যায় নি। সেও পাল্টা স্লোগান দিয়েছে।
আমাদের এই বোনটার নাম মুসকান। উর্দু 'মুসকান' শব্দের অর্থ হাসি। আমাদের এই বোন আমাদের মুখে হাসি ফোটায় নি, বরং তার সাহসিকতা দিয়ে আমাদের কাপুরষতায় আরেকবার কালিমা লেপন করে দিয়েছে।
আল্লাহ তা'আলা আমাদের এই বোনটিকে কবুল করে নিন। আমাদের অক্ষমতার অজুহাত একপাশে রেখে এই উম্মাহর জন্যে কিছু করার তৌফিক দিন। আল্লাহুম্মা আমিন।
লেখা:- শিহাব আহমেদ তুহিন